শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

জার্নাল, সেন্ট্রাল পার্ক, কিথ হ্যারিং ও একদিন

0

কিথ হ্যারিং আশির দশকের একজন জনপ্রিয় গ্রাফিতি শিল্পী ও অ্যাক্টিভিস্ট। ১৯৫৮ সালে জন্ম নেওয়া এই শিল্পী ভালোবাসতেন কার্টুন আঁকতে আর মিউজিয়ামে ঘোরাঘুরি। শিল্পী হিসেবে কিথ একজন কিংবদন্তি। নিউ ইয়র্কে তাঁর করা গ্রাফিতি সাবওয়ে, দেয়াল সব জায়গায় শোভা পায়। তাঁর করা গ্রাফিতিগুলো উচ্চমূল্যে বিক্রি হতে থাকলে তিনি একটি দোকান খোলেন এবং পিসগুলোর দাম যেন সবার নাগালের মধ্যে থাকে, তা নিশ্চিত করেন। ১৯৮৯ সালে কিথ হ্যারিং ফাউন্ডশেন খোলা হয়, সেখান থেকে তিনি এইচআইভি এইডস প্রতিরোধে সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনার পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য বৃত্তি ও আর্টের আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করেন। কিথ হ্যারিং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে একজন অনুপ্রেরণার নাম।

ডায়েরি লিখতে পছন্দ করতেন তিনি। সব সময় জার্নাল রাখতেন। ১৯৭৮ সালের ১৪ অক্টোবরে ওয়াশিংটন পার্কে বসে তিনি যে ডায়েরিটি লিখেছিলেন আমি এখানে তাঁর সেই লেখাটিকে ভাষান্তর করার চেষ্টা করেছি।


…এখানে বসে লিখতে খুব আরাম লাগতেছে। ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কের মতো জায়গায় এত আরাম খুব একটা দেখা যায় না। এই শহরের কারিশমা উপভোগ করার অনেক উপায় আছে। একটা ঘটনার প্রভাব ওই মানুষটার চিন্তা, মানসিক অবস্থা, আচরণভেদে ভিন্ন হয়, অসংখ্য অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আজকে যা আমাকে আঘাত করতে পারে, প্রভাবিত করতে পারে, কালকে সে আমার চিন্তার বিষয় নাও হতে পারে। সব কিছুই পরিবর্তনশীল। জন্ম থেকে প্রতিটি সেকেন্ড কাটে বিভিন্ন সংবেদন, সম্মুখীনতা, বিভিন্ন দিকের বিভিন্ন চাপ, শক্তি, যা অবিরত এসব অনুভূতিকে প্রতিক্রিয়াশীল করে তোলে। সময় কখনো নিজেকে রিপিট করে না, করবেও না। এই সময় যা কিছুই আপনি অনুভব করবেন, তা আরেকবার ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ পারিপার্শ্বিক যা উপাদান আছে, তা আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। শারীরিকভাবেও মানুষ একই থাকে না, তারও সব সময় মানসিক আর শারীরিকভাবে পরিবর্তন হতে থাকে।

বৈশ্বিক বাস্তবতা বলতে আমরা যা বুঝি তা হলো গতি। গতি নিজেই আন্দোলন, পরিবর্তন। কোনো পুনরাবৃত্তি থাকলে তা হুবহু এক না। কারণ সময় বয়ে গেছে আর সে-ও ওখানকার উপাদান।

দুজন মানুষের অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, চেতনা কিংবা চিন্তা কখনো এক হতে পারে না। সব কিছু বদলায় এবং সব কিছুর সময় আলাদা। এসব পরিবর্তনশীল মেলামেশা একে অপরকে ধ্বংস করা, নতুন কিছু তৈরি করা, নতুন চিন্তা, ‘বাস্তবতা’ মানে মানুষী এই অভিজ্ঞতা সব সময়ই বদলায়, আমরা একে বলি ‘বিকাশ’।

আমার কাছে অবাক করা মনে হয় এই ব্যাপারটা যে বেশির ভাগ মানুষ তাদের জীবন গড়ে তুলছে এই চিন্তায় যে এই পরিবর্তন, অবস্থার পার্থক্য এগুলোর আসলে অস্তিত্ব নেই। তারা খুব সহজে এই মৌলিক বিষয়কে উপেক্ষা করে, নিজেদের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তারা পরিকল্পনা করে, দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি দেয় আর একটা সিস্টেম খাড়া করায় তারপর ওই সিস্টেমের দ্বারা পরিচালিত হয়, নিয়ন্ত্রিত হয়।

মানুষ জানতে চায় না যে তারা পরিবর্তনশীল। যদি না তারা ভাবে এটা একটা উন্নতি আর একবার যদি তারা ধরে নেয় যে এই পরিবর্তন ইতিবাচক, তাহলে তারা অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে, মতলব আঁটতে পারে এই অপ্রাকৃতিক পরিবর্তনটাকে বাস্তব করার জন্য।

এই বিষয়টাকে এত বেশি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা সম্ভব যে এটা লিখে ফেলাও বেশ কঠিন। কিছু মনোভাব আমি আশপাশে দেখি সেগুলো হলো :

পরিবর্তন ততক্ষণই গ্রহণযোগ্য, যতক্ষণ এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পরিবর্তনকে প্রেডিক্ট (ভবিষ্যদ্বাণী করা) করা যায়।
পরিবর্তনকে রদবদল/পরিকল্পনা/কৌশল খাটিয়ে বাস্তবায়ন করা যায়।

যদি আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখি, আমি অনেক ধরনের কল্পনা আঁচ করতে পারি যে আমাকে কেমন দেখাচ্ছে। আমার মনে হয়, যেন আমার অনেকটি মুখ। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন দেখায়। মানে একবারে আলাদা। এটা তারা কি অনুভব করছে তার ওপর নির্ভর করে কিন্তু এর চেয়ে বেশি নির্ভর করে আমার অনুভূতি, আবেগ, বাস্তবতাÑযা আমি ওই সময় তাদের মধ্যে দেখছিলাম।
সাধারণত এর ভিত্তি হচ্ছে, পরিবর্তনই বাস্তবতা, যে আমরা সব সময় বদলাচ্ছি, অবিরত, ভিন্ন অবস্থায়, ভিন্ন চিন্তায়, অনেক সময় ভিন্ন বাস্তবতায়—

এটা অবহেলিত
অথবা ভুলভাবে বোঝা
অথবা ভুল ব্যাখ্যা করা
অথবা মুখোমুখি আনা।

আরো সহজভাবে, মানুষ অল্প হলেও জানে যে তারা একটা ধ্রুব রদবদলের মধ্যেই আছে, কিন্তু খুব অল্প কিছু মানুষ এটার অভিজ্ঞতা নেওয়ার চেষ্টা করে কিংবা প্রশ্ন করতে পারে কিংবা তদন্ত করতে চায় এর কারণ এবং নিহিতার্থ। বরং মানুষ এই বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে চেষ্টা করে সম্পূর্ণ উল্টা একটা প্যাটার্ন অনুসরণ করে। এটা অনেকটা এমন যে জীবন্ত ঘাসের ওপর লোহার গরাদ বসানো আর ঘাসদের বলা যে সাইজ নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এই সাইজমতো বেড়ে ওঠো।

আমার মনে হয়েছে, আমি ঘাসদের মতো বাঁচতে পারব না। তারা পারবে হয়তো একসময়। কিন্তু আমরা সেই সময় থেকে এত দূরে যে এটা কল্পনা করাও কঠিন। মানুষ কিন্তু চাইলেই মেনে নিতে পারে যে তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মতো তারাও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। অন্তত তারা এই চিন্তার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতে পারে বিরুদ্ধে না গিয়ে।

একটা সময় আসবে, আমি নিশ্চিত যখন আধুনিক মানুষ এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস জোগান দিতে পারবে। প্রশ্ন করবে, বিশ্লেষণ করবে এবং এই চিরন্তন সত্যের সাথে অধিক শান্তির একটা জীবন যাপন করতে পারবে। একটা চিন্তার সাথে সংগতিপূর্ণ বসবাস। একটা সমন্বিত বসবাস অনিয়ন্ত্রিত বাস্তবতার সাথে যেটা আমাদেরই করতে হবে, আমরা মানি আর নাই বা মানি। এর সাথে কারবার করা ছাড়া এর কোনো বিকল্প নেই।

আমি এখনো লিখে যাচ্ছি। কারণ এই ‘বাস্তবতার’ সাথে বসবাস আমার কেমন লাগছে বলার আগে, আমি এটা স্পষ্ট করতে চাই (নিজেকে) যে এটা বাস্তবতা, এর অস্তিত্ব আছে এবং আমি যা করছি, তা সম্পূর্ণ কারণ ছাড়া নয়।

নিজ জ্ঞানের একটা সীমাবদ্ধতা হলো যে তোমার কী জ্ঞান, তা না জানা এবং তার ফলাফল সম্পর্কে ধারণা না রাখা। আর পরির্বতনের ফাঁদ হলো এর অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করা। ‘আমি যা বুঝি সেভাবে চলি’ এটা মানলে ‘অন্যভাবেও চলা সম্ভব’ কিংবা ‘যা ভাবো তা না জানা’-কে উপেক্ষা করার সম্ভাবনা থেকে যায়। তুমি যে ‘উত্তর জানো’ এটার পরিণাম ‘উত্তর নেই’-এর সমান ভয়াবহ।

কবিতার মতো বাক্য যার কোনো মানেই স্বাভাবিক অর্থে নেই, তাও কবিতা হতে পারে।
কিথ হ্যারিং কবিতার মধ্যে ভাবে।
কিথ হ্যারিং কবিতা আঁকে।
কিথ হ্যারিংয়ের শব্দের দরকার নেই।
শব্দই কবিতা বানানোর জন্য জরুরি নয়।

ছবি আঁকার মধ্যে, শব্দকে দেখানো হয় ছবির আকারে। ছবিকে কবিতা বলা যায়, যদি ছবিকে শব্দ করে পড়া হয়। ‘ছবি শব্দকে বর্ণনা করে’ মিশরীয় ছবি/হাইরোগ্লাফি/পিক্টোগ্রাম/সিম্বল। শব্দই যেন চিত্রাবলি।

চিত্রাবলি কি শব্দের আকারে (যোগাযোগের ক্ষেত্রে) বিদ্যমান থাকতে পারে? বিদেশি ভাষা, দুর্বোধ্য অক্ষর অনেক সময় সুন্দর লাগতে পারে, অর্থ না জেনেও তার প্রকাশ্য বিষয়াদির সাথে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব। চায়নিজ ভাষায় লেখা একটা বই তার ভেতরে আঁকা ছবির মতোই সুন্দর হতে পারে। ছবি শব্দকে বর্ণনা করে।

এসব বলছি ‘সব কিছু পরিবর্তনশীল’ প্রসঙ্গেই। এ কারণে, আমার জন্য, পেইন্টিং, যেভাবে আমি জানি, শব্দালংকারও হতে পারে। কারণ আমি একেক সময় একেক রকম। আমি বিশ্বাস করি, আমার জীবনের যেকোনো দুটি দিন হুবহু এক ছিল না। একইভাবে হয়তো, কিন্তু হুবহু না। আমি চিন্তা করি, কাজ করি, অনুভব করি, বেঁচে থাকি আলাদাভাবে প্রতিদিন, প্রতিটি মুহূর্ত এবং আমি সময় অনুসারে যেমন ভিন্ন, তেমন আমার আঁকা ছবিও ভিন্ন দেখাবে।
আমি প্রতিদিন ভিন্নভাবে আঁকি।
প্রতি ঘণ্টা।
প্রতি মিনিট।
প্রতি মুহূর্ত।
আমার আঁকা ছবি এই মুহূর্তকে ধরে রাখে। তারা আমার চিন্তার প্যাটার্নকে ধরে রাখতে পারে। সাদৃশ্য ক্যামেরা ছাড়া সম্ভব নয়। পুনরাবৃত্তি ক্যামেরা (যন্ত্র) ছাড়া সম্ভব নয়।

প্রতিদিন ভিন্নভাবে একটা সংগতিপূর্ণ গঠনে আঁকা অসম্ভব (একটা সেশনের বেশি)। এটা হয়, কোনো তকলিফ ছাড়া, জোরপূর্বক বদল না এনে, অবক্ষয়, কোলাজ, পুনরাবৃত্তি ছাড়া না কিন্তু। বিশুদ্ধ শিল্প তখনই হয়, জীবনের মুখোমুখি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া থেকে।

আমি এটা বলছি না যে এ পর্যন্ত যা আর্ট করা হয়েছে, তা বাজে বা কম বিশুদ্ধ। আমি বলতে চাই, এটাই আর্টের অভিব্যক্তি এখন। আমাদের পরির্বতন অনেক তরান্বিত হয়েছে। প্রত্যেক আর্টিস্ট (মানুষ) যাঁরা শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন, হরেক রকমের জীবন কাটিয়েছেন, এ জন্য আর্ট ও জীবনের প্রতি তাদের মনোভাবও ভিন্ন। যদিও বেশির ভাগ গঠিত আর্টের মুভমেন্ট এবং ধরন একটা নির্দিষ্ট গ্রুপের জন্য অনন্য, কিন্তু এটা সব সময় একজন ব্যক্তির সৃষ্ট বস্তু। যদিও ‘দলগত মানসিকতা’ অথবা ‘সাংস্কৃতিক গ্রুপিং’ সব সময়ই আর্টিস্টদের মধ্যে ছিল, কিন্তু শিল্পের কাজ সব সময়ই ব্যক্তিকেন্দ্রিক অথবা ব্যক্তি পর্যায় থেকে জোগান প্রেরিত গ্রুপের প্রচেষ্টাকে সফল করার দোহায়।

কিন্তু আর্টের এত মুভমেন্ট, গ্রুপ ঢং এবং সময় দেখার পর আমি বিশ্বাস করি, আমরা এমন একটা সময়ে পৌঁছে গেছি, যেখানে আর গ্রুপিং, আন্দোলন বা বুদ্ধির ভগ্নাংশ আর খাটে না। এখন সময় আত্মবোধের।

মিডিয়া আর স্বতন্ত্র চিন্তার বিপক্ষে অবস্থানরত সমাজ আমাদের এক রকম বাধ্য করছে বিশ্বাস করতে যে আমরা ‘ওই রকমের মানুষ’, ‘ওই দলের মানুষ’ অথবা ‘সাধারণীকরণ’-এর মতো বাধাধরা চিন্তায়। তার পরও আত্মবোধের গুরুত্ব এবং এটাই মূল স্তম্ভ মেনে অনেক আর্টিস্ট কাজ করে যাচ্ছে। আত্মবোধের গণসমাজ দেখতে পারে না, শত্রু ভাবে। ব্যক্তি তার নিজ কথা বলে, এই কারণে সে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। আর্টও বৈশিষ্ট্যমূলক। আমার মনে হয়, এই বিষয়টাই আধুনিক আর্টের ভিত্তিস্বরূপ। এটা উপেক্ষা করার মতো শিক্ষা নয়। সময়ের শুরু থেকেই শিল্পী এ কথা বলার চেষ্টা করে আসছে।

যখন আর্টিস্ট তার নিজের লক্ষ্য ছেড়ে দেয় (অথবা কেউ তারে ছাড়ায়ে দেয়) তখন সে গ্রুপের খোঁজে বের হয়, আন্দোলনের সাথে যায়, গ্রুপের জন্য ইশতেহার বানায় এবং গ্রুপ আইডিয়া প্রস্তুত করে। মাত্তিসে একটা বিশুদ্ধ দর্শন ধারণ করতেন এবং সুন্দর সব ছবি এঁকেছেন। কেউ কোনো দিন তাঁর মতো এঁকেছে বা আঁকবে না। সে একটা ব্যক্তিক বিবৃতি। কোনো আর্টিস্ট আন্দোলনের সাথে জড়ায় না, যদি না সে অনুসরণকারী হয়। তখন কারা অপ্রয়োজনীয় আর অহেতুক শিল্পের জন্ম দেয়। যদি সে একটা মৌলিক পদ্ধতি বিশ্লেষণ করে বা মৌলিক চিন্তার চর্চা করে তবেই সে যোগ্য অবদান রাখতে পারে, কিন্তু যেই না তারা নিজেকে অনুসরণকারী হিসেবে মেনে নেয় অথবা সত্যকে পরীক্ষা না করেই তাকে গ্রহণ করে, তারা আর্টের আত্মবোধের অভিব্যক্তি আর ছুঁইতে পারে না।

১৯৭৮-এ এমন কিছু চেষ্টা দেখা যায় যে, কোনো আইডিয়া পেলে তাকে শ্রেণীভুক্ত করা বা লেবেলের মধ্যে নিয়ে আসার প্রয়াস তারপর সেই আইডিয়াকে এতভাবে শোষণ করা হয় যে শেষ পর্যন্ত যা থাকে তাকে আর আর্ট বলা চলে না। এবং এখন আমার মনে হয়, এসব গ্রুপের মানসিকতার বিপেক্ষে অবস্থান নেওয়া উচিত। আমি জানি না, এটা আগে বলা হয়েছে কি না, কিন্তু চলতি বা নতুন কোনো আন্দোলনের অভাবে অনেক সময় মনে হয় আমরা মৌলিক চিন্তা বা বৈশিষ্ট্যগত আর্ট দেখছি। তারাও যথেষ্ট প্রভাবিত অবশ্যই, অনেকে হয়তো বা তার চেষ্টা নিয়ে মনোযোগীই ছিল না। কিন্তু গত দশ বছরের বাতিল গ্রুপ আন্দোলন, বেশি জিগির, অবিতর্কিত মুভমেন্ট যেমন পপ, ধারণামূলক, মিনিম্যাল, পোস্ট হ্যান, অ্যান্টি ত্যান ইত্যাদি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করতেছে যে আর্ট সব জায়গায় বিদ্যমান। এই যে আর্টের ধারণা প্রত্যেক মানুষ প্রতিদিন মুখোমুখি হইতেছে তার চিন্তা বা গড়ন অসংখ্য রকম হতে পারে এবং তা অসংজ্ঞায়িত। কারণ এটা প্রত্যেকের কাছেই আলাদা। সমাজে ‘ব্যক্তি চিন্তা’র গুরুত্ব ও মানসিকতা বিশাল আর এটাই বাস্তবতা। এটা আগামী প্রজšে§র জন্যও জানা জরুরি যে ব্যক্তি পর্যায়ে চিন্তাই তোমাকে সম্পূর্ণ করে তোলে আর আমরা সবাই আলাদা, পরিবর্তনশীল, নিজের লক্ষ্যের দিকে কাজ করে যাওয়া উচিত। কোনো গ্রুপের মধ্যে গণপরিচয় কিংবা ব্যক্তিবিরোধী বাধাধরা মানুষ হতে চাই না, যাদের একই চিন্তা, একই প্রয়োজন আর একই উদ্দেশ্য।

আমি আমিই। আমাকে দেখতে তোমার মতো লাগলেও কাছ থেকে দেখো আমি কোনোভাবেই তোমার মতো না। আমি অনেক আলাদা। আমার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তোমার থেকে আলাদা। কারণ আমার অভিজ্ঞতা আলাদা, আমি যেখানে থেকেছি সেখানে তুমি থাকোনি, আমি যেভাবে জীবন যাপন করেছি, তুমি করোনি। এখানে ভালো-খারাপের প্রশ্ন আসছে না। আমি তুমি হয়তো একই শার্ট, একই জুতা কিংবা একই হেয়ার কাট পরে ঘুরে বেড়াতে পারি, কিন্তু এটা কোনোভাবেই তোমাকে অধিকার দেয় না যে পূর্বপরিকল্পিত ধারণা থেকে আমি কী বা আমি কে— এ ধরনের সংজ্ঞায়ন করবা।
তুমি আমাকে চেনো না। চিনবাও না।
আর্ট হচ্ছে একটা ব্যক্তিগত অনুসন্ধান। আর্ট বলতেই বোঝায় ‘এটা কী?’ অথবা ‘এটা কী বোঝায়?’
আর্টের অর্থ অনুভব করে দর্শক, আর্টিস্ট নিজে না।
আর্টিস্টের চিন্তা দর্শকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। দর্শক নিজেই আর্টিস্ট কারণ আর্টকে দেখার মাধ্যমে সে নিজের মতো করে তাকে অনুভব করে।
তার কল্পনাশক্তি নির্ধারণ করে এটা কী বা এটা কী বোঝায়।
আর্টের কল্পনায় দর্শকের বিবেচনায় আনার প্রয়োজন নেই। কোনো ডিসক্লেইমারেরও দরকার নেই।
সবচেয়ে ভয়াবহ অস্ত্র একজন আর্টিস্ট ব্যবহার করতে পারে, যখন তিনি আত্মবোধ জাগ্রত একটা সমাজের জন্য কাজ করছেন তা হলো সংজ্ঞায়ন।
সংজ্ঞা অপ্রাসঙ্গিক।
সংজ্ঞা উদ্দেশ্যকে পরাজিত করে।
জনগণের অধিকার আছে আর্টের দিকে।
সমসাময়িক আর্টিস্টদের অধিকাংশের মধ্যে জনগণকে উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখা যায়।
মানুষের আর্ট প্রয়োজন আর একজন আর্টিস্টের উচিত এই প্রয়োজন বোঝা, শুধু বুর্জোয়াদের জন্য এঁকে বাকি জনগণকে উপেক্ষা করলে আর্টের প্রয়োজনীয়তা সমর্থন হয় না।

শিল্প সবার জন্য উন্মুক্ত। জনগণ শিল্পের কদর করে না। কারণ তারা আর্ট বোঝে না, এই মতবাদে বিশ্বাস করেও যদি আর্টিস্ট এমন শিল্পকর্মের জন্য দেয়, যা জনগণের কাছে দুর্বোধ্য তবে এটা শিল্পীরই দোষ, সে-ই কদর করেনি এবং এই স্বঘোষিত আর্টিস্টদের জ্ঞান সবই বোগাস।

শিল্প সবার জন্য উন্মুক্ত। জনগণ শিল্পের কদর করে না। কারণ তারা আর্ট বোঝে না, এই মতবাদে বিশ্বাস করেও যদি আর্টিস্ট এমন শিল্পকর্মের জন্য দেয়, যা জনগণের কাছে দুর্বোধ্য তবে এটা শিল্পীরই দোষ, সে-ই কদর করেনি এবং এই স্বঘোষিত আর্টিস্টদের জ্ঞান সবই বোগাস।

শিল্প একটা বুদ্ধিভিত্তিক সমাজের জন্য ভালো প্রভাবক। কিন্তু গণমানুষ সব কথা বলে না এই ভয়ে যে তাদের মূর্খ শোনাবে, কিংবা শিল্প-জ্ঞানের স্বল্পতা প্রকাশ পাবে। তাই দায়িত্বটা আর্টিস্টদের বিবেকের ওপর অধিকভাবে নির্ভর করে।
আর্টিস্ট একা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, দর্শককে আলাদা করে। কেন তারা প্রকাশ করে না, কেন আদৌ আর্টের প্রয়োজন, দর্শকের দায়িত্ব কী হতে পারে? কীভাবে অনুভব করতে হবে শিল্প আর কেন?
সিদ্ধান্তটি মূলত এই যে আর্টটা কি শুধু শিক্ষিত কয়েকটা লোকের জন্য, না সবার জন্য?
শিল্প কি জনগণ ছাড়া সফল হতে পারে?
যদি মানুষ শিল্পকে ভয় পায়, তাহলে কি তাদের ভয় পাওয়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের হাত আছে? আমাদেরও ভয় পাওয়া উচিত?
তারা কি সব সময়ই ভয় পেত? তারা কি আসলে গরজে নেওয়ার মতো? আর্ট কি শুধু ব্যক্তির জন্য, ব্যক্তি দ্বারা প্রদেয় ব্যক্তির দেখা এবং সুনাম করার জন্য?

আর্ট কি নিজের জন্য? আর্ট কি তাহলে আর্টিস্টের অহংবোধ পূর্ণ করার জন্য?
আমি আগ্রহী এমন শিল্প সৃষ্টির যার মাধ্যমে আমি অনেক বেশি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দেখতে পাব, অভিজ্ঞতা পাব, তাদের বুদ্ধি কীভাবে আর্টকে সংজ্ঞায়ন করছে, এটা শিখতে পারব, কোনো নির্দিষ্ট অর্থ আমি এঁকে বেঁধে দিতে চাই না।
দর্শক একটা ছবির বাস্তবতা সৃষ্টি করে, অর্থ সৃষ্টি করে, মনন সৃষ্টি করে। আমি শুধু একজন মধ্যবর্তী লোক, যে এই চিন্তাগুলোকে একসাথে করছি।

নির্দিষ্টভাবে যোগাযোগের কিছু নেই, কিন্তু যে শিল্প আমি তৈরি করেছি, তা মানুষের চিন্তার সাথে পরিচিত না হলে, (অথবা প্রাণী, আমার ধারণা) তা অসম্পূর্ণ আবার এটা বিচক্ষণতার সাথে অনুভব না করলেও তা অসম্পূর্ণ। আমার করা এই শিল্পের অগণিত অর্থ রয়েছে। কারণ তা অগণিত মানুষের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবে।
এটাই আমার বার্তা। মাধ্যমটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
আর্ট আমি যেমনে জানি তাই।
জীবন আমি যেমনে জানি তাই।
মাধ্যমটা বার্তা পৌঁছানোর যন্ত্র।
মাধ্যমটা বার্তা নয়।
বার্তাটাই বার্তা।
শিল্পই জীবন। জীবনই শিল্প। এই দুইয়ের গুরুত্ব একই সাথে অধিক বাড়িয়ে বলা আবার ভুল বোঝায় ভরা।
ধ্বংসাত্মক উপাদান সব আর্টেই বিদ্যমান, কিন্তু তা শুধুই দর্শকের চিন্তার মধ্য দিয়ে আমলে আসে।
এখানে কোনো উত্তর ধার্য করা নেই, প্রশ্ন আছে শুধু। আমি যখন সোহো (SoHo)-তে যাই, নিজের শিল্পকর্মেরই এত নতুন চিন্তা নিয়ে ফিরে আসি যে মাঝে মাঝে মনে হয় এ জন্যই যাই কি না। গ্যালারির জায়গাগুলোকে আমি গ্যালারিই মনে করি, আমার আর্ট দেখাচ্ছে তাই একে নিজের বলে মনে হয় না। জায়গাগুলোতে অনেক ফালতু ছবিই টাঙানো থাকে, যার থেকে ভালো ছবির যোগ্য এসব।

আমি বুঝতে পারলাম যে আমি এখানে এসেছি, কারণ এই শহরে কম গ্যালারিই আছে, যাতে আমার করা ছবিগুলো আঁটবে।
আমি অনেকটি জায়গা দেখলাম, যা দেখে আমার প্রথম অনুভূতি হলো যে মনে হয় এ জায়গা আমার জন্যই করা হয়েছে।

কিন্তু আমার করা কাজগুলো যেকোনো জায়গায় এঁটে যাবে। কারণ তাদের সেই অভিজ্ঞতা আছে আর জায়গায়কে মূল্য দিতে পারে। দেয়াল দেখলাম আজকে যেখানে ৩০X৪০০ ফুটের পেপার প্যানেল আরামে ঝুলিয়ে দিতে পারব।
চমৎকার। কিন্তু কীভাবে যাব ওখানে?

আজকে কল্পনা করলাম একটা গ্যালারিভর্তি ভিডিও মনিটর তাতে আমার বিভিন্ন ভিডিও পেইন্টিংস দেখাব। আমি এটা করতে চাই ঠিকই, কিন্তু এখানেই আমার সাথে আমার দ্বন্দ্ব। আমি এটার বিরুদ্ধে, কারণ আমার নতুন চিন্তা যেটা আসবে, ভিন্ন আচরণ, আর ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি এবং আমার এই ভিডিও মনিটরের কল্পনা হয়তো আমি কোনো দিন করব না, কারণ তত দিনে নতুন চিন্তার গুরুত্ব আমার কাছে অধিক।
এই গ্যালারিটা যেভাবেই হোক আমার চিন্তায় আছে। ওপেনিংয়ে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানও অনেক সুন্দর ছিল।
আমার প্রথম ভিডিও পেইন্টিং শেষে আমি যখন এক কোনায় নিজেকে আঁকছি তখন আমি নিজে থেকে এই গতিবিধি নিয়ে সতর্ক থেকেছি। যেকোনো আন্দোলনের গুরুত্ব কয়েক গুণ বেড়ে যায় তার কর্মদক্ষতার দ্বারা। এই সম্পাদনা (ছবি আঁকা) আঁকা ছবির মতোই গুরুত্বপূর্ণ।
গতিবিধিই চিত্রকলা। চিত্রকলাই গতিবিধি।
একটা ছবিতে, সংগীত, সম্পাদনা, আন্দোলন, চিন্তা, নৈপুণ্য এবং বাস্তবিক জীবনের রেকর্ড থাকে যাকে পেইন্টিংয়ের মধ্যে ধারণ করা হয়।
যেন পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার একটা নকশা।
পেইন্টিং সম্পাদনার মতো।
ভিডিও— এই মাধ্যমের ক্ষমতা আছে যোগাযোগ আরো বড় করার, আরো সরাসরি করার, পেইন্টিং ও ভাস্কর্যকে জড়িত করার।
এটা খুব একটা সত্য না যে নিউ ইয়র্ক একটা অব্যক্তিক শহর। বরং এই শহর যথেষ্ট বন্ধুত্বপূর্ণ, যদি তারে তার মতো থাকতে দাও। বাড়ি ফেরার পথে হাঁটাপথটাও খুব সুন্দর। হাসি বিনিময় হলো, মানুষভেদে দু-একটা কথাও হলো। মানুষ মানুষের সাথে একটা নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত খোলা। সেখানেও ভয়ের বাধা রয়েই গেছে। এই জায়গাটা খুব চমৎকার, অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়।
এটা অবাক করার মতো যে পেইন্টিং ক্লাসের বাইরে ২৪ ঘণ্টাই আমি ক্লাসটাকে অভিশাপ দিই। আবার ক্লাসে মনে হয় বিষয়টার গুরুত্ব থাকতে পারে, ক্লাস থেকে বের হয়ে আবার অভিশাপ দিতে থাকি।

পেইন্টিং ক্লাসের থিওরি আর তত্ত্বজ্ঞান আমার ভালোই লাগে। আমি বুঝতে পারতেছি কীভাবে পুনরাবৃত্তি এবং নিয়ন্ত্রিত শব্দে ব্যবহার করে তাকে পরে আমরা সম্পর্ক স্থাপনে ব্যবহার করতে পারি, কিন্তু কোনো অজানা কারণে ক্যানভাস আমাকে টানে না। ক্যানভাস যতটা না আমি ব্যবহার করেছি, তার চেয়ে বেশি ঘৃণা করি। আঁকার ক্ষেত্রে রং আমি পছন্দ করি, কিন্তু এই মাধ্যমটা খুবই আদি আর সংযত। তেলরঙে, তেলটাই বাহন যে রং বয়ে নিয়ে যায়। ভিডিওতে সেটা আলো (লাইট)। আমার ধারণা, রঙের ব্যবহার অনিবার্য, কিন্তু কোনো বিকল্প যদি থাকে তাহলে আমি সেটা জানতে চাই। হয়তো বা আমার ভালোই লাগবে, যদি এটা আমি উপভোগ করতে পারি, আনতে পারি, পরখ করে দেখতে পারি এবং এর সাথে খেলা করতে পারি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তেলরং থেকে পাওয়া কঠিন, যেখানে আগে থেকে আঁকা আকৃতি নিয়ে কাজ করছ কিংবা বারবার আঁকছ একে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল এই রং নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবে কিংবা তোমাকে।
ক্যানভাসের উপাদান চমৎকার। এটা শক্ত, বিক্রি করা যায়, এক রকম চিরস্থায়ী বলা চলে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে এটা নিষিদ্ধ। আমি ৮ ডলার খরচ করে ৩০X৪০ ক্যানভাস আর তেলরং কিনতে পারব তাতে আমার মনে হবে, এই কাজটার মূল্য কিছু হলেও হওয়া উচিত। কিন্তু যখন আমি কাগজে আঁকি, একটা পুরো ৪X৯-এর পেইন্টিংয়ের মূল্যও থাকে শূন্যের কাছাকাছি। আমি আঁকতে ভালোবাসি এবং আমার কাজের মধ্যে তা দেখা যায়।

আমার যায় আসে না এটা পেইন্টিং না, ড্রইং না, ভাস্কর্য।
আমার যায় আসে না তুমি এটা পছন্দ না করলে।
আমার যায় আসে না কাগজটা ভাঁজ পড়া বা ছেঁড়া হলে।
আমার যায় আসে না এটার ওপর দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও।
আমার যায় আসে না যদি দাগগুলো বাঁকা হয়।
আমার যায় আসে না যদি আমি এতে না-ও আঁকি।

ছবিটি ভালো না খারাপ— এই চিন্তা থেকে দূরে বসে আমি আঁকতে পারি। আমি গতিবিধি এবং তাৎক্ষণিক বিচার দিয়েই শিল্পকর্মটি করি আর আমার শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করি (যদি আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে)। হয়তো বা নিয়ন্ত্রণ এ ক্ষেত্রে একটা বাজে শব্দ।

পেইন্টিংসের উপাদান কম থাকলেও ব্যাপার না। যতক্ষণ না এটা নিষিদ্ধ বা পবিত্র, ততক্ষণ আমি আঁকতে পারব, কোনো বাধা ছাড়াই।
ছবিটি ভালো না খারাপ— এই চিন্তা থেকে দূরে বসে আমি আঁকতে পারি। আমি গতিবিধি এবং তাৎক্ষণিক বিচার দিয়েই শিল্পকর্মটি করি আর আমার শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করি (যদি আদৌ কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে)। হয়তো বা নিয়ন্ত্রণ এ ক্ষেত্রে একটা বাজে শব্দ।
আমি উপাদানগুলো নিয়ে কাজ করতে থাকি। এটা শেষ পর্যন্ত (কোনো কাজ আসলে শেষ হয় না) যে বার্তা পৌঁছানোর কথা সেটা পারব কি না, এই চিন্তা আমার মাথায় আসে না। এর দিকে তাকিয়ে থাকাও শান্তির। আদেশ থেকে নেওয়া ছুটি। অথবা ভিন্ন রকমের আদেশের উপত্তি হয় এই কাজ থেকে। এটার প্রয়োজন ভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়া, সম্ভব হলে ভিন্ন ব্যাখ্যাও।
শিল্প ঢিলা, প্রাকৃতিক, সত্যি, নিষিদ্ধ সংজ্ঞার বাইরে। এটা সাময়িক এবং চিরস্থায়ীভাবে অগুরুত্বপূর্ণ। এর অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা অবগত। একে আমরা ক্যামেরা দিয়ে পার্মানেন্ট করতে পারি, কিন্তু সেটা আমার প্রয়োজন নেই।
একটা সম্ভাবনা আছে যে কাগজে আমার আঁকা ছবিগুলো ক্যানভাসের মতোই দীর্ঘদিন টিকে থাকবে। নিউক্লিয়ার কোনো বোমা এসে পড়লে অবশ্য সব একই গতিতে ধ্বংস হওয়ার কথা।
কম্পিউটারের সিলিকন চিপ একটা নতুন জীবন এখন। ঘটনাক্রমে মানুষ কম্পিউটারের দাসে পরিণত হবে। আমরা কি এতদূর চলে এসেছি? এমন অনেক কাজে আমরা এখনই সেই অবস্থায় পৌঁছে গেছি। আমরা কি কম্পিউটারকে কন্ট্রোল করতেছি, নাকি তাদের সাহায্য করতেছি আমাদের কন্ট্রোল করতে?
এটা ১৯৮৪ এবং ১০ বছর হলো। যদি তখনও কম্পিউটার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের ক্ষমতার বাইরে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে পারে, তাহলে মানুষের দায়িত্ব কী?
কম্পিউটারের হয়ে কাজ করা?
এবং আর্টিস্টের কাজ কী?
এই অবস্থায় প্রতিবাদ করা না মেনে নেওয়া?
আমার কাছে মনে হয় বিবর্তনের শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে মানুষ। যদি এই পথ ধরেই সামনে এগোই, তাহলে ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসব আমরা। যন্ত্রও বানাইতেছি নিজেদের ধ্বংসের জন্য। আমরা আত্মবিধ্বংসী। হয়তো বা কম্পিউটার আমাদের বাঁচাবে। হয়তো বা এটা ভালো যে জীবনধারার একটা বিকল্প আবিষ্কার, যা মানুষের চেয়ে বেশি কার্যক্ষম এবং নিজের বৃদ্ধির খেয়াল রাখে। কম্পিউটার কি আমাদের সাহায্য ছাড়া ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারবে? আমার মনে হয় পারবে। আমরা যদি চাই এমন কম্পিউটার বানানো সম্ভব।
যন্ত্র নান্দনিকতা?
কম্পিউটারের কি নান্দনিক জ্ঞান আছে? এটা কি কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা সম্ভব যেন এটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনোটা নান্দনিক, কোনোটা নয়? কেন নয়?
মানুষের জীবনে শিল্পের গুরুত্ব খুব কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবে। এইটা হয়তো শিল্পের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়। আর্টিস্টরা প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছে যে কম্পিউটার তাদের পেছনে গটগট করে হেঁটে আসছে। আমরা আতঙ্কিত। আমাদের অস্তিত্ব, ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা, আমাদের জীবন সব আসছে দিনের যন্ত্রের দ্বারা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। এটা আমাদের জীবনে স্থায়ী আর বড় স্থান দখল করতে যাচ্ছে।
যদি মানুষকে বর্ধিত করা যায়, তাহলে আবেগ, উল্লাস, বিচার, সৃজনশীলতা, নান্দনিকতা, ব্যবহার এসবও বর্ধমান।
প্রশ্ন : একজন শিল্পী হিসেবে এই অবস্থার অবগতির পর আমার কোথায় দাঁড়ানো উচিত?

আমি মানছি, একটা পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে মানুষ আর বাড়তে পারে না। কিন্তু আমাদের বিবর্তিত হওয়া উচিত নতুন জীবনধারায় যেন বিকল্প মানুষ্য অবস্থায় আমরা টিকে থাকতে পারি। যে প্রশ্নে আমার সমস্যা সেটা হলো : নতুন যে জীবনধারার কথা বলছি সেটা কি মানুষের নান্দনিকতাকে সম্পূর্ণ বিস্মৃতির চোখে দেখবে? এটা কি জোরপূর্বক? এটাই কি নিজ বৈশিষ্ট্য? নতুন জীবন গঠনাকৃতি মানুষ্য বৈশিষ্ট্য ছাড়াই? আমরা কি কল্পনাপ্রসূত হয়ে আমাদের একটা ছবি আমরাই তৈরি করেছি, নাকি সম্পূর্ণ আলাদা?

আমাদের সময়ের আর্টিস্টদের এই প্রশ্ন করতে হবে। কারণ আমরাই যান্ত্রিক নান্দনিকতার সাথে এই লড়াই লড়ব।

আমাদের সময়ের আর্টিস্টদের এই প্রশ্ন করতে হবে। কারণ আমরাই যান্ত্রিক নান্দনিকতার সাথে এই লড়াই লড়ব। মিনিম্যাল আর্ট ক্রমেই যান্ত্রিকতার দিকে ঝুঁকছে। এটা এক অর্থে আমাদের তৈরি করছে আগামী যান্ত্রিক যুগের জন্য বক্স, লোহা, আকার, নান্দনিকতাহীন ভাস্কর্য, ঐতিহ্যগত সৌন্দর্যহীনতা। এগুলো মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে এবং সাথে সাথে আমাদের জীবনকেও। অথবা মিনিম্যাল (ক্ষুদ্র) শিল্পে একটা বেদনাদায়ক প্রভাবের সামনে পড়তে যাচ্ছে। ভবিতব্য আগামীর সাবধানবাণী। পাংক রক।

নেতিবাচক কথা বলে কি আপনি ইতিবাচক হওয়ার চেষ্টা করছেন? এই পন্থাই কি আমাদের নেওয়া উচিত? এই অর্থহীনতা কি মানুষ দেখতে পাবে? নাকি ভবিষ্যৎকে মেনে নেবে এবং মেনে নিলে কি উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে?
নেতিবাচক হয়ে, নেতিবাচক কর্মের অর্থহীনতা সামনে নিয়ে আসা কি ইতিবাচক কাজ? দাদাবাদ ইতিবাচক না নেতিবাচক?
এই প্রশ্ন নির্ধারণ করবে আর্টে আমার অবস্থান, জীবনেও।
কতজন মানুষ এই বিপজ্জনক অবস্থা আঁচ করতে পারছে? আর যদি আঁচ না-ই করতে পারে মানুষকে আসছে যান্ত্রিক জীবনের জন্য কীভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব?

আমি কি কম্পিউটারের সঙ্গী না পুরো মানবজাতির? আর্টের ইতিহাস আছে আমাদের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত।
আমরা কি এই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারি? এটা কি ছেড়ে দেওয়া বলে না বিবর্তিত হওয়া বলে? মানুষ হিসেবে এই বিকল্প জীবনব্যবস্থার গুরুত্ব কী দেখা দরকার? এটা কি আমাদের পূর্বকৃত কর্মের ফল? নাকি পুরো মানুষের ইতিহাসের আবিষ্কার? এটা মানবজাতির একটি পণ্য না? মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার এবং জীবনকে সামনে নিয়ে যাওয়ার।
জীবনকে মানুষের পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না সব সসয়। এটা উপলব্ধি করার সময় আমাদের হয়ে গেছে। আমরা বিবর্তনের একটা প্রয়োজনীয় ধাপ। আমরা জানি না, এর শেষ কোথায়? কী আছে এর শেষে? আদৌ কি শেষ আছে?
বিবর্তন থামাতে হলে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে যে আমরা ব্যর্থ, আমরাই শেষ এবং এটা বিশ্বাস করা যে আমরা আর বিবর্তিত হবো না, ব্যাপারটা সর্বনাশা সাবেত হতে পারে। জীবন মানুষের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেঁচে থাকার শক্তি মানুষসহ, পশু, আকাশ, বাতাস, পানি, গ্র্যাভিটি, শূন্যের মধ্যে বিরাজমান। যেকোনো মূল্যেই তাকে চলতে হবে।
পৃথিবী, সৌরমণ্ডল, মানুষ এসবের ধ্বংস জীবনের ধ্বংস নয়। আমাদের ছাড়াও সে চলবে।
আমাদের বিকল্প আছে। হয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকো আর হয়তো না।
আমার ভোটটি বেঁচে থাকার পক্ষে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও অনুবাদক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। কবিতা ও অনুবাদ ভালো লাগে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।