শনিবার, এপ্রিল ২৭

নির্বাচিত দশ কবিতা : মেঘ অদিতি

0

কনফেশন


সন্ন্যাস নেবার আগে
কনফেশন নির্যাস মেখে দেখেছি
মগ্নতায় ব্যাঘাত ঘটে না খুব
শুধু ভাসমান কথা থেকে সরে যায় কেউ
স্তব্ধ মগজ
আমি কাউকে ছুঁতে পারি না…
ইশারা-মাত্র অভিমান খুলে যায় জেনেও
মিলিয়ে গেল এক স্ফুলিঙ্গ…
সেই থেকে ভাষা ভুলে বসে আছি অন্ধকারে


স্মৃতিবিন্দু


যা কিছু গভীর তার সবটুকু দিয়েছি তোমাকে
মাছরাঙা নাভিতল নিভৃতের হরিতকি বন
তবু খোঁজো স্মৃতিবিন্দু, সঙ্গোপনে দেরাজে যখন
হৃদয় আগলে রাখি অর্থহীন অপার বিষাদে
নিজেকে সরিয়ে ভাবি এই বেশ লুকোচুরি খেলা
ছেঁড়াখোঁড়া ধারাপাতে থেকে যাবো এমন ভ্রমণে
এ তো সেই তুমি নও, যাকে আমি অনিরুদ্ধ জানি

চেতনার কোন স্তরে ভালোবাসা নিজেকে চেনায়?
উত্তর অজ্ঞাত তাই লক্ষ্যভেদী সে শিকার আমি
তুমি যাকে প্রেম বলো তাকে আমি স্পর্শ বলে জানি…


ঝাঁপতাল


যৌথ চাদরের ঢাল
ওখানে মুখ রেখেছে
চৌকো আলোয় মাতরিয়শকা
এক, দুই, তিন… অসংখ্য টুকরো কাচ
তুলে নিতে ভাবি
তুমি যদি বলো নিরাময়ের কথা
আমি কিন্তু ইশারা করছি অসুখহীনতার দিকে
শতাধিক ক্ষত নিয়ে সতর্কতায়
অদৃশ্যে বিভক্ত হতে হতে ভাবছি
এবার শিখে নেবো ঝাঁপতাল

একটা সেতু অন্তত জেগে থাক
এই মধ্যরাতে…


গুঞ্জন


এবার গুঞ্জন তোলো নওল বাতাস
মৃদুস্বরে হোক একবার টুং
ভেঙে ফেলা যাক পুরোনো থার্মোমিটার

সন্ধের ঘ্রাণ মেখে গুল্মলতার মুখবন্ধে
লিখে যাব জ্বরতপ্ত নিস্তব্ধতা
নিরুদ্দিষ্টের দিকে কুঁকড়ে থাকার দিনে
আপাতত নাভিপদ্মে এই বুদ হয়ে থাকা…


অপেক্ষা


ফুলের চেয়ে নরম কোনো অপেক্ষা

আর রেমাক্রীর জলে জলে বেপথু রোদ্দুর
ভাবা মাত্র ঘুমের ভেতর হেসে উঠল এক লুসিড ড্রিমার
তারপর, বহুদূরে সরে গেল আততায়ী মুখগুলো

মাথাভর্তি রোদ, ব্যক্তিগত যৌনতা অথবা
কাফেলা বিষয়ক কোনো সংলাপ ভাবতে গেলেই
আজকাল মনে পড়ে যাচ্ছে একটা দরজা খোলা এখনও বাকি…


অপমান


তুমি তো অমন নও—
গর্ভজলে সাঁতরে বেড়ায় যেমন চতুর বেড়াল
দরজায় তোলা খিল, মাংসের ঝোল আর
পত্রে লেখা, জীবন মরকতমণি

তুমি কি অমন?

আশ্বিনে ফোটা সকাল
কীভাবে মিশে যাচ্ছে দ্যাখো নীরব অপমানে…


ভুল ঠিকানা


এমন রাত্রিও তবে আসে—
আমার ডিঙিতে মোটে এইটুকু স্থিতি
বিসর্জনে চাঁদকুড়া খেলা করে তাতে

এখন মহানিম ফুঁড়ে দ্রুতযান উড়ে এলে
ঘুমপাড়ানি গানেরা নিভৃতে
ঘোলাচাঁদে লিখে যাবে ‘ইলাহি ভরসা’

আশরীর ডুবে যাবে গজস্কন্ধ এক
ভুল ঠিকানায়…


হায়াসিন্থ


হায়াসিন্থ ফুল নয় ফুলের অধিক কিছু আজ
এনেছে আমাকে টেনে বিরল এ সান্ধ্যশহরে
মাছের চোখের মতো ম্রিয়মাণ আলোগুলো জ্বেলে
আমাকে দেখাল যাকে, তার নাম হায়াসিন্থাস
আলোর দেবতা এলো, ধীরে, সমাধির অন্ধকারে
আকাশের রক্তমেঘ টুপটাপ কত ঝরে গেল
অঝোর কান্নায় শেষে নুয়ে গেল স্বয়ং অ্যাপোলো
চারধারে স্নেহফুল মৃত্যুহীন জন্মে বারেবারে
হায়াসিন্থ ঠিক আর ফুল নয় ফুলের অধিক
আমাকে এনেছে বেঁধে আজ তার রেশম রুমালে
আলো সব নিভে গেছে চেয়ে আছে তারার জমিন
যত ডাকি হায়াসিন্থ ধ্বনিগুলো আর্তনাদ করে
নিভন্ত কপট রাতে দূরে সেই সমাধি ফলকে
হায়াসিন্থ ফুল হয়ে থেকে যায় ব্যথার অধিক


বিষাদ তারা


বিষাদ তারাদের হঠাৎ ঝিকিমিকি
বাকলে লেখা নাম ঠিকরে ওঠে জ্বলে
আয়ুর বর্ণিল মৃত্যু চিনেছ কি!
নিঝুম বিকেলের ডানায় লিখে রাখি
আবছা সেই মুখ চোখের রেখা নীলে
বিষাদ তারাদের হঠাৎ ঝিকিমিকি
পুরনো টানেলের ভিতরে নানা বাঁকে
গোপনে ধূলিবাস নিয়েছ বহু ছলে
আয়ুর বর্ণিল মৃত্যু চিনেছ কি!
তিনিশ গাছেরাও জেনেছে কথা বাকি
আড়াল হলে তুমি কুহেলি ঢেকে নিলে
বিষাদ তারাদের হঠাৎ ঝিকিমিকি
তীয়রে ওঠে সুর মর্মে জ্বালা সেকি
ছলকে পড়ে ঘুম আদিম তরুমূলে
আয়ুর বর্ণিল মৃত্যু চিনেছ কি!
থেকেছ দূরে দূরে হাসিও ছিল মেকি
জানি না চুপচাপ কতটা উড়ে এলে
বিষাদ তারাদের হঠাৎ ঝিকিমিকি
আয়ুর বর্ণিল মৃত্যু চিনেছ কি?


বেবি বুমারস


হীরককণার মতো এইসব উজ্জ্বল সকাল, টাইমলাইন থেকে গড়িয়ে গেলে সবকিছুতেই জন্ম নেয় অবিশ্বাস। আমাদের পেট-বুক-ঊরু ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে ছায়াপথ আর উত্তর-দক্ষিণ প্রদক্ষিণ শেষে পূর্বপুরুষের ভিটেয় আপনি যখন স্কচের বোতল উপুড় করেন তৎক্ষনাৎ ঝনাৎ, শুরু হয়ে যায় মহামানুষের থ্রিলার…

হাওয়ায় তখন আপনার চুল উড়ে চলেছে পুবে
টাইমলাইন জুড়ে ঘি রঙা কোয়ান্টাম প্রকৃতি
ফাদার জর্জ লেমিত্রে হাত ধরছেন ব্রহ্মার
অথচ ভাবছেন তিনি মহাবিস্ফোরণের ভাবনা

ট্রেনের কামরায় এভাবেই ফুরিয়ে আসে
এইসব খুচরো ছোটো বিকেল
এভাবে দরজাও ফুরিয়ে আসে
জানলা আঁটো

সন্ধ্যা নেমেছে কিছু আগে
আপনি আপেলপাতায় হাত রাখলে
দ্রুত খুলে যায় তখন ঘূর্ণন পথ
লাল মাংস, মদ আর এটিএম বুথ
স্বভাবসুলভ আপনাকে স্বাগত জানায়

অতঃপর আপনি বলেন, ফেংশ্যুই মতে, বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ধাতব বস্তু রাখলে সম্পদ বৃদ্ধি হয়। এবং আফিম এক যুদ্ধের নাম।

এদিকে আপনি বেবি বুমারস, ফেংশ্যুই ছেড়ে আফিমের গল্প শোনাতে স্বর্ণতরলে সামান্য আকাশগঙ্গা মিলিয়ে হঠাৎ জেন এক্সকে বলেন, শপথ মেঘপুঞ্জের, শপথ স্বচ্ছ এই জলশরীরের, অদৃশ্য বস্তুকণার মতোই আপনার ওপর ভর করেছে এখন ডার্ক ম্যাটার।

অতএব কল্পনা কর। উপলব্ধি কর।

কল্পনা…
এবং উপলব্ধি…

বরফে মুড়ে থাকা পাহাড়ে পাহাড়ে বেজে ওঠে তখন প্রবল ঝড়ো হাওয়া।

উদ্দাম দৌড়ের পাশে বোতলে ফিরে যাচ্ছে গেলাসের স্কচ। বিরামচিহ্নের পাশে জেগে উঠছে সৃজনধ্বনি।

মন স্থাপন কর। বুদ্ধি স্থাপন কর। ধৈর্য ধারণ কর। তাকে দেখাও পথ।

জেন আলফা…
দে আর অলসো এক্সপেক্টেড টু বি দ্য লঙ্গেস্ট লিভিং জেনারেশন এজ ওয়েল এজ দ্য ওয়েলদিস্ট।
ঠিক যেন পুরনো টাইমফ্রেমে ফিরে যাওয়া

বলতে না বলতেই,
আপনি পরিণত হন এক বোতামে

বোতাম থেকে বিন্দুতে…
বিন্দু থেকে অদৃশ্যে…

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মেঘ অদিতির জন্ম বাংলাদেশের জামালপুরে। ঢাকায় থাকেন। পেশায় গ্রাফিক ডিজাইনার। তিনি মূলত কবি। পাশাপাশি গল্প এবং গদ্য চর্চা করেন। সম্পদনামণ্ডলির সঙ্গে যুক্ত আছেন ঐহিক নামক বাংলা ভাষাভিত্তিক ওয়েব পত্রিকার। ঐহিক বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

 

প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাতটি। কবিতার বই চারটি আর গল্পের তিনটি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।