বুধবার, এপ্রিল ২৪

তিনা মোদোত্তি : শিল্প . রাজনীতি . জীবন : সাদিয়া মেহজাবিন

0

জীবনের দিকে ফিরে তাকালে তিনার সাথে পরিচয় ঠিক হয়নি, হয়েছিল ফ্রিদা কাহলোর সঙ্গে। যেখানে ফ্রিদাকে অন্তিম ধরে এগিয়ে চলছিলাম, প্রশ্নের ভীড়ে খুঁজে পাওয়া যায় খানিক তিনাকেও। কিন্তু সে তিনা কে? ছবি নাকি ছায়া? তিনা মোদোত্তিকে তাই বিস্তারিত জানতে হাতে তুলে নিলাম লাল মলাটে ‘তিনা মোদোত্তি : শিল্প . রাজনীতি . জীবন’ বইটি। যার অনুবাদ-সংকলন এবং সম্পাদনা করেছেন মাহমুদ আলম সৈকত।

Tina Modotti

তিনা মোদোত্তি : শিল্প . রাজনীতি . জীবন | অনুবাদ-সংকলন-সম্পাদ : মাহমুদ আলম সৈকত | প্রচ্ছদ : লরেন হ্যামেরি ফেরাজ-এর ড্রইং অবলম্বনে তৈরি | প্রকাশক : বুবুক | পাঠকের মূল্য : ২৩৫ টাকা | বইটি কিনতে এখানে ক্লিক করুন

তিনাকে একাধারে কুঁড়িতে বেঁধে ফেলেছে বলা যায়। সূচিতে ‘জোছনা চুয়ানো রাতে’, ‘ফুরালো না আঁধার’ কিংবা ‘ডুবে যাবে চাঁদ, রাত ফুরাবার আগে’ এমন বিশটি অধ্যায়ের নামগুলো দেখে বোধ করি, এ যেন বাংলায় তিনাকে নিজের কাজলা দিদি রূপে পাওয়া। দহলিজ আলাপ দিয়ে নিজেদের বারান্দায় শুরু হলো তিনা নিয়ে খোশ-গল্প। তিনাকে যে দাগেই ফেলুক না কেন, স্পষ্ট বলা আছে শিল্প-রাজনীতি-জীবন বাদে সৃষ্টিশীল মানুষকে আঁকা সম্ভব নয়। নারীবাদী আইকন তিনা মোদোত্তিকে নিয়ে তাই এত আয়োজন।

‘জোছনা চুয়ানো রাতে’ দিয়ে শুরু। উনত্রিশ বছর পর মারিয়া তাঁর পরিচিত রাস্তায় হাঁটবেন। ইতালির মেয়ে মারিয়া ভেবে আকুল, আমেরিকান নাকি অস্ট্রীয়। ক্লান্ত মারিয়া আগে এমনটি ছিলেন না। বন্ধুদের খবর নেওয়া, সচেতন হাসিখুশি মেয়েটি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। সিগারেটের কালচে দাগ ঠোঁটে, অতিরিক্ত মদ্যপান শরীরের নির্জীবতা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাকে সকলে যে নামেই ডাকুক না কেন, তার প্রকৃত নাম তিনা। তিনা মোদোত্তি। হ্যাঁ, সাংবাদিকের কলমে আষ্টে-পিষ্টে জড়ানো তিনা। আপাতত প্রারম্ভিক আলোচনায়, এখনো তিনা মহৎ কেউ নন। অতি সাধারণ একজন নারী। বাংলায় যাকে সতী করার চেষ্টা বিন্দুমাত্র পাওয়া যায় না।

গর্ত থেকে বের করে আনতে হবে সে আদি তিনাকে। ‘অঙ্কুরে খুঁজি জীবন’ তিনার জীবনের সে বীজের সন্ধান যা তাকে ‘একজন তিনা’ হতেও সাহায্য করেছিল। গুইসেপ্পেতের বহেমিয়ান জীবন, আসুন্তা এদেলেইদে লুইজাকে বাধ্য করেছিল জিনগতভাবে খানিকটা ভবঘুরে হতে। তবুও ঝড়ের কবল থেকে কে-ই বা রক্ষা পায়। লুইজা বা তিনার মা ফলত হয়ে উঠেছিলেন সাধু-সন্ত মা, আলাভোলা মা। হয়তো এক্ষেত্রে মায়েরাই সে প্রকৃষ্ট ভূমিকা রাখে বারংবার, টর্নেডোর দিনে সামলে নেওয়ার।

‘ঝড়ো হাওয়ার দিন’-এ আমরা দেখতে পাই তিনা দায়িত্বশীল নারীর মতোই খালার দেওয়া স্কার্ফ বিক্রি করে ঘরে খাবার আনছে, মা অঝোরে কেঁদেছিলেন। তিনা ভুলে যাননি এতসব, অমর উক্তি দিয়ে গেলেন যেন। ‘ক্ষুদা আর দারিদ্র্য একটা পরিবারকে এমনভাবে যুক্ত করে, পরিবারের সবাই পরস্পরকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরে যেমনটা বিপুল আরাম-আয়েশ আর ধন-দৌলত থাকার পরও সম্ভব না’। কিন্তু তিনা ভেবে তো আর থেমে গেলেন না। চললেন ফ্রান্সিসকোর পথে।

যাত্রাপথে দেখা হলো ‘রোবো’র সাথে। মোদোত্তির বিষাদভরা সৌন্দর্য ও অনির্ণেয় অভিব্যক্তিতে রোবো মুগ্ধ হলেন। নৈরাজ্যবাদী তকমাধারী রোবোর সাথে তিনার ঘনিষ্ট সম্পর্কের নথি মেলে ‘কাছেই ডাকছে পাখি-সুসময়’ অধ্যায়ে। তিনা ধীরে ধীরে রোবোর স্টুডিও আড্ডার অন্যতম একজন হয়ে উঠলেন। বিবাহ নামক বন্ধনের কথাও শোনা যায় এতে।

যাত্রাপথে দেখা হলো ‘রোবো’র সাথে। মোদোত্তির বিষাদভরা সৌন্দর্য ও অনির্ণেয় অভিব্যক্তিতে রোবো মুগ্ধ হলেন। নৈরাজ্যবাদী তকমাধারী রোবোর সাথে তিনার ঘনিষ্ট সম্পর্কের নথি মেলে ‘কাছেই ডাকছে পাখি-সুসময়’ অধ্যায়ে। তিনা ধীরে ধীরে রোবোর স্টুডিও আড্ডার অন্যতম একজন হয়ে উঠলেন। বিবাহ নামক বন্ধনের কথাও শোনা যায় এতে। এর ভীড়ে তিনাকে দেখা যাবে রুডলফ ভ্যালেন্তিরোর নির্বাক চলচ্চিত্রে।

রোবো আর তিনার স্থানে হরেকের আড্ডা। নানাবিধ আলাপ। মার্কসবাদী তত্ত্ব-বিচার-বিশ্লেষণ ভাবনা। তবুও দেখা যায় তারা এক বিষয়ে একমত হতে পেরেছিলেন অন্তত। ‘বিশ্বকে পালটে দেয়া মানে কেবল ক্ষমতার হাতবদল বা সরকারকে অস্বীকার করা নয় বরং নিজেদেরকে সর্বোচ্চ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে স্বীয় বিশ্বাসের অনুশীলন করা।’

‘তারার আলোয়’ অধ্যায়টি মূলত তিনার অভিনয় জীবন নিয়ে। থিয়েটার পাড়ায় তিনার যাতায়াত শুরু কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে। কিন্তু ততদিনে তিনার নাম ছড়িয়ে পড়ে। ‘লা ইতালিয়া’তে রিভিউ আরও সহায়তা আনে। ‘দারিও নিকোদেমি’র লা নেমিকা নাটকে মার্তা রিনল্ট চরিত্র, তিনাকে এনে দেয় অতি মূল্যবান মন্তব্য। ‘তিনা মোদোত্তি আমাদের থিয়েটারের লম্বা দৌড়ের ঘোড়া!’

আসলে তাই। এরপর ‘লা মর্তে সিভিলে’-তে অপরাধি চরিত্রে, হেনরিক ইবসেনের দ্য ঘোস্টের ইতালীয় সংস্করণ ‘গ্লি স্পেত্রি’ সহ একাধারে অনেক চরিত্রেই আমরা তিনাকে দেখতে পাই।

এখন অব্দি যারা তিনার কেবল অভিনয় স্বত্তাকে খুঁজে পেয়েছেন তাদের জন্যেই বোধহয় ‘নতুন পথের দিশা’। আবার বলা যায়, ফিরে দেখাও। এবার পরিচয় ঘটবে ‘আলোকচিত্রী’ ‘তিনা মোদোত্তি’র সাথে। তবে অভিনয় ছেড়ে এসেছেন তিনা, এ কথা সত্য। ‘রোবো’র স্টুডিওতেই ‘এডওয়ার্ড ওয়েস্টেনের’ সাথে পরিচয় তিনার। যিনি খ্যাতিমান তো বটেই, একাধারে শিল্প-সমঝদার। শিল্পের বাহাসের সাথে, যিনি ব্যবসায়িক দরদামের রফাতেও সিদ্ধান্ত দিতেন। কিন্তু বস্তুত রোবো-মোদোত্তির সম্পর্কের ছায়া ঘনিভূত হতে দেখা যায় এতে।

ঘটনাক্রমে ওয়েস্টনের প্রতি শারীরিক আকর্ষণ তাদের প্রণয়ের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে ধরা যায়। ওয়েস্টেনের আলোকচিত্রী জ্ঞান তিনাকেও সাহায্য করে, তিনা খুঁটিনাটি শিখে নিলেন। মেক্সিকোতে থিতু হলেন আলোচনাক্রমে। ন্যাশনাল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে তিনা একটি প্রদর্শনীও করলেন । তবে রোবোর মৃত্যুর এখন এক বছর। আর তিনাকেও যেত হলো ফের আমেরিকায়। বাবার শেষকৃৎ করতে।

‘উন্মাতাল সময়ের আখর’ ফলে তিনা-ওয়েস্টনের প্রেমের মিলনের অধ্যায় হিসেবে ধরা দিল। তবে প্রেম স্বাভাবিকভাবেই কবিতারও উদ্গ্রীব করে। তিনার একটি মাত্র কবিতার কথা জানা যায় এতে। ‘কবি নাকি ছবি’ ‘তিনা’ সময়ে বিস্ময়ের জাগরণ করে অবশ্যই। ‘চাঁদকে আমি তিনফালিতে কাটব/ বড় ফালিটা তোমার জন্যই রাখা, চট করে খেয়ে ফেলো না কিন্তু’। ভাবা যায় বাংলায় যদি লিখতেন কবি, এ চাঁদের খনি?

‘অজ্ঞাত মুখচ্ছবি’ এখন আলোকচিত্রের একটি ফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেসময়ের তিনাই ১৯২৪-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ‘জনপ্রিয় ধারা’ হিসেবে এ ফর্ম ধরে রেখেছিলেন বলা যায়। ক্যামেরা তখন তিনার একমাত্র প্রেম হয়ে উঠে। তিনার ছবিগুলোতে ‘আধারে থাকা নারীরা’ সে অর্থে সুন্দর নন। অর্থাৎ আমাদের কাছে সুন্দরের যে সংজ্ঞা তাতে অন্তত নন।

‘অজ্ঞাত মুখচ্ছবি’ এখন আলোকচিত্রের একটি ফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেসময়ের তিনাই ১৯২৪-১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ‘জনপ্রিয় ধারা’ হিসেবে এ ফর্ম ধরে রেখেছিলেন বলা যায়। ক্যামেরা তখন তিনার একমাত্র প্রেম হয়ে উঠে। তিনার ছবিগুলোতে ‘আধারে থাকা নারীরা’ সে অর্থে সুন্দর নন। অর্থাৎ আমাদের কাছে সুন্দরের যে সংজ্ঞা তাতে অন্তত নন। তিনা তাই ওয়েস্টনের আলোকচিত্রে স্বয়ং মডেল হিসেবেও এক নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন। এক্ষেত্রে ওয়েস্টনও স্বীকার করে তিনার সে ‘ভিন্ন রূপ’ একমাত্র ক্যামেরাই ধরতে পেরেছিল।

এবার ‘দিয়াগো’র আগমন আমাদেরকে মেক্সিকোর সেই ঐতিহাসিক সময়ের সাথে পরিচয় করায় যেখানে একই সাথে ‘ফ্রিদা-দিয়াগো-তিনা’ ত্রিভুজ স্বত্তার সাথে মিশিয়ে তুলবে। জানা যায়, ‘ফ্রিদা কাহলো’কে নিয়ে হওয়া চলচ্চিত্রে, গল্পের স্বার্থেই ফ্রিদার সাথে তিনার অমন নাটকীয় সাক্ষাৎকার দর্শক দেখতে পায়। যেখানে মোদোত্তিই নাকি রিবেরার সাথে ফ্রিদার পরিচয় করিয়েছিল।

ফ্রিদা আর দিয়াগোর আগমন একই সাথে তিনার রাজনৈতিক মতাদর্শের সাথে আমাদেরকে আরও জানাবে, তার রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস। ‘ওয়ার্কার্স প্যারেড’ ছবিটি এক্ষেত্রে তিনার কমিউনিস্ট ও শৈল্পিক জীবনকে গাঢ় করে বুঝতে সাহায্য করবে। ক্রমশ আদর্শবাদী তিনা বিপ্লববাদী শিল্প ও রাজনীতির প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে পড়ে। জেলও খাটতে হয়ে তিনাকে। এ অংশে ক্ষমা চেয়ে বলতে হয়, রাজনৈতিক জ্ঞানে এখনো ধার দেওয়া বাকি বলে বইয়ের রাজনৈতিক অংশ নিয়ে বিপুল ভাবনার বহিঃপ্রকাশ সম্ভবপর হচ্ছে না। তবে তিনার ওয়েস্টিনকে লেখা একটি বাক্য তুলে না আনলেই যেন নয়। ‘প্রায়ই মনে পড়ে, নিৎসের একটি উক্তি তুমি আমায় বলতে, যা আমাকে খুন করে ফেলতে পারে না তাই আমাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।’ তিনা আদতেই মনে করতেন সর্বহারাদের জন্যে তার একমাত্র হাতিয়ার আলোকচিত্র। তাই হয়তো নিজের আলোকচিত্র নিয়ে বলতেন, ‘নিউ আইজ, নিউ কম্পোজিশন, নিউ কনশাস’।

মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে তিনা থিতু হলেন, ফিরে পেলেন নিজের নাম। এবং শেষ অব্দি কবরের ডিভানে পাবলো নেরুদার কবিতায় ঝড়ে পড়া ফুলের সাথে সমাপ্তি হলো একজন ‘তিনা মোদোত্তির’।

সম্পূর্ণ বইতে দেখা যায়, তিনা মহান কিছু নন আবার অতিসামান্যও নন। কোথাও একবারের জন্যও অনুবাদ বোধ হয়নি বলেই, নিজের ভাষায় তিনাকে পড়ার সুযোগ হলো। না হয়, গদ্যের ছলে ঘন-টানা অনুবাদ পাঠককে বিরক্তই করত। তিনাকে নিয়ে বাংলায় তেমন কোনো কাজের সন্ধান পাওয়া যায় না, এখনো এমনটা বলার সুযোগ নেই আর। সাবলিল ছন্দে বাংলা ভাষায় তিনাকে নিয়ে এ অনুবাদ-সংকলন গুরুত্ব হারাবে না নিশ্চিত। একই সাথে বহুল ছবির ব্যবহার, কবিতার অনুবাদ, টীকা, তথ্যসূত্র পাঠককে সমাদৃত করবে আলোয়। প্রত্যেক অধ্যায়ের নামকরণ, পাঠ শেষে যৌক্তিকতা এনে দেয়। বইটিকে ‘রিডার-ফ্রেন্ডলি’ বলা যায়। কেননা কোথাও সমাধান বা মন্তব্য নেই। পাঠকের উপর ছেড়ে দিয়েছেন সব। ইচ্ছে হলে নিজের মতো সূত্র তৈরির সুযোগ আছে। তথ্যবহুল বইটি বারবার মনে করিয়ে দেবে মলাটে আঁকা শেষ বাক্যকে—

‘শিল্পের নানাবিধ সমস্যার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে
আমি জীবনের হরেক সমস্যার সমাধান করতে পারব না’।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। একটি জাতীয় দৈনিকে খণ্ডকালীন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি নানান পত্রিকা, সাময়িকী ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত লেখালেখি করছেন। নানামূখী বিষয়ে লেখালেখির আগ্রহ থাকলেও নারী অধিকার, সাক্ষাৎকার ও বইপর্যালোচনা নিয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।