শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

জুটি

0

বিদেশে এলে আসলেই মানুষের মন তরল হয়ে যায়। নইলে সালমান শফিক আমাকে একবারে ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়ে যায়!

গত আট মাস ধরে চেষ্টা করছি একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য। এর মধ্যে অন্তত দশ বার ম্যাসেজে, ইনবক্সে বা সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছি। প্রতিবারই কিছু একটা অজুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছেন দেশসেরা এই ব্যাটসম্যান। সর্বশেষ মিরপুর স্টেডিয়ামে একটু আলাদা করে দেখা হলে বলেছিলাম, একটু সময় দেওয়ার জন্য। খুব বিনীতভাবে সালমান বলেছিলেন,

‘দাদা, ব্যক্তিগত কিছু ঝামেলা যাচ্ছে তো। এবার শ্রীলঙ্কা থেকে ফিরে আপনাকে বড়ো ইন্টারভিউ দেব।’

গত আট মাস ধরে চেষ্টা করছি একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য। এর মধ্যে অন্তত দশ বার ম্যাসেজে, ইনবক্সে বা সরাসরি প্রস্তাব দিয়েছি। প্রতিবারই কিছু একটা অজুহাত দিয়ে পাশ কাটিয়ে গেছেন দেশসেরা এই ব্যাটসম্যান।

সেই শ্রীলঙ্কাতে বসেই রাজি হয়ে গেলেন ইন্টারভিউয়ের জন্য। শুধু রাজি? রীতিমতো আমার সাথে ডিনার করতে চাইলেন। বললেন,

‘হোটেলে বসে ভালো লাগছে না। চলেন কোথাও একসাথে খাই। খেতে খেতে কথা বলব।’

আমি তো পুরো আইফেল টাওয়ার বাসায় খুজে পাওয়ার মতো আনন্দ পেলাম। বললাম,

‘এই পাশেই একটা মল আছে— ক্রিসকেট। ওটার নিচে বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। যাবেন?’

‘চলেন। ভিড় না হলেই হলো।’

‘নাহ। খুব একটা ভিড় হয় না। আর ওখানে একটা ফুডকোর্টের মালিকের সাথে মুখচেনা আছে। বললে এক পাশ ফাকা করে দেবে।’

ব্যাস!

আমার মনে হয়, সালমানের এই রাজি হওয়ার পেছনে সাকলায়েন মুশতাকের একটা ভূমিকা আছে। সালমান নিজে স্পিনার নন; মাঝে মাঝে হাত ঘুরান মাত্র। কিন্তু বোলিং কোচ সাকলায়েনকে খুব মানেন। আর পাকিস্তানী এই সাবেক অফস্পিনারের সাথে ইদানিং আমার সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে।

আমার মনে হয়, সালমানের এই রাজি হওয়ার পেছনে সাকলায়েন মুশতাকের একটা ভূমিকা আছে। সালমান নিজে স্পিনার নন; মাঝে মাঝে হাত ঘুরান মাত্র। কিন্তু বোলিং কোচ সাকলায়েনকে খুব মানেন। আর পাকিস্তানী এই সাবেক অফস্পিনারের সাথে ইদানিং আমার সম্পর্ক খুব ভালো যাচ্ছে। শ্রীলঙ্কায় আসার পর তার সাথে আধ্যাত্মিক আলোচনা করেই সময় কাটছে।

সাকলায়েনের সাথে ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ক্যান্ডি থেকে।

শ্রীলঙ্কায় এসেছিলাম একা একা। আমার বিভিন্ন মিডিয়ার কলিগরা একদিন আগে কলম্বো পৌঁছে ক্যান্ডিতে চলে গিয়েছিল। আমি একদিন পরে বলে কলম্বো থেকে অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড নিয়ে ওদের পিছু ধাওয়া করলাম। আগে থেকেই বলে রেখেছিলাম, তাই কলিগরা তাদের রেস্ট হাউজে একটা সিট রেখে দিয়েছিল। দুপুর নাগাদ ট্রেনে বসে যখন ফোন করলাম, ওরা বলল— টিম হোটেলে যাচ্ছে।

আমি সরাসরি লাগেজ নিয়ে টিম হোটেলে চলে এলাম। এখান থেকে ডেইলি অ্যাসাইনমেন্ট সেরে রেস্ট হাউজে উঠব। কিন্তু টিম হোটেলে গিয়ে দেখি, একটু আগে চলে এসেছি; ওরা এখনও কেউ আসেনি। লবিতে অপেক্ষা করতে করতে সাকলায়েন মুশতাকের চোখে চোখ পড়ে গেল।
কাছে যেতে বলল,

‘তুমি কী আজই এলে?’

‘ক্যান্ডিতে আজ এসেছি।’

সেই গল্প শুরু হলো। এরপর রাতে খেতে গিয়ে আরেক দফা দেখা হয়ে গেল। শ্রীলঙ্কান খাবার একেবারে যাচ্ছেতাই একটা ব্যাপার। কলম্বোতে নেমে খাবার গলা দিয়ে নামাতে পারছিলাম না। এখানে এসে শুনি, সবার এই এক দশা। তাই দল বেঁধে কেএফসিতে চললাম, যদি চেনা জানা কিছু খাবার মেলে। সেখানে গিয়ে দেখি আমাদের কয়েকজন ক্রিকেটার আর সাকলায়েন।

কলিগরা চেষ্টা করতে লাগল ক্রিকেটার কারো কাছ থেকে কিছু ‘কোট’ পাওয়া যায় কি না। তাহলে আগামীকাল একটা লেখা দাঁড় করানো যাবে। আর আমাকে আটকে দিল সাকলায়েন। এগিয়ে এসে বলল,

‘চলো হাঁটি।’

ঢাকায় টুকটাক কথার সুবাদে যা বুঝেছি, সাকলায়েন খুব ধর্মমনা মানুষ। কিন্তু এবার দীর্ঘ আড্ডায় বোঝা গেল, সেটা সাধারণ নয়। অনেক উচ্চ স্তরের চিন্তা ভাবনা করে সে। জীবনের অসারতা, প্রয়োজনীয়তা, জীবনের পরের জীবন; অনেক কিছু নিয়ে কথা হলো। সেই কথা আমাদের এখনও চলছে।

আমার ধারণা প্রিয় কোচের সাথে এই সুসম্পর্ক সালমানকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে। তা না হলে আমার প্রস্তাবে রাজি হওয়া এবং ডিনার করতে রাজি হওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না।

আমার অবশ্য কারণ দরকার না। দরকার ইন্টারভিউ। সেটা পেয়ে যাচ্ছি বলে টগবগ করছিলাম। কিন্তু হলো না। ইন্টারভিউ হলো না। তবে তার চেয়ে দামি জিনিস পেলাম। একটা এক্সক্লুসিভ স্টোরি পেলাম— জুটি।

আমি আর সালমান একটু অন্ধকার জায়গা দেখে বসেছিলাম। সালমানকেই জিজ্ঞেস করলাম,

‘বলেন কী খাবেন?’

‘এখানে তো মনে হচ্ছে সাদা ভাত পাওয়া যাবে। আপনি তো গরু খান না। আমি খাই আজ।’

মেন্যু কার্ড নিয়ে উঠে গেলাম। এই ফুডকোর্টে তাই নিয়ম। উঠে গিয়ে অর্ডার করে আসতে হয়। আবার খাবার নিয়ে আসতে হয়। তবে মুখ চেনার সুযোগ নিয়ে বলে আসলাম—

‘ভাই, আমার সঙ্গে একজন ক্রিকেটার আছেন। খাবারটা একটু সার্ভ করবেন?’

এখানে ক্যাশ সামলানো ছেলেটা বাঙালি। সে হেসে বলল,

‘ক্রিকেটারটা সালমান না?’

‘হ্যাঁ। আপনি চেনেন?’

‘আমি খাবার নিয়ে আসছি। তখন দেখবেন।’

ব্যাপারটায় আমি রোমাঞ্চ পাইনি। কিন্তু খাবার হাতে এসে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখেই সালমান চোখ বড়ো বড়ো করে বলল,

‘পিন্টু না! তুই এখানে?’

ছেলেটি একটু মুচকি হেসে আমাদের টেবিলেই একটা চেয়ারে বসে পড়ল,

‘আজ তিন বছর হলো এখানে আছি।’

‘বলিস কী! আমি তো এর মধ্যে অনেকবার শ্রীলঙ্কা এলাম।’

পিন্টু নামের লোকটা হেসে বলল,

‘প্রতিবারই কলম্বোতে তোর খেলা দেখতে গেছি।’

‘খেলা দেখতে গেলি। হোটেলে দেখা করবি না!’

ছেলেটি লাজুক হাসল।

এবার সালমান আমার দিকে ফিরে বলল,

‘আপনি বিরক্ত হচ্ছেন? আসলে ও আমার এক সময়ে বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা একসাথে খেলা শুরু করেছিলাম।’

এবার আমিও একটু মজা পেয়ে গেলাম,

‘বলেন কী! পিন্টু সাহেব সালমানের সাথে খেলতেন?’

পিন্টু কিছু বলার আগে সালমান বলল,

‘ও আমার চেয়ে বেটার ব্যাটসম্যান ছিল।’

পিন্টু লজ্জা পেয়ে বললেন,

‘না, না। সালমান সবসময় বেস্ট ছিল।’

কে বেস্ট ছিল, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ হলো, একটা ভালো স্টোরি পাওয়া গেছে। একটু গল্পটা জেনে নিলে হয়। সালমানকেই জিজ্ঞেস করলাম,

‘আপনাদের পরিচয় কোথায়?’

সালমান হেসে বলল,

‘সাতক্ষীরায়। আমরা একই গ্রামের ছেলে। আমরা সেই ছোটোবেলা থেকে ভালো বন্ধু ছিলাম। ক্রিকেটও একসাথে শুরু করেছি। আমাদের জুটি খুব বিখ্যাত ছিল।’

পিন্টু মনে হয় অতীতে ডুবে গিয়েছিলেন। বললেন,

‘তোর খুলনার এগেইনস্টে সেই ম্যাচটার কথা মনে আছে?’

সালমান হাসলেন,

‘মনে না থেকে উপায় আছে। তুই ডাবল মেরেছিলি। আমি ১৯৭ রানে আউট হয়ে গিয়েছিলাম।’

আমার দিকে ফিরে সালমান বলল,

‘জানেন, ১১ রানে ৩ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তিন দিনের ম্যাচ ছিল। আমরা ৪৬৩ রানের জুটি করেছিলাম। ওই সময় এজ লেভেলে ওটা মনে হয় বেস্ট পার্টনারশিপ ছিল।’

‘একবার ঢাকা মেট্রোর বিপক্ষে সালমান ইনজুরি নিয়ে ৭ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিল। তারপরও আমরা দুই শ রানের জুটি করেছিলাম। আমরা উইকেটে থাকলে সবাই শিওর থাকত যে, একটা বড়ো পার্টনারশিপ হবে।’

পিন্টু আবার আরেকটা গল্প মনে করলেন,

‘একবার ঢাকা মেট্রোর বিপক্ষে সালমান ইনজুরি নিয়ে ৭ নম্বরে ব্যাট করতে নেমেছিল। তারপরও আমরা দুই শ রানের জুটি করেছিলাম। আমরা উইকেটে থাকলে সবাই শিওর থাকত যে, একটা বড়ো পার্টনারশিপ হবে।’

সালমান বললেন,

‘আসলে মাঠের বাইরেও আমাদের সম্পর্ক এতো ভালো ছিল যে, মাঠে আমরা দু’জনকে খুব ভালো বুঝতাম। আমরা কখনো কল দিয়ে রান নেইনি। বডি মুভমেন্ট দেখলে বুঝতাম, কী করতে হবে।’

আমার স্টোরি মোটামুটি জমে গেছে। ইন্টারভিউ আরেক দিন নিলেও চলবে। এখন শুধু পিন্টু কেন খেলা ছাড়ল, সেটা জানা দরকার। তাই দু জনকেই প্রশ্নটা করলাম,

‘কিন্তু পিন্টু সাহেব খেলা ছেড়ে দিলেন কেন?’

সালমান কিছু বলার আগেই পিন্টু বলল,

‘একটা ইনজুরি ছিল। ওটা আর রিকভার করতে পারিনি। পরে ফেরার অনেক চেষ্টা করেছি। হয়নি।’

ব্যাস। আমার স্টোরি হয়ে গেল— কলম্বোয় মিলল সালমানের জুটি!

পিন্টু বিল দিতে দিলেন না। তিনি এই দোকানটার ম্যানেজার। বললেন,

‘আরেক দিন দেবেন। আজ সালমানের গেস্ট আপনি।’

তাই হলো। ক্রিসকেট থেকে হোটেল তাজ পায়ে হাঁটা পথ। যদিও ক্রিকেটারদের এভাবে বাইরে বের হওয়া মানা থাকে। কিন্তু সালমান অনুমতি নিয়ে এসেছিলেন। আর কলম্বো তখন শান্ত শহর। তাই আমরা হেঁটেই ফিরছিলাম। ফিরতে ফিরতে মনে হলো, একটু কোথায় কিন্তু থেকে গেছে।

সালমানকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘পিন্টুর ইনজুরির পর সেরকম ট্রিটমেন্ট হয়নি? ফিরতে পারলেন না…’

সালমান এড়াতে চাইলেন। বললেন,

‘নাহ। তখন তো এতো সুযোগ সুবিধা ছিল না। আর আমরা তখন সাতক্ষীরা থাকি। মাত্রই ঢাকায় এসেছি।’

‘ঢাকায় ক্লাব পেয়েছেন তখন?’

‘হ্যাঁ, আমরা দু’জনই তখন সেকেন্ড ডিভিশন একটা টিমে খেলি।’

‘তাহলে তো হাতে কিছু টাকাও ছিল।’

‘ওই টাকাই তো ওকে শেষ করল।’

কথাটা বলেই জিভ কাটলেন সালমান। আমি ধরে ফেললাম,

‘তার মানে, আরও কিছু আছে, সালমান।’

‘শোনেন, এটা লিখেন না।’

‘নাহ লিখব না। আপনি বলেন। গল্পটা জানা থাক।’

পিন্টু আসলে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারেনি। সেবার ক্লাব থেকে আমরা ভালো একটা অ্যামাউন্ট পেয়েছিলাম। ও সেই টাকা দিয়ে যাচ্ছেতাই করে বেড়াত। ক্রিকেটে আর মন দিতে পারেনি। পরেরবার ক্লাবে ডাক পেলেও আর ইলেভেন পেত না।

‘পিন্টু আসলে সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারেনি। সেবার ক্লাব থেকে আমরা ভালো একটা অ্যামাউন্ট পেয়েছিলাম। ও সেই টাকা দিয়ে যাচ্ছেতাই করে বেড়াত। ক্রিকেটে আর মন দিতে পারেনি। পরেরবার ক্লাবে ডাক পেলেও আর ইলেভেন পেত না। ফিটনেস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।’

এটুকু হয়তো লেখা যাবে না। কিন্তু সবমিলিয়ে গল্পটা খারাপ হলো না। কিন্তু গল্পটার একটা পরিশিষ্ট বাকি থেকে গিয়েছিল।

পরদিন রাতে ম্যাচ শেষ করে ক্রিসকেটের নিচেই খেতে গিয়েছিলাম। সঙ্গে আরও দুই তিন কলিগ ছিলেন। পিন্টুর দোকানটাতেই খেলাম। খাওয়া শেষে সবাই বের হয়ে যাচ্ছে, তখন পিন্টু ডাক দিলেন,

‘দাদা, একটা কথা বলতাম।’

আমি বাকিদের বললাম, একটু পরে আসছি। পিন্টুর সাথে কথা বলার জন্য দাঁড়ালাম। পিন্টু কাছে এসে মুখটা নিচু করে বলল,

‘কেন খেলা ছাড়লাম, জানেন?’

‘আমি শুনলাম, আপনি একটু বিশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিলেন।’

পিন্টু খেপে গেল,

‘আমি আর কী করতে পারতাম? আমার চোখটাই তো শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমি তো বল দেখতে পেতাম না।’

‘মানে! আসল কাহিনিটা কী?’

‘কাহিনি হলো আমাদের দু’জনকে আন্ডার নাইনটিনে ডাকা হয়েছিল। আমরা জানতাম, যেকোনো একজন চান্স পাব। রাতে হোটেলে বসে বসে দু’জনই গল্প করছিলাম, যে চান্স পাবে সে বাকি জনকে হেল্প করবে।’

‘তারপর?’

‘ঘুমের মধ্যে আমার ডান চোখে কলম দিয়ে গুতো দিয়েছিল…’।

‘কে সালমান!’

‘হ্যাঁ। এই দ্যাখেন।’—চোখের সবসময়ের কালো চশমাটা খুলে বিকৃত একটা অক্ষি কোটর দেখাল পিন্টু।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কথাসাহিত্যিক, ক্রীড়া সাংবাদিক

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।