শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

শঙ্খ-স্মরণ : দিনগুলি রাতগুলি

0

১৯৯৬ সালে আমরা বীরভূমের এক অখ্যাত গ্রাম চিনপাই থেকে একটা কবিতাপত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিই। ‘আদম’। প্রথম থেকেই স্থির হয়, আড়ালে থাকা শক্তিশালী কবিরাই হবেন আমাদের পত্রিকার প্রধান অবলম্বন। যে সমস্ত তরুণ কবি অন্য রকম লিখতে চাইছেন, লিখছেনও, তাঁদেরকেও লেখা পাঠানোর জন্য আমন্ত্রণ জানাই। এবং প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিই, যাঁরা বিখ্যাত কবি, যাঁদের লেখালেখি বহুলপ্রচারিত কাগজগুলিতে নিয়মিত দেখা যায় তাঁদের কাছ থেকে আমরা লেখা চাইব না। তাঁরা যে আমাদের শত্রু, তা নয়, তাঁদের অনেকেরই কবিতা পছন্দ করি, পড়ি, পড়ে আলোড়িতও হই কিন্তু যেহেতু তাঁদের লেখা বড়ো বড়ো কাগজে প্রকাশিত হয় সেহেতু আমরা এইরকম কঠোর একটা সিদ্ধান্ত নিই। প্রথম সংখ্যায় আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক আড়ালে থাকা শক্তিশালী কবিদের অনেককেই আমন্ত্রণ জানাই। অধিকাংশ কবিই আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে কবিতা পাঠান। বিনয় মজুমদার এবং আলোক সরকারের কবিতা দিয়ে আমরা পত্রিকা শুরু করি। পরবর্তীকালে সূচিপত্রে একটু অদলবদল হলেও মূল জায়গা থেকে কখনো সরে দাঁড়ায়নি।

আমরা পত্রিকার জন্য কখনো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা জয় গোস্বামীর কাছ থেকে কবিতা বা গদ্য চাইনি। এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে আমি কর্মসূত্রে নদিয়ার তাহেরপুরে আসি। কলকাতার সঙ্গে একটা যোগাযোগও তৈরি হয়। কলকাতাতে থাকতেও শুরু করি। নিয়মিত কফিহাউস যাই। মূলত উৎপলকুমার বসুকে ঘিরে আমাদের আড্ডা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে আলাপ হয় কালীকৃষ্ণ গুহ, ভাস্কর চক্রবর্তী, অরুণ বসু, শম্ভু রক্ষিত, দেবদাস আচার্য, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, রণজিৎ দাশ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম বসু, গৌতম চৌধুরী, মৃদুল দাশগুপ্ত, একরাম আলি প্রমুখের সঙ্গে।

শঙ্খ ঘোষ-১--শ্রী

শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে গৌতম মণ্ডল

আমরা পত্রিকার জন্য কখনো নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় কিংবা জয় গোস্বামীর কাছ থেকে কবিতা বা গদ্য চাইনি। এভাবেই চলছিল। এর মধ্যে আমি কর্মসূত্রে নদিয়ার তাহেরপুরে আসি। কলকাতার সঙ্গে একটা যোগাযোগও তৈরি হয়। কলকাতাতে থাকতেও শুরু করি। নিয়মিত কফিহাউস যাই। মূলত উৎপলকুমার বসুকে ঘিরে আমাদের আড্ডা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে আলাপ হয় কালীকৃষ্ণ গুহ, ভাস্কর চক্রবর্তী, অরুণ বসু, শম্ভু রক্ষিত, দেবদাস আচার্য, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, রণজিৎ দাশ, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌতম বসু, গৌতম চৌধুরী, মৃদুল দাশগুপ্ত, একরাম আলি প্রমুখের সঙ্গে। তরুণ কবিদেরও অনেকের সঙ্গে বন্ধুতা তৈরি হয়। বিভিন্ন আড্ডায়, দেখি, শঙ্খ ঘোষের নাম ঘুরেফিরে আসে। সমীহের সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। অবশ্য কেউ কেউ এমনও দাবি করেন, শঙ্খ ঘোষ কোনো কবিই নয়, একজন গদ্যকার। এর মধ্যে ২০০৫ সাল নাগাদ প্রয়াত হন ভাস্করদা, কবি ভাস্কর চক্রবর্তী। আদম-এর উদ্যোগে কলেজ স্ট্রিটের স্টুডেন্টস হলে ভাস্করদার একটা স্মরণসভার আয়োজন হয়। মোটামুটি সে সভায় আসার জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই। কালীকৃষ্ণ গুহ এবং গৌতম বসু শঙ্খ ঘোষকে আমন্ত্রণ করেছি কিনা জানতে চান। শঙ্খ ঘোষকে আমি ডাকযোগে আদম পাঠাতাম ঠিকই কিন্তু কস্মিনকালেও তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। আমি এক দুপুরে দুরুদুরু বুকে তাঁকে ফোন করি। তিনি স্মরণসভার তারিখ সময় এবং স্থানের কথা জানতে চান। নির্দিষ্ট দিনে নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিতও হন তিনি। সেই প্রথম তাঁকে কাছ থেকে চাক্ষুষ দেখি। সেদিন আগের কথামতো সভায় কোনো কথা বলেননি তিনি তবে সভাস্থল ত্যাগ করেছিলেন সবার শেষে। সেদিনের সভা শেষ হওয়ার পর জানতে পারি, ভাস্করদা যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি সেসময় ভাস্করদার অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপি বানান শঙ্খ ঘোষ। ‘জিরাফের ভাষা’। বইটি প্রকাশের ব্যবস্থাও করেন। প্রকাশিত হলে শঙ্খ ঘোষ নিজে বইটির কিছু কপি নিয়ে হাসপাতালে যান এবং সেগুলো ভাস্করদার হাতে তুলে দেন। ভাস্করদা বইয়ের ব্যাপারটা কিছুই জানতেন না, তিনি অবাক হয়ে যান।

 


মাঝে মাঝে রবিবার শঙ্খ ঘোষের বাড়ি যেতে শুরু করেছি। ভালোও লাগছে সেই আড্ডা। কত ধরনের মানুষ। সবার জন্য অবারিত দ্বার। সবাই যে যাঁর মতো কথা বলে যাচ্ছেন, মাঝেমাঝে চা ও খাবার আসছে আর তিনি, শঙ্খ ঘোষ, সবার কথা মন দিয়ে শুনছেন। বলছেন কম। আরেকটা ব্যাপার খুব আকৃষ্ট করত; কেউ, সে যতই অকিঞ্চিৎকর হোক, বেরিয়ে গেলে শঙ্খ ঘোষ তাঁকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতেন। মাঝে মাঝে শঙ্খবাবুর বাড়ি গেলেও দু’একটা ব্যাপার আমাকে তখনও খুব ভাবাত। প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর সময়েরই একজন কবি, একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি, তাঁরা দুজনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেনও অথচ কবি হিসেবে কোনো পুরস্কারও পাননি এমনকি যোগ্য মর্যাদাটুকুও তিনি পাননি। শুধু কি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত? আলোক সরকার। মণীন্দ্র গুপ্ত। এঁরাও তো তেমন স্বীকৃতি পাননি। কবিতার জগতে এক অংশের মতো, এসবই শঙ্খ ঘোষের কাজ। নীরবতার রাজনীতি। এই রাজনীতির কথা আমিও যে অবিশ্বাস করতাম, তা নয়।

তবে ধীরে ধীরে মানুষটার যত কাছে আসি বুঝতে পারি তাঁর ব্যক্তিত্ব। সমুদ্রের মতো হৃদয়। মুক্ত মন। তিনি নিজে একটা প্রতিষ্ঠান হলেও, ছিটেফোঁটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার তাঁর মধ্যে নেই। তিনি নিজেও সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন, রাখেন।

তবে ধীরে ধীরে মানুষটার যত কাছে আসি বুঝতে পারি তাঁর ব্যক্তিত্ব। সমুদ্রের মতো হৃদয়। মুক্ত মন। তিনি নিজে একটা প্রতিষ্ঠান হলেও, ছিটেফোঁটা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার তাঁর মধ্যে নেই। তিনি নিজেও সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন, রাখেন।

শঙ্খ ঘোষ-২-শ্রী

শঙ্খ ঘোষ

এইরকম একজন মানুষ, একজন কবি শুধু বিখ্যাত বলে তাঁর কবিতা নেব না? তাঁর লেখা না নেওয়া আসলে নিজেকেই, নিজের পত্রিকাকে পত্রিকার পাঠকদের বঞ্চিত করা। একদিন ফেরার সময়, কেউ নেই ঘরে, আমি বলি আমার কথা। পত্রিকাটা কেন বের করি, তার কথা। তিনি আমার উদ্দেশ্যকে বাহবা দেন। কিন্তু আমি বলতে চাই, বলিও, আমি আমার মৌলবাদী অবস্থান থেকে সরতে চাই।

আমার নাছোড়বান্দা অবস্থান দেখে তিনি বলেন, এখন হাতে তো কিছু নেই। হলে দেব। দুসপ্তাহ বাদে তিনি একটা খাম দেন। খামের ভিতর কবিতা। ২০১০ সালের আদম-এর একটি সংখ্যায় সেটি প্রকাশিত হয়। এরপর আর কখনো শঙ্খবাবুর লেখা ছাড়া, তা কবিতা হোক বা প্রবন্ধ, আদম প্রকাশিত হয়নি।

 


ইতিমধ্যে আদম-এর আকার পৃথুল হয়েছে। এছাড়াও আদম একটা প্রকাশনা সংস্থা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করেছে। দেবদাস আচার্য, কালীকৃষ্ণ গুহ, গৌতম বসু, নির্মল হালদার প্রমুখের বই বেরিয়েছে। বেরিয়েছে কমলকুমার মজুমদারের স্ত্রী দয়াময়ী মজুমদারের বই। ‘আমার স্বামী কমলকুমার’। কাজ চলছে মণীন্দ্র গুপ্তের ‘কবিতাসংগ্রহ’র।

২০১১ এর বইমেলা চলাকালীন ‘কবিতাসংগ্রহ’ কিছু কপি বাইন্ডিং হয়ে আমাদের হাতে আসে। আমি মণীন্দ্রবাবুর বাড়ি হয়ে শঙ্খ বাবুর বাড়ি যাই। তাঁকে মণীন্দ্র গুপ্তের ‘কবিতাসংগ্রহ’টি দেখাই। এবং জিজ্ঞেস করি, আজ বইমেলা যাবেন কি না। উনি না বললে, আমি বলি, স্যার যেতে হবে আজ। কারণ মেলাতে বইটার একটা আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটাতে চাই। আপনাকেই প্রকাশ করতে হবে সেটা।

আমি মণীন্দ্রবাবুর বাড়ি হয়ে শঙ্খ বাবুর বাড়ি যাই। তাঁকে মণীন্দ্র গুপ্তের ‘কবিতাসংগ্রহ’টি দেখাই। এবং জিজ্ঞেস করি, আজ বইমেলা যাবেন কি না। উনি না বললে, আমি বলি, স্যার যেতে হবে আজ। কারণ মেলাতে বইটার একটা আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটাতে চাই। আপনাকেই প্রকাশ করতে হবে সেটা। আরও একটা ব্যাপার তাঁকে বলি, কোনো মঞ্চে বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হবে না, কোনো লাউডস্পিকার থাকবে না, এমনকি কবি নিজেও থাকবেন না। শুধু কয়েকজন তরুণ কবি থাকবে। শঙ্খ ঘোষ রাজি হয়ে যান কিন্তু তিনি বলেন, আমি আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটালে মণীন্দ্রবাবুর কোনো আপত্তি থাকবে না তো!

আরও একটা ব্যাপার তাঁকে বলি, কোনো মঞ্চে বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হবে না, কোনো লাউডস্পিকার থাকবে না, এমনকি কবি নিজেও থাকবেন না। শুধু কয়েকজন তরুণ কবি থাকবে। শঙ্খ ঘোষ রাজি হয়ে যান কিন্তু তিনি বলেন, আমি আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটালে মণীন্দ্রবাবুর কোনো আপত্তি থাকবে না তো!

শঙ্খ ঘোষ-৩-শ্রী

আদম আয়োজিত মণীন্দ্র গুপ্তের স্মরণসভায় শঙ্খ ঘোষ

আমি মণীন্দ্রবাবুকে সকালে জানিয়েছিলাম বইটা শঙ্খ বাবু প্রকাশ করতে পারেন। তিনি কোনো আপত্তি করেননি। তবু শঙ্খ ঘোষ যখন চাইছেন, তখন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসে মণীন্দ্র গুপ্তকে ফোন করি। তিনি সানন্দে সম্মতি দেন। সন্ধ্যার কিছু আগে শঙ্খবাবু লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে চলে আসেন। আমি তাঁকে আদম-এর টেবিলের সামনে নিয়ে আসি। গুটিকয়েক তরুণ কবির উপস্থিতিতে শঙ্খ ঘোষের হাত দিয়ে প্রকাশিত হয় অমূল্য সেই বই। মণীন্দ্র গুপ্তের ‘কবিতাসংগ্রহ’।

 

৪.
২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে আদম-এর একটা সংখ্যা করার প্রস্তুতি নিই। সংখ্যাটিতে সাধারণ বিভাগের পাশাপাশি ছিল দুটি ক্রোড়পত্র। একটা ক্রোড়পত্রের বিষয় ছিল : চিত্রকর রবীন্দ্রনাথ। এই বিভাগে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এমন ২৬ টি চিঠি ছাপা হয়েছিল যেখানে রবীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনা প্রকাশিত হয়েছিল। চিঠিগুলো প্রুফ দেখতে গিয়ে একটা সমস্যায় পড়েছিলাম। একই চিঠি, দেখা যাচ্ছিল, দুজায়গায় দুরকম। ঈষৎ পরিবর্তিত। বানানেরও ঈষৎ পরিবর্তন রয়েছে। যেমন ধরুন, দেখিনি। কোথাও আছে দেখিনি কোথাও আবার নি আলাদা। দেখি নি। এরকম অবস্থায় কোনটা ফলো করব, সেটা একটা প্রশ্ন। প্রশ্নের সমাধান হয়তো নিজেই কিছুটা করা যেত যদি খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘চিঠিপত্র’ বইটা আমার কাছে থাকত। কিন্তু ওই খণ্ডগুলো আমার কাছে ছিল না, সেগুলো বইপাড়ায় কিনতেও পাওয়া যাচ্ছিল না। এমতাবস্থায় উপায়? শঙ্খবাবুকে একথা জানালে, তিনি বলেন, প্রুফটা রেখে যাও, আমি দেখে দেব। আমি তো সানন্দে প্রুফটা তাঁর হাতে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। ভাবি, নিশ্চয় কিছুটা সময় লাগবে। অন্তত দিন পনেরো তো বটেই। কিন্তু, কী আশ্চর্য, তিন চারদিন বাদেই দেখি তাঁর ফোন। ফোনের ওপার থেকে তাঁর গম্ভীর গলা: তোমার প্রুফটা দেখা হয়ে গেছে। পরের রবিবারই তাঁর বাড়ি গেলে তিনি আমার হাতে তুলে দেন অমূল্য সেই সম্পদ। প্রুফ। প্রুফটা দিয়ে তিনি সেসময় একটা মূল্যবান কথাও বলেন। কথাটা আমি আজও অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। ‘যেকোনো লেখা, যেটাতে লেখক এডিট করেননি, সেটা উদ্ধৃত করতে গেলে প্রথম সোর্স-এর উপর সবসময় নির্ভর করবে।’

 


নিজে লেখালিখি ও পত্রিকা সম্পাদনার পর কৃষ্ণনগর থেকে প্রকাশনার কাজ চালানো মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কী করব? বন্ধ করে দেব? হঠাৎই মাথায় আসে কারো সঙ্গে শেয়ারে কলেজ স্ট্রিটে ঘর নিলে কেমন হয়? দপ্তরের কাজ তো হবেই পাশাপাশি নিজেদের বইপত্র বিক্রয়ের একটা কেন্দ্রও হবে। ডিটিপির কাজও হতে পারে। খুঁজতে খুঁজতে পলাশের সঙ্গে দেখা হয়। পলাশ বর্মন। তার একটা প্রকাশনা রয়েছে। কলিকাতা লেটারপ্রেস। ৩ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটে তার দপ্তর। সে প্রস্তাব দেয় আমার আপত্তি না থাকলে ওই ঘরটিকে দুজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। আমি কিছুদিন ভাবনা চিন্তা করার পর সায় দিই।

শঙ্খ ঘোষ-৪-শ্রী

আদম-এর কলেজ স্ট্রিটের দপ্তরে প্রভাত সাহা প্রণীত ‘অস্তিত্বের ভিক্ষাভাষা’ কাব্যগ্রন্থটি উদ্বোধন করছেন শঙ্খ ঘোষ। পাশে রয়েছেন কালীকৃষ্ণ গুহ, প্রভাত সাহা এবং গৌতম মণ্ডল

বইপাড়ায় আদম-এর দপ্তর, তা শুরু হবে এমনি এমনি? কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই? শঙ্খবাবুকে ব্যাপারটা জানাই। তাঁকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। তিনি এককথায় রাজি হয়ে যান। ২০১৮-এর ১ অক্টোবর। আমরা ঘরদুটিকে সাজাতে থাকি। সাজানো সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নির্ধারিত সময়ে তিনি এসে পৌঁছান। কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর একটা জলের পাত্রে কিছু ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দেন তিনি। এভাবেই বইপাড়ায় আমাদের যৌথযাত্রা শুরু হয়। সেইসন্ধ্যায় তিনটি কাব্যগ্রন্থও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন তিনি। আদম থেকে প্রকাশিত এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ হলো প্রভাত সাহার ‘অস্তিত্বের ভিক্ষাভাষা’, হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নক্ষত্রবীথিকা’ এবং অমিতাভ মণ্ডলের ‘সুন্দর’। সেই সন্ধ্যায় শঙ্খ ঘোষ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কালীকৃষ্ণ গুহ, গৌতম বসু, একরাম আলি, অনুরাধা মহাপাত্র, হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাত সাহাসহ আরও অনেকে। শঙ্খ ঘোষ সচরাচর খুব কম কথা বলেন কিন্তু সেদিন তিনি ছিলেন মুখর।

 


২০১৩ সাল থেকে আমরা আদমসম্মাননা চালু করি। প্রথম বছর আজীবন কবিতাযাপন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য যুগ্মভাবে আদমসম্মাননা জ্ঞাপন করি আলোক সরকার ও শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়কে। সম্পাদনা, গবেষণা এবং কবিতা রচনার জন্য এই সম্মাননা পান ভূমেন্দ্র গুহ। চিত্রশিল্পী হিসেবে হিরণ মিত্র এবং লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের জন্য সন্দীপ দত্তকে দেওয়া হয় এই সম্মাননা। ‘অনুবর্তন’ পত্রিকাও সম্মানিত হয়। দুইবাংলার চারজন তরুণ কবিকে আদমসম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়। এঁরা হলেন জিৎ মুখোপাধ্যায়, দেবাশিস মহারানা, নওশাদ জামিল এবং সোহেল হাসান গালিব। অনুষ্ঠানটি হয়েছিল রোটারি সদনে। এখানেও অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে শঙ্খ ঘোষ উপস্থিত হয়েছিলেন। শুধু এই অনুষ্ঠানে নয়, আদম-এর বেশির ভাগ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত থেকেছেন।

আমরা একবছর আজীবন কবিতাযাপন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য আদমসম্মাননা জ্ঞাপন করতে চেয়েছিলাম তাঁকে। তাঁকে সেকথা একাধিকবার বলেওছিলাম। আবেদন নিবেদন করেছিলাম। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি।

কিন্তু একটা ব্যাপারে, খুবই দুর্ভাগ্য, কিছুতেই তাঁকে রাজি করাতে পারিনি। আমরা একবছর আজীবন কবিতাযাপন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য আদমসম্মাননা জ্ঞাপন করতে চেয়েছিলাম তাঁকে। তাঁকে সেকথা একাধিকবার বলেওছিলাম। আবেদন নিবেদন করেছিলাম। কিন্তু তিনি কিছুতেই রাজি হননি। তিনি একটাই কথা বলতেন, তুমি এখানে নিয়মিত আসো, তোমাদের কাছ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করলে অন্য রকম বার্তা যাবে। নিরুপায় হয়ে, তাঁকে নিয়ে একটা আদম-এর একটা সংখ্যা প্রকাশ করার অনুমতি চাই। আদম শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা। কিন্তু তাতেও তিনি রাজি হননি। তিনি বলেন, আরও অনেক কাজ আছে, সেগুলো করো। নিজে লেখো।

শঙ্খ ঘোষ-৫-শ্রী

কবি দেবদাস আচার্যকে আদমের পক্ষ থেকে সম্মানিত করছেন শঙ্খ ঘোষ

 


মণীন্দ্র গুপ্ত প্রয়াত হন ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। আমরা ২৪ মার্চ মহাবোধি সোসাইটি সভাঘরে একটি স্মরণসভার আয়োজন করি। এই সভাতেও অশক্ত শরীর নিয়েও নির্ধারিত সময়ের আগেই উপস্থিত হন শঙ্খ ঘোষ। রঞ্জিত সিংহও এসেছিলেন যথাসময়ে। মণীন্দ্রবাবুর ছবিতে মাল্যদান করার পর আদম মণীন্দ্র গুপ্ত সংখ্যা আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করেন তাঁরা দুজনে। এরপর শুরু হয় মণীন্দ্র গুপ্তকে নিয়ে স্মৃতিচারণ । কেউ কেউ মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার নানান স্তর নিয়ে আলোচনা করেন, কেউ আবার তাঁর গদ্য, বিশেষ করে ‘অক্ষয় মালবেরি’ নিয়ে কথা বলেন। আমাদের এক সিনিয়র কবিবন্ধু, তিনি মণীন্দ্র গুপ্তের খুব ভক্ত, তাঁকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম কিছু বলবার জন্য। তাঁকে পোডিয়ামে ডাকি। তিনি কিছুক্ষণ মণীন্দ্র গুপ্তর কবিতা নিয়ে বলবার পরই হঠাৎ করে শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে বলতে শুরু করেন। নাম উল্লেখ না করে তিনি বলতে থাকেন, শঙ্খ ঘোষ একটা কুৎসিত লোক, তিনি সারা জীবন কবিতায় রাজনীতি করে গিয়েছেন, তাঁর জন্যই মণীন্দ্র গুপ্তের মতো কবি ও গদ্যকার অনালোকিত থেকে গেছেন। আমি আমার কবিবন্ধুর কাণ্ডজ্ঞান দেখে অবাক হই। লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। কেননা আমিই তো শঙ্খবাবুকে ডেকে নিয়ে এসেছি। এই বয়সেও, ৮৮ বছর বয়স, তিনি অশক্ত শরীর নিয়েও এসেছেন। তাঁকে শ্রদ্ধা না করতে পারি কিন্তু অসম্মান করতে পারি না। কিন্তু কীভাবে বোঝাব তাঁকে? বন্ধুটিকে? যায় হোক, তাঁর বক্তৃতা একসময় থামে। তারপর আরও কিছুক্ষণ সভা চলে। সভা শেষ হলে আমি কাঁচুমাচু হয়ে কিছু বলতে যাই। তিনি আমাকে নিরস্ত্র করেন। আমি তাঁকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিই। বাড়ি ফেরার পথে যেতে যেতে ভাবি, আমি কোনোদিন সামনে বলিনি ঠিকই কিন্তু আমিও তো একসময় ভাবতাম, এই লোকটা আলোক সরকার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং বিনয় মজুমদারকে চেপে দিয়েছে!

 


২০১৮ সালে ডিসেম্বরে আজীবন কবিতাযাপন ও কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য আদমসম্মাননা জ্ঞাপন করা হয় যুগ্মভাবে দেবদাস আচার্য এবং পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালকে। আর সম্পাদনা, গবেষণা এবং কবিতারচনার জন্য এই সম্মাননা দেওয়া হয় দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তরুণ কবি হিসেবে এই সম্মাননা পান বাংলাদেশের দুই তরুণ কবি বিধান সাহা এবং রিমঝিম আহমেদ আর ভারত থেকে শৌভ, শৌভ চট্টোপাধ্যায়। এই সভাতেও আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম শঙ্খবাবুকে। তিনি যথাসময়ে এসেওছিলেন। তাঁর হাত দিয়ে প্রাপকদের হাতে মানপত্র ও সম্মাননা-অভিজ্ঞান তুলে দিই। তবে আর সবাই উপস্থিত থাকলেও রোটারি সদনের ওই সভায় অসুস্থতার কারণে উপস্থিত থাকতে পারেননি পার্থদা। কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। সভাশেষে স্থির হয় পার্থদার বাড়িতে গিয়ে সম্মাননা জানিয়ে আসব। কিন্তু শঙ্খবাবুও যে যাবেন, তা আমরা ভাবতে পারিনি। একদিন রবিবারের আড্ডায় সে প্রসঙ্গ উঠলে তিনি নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পার্থদার বাড়ি যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তবে একইসঙ্গে এও জানান, পার্থকে আমি যেন অবশ্যই জিজ্ঞেস করে নিই, তাঁর হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করতে সে রাজি আছে কিনা।

পার্থদা রাজি ছিলেন, কিন্তু দিন দুয়েক পরে বেঁকে বসেন। তাঁর বক্তব্য, তাঁরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই অথর্ব। এই অবস্থায় শঙ্খদা আসুক, তা তিনি চান না। এই সংবাদ আমি শঙ্খবাবুকে জানাই। তিনি মুচকি হাসেন। এর কিছুদিন পর একদিন পার্থদার কাছ থেকে একটা ফোন পাই। তিনি আমাদের আসতে বলেন এবং শঙ্খদাও এলেও তাঁর কোনো অসুবিধে নেই, তা জানান।

পার্থদা রাজি ছিলেন, কিন্তু দিন দুয়েক পরে বেঁকে বসেন। তাঁর বক্তব্য, তাঁরা স্বামী স্ত্রী দুজনেই অথর্ব। এই অবস্থায় শঙ্খদা আসুক, তা তিনি চান না। এই সংবাদ আমি শঙ্খবাবুকে জানাই। তিনি মুচকি হাসেন। এর কিছুদিন পর একদিন পার্থদার কাছ থেকে একটা ফোন পাই। তিনি আমাদের আসতে বলেন এবং শঙ্খদাও এলেও তাঁর কোনো অসুবিধে নেই, তা জানান। আমি এই বার্তা দ্রুত শঙ্খবাবুকে জানিয়ে দিই। তারপর যাওয়ার জন্য একটা ডেট ঠিক হয়। নির্ধারিত দিনে শঙ্খ বাবুর বাড়ি পৌঁছলে দেখি তিনি রেডি হয়ে বসে আছেন। গৌতম বসুকে আগেই বলে রেখেছিলাম, তিনিও, দেখি, রেডি হয়ে চলে এসেছেন। এসেছেন একরামদাও, একরাম আলি। এরপর গাড়িতে রওনা দিই পার্থদার বাড়ি। পার্থদার বাড়িতে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমন্তদা ও পার্থদা দুজনেই আমাদের ঘরে ঢুকতে বলেন। আমরা ঢুকি এবং পার্থদার ঘরে বসি। কিছুক্ষণের মধ্যে হুইলচেয়ারে করে আসেন পার্থদার স্ত্রী। অঞ্জনা কাঞ্জিলাল। আড্ডা ক্রমশ জমে ওঠে। নানান ধরনের কথাবার্তা হয়। গ্রহ নক্ষত্র তিথির কথা। রোগের কথা। হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কথা। পার্থদা যেসময় শঙ্খ বাবুর শ্যামবাজারের ফ্ল্যাটে যেতেন সেসময়কার কথাও উঠে আসে। উঠে আসে নিশীথদার কথা, নিশীথ ভড়। এরপর সম্মাননা পর্ব শুরু হয়। মানপত্র পাঠ করেন হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। সেটি এবং সম্মাননা-অভিজ্ঞান এবং পুরস্কারমূল্য পার্থদার হাতে তুলে দেন শঙ্খ ঘোষ।

এই ঘটনায় আমার চোখে প্রায় জল চলে এসে যায়। একজন জ্ঞানপীঠ পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি, যিনি সুস্থ নন, বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তিনি একজন অনুজ কবির বাড়িতে গিয়ে তাঁকে একটা লিটল ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে সম্মাননা জ্ঞাপন করছেন!

 

৯.
শঙ্খ ঘোষ শুধুমাত্র সময় ও সমাজের দায়বদ্ধতা থেকে কবিতা লিখতেন, তা নয়। শাসক, তিনি যে দলেরই হোন না কেন, অনাচার করলে তার বিরুদ্ধে তিনি রাস্তায় নামতেও পিছুপা হতেন না। নন্দীগ্রাম গণহত্যার সময় মূলত তাঁরই নেতৃত্বে মহানগরে মহামিছিল হয়েছিল। যা শাসকের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ওই মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হাঁটতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিছিল যাতে অরাজনৈতিক থাকে সেকারণে তিনি চাননি মমতা হাঁটুক। ওদিকে কবির মান ভাঙাতে তাঁর বাড়ি চলে গেছিলেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। কিন্তু বিমান বসুর কোনো যুক্তিই তিনি শোনেননি। তিনি শাসকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কিন্তু শুধুই কি নন্দীগ্রাম? তৃণমূলের সময় কামদুনির ঘটনা ঘটলে তখনও তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন। বস্তুত যখনই অনাচার মাত্রাছাড়া হয়েছে তখনই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এমনকি অটলবিহারি বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি তাঁর হাত থেকে সরস্বতী সম্মান নিতে অস্বীকার করেন। জীবনে তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন কিন্তু সব পুরস্কারের অর্থমূল্য কোনো না কোনো সংস্থাকে দান করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশ কয়েকটা ঘটনার কথা জানি যেখানে তিনি অসুস্থ কবিকে আর্থিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বহু কবির বইপ্রকাশের ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষেই তিনি ছিলেন জাতির বিবেক। আমি তো তাঁর বাড়িটাকে লাইব্রেরি হিসেবে দেখতাম। প্রায়ই তাঁর বাড়ি থেকে পছন্দের বই নিয়ে আসতাম পড়ার জন্য।

 

১০
অনেকেই, বস্তুত বেশিরভাগ মানুষই শঙ্খ ঘোষকে গুরুগম্ভীর ব্যক্তি হিসেবে জানতেন। তিনি গুরুগম্ভীর ঠিকই সেটা তাঁর একটা রূপ, বাইরের রূপ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন রসিক মানুষ। যাঁরা তাঁর সঙ্গে একটু গভীরভাবে মিশেছেন তাঁরা তাঁর এই রূপের কথা জানেন।

বিয়ে করে ফেরার সময় প্রতিমা জেঠিমার মা তাঁর জামাইকে বলেন, আমার মেয়ের পাশাপাশি থেকো তাহলে দেখবে একদিন তুমিও ফর্সা হয়ে গেছ। একথা শুনে শঙ্খ ঘোষ তৎক্ষনাৎ বলেন, এর উল্টোটাও তো হতে পারে। আমার পাশে থেকে আপনাদের মেয়ে কালো হয়ে গেল!

আমি এখানে তাঁর রসিকতার একটা নমুনা তুলে ধরছি। এই ঘটনাটা অবশ্য অনেকেই জানেন।

প্রতিমা জেঠিমা ও শঙ্খ বাবু দুজনে সহপাঠী ছিলেন। দুজনে পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। এখন রূপে ও গুনে প্রতিমা ছিলেন অদ্বিতীয়া। তো প্রতিমার কাছ থেকে তাঁর বাবা ও মা এই অনুরাগের কথা জানলে প্রথমে খুব খুশি হতে পারেননি। না পারার কারণ হলো, সেসময় শঙ্খ ঘোষের চেহারা ছিল হাড়জিরজিরে। এবং কালো। এইরকম পাত্রের সঙ্গে কোন বাবা মা তার রূপবতী মেয়ের বিয়ে দিতে চায়? কিন্তু মেয়ে যেহেতু চাইছে তাই বাবা ও মা অরাজী থাকেননি। ধূমধাম করে বিয়েও হয়। বিয়ে করে ফেরার সময় প্রতিমা জেঠিমার মা তাঁর জামাইকে বলেন, আমার মেয়ের পাশাপাশি থেকো তাহলে দেখবে একদিন তুমিও ফর্সা হয়ে গেছ। একথা শুনে শঙ্খ ঘোষ তৎক্ষনাৎ বলেন, এর উল্টোটাও তো হতে পারে। আমার পাশে থেকে আপনাদের মেয়ে কালো হয়ে গেল!

 

১১.
শঙ্খ ঘোষের লেখালেখি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে ভবিষ্যতে আরও হবে। অন্তত তাঁর গদ্য নিয়ে। গদ্যকার হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর পর বাংলা ভাষায় একটিই নাম আসে। শঙ্খ ঘোষ। আর কবি হিসেবে? কবি হিসেবেও তিনি অসাধারণ। অনন্য। কিন্তু কেন অসাধারণ? অনন্য? শঙ্খ ঘোষের কবিতায় poetic language খুব একটা নেই। তিনি ইচ্ছে করেই তা রাখতেন না। উপমাই কবিত্ব, একথাকেও সম্ভবত তিনি বিশ্বাস করতেন না। এজন্য তাঁর কবিতায় জাঁকজমক কম। বাহুল্য প্রায় নেই বললেই চলে। তাঁর অনেক কবিতা হাঁটতে হাঁটতে লেখা। তাই লেখার মধ্যে হাঁটার rhythm পাওয়া যায়। শঙ্খ ঘোষের অনেক কবিতা পড়ে মনে হয় rhythm টা আগে এসেছে কথাগুলো পরে। এজন্যই কি তাঁর কবিতাকে খুব মাপা বলে মনে হয়?

তাঁর কবিতায় অসচেতনতা আছে ঠিকই; কিন্তু তাঁর কবিতায় শব্দব্যবহার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুচিন্তিত। এজন্য তাঁর কবিতায় বিশৃঙ্খলা বা উলম্ফন খুব বেশি দেখা যায় না। তিনি নিজেকে নৈরাজ্যবাদী মনে করতেন না।

শঙ্খ ঘোষ-৬-শ্রী

আদমসম্মাননা ২০১৪ জ্ঞাপনের সভা। রয়েছেন আলোক সরকার, শঙ্খ ঘোষ,ভূমেন্দ্র গুহ,অমিয় দেব এবং হিরণ মিত্র।

অনেকে, অনেক সমালোচক বলেন, কবি শঙ্খ ঘোষের দুটি মুখ। ধারা। social commitment থেকে তিনি যেমন কবিতা লেখেন তেমনি তাঁর অনেক কবিতায় বিশেষ করে ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ এবং ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’র কবিতাগুলো স্বগতোক্তিময়।

আসলে, আমার মনে হয়, প্রত্যেক কবির থাকে দুটি মুখ। একটা বাইরের দিকে মুখ অপরটা ভিতরের দিকে মুখ। এই দুই মুখ নিয়েই কবির জীবন। এই দুই মুখ যে সম্পূর্ণ আলাদা তা নয়, এই দুই মুখের ভিতর চলছে অবিরাম সংঘর্ষ। আর এই সংঘর্ষ থেকেই জন্ম নেয় তৃতীয় একটা সত্তা। এই তৃতীয় সত্তাই লেখে কবিতা। এজন্য শঙ্খ ঘোষের কবিতার সুনির্দিষ্ট কোনো ধরনের পরিবর্তে নানান ধরনের কবিতা দেখা যায়।

তবে যে ধরনের কবিতাই তিনি লিখুন না কেন, একথা সত্য, তিনি জীবনানন্দ দাশ নন। এমনকি তিনি যে উচ্চতার কবিতা লিখেছেন সেই উচ্চতার কবিতা তাঁরই দশকের কেউ কেউ লিখেছেন। আলোক সরকার, উৎপলকুমার বসু, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, বিনয় মজুমদার এবং আল মাহমুদের তুলনা তো আসবেই। আসবে জয় গোস্বামী এবং গৌতম বসুর প্রসঙ্গও।

কবি হিসেবে তিনি বিরাট কিছু না হলেও কবি, গদ্যকার, চিন্তক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, শিশু সাহিত্যিক এবং ব্যক্তিত্ব সব মিলিয়ে তিনি, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বিরাট। বিশাল। বস্তুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে যদি কোনো বাঙালি ব্যক্তিত্বর নাম করতে হয় তাহলে একজনের নামই করা যায়। তিনি, আর অন্য কেউ নন, শঙ্খ ঘোষ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম  ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪। পেশা শিক্ষক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : ‘উজাগর আঁখি’ (১৯৯৪), ‘রাত ও রাতের বিভা’ (১৯৯৫), ‘কন্দমূলের আকাশ’ (১৯৯৯), ‘কালপুরুষ’ (২০০০), ‘ভূপাখি ভস্মপাখি’ (২০০৫), ‘দুর্লভ শিখরদেশ’ (২০০৯), ‘অলসরঙের টিলা’ (২০১২), ‘বিবাহের মন্থর আয়োজন’ (২০১৬), ‘অরচিত অন্ধকার’ ( ২০১৯)। সম্পাদিত পত্রিকা : ‘আদম’। সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘কমলকুমার মজুমদারের চিঠি’, ‘আমার স্বামী কমলকুমার : দয়াময়ী মজুমদার’, ‘গদ্যসংগ্রহ : গীতা চট্টোপাধ্যায়’, ‘কবিতাসংগ্রহ : সুধীর দত্ত’, ‘কবিতাসংগ্রহ : সমীরণ ঘোষ’। প্রাপ্ত পুরস্কার : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, অহর্নিশ সম্মাননা, ঐহিক সম্মাননা প্রভৃতি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।