শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

মৌমিতার ঘরে ফেরা : হাবিবুল্লাহ ফাহাদ

0

শেষরাতে খুব কেঁদেছে আকাশ। কাক ভেজা হয়েছে ঘরবাড়ি, মাঠ। কার্নিশে গুম গুম করছে পায়রাগুলো। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজেছে ওরাও। জানালার পর্দা সরিয়ে তাকাল মৌমিতা। ভোরের ঝকঝকে আকাশ। একটু আগেও অঝোরে কেঁদেছে। অথচ লেশমাত্র নেই। কেউ কাঁদলে ছাপ থাকে চোখেমুখে। ফোলাফোলা লাগে মুখ। দাগ কাটে অশ্রু। জলে আটকে যায় নাক। এই যেমন মৌমিতা। সারারাত অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে। নীরবে। পাশে শুয়ে থেকেও কিছুই বুঝতে পারেনি অনিন্দ্য। পাহাড়ের মতো অটল ঘুম। একবার চোখ বুজলে আর খোঁজ থাকে না। কুম্ভকর্ণও বোধ হয় হার মানবে।

রাতের পর রাত এভাবেই কাটে মৌমিতার। নির্ঘুম। নিস্তরঙ্গ। কালসিটে দাগ পড়েছে চোখের নিচে। তাও চোখে পড়েনি অনিন্দ্যের। আজকাল নিজেকে নিয়েই থাকে সে। আর কোথাও কোনো খেয়াল নেই। সকালে অফিস। অফিস থেকে বাসা। বইপত্র নাড়াচাড়া। একার জগত। একই ছাদের নিচে যে আরেকজন মানুষ আছে, মাঝে মাঝে সে কথাও ভুলে যায়। এটা-ওটা দরকার হলে তখন মনে পড়ে মৌমিতাকে। কিংবা খাবার টেবিলে। রান্নায় নুন হয়েছে, কি হয়নি। ঝালটা জমেছে কি জমেনি, এটুকুই। হঠাৎ অনিন্দ্যের এই পরিবর্তন। আগে তো এমন ছিল না। হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করত। আড্ডাপ্রিয় ছিল। প্রসঙ্গের অভাব হতো না। কত রাত মুঠোফোন আলাপে নিঘুর্ম কেটেছে। বিয়ের আগে সেসব দিন। খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে অনিন্দ্য। সেই মন্¿েই মুগ্ধ হয়েছিল মৌমিতা। সম্পর্কটার একটা স্বীকৃতিও খুঁজে নিল। বিয়ে করল। পরিবারের অমতেই। মুখ ফিরিয়ে নিল বাবা-মা। আঘাত পেয়েছে খুব। একমাত্র মেয়ে। তার এমন অবাধ্য আচরণ, মানতে পারেননি তারা। তাতেও দুঃখ ছিল না মৌমিতার। ভালোবাসার মানুষের বুকের ওমেই আশ্রয় খুঁজেছিল। কিন্তু কেমন অচেনা হতে লাগল সব। বদলে গেল চেনা অনিন্দ্যও।

সব একরকম মেনেই নিয়েছিল মৌমিতা। যা কোনো মেয়েই সহজে মানতে পারবে না। বিয়ের পর তো না-ই। এমন কিছুও। ধৈর্য ধরেছে। তাও তো কম দিন হয়নি। পাঁচ-পাঁচটি বছর। অনিন্দ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে। কেটে গেছে।

সব একরকম মেনেই নিয়েছিল মৌমিতা। যা কোনো মেয়েই সহজে মানতে পারবে না। বিয়ের পর তো না-ই। এমন কিছুও। ধৈর্য ধরেছে। তাও তো কম দিন হয়নি। পাঁচ-পাঁচটি বছর। অনিন্দ্যের মুখের দিকে তাকিয়ে। কেটে গেছে। কে এমন অপেক্ষা করত? নিজের ভালোটাই বেছে নিত আর কোনো মেয়ে হলে। মৌমিতা তা করেনি। আশা ছাড়েনি আজও। কিন্তু অনিন্দ্য? সে যেভাবে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে!

ওদের পরিচয়, সম্পর্কটাও ছিল বেশ নাটকীয়। দা-কুমড়ো থেকে সংসার জীবন। হার মানাবে নাটকের গল্পকেও। অনিন্দ্য বলত। সম্পর্কের শুরুটা ছিল বেশ তিক্ত। গড়িয়েছিল থানা-পুলিশেও। সেদিনের সেই ঘটনা মনে করে বিমলানন্দ পায় দুজনেই। যা ঝড় তা সইতে হয়েছে অনিন্দ্যকেই। কী রুক্ষ ছিল মৌমিতা! সে যে অনিন্দ্যের প্রেম পড়বে কল্পনাও করা যায়নি কখনো। বিয়ে তো সেই দূর কা বাত।

ঘটনার সূত্রপাত শাহবাগে। বারডেম হাসপাতালের সামনে। ট্রাফিক সিগন্যালে। আলাদা রিকশায় করে যাচ্ছিল দুজনেই। হুড়োহুড়ি করে সিগন্যাল পার হচ্ছিল রিকশা দুটো। অমনি পথের মাঝখানে লাগল টক্কর। গেল উল্টে। ব্যস্ত রাস্তা। কোথা থেকে একটি বাস এসে দাঁড়াল বাজখাই শব্দে। শক্ত ব্রেক কষল বলে রক্ষে। তা না হলে যেত পিষে। ছুটে এলো কিছু লোক। ধরাধরি করে তুলল অনিন্দ্য ও মৌমিতাকে। ওদের খুব বেশি কিছু হয়নি। পিচঢালা পথে ছোটো ছোটো পাথরের কণা। তাতে ঘষা লেগে ছিলে গেল হাত-পা। চালক দুজনের আঘাতটা বেশি ছিল। একজনের ভাঙল হাত। রিকশার নিচে পড়ে। অন্যজনের মাথার ডান পাশটা গেল থেতলে। ওদের ধরাধরি করে নেওয়া হলো হাসপাতালে। কনুই গড়িয়ে রক্ত ঝরছে মৌমিতার। সামান্য লেগেছে পায়ের গোড়ালিতে। হাঁটুর কাছে জিনসটা ছিড়ে গেছে অনিন্দ্যের। ঘষা লেগেছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত জমে আছে ওখানটায়। বাঁ বাহুতেও লেগেছে খানিক। কাটা-ছেড়া কিছু নয়। চাপ লেগেছে। রাস্তার ওপাশে ফুলের দোকান। তার সামনের ফুটপাতে বসানো হয়েছে ওদের। ঘিরে আছে উৎসুক মানুষ। কেউ একজন হাসপাতালে নিতে চাইল মৌমিতাকে। রাজি হলো। বলল, হাসপাতালে নয়, থানায় যাব।

কথাটা শুনে ভরকে গেল অনিন্দ্য। ব্যথায় কাতর মুখ তুলে তাকাল। ওই প্রথম মৌমিতাকে দেখল সে। চোখাচোখি হলো দুজনের। আরও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল মৌমিতা। ফুটপাতে একহাতে ভর দিয়ে চেষ্টা করল উঠে দাঁড়ানোর। কষ্ট হচ্ছিল। একটি মেয়ে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরল। ওর মতোই বয়স। ‘আমায় একটু থানায় নিয়ে যেতে পারেন?’ মৌমিতা বলল।

দু-পা এগোলেই শাহবাগ থানা। ‘চলুন, যাচ্ছি।’ মেয়েটি বলল।

কিছুই বুঝতে পারছে না অনিন্দ্য। দুর্ঘটনায় পড়লে হাসপাতালে যায় লোকে। থানায় যাওয়ার কী হলো? কেমন মেয়েরে বাবা!

কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো মৌমিতা। সঙ্গে দুজন পুলিশ সদস্য। বোতলটা শূন্যে তুলে গলায় জল ঢালছিল অনিন্দ্য। তেষ্টায় ফেঁটে যাচ্ছে বুকটা। ‘এই যে, এই ছেলেটার জন্যই সব হলো।’ মৌমিতা তার কাছাকাছি এসে বলল।

জলের বোতলটা পথের ওপর রাখল অনিন্দ্য। বিস্মিত গলায় বলল, আমার জন্য মানে?

‘তা নয় তো কী? আপনিই তো পেছনে থেকে ওড়নাটা টেনে ধরলেন। আর অমনি চলতি রিকশাটা উল্টে গেল। এখন কিছুই জানেন না?’

মেয়েটা এসব কী বলছে! কে তার ওড়না ধরে টানল? বসা থেকে উঠে দাঁড়াল অনিন্দ্য। ‘ফালতু কথা বলবেন না। কে আপনার ওড়না টেনে ধরল?’

তেড়ে গেল মৌমিতা। ‘ফালতু কথা মানে?’ তর্জনিটা অনিন্দ্যের চোখের সামনে নাচিয়ে বলল, ‘ওড়নাটা টান না দিলে রিকশাটা ওল্টাল কী করে? অসভ্য কোথাকার।’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অনিন্দ্য। কী দজ্জাল মেয়েরে বাবা। বানিয়ে বানিয়ে কী সব বলছে। কী সুন্দর দেখতে। অথচ কী খরখরে ব্যবহার। দেখে মনেই হবে না, এমন বিছুটি পাতা।

এমনিতেই জ্বালা করছে ছিলে যাওয়া হাঁটুটা। মনে হচ্ছে লংকা বাটা লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। তার মধ্যে যা শুরু করেছে মেয়েটা। ‘দেখুন আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও।’ অনিন্দ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি কেন আপনার ওড়না ধরে টান দিতে যাব?’

‘ইশ্ কী দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতারে।’ মৌমিতা ঝাঁঝাল গলায় বলল, ‘তাহলে ওড়নাটা কে টান দিল, ভূতে?’ পুলিশের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘অফিসার, প্লিজ একটা কিছু করুন। এসব অসভ্যদের শিক্ষা না হলে হবে না।’

‘দেখছি কী করা যায়।’ একজন পুলিশ সদস্য অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনারা দুজনেই থানায় চলুন। ওখানে বসেই কথা শোনা যাবে।’

থানার ডিউটি অফিসারের টেবিলটা বেশ লম্বা। তার দুপ্রান্তে বসে আছে দুজন। অফিসার দুজনের মুখেই ঘটনাটি শুনলেন। মৌমিতার মুখের ওপর চোখ রাখলেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘কী নিয়ে লাগল দুজনের মধ্যে?’

‘কী নিয়ে লাগল মানে?’ আকাশ থেকে পড়ল মৌমিতা।

‘তরুণ বয়স। সম্পর্ক করলে এমন একটু আধটু হয়ই। এ ধরনের কেস অহরহ দেখতে হয়। যা হয়েছে মিলমিশ করে ফেলুন। সম্পর্কই চুকিয়ে ফেলুন নয়তো। পুলিশের এত সময় কোথায় বলুন? কত বড়ো বড়ো ঘটনা ঘটছে। তা-ই দেখা যাচ্ছে না।’

অনিন্দ্য হকচকিয়ে বলল, ‘না না, এমন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করে কে? সম্পর্ক-টম্পর্ক কিছু নয় অফিসার। এটা স্রেফ একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু উনি—’

‘দুর্ঘটনা মানে? মেয়েদের দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, তাই না?’ মৌমিতা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল।

‘দেখুন আপনি সেই কখন থেকে যা ইচ্ছে তাই বলে যাচ্ছেন। দুটো রিকশা তাড়াহুড়ো করে পার হচ্ছিল। লেগে গিয়ে উল্টে গেল। এমন ঘটনা তো নতুন নয়। প্রায়ই তো ঘটছে। আমার কী দায় পড়েছে যে আপনার ওড়না টেনে ধরব?’ অনিন্দ্য এক নাগাড়ে বলে থামল।

‘দেখুন এত সময় নষ্ট করা যাবে না।’ মৌমিতার দিকে তাকিয়ে অফিসার বললেন, ‘আপনি যদি লিখিত অভিযোগ করতে চান, করতে পারেন। আমরা দেখব।’

‘ঠিক আছে আমি তাই করব।’ মৌমিতা জবাব দিল।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল অনিন্দ্যের। ‘প্লিজ এই কাজটি করবেন না। একটু বোঝার চেষ্টা করুন—।’

‘কী বুঝব? আজ যদি বড়ো কিছু ঘটে যেত, তখন?’ মৌমিতা বলল।

বাসের নিচে আমিও তো থেতলে যেতে পারতাম। বিশ্বাস করুন আমি আপনার ওড়না টেনে ধরিনি। যদি ওড়নায় টান লেগেও থাকে তাহলে চাকায় আটকে যাওয়ার কারণে হতে পারে। ওড়নার একটা পাশ তো চাকার সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল।

‘বাসের নিচে আমিও তো থেতলে যেতে পারতাম। বিশ্বাস করুন আমি আপনার ওড়না টেনে ধরিনি। যদি ওড়নায় টান লেগেও থাকে তাহলে চাকায় আটকে যাওয়ার কারণে হতে পারে। ওড়নার একটা পাশ তো চাকার সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল।’

অফিসার অনিন্দ্যের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বললেন, ‘দেখুন এত যুক্তি দেবেন না। আপনাদের মতো ভদ্রবেশিরা কী করতে পারে, আমাদের ধারণা আছে। এমনি এমনি তো আর পুলিশের পোশাক গায়ে চড়েনি।’

‘কিন্তু অফিসার আমি তো—’।

অনিন্দ্য কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। ‘থামুন, আর ছাফাই গাইতে হবে না।’ অফিসার তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। মৌমিতার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, ‘এবারের মতো ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম। অভিযোগ করলে কয়েকবার থানায় আসতে হতে পারে আপনাকেও। তার চেয়ে একটা মুচলেকা নিচ্ছি। ভদ্রলোকের বেশ ধরেছে বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেল। তা না হলে দু-চারটে দেওয়ারও ব্যবস্থা করতাম।’

‘ঠিক আছে দেখুন, যা ভালো হয়।’ মৌমিতার রাগ কিছুটা থিতিয়ে এসেছে মনে হলো।

সেদিন মুচলেকা দিয়ে ঝামেলা চুকাতে হয়েছিল অনিন্দ্যকে। থানা থেকে বেরিয়ে দুদিকে চলে গেল দুজন।

ওই রাতে একটুও ঘুম হয়নি অনিন্দ্যর। কী যে হয়ে গেল! জীবনে থানার দুয়ারে যেতে হলো এই প্রথম। তাও আবার একটা ছোট্ট ঘটনায়। কী এক দজ্জাল মেয়ে! ডাহা মিথ্যা বলে ফাঁসাতে যাচ্ছিল। রিকশার চাকা দুটো টক্কর খেয়ে উল্টে গেল। আর বলল কিনা ওড়না টেনে ওকে ফেলে দিয়েছি! কী সুশ্রী দেখতে। ঝরঝরে শরীর। এক দেখায় নজর কাড়বে যে কারোরই। সুন্দরী মেয়েদের মেজাজ এতো রুখাশুখা হয়? অহংকারী হয় জানি, তাই বলে এতটা বদমেজাজি! এ তো একেবারেই বেমানান। হাজার রকমের ভাবনা এসে জড়ো হলো অনিন্দ্যর করোটিতে। উধাও হলো ঘুম।

মৌমিতা অবশ্য মুঠোফোনের নটিফিকেশন চেক করছিল ওই সময়। খেয়াল করতে পারেনি। মনে হয়েছিল কেউ হেঁচকা টান দিল ওড়না ধরে। আর তারপরই উল্টে গেল রিকশাটা। অবশ্য ওড়নার একটা পাশ আটকে ছিল চাকাতে।

ওই ঘটনার একমাস পরের ঘটনা। কাটাবনে হঠাৎ অনিন্দ্যকে দেখল মৌমিতা। পশু-পাখির মার্কেটের সামনে। ওর পাশ দিয়েই চলে গেল মাথা নিচু করে। ও খেয়াল করেনি মৌমিতাকে। অনিন্দ্যকে দেখে সেদিনের কথা মনে পড়ল মৌমিতারই। দেখতে শুনতে বেশ ভদ্র। কিন্তু সেদিন—। দেখে অবশ্য কারো বিশ্বাস হবে না, মেয়েদের ওড়না ধরে টান দিতে পারে এই ছেলে। কী জানি! মৌমিতা অবশ্য মুঠোফোনের নটিফিকেশন চেক করছিল ওই সময়। খেয়াল করতে পারেনি। মনে হয়েছিল কেউ হেঁচকা টান দিল ওড়না ধরে। আর তারপরই উল্টে গেল রিকশাটা। অবশ্য ওড়নার একটা পাশ আটকে ছিল চাকাতে।

কী ভেবে মনটা তরল হলো মৌমিতার। তারও তো ভুল হতে পারে। একবার ভাবল পেছন থেকে ডাকবে অনিন্দ্যকে। ততক্ষণে অনেকটা পথ চলে গেছে সে। এখন ডাকলেও শুনবে না।

বাসায় ফিরে ঘুরেফিরে অনিন্দ্যকে নিয়েই কাটল বেলা। মনে হলো একবার অন্তত সরি বলা উচিত। সেদিন সত্যিই বিগড়ে গিয়েছিল মাথাটা। কী বলতে কী বলেছে। দৌড়ে থানায় না গেলেও হতো। ছিঃ ছিঃ কী করেছে সে। হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল ছেলেটা। বদ স্বভাবের ছেলে হলে এতটা ভরকে যেত না। মৌমিতার মনে হলো, সে এখনো মানুষ চিনতে শেখেনি।

কীভাবে যোগাযোগ করবে ছেলেটার সঙ্গে? আবার যদি দেখা হয়, তখন—। হঠাৎ মনে পড়ল, সেদিনে থানায় দেওয়া মুচলেকার একটা জেরক্স চেয়ে নিয়েছিল সে। তাতে নম্বর-টম্বর আছে কি না দেখা যেতে পারে। বেডসাইড ড্রয়ার থেকে কাগজটা বের করল। তিন ভাঁজ করা। সেদিন যেমন রেখেছিল, তেমনই আছে। এই তো নম্বর! মুঠোফোনটা টেনে নম্বরটা তুলল মৌমিতা। রাত দশটা ছুঁই ছুঁই। এতরাতে কল করা ঠিক হবে? কাল সকালে করবে তাহলে? বিষয়টা মাথা থেকে না নামাতে পারলে ভালো ঘুমও হবে না। তার চেয়ে কলটা এখনই করা ভালো।

দুবার বাজতেই কলটা ধরল অনিন্দ্য।

‘হ্যালো’

মৌমিতার কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যালো, চিনতে পারছেন?’

‘কে বলুন তো।’ অনিন্দ্য জানতে চাইল এটুকুই।

‘নাম বললে চিনতে পারবেন?’

‘বলুন দেখি। চেষ্টা করব।’

‘থাক নাম পরে বলি। যে জন্য কল করেছি তা আগে বলেনি।’

‘কী সেটা?’

‘সরি বলতে।’

‘সরি কেন?’

‘আমার কাছে মনে হলো আপনাকে সরি বলা উচিত।’

‘কিন্তু তার আগে আপনার পরিচয়টা জানলে ভালো হতো না?’ অনিন্দ্যের উৎসুক গলা।

‘তা হতো। তবে পরিচয় জানার পর আপনি নিশ্চিত কলটা কেটে দেবেন। তাই সরিটা আগেই বলে নিচ্ছি।’ মৌমিতার ইতস্তত গলা ভেসে এলো।

‘আপনি কী জন্য সরি বলছেন, তা অন্তত জানার অধিকার আমার আছে, তাই না?’
‘মনে হচ্ছে খুব অধিকার সচেতন আপনি?’ মৌমিতার গলা চড়ে গেল কিঞ্চিৎ।

‘দেখুন, দরকারি কথাটি শেষ করে ফোনটি রাখলে ভালো হয়।’ অনিন্দ্যর বিরক্তিকর কণ্ঠ শুনল মৌমিতা।

‘খুব ব্যস্ত আপনি?’

‘তা কিছুটা ব্যস্তও বলতে পারেন। পড়ছিলাম।’

‘কী বই?’

‘সুধা পারাবার।’

‘কার?’

‘প্রফুল্ল রায়ের। দয়া করে কথাটি শেষ করবেন?’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। আপনার সময় আর নষ্ট করছি না। ফোনটা রাখছি।’ মৌমিতার খানিক ঝাঁঝাল গলা পৌঁছাল অনিন্দ্যের কানে।

‘আচ্ছা তা রাখুন। কিন্তু আপনার পরিচয়টা বললে ভালো হতো না?’ অনিন্দ্য গলা নরম করে বলে।

‘মৌমিতা।’

‘কোন মৌমিতা?’

‘কজন মৌমিতাকে চেনেন আপনি?’

‘আপাতত একজনকেই চিনি। কিন্তু সে যদি আপনি হন তাহলে এতসময় কথা বলা আমার ঠিক হয়নি।’

‘কেন ঠিক হয়নি?’

‘দজ্জাল মেয়েমানুষের সঙ্গে কী কথা?’

‘আমি দজ্জাল? আপনি খুব সাধু তাই না? খুব অহংকার আপনার।’ মৌমিতার মেজাজি গলা পৌঁছাল এপাশে।

‘অহংকারী তো আপনি। রূপসী মেয়েরা এতটা রুক্ষ হয় আমার জানা ছিল না।’

‘দেখুন ঝগড়া করার জন্য আপনাকে কল করিনি। মনে হলো আপনাকে সরি বলা দরকার, তাই—।’

‘সেদিন তো আমার কথা একবিন্দুও শুনতে চাননি। আজ এসব আদিখ্যেতার কারণ কী?’ অনিন্দ্যর অভিযোগ ভেসে গেল ওপাশে।

‘কোনো কারণ নেই। ভুলটা আমারও হতে পারে, তাই ভাবলাম—। আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো থাকুন।’ খট করে একটা শব্দ এলো অনিন্দ্যের কানে।

মৌমিতার আকস্মিক কলে। যাক, শেষমেশ সরি বলল মেয়েটা। পরাজয় মেনে নিল তাহলে। এ-ও বা কম কীসে! করোটিতে মৌমিতা-ঘোর। আচ্ছন্ন করে রইল অনিন্দ্যকে। এমনটা অবশ্য আগে কখনো হয়নি। কত মেয়ের সঙ্গেই তো পরিচয়। কাউকে নিয়ে এভাবে কল্পনাও করেনি কখনো। দুদিন পর মৌমিতার নম্বরে কল করল সে। একবার বাজতেই ধরল। মনে হলো এই কলটার অপেক্ষাতেই ছিল মৌমিতা

অভিমানের পাহাড় কিছুটা টলল অনিন্দ্যের। মৌমিতার আকস্মিক কলে। যাক, শেষমেশ সরি বলল মেয়েটা। পরাজয় মেনে নিল তাহলে। এ-ও বা কম কীসে! করোটিতে মৌমিতা-ঘোর। আচ্ছন্ন করে রইল অনিন্দ্যকে। এমনটা অবশ্য আগে কখনো হয়নি। কত মেয়ের সঙ্গেই তো পরিচয়। কাউকে নিয়ে এভাবে কল্পনাও করেনি কখনো। দুদিন পর মৌমিতার নম্বরে কল করল সে। একবার বাজতেই ধরল। মনে হলো এই কলটার অপেক্ষাতেই ছিল মৌমিতা। তারপর নিস্তব্ধতা। কারো মুখে কথা নেই। কেবল নিশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ। এপাড়-ওপাড় বইছে। সেই নীরবতা একসময় ভাঙল। কথা হলো। সেই কথা ধীরে ধীরে কাছে টানল দুজনকে। প্রেম এলো পঙ্ক্ষিরাজের ঘোড়ায় চড়ে। তার পিঠে উঠে বসল দুজনই। উড়ে বেড়ালো অন্তরীক্ষের নীলে। বেকার ছেলে অনিন্দ্য। বাবা-মা গত হয়েছেন আগেই। তার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হয়নি মৌমিতার বাবা-মা। কিন্তু কোনো বাধাই টিকল না। বিয়ে পর্যন্ত গড়াল সেই জল। একটা চাকরিও জুটে গেল অনিন্দ্যর। বিয়ের পর পরই।

সব কেমন ফ্যাকাসে হয়ে এলো। ফুলশয্যাতেই। অন্য এক অনিন্দ্যকে পেল মৌমিতা। যে বাহুর বন্ধনে নিজেকে জড়াতে চাইল সে, দেখল, সে এক অসাড় কাষ্ঠমাত্র। ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম বলে হয়তো—। দিন যেতে লাগল। কোনো পরিবর্তন এলো না। বরং অবনতিই হলো। মৌমিতার মুখের দিকে তাকাতেও পারছিল না অনিন্দ্য। লজ্জায়। অপারগতায়। মুখ খুলতে হলো মৌমিতাকেই। বলল, একবার ডাক্তারের কাছে গেলে হয় না?

অনিন্দ্য অমত করল না। দুজনেই গেল। বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার হলো। সব দেখেটেখে অনিন্দ্যকে একা ডেকে নিলেন ডা. সেন। বললেন, কিছু প্রশ্নের উত্তর আমার প্রয়োজন। দেবেন?

‘হ্যাঁ বলুন।’ অনিন্দ্য মলিন মুখ।

‘বিয়ের আগে থেকে সমস্যাটা আপনি জানতেন না?’ ডা. সেন জানতে চাইলেন।

‘হ্যাঁ, জানতাম।’ অনিন্দ্যর মাথা নিচু করে রইল।

‘দেখুন, এটা লজ্জার কিছু নয়। আর সব রোগের মতো এটিও একটি। তবে আপনি যখন জানতেনই তখন বিয়েটা না করলে হতো না?’

মাথা তুলল অনিন্দ্য। অবাক চোখে ডা. সেনের দিকে তাকাল।

‘না, আমি একেবারে না করার কথা বলছি না। আরও কিছুদিন সময় নিতে পারতেন। চিকিৎসা করলে এই সমস্যা যে কাটবে না, তা নয়। সময় লাগবে। যদিও সময়টা কতদিন সেটাই প্রশ্ন।’ ডা. সেন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।

‘কতদিন লাগতে পারে সেড়ে উঠতে?’ অনিন্দ্যর ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসের মতো বেরিয়ে এলো প্রশ্নটি।

ডা. সেন রিপোর্টগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেন ফের। শান্ত চোখে তাকালেন অনিন্দ্যর দিকে। ‘কতদিন লাগবে নিশ্চিত করে বলা যাবে না। একযুগ চিকিৎসা চলছে এমন রোগীও আমার আছে। হাল ছাড়িনি এখনো। যা হোক, চিকিৎসা চালিয়ে যান। দেখা যাক কী হয়।’

চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলে মৌমিতার উৎসুক জিজ্ঞাসা, ‘কী বললেন ডাক্তার?’

‘চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যাবে বলল। ওষুধপত্র দিল। এই আরকি।’ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল অনিন্দ্য।

‘আর কিছু বলল না?’

‘আর কী বলবে? বলল, নিয়ম করে ওষুধপত্র খেলে ঠিক হয়ে যাবে।’

অনিন্দ্য যে তাকে সব কথা বলতে চাইছে না, বুঝতে পারল মৌমিতা। সেও আর বেশি কিছু বলল না। কী বলবে? সবই তো শুনেছে। আড়াল থেকে। অনিন্দ্য যখন ঢুকল তখন চেম্বারের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিল মৌমিতা।

একবিছানায় শুলেও ফিরিয়ে রাখত মুখ। অনিন্দ্য না চাইলেও ওর সঙ্গে মেশার চেষ্টা করত মৌমিতা। জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত। হাত বুলিয়ে দিত শরীরের নানা অঙ্গে। চুমু খেত। তবুও যদি জেগে ওঠে অনন্তকালের নিদ্রিত শরীরটা। বিরক্ত হতো অনিন্দ্য।

ওইদিনের পর থেকেই আরও অচেনা হয়ে উঠল অনিন্দ্য। কোথায় যেন হারিয়ে ফেলল প্রাণের উচ্ছ্বাসটা। কেমন একা হতে লাগল গল্প আর আড্ডা প্রিয় মানুষটা। বইপত্র আর সোস্যাল মিডিয়ায় খুঁজল আপন ভুবন। মৌমিতার সঙ্গটাও অপ্রিয় হতে লাগল তার কাছে। শুরুতে নিজেকে জাগানোর যে চেষ্টা ছিল, কেমন মিইয়ে গেল সেটাও। একবিছানায় শুলেও ফিরিয়ে রাখত মুখ। অনিন্দ্য না চাইলেও ওর সঙ্গে মেশার চেষ্টা করত মৌমিতা। জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত। হাত বুলিয়ে দিত শরীরের নানা অঙ্গে। চুমু খেত। তবুও যদি জেগে ওঠে অনন্তকালের নিদ্রিত শরীরটা। বিরক্ত হতো অনিন্দ্য। বুঝতে পারত মৌমিতা। তবুও চেষ্টা থেমে ছিল না। কিন্তু একদিন অনিন্দ্য বলেই বসল, তাকে এমন বিরক্ত করলে সে আর ঘরে ফিরবে না। সেই থেকে আর হাত বাড়ায়নি মৌমিতাও। কোনোদিন মা হওয়া তো দূরে থাক, সংসর্গের সুধাও মিলবে না কখনো। কোনো মেয়ে তা মেনে নেবে কি না কে জানে। অগত্যা সব মেনে নেওয়ার চেষ্টা করল মৌমিতা। ‘অনিন্দ্যর যা ভালো লাগে তাই করুক। সম্পর্কটা কেবল শরীরেরই? মনেরও তো হয়। সন্তানহীন কত দাম্পত্যই তো টিকে আছে, সে কেন পারবে না?’—নিজেকে প্রবোধ দেয়। মন কি আর প্রবোধ মানে? এখন নির্ঘুম রাত সঙ্গী মৌমিতার। অশ্রু বিসর্জনে মনের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনিন্দ্য তার কিছুই জানে না।

টুং টাং শব্দে বেজে থেমে গেল মুঠোফোন। হোয়াটসঅ্যাপ নটিফিকেশন। রাজিব। মৌমিতার কলিগ। ‘সুপ্রভাত’। নিত্য সকালে এই মেসেজটি ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। কখনো রিপ্লাই দেয় না মৌমিতা। সিন করে রেখে দেয়। আজ কী মনে করে লিখল, ‘সুন্দর হোক দিন’। মৌমিতার চেয়ে বয়সে ছোটো হবে রাজিব। সবেমাত্র বিবিএ শেষ করল। ঢুকে গেল চাকরিতেও। ছেলেটা শুরু থেকেই চোখে চোখে রাখে মৌমিতাকে। হাতের কাজ গোছাতে গিয়ে লাঞ্চে প্রায়ই দেরি করে মৌমিতা। অপেক্ষা করে রাজিব। মৌমিতাকে নিয়ে যায় ডাইনিংয়ে। অফিস ছুটির সময়ও একই ঘটনা। মৌমিতার বেরোতে দেরি হলে রাজিবও বসে থাকে। ছেলেটা পাগলও আছে। কথা বলতে ইচ্ছে হলে ছুঁতোয়-নাতায় কড়া নাড়ে মৌমিতার কেবিনে। ঠিকই কাজের উছিলা জোটায়। বুঝতে পারে মৌমিতা। কাজ নাকি অন্য কিছু। জেনেশুনে কেন যেন ও প্রশ্রয়ও দেয় ছেলেটাকে। ভালোই লাগে হয়তো।

সকালের নাস্তা তৈরি করল মৌমিতা। নিজে খেল না। খেতে মন চাইছে না। সাজিয়ে রাখল টেবিলে। অনিন্দ্য এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। বেলা এগারোটায় ওর অফিস। সকাল নয়টায় মৌমিতার। তাই ওকে আগেই বেরোতে হয়। স্নান সেড়ে নিল। হালকা আকাশি সালোয়ার কামিজ বের করল আলমারি থেকে। অনেকদিন পরে না ড্রেসটা। আজ পরবে। অফিসের পথে বেরোলো মৌমিতা। মতিঝিলের একটি সিএ ফার্মে এডমিনে আছে। নাস্তা না করায় হাতে একটু সময় পাওয়া গেছে আজ। কিছুপথ হেঁটে তারপর বাস ধরবে। বৃষ্টিঝরা আকাশটা ফকফকা। ঠিক যেন ওর গায়ের বসনটির মতো। বেশ লাগছে সকালের হিম-কোমল হাওয়া। না, আজ আর বাসে চড়বে না। রিকশা করে যাবে। ফুরফুরে হাওয়া খেতে খেতে। একটা রিকশা মিলল কিছুদূর হাঁটার পর। স্নানের পর চুল শুকাতে পারেনি। রাবার ব্যান্ডে বাঁধা চুলগুলো খুলে দিল। রিকশা চলছে হেয়াররোডের বুক চিড়ে। আকাশচুম্বি পদাউকগুলোর নিবিড় ছায়া ঘেঁষে। লোমকূপে পালক বুলিয়ে যাচ্ছে হিম হাওয়া। অস্পর্শী শিহরন তুলছে ভেতরটায়। চোখ বুজে আছে মৌমিতা। এই পথ যদি অনন্তের মতো দীর্ঘ হতো! ভালোলাগা মুহূর্তগুলো খুবই ক্ষণস্থায়ী। উড়ো হাওয়া ভেসে আসা সুবাসের মতো। এই আছে, এই নেই।

‘এই মৌমিতা মেম।’

ডাক শুনে সম্বিৎ ফিরল মৌমিতার। পেছন ফিরে তাকাল। রাজিব তখনও রিকশার পেছন পেছন হাঁটছে। চালককে থামতে বলল মৌমিতা।

‘অফিসে যাচ্ছেন?’ জানতে চাইল রাজিব।

‘হ্যাঁ।’ সিটের ডানে সরে গেল মৌমিতা। ‘উঠে এসো।’

‘চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিলেন?’ রাজিব মৃদু হেসে জানতে চাইল।

‘কিছু না। তোমার বাসা কি বিজয়নগরেই?’

‘হ্যাঁ। আপনার?’

‘মগবাজার।’

‘প্রতিদিন রিকশায় করে যাওয়া হয়?’

‘না, বাসে করেই যাই। আজ ইচ্ছে হলো তাই রিকশায় চড়লাম।’

রাজিব বলল, ‘রিকশায় ঘুরতে আমারও খুব ভালো লাগে জানেন। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়, রিকশায় চড়ে আকাশ দেখতে দেখতে হারিয়ে যাই।’

‘হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় কেন?’ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল মৌমিতা।

‘এই যান্ত্রিক নগরে ভালো লাগে না একদম।’

মৌমিতা আকাশে চোখ রেখে বলল, ‘আমার কিন্তু ভালোই লাগে এই নগর রৌদ্র ছায়া।’

‘কবিতা পড়েন?’ রাজিব বলল।

‘একটা সময় খুব পড়তাম। এখন সময় হয় না। তুমি?’

‘আমারও একই অবস্থা। নয়টা-ছয়টা অফিস করে শরীর একেবারে সায় দেয় না কিছুতেই।’ রাজিব আক্ষেপের স্বরে বলল, ‘আরও কিছুদিন বেকার থাকাই ভালো ছিল।’

‘এখানেই রাখুন। এসে গেছি।’ মৌমিতা চালকের উদ্দেশে বলল।

তার পরদিনও রিকশায় চড়ে অফিসে রওনা হলো মৌমিতা। যথারীতি বিজয়নগর মোড়ে অপেক্ষা করছিল রাজিব। মৌমিতা আজও তুলে নিল তাকে। দুজনে সকালের ফুরফুরে হওয়া খেতে খেতে রওনা হলো অফিসে।

রাজিব ছেলেটা মন্দ না। মৌমিতার চেয়ে বয়সে ছয়-সাত বছরের ছোটো তো হবেই। কিন্তু একবারও তা মনে হয় না। মনে হয় সমবয়সী। অফিস যাত্রায় সঙ্গী পেয়ে ভালোই হলো মৌমিতার। গল্প করতে করতে পৌঁছে যায় অফিসে। পথ শেষ হয়, গল্প ফুরায় না। রাজিবও বেশ খুশি। মনে মনে ও তো এমনটাই চাইছিল। অফিসের প্রটোকলে মৌমিতা তার সিনিয়র বস। ওর সঙ্গে মেশার পর এমনটা মনেই হয় না। মনে হয় খুব কাছের কেউ।

ভেতরের হাহাকারটা ভুলে থাকার উপায় পেল মৌমিতা। রাজিবের সান্নিধ্যে এসে। অনিন্দ্যর অবহেলাও এখন তাকে দুঃখ দেয় না। ওর সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন ছকে বাঁধা হয়ে গেছে। সকালে নাস্তা তৈরি করে বেরিয়ে যাওয়া। অফিস থেকে ফিরে রাতের খাবার রান্না। একই টেবিলে মুখোমুখি দুজন অথচ নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে যাওয়া। কেউ কারো দিকে মুখ তুলে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করে না। অনিন্দ্য খেতে খেতে বইয়ের পাতায় চোখ রাখে। মৌমিতা মুঠোফোনের স্ক্রিনে। হোয়াটসঅ্যাপে রাজিবের নতুন কোনো ম্যাসেজ এলো কি না। প্রয়োজনে দু-একটি বাক্য বিনিময় ছাড়া কথা বলতেই যেন ভুলে গেছে ওরা।

ধীরে ধীরে অনিন্দ্যর মতো আপন জগত গড়ে নিয়েছে মৌমিতা। যেখানে ভাবনার পুরোটা জুড়েই রাজিব। সকালে অফিসে যাওয়া তো বটেই, ফেরার পথেও একসঙ্গে ফেরে ওরা। কখনো পার্কে কিংবা কফি শপে একান্তে সময় কাটায়। অফিসের বাইরে মৌমিতাকে তুমি বলেই ডাকে রাজিব। এই অধিকারটা সে আদায় করে নিয়েছে অল্প দিনেই। মৌমিতার জীবনে অনিন্দ্য বলে কেউ যে আছে, ভুলে বসেছে সে কথাও। রাজিবও ভুলে যায় মৌমিতা অন্য কারো স¿ী। মুখে না বললেও দুজনই বুঝতে পারে, ওদের ভালো লাগার সম্পর্কটা গড়িয়েছে বহুদূর।

আজও অফিস থেকে ফিরছিল দুজন। বিকেল থেকেই মেঘমেদুর আকাশ। ওরা ভাবল বৃষ্টি নামার আগেই ঘরে ফিরবে। তা আর হলো না। মতিঝিল থেকে বিজয়নগর আসতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। হঠাৎ কুকুর-বিড়াল বৃষ্টিতে কাকভেজা হলো দুজনই। প্রতিদিন রাজিবকে বাসার দুয়ারে নামিয়ে দিয়ে যায় মৌমিতা। আজও তাই করল। রাজিব রিকশা থেকে নেমে মৌমিতার হাত ধরে বলল, ‘একটা কথা বললে রাখবে?’

‘কী কথা?’ মৌমিতা জানতে চাইল।

‘বৃষ্টি এখনি থামবে বলে মনে হচ্ছে না। যেভাবে বাজ পড়ছে তোমায় এক ছাড়তে ভরসা পাচ্ছি না। তার চেয়ে বরং আমার চিলেকোঠায় চলো। বৃষ্টি থেমে গেলে বেরিয়ে যেও।’

‘তাহলে তো ভালোই হয়।’ মিষ্টি হেসে সায় দিল মৌমিতা।

রাজিবের চিলেকোঠার ঘরটায় একটা জানালাও আছে। যেখানে দাঁড়ালে ছাদটাকে দেখতে লম্বা উঠোনের মতো লাগে। তার দুপাশে গন্ধরাজ, কামিনী, নয়নতারা আর বস্টন ফার্নের টববাগান। অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে খোলা ছাদে। ঠিক যেন, পায়েল ছেড়া মুক্তো ছড়িয়ে পড়ছে ইঁতিউঁতি।

ভিজে চুপষে গিয়ে শরীরে কাঁপন ধরেছিল মৌমিতার। জানালায় দাঁড়িয়ে তোয়ালেতে গা-মাথা মুছতে মুছতে বলল, ‘ইশ্ এখন এক কাপ গরম কফি হলে বেশ লাগত।’

‘ঘরে কফির সবই আছে।’ রাজিব কাপড় বদলে নিতে নিতে বলল, ‘আমি বানালে তুমি খেতে পারবে কি না, সন্দেহ আছে।’

মৌমিতা তোয়ালেটা চেয়ারের সঙ্গে রাখল। ‘বললেই পারো আমায় বানিয়ে খাওয়াতে পারবে না।’

‘তা কখন বললাম?’

‘বলোনি আবার বলতে বাকিও রাখোনি। কোথায় কী আছে দেখিয়ে দাও। আমিই বানাচ্ছি।’

ধীরে ধীরে মৌমিতার আরও ঘনিষ্ঠ হলো সে। নিশ্বাসের শব্দে চমকে উঠল মৌমিতা। পেছন ফিরে তাকানোর আগেই রাজিবের হাত দুটো কটিদেশ পেরিয়ে পৌঁছে গেল নাভিমূলে। বিদ্যুৎস্পর্শের মতো উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল মৌমিতার শিরায় শিরায়। রাজিবের সর্পিল হাত দুটো শরীরের ভাঁজে ভাঁজে খুঁজতে লাগল মণি-মাণিক্য।

রাজিব মৌমিতাকে রান্নাঘরটা দেখিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। বেরিয়ে দেখল, মৌমিতা বেশ মন দিয়ে কফি বানাচ্ছে। এতটাই মগ্ন যে রাজিব কখন এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে তাও বলতে পারবে না। মৌমিতার পিঠের ওপর পড়ে আছে খোলা চুল। ভিজে যাওয়া ফুল তোলা সাদা কামিজটা তখনো শুকোয়নি। লেপ্টে আছে শরীরের সঙ্গে। তাতেই স্পষ্ট হয়েছে মৌমিতার শুভ্র ঢেউ খেলানো পিঠ, পেলব বাহু। পিঠের ঢেউ এসে থেমেছে মসৃণ কটিদেশে। এতটা নিবিড়ভাবে মৌমিতাকে কখনো দেখেনি রাজিব। দেখার সুযোগও হয়নি। হঠাৎ তার ভেতরে বয়ে গেল মৃদু সমীরণ। ধীরে ধীরে মৌমিতার আরও ঘনিষ্ঠ হলো সে। নিশ্বাসের শব্দে চমকে উঠল মৌমিতা। পেছন ফিরে তাকানোর আগেই রাজিবের হাত দুটো কটিদেশ পেরিয়ে পৌঁছে গেল নাভিমূলে। বিদ্যুৎস্পর্শের মতো উষ্ণ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল মৌমিতার শিরায় শিরায়। রাজিবের সর্পিল হাত দুটো শরীরের ভাঁজে ভাঁজে খুঁজতে লাগল মণি-মাণিক্য। পুরুষ-হাতের এমন স্পর্শে খরা-শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কামনার জলে সিক্ত হতে লাগল মৌমিতা। সব বিষণ্নতা, অপ্রাপ্তি, হতাশা, মুহূর্তে উড়ে গেল ফানুস হয়ে। ওষ্ঠে অধোর গুজে ওরা নির্বাক হয়ে রইল সবাক পৃথিবীতে। প্রবল বর্ষণে নিঃস্ব হয়েছে আকাশ। সন্ধ্যা নেমেছে বেশ আগে। ছাদমুখো জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে অন্ধকার ঢুকে পড়েছে চিলেকোঠায়। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।

‘আমার পরান যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো…’

মুঠোফোনের রিংটোনে সম্বিৎ ফিরে পেল মৌমিতা। দুহাতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল রাজিবকে। দৌড়ে গিয়ে হাতে নিল টেবিলে রাখা মুঠোফোনটা। স্ক্রিনে তখনো ভাসছে ‘অনিন্দ্য মাইলাভ’। তড়িঘড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মৌমিতা। আরও দুবার বাজল ফোনটা। রাত হয়ে গেছে। এত সময় বাসার বাইরে থাকে না সে। আজ এখনো ফেরেনি দেখে দুশ্চিন্তা করছে কি অনিন্দ্য? ফোনটা রিসিভ করল না মৌমিতা। থাকুক, একটু দুশ্চিন্তা হোক অনিন্দ্যের।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার। জন্ম ১৯৮৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। পেশায় সাংবাদিক। ঢাকা টাইমস ও সাপ্তাহিক এই সময় পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক। প্রকাশিত উপন্যাস : ‘জলপাই রঙের দিনরাত’, ‘বসন্ত রোদন’। গল্পগ্রন্থ : ‘বজলু জানে লাশের পরিচয়’, ‘দরজার ওপাশে ভোর’, ‘দানামাঝির বউ’। জীবনীগ্রন্থ: ‘আমাদের বঙ্গবন্ধু’। সম্পাদনা : ‘তিন যোদ্ধার মুখোমুখি’, ‘আলাপের সুবাসে সনজীদা খাতুন’, ‘স্বকৃত নোমানের কথামালা : গহিনের দাগ’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।