বৃহস্পতিবার, মে ২

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : পর্ব ১৬

0

গল্পের চরিত্রটি গ্রাম থেকে বউ নিয়ে শহরে এসেছে। দ্রষ্টব্য, বাংলাদেশের গ্রামই শহরে আসে। শহর গ্রামে যায় না। গেলেও, বসবাসের জন্য যায় না। এটাই সত্য। আমি এসেছি মধুপুর থেকে। আমি এসেছি ভায়না থেকে। মধুপুর গাড়াগঞ্জ বাজারলগ্ন কুমার নদের পাড়ের ছোটো গ্রাম। গাড়াগঞ্জ বাজার থেকে মধুপুর হয়ে রাস্তা গেছে বারোইপাড়া, হাবিবপুর, কবিরপুর। তারপরেই তো শৈলকূপা। ভায়না আমার জন্মস্থান। মামাবাড়ি। হরিণাকুণ্ডু থানা। শৈলকূপা আর হরিণাকুণ্ডু ঝিনেদার দুইপাশের দুই থানা। পরে বাবা-মা ঝিনেদা শহরে চলে গেলেন। আমরা ভাইবোনরাও গেলাম শহরে। আমি ঝিনেদা থেকে খুলনা চলে গেলাম, খুলনা থেকে পরে ঢাকায় চলে এলাম। এভাবেই জীবনানন্দ দাশের একটা গদ্যের কথা মনে পড়ে গেল, নাম—গ্রাম ও শহরের গল্প। কিন্তু আমরা জীবনানন্দ বা জীবন বিষাদে থাকব না এখন, থাকব না কোনো গ্রামে, আমরা থাকব পুরান ঢাকার ভজহরি সাহা স্ট্রিটে। নারিন্দার ভজহরি সাহা স্ট্রিটেরই অন্য নাম ভূতের গলি। কেউ কেউ বলেন এটি ইংরেজ বুট সাহেবের গলি। সেখান থেকেই কি ভূতের গলি? নাকি এই গলিতে কী পরিমাণ ভূত হাঁটাচলা করে বা করত সেকালে, তাই নাম হয়ে গেল ভূতের গলি? বিতর্ক চলতেই পারে। তবে ভূতের গলি ছিল, আছে, থাকবেও হয়তো। এই রচনা পড়ার পর পাঠক হিসেবে যদি কিছু প্রশ্ন মনে আসে, একদিন নারিন্দার ভজহরি সাহা স্ট্রিটে গিয়ে স্বশরীরে ভূতের গলিকে দেখে আসতে পারেন। দেখবেন, কোনো বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা হয়তো ৩৩ ভজহরি সাহা স্ট্রিট, নারিন্দা, ঢাকা। আবার পরের বাড়ির নেমপ্লেটেই হয়তো লেখা ৩৪ ভূতের গলি, নারিন্দা, ঢাকা। আবার এরপরের বাড়ির নেমপ্লেটে হয়তো লেখা ৩৫ ভজহরি সাহা স্ট্রিট (ভূতের গলি), নারিন্দা, ঢাকা। অর্থাৎ ভজহরি সাহা স্ট্রিট ভূতের গলিতে ব্রাকেটবন্দি। কিন্তু আমার এসব কথা বলার উদ্দ্যেশ্য মোটেও এলাকার বর্ণনা নয়। তাহলে কী উদ্দেশ্য? শহীদুল জহিরের জন্ম ৩৬ ভূতের গলিতে, কাঁটা গল্পের প্রধান চরিত্র আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িও ৩৬ ভূতের গলি। শহরের পুরোনো এলাকার এই বাড়িতেই ইতিহাসের তিন সময়ে তিন দম্পতি গ্রাম থেকে এসে ভাড়াটিয়া হয়ে বসবাস করে। তা করুগগে।


p 16. 1

৩৫ মি. মি. প্রজেকশন ব্যবস্থা এখন আর নেই, কিন্তু কাঁটাতে দেখা যাবে


আমি বলতে চাচ্ছিলাম, সেই তিন সময়ে আগত চরিত্রের তো একই নাম, শ্রী সুবোধচন্দ্র দাস। গরীব বলে ‘শ্রী’ আর লাগে না, লাগায়ও না। তো গল্পের সুবোধের ঢাকায় পেশা কী? কাঁটা গল্পে তা নির্ণীত হয়নি। তাতে গল্পের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তা যদি ছবি হয়, তাইলে নিশ্চিত পেশা লাগবে। সেই পেশাগত বাস্তবতাতেই তো তাদের ঘরের আসবাবপত্র, তাদের ব্যাবহারিক পোশাক, বাজার-সদাই করা দেখে বোঝা যাবে তাদের অর্থনৈতিক স্ট্যাটাস। অর্থাৎ পেশাগত অবস্থানের ভিত্তিতে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থান ভিজুয়াল করতে হবে। তাইলে ১৯৮৯-৯০ সালে যে চরিত্র সুবোধচন্দ্র দাস, সে কি চাকরি করে ঢাকায়? বাড়ি ভাড়া যে দেয়, চালডাল যে কেনে, কীভাবে কেনে? বউ স্বপ্নারানী দাসকে যে এটা ওটা কিনে দেয়, টাকা কই পায়? ঘরে তো বউ স্বনারানী ঘরের কাজ সামলায়, বাইরে সুবোধ কোথায় যায়? কী করে? বা এই বাড়িতে আগেও যে সুবোধ এসেছিল ১৯৭১ সালে, সে কী কাজ করত? ১৯৬৪ সালে যে সুবোধ এসেছিল, সে কি কাজ করত? অর্থাৎ কাঁটা গল্পের চরিত্রদের চাকরি-বাকরি জুটিয়ে দিতে হবে আমাকে, ছবি বানাচ্ছি বলে তাও করতে হবে আমাকে? আমি নিজেই চাকরিতে থিতু হতে পারিনি, চাইওনি, তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ না করেই চাকরিতে ঢুকছিলাম। থান শাড়িতে ফ্রি হ্যান্ড ডিজাইনার ছিলাম। সংবাদপত্রে সাব-এডিটর হিসেবে শুরু করে, ভারপ্রাপ্ত ফিচার এডিটর, ফিচার এডিটর এবং সহকারী সম্পাদক পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলাম। ৭ কি ৮টি সংবাদপত্রে ছিলাম সাকুল্যে। বিজ্ঞাপনী সংস্থায় স্ক্রিপ্ট রাইটারের চাকরি করেছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারির চাকরির প্রস্তাব এলো, আমি রাজি হয়ে গেলাম প্রাথমিকভাবে, তারপর তাদের বললাম, আমিই তো মাস্টার্স করিনি!। ঢাকা সেনানিবাসের মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর ‘বিজয় কেতন’ এ টেক্সট এডিটর হিসেবে চাকরি করেছি। একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বিভাগ চালানোর মতো ফালতু জবও করেছি। দু-তিনটে এনজিওতেও কাজ করেছি। বিচিত্র চাকরি। দাশ বাবু বলেছেন, আমরাও জানি—’পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।’ প্রায় ১৫ বছরে ১৬টি চাকরি আমার। নানান ঘাটের, নানান তরিকার চাকর হয়েছি। ফাইনালি বুঝেছি, ও আমার দ্বারা হবে না, হয়নি। ওরে, চাকরি আমার কোনোকালেও পছন্দের কিছু ছিল না, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারিই হোক আর বিসিএস পাট্টির ক্যাডারগিরিই হোক, শেষ পর্যন্ত চাকর তো চাকরই! চাকরের প্রতিভা হচ্ছে সে সিস্টেমের কাছে ভীষণ অনুগত। দাস। চাকর চাকরিকে জীবিকা বানায়। আমার তো প্রতিভা আছে, ফিল করি। তাই শ্রমিকগিরিতেই আনন্দ পাই। প্রতিভা অবশ্য চাকরেরও আছে, বেঁচে থাকার জন্য চাকরগিরির আনুগত্যের প্রতিভা। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকররির নামে মাসে মাসে মাইনে পাওয়া মাহেনদারকেও অধ্যাপক বলা হয়, বাংলাদেশে। আবার আদিখ্যেতা করে মাহেনদারদের বুদ্ধিজীবী তকমাও দেওয়া হয়। লে হালুয়া। বঙ্গদেশে মাহেনদার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিতি অর্জন করে থাকে! শ্লাঘা অর্জনকারি দাসের দাস। কিন্তু কথা বলছিলাম সুবোধচন্দ্র দাসকে নিয়ে। সুবোধ ঋষিপাড়ার ছেলে, কাজেই বনেদিপনার কিছু তার অভ্যাসেই নেই। লেখাপড়াও ম্যাট্রিক পাস না করা। গ্রাম থেকে শহরে আসা এরকম চরিত্র কী করে খাবে, কীভাবে থাকবে বাসা ভাড়া করে বউকে নিয়ে? অনেক ভেবেচিন্তে সুবোধদের চাকরি দিয়েছি আমি ঢাকায়। প্রথমে বাংলাবাজার কোনো ছাপাখানায় ঢোকাতে চাইলাম, পরে তা বাদ দিলাম। সবার চাকরি দিলাম সিনেমা হলে। আমরা তো সিনেমাই বানাচ্ছি, নাহ? তাই সিনেমা হলে ঢুকিয়ে দিলাম সুবোধচন্দ্রদের। এবার করে খাও বাছারা।


ppp 15. 9

৩৫ মি. মি. ফিল্মের ক্যান, ক্যান ভর্তি পুরনো দিন


১৯৮৯-৯০ সাল বাস্তবতায় আমরা যে সুবোধকে দেখতে পাব কাঁটা ছবিতে, সে সিনেমা প্রজেক্টর চালায়। যদিও ২০১৮ সালের বাস্তবতায় সিনেমার ৩৫ মিলিমিটার ব্যবস্থাপনা আর চালু নেই, সব ডিজিটাল ব্যবস্থা। কাজেই কোনো সিনেমা হলের প্রজেকশন রুমের আগের সেই মেশিনও আর চালু নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করে জানলাম, ফার্মগেট ছন্দ সিনেমা হলে ৩৫ মি. মি. ব্যবস্থা চালু আছে। ছিল তখনো। ছন্দ হলের লেটেস্ট কর্তৃপক্ষ তখন তেজগাঁও থানা। অনুমতি পাওয়া গেল। হল কর্তৃপক্ষ থেকে যিনি প্রোজেক্টর মেশিন চালান, তার নাম আলাউদ্দিন। আলাউদ্দিনের কাজটাই করবে সুবোধ। আবার চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ যার ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন, তিনি কাকরাইল ফিল্ম পরিবেশক পাড়ায় বসেন, তাঁর নামও মিয়া আলাউদ্দিন। সেই মিয়া আলাউদ্দিন ভাইয়ের কাছে কাঁটার কৃতজ্ঞতা অনেক। তিনি বলে দিয়েছিলেন বলেই কিছু পুরোনো ছবির পোস্টার পেয়েছি আমরা। এমন কি তিনি ফোন করে দিয়েছিলেন বলেই পুরান ঢাকার জনসন রোডের আজাদ ম্যানশন সিনেমা হল আমরা কয়েক দিন শুটিংয়ের জন্য ব্যবহার করতে পেরেছি। কাকরাইল পরিবেশক পাড়ার সিনিয়র সিটিজেন আলাউদ্দিন ভাইয়ের তথ্য অনুযায়ী আমরা যোগাযোগ করি, কোর্টকাচারির সামনে অবস্থিত আজাদ ম্যানশনের ম্যানেজার পরিমল বাবুর সঙ্গে। পরিমল বাবু আজাদ ম্যানশনের প্রজেক্টশন রুমে পাঠান আমাদের। ওখানে গিয়ে পরিচয় হয় যার সঙ্গে, তার নামও আলাউদ্দিন। আলাউদ্দিন বললেন, ‘এই হলে তো থার্টিফাইভ চালানো বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।’

‘তাইলে?’

আলাউউদিন বলেন, ‘তবে ফার্মগেটের ছন্দ হলে আগামী বিষ্যুদবার দিন পর্যন্ত লাস্ট শো হবে থার্টিফাইভেই।’

‘আমরা ওইদিন রাত ১২টা থেকে রাত ৪টা পর্যন্ত ছন্দ হল তো নিতে পারি। তাইলেই আমাদের হয়ে যাবে।’

আলাউদ্দিন বলেন, ‘সে আপনাদের ব্যাপার। তেজগাঁ থানা কিন্তু এখন ছন্দের মালিক।’

ব্যাপারটা মন্দ না, তেজগাঁ থানা ছন্দের মালিক। তরুণ কবি যারা ছন্দ বিষয়ে কিছু জানতে বুঝতে চায়, তারা তেজগাঁও থানায় যেতে পারে, ছন্দ শিখতে পারে। পুলিশ শেখাবে কবিতার ছন্দ—আহ, কী দারুণ ব্যাপার! আমরা আলাউদ্দিন ভাইকে বললাম, ‘ছন্দ হলের প্রজেকশন রুমে যিনি কাজ করেন, তার সঙ্গে কি আপনার পরিচয় আছে? ফোন নাম্বার আছে তার?’

আলাউদ্দিন বললেন, ‘আমিই ছন্দতে থার্টিফাইভ চালাই, আর আজাদ ম্যানশনে এই ডিজিটাল মেশিন চালাই। ওইখানে এক সহকারী রাখা আছে, এখানেও আছে।’

এভাবেই, ছন্দ ও আজাদ ম্যনশন মিলিয়ে কাঁটা ছবির জন্য নির্ধারিত সিকোয়েন্স শুটিং সম্পন্ন করেছি আমরা।


ppp 15 shuvo

কাজে মগ্ন কাঁটা টিমের একাংশ


আজাদ ম্যানশন একদা ছিল মুকুল ব্যানার্জির সিনেমা হল ‘মুকুল সিনেমা’। তিনিই এটা তৈরি করেন। কিন্তু ১৯৬৪ সালের ধর্মীয় দাঙ্গা বা রক্তারক্তি উত্তেজনার জের ধরে মুকুল বাবু স্থায়ীভাবে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যান কলকাতায়। যিনি কিনে নিলেন সিনেমা হল, তিনি নাম দিলেন আজাদ ম্যানশন। এখনো আজাদ ম্যানশন নামেই চলছে। একসময় পূর্ব পাকিস্তানে কলকাতার বাংলা সিনেমা সরকারি অনুমোদনেই ব্যবসায়িকভাবে চালানো হতো, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ৬৫ সালের আগ পর্যন্ত নিয়মিতই ঢাকা বা বাংলাদেশে চালানো হতো কলকাতার বাংলা সিনেমা। কাঁটা গল্পের তিন সময়ের এক সময় হচ্ছে ১৯৬৪ সাল। সেই সময়ে যে সুবোধ আসে ভূতের গলিতে, সেও তো সিনেমা হলেই চাকরি করছিল। থার্ড ক্লাসের গেইটম্যান সেই সুবোধ। তখন, সেই ৬৪ সালে এই হলে, হলের নাম তখনো ‘মুকুল সিনেমা’—চলছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে অজর কর নির্মিত ছবি উত্তম সুচিত্রা অভিনীত ‘সপ্তপদী।’ আমরা কাঁটাতে সপ্তপদী সিনেমা দেখতে পাব এক দৃশ্য। দেখব যে, উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন মোটর সাইকেলে আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে পথ যদি না শেষ হয় গাইতে গাইতে। আবার ১৯৭১ সালে, যখন পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের মুখোমুখি তদানীন্তন ইস্ট পাকিস্তান, তখনো তো একজন সুবোধ এসেছিল ভূতের গলিতে, সে সিনেমা হলের টিকিট বিক্রি করত। আমরা দেখব, তখন চলছে উর্দু ছবি বানজারান। সুবোধ টিকিট বিক্রি করছে। যুদ্ধের সময়েও বাঙালি-বিহারি কিছু লোক সিনেমা দেখতে ঠিকই টিকিট কিনছে।

তো আলাউদ্দিন ভাইকে নিয়ে আমরা ছন্দ হলের প্রজেকশন রুমে ঢুকি সন্ধ্যা ৬টার দিকেই। হল কর্তৃপক্ষ আমাদের হল দেবে রাত ১২টার পর, এইরকমই কথা ছিল। আমরা নির্বিঘ্নে শুটিং করব হলের মধ্যে। হল কর্তৃপক্ষ আগেই আমাদের জন্য হল ছেড়ে দিয়েছে, এটা সহযোগিতা, যা আমাদের কাজে লেগেছে। ছন্দতে ওই রাতেই লাস্ট কার্বন পুড়িয়ে থার্টিফাইভ মেশিন, চাকা ঘুরছে, ক্যানে সিনেমার রিল চালানো হয়েছে। অর্থাৎ কাঁটা ছবিতে সিনেমা সাবজেক্ট হয়ে ঢুকে পড়েছে। পড়লে কী করতে পারি আমি? সুবোধদের তো চাকরি হলো। নইলে বউ নিয়ে যে ঢাকায় এসেছে, খাওয়াবে কী? বাড়ি ভাড়া দেবে কী করে? বাচ্চাকাচ্চা পয়দা হলে চলবে কী করে?


আজিজ মহসিন (1)

কাঁটার অন্যতম প্রধান দুই অভিনেতা কায়েস চৌধুরী ও এস এম মহসীন, দুজনেই প্রয়াত


কাঁটা সেন্ট্রাল লোকেশনের গোছগাছ প্রায় সম্পন্ন, এখন শুটিংয়ে যাওয়া জরুরি। নারিন্দায় এসেছি শুধু শুটিং করতে কিন্তু আপাত অর্থে মনেই হতে পারে যে, আমরা নারিন্দায় বসবাস শুরু করে দিয়েছি। আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির বাইরে আমরা সেট নির্মাণ করেছি গেণ্ডারিয়া থানার পেছনে, চৌধুরী আলম নগরের মোড় বা মামুর মাজারের মোড়ে। সেখানে রহমানের চায়ের দোকানকে আমরা বানিয়েছি ইয়োর চয়েস সেলুন। রাস্তার পাশে বিহারি নাপিত আব্দুল আলীর সেলুন ঘর। সেলুন ঘরের দেওয়ালে ১৯৮৯-৯০ সালের সিনেমার পত্রিকা চিত্রালি সাঁটানো। চিত্রালীতে শাবানার একটা ইন্টারভিউ, রোজিনার সংবাদ দেখা যাচ্ছে। সংবাদ আছে জহির রায়হানের অন্তর্ধান নিয়ে। আরেকটি সংবাদ পাকিস্তানি ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ইমরান খানকে নিয়ে—’ইমরান খান কি চলচ্চিত্রে আসছেন?’ সেলুনে দৃশ্য আছে ১২টি। প্রতি দৃশ্যেই দুইটি করে সিনেমার পোস্টার দেখা যাবে। একটি সিনেমা আসিতেছে, একটি সিনেমা চলিতেছে, গুলিস্তান বা মানসী সিনেমা হলে। ১৯৮৯-৯০ সালের এরকম চল্লিশটা সিনেমার পোস্টার আমরা ছাপিয়ে এনেছি। অবশ্যই ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ সে-সব পোস্টারের একটি। সেলুন ঘরের সামনে দুটি কেঠো বেঞ্চ পাতা থাকে। ভূতের গলির প্রবীণ মহল্লাবাসী কয়েকজন বেঞ্চে বসে গল্পসল্প করে। পত্রিকা পড়ে। চা খায়। তাদের হাতে দেখা যায় ওই সময়ের ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা বা ইনকিলাব। ১৯৮৯-৯০ সালের যত সব প্রধান প্রধান খবর আমরা পড়ে নিতে পারব মহল্লাবাসীর সঙ্গে। একই সময়ে রেডিও থেকেও নিউজ পাব আমরা। আমরা দেখতে পাব ওই সময়ের সিনেমার ভিউকার্ড। আর দেওয়ালের ক্যালেন্ডার তো থাকবেই। এর সঙ্গে যথার্থ প্রপস ও কস্টিউম—সব মিলিয়ে পিরিয়ড ধরার চেষ্টা ছিল আমাদের বিস্তৃতভাবেই। প্রাসঙ্গিক এভিডেন্স আমরা সর্বোচ্চ দিতে চেষ্টা করেছি যথসাধ্য। তখন, বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আর্মি জেনারেল হোসেইন মোহম্মদ এরশাদ। বিরোধী দলগুলোর সরকার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। ভারতেও জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন চলছে। কংগ্রেস এর রাজীব গান্ধী ও বিজেপির লালকৃষ্ণ আদভানির মধ্যে নির্বাচনী লড়াইয়ে ক্রমশ ফ্যাক্টর হয়ে উঠছে বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির বিতর্ক। সেই ধাক্কা এসে পড়ছে বাংলাদেশেও। ইরানে ইসলামী বিপ্লবের নায়ক খোমেনির ইন্তেকাল হয় তখন। বেইজিংয়ে গণতন্ত্রপন্থী ছাত্রদের মিছিলে চায়না সরকার দমনপীড়নে এক দিনেই দশ হাজার ছাত্র হত্যা করে। খুকু-মুনীরের ফাঁসি হচ্ছে। সেই একই সময়ে ভূতের গলির আবদুল আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে ভাড়াটিয়া সুবোধচন্দ্র দাস ও তার স্ত্রী স্বপ্নারানী দাসের খবর আমরা পাচ্ছি মহল্লাবাসীদের থেকে। স্বপ্নারানীর বানানো চা-নিমকপারা খেয়ে এসে প্রশংসা করে মহল্লাবাসী।


p 16. 8

আলতারাঙা পা দেখে তো টের পাওয়া যায়, এমন পা স্বপ্নারানী দাসের


বাড়ির বিড়ালটা কাঁটা ইউনিটের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে গেছে পুরোপুরি। কবুতরগুলোও কথা শুনছে। আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে ঘুঘু দেখা যাবে। বলাই যায়, কাঁটা ছবির মাধ্যমে ব্যাপারীর বাড়িতে ঘুঘু চড়ে গেছে। এই বাড়িতে যেমন একসময় টিয়া দেখা যাবে, আরেক সময় ময়নাও দেখা যাবে। উঠোনে পাতকুয়া দেখা যাবে। তুলসীগাছ বাতাসে মৃদু দোল খাচ্ছে, দেখা যাবে। আর এসবকে ঘিরেই মহল্লাবাসীদের আনাগোনা দেখা যাবে। এবং এ সবের ভেতরে কিছু ম্যাজিক লুক্কায়িত আছে, সেটাই হয়তো আমি বা আমরা দেখানোর জন্য এই ধরনের একটা গেরিলা প্রবণতায় আক্রান্ত আছি, কাঁটার জন্য। পুরান ঢাকার বাইরেও, কাঁটার কিছু আউটডোর আছে। আমরা তখনো জানি না, সেই আউটডোর কোথায় হবে? একটি নদী লাগবে, লাগবে একটি বিশাল প্রান্তর-ব্যাপ্ত মাঠ ও মাটির রাস্তা। লাগবে একটি গ্রামীণ বাড়ির উঠোন, যেখানে এক সন্ধ্যায় একটি বিয়ের দৃশ্য ধরা হবে। কবুতর ও বিড়াল—পারস্পরিক সাংঘার্ষিক অবস্থানে থেকে যায় অনেকটাই। একই বাড়িতে তাদের বসবাস নিশ্চিত করতে হয়েছে কাঁটা টিমকে। আজিজ ব্যাপারীর দোতলা বাড়ির ছাদের কোনার খোপ খোপ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কবুতররা নেমে আসবে উঠোনে, বিড়াল দেখে উড়ে যাবে আবার বসবে উঠোনে, কাঁটার চরিত্রদের মেনে নেবে তারা—সময় নিয়ে শুট না করলে এভাবে আমরা পেতাম না। একই বাড়িতে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ধরতে হয়েছে বলেই আমরা সেটে ছিলাম নয় মাস। কাজেই, দুই বা তিন লটে ২২ দিনের শুটিং ডিজাইন করা কোনো প্রোডাকশনের সঙ্গে কাঁটার ডিজাইনের মিলবে না। নয় মাসে আমাদের পূর্ণ দিবস শুটিং প্রায় ৬১ দিন। প্রায় পাঁচশোর অধিক পাত্রপাত্রী। কাঁটার নির্মাণ টিমেও আছে প্রায় ১১-১২ জনের একটি দল। আর শুটিং ডে তে টেকনিক্যাল ক্রু—পার ডে শুট লোকেশন ভাড়া সহ সার্বিকভাবে খরচ প্রায় ১ লাখ টাকা। এ করতে পেরেছি আমরা, কাঁটা নির্মাণে আমাদের ভালোবাসা ও শ্রম-সময় বিনিয়োগ করতে কোনো দ্বিধা ছিল না বলেই। সত্যি, কাঁটা টিমের ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো খেটেছে। আমার মেজাজ খারাপের চাপ, গালিগালাজ হজম করেছে। ধকল নিয়েছে। কৃতজ্ঞতা শব্দটি ব্যবহার করলেও কাঁটা টিমকে কৃতজ্ঞতা জানানো শেষ হবে না। এবং কাঁটা টিমকে ওইরকম ঘোরগ্রস্থ না করে তুলতে পারলে আমিও একটি শিক্ষানবিশ ছেলেমেয়েদের দিয়ে এই কাজ তুলে আনতে পারতাম না। একজন নির্মাতা তার সেটে অধীশ্বর বটে, মধ্যমণিও; এবং একাও। কারণ, তার কোনো বিকল্প নেই, ইকুয়াল কলিগ নেই। যে কেউ অসুস্থ, শো মাস্ট গো অন। নির্মাতা অসুস্থ হলে পুরো সেটের লোকেরা শয্যাশায়ী হতে বাধ্য। তাই অধীশ্বর অসুস্থ হতে পারেন না প্রোডাকশনকালীন। সবাই ঘুমোচ্ছে যখন, নির্মাতার ঘরের জানালায় তখনো উঁকি দেয় অমীমাংসার নির্ঘুম চাঁদ। এমনটাই হয়, আমার হয়। আমার হয়েছে।


তিন যমজ হক ভাই

হাজী আবদুল করিম চরিত্রে হক ভাই ও তার তিন কন্যা


নারিন্দা ক্যাম্পে অনেক বিখ্যাত মানুষ এসেছেন শুটিং দেখতে। সাংবাদিক হাসান মামুন এলেন একদিন, সঙ্গে ছিল সাংবাদিক ও তরুণ কবি রাসেল মাহমুদ। মামুন ভাই ও আমি কলিগ ছিলাম মুক্তকণ্ঠ পত্রিকায় একদা। খুব ভালো মানুষ তিনি। বিস্তর পড়াশুনো করা লোক। রাসেল প্রথম আলোতে জব করে। অনেক বড়ো একটা প্রতিবেদন তৈরি করছিল কাঁটার জন্য। প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল—‘কী অবস্থায় কোটি টাকার কাঁটা?’ মামুন ভাই ও রাসেল মাহমুদের সঙ্গে এসেছিলেন শহীদুল জহিরের একনিষ্ঠ পাঠক আনিসুল হক সৌরভ। এসেছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ। তিনি শহীদুল জহিরের বন্ধু, শহীদুল জহির প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত সকল লেখার সমন্বয়কারী ও সম্পাদক, যা সবই প্রকাশিত হয়েছে পাঠক সমাবেশ থেকে। পরে রশীদ ভাই আমকে একদিন পরিচয় করিয়ে দেন শহীদুল জহিরের ইংরেজি অনুবাদক ভি রামস্বামী বা রামা সাঙ্গিয়ার সঙ্গে। রামাদা কেরালার লোক হলেও কলকাতায় বসবাস করছেন দীর্ঘদিন। রামাদার সঙ্গে আলাপের পর আলাপ হয় শহীদুল জহির অনুবাদে রামাদার সহ-অনুবাদক শাহরোজা নাহরীনের সঙ্গে। রামাদা কাঁটা ছবির ইংরেজি সাবটাইটেল করবেন, কথা হয়ে আছে। এসব আমার জন্য আনন্দদায়ক অনুভূতি তৈরি করে। আমি আনন্দিত হই। হঠাৎ সেদিন নিজের বাসার কাছেই ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রশীদ। খুব খারাপ লাগা অনুভূতি হয় কদিন আমার। এছাড়াও আমার বিষাদিত হওয়ার খবর জানাই কিছু? না, থাক। বিষাদ লুকিয়ে রাখার জিনিস। বিষাদ গুম করে দেওয়ার জিনিস। লুকালাম তাহলে? গুম করে দিলাম। গুম-সংস্কৃতি অব্যাহত আছে, থাকবেও? গুম হয়ে যায় সময়, যৌবন, ভালোবাসা। বর্তমান সময় থেকে অনেক আগের তিনটি সময় নিয়েই কাঁটা চিত্রিত। অদ্ভুত সুন্দর একটি গল্প। জাদুময়। এই জাদু আমরা ধরতে সচেষ্ট আছি। এই থাকা ভালো লাগা থেকে, এই থাকা দায়বদ্ধতা অনুভব করে। কী সেই দায়বদ্ধতা? কাঁটা দেখে সেটা ধরতে হবে দর্শকের। এমনিতে কাঁটা গল্পটি একবার পড়ে পুরো রস আস্বাদন করা পাঠক আমি একজনও পাইনি। আমি নিজেও পড়েছি অসংখ্যবার। চিত্রনাট্য করার সময় তো লাইন বাই লাইন পড়তে পড়তে ভেবেছি, থেমেছি। বইয়ের পৃষ্ঠায় ২২ পৃষ্ঠার গল্প কাঁটা, আমার কাছে যে সংস্করণ ছিল পাঠক সমাবেশের, সেই বইতে। আমি কাঁটা পড়তে পড়তে হয়তো ১০ পৃষ্ঠা শেষ করে ১১ পৃষ্ঠায় না ঢুকে পুনরায় ৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ঢুকেছি। এইভাবে এগোতে এগোতে পিছিয়েছি। আবার শুরু করেছি পড়তে। এরকম এক বহুস্তর বৈশিষ্ট্যে কাঁটা রচিত, যা বাংলা কথাসাহিত্যে প্রায় বিরল কিছু। এক পর্যায়ে গল্পের কাঁটা শেষ করে চিত্রনাট্যে ঢুকতে শুরু করেছে আমার অন্যান্য অভিব্যক্তি। চিত্রনাট্য কাটাকুটি চলতে থাকে। কত কী ঢুকে পড়ল অবলীলায়! আবার সেই অবলীলার কথা? অবলীলা কে যে তার কথা এত বলতে হবে? না, বলতে হবে না।

ওকে, বলব না।


p 16. 3

গলির মোড়ের যুবতী পাগলি চরিত্র করেছে সানজিদা সাত্তার


পাগলির কথা বলি। যুবতী পাগলিকে আমরা দেখি ভূতের গলিতে। হয়তো প্রত্যেক শহরের রাস্তায় বা গলির মোড়ে দেখা যায় কোনো পাগলিকে। এই পাগলি কোথাকার কে? তা আমরা জানি না। আমরা শুধু দেখি, যুবতী পাগলি গলির মোড়ে একা বসে থাকে, একা কথা কয়। একদিন কি যুবতী পাগলির তলপেট উঁচু হতে থাকে? কাঁটা ছবিতেও গলির মোড়ে এক যুবতী পাগলিকে আমরা দেখতে পাব। সানজিদা সাত্তার অভিনয় করেছে সেই পাগলির চরিত্রে। খুব কষ্ট করেছে সানজিদা এই চরিত্র করতে গিয়ে। কাঁটা অডিশনে আসা সানজিদা মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প থেকে নারিন্দা ক্যাম্প পর্যন্ত রিহার্সেল করেছে। ওকে বলতাম, ‘তুমি রিহার্সেল কী করবা? যাও, রাস্তায় ঘোরো, যেই দেখবা কোনো যুবতী পাগলি, ভাববা, ওইটাই তুমি। খেয়াল করবা, পাগলি কী করে? কী করে না? সৈয়দ গোলাম সারোয়ার এমন একজন সিনিয়র অভিনেতা, বয়স প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তাঁকে সবাই হক ভাই নামে ডাকে। হক ভাই একদিন বললেন, ‘দাদা, আপনার কবিতা তো পড়ি। আমি প্রায় দুইশ টেলিভিশন নাটক করেছি, গাদা গাদা সিরিয়াল করেছি, বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি অনেক কিন্তু আমাকে কেউ সিনেমায় নেয়নি। আপনি নেবেন?’

বললাম, ‘নেব। কাঁটাতে একদল সিনিয়র অভিনেতার চরিত্র রয়েছে। আপনি একটা চরিত্র করবেন। চরিত্রের নাম হাজি আবদুল করিম। ভূতের গলির বাসিন্দা। কাঁটার যে অংশ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার, সেই অংশে দেখা যাবে হাজি আবদুল করিমকে। সে দুইবার পাকিস্তানি আর্মিদের কাছে ধরা খাবে। প্রথমবার তেমন সমস্যা না হলেও দ্বিতীয়বার কিন্তু জান বাঁচাতে লোকজনের সামনে বেইজ্জতি হয়ে যাবে!’

হক ভাই বলেন, ‘কী করবেন আমাকে? যা করাবেন করান, আমার অসুবিধা নাই।’


রশিদ 1

প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ও শাহরোজা নাহরীনের সঙ্গে পাঠক সমাবেশে


সত্যি, অভিনেতা বা অভিনেত্রীর মুখ ও অন্তর থেকে এরকম বলা বা পালন করাটাই কাজ করানোর পক্ষে প্রয়োজনীয় শক্তি এনে দেয়। আমি সিনিয়র অভিনেতা সৈয়দ গোলাম সারোয়ার ওরফে হক ভাইয়ের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ, এমন একটা চরিত্র তাঁকে করাতে পেরেছি। চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ী তিনি যে সাহস দেখিয়েছেন, তা প্রায় বিরল ব্যাপার। হক ভাই আশি ছুঁই ছুঁই মানুষ, এমন বিনয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেন যেন-বা আমার বয়স আশি, তাঁর বয়স আমার অর্ধেক। কী ভীষণ রোম্যান্টিক বয় তিনি, এই বয়সেও!

নারিন্দার অনতিদূরেই বাহাদুর শাহ পার্ক। তার অপজিটেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক সাপোর্ট নিয়েছি আমরা। জগন্নাথের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক আর্টিস্ট রশীদ আমিনের কাছে গেছি একদিন। আমিন ভাই যখন চারুকলায় পড়তেন, আমাদের কিছু সিনিয়র ছিলেন। আমিন ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় জগন্নাথে, কথা হয় সুমনের সঙ্গেও। সুমনও জগন্নাথের চারুকলার শিক্ষক। রশীদ আমিন ভাই ও আমরা একদা প্রচুর দারুপিয়াসী জীবন কাটিয়েছি। জগন্নাথের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষক জুনায়েদ হালিম কাঁটাতে অভিনয় করেছেন। ফিল্ম এডিটর তিনি। জুনায়েদ ভাইয়ের সঙ্গেও আমার এক দারুণ বোঝাপড়া রচিত হয়ে আছে। জুনায়েদ ভাইও আমার লেখালেখির একজন একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, পাঠক। জগন্নাথের ছাত্র মুন্না কাঁটাতে একটি বড়ো চরিত্র করেছে, পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের চরিত্র। পাকিস্তানি ২০ জন সেনা সদস্য নিয়েছি আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার মানে কী? জগন্নাথে ২০১৮ সালেও পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান করছে? ব্যাপারটা তা নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনসিসি ক্যাডেটদের দিয়ে আমরা পাকিস্তানি সেনাদের চরিত্র করিয়েছি। উত্তরা বিএনসিসি’র সদর দফতর থেকে সেনাদের বুট আনা হয়েছে, ত্রিপল আনা হয়েছে। একদিন একদল সেনাও আনা হলো জগন্নাথের বিএনসিসি স্টুডেন্টদের হাঁটাচলা-দৌড়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য। নারিন্দা ভূতের গলির বিভিন্ন উপগলি দিয়ে দৌড়াচ্ছেন বিএনসিসির অরিজিনাল সেনাদের সঙ্গে খাকি পোশাকে আরেকদল শিক্ষানবিশ সেনা; এই দৃশ্য যেদিন ঘটল, সেদিনের একটি ঘটনা বলি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পোশাকে ২০ জন সেনা সদস্যের সঙ্গে জগন্নাথের বিএনসিসির ছেলেদের ২০ জনের একটি দল খাকি পোশাকে দৌড়াচ্ছে ভূতের গলিতে—ব্যাপারটা কড়া।

কাঁটা টিমের এক সহকারী শরৎগুপ্ত রোডের এক দোকান থেকে একটি কথা শুনে এসে বলল, ‘লোকজন বলতেছে টোকন ঠাকুর হিন্দু হইলেও সাহস আছে, মহল্লায় আর্মি নামায়ে দিছে।’ এই কথা শুনে আমরা হাসতে হাসতে মরি। কী কথা, ‘মহল্লায় আর্মি নামায়ে দিছে।’ না, আমি সামরিক আইন জারি করতে পারি না। সেই এখতিয়ার আমার নেই। আমি চল্লিশজন ইউনিফর্মড লোক ভূতের গলিতে মুভ করাইছি, কাঁটার জন্য। এর বেশি কিছু নয়। আর আমার কী পরিচয়? ওই যে, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে!’

কাঁটা টিমের এক সহকারী শরৎগুপ্ত রোডের এক দোকান থেকে একটি কথা শুনে এসে বলল, ‘লোকজন বলতেছে টোকন ঠাকুর হিন্দু হইলেও সাহস আছে, মহল্লায় আর্মি নামায়ে দিছে।’ এই কথা শুনে আমরা হাসতে হাসতে মরি। কী কথা, ‘মহল্লায় আর্মি নামায়ে দিছে।’ না, আমি সামরিক আইন জারি করতে পারি না। সেই এখতিয়ার আমার নেই। আমি চল্লিশজন ইউনিফর্মড লোক ভূতের গলিতে মুভ করাইছি, কাঁটার জন্য। এর বেশি কিছু নয়। আর আমার কী পরিচয়? ওই যে, ‘সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে!’ আমি ছবি বানাচ্ছি, আমি ছবির মানুষ। আমি কবিতা লিখছি, আমি কবিতার মানুষ। আমি চারুকলায় পড়তাম, রং ও রেখা, আলোছায়ার বিন্যাস আমার পাঠ্য ছিল। আমি স্বপ্ন ও সম্ভাবনার দরজা খুলে বেরিয়ে পড়েছি অনেক আগে। মানুষের দ্বারা মানুষ যে বঞ্চিত হয়, তাতে আমি পীড়িত হই। অন্যায়ের প্রতিবাদ করি, করছি, করব। মানুষের আঘাতে মানুষের বুক রঞ্জিত হয়, সে যে এলাকাতেই হোক, আমিও রঞ্জিত হয়ে পড়ি। ব্যক্তি থেকে গোত্রগত যেকোনো নিপীড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দায়বদ্ধ আমি। নইলে মানবজনম অর্থবহ হবে না—এ আমি জানি, মানি। আমার বুকের গহনে সেই গান বাজে সবসময়, যেই গান হাওয়া হয়ে ভাসতে ভাসতে বহে যায় সনাতন ধর্মাবলম্বীর বাড়ির ভেতর দিয়ে পার্শ্ববর্তী কোনো মুসলিমের বাড়ির ভেতরে। আমি কি সেই হাওয়া? আমি কি সেই আম্রমুকুল ঘ্রাণ?


৫ম ৭৭

বিড়ালের নাম ডায়না, তাকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল এক হুলো বিড়াল


রোহিঙ্গা নিপীড়নে আমিও ভেসে গেছি নাফ নদীর জলে। গুজরাটে আমি চলন্ত ট্রেনের কামরায় পুড়ে মরেছি। রামুতে আমি নিহত হয়েছি। নাসিরনগর বা অভয়নগরে আমি রক্তাক্ত হয়েছি। গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লির মানুষ আমি। আমাদের খড়ের ঘরে আগুন দিল কে বা কারা? অতএব, আমার আর্ট কালচার-জীবনযাপন বাবু-সাহেব বা কোনো শ্রেণির মনোরঞ্জন করার জন্য নয়, এটি একদম পরিষ্কার। কাঁটা নির্মাণ-অভিপ্রায়ও কোনো মনোরঞ্জন-উদ্যেশ্য-উদ্ভূত নয়। প্রত্যক্ষভাবে কাঁটার গল্প-পরিধি উপমহাদেশ, কিন্তু আদতে তা উপমহাদেশের সীমানার বাইরেরও চিত্র। পশ্চিমে আফ্রো-এশীয়রা দমন-নিপীড়নের শিকার, পূর্বেও বৈষম্য সক্রিয়াশীল এখনো। যেকোনো একটা অজুহাতেই দুর্বলের ওপড়ে পেশিশক্তির চড়াও চলে সবলের দ্বারা। তাহলে এত এত উন্নয়ন-অগ্রগতির মানেটা কী দাঁড়াল? কবি আল মাহমুদ যাকে বলেছেন, ‘কতদূর এগোল মানুষ?’


প ১২। ১৫ (1)

টোকন ঠাকুর কি ভূতের গলিতে আর্মি নামায়ে দিছে? হালাইভি ছাহছ আছে…


কাঁটার সেট নির্মাণ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আমরা শুটিংয়ে যাব। প্রপস-কস্টিউম-ক্যারেক্টার চূড়ান্ত হয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ, হঠাৎ কী হলো? কাঁটার প্রধান চরিত্র সেই মহিলা বিড়ালকে দেখা যাচ্ছে না আর। তাইলে? শুটিং কীভাবে হবে? বিড়ালিনীকে বাদ দিয়ে তো শুটিং করা যাবে না। বিড়াল খোঁজা শুরু হলো। না, পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেলেন তিনি? কে যেন বলল, এক হুলো বিড়াল গতকাল থেকে ঘুরঘুর করছিল। কাঁটার মহিলা বিড়াল কি তবে সেই হুলো পুরুষটার সঙ্গে পালিয়েছে?

‘হুম, পালিয়েছে।’

আচ্ছা, প্রেম করবি কর, তাই বলে শুটিং শুরু করার আগে মুহূর্তেই? কাঁটার চরিত্র বিড়াল তো অত খারাপ না! নিশ্চয়ই সেই হুলো তাঁকে ‘জান’ ‘সোনা’ ‘মধু” ‘টদু’ বলে ভাগিয়েছে! হুলো বিড়াল যদি ডেকেও থাকে, এই সময়, ডাকলই না হয়, মহিলা বিড়াল তাঁকে বলবে না, ‘না। এখন না।

হুলো বিড়াল ফুঁসলিয়ে মহিলা বিড়ালকে নিয়ে কোথায় যাবে? নিশ্চয়ই কোনো বিল্ডিংয়ের চিপায় পালিয়েছে! ‘খোঁজো, চিপাচাপা খোঁজো’—সহকারীদের এই নির্দেশ দিলাম। শুটিং শুরুর সব আয়োজন সম্পন্ন, এই সময় যদি একটা বড়ো ক্যারেক্টার উধাও হয়ে যায়, কেমন লাগে? আমারও সেই কেমন লাগা শুরু হলো। আচ্ছা, প্রেম করবি কর, তাই বলে শুটিং শুরু করার আগে মুহূর্তেই? কাঁটার চরিত্র বিড়াল তো অত খারাপ না! নিশ্চয়ই সেই হুলো তাঁকে ‘জান’ ‘সোনা’ ‘মধু” ‘টদু’ বলে ভাগিয়েছে! হুলো বিড়াল যদি ডেকেও থাকে, এই সময়, ডাকলই না হয়, মহিলা বিড়াল তাঁকে বলবে না, ‘না। এখন না। শুটিংয়ে শিডিউল দেওয়া আছে। এখন ওসব করতে পারব না!’ তাহলে এতদিন যত্ন-আদর করে আমাদের খাওয়ানো তেলে ভাজা রুই-ইলিশ কি বিফলে যাবে? ভাই অ্যালান পো, তুমি এসে বিড়াল খুঁজে দিয়ে যাও। কাঁটাতে অ্যালান পো চরিত্র করেছে গজেন্দ্রগমন। কিন্তু গজেন’দা কোথায়? সেইদিন রাতেই অনলাইন নিউজ পোর্টালে একটি খবর দেখাল সহকারীরা। গজেন’দা নারিন্দার কাঁটা ক্যাম্পের বাইরে চলে যায় শাহবাগ-সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে! সেদিন উদ্যানে ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কর্মরত বসিয়েছিলেন। র‍্যাব-পুলিশ নিয়ে ঝটিকা অভিযানে ধরে ফেলেছেন ১০৪ জন তামাকসেবীকে, যাদের সব্বাইকে একমাসের জামিন অযোগ্যধারায় মামলা দিয়ে কেরানীগঞ্জ জেলে প্রেরণ করে দিয়েছেন। এবং সেই ১০৪ জনের অন্যতম একজন বাবু গজেন্দ্রগমন। কী হবে এখন? একমাসের আগে তার রিলিজ হবে না! একে তো বিড়াল অনুপস্থিত, তার সঙ্গে অ্যালান পো-ও নেই!

কী করব এখন? কী হবে কাঁটা শুটিং শুরুর? পরের পর্বে আমরা জানতে পারব আরও…


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫


কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।