শনিবার, এপ্রিল ২০

নির্বাচিত দশ কবিতা : শিমুল সালাহ্উদ্দিন

0

আমাদের প্রেম


আমরা দুজন দুইটি গায়ে থাকি
কথারা সব দিনশেষে রয় বাকি

আর দু’জনা আগুনপোড়া ছাই
বিষমসহ ছাইমাখা ভাত খাই

ছাইমাখাভাত রক্তঝোলে মেখে
অশ্রু লবণ সামান্য দেই তাতে

লোকমা গালে তুলে দেয়ার কালে
বক্র তোমার ঠোঁটের কথা ভাবি

সে ঠোঁট আমায় বকল কতবার
হাসল আমার পাগল আচরণে
অভিমানে ফিরে থাকা ঘাড়ে
বসল কত চুমুর প্রজাপতি

আজকে আমরা দুইটি গায়ে থাকি
কথারা সব দিনশেষে রয় বাকি

আর দুজনায় আগুনপোড়া ছাই
বিষমসহ ছাইমাখা ভাত খাই

ভালোবাসো নাই-বা-বাসো ছাই
আমায় এসে খুন করে যা, রাই।


ক্লাউন


সারাদিন মনে মনে তোর সাথে কথা বলা।
……………একটা পাহাড় জমে যায় কথার,
………………………………….ভেতরে আমার৷
……………………..নাম দেই তুই-পর্বতমালা।
এতো ওজন তার, ঘাড়
নু’তে নু’তে এখন নতজানু আমার
মনে হয়, মাথা নোয়াতে জানে না যারা
তাদের মাথাই আদতে নাই।
তোর সামনে তাই, আবার দাঁড়াতে চাই।
দুই হাত প্রসারিত। বুক আছে। মাথা, নাই।
সমূহ ঘাই-সমেত ডাক পাঠাই।
সমস্ত শরীররন্ধ্রের অস্তিত্বসমেত উঠে আসতে চাই
তুই-পাহাড়ে
……………………………………..এক পা উঠি তো আমি
………………………………………………কয়েক হাজার পা পিছলে যাই।
…………………………………………………………আদতে, লোক হাসাই।।


ঘুরে দাঁড়াবার পদ্ধতি


হাত পা ছুড়ে দিয়ে আকাশ ছুঁতে চাওয়া গাছগুলির মতোই অবিনত আমি। নিচু স্বরে কথা বলতে পারি না বলে আমার প্রিয় এক শিক্ষক বলতেন কবির মতোই কণ্ঠস্বর আমার, উদ্ধত। আপস আমার ধর্ম নয় বলে সুন্দর-যত-ছিল তারা ব্যান্ডেজবাঁধা পা নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে যাচ্ছে নিরুদ্দেশে, আমাকে ফেলে রেখে দোদুল্যমান এক আশ্রমে…

অথচ নিজের অজ্ঞাতসারে যাকে খুঁজছো বৈধব্যের নিভু নিভু শুভ্র স্তব্ধতায়, তার মনোজ হংস কেন উড়ে গেছে নিরুদ্দেশের মানস সরোবরে, জানার ন্যুনতম চেষ্টাও করোনি তুমি! উপেক্ষার পর্দার আড়ালে একটি দুপুর বুকে করে সে ঘুমিয়ে পড়েছে পুকুরধারের কড়ইছায়ায়। ডাকছে আমাকে না লেখা কবিতাটির মতোন।

আমি আহতদেহমন ও ক্ষুব্ধ কিছু হরফের মিছিল নিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগুচ্ছি তার দিকে…আঘাতে আঘাতে রপ্ত করছি ঘুরে দাঁড়াবার পদ্ধতি…


আলাপে, বিস্তারে


ইউটোপিয়ান অরণ্যে ঘুরছে সনখদন্ত শাবকের দল। জলার ধারে হিংস্রতা ঢেলে, পান করে এসে তাদেরই একটা ভেজা গলবিলে থাবা ঝাড়ছে। তাকাচ্ছে তোমার দিকে, চোরাবালির ওপরে দাঁড়িয়ে আছো তুমি, ক্ষয়ে যাচ্ছে বালিতট, ডুবে যাচ্ছে পা।
বাদামি অরণ্যের অন্ধকার চিরে তোমার দেদীপ্যমান চোখের আশায় প্রস্তরবৎ না-পুরুষ না-নারী; দাঁড়িয়ে রয়েছি। দেখছি, সোনার বিন্দু গেঁথে আছে সন্ধ্যাঘাসের ডগায়…


ইরোটিক ডিজঅর্ডার


কেন তাঁর তন্দ্রার
…………………….মোড়ে মোড়ে কেঁদে ওঠে পাপ?
কেনে তাঁর অভিসার-স্বপ্নে
…………………….কাঁদে লাল ডাগর গোলাপ?
কেন তাঁর জঙ্ঘার
…………………….গভীরে এক স্রোত বয়ে যায়?
কেন তাঁর সংসার
…………………….টুকরো টুকরো ভুবনে ছড়ায়?
কেন তাঁর তন্দ্রার
…………………….মোড়ে মোড়ে পাপ কেঁদে ওঠে?
কেন তাঁর শরীর আর
…………………….আশ্লেষেও সাড়া দেয় না মোটে?


জরুরী পার্সেল


আমার খুব ইচ্ছে হয় একদিন নিজের কর্তিত মাথা হয়ে অতি জরুরী পার্সেলের ভেতর করে তোমার বাড়ি যাব। প্রবল আগ্রহে পার্সেল খুলে সম্বিৎ হারিয়ে ফেলা তুমি আমার হাসিমুখ লেগে থাকা কাটা মাথার দিকে বিস্ফোরিতনেত্র হা-মুখে তাকিয়ে থেকে বুঝবে, তুমিহীন একটা আতঙ্কের পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে কেমন লাগে!


সম্পর্কসূত্র


চলো,
শহরের সকল দরোজা খুলে ফেলি আজ
খুলে দিই জানালা সবকটা ঘরের
আলোহাওয়াভাষ প্রচুর এসে ভাসিয়ে
নিয়ে যাক আমাদের সব ধূসর শঙ্কা-মালা
আর দুজন আলাদা পৃথিবীতে চলে না গিয়ে
আমরা থাকি, একসাথে, এই আলাভোলা
ভালো আলোঝরনার নিচে—আর দুরত্ব রাখি।
একে অপরের নাকে নৈকট্যের দড়ি দিয়ে
আটকানো দুরত্ব— যেনে একটা ইঞ্জিনবিকল গাড়িকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরেকটা গাড়ি।
জানোই তো, সম্পর্ক না থাকলে দুরত্ব সমান শূন্য
অর্থাৎ,
…………………………………………সম্পর্ক= নৈকট্য+দূরত্ব
…………………………………………নৈকট্য= সম্পর্ক — দূরত্ব
…………………………………………দূরত্ব = সম্পর্ক — নৈকট্য
ফিরে এসে এই খেলা তুমি সহজেই ভেঙে দিতে পারো।

………………………………..যেও না, চলে যাওয়া আসলে এক সহজ শর্টকাট;
সমুদ্রের থেকে চোখ ফিরিয়ে স্থলের দিকে চাওয়া


বিস্ময়


যখন দক্ষিণমুখে যায় আমার একার নদী, স্রোত ও বহমানতা
তুমি তখন দুডানায় ভর করে উড়াল দিয়েছ উত্তরদিকের আকাশে
ও অন্ধকারে। ভেতরে অনেক ভাঙচুরের বিবরণ নিয়ে জ্যোৎস্নার ম্লান আলোয়
কদম গাছের আড়াল থেকে যে চাঁদ ওঠে আমার ছুটে গিয়ে তাকে
জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লজ্জা ও লানতের অবশশরীর নিয়ে,
বুকে ও শোণিতে অনেক খামচির দাগ নিয়ে
ভিজে ওঠা গণ্ডদেশ নিয়ে, এক অস্তিত্বভর্তি স্থবিরতা নিয়ে
আলুথালু ঠ্যাঙ ও পিচ্ছিলতা নিয়ে, কেবলি গোলাপবাগানের
নিস্তব্ধতা ও আদরের কথা মনে পড়ে…

নদীর জল তখন স্থির, শান্ত। দিগ্বলয়ে হস্তীযুথের মতো চলে যাচ্ছে মেঘখণ্ড।
দূর কাশবনে বাতাসের লীলা…

আমি যে বাঁচবে না, এমন ধারণা অনেকেরই ছিল।


আকাশ মূলত শূন্য


যার যার জানালায় বসে
যৌথ আকাশের মেঘ দেখা দুজনকে আমি চিনতাম।

যার যার জানালায় বসে যৌথ আকাশের মেঘ দেখা
কয়েকজনকে আমি চিনি আদতে, যারা পরে একা একা
আকাশ দেখার পথ বেছে নিয়েছে।
যার যার জানালায় বসে যৌথ আকাশের মেঘ দেখা
একশজনেরও কম মানুষ কী আমি চিনি
যারা আকাশ চিড়ে ফেলেছে ক্রোধে!

অথচ কোটি কোটি একা মানুষকে আমি চিনি,
যাদের কোন যৌথ জানালা নাই, যৌথ আকাশ নাই,
একসাথে বৃষ্টিতে ভেজার অবকাশ দূর-অস্ত, সুযোগই নাই।

তাদের জানালাগুলি বাঁকা।
……………………..তাদের আকাশগুলি একাকীত্ব আঁকা।
তারা খেতে বসে একা একা।
……………………..তারা বৃষ্টি দেখে একা একা।
একা যেতে হবে বলে
……………………..তারা কোথাও বেড়াতে যায় না।

তারা কাজ থেকে ফিরে ঘরে শুয়ে থাকে,
………………………………ছাদের দিকে তাকিয়ে ভাবে
………………….যৌথ আকাশের মেঘ কত সুন্দর!


ঊনমানুষের মৌনালাপ


স্তব্ধতাখচিত মুহূর্তের স্মৃতি বুকে
হুল্লোড়
……….হয়ে বসে আছি।

ফেটে পড়বার অপেক্ষায়।
…………….চীৎকারে।

নাকি সব ভুলে
……….কলার চেপে ধরে বলবো,

“ঠকাতে চেয়েছিলি কেন বল!’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, সাংবাদিক, গবেষক ও গণমাধ্যম পরামর্শক। জন্ম: ১৭ অক্টোবর, ১৯৮৭, ঢাকার উপকণ্ঠে, তুরাগে। পৈতৃক নিবাস গাজীপুরের টংগী থানার মুদাফা গ্রামে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন। সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট ও আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি’র। আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি’র জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন চারটি দলীয় মঞ্চপ্রযোজনা। অন্তর্জালে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলোচিত আয়োজন ‘InতাঁরView with শিমুল সালাহ্উদ্দিন’ এর পরিকল্পক ও উপস্থাপক তিনি। এছাড়া তিনি নির্বাচিত কবিদের নিয়ে কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান ‘কবির কবিতা পাঠ’ এর আয়োজক সংগঠন ’গালুমগিরি সংঘ’র প্রধান সমন্বয়ক। তাঁর প্রকাশিত ৪ টি কাব্যগ্রন্থ: শিরস্ত্রাণগুলি (ঐতিহ্য, ২০১০), সতীনের মোচড় (শুদ্ধস্বর, ২০১২), কথাচুপকথা…(অ্যাডর্ন বুকস্, ২০১৪), ও সংশয়সুর (চৈতন্য, ২০১৬)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।