শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

বৈকালিক

0

ডিম পরোটার বিল দিতে গিয়েই ঝামেলাটা লাগল। জব্বারের দোকানের ছেলেটা কাপ-পিরিচ গোটাতে গোটাতে বলল, কে বিল দিবেন স্যার?

কেউ গাঁটের পয়সা খোয়াতে আগ্রহী বলে মনে হলো না। পরস্পরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি শুরু হলো। প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত রাখল কেবল পিআইও আর এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার। ইঞ্জিনিয়ার পিআইও’র হাতে হাত রেখে বললেন, আরে রাখেন তো ভাই। কয় টাকা আর বিল।

পিআইও আর ইঞ্জিনিয়ারের বিল পরিশোধের প্রতিযোগিতা দেখে আসরের সবাই ঠোঁট টিপে হাসতে শুরু করল। এই হাসির মধ্যে একটা ইঙ্গিত আছে। এই ইঙ্গিত বিনিময় তাদের প্রাত্যহিক বিনোদনের অংশ। পিআইও এবং ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন স্পোর্টস অফিসার। পাখনার দুপাশে দুটো হাত মেলে বলতে লাগলেন, বাবুল, এইবার তুই ডিসাইড কর কার থেকে বিল নিবি। শোন, যে স্যার টিপস বেশি দিবো তার ফেভারে যাবি কিন্তু!

বাংলা-ইংরেজিতে মেশানো প্যাসেজটার মর্মোদ্ধার করতে না পেরে বাবুল ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়ে রইল ইউএনও’র দিকে। যেন নকলের চোথাসহ ধরা পড়ে গেছে মাধ্যমিকের পরীক্ষায়।

ওয়েলফেয়ার অফিসার হস্ত-বিক্ষেপণ করতে করতে বয়ান শুরু করলেন, দিতে যখন চায় দুইজনের কাছ থেকেই নে ব্যাটা। স্যার গো কাছে তো আর টাকা টাকা না— তেজপাতা।

ইউএনও মৃদু হাসেন। মুখ খোলেন না। মুখ খুললেই বিপদ। যতক্ষণ পারা যায় হাসির উপর থাকাই ভালো।
ওয়েলফেয়ার অফিসার হস্ত-বিক্ষেপণ করতে করতে বয়ান শুরু করলেন, দিতে যখন চায় দুইজনের কাছ থেকেই নে ব্যাটা। স্যার গো কাছে তো আর টাকা টাকা না— তেজপাতা।

ইঞ্জিনিয়ারের মাথার দু’পাশের দুটো শিরা দপদপিয়ে উঠল। উপকার করতে গিয়ে অপমান! খোঁচা মারা হচ্ছে কঞ্জুসের দল। প্রতিদিন গলা পর্যন্ত খেয়ে নিয়ে বিল দেওয়ার সময় সবগুলো দুই ইঞ্জিনিয়ারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। যেন উপজেলার রাক্ষসগুলোর উদর-দহন নির্বাপনের দায় কেবল এই দুই জনেরই। এসব নিয়ে অবশ্য ইঞ্জিনিয়ারের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু সমস্যা হলো, গায়ে পড়ে করা উপকারের প্রতিদান ঠাট্টা আর পরিহাস! এই তো আসর ভেঙে গেলে ডিপ্লোমা বলে আড়ালে এরাই তুচ্ছ-তাচ্ছ্বিল্য করবে তাদের। মানছে, তারা গায়ে খেটে দুটো পয়সা রোজগার করে, তা নিয়ে এতো আকথা-কুকথার কি আছে! আরে বাবা, উপজেলায় কে কি কামাচ্ছে কম বেশি সবারই জানা। কিন্তু কই কারো তো কিছু হাতে ওঠে না। অন্যকে খাওয়ানোর জন্য আত্মা লাগে।

ইঞ্জিনিয়ারের আত্মা এতোই অসহিষ্ণু হয়ে উঠল যে গলার আওয়াজ বেড়ে গেল, কি বলেন! তেজপাতা! টাকা আমাদের কাছে তেজপাতা না শ্যাওড়া পাতা আপনি জানলেন কেমনে। আপনি কি আমার ভায়রা ভাই হোন।
ওয়েলফেয়ার অফিসার দাবড়ানি খেয়ে যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ল, আরে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব খেপেন কেন, একটু দুষ্টামি করলাম।
শোনেন মিস্টার, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অফিসিয়াল— এটা ভুলে যাবেন না। কী বলেন-টলেন একটু হিসাব কইরা বলবেন।
টিইও এতোক্ষণ তালে ছিল ইঞ্জিনিয়ারকে ধরার। তার বুকে অনেকদিনের জ্বালা। সুযোগ পাচ্ছে না তাই জানোয়ারটাকে ফাঁদে ফেলতে। লাস্ট ইয়ার পূর্বপাড়া স্কুলের নতুন চারটি ভবন হলো। ইউএনও আর ইঞ্জিনিয়ার মিলে সব বিল দিয়ে দিল। তাকে জিজ্ঞেসটা পর্যন্ত করল না। তার ভাগ কই?

টিইও যেন ইঞ্জিনিয়ারের নেতিয়ে পড়া রাগটা কুড়িয়ে নিল, হিসাব তো ভাই উপজেলায় একমাত্র আপনারাই বুঝেন। পূর্বপাড়া ইস্কুলে যে চারটা কামরা বানাইছেন সেইটা কোন হিসেবে বানাইলেন একটু বলবেন। বৃষ্টি হইলে ঝমঝমাইয়া পানি পড়ে। ওখানে তো ক্লাস-ট্লাস কিসসু হয় না। বেকার পইড়া আছে। কি করবেন এতো টাকা দিয়া। মরলে তো কিছু নিয়া যাইতে পারবেন না।

ইঞ্জিনিয়ারের দাবড়ানি বুমেরাং হয়ে তার কাছেই ফিরে এলো। জোঁকের মুখে লবণ পড়ার মতো ছটফট করে উঠল ইঞ্জিনিয়ার। ইউএনও’র দৃষ্টি আকর্ষণ করল, স্যার… আপনি তো বহুবার সাইট ইন্সপেকশনে গেছেন, স্যার আপনি…
আরে রাখেন স্যার স্যার, টিইও’র কণ্ঠে বিজয়ীর দৃঢ়তা। ইরানি বিটুমিন দিয়া রাস্তাঘাট বানাইয়া কি হাল করছেন উপজেলার তা সবাই দেখতেছে। স্যার স্যার কইরা আর কতো পার পাবেন…

আপনার মতো উপজেলার শ্রেষ্ঠ চাঁদাবাজের মুখে দুর্নীতির কথা মানায় না। ইঞ্জিনিয়ার এবার গর্জন করে উঠল। প্রাইমারির টিচারদের সঙ্গে আপনারা কি করেন সেটা উপজেলার সবাই জানে।

টিইও আর ইঞ্জিনিয়ার দু’জনেই উঠে দাঁড়াল। মুখোমুখি অবস্থান। বৃদ্ধ সাব-রেজিস্টার দাঁড়িয়ে দুজনকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন, আরে ভাই আপনারা কি শুরু করছেন…

ইউএনও বুঝলেন আর মুখ বন্ধ রাখা যাবে না। এভাবে পরস্পরের কাছায় হাত দেয়া শুরু করলে অচিরেই তাকেও নগ্ন হতে হবে। তাই তিনি এখনই ঝগড়া অবসানে তৎপর হয়ে ওঠেন। ইশারায় জব্বারের ছোকড়াটাকে কাছে ডেকে নিয়ে পাঁচশত টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলেন। তার পর হাসি বিগলিত ঠোঁট দুটো নড়ে চড়ে উঠল, একি শুরু করলেন…। আপনারা সবাই বসেন। উপজেলায় কে কি করছেন সবাই কম বেশি জানে। এ নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো। আমরা তো সবাই মিলে একটা টিম। আমরা আমরা যদি…

ফুড ইন্সপেক্টার দেরি করে এসেছিল। তাই আলোচনায় ঢুকতে পারছিল না। এতোক্ষণে তিনি একটা মওকা পেলেন, ঠিক বলেছেন স্যার। আমরা আর কয় টাকা বেতন পাই। সংসার চালানোর জন্য বাধ্য হয়ে উনিশ বিশ করি। এই নিয়ে এতো কথার কি আছে।

আপনাদের লাভের ভারে তো আমাদের স্কুলগুলো দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

শোনেন আমরা আপনাদের মতো মানুষের ওপর জুলুম করে খাই না, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ঘোষণা দিলেন। মেন্নত করে খাই। খবর নিয়ে দেখেন, কোন কন্ট্রাক্টার সাইটের জন্য ইঞ্জিনিয়ার রাখে। আমাদের দিয়ে সব কাজ করিয়ে নেয়। খুশি হয়ে যদি লাভের কিছু অংশ আমাদের দিয়ে যায়—
আপনাদের লাভের ভারে তো আমাদের স্কুলগুলো দু পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
হইছে তো স্যার এবার থামা দেন। স্পোর্টস অফিসার ফের রেফারির ভূমিকায়।

এর মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আবার উঠে দাঁড়ালেন। সবাই ভাবল রাগ করে আসর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু পরে দেখা গেল তিনি বাথরুমে ঢুকছেন। তাতে সবাই আশ্বস্ত হলো। কিন্তু ইউএনও সাহেবের কপালে চিন্তার গিঁট পড়ল। এই বাথরুমের যন্ত্রণায় রুমে আসর বসাতে চান না তিনি। একেকজন সারাদিনের বদ-অর্জনগুলো যেন এ বাথরুমে এসে ছাড়ে। গন্ধে আর ও-মুখ হওয়া যায় না। অনেকবার পানি ঢালার পর ব্যবহারের উপযোগী হয়।

শোনেন, ফুড ইন্সপেক্টার পেছন থেকে বলে উঠলেন। শুনি অন্যান্য ডিপার্টমেন্টে নাকি সরকারের অর্থ তছরুপ হয়। কিন্তু একমাত্র আমাদের ডিপার্টমেন্ট সরকারের টাকায় হাত দেয় না। আমরা ক্লায়েন্ট থেকে কামাই করে সরকারকেও দেই আমরাও খাই। হে হে হে…

কে যেন ফোড়ন কেটে উঠল ‘ইঁদুর কৃষকের পরমবন্ধু’। কথাটি শ্রুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
একাউন্টস অফিসার মাথার টুপি ঠিক করতে করতে বললেন, ভাই এসব বাজে কথা বাদ দেন ত। একটু পরকালের কথা ভাবেন।

পরকালের কথা ভাবতে এজি অফিসের কমিশন কতো দিতে হয় একাউনটেন্ট সাহেব। ওয়েলফেয়ার অফিসার কথাটা শেষ করতে পারল না, সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

একাউন্টস অফিসার হাল ছাড়বার পাত্র নয়। তিনি আবার চেষ্টা করেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবার, ভাই আমি একটা সিরিয়াস কথা শুরু করছিলাম, আপনারা আর আউগাইতে দিলেন না।
ফুড ইন্সপেক্টার উৎসাহ যোগাল ‘বলেন বলেন’ বলে।
ভাই আমরা যাই করি পেটের দায়ে করি। রহমানে রহিম সবই দেখেন, বুঝেন। এই নিয়ে কিছু বলার নেই। কিন্তু তার পরেও তো আখেরাতের কথা নলেজে রাখা লাগবো।
খুব খাঁটি কথা। পিআইও’র সায়।
এসময় বাথরুম থেকে বের হলেন ইঞ্জিনিয়ার। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে একটা দুর্গন্ধের দমকা বাতাস এসে হামলে পড়ল আসরে। সবাই নিজ নিজ ঘ্রাণেন্দ্রিয় সংরক্ষণে তৎপর হয়ে উঠলেন। ইউএনও বেল টিপে পিয়নকে ডাকলেন। পিয়ন এসে দরজা লাগিয়ে গেল।
বাথরুমের দরজা বন্ধের পর আবার আসর হারানো ছন্দ ফিরে পেল।
আমি বাথরুমে বসেই আপনাদের কথা শুনছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার আবেগাক্রান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন। খুবই গঠনমূলক একটা আলোচনা শুরু করেছেন একাউনটেন্ট সাহেব। আমিও মাঝে মাঝে ভাবি, কি করা যায় এই পয়সা কড়ি দিয়া। শেষ বিচারের দিনে কি জবাব দিমু—
সে চিন্তা কইরা কিছু করা দরকার…
কি করা যায় সেইটা বলেন।
এই যে আমরা হারাম রুজিগুলা করতেছি সেই সবরে হালাল কাজে লাগানো যায় কিনা সেইটা ভাবেন।
কি রকম?
এই ধরেন, আমাদের গরীব-গুরবা আত্মীয় স্বজনেরে সাহায্য সহযোগিতা করলাম।
খুব ভালো কথা।
ইঞ্জিনিয়ার আর একাউন্টস অফিসারের কথোপকথনে ঢুকে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছিলেন ফুড ইন্সপেক্টার। পস্ পেয়ে তিনি শুরু করে দিলেন, না না এইভাবে হারাম রুজি হালাল হয় না। আমার বড়ো ভাইজান বলেছেন—
তা উনি কি বলেছেন।
উনি কে আগে জেনে নেন। উনি বিরাট মুফতি। ভুবনডাঙা জামে মসজিদের পেশ ইমাম।
ও।
উনি বলেছেন, হারাম রুজি হালাল করার একটাই পথ আছে।
কী পথ?
মসজিদের বাথরুম বানানো। হারাম রুজি দিয়া কেবল মসজিদের বাথরুম বানানো যায়।
খুব ভালো পরামর্শ। ইঞ্জিনিয়ার আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠলেন।
তাইলে তো ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের এক বছরের আয় দিয়া উপজেলার সবগুলা মসজিদে একটা করে বাথরুম হয়ে যাবে। ওয়েলফেয়ার অফিসার হাসি হাসি মুখে বলে উঠলেন। কিন্তু পরের বছর কি করবেন?
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ওবজেকশন। টিইও চিৎকার করে উঠলেন। অবজেকশন। আমি এই ফতোয়া মেনে নিতে পারলাম না।
কেন কেন? ফুড ইন্সপেক্টারের প্রশ্ন।
আপনারা যদি আমারে একটু সময় দেন তাহলে আমি একটা এস্টোরি বলতে চাই। তার পর আপনার বিবেচনা করে বলবেন আমার অবজেকশন গ্রহণযোগ্য কিনা।
সবাই বলেন বলেন বলে সম্মতি জানাল।
ধরেন আপনার খুব বেগ পাইছে। বাথরুমে গিয়ে ডাইনে বায়ে না চেয়ে হালকা হওয়া শুরু করলেন। কমোড ভরাইয়া ফালাইলেন। কাজ শেষে দেখলেন কলে পানি নাই। টিস্যুও নাই। একটু পরে দেখলেন জলবিয়োগেরও চাপ পাইছে। এখন যদি চালাকি করে বিয়োগ করা পানি বদনায় রেখে তা দিয়া শৌচকর্ম সারেন; সেটা কি হবে? তার পর কি শরীর পাক হবে, বলেন?
টিইও’র লেকচার শেষ হতে পারল না। বাথরুমের গন্ধে ভারী হয়ে উঠল পুরো কামরা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জয়দীপ দে জন্ম ১৯৮০ সালে, চট্টগ্রামের রেলওয়ে হাসপাতালে। বাবা ছিলেন রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ার। সে সূত্রে রেলপাড়ায় বড়ো হওয়া। আদিভিটে সিলেটে। পড়াশোনা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় ছিল চারুকলা। বর্তমানে শিক্ষক প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। বিচিত্র বিষয় নিয়ে লেখালেখি করতে আনন্দবোধ করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৮ টি। গল্প গ্রন্থ: হারকিউলিসের পাখাউপন্যাস: কাসিদ, নিষুপ্ত ও গহন পথেভ্রমণকাহিনি: মাদ্রাজের চিঠিগবেষণা গ্রন্থ: রেলকে ঘিরে, বঙ্গবন্ধুর কলকাতা জয়সংকলন: একাত্তরের কার্টুন

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।