শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

বাবা

0

মায়ের ছটফটানিটা টের পাচ্ছে তরী। ছোটবেলায় বাবা ফিরতে দেরি করলে এমন অকূল দুশ্চিন্তা তারও হত। তখন আর মোবাইল ফোন কোথায়? কী জানি কেন, বাবা ফিরতে দেরি করলেই মনে হত, কোনো বিপদ হয়নি তো? নব্বই-এর কলকাতার জ্যাম, কাজে আটকে পড়া… কিছু মাথায় আসত না। শুধু অনিষ্টচিন্তা হতো। সুবাস বলে, অনিষ্টচিন্তা ভালোবাসার লক্ষণ।

যে শৈশব ভুলে যেতে চায় তরী, সেই শৈশবে সে বাবাকে ভালোবাসত। বাবার সাইকেলের সামনের রডে বসেই টো টো ঘুরে বেড়ানো। বাবার কাছেই ঝোড়া-ভরা আবদার। মায়ের খাঁ খাঁ শাসনের একপাশে বাবার একফালি প্রশ্রয়ের মরুদ্যান। রোববার টিভিতে অ্যালিস যখন জাদু-গর্তে ঝাঁপ দেবে দেবে, সেই সময় বাবা গলা-খাঁকারি দিয়ে বলত, ‘ঠিক আছে, আর অঙ্ক করতে হবে না। আজকের মতো ছুটি।’ রান্নাঘর থেকে মা ছুটে আসত। উত্তেজনায় হাতের খুন্তি নড়ত এদিক ওদিক। ‘একদম না, প্র্যাক্টিস করুক। সবসময় ওর তীরে এসে তরী ডোবে।’

তরীর তখন বারো। শরীর-মন উচাটন। এক রোববারে ভদ্রলোক বলল, লেটারবক্স থেকে চিঠিপত্র নিয়ে আসতে। তরী গোছা-ভরা কাজের চিঠির মধ্যে পেল একটা আসমানি খাম, যার বুকে তারই নাম লেখা।

বাবা বলত, ‘বালাই ষাট! আমাদের সোনা তরী, ডুববে কেন?’

মনে মনে হেসে ফ্যালে তরী। সুবাসকে এসব গল্প বলা হয়নি। বলা হয়নি, কারণ ছোটবেলা মনে করতে তরীর ভালো লাগে না। মনে পড়েও না সব কিছু। ভারি পর্দা টেনে দিয়েছে স্মৃতির উপর। হেসে ফেলার পর তরী অবাক হয়। স্বগোতক্তির কালে অনেকদিন পর চরিত্রদের বিগত নামে ডাকল সে। বাবা। মা।

শৈশব বোঝেনি, স্নেহের হাত ধরে আসে খাঁচা। তরী মনে রাখতে চায় না সেই স্নেহ, যা নিঃশর্ত ছিল না, ছিল বাধ্যতা-হেতু উপঢৌকন। এই যে ভদ্রমহিলা, ছটফট করছে অনিষ্টচিন্তায়, সে খাঁচার অতন্দ্র প্রহরী ছিল। আর ওই যে ভদ্রলোক, কী বলা যায় তাকে? সে স্মিতহাস্য এক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। যাকে গলা চড়াতে হয় না, বন্দুক হাতে গারদ পাহারা দিতে হয় না৷ তবু যার অঙ্গুলি-হেলনের আভাস লেগে থাকে সব নিষেধে৷

তরীর তখন বারো। শরীর-মন উচাটন। এক রোববারে ভদ্রলোক বলল, লেটারবক্স থেকে চিঠিপত্র নিয়ে আসতে। তরী গোছা-ভরা কাজের চিঠির মধ্যে পেল একটা আসমানি খাম, যার বুকে তারই নাম লেখা। কী মনে হওয়ায় সে সবই তুলে দিয়েছিল ভদ্রলোকের হাতে। শিলিগুড়ির এক ইংরেজি স্কুলের হোস্টেলের রোদেলা বারান্দায় বসে এক ছেলে চিঠি লিখেছিল তাকে। তরী তাকে চোখে দেখেনি। জানা গেল, সে তুতো-দাদা শুভর ক্লাসমেট। সে সব ছিল চিঠিপত্রের কাল। দাদাকে পাঠানো কিছু এলোমেলো চিঠি, সে চিঠিতে লুকোনো কবিতা…দাদার সহপাঠীর মনে হয়েছিল, এমন পত্রপ্রেরকের সঙ্গে বন্ধুতা পাতালে হয়। চিঠিটি যেদিন এসেছিল, মহাকালি বালিকা বিদ্যালয়ের সাতের ক্লাসের তরী তিরতির কেঁপেছিল। চিঠি অবশ্য খুলতে পারেনি সে। ভদ্রলোক নির্মম টানে ছিঁড়েছিল খামের মুখ। দুজন মানুষ চিঠির উপর হামলে পড়েছিল, যেন কোনো সময়-বোমাকে নীরিক্ষণ করছে, যার তার কেটে ফেলতে হবে এখনই। তিরতির থেমে গেছিল। চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি।

কলেজের সময় পথিক এলো। যাদবপুরের মাঠে একদিন হাত ধরল সে। এবার ভুল করেনি তরী। গোপন রেখেছিল তিরতির। ততদিনে মোবাইল এসেছে, হোয়াটস্যাপ যদিও বহুদূর। বারবার এসএমএস আছড়ে পড়ত টুংটাং। প্রহরী খেয়াল করল। জানাল ঊর্ধ্বতনকে। তরী আবার ধরা পড়ে গেল। পথিকের এসএমএস পড়েছিল ভদ্রলোক মুক্তকণ্ঠে বসার ঘরে। নিজেকে উলঙ্গ লেগেছিল তরীর। তারপরেও কিছুদিন মাঠ, লাইব্রেরি, ক্যাম্পাস…একদিন এইট বিতে দাঁড়িয়ে দুজন। এস থার্টিওয়ানে উঠে চলে যাবে পথিক আর তরী ট্রেন ধরবে বাড়ি ফেরার। হঠাৎ পিঠে হাত। স্মিতহাস্য ভদ্রলোক। ‘বারণ করেছিলাম না?’ তরীকে পিছনে ঠেলে ভদ্রলোক দুজনের মাঝে। কেটে কেটে পথিককে বলেছিল— ‘আর একদিনও যদি…’

পথিকের কান লাল হয়েছিল। বাস-স্ট্যান্ডে ইতিউতি হাসাহাসি, কৌতূহলী চোখ। এস-একত্রিশ লঝঝরে হলেও পথিককে মুখ লুকোতে দিয়েছিল। সেদিনের পর আর কথা হয়নি। আরও একবার উলঙ্গ বোধ করেছিল তরী। বাড়ি ফিরতে প্রহরী মহিলা বলেছিল, ‘কোথায় যাও দিনরাত জানি না ভেবেছ? নোংরা মেয়েমানুষ…’

এ পর্যায়ে প্রথামাফিক অশান্তি হয়েছিল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। স্নেহ নামক খাঁচা সজোরে প্রত্যাখ্যান করে নিজের শরীর-মনের মালিকানা ফেরত নিয়েছিল তরী।

মহিলাকে এত অশ্লীল লাগেনি কখনও। বমনেচ্ছা হয়েছিল। সেই থেকে সামাজিক ডাক বাদে, ‘বাবা-মা’ শব্দরা অর্থহীন হয়ে গেল। নিজেকে শরীর ভিন্ন কিছু মনে হতো না, যে শরীরের শুদ্ধতা রক্ষাই প্রহরী ও তার ঊর্ধ্বতনের কাজ।

চাকরি পাওয়ার পর তরী বাড়ি ছেড়েছিল। পেয়িং গেস্ট কয়েক বছর। তারপর নিজের ছোট ফ্ল্যাট। এ পর্যায়ে প্রথামাফিক অশান্তি হয়েছিল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। স্নেহ নামক খাঁচা সজোরে প্রত্যাখ্যান করে নিজের শরীর-মনের মালিকানা ফেরত নিয়েছিল তরী। কর্তৃপক্ষ বলেছিল, ‘যাচ্ছ, যাও। এ বাড়ি থেকে আশা কোরো না কিছু।’ অক্ষমের বিলাপ। এ প্রৌঢ় অসহায়তায় খারাপই লেগেছিল। কিন্তু কী-ই বা করার ছিল!

কাল তরীর জন্মদিন। সে উপলক্ষে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাকেও ডাকে সে প্রতি বছর। এ ডাক ফেরায় না তারা। আগের দিনই চলে আসে। নিজের হাতে পরিবেশন করে মহিলা তরীর বন্ধুদের। কথাচ্ছলে জেনে নেয় তাদের ঠিকুজি-কুষ্ঠী। নিয়ন্ত্রণের এসব ব্যর্থ চেষ্টা তরী এখন ক্ষমার চোখে দেখে।

মহিলা আজও এসে পৌঁছেছে। বিশেষ মিটিং সেরে আসার কথা ভদ্রলোকের। কিন্তু এখনও এলো না সে। মহিলা ঘর-বার করছে। আবার ছোটবেলা মনে পড়ে যায় তরীর। অনেকদিন পর ‘মা’ ডাকতে ইচ্ছে করে। ‘বাবা’-কে ফোন করলে হয়। মিটিং-এর সময় ফোন করা মানা বলে তরী ইতস্তত করে।

ঘণ্টা দুই পরেও মোবাইল সুইচ অফ আসে। দুশ্চিন্তা বাড়ে। মাকে বোঝায় তরী, হয়তো চার্জ ফুরিয়েছে, হয়তো বাড়ি ফিরেছে বাবা, হয়তো… সুবাসকে ফোন করে তরী উৎকণ্ঠা ভাগ করতে। সুবাস বলে, তরীর পুরোনো বাড়ি গিয়ে একবার খোঁজ নিয়ে আসবে কি বাবা ফিরল কিনা?

প্রেসারের ওষুধ খাওয়ার সময় হলো মায়ের। তরী দুটি রুটি খেতে তাঁকে রাজি করায় কোনোমতে। মা অনিচ্ছায় দাঁতে রুটি ছিঁড়ছিল। সেই সময় ফোন এলো। অচেনা নম্বর।
‘হ্যালো, আপনি কি মিসেস ব্যানার্জি?’
‘বলছি।’
‘মিঃ ব্যানার্জির থেকে ফোন নাম্বার পাওয়া গেছে। আমি থানা থেকে বলছি।’

২.
রিক্সা এঁকেবেঁকে চলেছিল গলি-ঘুঁজি দিয়ে। নির্ঘুম রাতের টানা কান্নাকাটির পর মায়ের চোখ দুটি টকটকে লাল। থম মেরে বসে ছিল তরী। সুবাসকে জানানো হয়নি। বস্তুত জানানোর মতো কিছু জানা নেই। ফোনটার পর অনিষ্টচিন্তা, যা কিনা ভালোবাসার লক্ষণ, বুকের কাছে দলা পাকিয়ে শ্বাস রোধ করছিল। একপাশের কথাই শুনতে পাচ্ছিল তরী মিনিট খানেক। তারপর বিহ্বল মা ধপ করে বসে পড়েছিল চেয়ারে। তরী নিশ্চিত হয়ে গেছিল প্রাণঘাতী কোনো দুর্ঘটনার বিষয়ে। মা অথচ নিশ্চুপ। মায়ের কাঁধ ধরে ঝাঁকয়েছিল জোরে। মিনিট দুই পরে মা বলেছিল, ‘অ্যাক্সিডেন্ট নয়। থানায় আছে। কাল জামিনের জন্য যেতে বলছে।’ থানায়? কাস্টডি? কেন? তরীর সব হিসেব আবারও গুলিয়ে গেছিল। অচেনা নাম্বারে রিং ব্যাক করেছিল। কেউ ফোন ধরেনি।

কোন থানা, তা অবশ্য জানিয়েছিল পুলিশ। ভদ্রলোকের উপর যতই রাগ থাকুক, তরী ভেবে পায় না, কী অপরাধ তার পক্ষে সম্ভব। তরীর সঙ্গে ঘটা অপরাধ যা কিছু, সেসব আইনের চোখে অপরাধ নয়।

ঘ্যাঁচ করে রিক্সা ব্রেক কষতেই চিন্তারা ছিঁড়ে গেল। থানাটার বাইরের দেওয়ালে সদ্য বোলানো নীল-সাদা রঙের ঘ্রাণ। আড়মোড়া ভাঙছে উর্দি। ভদ্রলোকের নাম বলতেই তার চোখে যা চলকে ওঠে, তার নাম বোধহয় মস্করা। সেই হাসিতে, তরী খেয়াল করে, তার অনিষ্টচিন্তা উবে যায়। এতক্ষণ মনে হয়েছিল, কোথাও ভুল হচ্ছে। অথচ তা আর মনে হয় না। যেন কার্যকারণ সূত্রটি পাওয়া গেছে। ঘ্যাঁচাং ঘ্যাচাং করে কল টিপছিল যে তোয়ালে জড়ানো স্যান্ডো পরা যুবক, জানা গেল, ভদ্রলোককে জেলে পোরার সময় তারই ডিউটি ছিল সেকন্ড অফিসরের। এখন ডিউটি চেঞ্জ হয়েছে সদ্য। আরেক অফিসার বুঝে নিচ্ছেন কাগজপত্র। তাই অপেক্ষা করতে হবে। স্যান্ডো গেঞ্জি এগিয়ে আসে স্বতঃপ্রণোদিত। অর্থবহ দৃষ্টি হেনে তরীকে জিজ্ঞ্যেস করে, ‘ভদ্রলোকের মাথায় ছিট? ডাক্তার দেখান।’ কন্সট্যাবেলের নির্দেশ মতো ওরা বাইরের ঘরে বসে।

ভিতরটা এঁদো। রঙ, পলেস্তারা সব বাইরের জন্য। হিসির গন্ধ ভেসে আসে। নাক চাপা দেয় ভদ্রমহিলা। কনস্ট্যাবেল হলুদ দাঁত বের করে হাসে। ‘মারের চোটে মুতে ফ্যালে কিনা!’

মহিলার শিউরে ওঠা তরী টের পায়। কনস্ট্যাবলও পায়। ‘ঘাবড়াবেন না। ওঁকে মারা হয়নি। ভদ্রলোক, তার উপর বয়স্ক। এসব কেসে গায়ে হাত তোলার রিস্ক আছে। তবে কী করে যে এসব কেসে ফেঁসে যায়!’

তরী সুযোগটা হাতছাড়া করে না। চটজলদি জিজ্ঞেস করে— ‘কীরকম কেস?’

আবার হলুদ দাঁত। খিক খিক। ‘৩৫৪সি’। এই বলে কনস্ট্যাবল অন্তর্হিত হয়।

বিকট কা কা শব্দে চারটে কাক উচ্ছিষ্ট নিয়ে ছেঁড়াছেঁড়ি করছে পাশের বাড়ির টিনের চালে, জানলা দিয়ে দেখা যায়। কা কা ডাককে অট্টহাস্য বলে ভুল হয়। হলুদ দাঁতগুলো চোখ অতিক্রম করে কানেও ধ্বনি তুলছে। ভদ্রমহিলা বলে, ‘৩৫৪সি কী?’

গুগলের সার্চ বারে টাইপ করতে গিয়ে তরী টের পায়, তার হাত কাঁপছে। ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারীর ব্যক্তিগত ছবি তোলেন তাঁর অনুমতি ছাড়া…কিংবা যদি অনুমতি ক্রমে তোলা ছবি বিনা অনুমতিতে ছড়িয়ে দেন…’ অক্ষরগুলো সহাস্যে নর্তন করছে…এক থেকে তিন বছরের জেল…জরিমানা…তরী টের পায়, তার কান গরম হয়ে উঠছে। ছোটবেলায় ভদ্রলোক…ভদ্র বলা উচিত হবে কি?…লোকটা ছোটবেলায় বলত ‘তরী মায়ের টুকটুকে কান দেখেই বোঝা যায়, রাগ করেছে কিনা’…উফ, নাছোড় ছোটবেলা…হৃদয় খুঁড়ে শৈশবের মূলোৎপাটন করতে চায় তরী, রক্তাক্ত হয়।

অফিসার ঢোকে। ঘাড় কাত করে সৌজন্যসূচক। পুরোনো কাঠের চেয়ার আর্তনাদ করে বলিষ্ঠ হাতের টানে। সরাসরি কাজের কথায় যায় সে।

—উনি কি অসুস্থ? মানসিক বিকার আছে?

ফ্যালফ্যাল মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মা-মেয়ে।

—কাল টালিগঞ্জের মোড়ে লোকজন যেখানে বাসের অপেক্ষা করে…উনি নাকি ছবি তুলেছেন অপরিচিত মেয়েদের। বুঝতে পারছেন তো? ইয়ে মানে, বিশেষ বিশেষ অঙ্গের ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলেন। একটা মেয়ে প্রতিবাদ করে। লোক জড়ো হয়। ট্রাফিক পুলিশ তারপর আমাদের খবর দেয়। মানে ওঁর ভালোর জন্যই। বুঝতেই পারছেন…আজকালের মাথাগরম ছেলেমেয়ে। গায়ে হাত তুলত এরপর। তারপর ধরুন, রাস্তার লোকও হাতের সুখ করে নিত। থানায় নিয়ে এসে ভালোই হয়েছে একরকম। বেঁচে গেছেন।’

অপরাধীর স্ত্রী ডুকরে ওঠে। অথচ তরী লক্ষ্য করে, লজ্জা পাওয়ার মতো যে কিছু নেই, সে ব্যাপারেই অফিসারের স্বর-প্রক্ষেপন আশ্বস্ত করছে। যদিও মুখে সে বলছে বিকারের কথা, কিন্তু স্বর বিশ্বাসঘাতকতা করছে। তা বরং বলছে, এমন তো কতই হয়!

উনি নাকি ছবি তুলেছেন অপরিচিত মেয়েদের। বুঝতে পারছেন তো? ইয়ে মানে, বিশেষ বিশেষ অঙ্গের ছবি তোলার চেষ্টা করেছিলেন।

অফিসার চা বলেন মা-মেয়ের জন্য। তরী জানে, তাদের বেশভূষা ও চেহারা সমীহ উদ্রেক করে। থানায় এক কাপ চায়ের হকদার তারা আলবাত। লজ্জার বদলে, এই স্বাভাবিকতায় অস্বস্তি হয় তরীর।

‘ছেলেমেয়েগুলো ডেসপারেট, বুঝলেন কিনা! চাপে পড়েই কেস নিতে হলো। নাহলে ফেসবুক-টেসবুকে ছয়লাপ করে দিত। থানারও বদনাম হতো। বোঝেনই তো…নাহলে ওরকম বয়স্ক ভদ্রলোক। আমরা হয়তো ঘণ্টাদুই থানায় বসিয়ে ছেড়ে দিতাম।’

কান-এঁটো হাসি। এ দাঁতগুলো টুথপেস্টের বিজ্ঞাপনে শোভিত দন্তসারির মতো উদ্ভাসিত, হলদেটে নয়। হাসি থেকে আবারও স্বাভাকিকতা ঠিকরে আসে তীরের মতো। তরীকে বিদ্ধ করে।

পুলিশই বলে দেয় সম্ভাব্য উকিলের নাম। এ তল্লাটেই বাড়ি। পুলিশই জানায় তার ফোন নাম্বার। বলে, ‘এসব কেস এঁর কাছে নস্যি। আমরা আজ কোর্টে প্রোডিউস করব সেকন্ড হাফে। ইনিই জামিন করিয়ে দেবেন। আপনারা শুধু ফোন করে মালকড়ি যা লাগে…’

তরী বোঝে, সে মালকড়িতে সবারই বখরা আছে। তরীর অসহায় লাগে। বাবার কথা ভেবে কি? না। না। তরী স্থির জানে, এ অসহায়তার জাল ছড়াচ্ছে অন্যতর ঊর্ণনাভ।

৩.
মাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তরী। মহিলা ভেঙে পড়েছে। নিষ্ঠ কর্মচারী জেনেছে, কর্তৃপক্ষ ঠকিয়েছে তাকে। সময় চাই তার। সে এখন কাঁদুক-কঁকাক। যাবার আগে ভদ্রমহিলা হাত জড়িয়ে ধরেছিল, মনে করিয়ে দিয়েছিল সন্তানের কর্তব্য। তরী জানে, এখন মাথাকে ঘুম পাড়াতে হবে। যন্ত্রবৎ হাত পেতে কিছু নোট সংগ্রহ করতে হবে যন্ত্রের কাছে। তারপর পাওনা-গণ্ডা বুঝিয়ে দিয়ে আসতে হবে আইন-ব্যবসায়ীকে। এছাড়া উপায় নেই। যান্ত্রিকতাকে আবাহন করে তরী মনে-প্রাণে।

অথচ টাকা নিয়ে এটিএম বুথ থেকে বেরোনোর পরেই আবারও সেই পুরোনো অনুভূতি ফিরে আসে। যেন তাকে সবাই দেখছে। সে উলঙ্গ বোধ করে।

চেম্বারের বাইরে পরামর্শপ্রার্থী বসে আছে দুজন, এই সাতসকালেও। তরী তিন নম্বর সিটটিতে বসে। বাকি দুজন, এক তরুণ ও এক মধ্যবয়সী নারী, নিজেদের মধ্যে গুজগুজ করে চলে। একই পার্টি নিশ্চয়। কিছু পরে সহকারী এসে তাদের ডেকে নিয়ে যায়। তাড়া তাড়া কাগজ হাতে উঠে দাঁড়ায় তারা। তরী অপেক্ষা করে নাম লিখিয়ে।

ভিতর থেকে গূঢ় আলোচনা গড়িয়ে আসে এঘরেও। উকিল মহাশয়ের গলাখানি বাজখাঁই। ‘কত্ত রেপ কেসের বেইল করিয়ে দিলাম! আরে পক্‌সোতেও বেইল করিয়েছি আমি। ভরসা রাখুন।’ তরীর গা গুলিয়ে ওঠে। ঠিক সেই সময় ডাক পড়ে তার।

মুচকি হেসে আইনজ্ঞ বলেন, ‘পেটি কেস। বেইলেবেল-ও। তবে রেপুটেড মানুষ। এর পর সামলে রাখবেন। আজ রাতেই বাবা বাড়ি ফিরছেন, নিশ্চিন্ত থাকুন।’ কোনোমতে টাকাপয়সা বুঝিয়ে দেয় তরী। বেরিয়ে আসে সৌজন্যের নমস্কার ঠুকে।

চেম্বার পেরিয়ে তার গতি বাড়তে থাকে ক্রমে। রাস্তার লোক ফিরে তাকায়। ছুটছে কেন তরী? একটা ভ্যাট খুঁজছে সে। একটা ভ্যাট পেতেই হড়হড় বমি ঢেলে দেয়। কুকুরেরা ঘাড় তুলে তাকায়।

৪.
বাবা ডাইনিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে আছে। মাথা নিচু। আত্মকথনের মতো বলছে কিছু বিড়বিড় করে। ‘আমি জানতাম না। আমি জানতাম না, ওটা করলে কেস হয়। ওটা অপরাধ আমি জানতাম না।’

মা ঠক করে খাবারের থালা নামায় সামনে। আপাতত তারা তরীরই ফ্ল্যাটে। জন্মদিনের পার্টি ক্যান্সেল করা হয়েছে মায়ের অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে। সুবাসকে এখনও কিছু বলতে পারেনি তরী। সময় চেয়েছে। কী করে পিতৃ-অপরাধের কথা বলতে হয়? কী করেই বা নিজ-অপরাধের কথা বলে? তরী নিজেও কি অপরাধী নয়? অপরাধী-খালাসের বন্দোবস্ত করেছে যে হাত, সে হাত কি রক্তাক্ত নয়?

ভদ্রমহিলার ধৈর্য আর ক্ষমাশীলতায় তরী অবাক হয়। এ কি ভালোবাসা? প্রেম? নাকি অসহায়তা শুধু?

লোকটা সরিসৃপের মতো ঝুঁকে পড়ে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে এবার। মাটি সীতাদের যেভাবে গ্রহণ করে, যাকে তাকে সেইভাবে নয়। নিজের বেডরুমে চলে আসে তরী। ট্যাবলেট খোঁজে অ্যাংজাইটি-নিবারক। সে চায় না, তার গলা পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী শুনুক। বস্তুত, সেও কি চায় না এই আখ্যান চাপা দিতে, ভুলে যেতে?

লোকটি ত্রিশ বছরের পুরোনো স্ত্রীকে বলে, ‘বিশ্বাস করো, তেমন কিছু নয়। গায়ে হাত-টাত দেওয়ার ব্যাপার নয়। মোবাইল থাকলে কতরকম ছবিই তো তোলে কত লোকে।’

এক্ষণে কোথাও বাঁধ ভাঙে। তরী ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘তেমন কিছু নয়? কী বলতে চাও? তেমন কিছু নয়? আমার বুকের ছবি যদি তুলত বাসের বা রাস্তার কোনো লোক, সেটা তেমন কিছু হত না? ছিঃ!’ কান্না তার স্বরকে ভেঙেচুরে দেয়।

‘তুমি কীরকম তেমন কিছু-র ভয়ে আমাকে মিশতে দিতে না কারও সাথে? কীরকম তেমন কিছু? আসলে তোমরা ভয় পাও, নিজেদের নোংরামিকেই ভয় পাও। নিজেদের চেনো বলে…’

লোকটা সরিসৃপের মতো ঝুঁকে পড়ে মাটিতে মিশে যেতে চাইছে এবার। মাটি সীতাদের যেভাবে গ্রহণ করে, যাকে তাকে সেইভাবে নয়। নিজের বেডরুমে চলে আসে তরী। ট্যাবলেট খোঁজে অ্যাংজাইটি-নিবারক। সে চায় না, তার গলা পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী শুনুক। বস্তুত, সেও কি চায় না এই আখ্যান চাপা দিতে, ভুলে যেতে?

প্রেমিসের আলো নিভছে একে একে। ফ্ল্যাটবাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। নিস্তব্ধতার মধ্যে নারীর বিলাপ শুনতে পায় তরী। ‘মেনোপজের পর থেকে…আমার ইচ্ছে করে না, পারি না বলেই কি এরকম হলো!’

পুরুষটি নিশ্চুপ। মহিলা নিজেরই দোষ দেখছেন শেষমেশ। প্রবল কষ্টের মধ্যেই বিকট হাসি পায় তরীর। খুট শব্দে বেডরুমের দরজা খোলে সে। নারীটি পুরুষের বাহুলগ্না হয়ে কাঁদছে। পুরুষটি ক্ষমা চাইছে। তরীকে দেখে তারা একে অপরের থেকে দূরে সরে যায়। নিজের খাবারটুকু বেড়ে তরী আবার শোওয়ার ঘরে ফেরে। আয়নায় নিজের মুখোমুখি হয়।

এখন সব কিছু স্বাভাবিক তরী ব্যানার্জী। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। ‘স্বাভাবিকতা’ বজায় রাখতে তুমিই কি কম খেটেছ সারা দিনমান? খুশি তুমি? নিশ্চিন্ত? এত শান্ত স্বাভাবিকতা আজ রাতে তোমাকে ঘুমোতে দেবে তো?

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গদ্যকার, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক পেশায় শিক্ষক। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ : অ-নান্দনিক গল্পসংকলন  (ছোটগল্প) নারীবাদী চিঠি ও অন্যান্য  (প্রবন্ধ) খাদের ধারে ঘর  (সম্পাদিত) এছাড়াও একটি ওয়েব-ম্যাগ সম্পাদনা করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।