মঙ্গলবার, এপ্রিল ৩০

ইট মহল্লা : নীলাদ্রি দেব

0

১.
ক্যানন ৭০০ ডি (৫৫-২৫০)।

ক্যানন এসএক্স ৪১০ আইএস, এটা ম্যাক্রো।

এই দিনগুলোতে দাঁড়িয়ে পরের সিরিজের আলো ছিটকে আসে আমার চোখে। জ্যোতুদার দেওয়া বিস্কুটগুলো ঠিক এই সময়েই ডুবে যায় চায়ের ভেতর। একটা ফলস বাইট আমাকে ভাবায়। সেই অপরিচিত ছবিটি আমার রাতের ঘুমের ভেতর হানা দেয়। বক্সারের ওপরে ও নিচে খয়েরি চামড়া। বুকে ও দুপায়ের মাঝে দুচারটে আঙুল চালাই। ওয়াশরুমে কেমন একটা ছায়া, ছবি দুটো ঝুলছে।

ছবি দুটো দুই আঙুলের চাপের ভেতর। অর্থাৎ ঝুলে থাকা কিংবা আঙুল দুটোই ছবিটির থেকে ঝুলছে, এমন। সাদা আলোয় যা বলছে, ওয়ার্ম আলোতে অন্য কিছু কি? অতএব একটি বোর্ড মাঝে রাখা হলো। যার বিপরীত দিকে সবুজ মখমল। ওতে কালার পিন মানে থাম্ব পিন দিয়ে দুটো ছবি গুঁজে দেওয়া হলো। এরপর দরজা খোলার মতো একটা শব্দ পেয়েছি। কিন্তু জানি না আর কেউ এলেন বা গেলেন কি না। সামনেই একটা এক্সিবিশন আছে। ছবি বলতে যে শুধুই ফটোগ্রাফ, আলাদা করে আর বলতে হবে না। এমন এক্সিবিশনগুলোতে গেলে আজকালের ঘটনার খানিকটা স্পর্শ পাই। আর বাকিটা যাত্রা বা নাটকের মাঝামাঝি দীর্ঘ মেকআপ ও অসুস্থ আর্টডিরেকশনের নিম্বু পানি। যারা দেখতে আসেন, রিলেট করতে চাইছেন। দেখছেন প্রিন্ট। দেখছেন অপরিচিত একটি মুহূর্তকে। আর ছবিটা কার, হালকা নোট রাখছেন অনেকে। এই দিনগুলোতে দাঁড়িয়ে পরের সিরিজের আলো ছিটকে আসে আমার চোখে। জ্যোতুদার দেওয়া বিস্কুটগুলো ঠিক এই সময়েই ডুবে যায় চায়ের ভেতর। একটা ফলস বাইট আমাকে ভাবায়। সেই অপরিচিত ছবিটি আমার রাতের ঘুমের ভেতর হানা দেয়। বক্সারের ওপরে ও নিচে খয়েরি চামড়া। বুকে ও দুপায়ের মাঝে দুচারটে আঙুল চালাই। ওয়াশরুমে কেমন একটা ছায়া, ছবি দুটো ঝুলছে। বাঁহাতি জাঙিয়ার পাশে দুটো ছবি। পশ্চিমের দেওয়াল মানে প্রতিফলক। কমোডটা টেনে আনি। বসি। ডিমারের অসংযত ব্যবহারে কেটে গেছে নাদচিহ্ন। একটা স্পট আমার ওপর, অন্যটা ছবিতে। ছবি দুটো যথেষ্ট আলো ধরতে শিখে গেছে। এবার প্রতিফলকের দুপাশে নিচ থেকে উঠে আসা দুটো সমান্তরাল আলোর পার ব্যালেন্স করছে নিজস্ব ছায়াকে।

প্রথম ছবিটি মনোক্রম, ভাটার।

দ্বিতীয়টি ওই ভাটার একটি শ্রমিক দম্পতি কিংবা তাদের মেয়ের।

 

২.

শেষ ছয় মাস বসার তেমন সময় করে উঠতে পারেনি এ পাড়ার বেশিরভাগ মানুষজন। তাই হয়তো পা মেলে বসে আছে একটা গোল উঠোনে। উঠোনের পুরোটাই কেউ না কেউ। ছোটো কালো পিঁপড়ের একটা লাইন দুলালির ছেদড়ে থাকা নাইটির ভেতরে হারিয়ে যাচ্ছে। মহল্লাটা অল্প কিছু দিন হলো ফিরেছে। একেকবার একেক রাজ্যে যায় যেখানে হাজিরা একটু বেশি পাওয়া যাবে। হরিয়ানা বিহারেই বেশি। সীমান্তেও। হঠাৎই নাইটিটা হাঁটুর চার আঙুল ওপর পর্যন্ত তুলে ঝেরে নিল দুলালি। আফজাল, আনিজাল হয়তো কোনো কারণে মার্জিনটা ডিঙিয়েছে, একে অন্যের মা-বাবার কাদা খোঁচা শুরু করল।

—এমন লাগালাগি মাগি দুপুর দুপুর।

—বাপের লুঙ্গির ফুটা তো এর চেও বড়ো।

আফজাল নয়। অনিজাল এগারো।

এমন সময় হঠাৎ একটা মার্বেল এসে আঘাত করল ছড়িয়ে থাকা মার্বেলগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট একটিতে। যা পদার্থবিদ্যার সূত্র মেনে কিনা জানা যায় না, দুলালির কপালে এসে লাগল। বৃত্ত নিখুঁত না থাকলে যতটা, রক্ত পড়ল। উঠোনের রাইট ডাউনে এসে সবাই ঘন হলো। এতক্ষণ চলছিল রেডিয়োটা। খেয়াল করিনি। কতটা ভোজপুরি গান বাজলেও তা নির্জন বাজে! নব ঘুরিয়ে দিতেই আধকাটা সংবাদ শিরোনাম। পঞ্চায়েত ভোট আসছে।

—আমাদের রাস্তাগুলান পাকা হয় নাই।

—তাতে কী হইছে?

—ইলেকট্রিক নাই।

—প্রবলেম তো হয় না। ঘরদুয়ার তো দিছে। কয় মাসই-বা থাকি। যেগুলান থাকে, ভালাই আছে।

—হাগির যাইতে লাগে নদীতে।

—ছাদ দেওয়া পায়খানা তো পাইছি।

—সেইটা ঠিক। ছাগল, পাট… এইসব তো রাখতে পারি।

পঞ্চায়েত একদম যে কিছু দেয় না, তা তো নয়, সুষম পর্যায়ের গিভ-টেক। তার জন্যই ভোটের সময় যে যেখানেই থাকুক, ঘরে আসে। রেজাল্টের দিন মসম হয়, মালও। বাকিটা জমে সিন্দুকে, মানে টিনের ট্রাঙ্ক। ওতে আধার, ভোটার, জবকার্ড, বাচ্চার মাতৃ সদনের খাতা আর ঘরের লোকগুলোর একটা করে ছবি।

 

৩.

দুলালি ভাটাতে এবার যেতে চাইছে না। কিন্তু না গেলে লাইনটাও কেটে যাবে।

—যাবার বেলা মোহর দিয়ে আইসছিলাম।

ওর মানুষটা আদৌ বসে আছে কি না, তা জানতে ইচ্ছা যে একদম করে না, তা তো নয়।

—প্যাট আর চ্যাট, মাইঝখানে খিলি পান আর খিলিখিলি হাসি। যদি ফিরি না যাই, এইখানে একখান ভাতার ধইরতে হবে। খাওয়া খাদ্য বুইঝে পাইতে হবে।

আসলে সম্পর্কের একটা উষ্ণতা পেয়েছে। নয়তো যাতায়াত ভারি হয়ে আসত না। ও শ্রমের শেষে সন্ধ্যাবেলায় ঠিক ১০০ থেকে ১ গুনতে চেষ্টা করে। পুরোনো সব কথাগুলো পাশাপাশি বসায়। ক্রোনোলজি, আগের ও পরের সংখ্যা… এসব। যখন ওর খুব জ্বর আসে, কেউ না কেউ খাবার ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু মাথার কাছে বসে জলপট্টি দেওয়ার মতো কারো কথা ওর মনে পড়ে না। খুব জ্বরের মধ্যে ও যখন আবোল-তাবোল বলে ব’লে আমরা ভাবি,

—তখন আমি পরিবারের মানুষগুলানকে গুসাই। একবার টেরাঙ্ক থেকে আলনা, আলনা থেকে মিশ্চেব।

হালকা বাতাসে ভেঙে পড়ে ওর কাণ্ড, শাখা। অন্য কোনো গাছের থেকে পরজীবী আসে। জড়িয়ে যায় ওর দেহে। আগায়। লতায়। শীতে গাছটা যখন প্রায় ন্যাড়ার মতো দেখায়, ডাল শুকিয়ে যায়, কে যেন ভাটি থেকে দুহাতা আগুন এনে রাখে ওর মূলের কাছে।

কোনোভাবেই গুছিয়ে উঠতে পারে না। একটা ফ্যামিলি ট্রি। খুব ঝুঁকে আসে। হালকা বাতাসে ভেঙে পড়ে ওর কাণ্ড, শাখা। অন্য কোনো গাছের থেকে পরজীবী আসে। জড়িয়ে যায় ওর দেহে। আগায়। লতায়। শীতে গাছটা যখন প্রায় ন্যাড়ার মতো দেখায়, ডাল শুকিয়ে যায়, কে যেন ভাটি থেকে দুহাতা আগুন এনে রাখে ওর মূলের কাছে। ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতা এত দাহ্য। রক্তরস শুকিয়ে আসে। প্লাজমা। মূলের কাছে এখনো পোড়া একটা দাগ। প্রায় মৃত একটা দেহ নিয়ে একা গাছ আরও খানিকটা বেঁটে হয়ে আসে। দুটো আঙুল দিয়ে টিপে দেখলে কাঠ রঙের ছাই।

 

৪.

দুলালির বাবা আয়ান, মা ইমামা। ইমামার বাড়ি ছিল দুটো গ্রাম পরে। ওদের শাদির বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুলালির জন্ম। সে বছর বাপের বাড়িতে উঠে আসে বাচ্চা সমেত ইমামা। আয়ান বছর ছয়েক এভাবে, ভাটায় যাবার আগে ইমামাদের শ্বশুরের জিম্মায় রেখে আসত। খাওয়াপরার খরচ হাফ হয়ে যেত। কিন্তু যখন শ্বশুর মরল, শ্বশুরের বউ এসে জুড়ল সংসারে, সে বছর ঘরসুদ্ধু চলল ভাটার আড়তে।

—নানির তখন খুব লাগালাগি মালিকের সাথে। ও মাল তো ফাঁসি গেইল। নানিও আলগা হয়া গেইল আমাদের থাকি।

আয়ান গত ছ-বছরে চার চারটে ভাটার বাচ্চার বাপ। ফিরে আসার মতো একটা থার্ড ব্রাকেট ছিল। তাই বাচ্চা সমেত ওদের মায়েদের ফেরত পাঠিয়ে দিত ভোটার কার্ডের মরদের কাছে।

এবার তেমনটা হলো না। ইমামা আয়ানের মাখামাখি দেখল আর বুঝতে চেষ্টা করল প্রতি বছরের হাফ মরসুমের নিজস্ব খরা। তার ওপর প্রতিদিনের প্রচণ্ড চাপের শেষে সহজ অথচ খোলামেলা অন্য নারীর প্রতি আসক্তি আয়ানকে যেভাবে অমাবস্যা ও গর্ত শেখাচ্ছে, ইমামাও তো মানুষ! শরীর টানছে। আর মরদের অভাব তো নেই। ইমামাও ঝুলে পড়ল।

অক্টোবর থেকে মার্চ, ইমামা পোয়াতি। আয়ান যেন এবার খুলে খেলছে। অন্যরকম পরিবার পরিকল্পনা। আর ইমামা নতুন মরদের সাথে নিয়ে যেতে চাইছে প্রথম মা ডাক। দুলালিকে।

নথি বলতে লোকাল পঞ্চায়েতের রেসিডেন্সিয়াল। আধার করা হয়নি। কত বছর মনে পড়ছে না, নিজের জন্মগ্রামে ফিরে বুঝতে পারছে, ভাগফল কখনোই মিলে যায় না এখানে। ঘরের লোক বদলালে ঘর বদলে যাবেই। ট্রাঙ্কটায় দুলালির নাম লেখা আছে নেইলপলিশে।

 

৫.

দুলালি পুরোনো আস্তানায় এসেছে। আয়ানের এখনকার সংসারে নাদিরা ও তাদের বাচ্চারা। এই ক-বছরে দুলালি বুঝতে পেরেছে স্রোতের বিপরীত কতটা তীক্ষ্ণ। কেন এমন সমঝোতার রাজনীতিতে, এমন বিনিময় প্রথায় মায়েরা সন্তানসহ মাইগ্রেট করে। কপালের ফেরে দুলালির কাছেও এখন চার পাঁচ জায়গার নথি। নথি বলতে লোকাল পঞ্চায়েতের রেসিডেন্সিয়াল। আধার করা হয়নি। কত বছর মনে পড়ছে না, নিজের জন্মগ্রামে ফিরে বুঝতে পারছে, ভাগফল কখনোই মিলে যায় না এখানে। ঘরের লোক বদলালে ঘর বদলে যাবেই। ট্রাঙ্কটায় দুলালির নাম লেখা আছে নেইলপলিশে। আয়ানের শরীর ভাঙলেও এখনো রস আছে।

আফজাল আনিজাল কোত্থেকে একটা হুইলচেয়ার ঠেলে আনে। ব্যবহারের পর বিক্রি করা একটা হুইলচেয়ার। আর তার সামান্য অংশ দখল করে বসে আছে বছর আড়াই একটা বাচ্চা, দেখে মনে হয় সিনড্রোম, দুলালি কোলে তুলে নেয়। ও খসিয়ে দিতে চেয়েছিল বাচ্চাটা। গাছপাতা শিকড়ের রস ট্রাই করেছিল। মরদটা ঝলসে গেছিল ভাটার আগুনে। শেষে একটা বর্ষা ভাটার ভেতর। দুলালি যখন মা হচ্ছে, তখন ওর বছর ষোলো বয়স।

 

৬.

একটা গল্প, গোল মতো, এখানেই শেষ হতে পারত। পঞ্চায়েত দুলালি আর ওর বাচ্চার আধার করে দিতে সাহায্য করল শর্ত সাপেক্ষে। শহরের ক্রেসে ঝিয়ের একটা কাজের জন্য কথা চলছে। এমন সময় ফোন এলো। গত বছরের মোহর দেওয়া স্বামী।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৯৫। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে। মূলত কবিতা লেখেন। তবে গল্প লিখতেও স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।