শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

ফারুক মঈনউদ্দীন অনূদিত এমারিলিস গাচোপ্পোর গল্প : কুকুর

0

রেনাটার যতদূর মনে পড়ে, ওর দাদী সবসময় মরতে চেয়েছেন। বুড়ি কেবল মরার ইচ্ছেই প্রকাশ করতেন না, কাছেধারে কেউ থাকলে এই প্রকাশ ঘটত উচ্চৈঃস্বরে। যেমন বলতেন:

‘আমি এমন হয়রান। মনে হয় কাল সকালে আর উঠতে পারব না।’

‘জানি, এটাই হবে আমার শেষ গ্রীষ্ম।’

‘খুব জলদি আমাকে স্বর্গে ডেকে নেবেন তিনি, তখন তোমরা দুঃখ করবে।’

‘সবখানেই ব্যথা। সব জায়গাতে। তোমরা বুঝতে পারবে না। কথা বলতে, হাঁটতে, নিঃশ্বাস নিতে, ঘুমাতে, চোখ খুলে দেখতে, শুনতে— সব কিছুতেই ব্যথা। উজ্জ্বল রং তো আমার চোখের জন্য একরকম সন্ত্রাস। তোমাদের গলার আওয়াজ কানের পর্দায় আঁচড় মারে। আমার পিঠে ব্যথা, আঙুলগুলো টিপটিপ করে, হাঁটু ফুলে গেছে। কেউ জানে না।’

কখনো সরাসরি ঈশ্বরের কাছে মিনতি করতেন:

‘আমাকে শুনতে পাও? কাউকে এত লম্বা সময় বাঁচিয়ে রাখা নিষ্ঠুরতা।’

ছাদের দিকে হাতের মুঠি নেড়ে চিৎকার করে বলতেন: ‘কেন আমাকে এখনো তুলে নিয়ে যাচ্ছ না? আমি তৈরি হয়েই আছি।’

‘এই জীবন একটা অভিশাপ।’

দাদী তাঁর আবেগ কেবল দেখাতেনই না, প্রতিটা চলনে এবং মুখ থেকে নির্গত শব্দে সেটাকে জ্যান্ত করে তুলতেন। যেন ওসবের মধ্যেই ঘর বানিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি কাতরাতেন, বিলাপ করতেন, চেঁচিয়ে উঠতেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। সারাক্ষণ পরকালের উদ্দেশে কথা বলে যেতেন তিনি। হাত মুঠো করে কামড়াতেন তিনি, সেখানে দাঁতের দাগ নাকি হালকা কালশিটে পড়বে সেটা নির্ভর করত বাঁধানো দাঁতের পাটি লাগানো আছে কি না, তার ওপর। কখনো অনুনয় করতেন, মাঝেমধ্যে হাঁটু গেড়ে বসতেন। তাঁকে নিরাশ করলে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলতেন তিনি, যেন সামনে কাউকে দেখলেই তাঁর ভেতরে শারীরিক যন্ত্রণা হানা দেবে। ছেলের বিয়ের দিন অনুষ্ঠানের পুরো সময় গলা ফাটিয়ে কান্নাকাটি করেছিলেন তিনি। রেনাটার মা বলেন, এই মহিলার বিলাপ এত জোরে ছিল যে, চিৎকার করে বিয়ের মন্ত্র পড়তে গিয়ে গলা ভেঙে ফেলেছিলেন পাদ্রি।

ওদের বাড়ির ক্যাবিনেটের ওপর ফ্রেমে বাঁধানো একটা বিয়ের ছবি ছিল। সেই ছবিতে রেনাটার মায়ের দুই গাল বাচ্চা পুতুলের মতো নাদুসনুদুস, বাবার কপালে তখনই ভাঁজ পড়ে গিয়েছিল, তাঁর কাঁধ ছিল বুড়ো মানুষের মতো কুঁজো। ছবির মায়ের বয়স তখন ষোলো, রেনাটার এখনকার বয়সের সমান। ওর বাবা তখন বিশ ছুঁইছুঁই, মাত্র মিলিটারির চাকরি শেষ করেছেন। এখন দুটো চেহারাই শেষ। ছবিতে তাঁদের ঘিরে ছিলেন বর-কনের বাবা মায়েরা: নিজের পাতলা রেশমী নেকাবের ভেতর দিয়ে ক্যামেরার লেন্সের দিকে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থাকা ওর দাদী ছাড়া বাকি সবাই এখন মৃত। রেনাটার সন্দেহ, সবাইকে নিজের রোগভোগের কথা যতটা জানান দেন, ততটা মরতে চান না তিনি। তাঁর বিশ্বাস, বহুদিন ধরে অন্যদের চেয়ে বেশিই কষ্ট পেয়ে আসছেন তিনি। যেমন, রেনাটা যদি বলে ওর মাথাব্যথা করছে, দাদী বলবেন, তিনি তো গত বিশ বছর ধরেই এটাতে ভুগছেন। যদি রেনাটার মা বলেন, তিনি ক্লান্ত, দাদী বলবেন, কোনো সাহায্য ছাড়া একবারের জন্যও না জিরিয়ে ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেই জীবন পার করলেন তিনি। বয়সকালে দিনের পর দিন— না, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কাটিয়েছেন না ঘুমিয়ে। পিঠের ওপর বাচ্চা নিয়ে কঠোর খাটুনি খেটে জলপাই তুলেছেন মাঠ থেকে। অন্য বাচ্চাকে বুকে নিয়ে মোজা রিফু করেছেন, জামা সেলাই করেছেন। রান্না করে ঘর পরিষ্কার করেছেন আরেকটা বাচ্চাকে কাঁখে নিয়ে। দাদীর মতে, রেনাটা বা তার মায়ের কোনো ধারনাই নেই ক্লান্তি কাকে বলে, ঈশ্বর কখন যে তাঁকে বিশ্রাম দেবেন। দাদী যখন এসব কথা বলা শুরু করতেন, রেনাটা গোপনে প্রার্থনা করত, ঈশ্বর যাতে তাঁর আর্জিটা রাখেন।

ওর মায়ের যখন প্রসব বেদনা শুরু হয়, রেনাটার কাছে মনে হয় যে কিছু একটা, খুব খুউব বড়ো একটা সমস্যা হচ্ছে কোথাও। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হয় ওর। মনে হয় মা মারা যাচ্ছেন, যেন পায়ের নিচের মাটি দুধারে ফাঁক হয়ে নরকে টেনে নেবে তাঁকে। তার চেয়ে বেশি অস্বস্তিকর ছিল, আসলে কোনোই সমস্যা ছিল না কোথাও।

ওর মায়ের যখন প্রসব বেদনা শুরু হয়, রেনাটার কাছে মনে হয় যে কিছু একটা, খুব খুউব বড়ো একটা সমস্যা হচ্ছে কোথাও। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হয় ওর। মনে হয় মা মারা যাচ্ছেন, যেন পায়ের নিচের মাটি দুধারে ফাঁক হয়ে নরকে টেনে নেবে তাঁকে। তার চেয়ে বেশি অস্বস্তিকর ছিল, আসলে কোনোই সমস্যা ছিল না কোথাও। দৃশ্যত সবই ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

আগের মাসগুলো থেকে ওর মায়ের শরীরটা আলুবোখারার মতো ফুলে ফেঁপে উঠছিল, প্রসূতিদের কোমর ঢোলা লম্বা যে পোশাক তিনি পরছিলেন, তাতে তাঁর শরীরের হোঁতকা চওড়া ভাবটা আরও বেশি ফুটে উঠছিল। তাঁর পেট কন্দের মতো হয়ে ওঠার পরও তিনি হাত আর হাঁটুর ওপর উপুড় হয়ে চেয়ারের নিচে চুল, ময়লার ঝুল, রুটির টুকরো এসব খুঁজে বেড়োনো পছন্দ করতেন। একপাশে শুয়ে পড়ে ফ্রিজের নিচে উঁকি দিয়ে খুঁজতেন ঝুলকালি, ময়লা, হারানো পয়সা আর চাউলের দানা। রান্নাঘরের কাবার্ডের সব জিনিসপত্র নামিয়ে খুঁজে বেড়াতেন ময়দার কনা কিংবা চিনির দানা, প্যাকেটের গায়ে মাকড়সার জাল কিংবা ইঁদুরের দাঁতের চিহ্ন। কাবার্ডের তাকগুলোতে এত বেশি জীবানুনাশক ছিটাতেন যে সারা বাড়িতে অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ পাওয়া যেত। পুরনো টুথব্রাশ দিয়ে বাথরুমের টাইলসের খাঁজ থেকে ঘষে ঘষে তুলতেন কালো ছাতলা। একবার সকালের নাশতার সময় চুলোর পেছন দিয়ে একটা ইঁদুরকে দৌড়ে পালাতে দেখা যায়। সেদিনই দেয়ালের ধার থেকে চুলো আর ফ্রিজ সরিয়ে ফেলেন তিনি। সেখানে বসান লোহার একটা ফাঁদ, তারপর ছোটো সাদা পিরিচের ওপর কয়েকটা করে নীল রঙের বড়ি রেখে সেগুলো ফ্রিজের পেছনে, বাথরুম আর সিংকের নিচে রেখে দেন। কিছু ফুলকপি সেদ্ধ করে সেগুলো বিষে চুবিয়ে ফেলে রাখেন চুলোর পেছনে। দাদী ওর মায়ের পেছনে ঘুরে ঘুরে ধারাবর্ণনা দিতে থাকেন। বলতে ছাড়েন না, তিনি যে ঘরে সংসার করতেন সেখানে কখনোই কোনো ইঁদুর ঢোকার সাহস পেত না। হতে পারে চলাফেরা করত ওরা। কে না জানে ইঁদুর প্লেগ ছড়ায়।

ওর মা এসব শুনতেন বলে মনে হতো না। এক সকালে ওরা কিছু একটা ছুটে পালানোর শব্দ পায়, ওর মায়ের কান বিড়ালের মতো খাড়া হয়ে ওঠে। টেবিলটা দেয়ালের দিকে ঠেলে দেন তিনি, কফির কাপ প্লেট ইত্যাদি মেঝের ওপর সশব্দে আছড়ে পড়ে। হ্যাঁচকা টানে চুলো সরিয়ে ঝাড়ুটা তুলে নেন। ইঁদুরটাকে দেখা গেল, মার চোখে চোখে তাকিয়ে আছে। বিষক্রিয়ায় চলাফেরা ঢিলে হয়ে এসেছে, তাই পালিয়ে না গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। ঝাড়ুটা নেমে এলো তখন: একবার, দুবার, তিনবার, তারপর বার বার, যতক্ষণ পর্যন্ত না তালগোল পাকিয়ে ভিজে চ্যাপ্টা হয়ে যায়।

এক সকালে মায়ের প্রসব বেদনা ওঠে। ওর বাবা তখন কাজে। এসময় কফিপটটা শিস দিয়ে ওঠে, ওর দাদী সার্ডিন মাছ খাচ্ছিলেন। সেই গন্ধে ভরে উঠেছে সারা ঘর। কাঁটাচামচ দিয়ে টিনের ভেতর থেকে একেকটা তেলে ভেজানো মাছ তুলে মুখে ফেলে মিহি আঁশগুলোকে বাঁধানো দাঁতের পাটি দিয়ে ঘষছিলেন বুড়ি। কখনো চুলের মতো মিহি কাঁটা মুখের ভেতর থেকে বের করে নিয়ে সামনে টেবিলের ওপর রাখছিলেন। আজ কেমন আছেন জানতে চাইলে রেনাটা আর ওর মা দুজনই জানে জবাবটা কী হবে: বুড়ি কঁকিয়ে বলবেন, ‘এরকম জীবন একটা অভিশাপ। কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, শেষপর্যন্ত স্বর্গের দরজায় পৌঁছে গেছি আমি।’

সার্ডিনের খালি টিনের কৌটাটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে নিচের গলিতে ছুড়ে দেওয়ার আগে রেনাটার মা শাশুড়ির ওপর চোখ ঘুরিয়ে আনেন। এই বাড়িতে সবাই আপন মনে কথা বলে, সেসবের কোনোটা কখনো কারো ওপর গিয়ে পড়ে, তবে ফল হয় সামান্যই। যেমন এখন দাদীর আরজিতে ওর মায়ের গলার আওয়াজ চাপা পড়ে যাচ্ছে। রেনাটা দেখে দুই মহিলা যখন রান্নাঘরে পায়চারি করছিলেন, ওর মা দুই হাত পেটের নিচে এমনভাবে ধরে রেখে শব্দ করে গোঙাচ্ছিলেন, যেন মনে হয় কাপড়ের নিচ থেকে খসে পড়ে যাবে পেটটা। ওর দাদী দুহাত শূন্যে ঝাঁকিয়ে জপমালাটা বুকের ওপর আছড়াতে আছড়াতে আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘হে প্রভু, বাচ্চাটাকে জীবন দিয়ে অভিশপ্ত কোরো না, ওটাকে ফিরিয়ে নাও!’

শরতের শেষে স্কুল ছেড়েছে রেনাটা। ওর বয়সী অন্য মেয়েদের বেশিরভাগই ঘরে থেকে মাকে সাহায্য করছে কিংবা কোনো চাকরি খুঁজে নিয়েছে। কিন্তু থালাবাসন ধোয়া কিংবা শেলফে ঝাড়ন বোলানোর কথা ভাবতেই ঘুম পায় ওর। এই গ্রীষ্মেও ওর স্কুলের বন্ধুরা টাউন স্কোয়ারে জড়ো হয়ে আইসক্রিম কিনত, একটা সিগারেট ভাগ করে খেত কয়েকজন মিলে। সকালে আর সন্ধ্যায় রুটির টুকরোর মধ্যে পেঁচিয়ে ভাজা অচেনা মাংস বিক্রি করা রাস্তার অস্থায়ী দোকানগুলোতে ঘোরাঘুরি করত ওরা। খাবার বাড়িতে নিয়ে আসতেই পছন্দ করত রেনাটা। বাড়িতে এসে শোয়ার ঘরে একা একা বসে খেত ও : মাংসের পুর দেওয়া ফ্রাইড রাইসের গোল্লা, টিনের শুকনো ডুমুর, তেল মশলায় ডোবানো জলপাই, পনির ভরা গরম ব্রেড রোল, ফাঁপা মরিচের মধ্যে সার্ডিনের কুচি আর রুটির গুঁড়ো, লবণ দেওয়া কাঠবাদাম, কুচো মাছ আর পনির বসানো টমেটো সস মাখা পাউরুটি। যতক্ষণ পর্যন্ত না ওর দুই উরু ঘামে আঠালো আর পিচ্ছিল হয়ে ওঠে, বেলুনের মতো পেট ফুলে এত শক্ত হয়ে উঠে যে মনে হয় সিমেন্ট গোলা জল খাওয়ার পর জমাট বেঁধে গেছে সব। মায়ের আলমিরাতে লুকিয়ে রাখা আদিরসের পেপারব্যাক পড়ে ওর দিন কাটে, ওগুলোর প্রচ্ছদে পুরুষালী মানব-অশ্বের পায়ের কাছে বুক আঁকড়ে ধরা লারেলাপ্পা ধরনের পোশাক পরা মেয়েদের জলরং ছবি। কোনো রাতে ঘুমের জন্য ছটফট করে ও, কিন্তু সারাদিন কর্মহীন বসে থাকার কারণে শরীরজুড়ে অস্থিরতা। আর ঘুমিয়ে পড়লে ও এত বেশি দাঁত কাটে যে সকালে মুখে রক্তের স্বাদ পাওয়া যায়, মুখ খুলতে গেলে চোয়ালে লাগে।

ওর মা হাসপাতালে থাকার সময়টুকু ছিল ওর দাদীর জন্য দারুণ মজার। বুড়িকে চঞ্চল বালিকাসুলভ মনে হয়, দুই গালের তোবড়ানো ভাবটাও যেন আর নেই। নির্দিষ্ট কোনো কাজের জন্য খুব ভোরে ওঠার মতো জলদি ঘুম থেকে উঠে পড়তেন তিনি। ছেলের জন্য কফি বানিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়া আধোঘুমের ছেলের ঠোঁটের কাছে পেয়ালাটা তুলে ধরতেন। ঠোঁটের কোণ মুছে দিতেন ন্যাপকিন দিয়ে। খাওয়ার সময় ওঁর প্লেটের মাংসগুলো ছোটো ছোটো টুকরো করে দিতেন। দুপুরে খাওয়ার পর বাবা যখন দিবানিদ্রায়, দাদী ছেলের গায়ের ওপর কম্বল চাপা দিয়ে বিলি কাটেন চুলে, কম্বলটা এমনভাবে জড়িয়ে দেন যে আষ্টেপৃষ্টে কাঁথা জড়ানো নবজাতকের মতো মনে হতো তাঁকে। তারপর আলতো করে চুমু দিতেন ছেলের কপালে, গালে আর ঠোঁটে। রাতে কাজ থেকে ফিরে ছেলে গোসল করতে গেলে স্নানঘরের টয়লেটের ধারের ওপর বসে তদারক করেন বুড়ি, মনে করিয়ে দেন যাতে কানের পেছনে, বগলের নিচে আর দুপায়ের মাঝের জায়গা যাতে ভালোভাবে পরিস্কার করা হয়। মাঝরাতে চুপিচুপি শোবার ঘরে ঢুকে খাটের কোনায় বসে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। দাদীকে এসব করতে দেখে রেনাটার অসুস্থ লাগত। এই মহিলাকে এতখানি খুশি কখনোই দেখেনি ও, তাঁর চোখে দেখা যেত একধরনের উজ্জ্বলতা। টেবিলে বসে ছেলের গালে হাত বুলিয়ে দাদী বলতেন, ‘আমার ছেলে, আমার জান, আমার ছেলে।’

শব্দগুলো এমনভাবে বলতেন যেন কোনো পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করছেন, এসব বলতে পারাই যেন আনন্দের।

বাবা কাজে চলে গেলে রেনাটা দেখে, ওর বাবা-মায়ের বিছানার চাদরের ওপর তল্লাশী চালিয়ে ছেলের নিঃসঙ্গ শোয়ার জায়গাটার গন্ধ শুঁকছেন দাদী। ওকে লক্ষ করেন না তিনি, কিংবা না দেখার ভান করেন। কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয় রেনাটা, ভেতরটা ফাঁপা লাগে।

বাবা কাজে চলে গেলে রেনাটা দেখে, ওর বাবা-মায়ের বিছানার চাদরের ওপর তল্লাশী চালিয়ে ছেলের নিঃসঙ্গ শোয়ার জায়গাটার গন্ধ শুঁকছেন দাদী। ওকে লক্ষ করেন না তিনি, কিংবা না দেখার ভান করেন। কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা ভেজিয়ে দেয় রেনাটা, ভেতরটা ফাঁপা লাগে। নিজ চোখে যা দেখেছে সেটা ঠিকভাবে মেলাতে পারে না, তবে অবাকও হয় না। মনে হয় যেন বেঁচে থাকা এই গোপন নরককুণ্ডের ভেতর দিয়ে অতি কষ্টে হেঁটে চলেছেন দাদী। অন্য কিছু দিয়ে এইমাত্র দেখা দৃশ্যটা ভেতর থেকে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলার জন্য রান্নাঘরে গিয়ে টেলিভিশনটা চালিয়ে দেয় ও। একটা ভ্যারাইটি শো চলছিল তখন, চোখে মেক আপ দেওয়া দীর্ঘ চুলের এক সুন্দরী ক্যামেরার সামনে চাপা স্বরে গান গাইছিল, স্টুডিওর দর্শকেরা হর্ষধ্বনি দিয়ে ওঠে। রেনাটা চাইছিল কোনো একদিন এমন একটা মুহূর্ত যাতে ওর কাছে ফিরে আসে, ও ঠিক ধরতে পারবে না, ওটা কি স্মৃতি, নাকি স্বপ্ন।

হাসপাতালে যাওয়ার কয়েকদিন পর রেনাটার মা ফোন করেন। একটা ছেলে হয়েছে ওঁর। বাচ্চা নিয়ে ফিরে আসতে চান তিনি।

‘ছেলে’। বাবা নিজে নিজেই খুশি। উদযাপন করার জন্য তিনটা গ্লাসে ওয়াইন ঢালেন তিনি। ওর দাদী আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘বেচারা বাচ্চাটা। জীবনের অভিশাপ হয়ে এলো বাছা।’

তবু ভেতরে ভেতরে খুশি তিনি। বাচ্চা ছেলেরা সহজেই ভালোবাসে এবং ওদের ভালাবাসা সহজ।

যেদিন মা আর বাচ্চাটাকে নিয়ে আসার কথা, সেদিন ওর বাবা দিনটা উদযাপন করতে চাইলেন। জবাই করা একটা বাচ্চা শূকর নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন তিনি। বালতিতে ফুটানো জল নিয়ে বাবার কাছে যায় রেনাটা, বাসার নিচের গলিতে টেবিলের ওপর প্রাণীটাকে ফেলে রাখা হয়েছিল। ভোরের স্বচ্ছ আলোয় শূকরটার চামড়ার ওপর ছুরি দিয়ে চাঁচতে চাঁচতে গরম পানি ঢেলে দিচ্ছিলেন বাবা, প্রতিবার গরম পানি ঢালার সাথে চামড়া থেকে হিসহিস করে বাষ্পের মেঘ উঠে আসছিল। সেই বাষ্প থেকে আচ্ছন্ন করা একটা গন্ধ উঠে আসে-পোড়া চামড়ার মিষ্টিমতো একটা গন্ধে রেনাটার মাথা ঝিমঝিম করছিল, জ্বরজ্বর লাগে ওর। বাবা বলেন, ‘পানি ঢাল!’ তারপর ধমকে উঠে বলেন, ‘আরো! জোরে!’

পশুর চামড়ার ওপর ছুরি চালানো কঠিন কাজ, মাঝে মাঝে ছুরির ফলা আটকে গিয়ে হাতের ওপর আঁচড় লাগছিল। লোমশ চামড়াটা পরিষ্কার ও মসৃণ না হওয়া পর্যন্ত একনাগাড়ে পানি ঢেলে চামড়াটা ডলতে হয় ওদের। কাজটা শেষ হলে রেনাটা ওর হাতের তালু বুলিয়ে আনে ওটার ওপর, দেখতে পায় আঙুলের গিঁটগুলো লাল ফুটকিতে ভরে গেছে।

ছুরিটা ওটার শরীরের ভেতর চালিয়ে দিয়ে একটা বড়ো পাত্রের ওপর ধরে রাখেন বাবা, গলগল করে ঘন রক্ত বেরিয়ে আসে। সব রক্ত বের হয়ে গেলে পাত্রটা দাদীর কাছে দিয়ে দৌড়ে নেমে আসে ও। বাবা তখন শরীরটার ভেতর কবজি পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়েছেন। ওটার পাঁজরগুলো সশব্দে ভেঙে দুভাগ করে ফেলেন তিনি। তারপর ‘জলদি!’ বলে খেঁকিয়ে ওঠেন।

ওর হাতের তালুর ওপর ভাপ ওঠা হৃৎপি-টা তুলে দেন তিনি, এমন গাঢ় লাল যে প্রায় কালো মনে হয় ওটাকে, যেন একটা গরম চুনি পাথর। একঘণ্টা আগে এই জিনিসই শূকরটার শরীরের ভেতর ঢিপঢিপ করছিল। চেকনাই আর নাড়িভুঁড়ি পৌঁছে দিতে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওঠানামা করছিল রেনাটা। সব কাজ শেষ করে বাবা ওটাকে কাঁধে ঝুলিয়ে এনে রান্নাঘরের টেবিলের ওপর ছুড়ে ফেলেন। তারপর শরীরটার বাকি যা ছিল সেসব বিচ্ছিন্ন করে ওর দাদীর কাছে দিতে থাকেন। দাদী ওগুলো একটা মুগুর দিয়ে ধুনে পাতলা ফালি করে ফেলেন। কাজ করতে করতে তিনি কোথায় কোথায় সন্তান জন্ম দিয়েছেন তার ফিরিস্তি দিতে থাকেন: চাষের মাঠে, রান্নাঘরে, ভাইয়ের বিয়েতে যাওয়ার পথে। তারপর বলেন যে নিজে নিজেই বাচ্চা প্রসব করেছেন চুপচাপ, সব শেষ হলে ফিরে গেছেন রোজকার কাজে।

কয়েক ঘণ্টা পর রক্তের একটা গাঢ় ধাতব গন্ধ ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে, তারপর মাংসটা রান্না হতে থাকলে সেই গন্ধ আরো তীব্র ও মিষ্টি হয়ে ওঠে, চর্বিগুলো মচমচে হয়ে ছিটকে উঠছিল। রান্না শেষে বাবা মাংসের চ্যাপ্টা টুকরোগুলো ওদের থালায় তুলে দেন। নিজেদের বাটিভর্তি কমলার ফালি, মৌরি আর লাল পেঁয়াজ নিয়ে আসে সবাই। ওর দাদী বলেন, ‘আহা, তোর বাবা কত ভালো। এটা দেখ। না, আমাকে শুধু ছোটো একটা টুকরো দিস। আরে, আরে! এটা দেখ একবার।’

দাদী ছেলের জন্য মাংস কেটে দিতে থাকেন। মুখের ভেতর কমলার মিষ্টি চাটনি ফেটে রসালো মাংসের ভেতর দিয়ে যাওয়ার তীব্র স্বাদ চাখতে চাখতে লোভীর মতো খাচ্ছিল রেনাটা। বাবা খাওয়া শেষ করার সাথে সাথে দাদী বলেন, ‘আরেকটা নাও। আরো আছে। তোমার খাওয়া দরকার।’

রেনাটা যখন পাউরুটির একটা খাস্তা টুকরো দিয়ে নিজের থালার রস মুছে নিচ্ছিল, ওর বাবা বাধ্য ছেলের মতো আর এক ফালি মাংস নেন। সেটুকু শেষ করার পর পেটের ওপর হাত রেখে চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে বসেন। দাদী বলেন, ‘খেতে থাকো, আরো একটু নাও। জানি তোমার এখনো খিদে আছে। এত কঠিন পরিশ্রম কর তুমি।’

তৃতীয়বার নেওয়ার পর শেষটুকু যখন চিবোচ্ছিলেন, ছেলের থালায় আরো এক দলা মাংস তুলে দেন দাদী। মাথা নাড়েন বাবা। ‘প্লিজ’ বলে দাদী ছেলের উরুর ওপর হাত রাখেন। ‘তোমার শক্তি দরকার। খাও দয়া করে।’

ওর বাবা যখন ধীরে ধীরে বাকি সব শেষ করতে থাকেন, চুপচাপ বসে থাকে ওরা। তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাস কষ্টকর হয়ে ওঠে। সব শেষ হলে দাদী একটা তৃপ্তির হাসি হাসেন। বলেন, ‘হ্যাঁ, এইতো ভালো ছেলে।’

দাদী কেবল খাওয়া আর প্রার্থনার সময় বাঁধানো দাঁতগুলো পরেন, এখন সেগুলো খুলে নিয়ে নিজের প্লেটের পাশে একটা প্লাস্টিকের কাপের পানিতে ছপাৎ করে রেখে দেন।

খাওয়ার পর রেনাটা আর ওর দাদী একসাথে বসে আমেরিকান সোপ অপেরাগুলো দেখে। ওদের প্রিয় যেটা দিয়ে শুরু হয়, সেটা ওদের দেশে ‘ফরএভার’ নামে পরিচিত। দাদী নিজেকে হাওয়া করতে করতে রান্নাঘরের জানালার পাশে চেয়ারে বসে অপেক্ষা করেন। জুতোজোড়া খুলে রেখে আরেকটা চেয়ারে পা তুলে দেন তিনি। গা চুলকায় এমন কালো পোশাক তাঁর গায়ে, কার্ডিগান, পায়ে কাঁচা মাংসের মতো রঙের মোজাজোড়া চামড়ার সাথে বেমানান, পায়ের গুলের গায়ে হিজিবিজি ছড়ানো মোটা নীল শিরাগুলোকে ঢেকে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে মাত্র। রেনাটা ছোটো টেলিভিশনটা চালু করে দিয়ে আরেকটা চেয়ারে বসে। দুজনই থিম সংটার সাথে গুনগুন করে গলা মেলায়। বিকল্প কোনো অভিনেতার বদলে সংজ্ঞাহীন অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে আসা প্রিয় চরিত্র স্টোন পর্দায় উপস্থিত হলে দাদী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। লাঞ্চের পর থেকে নীরবতা ছড়িয়ে গিয়ে শেষবিকেল পর্যন্ত সময়টুকুর ওপর কম্বলের মতো বিছিয়ে থাকে। সোপ অপেরার নাটকীয় বাজনা আর জাঁকালো ডায়লগগুলো সেই নৈঃশব্দ্যকে আরো তীব্র করে তোলে। রেনাটা ভাবে, এই সময়গুলোতে নিজের কাছ থেকে লুকানো যায় না। দিনের এই উষ্ণ প্রহরে দেশের নো ম্যানস ল্যান্ডের মতো যেন এক ধরনের মরুভূমি ওরা। চরিত্রগুলোর সংলাপের মাঝের দীর্ঘ বিরতির মধ্যে যে নিরবতা শোনা যায়, সবকিছুকে ভাসিয়ে নেয় যেন সেটা। সোফায় শোয়া ওর বাবার নাক ডাকার শব্দ পুরো ঘরকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে।

বিকেলের হিংস্র রোদ ঠেকানোর জন্য রান্নাঘরের জানালাটা অন্য অ্যাপার্টমেন্টগুলোর মতো অর্ধেক খোলা। বাইরে সূর্যের আলো উল্টোদিকের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটাকে ধুইয়ে দিচ্ছে, সমুদ্রের দিক থেকে শহরের দিকে বয়ে আসা অল্প হাওয়ায় প্রতিবেশীদের রোদে দেওয়া সাদা বিছানার চাদর আর অন্তর্বাসগুলো হালকা দুলছে। তখন নিচের রাস্তা থেকে কুকুরের খেঁকানি আর একগুচ্ছ ভীত বিদেশী কণ্ঠস্বর শোনা যায়। রেনাটা আর ওর দাদী ছুটে গিয়ে জানালার বাইরে মাথা বের করে দেয়। যেমন সন্দেহ করেছিল: ইউরোপ থেকে আসা লালমুখো কয়েকজন ট্যুরিস্টকে তাড়া করছে রাস্তার কুকুরগুলোর একটা। ওদের মাথায় স্ট্র হ্যাট, খাকি শর্টস আর গলায় ঝোলানো বড়ো বড়ো ক্যামেরা। ওরা হেঁটে যাওয়ার সময় কুকুরটা ওদের পিছু নিয়ে মাঝে মাঝে গোড়ালি কামড়ে ধরার চেষ্টা করে গর্জন করতে থাকে। এসব লোক সবসময় আসবে সামারে, শহরের মধ্য দিয়ে অতিকষ্টে হেঁটে যাবে যেন এটা কোনো চিড়িয়াখানা, স্থানীয় লোকজনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছবি তুলবে, যেন ওরা কোনো অদ্ভুত প্রাণী। লাঞ্চের সময় বারে গিয়ে ঢুকবে, টয়লেটে গিয়ে দীর্ঘ সময় লাগাবে, তারপর জলদি সার্ভ না করলে ওয়েটারদের মুখের ওপর আঙুল নাচিয়ে রাগারাগি করবে, কারণ, ওদের কথা বুঝতে পারেনি ওরা অথবা মেন্যু পছন্দ হয়নি। ওদের একজন সবসময়ই গরমে অজ্ঞান হয়ে পড়লে অথবা যেমন আজ, রাস্তার কুকুরের তাড়া খেয়ে গাড়িতে ওঠার পর হেঁটে বেড়ানো বন্ধ হবে ওদের। ট্যুরিস্টদের দল আর কুকুরটা মোড় ঘুরে চলে যায়। ওর দাদী উল্টোদিকের বাসার মহিলাটির দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা নাড়ান। তারপর রেনাটার কাঁধে কনুইয়ের গুঁতো মেরে হাসেন, ‘ওগুলোর হাবা মুখগুলো দেখলি? কী সব লোক!’

এখানকার কুকুরগুলো বুনো স্বভাবের, দলবেঁধে গলিময় দাপটে হেঁটে বেড়ায়। এই ইতর প্রাণীগুলো বাড়ি পাহারা দেওয়া মাদীগুলোর বংশধর। অনাকাঙ্ক্ষিত বলে দুনিয়াতে আসার অল্প কিছুদিন পর গাড়ি থেকে ছুড়ে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয় ওগুলোকে। রাস্তার ধারগুলো যেন অবাঞ্ছিত জিনিসপত্রের পবিত্র আধার— কেবল কুকুর নয়, নোংরা জাজিম, বিড়ালের বাচ্চা, পুরনো কাপড় আর ছেঁড়া সোফা-সবকিছুর।

এখানকার কুকুরগুলো বুনো স্বভাবের, দলবেঁধে গলিময় দাপটে হেঁটে বেড়ায়। এই ইতর প্রাণীগুলো বাড়ি পাহারা দেওয়া মাদীগুলোর বংশধর। অনাকাঙ্ক্ষিত বলে দুনিয়াতে আসার অল্প কিছুদিন পর গাড়ি থেকে ছুড়ে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয় ওগুলোকে। রাস্তার ধারগুলো যেন অবাঞ্ছিত জিনিসপত্রের পবিত্র আধার— কেবল কুকুর নয়, নোংরা জাজিম, বিড়ালের বাচ্চা, পুরনো কাপড় আর ছেঁড়া সোফা-সবকিছুর। রোববারে গির্জা থেকে বের হয়ে বয়স্ক দম্পতি আর পরিবারগুলো গাড়ির পেছনের সিটে ডাঁই করা প্লাস্টিক ব্যাগে রাজ্যের আবর্জনা এনে এখানে ফেলে দিয়ে যায়। রোববার সন্ধ্যার কয়েক ঘণ্টা গাঙচিল আর শকুনেরা আক্রমণ শুরু করার আগে এইসব প্লাস্টিক ব্যাগের স্তুপকে ছিমছাম মিশরীয় পিরামিডের মতো দেখায়।

সেই সব হাঁসফাঁস করা গরমের বিকেলগুলোতে রেনাটার ভেতর একটা হিংস্রভাব জেগে ওঠে, খুব বাজে লাগে তখন। কাউকে পেটাতে কিংবা কোনো কিছু ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু শক্তি পাচ্ছে না— অনুভূতিটা এমন। নিজের ওপর, পরিবারের ওপর, এই শহর আর চারপাশের অন্য শহরগুলোর ওপর মহা বিরক্ত ও। শরীরের ভেতর থেকে নিজেকে আঁচড়ে বের করে আনতে ইচ্ছে করে। চারপাশের বাতাস কাঁপতে থাকে এসময়, মনে হয় দাঁতের ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে আটকে আছে ও, অপেক্ষা করছে মুখের ভেতর থেকে সবগুলো দাঁত বের করে আনার জন্য। পরের দিকে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বমিভাব নিয়ে অসুস্থ পড়ে থাকত ও। মা বলেন, এর অর্থ হচ্ছে ও রমণী হয়ে উঠছে। রেনাটা ভাবত, সে আশায় বসে থাকো তুমি। ওর মার দুশ্চিন্তা শুরু হয় এসময়।

‘ফরএভার’ নাটকে পরিবারকর্তা ভিক্টর নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। তার বড়ো ছেলে স্টোনের বিয়ে করার কথা প্রেমিকা ভ্যানেসাকে, অথচ ওর বাবা ভিক্টর মেয়েটাকে পছন্দ করত না (এই ভ্যানেসার সাথে ভিক্টরেরও প্রেম ছিল একসময়)। ওদের বিয়ে যখন প্রায় চূড়ান্ত, স্টোন আবিষ্কার করে যে ওর মা কেলি নিখোঁজ এবং সম্ভবত মারা গেছে। রেনাটা ভাবে, পিতৃমাতৃহীন স্বামী। মেয়েটা ভাগ্যবান।

তখনো টেলিভিশনের পর্দার ওপর চোখ রেখে ওর দাদী বলেন, ‘আমাকে বাদ দিয়ে— আমি মারা যাওয়ার পর যদি তুই বিয়ে করিস— তোকে কখনোই মাফ করব না আমি। চাইব, তুই যাতে মরে যাস।’

সেদিন বিকেলে ওর দাদী মাইগ্রেনের ব্যথা নিয়ে নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর বাবার সাথে রেনাটা ওর মা আর বাচ্চাটাকে নিয়ে আসার জন্য হাসপাতাল রওনা হয়। ওদের শহরকে ঘিরে থাকা ঢেউখেলানো পাহাড়ের শরীরটা যেন আঙুরক্ষেত, ফলের বাগান আর গরু চড়ানোর মাঠের জোড়াতালি। হাসপাতালটা পাহাড়ের ওপরের শহরে, সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। ও শুনেছে যে দ্বীপটাতে ওরা থাকে, সেটা শ্যামল বনানী আর বহমান নদীসহ একসময় সবুজ ছিল। শুনেছে একমসময় সেখানে হাতীও নাকি ছিল, পাহাড়ের ওপর থেকে গর্জন করত ওগুলো। এখন সব শুকিয়ে গেছে, আগুন আর খরায় কালো ফ্যাকাশে ঘাস। এখানকার মানুষজন ছেলেবেলা থেকেই রোদের ভেতর কাজ করে, ওদের বুড়ো আঙুল আর হাতের তালুতে বেড়ে ওঠা কড়াগুলো সমুদ্রের ভেতর থেকে উঁচু অন্তরীপের মতো জেগে থাকে। দ্বীপটা ফুল ফোটা গিঁটওয়ালা ক্যাকটাসে ভরা। খচ্চরগুলো নুড়িবিছানো পথ ধরে বহু কষ্টে ওঠানামা করে। গর্তভরা রাস্তাগুলো লাল মাটির ওপর দিয়ে খ্যাপার মতো এঁকে বেঁকে চলে গেছে। বাইকে দুজন করে বসা ফুর্তিবাজ ছোকরাদের অতিক্রম করে যায় ওরা। ওদের ঝোলাভর্তি বাগান থেকে চুরি করে আনা ডুমুর আর কমলা। গাড়িটা তীক্ষè বাঁক নেওয়ার সময় ঝাঁকুনি খেলে ওর বাবা শেষ কোকাকোলাটুকু গলায় ঢেলে খালি ক্যানটা জানালা দিয়ে টুসকি মেরে বাইরে ফেলে দেন। তর্জনী আর বুড়ো আঙুলে ঘষা দিয়ে বাবা বলেন, ইচ্ছে করেই এরকম রাস্তা বানিয়েছে ওরা। যাতে বেশি মানুষের দুপয়সা আয় হয়।

এদিককার ল্যান্ডস্কেপ জুড়ে চোখে পড়ে অসমাপ্ত বাড়িঘর, ট্রাক্টর আর ছাগল। সবগুলো বাড়ি আধাখেচড়া রেখে দেওয়া হয়েছে-জানালার ফ্রেমগুলোতে কাচ লাগানো নেই, একপাশের দেয়াল না থাকায় রুমগুলো বাইরের মানুষের কাছে পুতুলের ঘরের মতো খোলা, পাইপগুলো উন্মুক্ত, ছাদের পুরোটায় টালি বসানো হয়নি, বিদ্যুৎ গিয়েছে বাড়ির অর্ধেক পর্যন্ত, জায়গায় জায়গায় লম্বা ঘাসের ভেতর থেকে মাথা বের করে আছে নির্মাণসামগ্রী আর জং ধরা লোহালক্কড়। বাবা বলেন, কারণ খুব সহজ। বাড়ি তৈরি শেষ হলেই কেবল বাড়ির ওপর ট্যাক্স দিতে হবে। যদি কখনোই তৈরির কাজ শেষ না হয়, তোমাকে ট্যাক্স দিতে হবে না।

একটা সেতুর নিচে বুকের লোম ঝলসানো গেঞ্জিপরা কিছু লোক মাংস সেঁকছিল। গ্রিলের মতো ব্যবহার করা লম্বা টিনের সিলিন্ডারের ভেতর দিয়ে ঢেউয়ের মতো বের হয়ে আসছিল ধোঁয়া। ছোটো ছোটো সূর্যের মতো দেখতে উপচে পড়া কমলা বাগান অতিক্রম করে যায় ওরা। আকাশ এত বিশাল যে মাঠের ওপর গম্বুজের মতো নেমে এসেছে। আগুন-লাল আসল সূর্যটা ডিমের ভাঙা কুসুমের মতো বাতাবরণ পেরিয়ে চলকে পড়ছে যেন।

একসময় শহরটা দৃষ্টিসীমায় আসে। ওটাকে ঘিরে থাকা ভেঙে পড়া বাড়িগুলো ধূসর ও জমাট বাঁধা, যদিও অনেক আগে তৈরি নয় ওগুলো। দূর থেকে পাহাড়টাকে দেবদূতের মতো রাজার মাথা বলে মনে হয়, শহরটা যেন তার কংক্রীট মুকুট, আর ওটাকে ঘিরে থাকা ধোঁয়া ও কুয়াশা যেন তার নোংরা বর্ণবলয়। শহরের ঠিক বাইরের উপত্যকায় ভেঙে পড়া মার্বেল পাথরের থামগুলো লাল ধূলোর ভেতর থেকে ভাঙা দাঁতের মতো বের হয়ে আছে। স্কুলে থাকতে ওরা বলত, এগুলো ছিল অন্য দুনিয়ার মন্দির, তাই আমাদেরগুলোর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আদিম মানুষেরা সমুদ্র থেকে উঠে এসে এসব মন্দির তৈরি করেছিল দুষ্ট দেবতাদের বর্ম হিসেবে। সেসব মন্দিরের ভেতর পশুবলি দিত ওরা, কখনো শিশুবলিও। এখন লোকজন ঠেলাগাড়ি নিয়ে এসে সেগুলো থেকে খণ্ড খণ্ড অংশ কেটে নিয়ে যায় বাড়ি বানানোর জন্য। একবার বাবা ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে। উপত্যকাজুড়ে ছিল কাঠবাদাম গাছ, মাংশল আবরণটা দুভাগ করে ভেতরে দুধের মতো শাঁস দেখাবার জন্য ওর জন্য একটা কাঁচা বাদাম ভেঙেছিলেন তিনি। ওর মনে আছে কালো পোশাকপরা কয়েকজন বুড়ি ধ্বংসস্তুপের মধ্যে উবু হয়ে লম্বা ঘাসের ভেতর থেকে কিসব যেন কুড়িয়ে নিচ্ছিল। খালি বোতল, ব্যবহৃত কনডম, ন্যাপকিন, চিনির খালি প্যাকেট-এসবের ভেতর তন্নতন্ন করে খুঁজছিল ওরা। স্টুর সাথে রান্না করার জন্য তুলে নিচ্ছিল বুনো মৌরির পাতা আর তেতো চিকোরি [একধরনের ভোজ্য উদ্ভিদ— অনুবাদক]। একটা তুঁতগাছ দেখতে পায় ওরা, বাবা ওকে গাছটাতে তুলে দিয়েছিলেন। ও যখন তুঁতফল পাড়ছিল, সেগুলোর কিছু ফেটে গিয়ে লাল বেগনী রস বেয়ে পড়েছিল ওর হাতে আর জামায়। নেমে আসার পর বুঝতে পারে হাতের চামড়া ছড়ে গেছে। রক্ত আর ফলের রসে মাখামাখি হয়ে কোনটা কি বোঝা যাচ্ছিল না। মনে আছে মন্দিরগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে ছিল রাজ্যের আবর্জনা: বাতিল কার্ডবোর্ড, স্টাইরোফোমের ফালি, খালি সিগারেটের প্যাকেট, বিয়ারের বোতল, শিকনি মাখা টিস্যু, দলা পাকানো রশিদ, নোংরা ন্যাপকিন আর ছোটো ছোটো প্লাস্টিকের কাপ, টমেটো সসের খালি বোতল, মাখনের মতো হলুদ মার্জারিনের খালি কৌটো, ধর্মীয় লিফলেট, চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি। সেই স্মৃতিকে স্বপ্নের মতো লাগে ওর, ভাবে, আদৌ ওটা স্বপ্ন ছিল কি না। তবু ভালো যে সময় ওদের কতখানি আলাদা করে ফেলেছে তাতে কিছুই আসে যায় না, মানুষ সবসময় পেছনে প্রমাণ ফেলে আসে।

শহরের পেছনে গিয়ে পৃথিবীটা শেষ হয় যেন।

ধূসর কাঠামোর হাসপাতালটা বড়ো, চারপাশ ঘিরে পার্কিং লট। ওটার উঁচু টাওয়ারগুলোর মাথায় ঘিরে আছে মেঘ। সরু করে চেরা লম্বা জানালাগুলো মধ্যযুগীয়। সামনে একটা গুমটি ঘর, সেখানে মাথায় টুপি আর সাসপেন্ডার পরা বয়স্ক লোকজন জড়ো হয়ে সিগারেট টেনে পাতলা ছোটো গ্লাসে ওয়াইন আর তেতো মদ খাচ্ছিল। হাসপাতালে ঢোকার মুখে ইনফরমেশন ডেস্কে যাওয়ার জন্য ওদের একটা ম্যাপ ধরিয়ে দেওয়া হলো। ম্যাপ ধরে কয়েকটা করিডর পেরিয়ে গেলে একপ্রস্ত সিঁড়ি বেয়ে উঠে পৌঁছানো যায় আর একগুচ্ছ করিডরে। ইনফরমেশন ডেস্কে পৌঁছার পর প্রসূতি ওয়ার্ডে যাওয়ার জন্য আরেকটা ম্যাপ দেওয়া হয় ওদের। এই ম্যাপ ধরে ওরা আবার মূল ঢোকার মুখে গিয়ে পৌঁছে, সেখান থেকে আরেক প্রস্ত সিঁড়ি ভাঙতে হয়। ওটা বেয়ে উঠলে আবার একগুচ্ছ করিডর, সেখান থেকে তিন প্রস্ত সিঁড়ি বেয়ে নিচে। ফায়ার এক্সিট খুলে আরেকটা করিডরে পৌঁছে ওরা, ওটা ধরে এগিয়ে গেলে একটা বাগান আর বিড়ালদের ঘর পেরিয়ে দশ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নামতে হয়। জানালাবিহীন প্রসূতি ওয়ার্ডে ঢোকার মুখে টিকিট মেশিন থেকে নম্বর নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। ভেতরে বেশ জটলা দেখা যায়। নারী পুরুষ ছোটো ছোটো দলে দাঁড়িয়ে, কোথাও গাদাগাদি করে বসে আছে মেঝের ওপর। ওদের ভেতর দিয়ে বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করে খেলছিল, ডাকাডাকি করছিল একজন আরেকজনকে। এক বুড়ি ওর চারপাশ ঘিরে জড়ো হওয়া ঘ্যানঘ্যান করা বাচ্চাদের জন্য একটা পোর্টেবল গ্রিলে পুর দেওয়া বেগুন সেঁকে সেগুলো গুঁজে দিচ্ছিল দুই ফালি পাউরুটির মধ্যে। দাঁতের মধ্যে সিগারেট কামড়ে ধরে দুই লোক তাস পেটাচ্ছিল বসে। এক মহিলা নখ কাটছে, অন্যেরা ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টায়, কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে। একটা মেয়ে পুরো জায়গাটার মধ্যে জাল টানার মতো ঘুরে ঘুরে ক্রেতা খুঁজে টিস্যুর প্যাকেট, ন্যাতানো গোলাপ, সিগারেট লাইটার, হ্যান্ড সেনিটাইজার-এসব ফেরি করে বেড়ায়। নম্বর দেওয়া টিকিটগুলো লোকজনের হাতের মুঠোয় কিংবা দুই ঠোঁটের মধ্যে ধরা। একটা ছোটো পর্দায় নিঃশব্দে নম্বরগুলো কিছুক্ষণ পরপর ভেসে ওঠে, ওটা ঘিরে দাঁড়িয়ে লক্ষ রাখছিল এক দল মানুষ, পর্দার আলোয় ওদের চেহারা নীলচে আভায় ছোপানো।

কিছুক্ষণ পর ওদের নম্বর ভেসে ওঠে। দ্রুত পায়ে একটা বড়ো ঘরে গিয়ে ঢোকে ওরা, সেখানে ডেস্কের পেছনে এক মহিলা ঝনঝন শব্দে পাশে রাখা লম্বা ফাইল ক্যাবিনেট খোলে। ওটার ভেতর থেকে মায়ের রুমে যাওয়ার আরেকটা ম্যাপ বের করে বাবার হাতে ধরিয়ে দেয় মহিলাটি।

কিছুক্ষণ পর ওদের নম্বর ভেসে ওঠে। দ্রুত পায়ে একটা বড়ো ঘরে গিয়ে ঢোকে ওরা, সেখানে ডেস্কের পেছনে এক মহিলা ঝনঝন শব্দে পাশে রাখা লম্বা ফাইল ক্যাবিনেট খোলে। ওটার ভেতর থেকে মায়ের রুমে যাওয়ার আরেকটা ম্যাপ বের করে বাবার হাতে ধরিয়ে দেয় মহিলাটি। ম্যাপ ধরে বন্ধ দরজার সারির মধ্য দিয়ে একটা লম্বা করিডর ধরে যেতে হয় ওদের। বিভিন্ন দরজার পেছনে বাচ্চাদের কান্না আর মহিলাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। চারপাশে অ্যন্টিসেপটিকের গন্ধ। শেষপর্যন্ত করিডরের শেষ মাথায় মায়ের রুমে গিয়ে পৌঁছায় ওরা।

দরজা খুললে ওর মাকে দেখা যায়, লোহার খাটের ওপর উপুড় হয়ে বাচ্চাটার সাথে সোহাগে বকবক করছেন। হাসপাতালের গাউনে একটা হোঁতকা গাঙচিলের মতো দেখাচ্ছিল তাঁকে। পেটটা অর্ধেক বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো অদ্ভুত দেখায়। রেনাটা অবাক হয়ে ভাবে, ওর মায়ের ভেতরের নাড়িভুঁড়ি যা-ই ছিল, সেগুলোর কী হবে এখন। ও কল্পনা করে, পেটটা এখন খালি, পুরোনো ফলের মতো পচে কালো হয়ে যাওয়া। দেখতে পায়, নাড়িভুঁড়ি কুঁচকে খুলে টুকরো হয়ে মিলেমিশে গেছে ওর মায়ের ভেতর।

বাচ্চাটাকে রেনাটার হাতে জোর করে ধরিয়ে দেওয়া হয়। চাপাচাপিতে বিকৃত, বিরক্ত ও ক্লান্ত মনে হলো ওটাকে, যে দুনিয়ায় নিজেকে দেখছে, তার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। বাচ্চাটাকে এখনো মানুষের মতো মনে হচ্ছে না। অতিরিক্ত চাপে পিষ্ট, আর খুব নরম। বোঁটকা গন্ধওয়ালা ময়লা বিছানার চাদর, বাচ্চাটার গায়ের টকটক দুধের গন্ধ ভাল লাগে না। হঠাৎ করে বাচ্চাটার ওপর বমি করে দিতে ইচ্ছে করে ওর। মা কিন্তু বাচ্চাটাকে নিয়ে আচ্ছন্ন আর ঘুমঘুম চোখে খুশি। তাঁর শরীরের কোনো ধার নেই আর, বাচ্চাটার মতো আকৃতিহীন, আঠালো আর নরম। আচমকা মনে হয় যেন ও আর বাচ্চাটা খুব কাছাকাছি, যেন দুজনই গলে গিয়ে একত্রে মিশে মায়ের পেটের ভেতরে ছিল একসময়।

মা বলেন, ‘তুমি বাচ্চাটাকে ধরো। শিগগির তোমার নিজেরও হবে।’

কী যে বিরক্তিকর মনে হয় ওর।

ওরা যখন গাড়িতে কোনোরকমে ঠাসাঠাসি করে বসে বাড়ির পথে রওনা হয় তখন আকাশ বেগনিলাল, উপত্যকার ওপর দিয়ে ঠান্ডা একটা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চাটাকে বুকের কাছে জড়ো করে ধরে মা পেছনের সিটে বসা, বাচ্চাটা যেন মায়ের বিচ্ছিন্ন করা হাত কিংবা কেটে নেওয়া শরীরের অন্য কোনো অংশ, বিচ্ছিন্ন হলেও কোনোভাবেই যেন তাঁর শরীরের হাড়-মাংসের বাইরে নয়। খুব দ্রুত শহর থেকে বের হয়ে জঙ্গল আর কৃষিজমির মধ্য দিয়ে ছুটতে থাকে গাড়ি, আঁকাবাঁকা রাস্তায় তীক্ষ্ণ বাঁকগুলোতে হঠাৎ করে মোড় নিচ্ছিলেন বাবা। স্টিয়ারিং ধরা হাতের আঙুলের গিঁটের ওপর তাঁর চামড়া আঁটো হয়ে বসা, রিয়ার ভিউ মিররে চকিতে তাকালে চোখে ফুটে উঠছিল উদ্বিগ্ন বুনো দৃষ্টি। অনেক দেরি হয়ে গেছে। আরো জোরে চালাতে তাগাদা দিচ্ছিলেন মা, বাচ্চাটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরতে চান তিনি, কাজে যাওয়ার জন্য ওর বাবাকেও কাল ভোরে উঠতে হবে।

অন্ধকার পথ, রাস্তার পাশের গাছগুলো আবছা ভুতের মতো দাঁড়িয়ে। লম্বা ছায়ার মতো একটা মূর্তি আচমকা রাস্তার ওপর উঠে আসে। একটা ছোটো প্রায় অষ্ফুট হাঁপানোর শব্দ করেন বাবা, তবে একইভাবে ছুটতে থাকেন সামনে। চোখ বন্ধ করে নিজের শরীর আঁকড়ে ধরে রেনাটা। গাড়িটা ধাক্কা খায়, ধপ করে ভয়ঙ্কর শব্দ হয় একটা। শিউরে উঠে চোখ খোলে ও। বাবা তখনো নির্বিকার চালিয়ে যাচ্ছেন। রাস্তাটা আবার মসৃণ। মনে হয়, সবাই যেন চিৎকার করছে, অথচ গাড়ির ভেতর সব চুপচাপ। খাবি খাওয়া মাছের মতো মুখটা হাঁ করে আবার বন্ধ করে ও। পেটের ভেতর সব কিছু উল্টে আসতে চাইলে দরজার হাতল চেপে ধরে। গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে, না কি জানালা দিয়ে বমি করতে চাইছে— বোঝা যায় না। বাবার দৃষ্টি সামনের রাস্তার ওপর স্থির, মা তখনো ঘুমন্ত বাচ্চাটার সাথে সোহাগে বকবক করছেন।

ছোটোবেলায় দেখা দুঃস্বপ্নের মতো হঠাৎ বাবা-মাকে দানবীয় মনে হয় ওর, স্বপ্নের ব্যাপারটা সবসময় ঘটত একটা বড়ো বাড়ির ভেতর। সেই বিশাল বাড়ির মধ্যে বাবা মাকে খুঁজত ও। যখন খুঁজে পেতো, দেখত ওঁরা ওর বাবা-মা নয়। সামান্য কিছু চোখে পড়া পার্থক্য ছাড়া দেখতে ওরা বাবা-মায়ের মতোই। যেমন, চোখের ভুরু খুব বেশি ছুঁচোলো, চোখের পাপড়িগুলো বেশ বড়ো, আর সেগুলোর গোল অংশে কালির ছোপ, অথবা দাঁতগুলো খুব ধারালো আর সাদা। দুজনেরই হাসি একই রকম বিশাল চওড়া। ছোটোবেলার সেইসব দুঃস্বপ্ন ছিল আগাম শঙ্কা, স্বপ্ন নয়— এমন ভাবনা এড়াতে পারত না ও। মনে হতো, বাবা-মার মতো দেখতে সেই লোকেরা ওর আসল বাবা-মাকে মেরে ফেলে ওদের চামড়া জামার মতো গায়ে পরে নিয়েছে।

খামারবাড়ি, নুড়িপাথরের রাস্তা, বেড়া দেওয়া জমি, আঙুরবাগানের পাতার চাঁদোয়া পেরিয়ে যায় ওরা। সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে রেনাটার কল্পনায় সেই মূর্তিটা আবার সামনে দেখা দেয়। চোখ বন্ধ করার আগে যা দেখেছিল সেটা কল্পনা করে ও: মূর্তিটা উল্টে পড়ে, তার ওপর দিয়ে চলে যায় গাড়িটা। ওটার শরীরের কিছু অংশ চাকার নিচে পিষে যায়, আর কিছু আটকে যায় গাড়ির নিচের কলকব্জার সাথে। আবার কল্পনা করে ও। সবখানেই রক্ত আর মাংস। মূর্তিটা লাফিয়ে রাস্তা থেকে সরে যায় আবার, এবার কেবল পা-টা থেঁতলে গেছে। তার পর আরো একবার। হামাগুড়ি দিয়ে সরে যায় ওটা। বার বার। ধাক্কা লাগার আগে হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তায় উঠে এসেছিল মূর্তিটা। যতই কল্পনা করে, ততই ছোটো হয়ে আসতে থাকে ওটা। মূর্তিটা চার পায়ের। গাড়ির ঝাঁকুনি লাগার কথাটা মনে মনে ভাবে ও। সেটাও এবার যেন ক্ষীন, মৃদু হয়ে আসে, একটা বড়ো পাথরকে ধাক্কা দিলে আর একটা ছোটো প্রাণী, যেমন একটা কুকুরকে দিলে যেমন হয়, সেরকম।

একটা কুকুর ওটা। রেনাটা বেশ ক্লান্ত। ক্লান্ত ওর বাবা-মাও। বাচ্চাটা ঘুমিয়েছে শেষপর্যন্ত। আরেকটা দিনের কাজের জন্য কাল ভোরে উঠবে বাবা। বাড়িতে দাদী ওদের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। ব্যস্ত একটা দিন গেল আজ। সত্যিই ওটা যদি কুকুর হতো, সহজ হয়ে যেত ব্যাপারটা। যদি মানুষও হয়ে থাকে, ওরা বোধহয় চিনতে পারেনি ওকে, ওর কোনো পাওনাও নেই ওদের কাছে। তবে কুকুরই ছিল ওটা। ব্যাপারটা এভাবে দেখতেই পছন্দ করে ও।


এমারিলিস গাচোপ্পো

এমারিলিস গাচোপ্পো

লেখক পরিচিতি :
ইতালিয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয় লেখিকা এমারিলিস গাচোপ্পোর জন্ম ১৯৯০ সালে। অস্ট্রেলিয়ার মনাশ এবং ইতালির বোলোন্যিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে যৌথভাবে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে পিএইচডি করে ইতালির ত্রিয়েস্তে বাস করে লেখালেখি করছেন তিনি। তাঁর গল্প ‘স্বপ্নগুলো’ ছোটোগল্প বিভাগে মেলবর্নের লর্ড মেয়র পুরস্কার লাভ করে ২০১৫ সালে। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা গদ্য নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে আসছে। তাঁর কিছু গল্প ব্রিস্টল শর্ট স্টোরি প্রাইজ, স্ক্রাইব ননফিকশন প্রাইজ, ওভারল্যান্ড স্টোরি ওয়াইন প্রাইজের হ্রস্বতালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। অ্যাওয়ার্ড উইনিং অস্ট্রেলিয়ান রাইটিং, গোইং ডাউন সুইংগিং, টু স্টোরিজ ল্যাডিজ এবং আরও বিভিন্ন জায়গায়ও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা। বর্তমানে ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য প্রথম পূর্ণাঙ্গ বই স্মৃতিকথা, ইতিহাস ও ভ্রমণকাহিনি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। মনাশ ইউনিভার্সিটিতে লিটারারি স্টাডিজ বিভাগে পড়ানোর পাশাপাশি মেলবর্নের ইমার্জিং রাইটার্স ফেস্টিভ্যাল পরিচালনা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লেখক সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি। ‘ইট ওয়াজ অ্যা ডগ’ নামের এই গল্পটি ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তারিখের গ্রাণ্টা ম্যাগাজিনের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়।

গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশের অনুমতি চেয়ে পাঠানো ইমেইলের জবাবে ১৮ জুন, ২০২১ তারিখের মেইলে সম্মতি জানিয়ে এই অনুবাদককে তিনি লেখেন, “‘ইট ওয়াজ অ্যা ডগ’ গল্পটা বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করার জন্য অবশ্যই সম্মতি আছে আমার।” (‘You of course have my consent to translate and publish ‘It Was a Dog’ in Bengali.’)

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ভ্রমণ লেখক, অর্থনীতি বিশ্লেষক ও অনুবাদক। অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত প্রথম গল্পের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে গল্পকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে। পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমে কর্পোরেট জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ২০০০ সালের প্রথম থেকে মুম্বাই প্রবাসকালে দৈনিক প্রথম আলোতে তাঁর লেখা ‘মুম্বাইর চিঠি’ শিরোনামের নিয়মিত কলামটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মূলত এই কলামটির মাধ্যমেই তাঁর ভ্রমণবিষয়ক লেখালেখির সূত্রপাত ঘটে। এযাবত প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে গল্পগ্রন্থ চারটি, অনুবাদ পাঁচটি, ভ্রমণ সাতটি, অর্থনীতি-ব্যাংকিং বিষয়ক গ্রন্থ চারটি এবং প্রবন্ধগ্রন্থ একটি। মার্কিন গবেষক ক্লিণ্টন বি সিলির লেখা জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যিক জীবনী ‘অ্যা পোয়েট অ্যাপার্ট’ গ্রন্থের সফল অনুবাদ ‘অনন্য জীবনানন্দ’ বইটির জন্য তিনি ‘আইএফআইসি ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার ২০১১’ এবং ভ্রমণসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালের বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।