মঙ্গলবার, মার্চ ১৯

সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে স্যারের পাণ্ডিত্য আমাদেরকে মুগ্ধ করত : ম মাসুদ হোসেন খান

0

কবি অসীম কুমার দাস, আমার শিক্ষক। আমরা অবশ্য তাঁকে কবির চেয়ে ইংরেজি সাহিত্যের একজন মেধাবি অধ্যাপক হিসেবেই বেশি মূল্যায়ন করতাম। তাঁর কাব্য চর্চা সম্পর্কে তেমন জানাও ছিল না আমাদের। তিনি অত্যন্ত নিভৃতচারী এবং প্রচার বিমুখ। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হতে পারে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানশিপের সুযোগ তিনি নেননি। তিনি শুধু লেখাপড়া আর লেখালেখির মধ্যেই থাকতে চেয়েছেন। এছাড়া তিনি আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করেন এবং অবসরে ধ্যানে মগ্ন থাকেন।

আমার ছাত্র জীবনে স্যারের সঙ্গে ক্লাসের বাইরে কথাবার্তা বলার সুযোগ হয়নি। তবে আমি ২০০০ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাজশাহীতে কর্মসূত্রে অবস্থানকালে স্যারের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমি সুযোগ পেলেই স্যারের চেম্বারে যেতাম কিছু সময় কাটাতাম। সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে আলোচনা হতো নিয়মিত।

স্যারের সঙ্গে আমার স্মৃতিকথার সাথে তাঁর মাহাত্ম্যপূর্ণ কিছু কবিতাংশ যা আমার খুবই পছন্দ— তা লেখার মাঝে মাঝে দেওয়া হলো।

দেবতারা যখন ঘুমায়

ব্রোমাইড-বিধ্বস্ত শিরায়
দেবতারা এখন ঘুমায়,
জলোচ্ছ্বাসে
প্রলয় সন্ধ্যার,
নক্ষত্রখচিত মহাকাশ
নিমজ্জিত চূর্ণ
তমসায়;
অথচ আমার চোখে আলো
তোমার চোখেই আলো পায়।

আমি ছাড়াও স্যারের আরও দু-একজন ঘনিষ্ঠ ছাত্র-ছাত্রী এবং সহকর্মী শিক্ষকও আসতেন স্যারের সঙ্গে আড্ডা দিতে। ক্লাসরুম এবং ব্যক্তিগত আলাপে সবসময় সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ে স্যারের পাণ্ডিত্য আমাদেরকে মুগ্ধ করত। অনেক সময় সাহিত্য ও দর্শনের কঠিন বিষয়গুলো স্যারের কাছ থেকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতাম।

সাহিত্য ও দর্শন চর্চার বাইরে স্যারের যে জিনিসটা আমাকে অবাক করেছে তা হলো মানবের কল্যাণে তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনা। আমি দেখেছি স্যার কিভাবে বিপদগ্রস্ত মানুষের উপকারে এগিয়ে যেতেন। একবার স্যারের একজন ভারতীয় বন্ধু রাজশাহী এসে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর চিকিৎসাসহ সব ধরনের দেখভাল তিনি করেছেন।

আমি যতটুকু বুঝেছি স্যারের মতাদর্শ সব রকম ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে এবং তাঁর চিন্তা একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। তবে তিনি হয়তো বিশ্বাস করেন ধ্যান ও আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের মাধ্যমে সেটা সম্ভব। তিনি সমাজ, দেশ ও তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে সর্বদা ধ্যানমগ্ন থাকতে পছন্দ করেন। এ ব্যাপারে অবশ্য অনেকের ভিন্ন মত থাকতে পারে।

বোধন

ধ্বংস বিলাসিনী দেবী জাগো!
তুমি একা জেগে ছিলে,
যখন আঁধার ছিল
অন্ধকারে ঢাকা আরও দূর—
অট্টহাসি
বেজেছিল পাখোয়াজে—
দ্রিমিকি দ্রিমিকি ক্লিং কালী।

তাঁর এই ধ্যানমগ্নতা এবং প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তিনি কবিতার অমৃতলোকে চলে যান। তাঁর ঐশ্বরিক সাধনা, মানব কল্যাণ কামনা, সাহিত্য, দর্শন ও ইতিহাস বিষয়ে পাণ্ডিত্যের সংমিশ্রণে উৎসারিত হয় কবিতার সারাৎসার।

স্যার বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে দেশের মানুষের বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত।

আমি আশা করি, মানুষের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং সরকারও সকলের ব্যক্তিস্বাধীনতা সমুন্নত রেখে সুষ্ঠু সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে মননিবেশ করবে যাতে কবি ও লেখকরা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত না থাকে। স্যারের সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

একজন লেখক, সম্পাদক এবং উন্নয়ন কর্মী

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।