শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

বোধহয় গন্ধরাজ : আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির

0

প্লাটফর্মের বড়ো বড়ো টাংস্টেন বাতিগুলো বেশিদূর আলো ছড়াতে পারছে না। কুয়াশা প্রতি মিনিটে আরও ঘন হয়ে সামনের সবকিছু ঢেকে দিচ্ছে। ট্রেন আসতে বোধহয় আরও অনেক বাকি। স্টেশনের কারও চলাফেরায় তাই কোনো ব্যস্ততা নাই। কেবল চায়ের দোকান দুইটা ঘিরে সবাই গুঁটিশুটি মেরে বসে আছে। জমাট গল্প হচ্ছে, রেডিও-ভাঙা গান শোনা যাচ্ছে অস্পষ্ট। ওই দিকটায় গিয়ে বসলে একটু আরাম লাগত মনে হয়। এখানে বসে রীতিমতোন কাঁপছি। গায়ে তীরের গতিতে বাতাস বিঁধে যাচ্ছে। তার উপর কান খোলা, মাফলার আনতে ভুলে গেছি।

অবশ্য যখন বের হয়েছি তখন একদমই বাতাস ছিল না। দুপুরের রোদও আজকে বেশ কড়া ছিল। সন্ধ্যার পর সবকিছু এই রকম ঠান্ডায় জমে যাবে বুঝতে পারি নাই। হোস্টেল খুব একটা দূরে না। দৌড় দিলে বড়োজোর পনেরো মিনিটের পথ। কিন্তু ওই দিকে যাওয়া মানে সাক্ষাৎ যম-দর্শন।

এখন বাজে সাতটা চল্লিশ আর মিনিট বিশেক পরেই আমার খোঁজ পড়ে যাবে। আটটায় ডাইনিং রুমে স্বয়ং হোস্টেল সুপার আসবেন আজকে ছাত্রদের সাথে খেতে। উদ্দেশ্য অবশ্যই খাওয়া নয়, অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আমার বিচার। দুইটা অপরাধের গুরুতর অভিযোগ এসেছে আমার বিরুদ্ধে।

এখন বাজে সাতটা চল্লিশ আর মিনিট বিশেক পরেই আমার খোঁজ পড়ে যাবে। আটটায় ডাইনিং রুমে স্বয়ং হোস্টেল সুপার আসবেন আজকে ছাত্রদের সাথে খেতে। উদ্দেশ্য অবশ্যই খাওয়া নয়, অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আমার বিচার। দুইটা অপরাধের গুরুতর অভিযোগ এসেছে আমার বিরুদ্ধে। সাক্ষী আর অভিযোগকারী একই ব্যক্তি। তার কাছে জোরালো প্রমাণও নাকি আছে! পালিয়ে না এসে তাই উপায় ছিল না কোনো। আমার নতুন শত্রু এই লোক নিশ্চয়ই এতক্ষণে এসে বসে আছে ডাইনিং রুমের সামনে।

‘ভয়ানক চাল্লু মাল!’

বয়স প্রায় তিরিশ। আমার থেকে অন্তত বারো-তেরো বছরের বড়ো হবে। এই এক যুগে সে কমপক্ষে পাঁচটা বড়ো বড়ো শহরে বাস করেছে। সবশেষে ছিল ঢাকায়। কোনো একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ত। সবাই বলে পড়া শেষ করতে পারেনি। সে যদিও স্বীকার করে না। সব বয়সের মানুষের সাথে মিশতে পারে অনায়াসেই। বিশেষ করে টিনেজারদের সাথে খাতির খুব। একদল ভক্ত অনুরাগীও আছে, যদিও কবিতা-গল্প কিছু লেখে না, গানও গায় না। আমার সাথে পরিচয়, যেদিন সে এই ছোটো শহরে প্রথম সাইবার ক্যাফে খুলল, তার ঠিক পরের দিন।

হোস্টেলের সামনের রাস্তা সোজা চলে গেছে বাজার বরাবর। পুবদিকে লম্বা খাল। খাল শেষ হলে প্রায় এক শ বছরের পুরোনো তেঁতুল গাছ। তার নিচে শহরের সবচেয়ে ভিড়ওয়ালা চায়ের দোকান। সেদিন শুক্রবার ছিল। আসরের আজানের পর দোকানের পাশ দিয়ে একলা হাঁটছি। বড়ো একটা জটলার দিকে চোখ পড়ল। একজন যুবককে ঘিরে অন্তত জনা-পঞ্চাশেক মানুষ, গভীর মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে। বক্তার হাতে চায়ের কাপ কিন্তু চুমুক দিচ্ছে না একবারও। হাতের সিগারেটও পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেবল কথা আর শ্রোতা বাদে আর কোনো দিকে তার খেয়াল নাই।

‘ইন্টারনেট অইল জাদু! এই উল্লাপাড়া টাউনে বইস্যাই আপনে লন্ডন আমেরিকা দুবাই ব্যাক জায়গায় ঘুইর‌্যা আইসপ্যার পাইরবেন। আবার ধরেন মালেশিয়া থাইক্যা কেউ একজন একখান ছবি পাটাইলো, এহেনে আসতি সময় নাইগব মাত্র দশ সেকেন্ড। আর যাগোর বয়েস কম তাগোর জন্যে আছে আরেক চমক— ফেসবুক। এহন আর চিঠি লেইহ্যা পত্রমিতালি করা নাইগব না। তামাম দুনিয়ার অল্পবয়েসী ব্যাটাছল-মাইয়াছল এই ফেসবুকে আছে। যারে ইচ্ছা খুইজ্যা খুইজ্যা বন্ধু বানাইব্যার পাইরব্যা।’

সবাই প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে শুনল ঠিকই। কিন্তু বছর তিরিশের লোকটা যখন কথার শেষে সবাইকে বলল তার সাথে যেতে, কেউ গেল না। আসলে রূপকথার গল্প শোনার মতোন করে ফেসবুকের গল্প শুনেছে তারা এতোক্ষণ, খুব একটা বিশ্বাস করতে পারে নাই। সে হতাশ মুখে ফিরে গেল আস্তানায়।

আস্তানা বলতে একটা চকচকে নতুন দোকান। সামনে কাচ দেওয়া। উপরে আলো-জ্বলা সাইনবোর্ড। উঁকি দিয়ে দেখলাম ছোটো ছোটো কুঠুরি দিয়ে ভাগ করা ঘরটা। সামনের দিকে খোলা চেয়ার টেবিল। চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে রূপকথার গল্পওয়ালা যুবক। আমি প্রায় নিঃশব্দে আবার রাস্তায় নেমে আসলাম। সন্ধ্যার আগেই হোস্টেলে ফেরা আমাদের জন্যে বাধ্যতামূলক। তাছাড়া এইচএসসি পরীক্ষার বাকি মাত্র কয়েক মাস। পড়াশোনার চাপ ইদানিং তাই অতিরিক্ত বেশি। সকাল সাতটা থেকে ব্যাচে পড়া, তারপর কলেজে প্র্যাক্টিকাল ক্লাস। একমাত্র বিকেলের দেড় দুই ঘণ্টা ছাড়া ঘুরতে বের হওয়ার উপায় নাই।

পরের বিকেলে, আজান পড়ার সাথে সাথে বের হয়ে গেলাম। আজকে আর কোনো জায়গায় থামাথামি নাই। দ্রুতপায়ে সোজা চলে গেলাম নতুন দোকানে। কোনো সংকোচ না করে কাচের দরজা খুলে ঢুকে গেলাম। কালকের লোকটা টেবিলের কম্পিউটারে বুঁদ হয়ে আছে। পুরো ঘরে অনুজ্জ্বল আলো। সেই আলোয় গত ঈদে বের হওয়া জনপ্রিয়তম অ্যালবামের গান বাজছে।

‘ফেসবুক দেইখপ্যার আইসলাম।’

লাজুক একটা হাসি ঝুলে আছে আমার মুখে। লোকটা বুঝে গেছে নিশ্চয়ই আমি বিদেশি মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব করার লোভে চলে এসেছি। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা কুঠুরির মধ্যে আরও একটা ছেলের মাথা দেখা যায়।

‘খালি ফেসবুক না আরও একখান জিনিস আছে। ব্যাক মাইনষের সামনে তো কইব্যার পারি নাই।’

পরে জেনেছিলাম অন্য ছেলেটা ফেসবুক দেখতে আসত না আমার মতো। একেবারে উত্তরের দুইটা কম্পিউটারে রঙিন-সাদাকালো প্রায় তিরিশ চল্লিশটা পর্ন ভিডিও তোলা ছিল। প্রতিদিন দশ-দশ বিশ টাকা খরচ করে তিরিশ মিনিট এক কুঠুরি, বাকি তিরিশ মিনিট অন্য কুঠুরিতে বসত।

দেখতে দেখতে অল্প কয়দিনেই আমি আমি ইন্টারনেটের নেশায় ডুবে গেলাম। এক ঘণ্টা সময় যেন দশ মিনিটেরও কম। কোনদিক দিয়ে পার হয়ে যায় টের পাই না। কোনোদিন ‘বোনাস’ দশ-পনেরো মিনিট চেয়ে নেই। এই শহরে আমিই প্রথম তার জাদুর গল্পে বিশ্বাস করেছি, এই খাতিরেই বোধ হয় ওই অতিরিক্ত সময়ের জন্যে সে কোনো টাকা দাবি করে না।

আমার বন্ধু সংখ্যা একমাস পরে দাঁড়াল একুশ জনে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি এই সাইবার ক্যাফেওয়লার ফেন্ডলিস্ট থেকে পাওয়া। আমার বাইশতম বন্ধুও যে হলো, সেও তার মিউচুয়াল। রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে মেয়েটা। প্রোফাইলে এক রঙের জর্জেট শাড়ি পরা ছবি। প্রায় প্রতিদিনই ছবি আপ্লোড করে সে। আর আমার পুরো প্রোফাইলে কেবল একটা ছবি। তাও মোবাইলের ঘোলা ক্যামেরায় তোলা, বিশ্রী রকমের ঝাপসা।

এক মাস পার না হতেই আমার ফেসবুকে ঢোকা বন্ধ হয়ে গেল। আসলেই নেশাগ্রস্তের মতোন হয়ে গেলাম আমি। প্রতিদিন বিকালে গিয়ে পারলে ক্যাফেওয়ালার পায়ে ধরি। কিন্তু তার ওই এক কথা, কলেজের ছাত্রদের ফেসবুকের ফাঁদে ফেলার মতোন পাপ কাজ করে সে মহা অনুতপ্ত, তওবা করেছে আর এই কাজ করবে না। আমি যতোই কাঁদো কাঁদো গলায় অনুরোধ করি, তার কণ্ঠ আরও শক্ত হয়ে আসে। তর্জনী চলে যায় বাইরে।

‘যাও মিয়া, পড়াশুনা করো। সামনেই তো পরীক্ষ্যা। নেশাখোর, গাইঞ্জাখোরগোর মতো করো ক্যা? বাইরে বড়ো বড়ো কইর‌্যা পোস্টার টাঙাইছি দ্যাহো নাই। দরকার অলি পারে হারা বাজারে টাঙাইয়্যা দিমু।’

মুখে সাধু সাজলে কী হবে আসল কাহিনি বুঝতে আমার বাকি নাই। তার দোকানে ঢুকে সব করা যায় খালি ফেসবুক বাদে! ঘণ্টাপ্রতি দাম পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছে। ব্যবসার ক্ষতিও নিশ্চয়ই হচ্ছে। আমি ছাড়া আর ওই পর্ন দেখতে আসা কয়েকটা ছেলে ছাড়া তার আর তেমন কাস্টমারও নাই। তবু আমার প্রতি নির্দয় আর কঠিন তার আচরণ। সবই আমার ওই বাইশ নম্বর বন্ধুর কারণে।

আমার সাথে আলাপ শুরু হওয়ার আগে, এক রঙের জর্জেট শাড়ি পরা মেয়েটার সাথে সাইবার ক্যাফের এই লোকটার প্রতিদিন কথা হতো। মেয়েটার প্রতি সে বোধহয় অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। নানান রকম স্বপ্ন দেখাও শুরুর করেছিল হয়তো। কিন্তু এক সময় খেয়াল করল মেয়েটা তাকে আর পাত্তা দিচ্ছে না। লোকটার চিঠির সমান বড়ো বড়ো মেসেজের রিপ্লাই আসে দুই তিন দিন পর পর, তাও এক দুই শব্দে। তার সন্দেহের তীর চলে আসে প্রথমেই আমার দিকে। পিসিতে কী একটা চেক করার নাম করে আমার ইনবক্সও দেখে ফেলে সে। পরের দিন সকালেই দোকানের সামনের সবগুলো দেয়ালে আর গাছে দেখি হাতে লেখা রঙিন পোস্টার ঝুলছে।

‘ছাত্রজীবনে প্রেম, মাদক এবং ফেসবুক এই তিন নেশা সর্বনাশা। এদেরকে না বলুন’

 

♣♣

খুব ভোরে এসে ট্রেন থামল উল্লাপাড়া স্টেশনে।

আমার ঘুম ততক্ষণে কেটে গেছে। উঠে ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পুরো স্টেশন খুঁজে দেখলাম একটা পত্রিকার স্টল আর চায়ের দোকান বাদে সব বন্ধ।

স্টেশন থেকে বের হয়ে দুই কদম হাঁটতেই চোখে পড়ল একটা বাজার। বাজারের আর স্টেশনের মাঝামাঝি একটা পরিত্যক্ত ওভারব্রিজ। তার নিচে ছোট্ট একটা পানের দোকান। অন্তত সত্তর বছর বয়সী এক মহিলা বসে আছে দোকানের সামনের বেঞ্চে। বুড়ি সুপারি কাটছে আর একা একা কথা বলে যাচ্ছে। বুঝলাম এটা তারই দোকান।

স্টেশন থেকে বের হয়ে দুই কদম হাঁটতেই চোখে পড়ল একটা বাজার। বাজারের আর স্টেশনের মাঝামাঝি একটা পরিত্যক্ত ওভারব্রিজ। তার নিচে ছোট্ট একটা পানের দোকান। অন্তত সত্তর বছর বয়সী এক মহিলা বসে আছে দোকানের সামনের বেঞ্চে। বুড়ি সুপারি কাটছে আর একা একা কথা বলে যাচ্ছে। বুঝলাম এটা তারই দোকান। সারাদিনের পান বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। বাজারের ভেতর গিয়ে একটা নাশতা করার জায়গা খুঁজতে হবে। হাতে সময় কম। কাজ শেষ করে পাঁচটার ট্রেনে ফিরতে হবে রাজশাহী।

কাজ বলতে ওই সতেরো বছর বয়সী মিষ্টি ছেলেটাকে খুঁজে বের করা। ফেসবুকে পরিচয় হয়েছে মাস দেড়েক আগে। পরিচয়ের দিন থেকে প্রতিদিন আসরের নামাজের পর এক ঘণ্টা আমাদের কথা হতো। আমার একটা বাক্যের উত্তরে সে দশটা বাক্য লিখত। প্রত্যেকটা শব্দে তার তরুণ মনের উচ্ছাস লেগে থাকত। আমি পড়ে এতো মুগ্ধ হতাম যে কী উত্তর দেবো খুঁজে পেতাম না। ওইদিকে সে উদ্বেগে উদগ্রীব হয়ে থাকত। আমার দেরি দেখে হতে পারে অভিমানে লাল হয়ে যেত। বানান ভুল, অসংলগ্ন বাক্য— তার অস্থিরতা, আকুলতা আমাকে অল্প কয়েকদিনেই নেশায় ডুবিয়ে দেয়। বয়সের পার্থক্যকে মনে হয় সবথেকে তুচ্ছ। এতো আবেগ উজাড় করে যার সাথে কথা বলা যায় সে আর যাই হোক ছোটো নয়, দূরের কেউ নয় কোনোদিনই।

প্রায় তেরো চৌদ্দ দিন হলো সে নিখোঁজ। বোকামি আমারই হয়েছে। তার হোস্টেলের ফোন নম্বর বা কোনো মোবাইল নম্বর নেওয়া উচিত ছিল। আসলে এতো নিয়ম করে ঠিক একই সময় প্রতিদিন কথা হতো যে হুঁট করে যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার কোনো ভয় কাজ করে নাই।

দুই সপ্তাহের অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ গত রাতে, একলা বারোটার ট্রেনে উঠে রওনা করেছি। রুমমেটরা সবাই জানে বাড়ি যাচ্ছি। সাধারণত সন্ধ্যা সাতটার বাসে বাড়ি যাওয়া হয়। কেউ যাতে সন্দেহ না করে, তাই ছয়টার মধ্যে হল ছেড়েছি। সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা বসে থেকেছি স্টেশনে। হাতে থ্রিলার বই আর গন্ধরাজের মালা।

ফুলগুলোর সাদা রং মলিন হয়ে গেছে। পাপড়ি গুলোর তেজ ফুরিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কিন্তু ঘ্রাণ তীব্র সতেজ আছে এখনও। যত্ন করে হাতে জড়িয়ে রেখেছি সারারাত। আমি চাই তার সাথে দেখা হওয়ার মুহুর্ত-জুড়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুলের প্রিয় ঘ্রাণ মিশে থাকুক।

যাই হোক তাকে দ্রুত খুঁজে পাবো এই আশা নিয়ে বাজারের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বুড়ি এইবার সুপারি কাটার শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে গুনগুণ করছে। কী গান গাইছে, কোন ভাষায়— কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।

 

♣♣
আজকে সকালে যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য। তখন ভোর সাতটা। আমি সাইবার ক্যাফের ভেতরেই ঘুমিয়েছিলাম রাতে। মেজাজটাও খারাপ ছিল খুব। গতরাতে এতো আয়োজন করে কলেজ হোস্টেলে গেলাম আরও দুইজন সাক্ষী, কয়েকটা ছবিসহ কিন্তু কাজ হলো না। আসামী লাপাত্তা।

‘কতদূর আর যাইবো। ফিরলিই বিচার। কঠিন শাস্তি। নাকের ডগায় পরীক্ষা ঝোলে, আর হে কিনা ফাল পাইরা গেছে ইন্টারনেটে পিরিত কইরব্যার। দরকার হলি তার গার্জিয়ানেক ডাইক্যা আনমু…’

ইত্যাদি বিচিত্র সব আশ্বাস দিয়া হোস্টেল সুপার আমাকে বিদায় দিল। কিন্তু এই নেশায় মত্ত ছেলে আর ফেরে কি না সন্দেহ। কলেজে আসলেও হোস্টেলমুখো হবে বলে মনে হয় না। যদিও বইপত্র, বিছানা বালিশ কিছুই নেয় নাই।

আজকে ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে রাস্তার পাশের কলে গিয়েছি মুখ ধোয়ার জন্যে। হঠাৎ ভূত দেখার অভিজ্ঞতা। রাজশাহী ভার্সিটির সেই সুন্দরী মেয়েটা রিক্সা থেকে নামল ঠিক আমার দোকানের সামনে। ছবির চেয়ে আরও বেশি সুদর্শন। পরনে সেই একরঙা শাড়ি। হাতে গন্ধরাজের মালা।

‘নিশ্চয়ই ওই বদমাইশ পোলাডক খুইজব্যার আইছে! তলে তলে এতোদূর! যা সন্দেহ করছিলাম তাই। ছিঃ ছিঃ। হাঁটুর বয়েসী একটো ছলের সাথে ফষ্টিনষ্টি!’

সামনাসামনি এইসব কথার একটা অক্ষরও মুখ দিয়ে বের হলো না। বরং তাকে বসতে দিয়ে এক দৌড়ে চা আনতে গেলাম। আর কী খাওয়ানো যায় মাথায় আসছে না। সব দোকানপাট এখনও খোলে নাই। মুখে একটা হাসি ঝুলিয়ে তার সাথে যথাসম্ভব মিষ্টি স্বরে কথা বলছি। যদিও রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। যতই আমি অন্য আলাপে যেতে চাই সে ঘুরে ফিরে ওই ছেলের প্রসঙ্গেই ফেরত আসে।

‘কোথায়, কেন পালিয়ে গেছে? কী বলেন! ওর বন্ধু-বান্ধব জানবে হয়তো কই গেছে। হোস্টেল কোনদিকে, একটু দেখিয়ে দেন, প্লিজ।’

একটা কৃত্রিম আগ্রহ দেখিয়ে তাকে নিয়ে কলেজের দিকে রওনা হলাম। এতো পরিতাপের মাঝেও মনে গোপন আনন্দ উঁকি দিচ্ছে। এতোদূর এসেও এই মেয়ে ওই পাকনা ছেলের দেখা পেল না। রাতে শাস্তির ব্যবস্থা করতে না পারার আক্ষেপ কমে গেছে অনেকখানি। তার হাতের ফুল ধীরে ধীরে নোংরা হয়ে যাচ্ছে। আমার ক্যাফেতে বসেই ওদের গন্ধ ফুরিয়ে গেছে অনেকখানি।

 

♣♣

সারারাত ট্রেন চলেছে। আমার মুখোমুখি বসেছিলেন তিনজন বয়স্ক লোক। তারা সন্তানদের নিয়ে গল্পে মত্ত। আমি দেখছিলাম বাইরের দুনিয়া। দুইপাশের অন্ধকারে পার হয়ে যাচ্ছিল বাড়ি, ঘর, দোকান, গাছ, মানুষের পর মানুষ। ট্রেনের শব্দ গানে সঙ্গত করা বাদ্যযন্ত্রের মতোন। ব্রিজের উপর দিয়ে যখন ট্রেন যায় মনে হয় নিচে কিছু নাই, জলের উপর ভেসে চলেছি। তাল, লয় বদলে যায় এর সংগীতের। ঈশ্বরদী এসে যাত্রাবিরতি দিল দশ মিনিটের। কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে নেমে স্টেশনের স্টল থেকে দুইটা ম্যাগাজিন কিনে ফিরে এলাম।

নির্ঘুম যাত্রার শেষে, সকালবেলা পা ফেললাম রাজশাহী স্টেশনে। খিলান দেওয়া উঁচু দালান। বড়ো বড়ো তিনটা প্লাটফর্ম। এতোদূরের শহর। মহানগর। নতুন নতুন মুখ। জীবনের শুরু বোধহয় এভাবেই হয়। এক নদী থেকে আরেক নদী, এক শহর থেকে আরেক শহর আমরা বয়ে চলি।

ডিভাইডার দেওয়া বিশাল রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম রিকশা নেওয়া জন্যে। বামপাশে তাকিয়ে দেখি একটা বাচ্চা ছেলে কয়েকশ রজনীগন্ধা নিয়ে বসে আছে। সাথে আর কোনো ফুল নাই। পঞ্চাশটা ডাঁটা আশি টাকায় কিনে রিকশায় উঠে বসলাম। গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্যতম বৃহত্তম ক্যাম্পাসে মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না জানি।

ডিভাইডার দেওয়া বিশাল রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম রিকশা নেওয়া জন্যে। বামপাশে তাকিয়ে দেখি একটা বাচ্চা ছেলে কয়েকশ রজনীগন্ধা নিয়ে বসে আছে। সাথে আর কোনো ফুল নাই। পঞ্চাশটা ডাঁটা আশি টাকায় কিনে রিকশায় উঠে বসলাম। গন্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের অন্যতম বৃহত্তম ক্যাম্পাসে মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া সহজ হবে না জানি। হলের নাম বলেছিল একদিন। সেই ভরসাতেই এগিয়ে যাচ্ছি। যদি তাকে একেবারেই খুঁজে না পাই, তখন কী করব, কোথায় যাব— জানি না।

বাড়ি ফিরে যাব? এইখানকার কোনো একটা সাইবার ক্যাফেতে আসরের পর বসে দেখব, তাকে পাই কি না? এই শহরে পরিচিত কেউ নাই আমার। হোটেলে থাকার খরচ কেমন কে জানে?

বরং ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সব শঙ্কা ভুলে যাওয়া ভালো।

ভাবতে না ভাবতেই কেমন একটা ঘোর নামল পুরো শহরজুড়ে। আমার সাথে তাল মিলিয়ে নতুন প্রেমের হাওয়ায় রিকশাটাও যেন সাদা পাখনা মেলে উড়ে চলেছে।

 

♣♣
ফেরার সময় আর পা চলছে না। রিকশাও মনে হচ্ছে আশাভঙ্গের ভারে ভেঙে পড়তে চাইছে, সামনে যেতে পারছে না। আধা ঘণ্টার পথ আসতে যেন পুরো এক বেলা কেটে গেছে। ছেলেটার বাড়ির মোবাইল নম্বর পেয়েছিলাম। কিন্তু বাড়িতে সে যায় নাই। অজানা আশঙ্কায় এলোমেলো লাগছে খুব। কী করব বুঝতে পারছি না। এখানে রাতটা থেকে যাওয়ার কোনো উপায় নাই। যন্ত্রচালিতের মতো তাই স্টেশনে চললাম। পাঁচটার ট্রেন ধরতেই হবে।

সাইবার ক্যাফের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন একটা অনুভূতি হলো। মনে হলো প্রায় মরে যাওয়া গন্ধরাজগুলো থেকে আগরবাতির গন্ধ ভেসে আসছে। মালাটা তৎক্ষনাৎ ছিঁড়ে ফেলে দিলাম।

সারা শহরে একটাই ইন্টারনেটের দোকান। তাই ভিড়ও প্রচণ্ড। হোস্টেলের সামনে দেখা হয়েছে এমন অনেকগুলো ছাত্রকে দেখলাম লম্বা লাইন করে দাঁড়ানো। আমার দিকে চোরের মতো তাকাচ্ছে, আর মুখ টিপে হাসছে। ওদের পার হয়ে দেয়ালের রঙিন পোস্টারগুলোতে চোখ পড়ল।

সারা শহরে একটাই ইন্টারনেটের দোকান। তাই ভিড়ও প্রচণ্ড। হোস্টেলের সামনে দেখা হয়েছে এমন অনেকগুলো ছাত্রকে দেখলাম লম্বা লাইন করে দাঁড়ানো। আমার দিকে চোরের মতো তাকাচ্ছে, আর মুখ টিপে হাসছে। ওদের পার হয়ে দেয়ালের রঙিন পোস্টারগুলোতে চোখ পড়ল।

‘ছাত্রজীবনে প্রেম, মাদক, আর ফেসবুক, এই তিন নেশা সর্বনাশা। এদেরকে না বলুন’

এই লাইনের সবাইকে তো ছাত্রই মনে হচ্ছে। ক্যাফেতে ঢুকতে এমন উপচে পড়া আগ্রহ দেখে অবাক হলাম। যতদূর জানতাম এই শহরে মাত্র দুইজন ফেসবুকার, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে আসে হাতে গোনা সাত-আট জন। তাহলে কি আমি এসে এদের ফেসবুকের নেশা বাড়িয়ে দিলাম? নাকি পোস্টারের নিষেধাজ্ঞা ওদের কৌতুহলকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। শাস্তির ভয় ভুলে গেছে সবাই?

ষোল সতেরো বছর বয়সী ছেলেগুলোর একেকজন আসলে উজ্জ্বল সাদা ফুল। এদের ঘ্রাণ এতো তীব্র যে মুহূর্তেই মাতাল করে ফেলে। রিকশা থেকে মাথা ঘুরিয়ে ওদের আবছা মুখ দেখলাম বার কয়েক। ভয়, উদ্বেগ আর মায়ায় ভেসে যাচ্ছি আমি। আমার সামনে সমুদ্রের ঢেউ। পায়ের নিচে বালুর বদলে অসংখ্য সাদা ফুল।

সেই ছেলেটা বোধহয় গন্ধরাজ ছিল। অন্তত দশহাজার ভেজা হাসনাহেনার ভিড়ে, আমার পায়ের কাছে সে শুষ্ক, বিরহী— একলা ডুবে গেছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদিরের জন্ম সিরাজগঞ্জে, ১৯৯০ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে । এখন পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতার বই দুইটা, অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান  (২০১৬) ও যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন (২০২০)। প্রথম গল্প সংকলন বছরের দীর্ঘতম রাত  প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।