মঙ্গলবার, জুন ১৭

আমার বই : ঋতুপর্ণ ঘোষ : চলচ্চিত্র, জীবন ও সাক্ষাৎকার : নাফিস সাদিক

0

কয়েক বছর আগে এক বৃষ্টির রাতে আমি ‘রেইনকোট’ (২০০৪) ছবিটা প্রথমবার দেখি। পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের হিন্দিতে নির্মিত একমাত্র চলচ্চিত্র সেটি। ছবির নায়ক এক ঝমঝমে বৃষ্টির দুপুরে ভিজতে ভিজতে যেয়ে কড়া নাড়ে দক্ষিণ কলকাতার এক বাড়ির দরজায়। বেশ খানিকক্ষণ পরে খুলে যায় দরজা। দীর্ঘ ছয় বছর পর দেখা হয় প্রেমিক-প্রেমিকার। ভাগলপুর নামক দূর মফস্বলে একসময় তারা ছিল খুব কাছাকাছি, প্রকৃতির কোন এক অদ্ভুত খেয়ালে আজ তারা অনেক দূরের। সময়ের সাথে বদলে গেছে অনেক কিছুই, কিন্তু মরে যায় নি পুরনো প্রেম।

Nafis Sadik

ঋতুপর্ণ ঘোষ : চলচ্চিত্র, জীবন ও সাক্ষাৎকার | নাফিস সাদিক | প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা | প্রকাশক : বাতিঘর : মুদ্রিত মূল : ৬০০ টাকা। বইটি কিনতে এখানে ক্লিক করুন

বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি, ঘরের মাঝে আলো আঁধারির পরিবেশে দীর্ঘ ছ’ বছর পর মুখোমুখি হয় তারা। কথার ঝুড়ি খুলে বসে দু’জনে। নিজেদের করুণ বর্তমান এবং শোচনীয় অবস্থা লুকোতে অবিরাম মিথ্যা বলে, সুখে থাকার অভিনয় করে। কিন্তু শত চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের সব গোপন কথা– সত্যের আপন নিয়মেই প্রকাশ হয়ে পড়ে।

ঋতুপর্ণ ঘোষের সাথে আমার আত্মিক যোগাযোগ ঘটে ‘রেইনকোট’-এর মাধ্যমে। বাদল দিনের বিষাদমাখা এই কোমল কবিতার মতো ছবিটি আলাদাভাবে ছাপ রেখে যায় হৃদয়ে। এরপর তাঁর বাকি চলচ্চিত্রগুলোও একই রকম আগ্রহ নিয়ে দেখতে শুরু করি।

অনেকে আগ্রহ নিয়ে পড়ে অনুভূতি প্রকাশ করল। বস্তুত আমার মতো আরও অনেক মানুষের হৃদয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের যে বিশেষ স্থান রয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হলাম। অন্তরতম সব অনুভূতির গল্প সাবলীল সংলাপে তিনি উপস্থাপন করেছেন চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায়। তাঁর ছবি দেখতে গিয়ে তাই দর্শকেরা চরিত্রগুলোর মাঝে বারংবার আবিষ্কার করেছে নিজেদেরকে।

তাঁর ব্যক্তিজীবন এবং চলচ্চিত্র নিয়ে যেখানে যা কিছু পাই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে থাকি। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা সাক্ষাৎকার, ‘রোববার’-এর পাতার ‘ফার্স্ট পার্সন’, কিংবা ‘ঘোষ এন্ড কোম্পানি’র আলাপচারিতাগুলো আমার মুগ্ধতা আরও বাড়িয়ে দেয়। পড়তে পড়তেই এক সময় তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে লিখতে আগ্রহ তৈরি হল। ঋতুপর্ণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার প্রথমবারের মত ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলাম। অনেকে আগ্রহ নিয়ে পড়ে অনুভূতি প্রকাশ করল। বস্তুত আমার মতো আরও অনেক মানুষের হৃদয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষের যে বিশেষ স্থান রয়েছে, তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে সক্ষম হলাম। অন্তরতম সব অনুভূতির গল্প সাবলীল সংলাপে তিনি উপস্থাপন করেছেন চলচ্চিত্রের রূপালি পর্দায়। তাঁর ছবি দেখতে গিয়ে তাই দর্শকেরা চরিত্রগুলোর মাঝে বারংবার আবিষ্কার করেছে নিজেদেরকে। আর এভাবেই ঋতুপর্ণের সাথে অন্তরের যোগ ঘটেছে আরও অনেক চলচ্চিত্রপ্রেমীর। পাশপাশি মানুষকে আপন করে নেওয়ার যে সহজাত শক্তি তাঁর ছিল, তা দিয়েও তিনি বেঁচে রয়েছেন অজস্র মানুষের স্মৃতির আলোকমাখা কুটিরে।

লক্ষ করলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র নিয়ে ইংরেজিতে যতটুকু বা লেখালেখি হয়েছে, বাংলায় তার পরিমাণ অতি সামান্য। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল পরবর্তী বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরবময় ঐতিহ্যের ধারক এবং তাঁর সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতাদের একজন হিসেবে ঋতুপর্ণ ঘোষের চলচ্চিত্র আরও বেশি গভীর আলোচনার দাবি রাখে। সরল চোখে বাইরে থেকে তাঁর ছবিতে যতটুকু দেখা যায়, ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে মেলে আরও অনেক কিছু। ‘বাড়িওয়ালি’ (১৯৯৯), ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ (২০০৮), কিংবা ‘চিত্রাঙ্গদা: দ্য ক্রাউনিং উইশ’ (২০১২) দেখার সময় তা বারবার অনুভব করেছি। আর সেই অনুভবই এই গ্রন্থটি লিখতে আমাকে প্রেরণা দিয়েছে।

নির্বাচিত সাতটি চলচ্চিত্রের বিস্তৃত বিশ্লেষণের পাশাপাশি রয়েছে তাঁর অন্যান্য ছবিগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি সংকলিত হয়েছে তাঁর লেখা সব গান। ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং তাঁর চলচ্চিত্রের সাথে ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার এই গ্রন্থ দুই বাংলাতেই ঋতুচর্চাকে আরও বেগবান করবে বলে বিশ্বাস করি।

ঋতুপর্ণ ঘোষের জীবন ও তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রার একটি সামগ্রিক রূপরেখা পাওয়া যাবে এই বইয়ে। আনন্দের সাথে বলতে হয়, তাঁকে নিয়ে এটিই বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। তাঁর অভিনয়, উপস্থাপনা, পত্রিকা সম্পাদনা থেকে শুরু করে সকল সৃষ্টির একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ বিন্যাস এখানে দিতে চেষ্টা করেছি। নির্বাচিত সাতটি চলচ্চিত্রের বিস্তৃত বিশ্লেষণের পাশাপাশি রয়েছে তাঁর অন্যান্য ছবিগুলো নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি সংকলিত হয়েছে তাঁর লেখা সব গান। ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং তাঁর চলচ্চিত্রের সাথে ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার এই গ্রন্থ দুই বাংলাতেই ঋতুচর্চাকে আরও বেগবান করবে বলে বিশ্বাস করি।

আমার অনেক আবেগ এবং দীর্ঘ দুই বছরের ক্রমাগত ভাবনা, শ্রম ও যত্নের ফসল এই বই। গত বছরের ৩১ আগস্ট– ঋতুপর্ণ ঘোষের ৬০তম জন্মদিনে বাতিঘর প্রকাশনা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ : চলচ্চিত্র, জীবন ও সাক্ষাৎকার’। সেদিক থেকে এ বইমেলার নতুন বই এটি। বাংলাদেশ এবং ভারত–দু’ দেশেই সহজে পাওয়া যাচ্ছে। ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং সিনেমাপ্রেমী সকল পাঠক বইটা উপভোগ করবেন বলে আমার বিশ্বাস। পাঠকের ভালবাসা পেলে শ্রম সার্থক হবে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে, সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জে। শিক্ষাজীবনের সূচনা এবং বেড়ে ওঠা সেখানেই। কৈশোর কেটেছে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত। সাহিত্য, চিত্রকলা এবং চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগ থেকে বিচিত্র বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিতব্য গ্রন্থ: ‘ঋতুপর্ণ পাঠ: চলচ্চিত্র, জীবন এবং অন্যান্য'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।