বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

‘একটা গ্লাসের মধ্যে কিছু স্বপ্ন, কিছু জাদু আর কিছু বাস্তবতা নিলাম। তারপর ঝাঁকালাম। এটাই হলো আমার সিনেমা’: বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

0

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : দেবর্ষি ঘোষ
ভূমিকা এবং ভাষান্তর : নাফিস সাদিক


বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪– ১০ জুন, ২০২১)


সত্যজিৎ–ঋত্বিক–মৃণাল যুগের শেষে বাংলা চলচ্চিত্র অঙ্গনে স্বতন্ত্র স্বরের নির্মাতাদের একজন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ১৯৪৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পুরুলিয়ার আনাড়ায় তাঁর জন্ম। কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পড়েছিলেন অর্থনীতি নিয়ে। শিক্ষাজীবন শেষে অধ্যাপনা শুরু করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ শ্যামসুন্দর কলেজে।

আগে থেকেই কবিতা লিখতেন, এরপর কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হওয়ার পর চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আলাদা অনুরাগ জন্ম নেয়। ১৯৭৮ সালে নির্মাণ করেন প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘দূরত্ব’। এরপর একে একে নির্মিত হলো ‘নিম অন্নপূর্ণা’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘বাঘ বাহাদুর’, ‘তাহাদের কথা’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘উত্তরা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’, ‘স্বপ্নের দিন’, ‘কালপুরুষ’, ‘জানালা’, ‘টোপ’, ‘উড়োজাহাজ’– সহ আরও অনেক ছবি। নিজেও একজন কবি হওয়ায় তাঁর ছবিগুলোর ফ্রেমে-ফ্রেমে লেগে থাকে এক ধরনের কাব্যিক স্পর্শ। দেখার সময় তারা জাগিয়ে তোলে গভীরতম কোনো বোধ, অন্তরতম কোনো অনুভূতি, নির্জনতম কোনো চেতনা। অজস্র লোকের ভিড়ের মাঝে বাস করেও মানুষের ভিতরে অসীম একাকীত্ব, কিংবা প্রকৃতির সাথে তাদের যে নিবিড় ও চিরন্তন সম্পর্ক, তাকে পুনঃপুন ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর ছবিতে। পরিচালক হিসেবে দীর্ঘ চার দশকের যাত্রায় ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পাশাপাশি ভেনিস, বার্লিন, লোকার্নোর মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতেও সম্মানিত হয়েছেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। গত ১০ জুন, ২০২১ দক্ষিণ কলকাতায় নিজের বাড়িতে ৭৭ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন এই গুণী নির্মাতা।

করোনা মহামারীর কারণে থমকে গিয়েছিল তাঁর সর্বশেষ ছবির কাজ। সেই সময়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন দেবর্ষি ঘোষ। সাক্ষাৎকারটির উল্লেখযোগ্য অংশ নিচে দেওয়া হলো—

 

দেবর্ষি ঘোষ: সিনেমার বিন্যাস এবং শ্যুটিং পশ্চিমবঙ্গে হওয়া সত্ত্বেও আপনি হিন্দিতে ছবি বানান কেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: শৈশবের কয়েক বছর আমি খড়গপুরে কাটিয়েছি। সেখানকার সংস্কৃতি কিন্তু একেবারেই ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ ছিল না। জনসংখ্যার একটা বড়ো অংশ ছিল তেলেঙ্গি সম্প্রদায়ের, যারা অন্ধ্র প্রদেশ থেকে ওখানে এসেছিল। খড়গপুরেই আমি প্রথম বাঘ বাহাদুরদের দেখি। ওরা এক ধরনের লোকশিল্পী, যারা নিজেদের গায়ে বাঘের মতো করে রং লাগায়, গান গায় আর নাচে। এরা বাঙালি ছিল না, এরাও ছিল তেলেঙ্গি। পবন মালহোত্রাকে প্রধান চরিত্রে রেখে এজন্য ‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯) ছবিটা আমি বানিয়েছিলাম হিন্দিতে।

একই জিনিস ঘটেছে ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’ (২০১৩) ছবিটার ক্ষেত্রে। সংস্কৃতি এবং প্রধান চরিত্রের পারিপার্শ্বিক অবস্থা নির্ধারণ করে দেয় ছবির ভাষা। তবে ‘আন্ধি গলি’ (১৯৮৪) ছবিটা হিন্দিতে বানাতে বাধ্য হয়েছিলাম, কারণ প্রযোজক চাইছিলেন একটা বড়ো অংশের দর্শকের জন্য ছবিটা নির্মিত হোক।


বাঘ বাহাদুর

‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯) চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ; ছবি সৌজন্য : অলোকানন্দা দাশগুপ্ত


দেবর্ষি ঘোষ: যে ধরনের চরিত্রগুলো আপনার ছবিতে ঘুরেফিরে আসে, তারা হয় আগামী দিনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে, অথবা অতীতের মাঝে আশ্রয় খোঁজে। এরা আপনাকে কেন আকর্ষণ করে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: বস্তুবাদী না এমন মানুষকে আমি পছন্দ করি। যারা আবেগপ্রবণ, সংবেদনশীল, কথা বলতে বলতে অন্য কোথাও হারিয়ে যায়, এমন মানুষের সঙ্গ আমায় আকর্ষণ করে। যারা খুব প্র্যাকটিকাল, যেকোনো কিছু খুব সহজে— দ্রুত ধরে ফেলে, তাদেরকে আমার অতো ভালো লাগে না। আমার ছবির ইমেজ এবং চরিত্রগুলো একান্তই স্বতন্ত্র এবং ব্যক্তিগত। যে কোনো ‘আনোয়ার কা আজব কিসসা’য় আপনি যে ইমেজগুলো দেখেন সেগুলোও আমার ভেতরে জন্ম নিয়েছে।

নন্দনগত দিক থেকে আমার শুরুর দিকের ছবিগুলো, যেমন— ‘দূরত্ব’ (১৯৭৮), ‘গৃহযুদ্ধ’ (১৯৮২), ‘নিম অন্নপূর্ণা’ (১৯৭৯) এবং ‘আন্ধি গলি’ (১৯৮৪) পরের ছবিগুলোর থেকে আলাদা। আমি যেহেতু কবিতা লিখি, একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আমার সিনেমার ভাষাকে কবিতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার কবিতায় যে ইমেজ এবং অনুভব আছে, সেগুলো স্বতন্ত্র বলেই মনে করি। কোনো রকম বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ, বা ইমেজ ধার করে আনার ব্যাপার সেগুলোয় নেই।

রিয়েলিস্টিক সিনেমা আমি দেখতে পছন্দ করি, কিন্তু তেমন ছবি বানানোয় আমার কোনো উৎসাহ নেই। একটা গ্লাসের মধ্যে কিছু স্বপ্ন, কিছু জাদু আর কিছু বাস্তবতা নিলাম। তারপর ঝাঁকালাম। এটাই হলো আমার সিনেমা।


বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ২

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৪– ১০ জুন, ২০২১)


দেবর্ষি ঘোষ: ১৯৮৮ সালে নির্মিত ‘ফেরা’র আগে পর্যন্ত আপনি আপনার বেশিরভাগ ছবি নকশাল আন্দোলনের প্রভাবকে কেন্দ্র করে বানিয়েছেন। প্রধান চরিত্রগুলো আগে নকশালপন্থী ছিল এবং পরে আদর্শের সাথে লড়াইয়ের ব্যর্থতার ভার বহন করে চলেছে। এই হতাশাবাদের উৎস কী? একই রকম বিষয়কে কেন্দ্র করে সত্যজিৎ রায় বা মৃনাল সেনের ছবিতে কিন্তু এরকম দেখা যায়নি।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: নকশালবাড়ি আন্দোলনের সময় আমি ছাত্র ছিলাম। বয়স ছিল ২৩। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমি গিয়েছি এবং খুব কাছ থেকে পুরোটা দেখেছি। আমার দেখাটা সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের মতো না। ওনারা এটা নিয়ে আবেগপ্রবণ কিংবা আশাবাদী হতে পারতেন, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। আমার খুব কাছের কিছু বন্ধু এ সময়ে নকশালপন্থী হয়ে গিয়েছিল। আমি ওদেরকে সমর্থন দিয়েছি, কিন্তু নিজে আন্দোলন থেকে দূরে থেকেছি।

আমার মনে হয়েছিল কোথাও যেন একটা ভুল রয়ে গিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মূল্যবোধের সাথে তাদের আদর্শের সংঘাত হচ্ছিল। আমার মনে হয়েছিল নকশালপন্থার মূল জিনিসটা এই মানুষগুলোর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।

এরপর তো খুনোখুনি আর সহিংসতা শুরু হয়ে গেল– যেটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। আমি বুঝতে পারতাম যে, তারা সৎ। কিন্তু তাদের মধ্যে এক ধরনের বৈপরীত্য কাজ করত। আমি এটাকে রোমান্টিসাইজ করতে পারিনি। আমার সবসময় মনে হতো, তারা কিছুই পরিবর্তন করতে পারবে না এবং বাস্তবেও তারা পারেনি।

 

দেবর্ষি ঘোষ: শৈশব এবং কৈশোরের একটা বড়ো অংশ কলকাতার বাইরে থাকায় কি আপনার মধ্যে নগরের বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা থেকে এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে? আপনার ছবির চরিত্রদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা প্রকৃতির কাছাকাছি ফিরতে চায় বা শৈশবের সারল্যে ফেরার স্বপ্ন দেখে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: হতে পারে। আমার বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান রেলওয়ের একজন ডাক্তার। আমরা এক রেলওয়ে কোয়ার্টার থেকে অন্য রেলওয়ে কোয়ার্টারে ঘুরে বেড়িয়েছি। গ্রামে বাস করেছি, পুরুলিয়ার মতো ছোটো শহরেও থেকেছি। খড়গপুরে থাকার সময় আমি ঘাসের মধ্যে লাল পোকাদের সাথে খেলতাম, এটা আমার এখনও মনে পড়ে। শৈশব আমাকে অজস্র ইমেজের সন্ধান দিয়েছিল। আর সেগুলোই আমার ছবিতে ঘুরেফিরে আসে।

যখন আমি প্রথম শহরের সংস্পর্শে এলাম, ততোদিনে আমি বড়ো হয়ে গেছি। শহরের সাথে আমি ঠিক খাপ খাওয়াতে পারলাম না, যেটা এখনও পারি না। কিন্তু এখন তো কলকাতার বাইরে বাস করারও কোনো উপায় নেই। ইচ্ছে হয় আমি যদি কোনো একটা নির্জন সৈকতে চলে যেতে পারতাম, যেটা বোম্বের মতো জনবহুল না। অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনো একটা পাহাড়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম। শহর আমাকে ভারাক্রান্ত করে, হতাশ করে।

পুরুলিয়ায় আমার কাছে নায়ক ছিল ঝুমুর নৃত্যশিল্পীরা, যাদেরকে আমার ‘উত্তরা’ (২০০০) ছবিতে দেখতে পাবেন। তারা মনের আনন্দে গাইত এবং নাচত, কিন্তু কখনও টাকা পয়সা দাবি করত না। তারাই ছিল আমাদের কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মোহাম্মদ রাফি, মান্না দে। তাদের লোকাল রেকর্ডিংগুলো আশপাশের অঞ্চলে বিক্রি হতো।

খড়গপুরে একমাস ধরে রামায়ণ ও মহাভারত-কেন্দ্রিক যাত্রাপালা হতো। বাঘ বাহাদুররা মহররম থেকে দুর্গাপূজা-সহ বছর জুড়ে অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। তারা গাইত, নাচত এবং অভিনয় করত। আমাদের কাছে ওরাই ছিল নায়ক। এখন তো ‘নায়কে’র ধারণাটাই বদলে গেছে।


বাঘ বাহাদুর ২

‘বাঘ বাহাদুর’ (১৯৮৯) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্যে পবন মালহোত্রা ; ছবি সৌজন্য : দূরদর্শন


দেবর্ষি ঘোষ: আপনি কি মনে করেন আপনার ছবিতে পুরুলিয়া অথবা বিহারের শিমুলতলার মতো যেসব গ্রামীণ বা আধা-গ্রামীণ পরিবেশ দেখিয়েছেন, সেগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে? অথবা এর মাঝে হারিয়ে গেছে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: পুরুলিয়ার যে জায়গায় আমি ‘উত্তরা’র (২০০০) শ্যুটিং করেছিলাম, সে জায়গাটা ছিল খুব অন্য রকম। বহু বছর পর সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম, ঐ জায়গাটা পুরোপুরি খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। ট্রাকে করে সেখানকার লাল মাটি অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পুরো জায়গাটা এখন বড়ো বড়ো গর্ততে ভর্তি। ওখানে একটা পাবলিক হাসপাতাল বানানো হয়েছে, যেখানে রোগী আছে, চিকিৎসক নেই।

প্রকৃতি আমার কাছে একটা সুগন্ধি নির্যাসের মতো, যা সব বেদনা দূর করে। আমি নিজের চোখে মানুষকে প্রকৃতি ধ্বংস করতে দেখেছি, তবে প্রকৃতিও মাঝে মাঝে রুখে দাঁড়ায়। যার ফল আমরা এখন অনুভব করছি। যখন বিন্ধ্যা পর্বতের কাছে একটা রেলস্টেশনে আমার বাবার পোস্টিং হয়েছিল, তখন পাহাড়ের ওপর পুড়তে থাকা জঙ্গল দেখার কথা আমার এখনও মনে পড়ে। যখন মানুষ প্রকৃতির সাথে খেলায় মেতে ওঠে তার ফল খুব মারাত্মক হয়।


উত্তরা

‘উত্তরা’ (২০০০) ছবির শ্যুটিংয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ; ছবি সৌজন্য : অলোকানন্দা দাশগুপ্ত


দেবর্ষি ঘোষ: আপনি একজন স্বশিক্ষিত পরিচালক, যিনি কলকাতার ফিল্ম সোসাইটিগুলোর সদস্য হয়ে সিনেমার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। এরপর অর্থনীতির শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে সিনেমা বানানো শুরু করলেন…

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ষাট বা সত্তরের দশকে আমরা যেসব ছবি দেখতাম, সেগুলোর নির্মাণ বেশিরভাগই ছিল খুব স্বতন্ত্র ধরনের। আত্মজৈবনিক না হলেও প্রচণ্ড রকমের ব্যক্তিগত। কোনো ধরনের পুনঃনির্মিত বা নিয়ন্ত্রিত ইমেজের ব্যবহার সেগুলোতে ছিল না। ঐ ছবিগুলোই আমাকে অনুপ্রাণিত করল।

তারও আগে আমি চোখ বন্ধ করলে ইমেজ দেখতে পেতাম। গান শোনা, বা কবিতা পড়ার সময়ও মাথার মধ্যে এমন ইমেজ তৈরি হতো। আমার মা গান গাইতেন, আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। মা আমাকে চোখ বন্ধ করে শুনতে বলতেন। কোনো একটা সুর শুনলে বা একটা পেইন্টিংয়ের দিকে তাকালে আমার মাথার ভিতর অজস্র ইমেজ তৈরি হতো। আমরা চারপাশে যেসব ইমেজ দেখি, সেগুলো নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ব্যক্তিগত ইমেজের মধ্যে এক ধরনের স্বাতন্ত্র্য থাকে। এর মাঝে স্বপ্ন থাকে, জাদু থাকে, বেঁচে থাকার উত্তেজনার গল্প থাকে।

ঐ সময় আমি একটা স্টিল ক্যামেরা হাতে পেলাম আর ফটোগ্রাফি প্র্যাকটিস করতে শুরু করলাম। সিনেমা এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে আমি আমার প্রবৃত্তি এবং অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করি। আমি কখনো কোনো ফিল্ম স্কুলে যাইনি, তবে কলকাতার সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এবং টেলিভিশন ইন্সটিটিউটের আমি চেয়ারম্যান ছিলাম। আমার ছাত্রদেরকে আমি বলতাম— যদি তুমি এখন ফিল্ম নাও বানাতে পারো, তবুও ইমেজের কথা ভাবতে শুরু করো। কবিতা পড়ো, গান শোনো আর মাথার ভিতর ইমেজ জমা করতে থাকো।

 

দেবর্ষি ঘোষ: আপনার প্রিয় নির্মাতা কারা?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: লুই বুনুয়েল, আন্দ্রেই তারকোভস্কি, থিও অ্যাঞ্জেলোপুলোস।


মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

মৃণাল সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং আদুর গোপালকৃষ্ণন ; ছবি সৌজন্য : অলোকানন্দা দাশগুপ্ত


দেবর্ষি ঘোষ: আপনি আপনার ছবির বিচিত্র স্বভাবের নায়ক এবং তাদের ক্ষুব্ধ-বিচলিত জীবনসঙ্গীদের প্রতি যে সহমর্মি, সেটা বোঝা যায়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: আমি মনে করি না যে মানুষ সাদা-কালোর মতো বর্ণহীন বা বিবর্ণ। প্রত্যেকের মধ্যে নানা রকম দিক থাকে— কিছু গ্রহণযোগ্য, কিছু গ্রহণযোগ্য নয়, আবার কিছু দিক অন্য দিকগুলোকে পরাভূত করে। আমার চরিত্রগুলো তাদের ভিতরের বিভিন্ন প্রবৃত্তির মধ্যে ঘুরতে থাকে। শুরুতে এদের যতোটা সরল মনে হয়, বাস্তবে এরা তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।

আমার ‘চরাচর’ ছবির লখার কথা যদি ধরেন, সে বাইরে থেকে সাধাসিধে এবং সাধারণ, কিন্তু সে অসাধারণ সব জিনিসের স্বপ্ন দেখে। আবার তার স্বপ্ন তাকে এমন জায়গায় নিয়ে পৌঁছায় যে, কিছু মানুষ তাকে পছন্দ করে কিন্তু বাকিদের কাছে সে অসহনীয় হয়ে ওঠে।


চরাচর

‘চরাচর’ (১৯৯৪) চলচ্চিত্রে লখা চরিত্রে রজিত কাপুর ; ছবি সৌজন্য : অলোকানন্দা দাশগুপ্ত


দেবর্ষি ঘোষ: আপনার ‘কালপুরুষ’ (২০০৫) ছবিটি একটা বাবা-ছেলের সম্পর্ক নিয়ে, যেখানে বাবা আত্মহত্যা করেন। চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্যে জগৎ সংসার নিয়ে পিতা-পুত্রের যে কাল্পনিক কথোপকথন হয়, তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এই ছবিটা দেখে অনেক মানুষ আমাকে টেলিফোন করেছিলেন। কেউ কেউ ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন, তাদের বাবার কথা স্মরণ করেছিলেন। মধ্যরাতের পর ফোন করে কেউ কেউ ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলেছিলেন।

আমার কোনো ছবিকেই ঠিক আত্মজৈবনিক বলা যাবে না। তবে আত্মজীবনীর উপাদান আমার কাজে স্বাভাবিকভাবেই ঘুরেফিরে আসে। ‘কালপুরুষ’ও তাই। এর বিষয়বস্তু আমি অনুভব করেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি আর তার ঘ্রাণটুকু নিয়েছি। যখন আমি ছোটো ছিলাম, আমার বাবা ছিলেন খুব ব্যস্ত মানুষ। আমাদেরকে যথেষ্ট সময় দিতে পারতেন না। ফলে আমাদের মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।

কিন্তু আমি কখনও তাকে বুঝতে ভুল করিনি। আমি বুঝতে চেয়েছিলাম, নিজের ছেলের সাথে তিনি কোন ধরনের সম্পর্ক রাখতে চেয়েছিলেন, জীবন নিয়ে কোন কোন ধরনের প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো– যেমন, জীবনের অর্থ কী, কেন আমি এখনও বেঁচে আছি, ইত্যাদি। জীবনের যেমন অর্থ আছে, উদ্দেশ্য আছে, তেমনি একজন মানুষের নিজেকে মেরে ফেলার পেছনেও নিশ্চয়ই সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ থাকতে পারে। তাদের নিশ্চয়ই পৃথিবীকে আর বলার কিছু থাকে না।


কালপুরুষ

‘কালপুরুষ’ (২০০৫) ছবিতে পিতা এবং পুত্রের চরিত্রে মিঠুন চক্রবর্তী এবং রাহুল বোস


দেবর্ষি ঘোষ: ওপর ওপর না বোঝা গেলেও সহিংসতা আপনার ছবিতে লুকিয়ে থাকে, যেমন— ‘উত্তরা’ (২০০০) এবং ‘টোপ’ (২০১৬)।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ভয় জিনিসটাকে বালিশের তলায় রেখে আমরা ঘুমাই। আমরা জেগে উঠি, তার সাথে ভয়ও জেগে ওঠে, সারাটা দিন আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায়, তারপর আমাদের সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। ভয় থেকে আমাদের নিস্তার নেই। আমরা জানি না ভয় কোন সময়, কিভাবে আমাদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবে। আমি এটা দেখেছি, অভিজ্ঞতা থেকে অনুভব করেছি এবং পরিষ্কারভাবে বুঝেছি।

 

দেবর্ষি ঘোষ: আপনি, সত্যজিৎ রায় অথবা মৃণাল সেন যে ধরনের আর্টহাউস ছবি বানিয়েছেন এবং যেগুলো ক্রমাগত আন্তর্জাতিক সম্মান অর্জন করেছে, কলকাতায় তেমন ছবির নির্মাণ প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এটা তখনই ঘটে যখন কেউ সিনেমা ভালো না বেসে সিনেমা বানাতে আসে। যখন কেউ ফিল্ম বানায় অর্থের জন্য, খ্যাতির জন্য অথবা দেশ-বিদেশে ঘোরার জন্য, তখন ফিল্ম ফিল্ম হয় না। যখন আমি শিক্ষকতা ছেড়ে ছবি বানাতে আসি, তার পেছনে অর্থ বা সুবিধার কোনো প্রলোভন ছিল না। ছবি বানানোয় আমি জীবনের কোনো পর্যায়ে কখনো আপোস করিনি। যদি কোনো প্রযোজক আমার কাজে হস্তক্ষেপ করত, আমি শ্যুটিং মাঝপথে ফেলে চলে যেতাম এবং যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা সেখান থেকে ফিরে যেত, আমি শ্যুটিং শুরু করতাম না।

আমি জানি সারা বিশ্বজুড়ে আমার ছবির দর্শক রয়েছে। এমন না যে আমার হাউসফুল শো চাই না, কিন্তু তাই বলে দর্শক টানার জন্য আমি ছবি বানানোয় আপোস করব না।

 

দেবর্ষি ঘোষ: সিনেমা পরিচালকের জীবনে কি কখনও অবসর আসে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ছবি বানানোয় শারীরিক শ্রম গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই একটা সময় অবসর নিতেই হয়। ‘উড়োজাহাজে’র (২০২০) শ্যুটিং করার সময় হাসপাতাল থেকে আসা-যাওয়া মিলিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা বাজে রাস্তায় জার্নি করে আমাকে শ্যুটিংয়ে পৌঁছতে হতো। শরীরের উপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল গেছে।


উড়োজাহাজ

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি `উড়োজাহাজ’ (২০২০); পোস্টার ডিজাইন: ধ্রুব এষ


ফিল্মমেকারের জীবনে অবসর আসতে পারে, কিন্তু ইমেজ কখনও তাকে ছেড়ে যায় না। ইমেজকে জড়িয়ে ধরে সে ঘুমোতে যায়, আবার ইমেজ মাথায় নিয়ে জেগে ওঠে। যখন আমি ফিল্ম বানাচ্ছি না, তখন আমার সে রকম কিছু করতে ভালো লাগে না। শুধু নিজের স্মৃতির সাথে বোঝাপড়া করতেই সময় কেটে যায়। হয়তো ছবি বানানো আর হচ্ছে না, তবুও বেঁচে আছি, কবিতা লিখি, সুর বানাই।

বার্ধক্য জীবনেরই অংশ। আমি হয়তো আর ছবি বানাতে পারব না, তবে এটা নিয়ে আমার খারাপ লাগে না। করোনা মহামারি শুরুর আগে আমি আমার পরবর্তী ছবির শ্যুটিং শুরু করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু সেটা বানানো এখন আর সম্ভব না। আমি এক সময় হয় আমার অথবা জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ছবি বানাতে চেয়েছি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে সিঙ্গেল স্ক্রিন হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে, তাতে ছবি বানানো এবং থিয়েটারে মুক্তি দেওয়াটাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

 

  • [ এই সাক্ষাৎকারটি Scroll.in ওয়েবসাইটে প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ২৬ নভেম্বর, ২০২০ সালে। কথোপকথনটি ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষান্তরের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারগ্রাহক দেবর্ষি ঘোষের অনুমতি গৃহীত হয়েছে। ]
শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ এপ্রিল ১৯৯৯ সালে, সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জে। শিক্ষাজীবনের সূচনা এবং বেড়ে ওঠা সেখানেই। কৈশোর কেটেছে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যয়নরত। সাহিত্য, চিত্রকলা এবং চলচ্চিত্রের প্রতি অনুরাগ থেকে বিচিত্র বিষয়ে লিখতে ভালোবাসেন। প্রকাশিতব্য গ্রন্থ: ‘ঋতুপর্ণ পাঠ: চলচ্চিত্র, জীবন এবং অন্যান্য'।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।