শনিবার, এপ্রিল ২৭

সম্মোহিত সে পাথর, ঝরনার মতো : নাহিদ ধ্রুব

0

Motif-01নিয়তি
উত্তরাধিকার সূত্রে এইসব পাওয়া গেলে, হয়তো দোষ দিতে পারতেন আপনার পিতাকে কিন্তু স্রেফ গুজবের দিকে ঝুঁকে যদি বাস্তবতাকে আবিষ্কারের নেশা আপনাকে পায়, তবে মূলত দোষটা কার? প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য যখনই নামবেন পথে তখনই শুরু হবে ঝড়। এমনই হয়েছে চিরকাল। অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছ, বিশ্ব সংসারের ওপর রাগ করে অসংখ্যবার দুমড়িয়ে পড়েছে পথে। পাখিদের চঞ্চলতা দেখে আপনি হয়তো ধরে নেবেন এখন বর্ষাকাল। যদিও আপনার পৃথিবীতে তখন হয়তো বসন্ত চলছে, কোকিল ডাকছে কুহু, অচেনা রাখাল বেসুরো গলায় গাইছে রবীন্দ্রনাথের গান, ‘আহা আজি এ বসন্তে’। কিন্তু চারপাশে কোনো উজ্জ্বল ফুল না দেখে হয়তো সন্দেহ বেড়ে যাবে আপনার। এই সময়কে মনে হবে বড়ো দুঃসময়। তবুও আপনি হেঁটে যাবেন পাহাড়ের দিকে, কেননা পাহাড়ের দিকে হেঁটে যাওয়াই নিয়তি আপনার।

গুগল ম্যাপ ছিল তার সঙ্গী। আরও ছিল তুমুল বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি দেখে, আপনার সেদিনও মনে হয়েছিল এখন হয়তো বর্ষাকাল। ঋতু বিষয়ক জটিলতা নিয়ে আপনি যখনই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন বন্ধুদের দিকে তখন আপনার আরেক বন্ধু যার নাম হয়তো মেঘ, সে হেসেছিল হায়েনার মতো। দুঃখ পাওয়ার বদলে আপনি হয়তো অপমানিত বোধ করেছিলেন।

 

যাত্রা
বহুকাল আগে হয়তো আপনি এভাবেই হেঁটে গিয়েছিলেন পাহাড়ি পথ ধরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো এক নিষিদ্ধ ঝরনার সন্ধান পেয়ে, আপনি ও আপনার দুই বন্ধু হয়তো করেছিলেন ওই ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে, দাঁত কেলিয়ে একটি ছবি তোলার পরিকল্পনা। যৌবন আপনাদের দিয়েছিল প্রশ্রয়, আপনার এক বন্ধু যার নাম হিমালয়, যে পাহাড়কে মনে করত নিজের প্রজা, সে হয়তো আপনাকে দমকা হাওয়ার মতো দিয়েছিল উসকানি। পাহাড়ে চড়তে অপারগ আপনি, ক্ষুধার্ত কিংবা লোভী মাছের মতো গিলেছিলেন টোপ। এই জমানায় কে আর সংবরণ করতে পারে, দারুণ ছবির বিনিময়ে কয়েকটা লাইকের লোভ। ফলে, কোনো এক বসন্তের দিনে, আপনারা নেমে গিয়েছিলেন পথে। শুরুতে বাস জার্নি, তারপর চান্দের গাড়ি, পরে নৌকা, এরপর জনহীন কোনো এক জনপদে আপনাদের সঙ্গ দিয়েছিল এক পায়ে চলা পথ।

ওইখানে হয়তো ছিল না কোনো পাহাড়িদের পাড়া, থাকবার কথাও না, ছিল না আর্মির আগ বাড়ানো আঁতলামো, ছিল না জলপাই রঙের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা রক্তে রাঙা চোখ। আপনারা হেঁটে যাচ্ছিলেন আপন মনে, ঝোপঝাড় পিছে ফেলে, ঝিরি পথ ধরে। কমান্ডিং অফিসারের মতো আপনার বন্ধু, যার নাম হিমালয়, সে হয়তো দিয়ে যাচ্ছিল লিড। গুগল ম্যাপ ছিল তার সঙ্গী। আরও ছিল তুমুল বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি দেখে, আপনার সেদিনও মনে হয়েছিল এখন হয়তো বর্ষাকাল। ঋতু বিষয়ক জটিলতা নিয়ে আপনি যখনই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন বন্ধুদের দিকে তখন আপনার আরেক বন্ধু যার নাম হয়তো মেঘ, সে হেসেছিল হায়েনার মতো। দুঃখ পাওয়ার বদলে আপনি হয়তো অপমানিত বোধ করেছিলেন। যদিও আপনি জানতেন, এই পাহাড়ে, আপনার মতো আনাড়ি কারো প্রতিবাদ করা চলে না, ফলে আপনি সব অপমান হজম করে অপেক্ষায় ছিলেন মোক্ষম সুযোগের, অপমান সুদে আসলে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।

 

পাহাড়ের চূড়া
হাঁটতে হাঁটতে যখন আপনারা ক্লান্ত, যখন শুকনো খাবার শুকিয়ে যাচ্ছিল আরও, আপনারা হয়তো তখন একটি গুহার সামনে ঘুমিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গুহার ভেতর থেকে যেকোনো মুহূর্তে বেরিয়ে আসতে পারে বাঘ, এই ভয়ে আপনি জেগেছিলেন সারা রাত আর আকাশের দিকে তাকিয়ে, নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে আপনার হয়তো মনে হয়েছিল, এ যাত্রা শেষ করে ঘরে ফিরে গেলে, আপনি আর কখনো হবেন না এ মুখো। এভাবে হয়েছিল সকাল, অবিকল স্বপ্নের মতো সুন্দর। এমন এক সকালের সামনে দাঁড়িয়ে আপনি ভুলে গিয়েছিলেন আপনার পরিচয়। হাবাগোবা ছেলেটা হয়তো তখন হয়ে উঠেছিল দুখু মিয়ার মতো চঞ্চল। ফলে, আপনিই দখল করেছিলেন হিমালয়ের স্থান এবং গুগল ম্যাপকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হেঁটেছিলেন নিজের ইচ্ছেমতো। কিন্তু, পাহাড় তো আদিম দেবতা, চাইলেই তৈরি করতে পারে অদ্ভুত গোলকধাঁধা। আপনারা নিজ গুণে হয়তো পা দিয়েছিলেন পাহাড়ের ফাঁদে। যখন ঝরনার খোঁজে আপনাদের নিচে নেমে যাওয়ার কথা, তখন হয়তো আপনারা উঠে যাচ্ছিলেন আরও উঁচুতে। পাহাড় হয়তো পেয়েছিল ‘থ্রি ম্যান ইন অ্যা বোট’ বইয়ে গোলকধাঁধার পাতা উলটানো পাঠকের মতো আনন্দ। সময় যখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়েছিল, তখন আপনারা হয়ে পড়েছিলেন নার্ভাস। কোথাও নেই ঝরনার দেখা, মোবাইল মরে গিয়েছিল তখন চার্জের অভাবে। ফলে, দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষের মতো আপনারা হয়ে পড়েছিলেন ঝড়ে আটকা পড়া পাল ছেঁড়া নৌকা। শুরু হয়েছিল বিবাদ। হিমালয় হয়তো আপনাকে ব্লেম করে দিয়েছিল অকথ্য ভাষায় গালাগাল। নির্বিকার আপনি তখন ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন গোলকধাঁধার ম্যাপ আবিষ্কারের জন্য আর আপনার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে মেঘ হয়তো দিয়েছিল, পাহাড়ের চূড়ায় উঠে যাওয়ার প্রস্তাব, কেননা পাহাড়ের চূড়া থেকে হয়তো পাওয়া যাবে কাঙ্ক্ষিত ঝরনার দেখা।

 

ব্ল্যাক পার্ল
এভাবেই হয়তো আপনারা পৌঁছে গিয়েছিলেন পাহাড়ের চূড়ায় এবং দেখতে পেয়েছিলেন সেখানে পড়ে আছে তিনটি আশ্চর্য কালো পাথর যেন ব্ল্যাক পার্ল। আপনাদের মনে পড়ে গিয়েছিল, ক্যাপ্টেন জ্যাক স্পারোর কিংবা দ্য কার্স অব ব্ল্যাক পার্ল সিনেমার কথা। আপনারা হেসেছিলেন হেলে দুলে। পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝরনার অস্তিত্ব উদ্ধারে ব্যর্থ হয়ে হয়তো আপনারা ভেবেছিলেন, এই ঝরনা আসলে পৃথিবীতেই নেই। আপনারা তখন পরিকল্পনা বদলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং ফিরে যাওয়ার আগে তিনটি পাথরে লিখে রেখেছিলেন আপনাদের নাম।

এই ঘটনার পর, বছর না ঘুরতেই কোনো এক অজানা কারণে, কাউকে কিছু না বলে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আপনার বন্ধু হিমালয় এবং তার স্মৃতি ভুলতে আপনি ও আপনার বন্ধু মেঘ হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন ওই পাহাড়ের চূড়ায় এবং আবিষ্কার করেছিলেন, বাকি দুটো পাথর যথাস্থানে থাকলেও হিমালয়ের নাম লেখা পাথরটি কোথাও নেই। আপনারা ব্যস্ত হয়ে হিমালয়ের নাম লেখা পাথরটি খুঁজে ব্যর্থ হয়ে অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন একে অন্যের দিকে এবং ফেরার আগে চেষ্টা করেছিলেন নিরাপদে সরিয়ে রাখতে নিজেদের নাম লেখা পাথরগুলো। কিন্তু, পাথরের আকাশ সমান ওজনের কাছে পরাস্ত হয়ে আপনারা বুঝেছিলেন, কোনো মানুষের পক্ষে এ পাথর পাহাড় থেকে ফেলে দেওয়া রীতিমতো অসম্ভব।

কিন্তু কেউ হয়তো ফেলে দিয়েছিল, নাহলে এ বয়সে মেঘ কেন মরে যাবে স্ট্রোক করে! ওই ঘটনার কয়েক বছর পরে, মেঘের মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে হয়তো আপনার মনে হয়েছিল এই কথা। মনে হয়েছিল এখনই যেতে হবে ওই পাহাড়ের চূড়ায় এবং যে করেই হোক আপনার নিজের নাম লেখা পাথরটিকে করতে হবে উদ্ধার।

হয়তো আপনার এবারের যাত্রা হবে আরও সহজ, হয়তো গাছেরা নিজ থেকে সরে গিয়ে তৈরি করে দেবে আপনার জন্য পথ এবং বৃষ্টিকে ভালোবেসে আপনি সহজেই পৌঁছে যাবেন পাহাড়ের চূড়ায় এবং দেখতে পাবেন কোথাও নেই মেঘ লেখা পাথর। আশঙ্কা এভাবে সত্যি হবে আপনি জানতেন, তবুও ভয়ে শুঁকনো পাতার মতো কেঁপে কেঁপে উঠবে আপনার শরীর। আপনি ব্যস্ত হয়ে নিজের নাম লেখা পাথরটি খুঁজতে চেষ্টা করবেন এবং দেখবেন পাথরটি ভাসছে শূন্যে।

 

লাস্ট সাপার
এই ভেবে কোনো এক বসন্তকালে আপনি হয়তো নেমে যাবেন পথে এবং বসন্তকালকে আপনার কাছে মনে হবে, বর্ষাকাল। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আকাশ ভেঙে নেমে আসবে বৃষ্টি, পিচ্ছিল হয়ে যাবে পথ। জোঁকেরা আক্রমণ করবে আপনাকে, সাপেরা জানাবে নিমন্ত্রণ, আপনি তবুও গোলকধাঁধার সূত্র মুখস্থ করতে করতে হেঁটে যাবেন আপনার লক্ষ্যের দিকে। হয়তো আপনার এবারের যাত্রা হবে আরও সহজ, হয়তো গাছেরা নিজ থেকে সরে গিয়ে তৈরি করে দেবে আপনার জন্য পথ এবং বৃষ্টিকে ভালোবেসে আপনি সহজেই পৌঁছে যাবেন পাহাড়ের চূড়ায় এবং দেখতে পাবেন কোথাও নেই মেঘ লেখা পাথর। আশঙ্কা এভাবে সত্যি হবে আপনি জানতেন, তবুও ভয়ে শুঁকনো পাতার মতো কেঁপে কেঁপে উঠবে আপনার শরীর। আপনি ব্যস্ত হয়ে নিজের নাম লেখা পাথরটি খুঁজতে চেষ্টা করবেন এবং দেখবেন পাথরটি ভাসছে শূন্যে। আপনার হয়তো মনে হবে, এসবই ভ্রম, অডিটরি হ্যালুসিনেশন, আপনি তাই শূন্যের দিকে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টা করবেন এবং উচ্চতা সম্পর্কে সচেতন হতে তাকাবেন নিচের দিকে আর দেখতে পাবেন অপূর্ব সে ঝরনা, যার খোঁজে আপনারা প্রথম এই পাহাড়ে এসেছিলেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২ ডিসেম্বর, ১৯৯১; বরিশাল। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতায় স্নাতক। পেশায় সাংবাদিক। প্রকাশিত বই : মৃত্যুর মতো বানোয়াট  [কবিতা; ২০১৭] থাকে শুধু আলেয়া  [কবিতা;২০১৯], হিম বাতাসের জীবন  [গল্প ;২০২০], উদাসীনতা, সঙ্গে থেকো; [উপন্যাস; ২০২১] ই-মেইল : dhrubonahid@gmail.com

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।