বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’র নেপথ্য গল্প

0

বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে ‘আগুনপাখি’ অপরিচিত নয়। এর লেখক হাসান আজিজুল হক, যাকে বলা হয় বাংলা গল্পের রাজপুত্র। এই গল্পকারের প্রথম উপন্যাস ‘আগুনপাখি’। প্রথম বলছি এই জন্যে, উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয় তখনো তার প্রথম উপন্যাস ‘শামুক’, যেটি তিনি ছাত্রজীবনে লিখেছিলেন, প্রকাশিত হয়নি। ‘আগুনপাখি’র মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিলেন, শুধু গল্পে নয়, উপন্যাসেও তার হাত শক্তিশালী। সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও দেশভাগ শৈল্পিক কথন এই উপন্যাস। রাঢ়বঙ্গের এক নারীর জবানিতে লেখক তুলে ধরেছেন সাতচল্লিশ-পূর্ব অখণ্ড ভারতের উত্থান-পতন, রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ, দুর্ভিক্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশ গঠন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের কথা।

E software_ Strip Ad_Swakrito Noman‘আগুনপাখি’র বিষয়টি কোথা থেকে পেলেন হাসান আজিজুল হক, কিভাবে লেখা হলো এই উপন্যাস, কতদিন সময় লেগেছিল লিখতে―এসব জানতে একদিন ফোন দেই তার মোবাইল নম্বরে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানা গেল উপন্যাসটি রচনার নেপথ্য কাহিনি।

মা জোহরা খাতুনও তখন তাঁর বাসায়। এর আগে তিনি বড়ো ছেলের বাসায় ছিলেন। বয়স হয়েছে তার। বয়সজনিত কারণেই মতিভ্রম দেখা দিয়েছে। উল্টোপাল্টা কথা বলেন, লোকজনকে ঠিকমতো চিনতে পারেন না, কখনো কখনো নিজপুত্রকেও না। রাতের বেলায় কাঁথা-বালিশ-মশারি টেনেটুনে এক করে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকেন। দিনের বেলায় প্রায়ই একা একা বকেন।

আশির দশকের শুরুর কথা। ১৯৮২-৮৩ সাল হবে হয়তো। হাসান আজিজুল হক তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক। অধ্যাপনার পাশাপাশি লেখালেখিতে নিবিষ্ট। লিখছেন জীবনের সেরা গল্পগুলো। সপরিবারে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬/সি পশ্চিম পাড়া কোয়ার্টারে। তার মা জোহরা খাতুনও তখন তাঁর বাসায়। এর আগে তিনি বড়ো ছেলের বাসায় ছিলেন। বয়স হয়েছে তার। বয়সজনিত কারণেই মতিভ্রম দেখা দিয়েছে। উল্টোপাল্টা কথা বলেন, লোকজনকে ঠিকমতো চিনতে পারেন না, কখনো কখনো নিজপুত্রকেও না। রাতের বেলায় কাঁথা-বালিশ-মশারি টেনেটুনে এক করে কুণ্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে থাকেন। দিনের বেলায় প্রায়ই একা একা বকেন। একদিন সন্ধ্যাবেলায় তিনি তার জা, অর্থাৎ হাসান আজিজুল হকের চাচীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘ও ল-বউ, ডাল তো শুকোতে দিলাম, দেখ তো পাখি খেল কিনা?’ সবাই তো অবাক! কোথায় ল-বউ? কোথায় ডাল? এসব কী আবোল-তাবোল বকছেন তিনি! আরেকদিন বললেন, ‘দেখ কারা দাঁড়িয়ে আছে। তারা ঝগড়া করতে এসেছে, বুঝলি?’ কেউ তার কথা ঠিক বুঝতে পারে না। কোথাও তো কেউ নেই, কার কথা বলছেন তিনি! আবার কখনো নির্জন দুপুরে নিজমনে বলেন, ‘দেখ দেখ, ঘুঘু পাখি ডাকছে কেমন করে!’ মুখে ঘুঘুর ডাক নকল করেন, ‘ঘু…ঘু….ঘু…ঘু।’

এভাবেই নিজমনে আবোল-তাবোল বকতেন জোহরা খাতুন। একদিন হাসান আজিজুল হকের মনে হলো, আচ্ছা, মায়ের জীবনস্মৃতি রেকর্ড করে রাখলে কেমন হয়? পরে তো কাজে লাগতেও পারে। একটা রেকর্ডার জোগাড় করে এনে তিনি রেকর্ড শুরু করলেন। রেকর্ডারটি মায়ের মুখের সামনে ধরে জানতে চাইলেন, ‘মা, তোমার ছোটোবেলা কেমন ছিল?’ উত্তরে জোহরা খাতুন বললেন, ‘কেমন ছিল আবার? আমার মা তো ছোটোবেলায় মরে গেল। একটা ভাই রেখে গেল, তার বয়স মাত্র এক বছর, সে হলো আমার কাঁকালের পুঁটুলি। বাপ আবার আরেকটা বিয়ে করল। তারপর বাপও মরে গেল। আমার একটা নানী ছিল, সেও মরে গেল…।’

মায়ের কথাগুলো শুনে কিছুটা অবাক হলেন হাসান। মা বারবার শুধু মৃত্যুর কথা বলছে কেন? বলার মতো কথা কি আর নেই? বিষয়টি খুব ভাবাল তাকে। পরে বুঝলেন, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কারণেই হয়তো তার মায়ের মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। তাই আত্মীয়-স্বজনের বিয়োগব্যথাই এখন তার একমাত্র বলবার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জোহরা খাতুন মারা গেলেন ১৯৮৩ সালে। প্রায় কুড়ি বছর কেটে গেল। তার জীবনস্মৃতির সেই রেকর্ডগুলো কোথায় অযত্নে পড়ে আছে খোঁজ নেই। কুড়ি বছর ধরে মায়ের জীবনের সেসব স্মৃতি মাথায় ফেরি করে বেড়ান হাসান আজিজুল হক। মাকে নিয়ে লেখার কথা ভাবেন। লিখবেন লিখবেন করেও লেখা হয়ে ওঠে না।

জোহরা খাতুন মারা গেলেন ১৯৮৩ সালে। প্রায় কুড়ি বছর কেটে গেল। তার জীবনস্মৃতির সেই রেকর্ডগুলো কোথায় অযত্নে পড়ে আছে খোঁজ নেই। কুড়ি বছর ধরে মায়ের জীবনের সেসব স্মৃতি মাথায় ফেরি করে বেড়ান হাসান আজিজুল হক। মাকে নিয়ে লেখার কথা ভাবেন। লিখবেন লিখবেন করেও লেখা হয়ে ওঠে না।

২০০৩ সালের কথা। দৈনিক প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় ছাপানোর জন্য কবি সাজ্জাদ শরীফ একটা উপন্যাস চাইলেন হাসান আজিজুল হকের কাছে। কিন্তু উপন্যাস তো লেখেন না তিনি। একটা লিখেছেন সেই কবে, এখনো অপ্রকাশিত। উপন্যাস লেখার ঠিক পরিকল্পনাও নেই তার, ছাপতে দেবেন কোথা থেকে? পরক্ষণে ভাবলেন, তাঁর মায়ের জীবনের কথা নিয়ে তো একটা গল্প লেখা যেতে পারে। সাজ্জাদ শরীফকে তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, আমি যদি আমার মায়ের জীবনস্মৃতি, পশ্চিমবঙ্গের একজন পর্দানশীন মহিলার জীবন নিয়ে একটা গল্প লিখি, তুমি ছাপবে?’ সাজ্জাদ শরীফ কি আর আপত্তি করেন! হাসান আজিজুল হক যা লেখেন তা-ই তো ছাপবেন।

মা জোহরা খাতুনের জীবনের প্রথম অধ্যায় নিয়ে ‘একটি নির্জল কথা’ নামে একটা গল্প লিখলেন হাসান আজিজুল হক। খুব বড়ো নয় গল্পটি। পাঠিয়ে দিলেন প্রথম আলোর ঠিকানায়। যথারীতি ছাপা হলো ঈদ সংখ্যায়।

পরের বছর একই পত্রিকার ঈদ সংখ্যার জন্য সাজ্জাদ শরীফ এবার একটি বড়ো উপন্যাস চাইলেন। হাসান আজিজুল হক রাজি হলেন। হয়তো তিনি মনে মনে একটা উপন্যাস লেখার পরিকল্পনাই করছিলেন তখন। তাঁর মায়ের জীবনস্মৃতিই সেই উপন্যাসের বিষয়। তবু পরামর্শ চাইলেন প্রাবন্ধিক সনৎকুমার সাহার কাছে। উপন্যাসের বিষয় শুনে তিনিও উৎসাহিত করলেন, বিষয় হিসেবে ভালো, লেখা যেতেই পারে।

মায়ের জীবনের প্রথম অধ্যায় তো আগেই লিখেছেন, এবার লিখতে শুরু করলেন পরবর্তী অধ্যায়গুলো। ঠিক মায়ের জবানিতেই, বর্ধমানের ভাষায়। জোহরা খাতুনের জীবনকে কেন্দ্র করেই উপন্যাস।

মায়ের জীবনের প্রথম অধ্যায় তো আগেই লিখেছেন, এবার লিখতে শুরু করলেন পরবর্তী অধ্যায়গুলো। ঠিক মায়ের জবানিতেই, বর্ধমানের ভাষায়। জোহরা খাতুনের জীবনকে কেন্দ্র করেই উপন্যাস। তার মানে আবার এই নয় যে, উপন্যাসটি হুবহু জোহরা খাতুনের জীবনী। কারো হুবহু জীবনী তো আর উপন্যাস হয় না। লেখক ইচ্ছেমতো এই জীবনকে ভাঙচুর করেছেন। এই জীবনের সঙ্গে অন্য আরও অনেক জীবনকে যুক্ত করেছেন। বস্তবতার সঙ্গে কল্পনার মিশেল ঘটিয়েছেন। মায়ের জীবনের মধ্যে তিনি গাঁথলেন সাতচল্লিশ-পূর্ব অখণ্ড ভারতের উত্থান-পতন, তৎকালীন রাজনীতি, বিশ্বযুদ্ধের উত্তাপ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ, দেশ গঠন এবং সামাজিক অবক্ষয়ের নানা প্রসঙ্গ। আঁকলেন রাঢ়বঙ্গের মুসলিম সমাজের চিত্র, আঁকলেন একটি পরিবারের উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গোটা সমাজের উত্থান-পতনের চিত্র।

প্রায় ১৫৮ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটি লিখতে সময় লাগল প্রায় দেড় বছর। ছাপা হলো প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায়। পরে আরও কটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করে বই আকারে ছাপতে দিলেন। ২০০৬ সালে ঢাকার সন্ধানী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলো ‘আগুনপাখি’। পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া পড়ল। ২০০৭ সালে উপন্যাসটির জন্য কলকাতার আনন্দ পুরস্কার লাভ করলেন হাসান আজিজুল হক।

[লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল দৈনিক কালের কণ্ঠের সাহিত্য সাময়িকী শিলালিপিতে। প্রকাশের তারিখ : ৫ ফ্রেব্রুয়ারি, ২০১৬]

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

স্বকৃত নোমান বাংলা ভাষার কথাশিল্পী। জন্ম ১৯৮০ সালের ৮ নভেম্বর, ফেনীর পরশুরাম উপজেলার বিলোনিয়ায়। জ্ঞানার্জন ও লেখালেখিকে জীবনের প্রধান কাজ বলে মনে করেন। প্রকাশিত উপন্যাস : রাজনটী, বেগানা, হীরকডানা, কালকেউটের সুখ, শেষ জাহাজের আদমেরা, মায়ামুকুট, উজানবাঁশি। গল্পগ্রন্থ : নিশিরঙ্গিনী, বালিহাঁসের ডাক, ইবিকাসের বংশধর, বানিয়াশান্তার মেয়ে। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে আরও বই। এইচএসবিসি-কালি ও কলম পুরস্কার, ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল হুমায়ূন আহমেদ তরুণ সাহিত্যিক পুরস্কার, এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কারসহ ভূষিত হয়েছেন নানা সম্মাননায়। বর্তমানে বাংলা একাডেমিতে কর্মরত।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।