শনিবার, এপ্রিল ২৭

‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ : পৃথিবী বনাম সাবিত্রী

0

পহেলা মে ২০১৩ রাজশাহীর ‘উজান’ আবাসে বর্তমান লেখকের সঙ্গে এক ব্যক্তিগত আলাপে হাসান আজিজুল হকের তিতমধুর কণ্ঠের মন্তব্য ছিল যে দেশে— যে সমাজে প্রান্তীয় মানুষ, বিশেষত নারীর অস্তিত্বই প্রায়-অস্বীকৃত সেখানে ‘কর্তৃত্ববাদ’ স্বীকার বা অস্বীকারের প্রশ্ন তাদের কাছে বৃহদাকার মস্করা ছাড়া অন্য কিছু ঠেকে বলে মনে হয় না।

E software_ Strip Ad_Pias Mojid

হ্যাঁ, ‘ক্ষমাহীন বিশ্বের অধিপতি’ হাসান আজিজুল হক শামুক, বৃত্তায়ন, শিউলি, বিধবাদের কথা ইত্যাকার উপন্যাসিকাগুচ্ছ আর আলোড়নকারী প্রথম উপন্যাস আগুনপাখি’র পর আমাদের শোনালেন ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ (২০১৩)। ‘শোনালেন’ শব্দটা সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি কারণ এই উপাখ্যান পাঠের সমান্তরালে এমত অশ্রু ও রক্তের গাঁথা গীতাকারে জনজমায়েতে পরিবেশিত হয়ে জন্ম দিতে পারে নতুন মর্সিয়ার।

শঙ্খ ঘোষ অত্যল্পকাল আগে এক কবিতায় লিখেছিলেন যে, আমরা যেন এক ধর্ষণ থেকে চলেছি কেবল নতুন আরেক ধর্ষণের দিকে। ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ কি ব্যক্তি-নারীর গণধর্ষণের কাহিনি?

শঙ্খ ঘোষ অত্যল্পকাল আগে এক কবিতায় লিখেছিলেন যে, আমরা যেন এক ধর্ষণ থেকে চলেছি কেবল নতুন আরেক ধর্ষণের দিকে। ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’ কি ব্যক্তি-নারীর গণধর্ষণের কাহিনি? মোটেও না। কারণ যার ব্যক্তি-অস্তিত্বই এই পৃথিবীতে অস্বীকৃত সে তো উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হতে পারে না। চরিত্র বা নায়ক/নায়িকা যদি হয় তবে মূল্যবোধ নামের ঠুনকো কিছু যা ঝুনো নারকেলের মতো শুকিয়ে এখন ভবলীলা সাঙ্গ করার অবসর খুঁজছে।

আর আমাদের বিবেচনায় সাবিত্রী-পীড়নের এই গল্প কারো কারো হাতে রগরগে আবেদনময় উপন্যাসে রূপ নিতে পারে অনায়াসে। কিন্তু হাসান আজিজুল হক যেন তাঁর আখ্যানবিশ্বের নিষ্ঠুর তান্ত্রিকতার অভূত ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে সাবিত্রীর পায়ের কাছে আমাদের বিবশ-হেঁটমুণ্ডু করে তোলেন।

চেনা-খোলসে যে দু’বার পথ হাঁটেন না হাসান। তাই এই উপন্যাসে ভাষা ও আঙ্গিকে খুঁজে পাওয়া যায় অভিনতুনতা। ভাষা ব্যবহারের যাথার্থ্য যে হাসানের অনায়াস কথাসাহিত্যিক মুদ্রা তা উপলব্ধ হয় এই উপাখ্যানের অলি-গলিতে পরিভ্রমণে। হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ভেদে যে ভাষিক ভিন্নতা; তা এই উপন্যাসে প্রয়োগ হতে দেখি সহজ-স্বাভাবিক ছন্দে। তেলা-বটকৃষ্ণ-দুর্গাপদের সমান্তরালে সবুর-বেশারতুল্লা-ইব্রাহিম-সৈয়দ-হুদা-মওলাবখ্শ প্রমুখের সদর-বাহিরের কথকতায় সূক্ষ্ম স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান পায় পাঠক কিন্তু আমাদের অনন্য ঔপন্যাসিক এই ভাষা— স্বাভাবিক বৈচিত্র্য ছাপিয়ে এক জায়গায় সম্প্রদায় নির্বিশেষে এদের অভিন্ন ঐক্যও দিবালোকপ্রতিম স্পষ্ট করে দেখান। জন্তুর বীভৎসতায় সাবিত্রী-সম্ভোগে এদের ধর্ম-বর্ণ কি ভাষিক ভিন্নতা যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে যায় সুদূরে। এইখানে তারা সবে মিলে একপক্ষ আর একলা সাবিত্রী দাঁড়িয়ে থাকে বিপরীত পক্ষে।

এমন একলা যে জ্যোৎস্নাও ছিল না তার অনুকূলে। কেননা উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি শেষের প্রস্তাবনা; সাবিত্রী বুড়ির পূর্ণিমাভীতি—

এখন চাঁদের পক্ষ চলছে, না অমাবস্যার পক্ষ চলছে? আলোর পনেরো দিন, না অন্ধকারের পনেরো দিন? অন্ধকারের পক্ষ শুনলেই নিশ্চিন্ত। চাঁদের আজ দশ দিন, তেরো দিন; পূর্ণিমার আর দু’দিন বাকি— শুনলেই মার্বেল দুটো একদম নিভে আসে। পূর্ণিমা কেন হয়, পূর্ণিমা কেন চিরদিনের জন্য বন্ধ হয় না। তেমন সময় কি কোনোদিন আসবে না, শুধুই অমাবস্যা, আঁধার!

তো, কোন নারীর থাকতে পারে এমন তিমিরবিলাস! নিশ্চয়ই বাস্তবের মারে যার কাছে আলো আর অন্ধকার কোনো পৃথক তাৎপর্যে ধরা দেয় না। আমরা উপাখ্যানের প্রারম্ভে লক্ষ করে উঠেছি যে, ‘বেহদ্দ বেহায়া’ চাঁদ সাবিত্রীর সব অবগুণ্ঠন ফাঁস করে দিয়েছে দুর্বৃত্ত-পীড়কদের চোখের সামনে আর তারপর যেন নির্বিকার চান্দ্রেয় আলোকমালাকে ব্যঙ্গ করেই তারা সাবিত্রীর জীবনকে করে তুলেছে অমাবস্যার সমার্থক। তাই উপাখ্যানজুড়ে ব্যাপ্ত সাবিত্রীর এমন জ্যোৎস্না-বিকার। উপন্যাসের শুরুর ন্যায় শেষেও যেন আদিঅন্ত-একাত্ম এই পূর্ণিমা-অমাবস্যা পালা! বৃদ্ধ ঠাকুরমা সাবিত্রী তার নাতনির মুখে পূর্ণিমার কথা শুনে দরজা বন্ধ করে দেয়। অপেক্ষা তার অনন্ত অমাবস্যার। জ্যোৎস্নার এমন ভয়ঙ্কর বিন্যাস সাবিত্রী উপাখ্যানকে বাস্তব-প্রতিবাস্তবের সীমান্তভেদী শিল্পরূপে উত্তীর্ণ করে যার অভিঘাত বাংলা কথাসাহিত্যের পাঠককে দীর্ঘকাল তাড়িয়ে বেড়াবে অমাবস্যার উৎস সন্ধানে।

উপন্যাসের শুরুর ন্যায় শেষেও যেন আদিঅন্ত-একাত্ম এই পূর্ণিমা-অমাবস্যা পালা! বৃদ্ধ ঠাকুরমা সাবিত্রী তার নাতনির মুখে পূর্ণিমার কথা শুনে দরজা বন্ধ করে দেয়। অপেক্ষা তার অনন্ত অমাবস্যার।

পরিপার্শ্বের নানা তরঙ্গ ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’কে স্পর্শ করে। তবে প্রজাস্বত্ব আইন-ঋণ সালিশি বোর্ড-মহাজনি আইন-জমিদারি বিলোপ আইন-ফজলুল হক-মুসলিম লীগ-কংগ্রেস-লক্ষ্ণৌ চুক্তি-পুনা চুক্তি-বেঙ্গল প্যাক্ট-হিন্দু মুসলিম বাটোয়ারা ইত্যাকার ঢেউ সাবিত্রীর বিড়ম্বিত জীবনে যেন থেকে যায় বিন্দুবৎ অস্পর্শিত কারণ সে তো এক ভুঁইচাপা ফুল মাত্র; আয়ুতে যে ক্ষণিকা কিন্তু সেটুকুই নিংড়ে নিতে শত অসুর একাট্টা।

কাহিনির ফাঁকে-ফোকরে এখানে তিনি অতিসন্তর্পণে ঢুকিয়ে দেন সাবিত্রী মামলার প্রাসঙ্গিক দলিল দস্তাবেজ। না, উপন্যাসকে কোন পোশাকি প্রামাণ্যতা দানে তার আগ্রহ নেই বরং এক নারীর নির্মম নিগ্রহকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র-আইন-আদালত-মামলা-নথি-এফআইআর-বাদী-বিবাদী-সাক্ষ্যপ্রমাণ-হাজিরা এসবের অনন্ত অন্তঃসারহীনতাকেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। উপন্যাসের একেবারে অন্তে সাবিত্রী মামলায় তার স্বামী দুকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের জবানবন্দির অনুলিপি তুলে দিয়ে ঔপন্যাসিক পাঠককে ধন্দে ফেলে দেন যে এই আখ্যান কল্পবাস্তবের না বাস্তবেরই খানিকটা কল্পনারঞ্জিত। উত্তর খুঁজতে যাওয়া একেবারেই অবান্তর কারণ আখ্যানের প্রারম্ভেই আমরা পাঠ করে উঠি—

নামত কিছু বাস্তব চরিত্র অবলম্বনে রচিত এই উপন্যাসের সব চরিত্রই লেখকের রচা। বাস্তবের সঙ্গে তাদের সাদৃশ্য আপতিক ও সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।

হাসান আজিজুল হক তাঁর বুনে তোলা কথার কাঁথায় কোন অহেতু ভঙ্গি ও ভাষিক প্রসাধনে নিতান্তই নিরাগ্রহী। উদোম বাস্তবের সামনে নিরুপায় দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তিভোগ তার পাঠকের অবশ্যপ্রাপ্য। শকুন থেকে সাবিত্রী উপাখ্যান-এর দূরত্ব অনেক কিন্তু আলাপে-আড্ডায় তিনি যেমন বলেন, যে ভূখণ্ড-ভাষা-মানুষের গল্প তিনি বলেন তার মৌল জায়গাটা মোটের উপর অনড় ফলে এক জায়গায় তার অবস্থান পাল্টায়নি। তিনি আসলে একই সঙ্গে পরাস্ত ও অজেয় মানুষের মুখপত্র। তবে এই মানুষ তার এক এক লেখায় বোলচাল পাল্টায়, দেহের সৌষ্ঠব পাল্টায়, তাদের কাহিনির ধরনও নিত্য পাল্টায়। সাবিত্রী উপাখ্যান তার সর্বসাম্প্রতিক সাক্ষ্য।


উৎসর্গপত্রের লেখাটি পাঠকের চোখ এড়ায় না ‘সাবিত্রী দেবী ক্ষমা করো’।

কিন্তু সাবিত্রী কি আমাদের ক্ষমা করবে? যে সাবিত্রীকে—

…এখন আলতো করে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলে দিলে সে হয়ে যাবে টুকরো টুকরো ছোট-বড় অস্থির একটি স্তূপ। শুধু আলগা চামড়া-ঢাকা। এই ভাঙাচোরা চূর্ণ-বিচূর্ণ সাবিত্রী তার দেহটিকে বিনাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও আটকাতে পারেনি। কিন্তু তার মধ্যেই দাঁড়িয়ে আছেন একজন অনশ্বর সাবিত্রী। তার দেহ নাই তবু সে অলৌকিক নয় অতিপ্রাকৃতিক নয়। ঠিক জীবন যেমন সে-ও তেমনি। রোদ মেখেছে, বাতাসে ভেসেছে, জলে ভিজেছে, ফুলের ঘ্রাণ নিয়েছে, কখনোবা একটি-দুটি মল্লিকার সঙ্গে মৃদু কণ্ঠে আলাপও করেছে।

এই তো সাবিত্রী কাহিনির শেষ কিন্তু জীবনের গল্পের কি কোন শেষ আছে! সাবিত্রী উপাখ্যানও তাই আরও অনেক অনিঃশেষ-অনিরুদ্ধ আখ্যানের উৎসমুখ খুলে দেয়।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৪ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বাংলা একাডেমিতে কর্মরত। কবিতার বই আছে বেশ কিছু। লেখালেখির সূত্রে পেয়েছেন কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মাননা, ঘুরেছেন বিশ্বের বেশ কিছু দেশ। piasmajid@yahoo.com

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।