শুক্রবার, এপ্রিল ২৬

হামিরউদ্দিন মিদ্যার রবিবারের ধারাবাহিক : ধুলোমাটির ভুবন | পর্ব-০২ | দু’চাকার বাহন

0

দু’চাকার বাহন


আমাদের গোয়ালঘরের মাচানের দিকে তাকালে একটা বহু পুরাতন জংধরা লজঝরে ভাঙাচোরা সাইকেল চোখে পড়বে। সাইকেলটির টায়ার, টিউব, মালগার্ডের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এখন আছে বলতে শুধু সাইকেলের কাঠামোটা। রঙটা উঠে গেলেও কোম্পানির স্ট্যাম্পটা এখনও উঠেনি। ব’এর সঙ্গে সাঁটা আছে একটা ছোট্ট গোল চাকতির মতো স্ট্যাম্প, তাতে দেখা যায় একটা মানব মূর্তি পৃথিবীটাকে হাতের তালুতে তুলে রেখেছে।

পাড়ায় ভাঙাচোরা কিনতে আসা ফেরিওয়ালা ঢুকলে মা কতবার ওই সাইকেলটি মাচান থেকে পেড়ে লোহালক্করের দামে বেচে দিতে চেয়েছে, কিন্তু আব্বা বেচতে দেয়নি। সাইকেলটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আব্বার অনেক স্মৃতি। আমারও ছোটোবেলার অনেক সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিল ওই সাইকেলটি।

তখন আমার দাদোর স্বচ্ছল অবস্থা ছিল না। এতগুলো ছেলেমেয়ে, তাদের খাওয়াতে পরাতেই হিমসিম খেয়ে গেছে। তার ওপর একটা সাইকেল কেনা, মানে এখনকার বাজারে একটা ঘোড়া কেনার সমান। গাঁ-গ্রামে তখন সাইকেলের এত চল থাকেনি। সবাই হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যেত। দাদো মাথায় করে ধানের বস্তা চাপিয়ে আট কিলোমিটার দূরে সোনামুখীর বাজারে বেচে দিয়ে ফিরতি পথে তেল, নুন, পেঁয়াজ, আলু কিনে আনত। দাদির জন্য আনত পান, সুপুরি, খয়ের, নারকেল তেলের ডিবা, কাপড় কাচার বাটি সাবান। যা শুনলে এখন গপ্পো মনে হয়।

বাজার গেলে রাস্তা ঘাটে ওই দু’চাকার যানটিকে দেখে দাদো হা-মুখ করে তাকিয়ে থাকত বিষ্ময়ে। তখনও আমাদের গ্রামে সাইকেল কেউ কেনেনি। গঞ্জে বগলাবাবুর হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে আমার আব্বারও ওই যানটিকে চাক্ষুষ দর্শন করার সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু কেনার কথা স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি। তারপর মল্লিক পাড়ার রবে দাদো যখন হঠাৎ করে একটা সাইকেল কিনে এনে গ্রামের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল, তখন সাইকেল নামক দু’চাকার যানটিকে সশরীরে ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়েছিল।

আব্বা ছিল রবে দাদোর খুব কাছ-ঘেঁষা। তুখোড় বুদ্ধির জন্য রবে দাদো খুব ভালোবাসত আব্বাকে। পরীক্ষা দিয়ে স্কুল থেকে যখন বাড়ি ফিরত আব্বা, রবে দাদো হেঁকে দাঁড় করাত, দেখি দেখি মিদ্দের ব্যাটা কেমন পরীক্ষা দিয়ে এলি।

প্রশ্নপত্র কেড়ে নিয়ে পথের মাঝেই চলত জেরা। শুনেছি আব্বা নাকি সব উত্তর ফটাফট দিয়ে দিত। আব্বার প্রতি ভালোলাগাটা ছিল সেখানেই।

আমাদের বাড়ি প্রায়ই আসত রবে দাদো। আমার দাদোর সঙ্গে চাষবাস, ব্যাবসা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করত। রবে দাদোই আব্বাকে ধরে ধরে সাইকেল চালানো শিখিয়েছিল। তারপর আব্বা সাইকেলটা নিয়ে কত যে হিল্লিদিল্লি ঘুরেছে! রবে দাদো কোথাও গেলেই ডেকে নিত আব্বাকে। ক্যারিয়ারে বসে থাকত রবে দাদো, আর আব্বা প্যাডেল করে টেনে নিয়ে যেত। আব্বার মনের ভেতর তখন যে কী উল্লাস!

এরপর গ্রামে আরও দু-তিনজন সাইকেল কিনল। দেখাদেখি আব্বাও খুব জেদ ধরল সাইকেল কেনার জন্য। অনেক কান্নাকাটির পর আব্বার ভাগ্যের শিঁকে একদিন ছিঁড়ল।

এরপর গ্রামে আরও দু-তিনজন সাইকেল কিনল। দেখাদেখি আব্বাও খুব জেদ ধরল সাইকেল কেনার জন্য। অনেক কান্নাকাটির পর আব্বার ভাগ্যের শিঁকে একদিন ছিঁড়ল। রবে দাদো আমার দাদোকে একদিন কথার প্রসঙ্গে বলে ফেলল, মিদ্দে তুমি এই বয়সে পায়ে হেঁটে আর কত ঘুরবে? হানিফকে একটা সাইকেল কিনে দাও। তুমারে লিয়ে এদিক সেদিক ঘুরবে। বিয়াই বিয়ানের সাথে দেখা করে আসবে। হাটবাজার যেখানেই যাও কত সুবিধে!

দাদো কী বুঝল কে জানে! সামনের আমনধানের চাষ উঠলেই ধান বেচার টাকা দিয়ে আব্বাকে একটা সাইকেল কিনে দিল। তাও যে সে কোম্পানির নয়। হারকিউলিস কোম্পানির! সাইকেলটি কেনা হয়েছিল সোনামুখীর বাজারে। গরুর গাড়িতে চেপে রবে দাদোর সঙ্গে আব্বা, মেজকাকা, ছোটো ফুফুও গিয়েছিল। মাটির ভাড়ে নয়ন সাহার দোকান থেকে রসগোল্লা এনে পাড়া-বাখুলের ছেলেপুলেদের বিলি করেছিল। নতুন সাইকেল কেনা হয়েছে বলে কথা!

সাইকেলটি কেনার পর দাদোর ব্যাবসার অনেক সুবিধা হয়ে গেল। ব্যাবসা বলতে গরু ব্যাবসা। দাদো আব্বাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ত কাহা কাহা মুল্লুকে। কোথায় জঙ্গল পেরিয়ে পাঁচাল, পশ্চিমে শুশুনিয়া পাহাড় লাগোয়া কত গ্রাম, শুলুকপাহাড়ির হাট, উত্তরে দামোদর পেরিয়ে ইলামবাজার পর্যন্ত। সারা সপ্তাহ ধরে গরু কেনা হলে, সব একসাথে চালান করত আশুড়িয়ার হাটে।

 

০২.
আমার রক্তেও সাইকেলের প্রতি নেশাটা কী করে যেন ঢুকে পড়ল। ওই দুই চাকার বাহনটির প্রতি আমার আকর্ষণ শিশুকাল থেকেই। আব্বা কোথাও যাবার জন্য সাইকেল বের করেছে তো, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল আমার কান্না। আমিও আব্বার সঙ্গে সাইকেলে চেপে যাবার জন্য বায়না ধরতাম। যতক্ষণ না আমাকে চাপাচ্ছে, কান্না থামত না। প্রতিদিন আমাকে সিটে বসিয়ে গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে যেতে হত। মা-ও পিছু পিছু যেত। তারপর ভুলিয়ে ভালিয়ে বাড়ি আনত।

পরে আমার বসার জন্য সামনের ব-এ একটা ছোটো সিট লাগানো হয়েছিল। আর দুটো পা-দানি। সব জায়গায় তো আর আমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। আব্বা তখন চাল ব্যাবসা করত। চাষিদের কাছ থেকে ধান কিনে সেগুলো বাড়িতে সেদ্ধ করে, হাস্কিং মেশিনে ভানিয়ে বাজারের কিছু দোকানে ও ঘরামী খদ্দেরকে বেচতে যেত। তখন মিলের চালের এত চল ছিল না।
সাইকেল নিয়ে আমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া ছিল খুবই কষ্টের। মায়ের মুখে শুনেছি, এক-দুইদিন এতই কাঁদতাম যে আমাকে সাইকেল থেকে টেনে নামানো যেত না। কাছাকাছি কোনো জায়গায় গেলে আমাকে নিয়ে যেত আব্বা। সোনামুখী, পখন্না, ধূলাই কতবার যে গেছি!

ওই দুই চাকার বাহনটিতে চাপার লোভেই নাকি জানি না, আমি ছিলাম মায়ের থেকেও বেশি ‘বাপ লাগাটে’। মানে আব্বা সঙ্গে থাকলে সারাদিন মাকে না দেখতে পেলেও আমার চলত। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে আব্বার কম মন কষাকষি হত! কখনও মায়ের কোল থেকে আমাকে ছিনিয়ে নেবার জন্য ক্রিংক্রিং করে সাইকেলের বেল বাজাত আব্বা। আমি বেলের আওয়াজ শুনেই ঝাঁপিয়ে মায়ের কোল থেকে নেমে ছুটে চলে যেতাম আব্বার কাছে। আব্বার মুখে তখন বিশ্ব জয়ের হাসি।

 

০৩.
যখন হাঁটতে চলতে শিখলাম, বড়ো হলাম একটু, ধীরে ধীরে চিনে নিচ্ছিলাম আমার চারপাশের জগৎটাকে।

আমাদের পাড়ার টুম্পাদি তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। গ্রামের স্কুল ছাড়িয়ে ভর্তি হয়েছে পাঁচ কিলোমিটার দূরে রামপুরের হাই ইস্কুলে। একটা ব’কাটা লেডিস সাইকেল নিয়ে সারা এলাকা চক্কর মারত টুম্পাদি। গোলাপি রঙের সাইকেলটায় চড়লে ফিতে দিয়ে বেনি বাঁধা চুলে টুম্পাদিকে কী সুন্দর যে মানাত! আমি তখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে টুম্পাদির সাইকেলটা দেখতাম। মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, কবে টুম্পাদির মতো বড়ো হব। কখন ক্লাস নাইনে উঠব। টুম্পাদির মতো আমারও একখান সাইকেল কবে হবে!

আমাদের বাখুলেই টুম্পাদির বাড়ি। পাড়ার ছোটো ছেলে বলতে তখন একমাত্র আমিই। স্কুল থেকে ফিরেই ব্যাগ থেকে বের করে আমাকে চকলেট দিত টুম্পাদি। আমিও যেন অপেক্ষা করে থাকতাম টুম্পাদির সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেলের আওয়াজটা শোনার জন্য।

এক দু’দিন বিকালে আমাকে পেছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে টুম্পাদি ঘুরিয়ে আনত মোষমরার চর, নামোপাড়ার ডিহি, করমচাঁদের খেয়াঘাট, পোড়াকুলের জঙ্গল। কখনও বাদার বাঁশবনের ভেতর দিয়ে সরু মোড়াম বেছানো পথ ধরে গ্রাম ছাড়িয়ে চলে যেত কুসুমডিহি, শিতলজোড়, মোলডাঙা, কলাবনী, পটাশপুর। সাঁইসাঁই করে সাইকেল ছুটাত টুম্পাদি। আর আমাকে মাঝেমধ্যেই সাবধান করে দিত, পাগুলো ফ্যারকাটা করে বস ভাই, শক্ত করে টিপে ধরবি আমাকে, কেমন?

এক দু’দিন বিকালে আমাকে পেছনের ক্যারিয়ারে বসিয়ে টুম্পাদি ঘুরিয়ে আনত মোষমরার চর, নামোপাড়ার ডিহি, করমচাঁদের খেয়াঘাট, পোড়াকুলের জঙ্গল। কখনও বাদার বাঁশবনের ভেতর দিয়ে সরু মোড়াম বেছানো পথ ধরে গ্রাম ছাড়িয়ে চলে যেত কুসুমডিহি, শিতলজোড়, মোলডাঙা, কলাবনী, পটাশপুর। সাঁইসাঁই করে সাইকেল ছুটাত টুম্পাদি। আর আমাকে মাঝেমধ্যেই সাবধান করে দিত, পাগুলো ফ্যারকাটা করে বস ভাই, শক্ত করে টিপে ধরবি আমাকে, কেমন?

আমি টুম্পাদির কোমর ধরে পা দু’টো চাকা থেকে দূরত্বে রাখতাম। কেন না, একবার আব্বার সঙ্গে নানাবাড়ি যাবার সময় চাকায় পা লেগে গোড়ালির মাংস উড়ে গেছিল। সেকি রক্ত! ভাগ্যিস জুতো ছিল পায়ে, নাহলে আরও বিপদ!

প্রতি রবিবার হারাই কাকাদের বাড়িতে ‘শক্তিমান’ দেখতে যেতাম। সাদাকালো টিভির স্ক্রিনে দেখা ওই সুপারম্যান কতরকম অলৌকিক কর্মসাধনই না করতে পারত! টুম্পাদির সাইকেলে চেপে যখন থেকে ঘুরতে লাগলাম, আমার সুপারম্যান বলো, সুপার হিরোইন বলো, সে ছিল টুম্পাদি। টুম্পাদি কী না পারে! টুম্পাদির সঙ্গে কোথাও বেরলে বুকটা তখন বেলুনের মতো ফুলে থাকত আমার। অচেনা পথঘাট, অচেনা গ্রামের ভেতর দিয়ে টুম্পাদির সাইকেলের পেছনে বসে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখা গেল রাস্তার ধারে বসে কতকগুলো চ্যাংড়া ছেলে হয়তো আড্ডা দিতে দিতে টোন-ট্রিটকারি করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সাইকেলের ব্রেক কষে রুখে দাঁড়াত টুম্পাদি, কী বললি হারামজাদা? বাপের ব্যাটা হয়েছিস তো সামনে এসে বল দেখি।

আমি ভয়ে ভয়ে বলতাম, পালিয়ে চলো টুম্পাদি।

টুম্পাদি পালিয়ে যাবার আগেই ছেলেছোকরার দল খেঁকশিয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে ফেলত। টুম্পাদির রুখে দাঁড়ানো দেখে একজন বলেছিল, মেয়ে তো নয়, যেন আগুনের ফুলকি!

পোড়াকুলের জঙ্গলে অনেক কাঁটা। চাকায় লিক হয়ে যাবে। অগত্যা রাস্তার পাশে সাইকেলটা দাঁড় করাল টুম্পাদি। এরপর ভেতরে প্রবেশ। শিঁয়াকুল, বনকুল পেঁকে পড়ে যাচ্ছে মাটিতে। প্রতিবছর গ্রীষ্মকালে কারা যেন আগুন ধরিয়ে দেয় জঙ্গলটায়। তাই এমন নাম। লপ লপ করে হাত বাড়িয়ে কুল তুলছে টুম্পাদি। কতক মুখে পুরছে, কতক কোঁচড়ে। আমার দুই প্যাকেটও কুলে ভর্তি করে দিল টুম্পাদি। তারপর সাইকেল নিয়ে আবার ফেরা। ফিরতে ফিরতে টুম্পাদি বলল, কুলগুলো কাউকে দিস না ভাই। সব কুল লুকিয়ে রেখে দিবি। কাল স্কুল থেকে ফিরে নুন-লঙ্কা গুড়ি করে খাব।

এরপর একটু শক্তপোক্ত হতেই টুম্পাদি একদিন বলল, সাইকেল চালানোটা এবার শিখে নে ভাই। হাই ইস্কুলে পড়তে যাবি কি পায়ে হেঁটে?

আমি ভ্যাবলার মতো দু’পাশে মাথা নাড়ি।

তাহলে?

আমার তো সাইকেল নাই। কার সাইকেল নিয়ে শিখব?

কেনে হাঁদারাম, আমারটা।

আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তা দেখে টুম্পাদি বলল, রবিবারে তো সারাদিন ঘরেই নামানো থাকে সাইকেলটা। তুই এখন ঠেলে ঠেলে কিছুদিন সাইকেলটা সোজা করে ধরে রাখতে শিখ তো। তারপর হাফপ্যাডেলে চালাতে শিখবি।

সাইকেল চালানোর হুবে নাওয়া-খাওয়া সব ভুলেই গেলাম। টুম্পাদির সাইকেল নিয়ে পাড়া, বাখুল ছাড়িয়ে গ্রামের স্কুলডাঙার মাঠে চলে যেতাম। প্রথম দুইদিন শুধুই ঠেলে ঠেলে হাঁটতাম। তারপর হাফ প্যাডেলে চেষ্টা করতে লাগলাম। একটা পা ব-এর ডানপাশে গলিয়ে আর একটা পা মাটিতে গেঁদে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে প্যাডেল করি। মাঝে মাঝে বাম পা-টিও প্যাডেলে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। টাল সামলাতে না পেরে ধপাস করে হেলে পড়ি।

টুম্পাদি একদিন আমাকে নিয়ে গেল পাখমারার ডাঙায়। ওখানে বড়োরা ফুটবল খেলে। পেছনের ক্যারিয়ারটা দুই হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে টুম্পাদি বলল, তুই প্যাডেল কর। কোনো ভয় নাই। পড়বি না।

আমি দুই পা প্যাডেলে তুলে সাইকেল চালাতাম, টুম্পাদি ধরে রাখত। আমার মনে সাহস জোগাত খুব। বলত, সাত কাছাড় না খেলে সাইকেল চালানো শিখতে পারবি না রে! এই দেখ আমার হাঁটুটা, —বলে পা-প্যান্ট গুটিয়ে আমাকে হাঁটুর কালচে দাগটা দেখাল টুম্পাদি, —বুঝলি ভাই, পুরো চামড়া উড়ে গেছিল। তুর তো এখনও একফোঁটা রক্তও মাটিতে পড়েনি।

আমি দুই পা প্যাডেলে তুলে সাইকেল চালাতাম, টুম্পাদি ধরে রাখত। আমার মনে সাহস জোগাত খুব। বলত, সাত কাছাড় না খেলে সাইকেল চালানো শিখতে পারবি না রে! এই দেখ আমার হাঁটুটা, —বলে পা-প্যান্ট গুটিয়ে আমাকে হাঁটুর কালচে দাগটা দেখাল টুম্পাদি, —বুঝলি ভাই, পুরো চামড়া উড়ে গেছিল। তুর তো এখনও একফোঁটা রক্তও মাটিতে পড়েনি।

এরপর একদিন টুম্পাদি কখন যে সাইকেলটা ছেড়ে দিয়েছিল আমি বুঝতে পারিনি। প্যাডেল করেই যাচ্ছি, করেই যাচ্ছি। ভাবছি টুম্পাদি তো সঙ্গে আছে, পেছনে ধরে আছে। আমি কিন্তু পড়িনি। অনেক দূর থেকে তখন টুম্পাদির হাত তালি শুনতে পেলাম। যখন বুঝতে পারলাম, কী যে উত্তেজনা!

যখন গ্রামের স্কুল ছাড়িয়ে হাই ইস্কুলে ভর্তি হলাম, টুম্পাদি তখন শ্বশুরবাড়ি। আমার ভাগ্যে জুটল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল। যে সাইকেলটি নিয়ে আমার হাতেখড়ি, যাকে নিয়ে আমি একদিন স্বপ্ন দেখতাম, সে-ই এলো আমার বাহন হয়ে। টুম্পাদি শ্বশুর বাড়ি চলে যাবার পর জমিরকাকা সাইকেলটি বেচে দিয়েছিল।

কয়েকটা চাল মিল চালু হয়ে যাওয়ার পর আব্বার ঘরামী চালের ব্যাবসাটা লাটে উঠল। আব্বা দিশেহারা। সেই পরিস্থিতিতে আমাকে একটা নতুন সাইকেল কিনে দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তাতে অবশ্য আমার কোনো মন খারাপ হয়নি। বরঞ্চ টুম্পাদির ব’কাটা লেডিস সাইকেলটি পেয়ে আমি গদগদ খুশি হয়েছিলাম।

আব্বা বলেছিল, এটা নিয়ে বছর দুই চালা। এরপর যখন বড়ো হবি। মাধ্যমিক পাশ করবি, তখন বাইশ ইঞ্চি একটা নতুন সাইকেল কিনে দেব।

ব’কাটা সাইকেলে সিটে চাপা খুব সহজ। আমি অল্প সময়েই সিটে বসে চালাতে শিখে গিয়েছিলাম। সাইকেল চালানোর লোভে স্কুল কামাই করতাম না।

মা বলল, সাইকেল নিয়েছিস, এবার তো তুর মামাদের বাড়ি একলাই ঘুরে আসতে পারিস খোকা।

আমার আর তর সইল না। সেদিন বিকালেই চলে গেলাম পশ্চিম নন্দরামপুর। আমি একাই আসতে পেরেছি জেনে মামা, মামি কী যে খুশি হলো! তারপর আমার কুটুমঘর যাওয়া লেগেই রইল। স্কুল ছুটি পড়লেই খালার বাড়ি, ফুপুর বাড়ি করে বেড়াতাম। আব্বার ওপর কোনো ভরসা করতে হচ্ছে না। নিজেই চলে যেতে পারছি যেখানে ইচ্ছে, কম ব্যাপার!

এখন আমার বাহন একটা বাইশ ইঞ্চি সাইকেল। সারাদিন সাইকেলটি কমপক্ষে চারঘন্টার সঙ্গী। সেই সেকেন্ড হ্যান্ড ব’কাটা সাইকেলটি এখন আর আমার কাছে নেই। এক ভাগ্নি নিয়ে গেছে।

হাটে-বাজারে, মাঠেঘাটে, বনেজঙ্গলে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। সময় সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ি। ব্যাগে নিই ছাতা, জল। কখনও সোনামুখীর সারা জঙ্গল চষে ফেলি। কখনও নৌকায় সাইকেল তুলে দামোদর পেরিয়ে চলে যাই। কত গ্রাম! কত মানুষ! কত রকমভাবে মানুষের বেঁচে থাকা! দুই চাকার আরোহী হয়ে এতবড়ো পৃথিবীর কতটুকুই বা আর জানতে পারি!


*অলংকরণে ব্যবহৃত ছবি হামিরউদ্দিন মিদ্যার তোলা


‘ধুলোমাটির ভুবন’ ধারাবাহিকের অন্যন্য পর্ব
প্রথম পর্ব : ঘরামী চালের ভাত


 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ 'আজরাইলের ডাক'। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন 'প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান'। ২০২১ সালে 'আজরাইলের ডাক' গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন 'দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান'। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।