রবিবার, এপ্রিল ২৮

টোকন ঠাকুরের ধারাবাহিক : জার্নি অব কাঁটা : পর্ব ২৮

0

নারিন্দার দিন হয়তো শেষ হয়ে আসছে তখন আমাদের কাঁটা টিমের জন্য। পুরান ঢাকার ভূতের গলিতে আমাদের বসবাসের সময়টা নয় মাস। কার্যত জায়গাটি শরৎগুপ্ত রোডে, যেখানে ছিলাম আমরা। যে বাড়ির বাড়িওয়ালা এই বাড়ি তৈরি করিয়ে সপরিবারে বসবাস করতেন, তাদের তো আমরা দেখিনি। দেশভাগের ঠিক আগে আগেই তিনি এই বাড়ি বিক্রি বা বিনিময় করে দিয়ে চলে যান কোলকাতায়। কোলকাতা থেকে সপরিবারে এই বাড়ি কিনে বা বিনিময়ে নিয়ে বসবাস করতেন মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন। তিনি ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকায় লিখতেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বৃটিশ ভারতীয় তরুণ হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল নাকি এই বাড়িতেও এসেছিলেন বা অতিথি ছিলেন কখনো। তবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই আমার কাছে। আবার মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের মেয়ে নুরজাহান বেগম সম্পাদনা করতেন সেকালের নারীদের কাছে খুবই গ্রহণযোগ্য পত্রিকা ‘বেগম’। নুরজাহান বেগমের স্বামী শিশুসাহিত্যিক জনাব রোকনুজ্জামান খান ওরফে দাদাভাই। দাদাভাই ছিলেন শিশুদের মানসিক বিকাশের সংগঠন ‘কচিকাঁচার আসর’ এর পরিচালক। দৈনিক ইত্তেফাক এর সাপোর্টে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা একদা কচিকাঁচার আসর’ এর অনেক অনুষ্ঠান হয়েছে এই বাড়িতে, যে বাড়িতে আমরা আছি তখন এবং কাঁটার সেন্ট্রাল লোকেশনও এই বাড়ি। আজ সেই দাদাভাই যেমন নেই, নুরজাহান বেগমও নেই। ‘সওগাত’ নেই, তবে নূরজাহান বেগমের বড়ো মেয়ে জনাবা ফ্লোরা আহমেদ সম্পাদনা করে চলেছেন ‘নূরজাহান’ পত্রিকাটি। যদিও বর্তমানে আর সেই জৌলুস নেই, এর চেয়ে অনেক ভালো ভালো সাময়িকী বা জার্নাল প্রকাশ হচ্ছে ঢাকা থেকে। তাই বলা যায়, যে ‘বেগম’ পত্রিকা একদিন সাড়ম্বরে বের হতো এই বাড়ি থেকেই, সেই পত্রিকা এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। পরিত্যক্ত রাজবাড়িতে ছিন্নমূল মানুষেরা যেমন হেগে রেখে যায়, সেই হাগা শুকিয়ে একদিন কটকটি হয়ে যায়, সেই দশাই আক্রান্ত আজ মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনের বাড়ি। ভাবা যায়, রাজবাড়িতে ঢুকতেই পারত না যে সাধারণ মানুষ, একদিন সেই রাজবাড়ি পরিত্যাক্ত হয়ে গেলে তার ভগ্নদশার বৈঠখানার ফ্লোরে হেগে রেখে যায় দুষ্টু পাড়ার ছেলেরা। সময় কেমন কত কিছু বদলে দেয় পৃথিবীতে!


p 28. 6

সন্ধ্যায় তুলসীতলায় প্রদীপ হাতে হেঁটে যাচ্ছে স্বপ্নারানী দাস


তবে নারিন্দা ছেড়ে আসার আগে ওই বাড়ির কিছু কিছু সিকোয়েন্স আমরা রি-শুট করতে থাকি। হয়তো আগের শুটে কিছু ভুলভ্রান্তি ছিল, কিছু দুর্বলতা ছিল। বাড়ির কবুতররা শেষ দিকে এসে যতটা মিশে গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে, প্রথম দিকে তো তা অতটা ছিল না। বাড়ির মহিলা বিড়াল মিসেস ডায়নাও আরও ঘনিষ্ট তখন আমাদের সঙ্গে। বিড়াল ও কবুতর যথেষ্ট সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও আমরা এক ফ্রেমে তাদের ধরতে চেয়েছি, ধরেছিও। এ ছাড়াও ১৯৮৯-৯০ সালে যে দম্পতি এই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হয়ে আসে, ঘরের কোনায় তখন আমরা দেখতে পাব একজোড়া ঘুঘু। ঘুঘুদের ডাক কেমন লাগে, শোনা যাবে কাঁটাতে। কথায় আছে না, ভিটেয় ঘুঘু চড়িয়ে দেবো? কার বাড়িতে? আজিজ ব্যাপারীর বাড়িতে? ১৯৭১ সালে যে দম্পতি ভাড়াটিয়া হয়ে এসছিল, তখন ঘরের কোনায় আমরা দেখতে পাব একটি সমুজ টিয়া। টিয়ার ডাক শোনা যাবে ছবিতে। এবং ১৯৬৪ সালের দম্পতিদের বসবাসের সময় আমরা দেখতে পাব একটি কালো ময়না। ময়নাও ডাকে। ময়না ডাকে, ‘কও তো পাখি স্বপ্না!’


p 28. 5

শুটিং দেখছে কাঁটার পাত্রপাত্রী ও টেকনিক্যাল টিম


কাঁটায় পাখিদের অংশগ্রহণ আছে। অংশগ্রহণ আছে বিড়ালের। সে এক স্ত্রী বিড়াল। বিড়ালিনী। ডায়না। ডায়না ছিলেন বৃটিশ রাজপরিবারের স্বাধীনচেতা সুন্দরি স্ত্রী। স্বামী-সন্তান ছিল, ছিল আলাদা বয়ফ্রেন্ড। আমাদের বিড়াল ডায়নার স্বামী আছে কি না জানি না, তবে এক বয়ফ্রেন্ডকে আমরা দেখেছি, শুটিংয়ের সময়েও তার আনাগোনা দেখেছি। এমন কি শুটিং থেকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে সে তার গার্লফ্রেন্ডকে। তখন আমরা বিপদে পড়েছি। শুটিং বন্ধ থেকেছে। এমন দিনও আমাদের ছিল, শুধু বিড়াল সেটে নেই বলে শুটিং হয়নি, হয়তো মানুষ-চরিত্র সেদিন সবাই ছিলেন। কিন্তু বিড়াল শিডিউল মেইন্টেইন না করাতে ক্যামেরা অন করা যায়নি। শুটিংয়ে কে যে কখন ফাঁসিয়ে দেয়, বলা মুশকিল। পাঁচশো মানুষ-চরিত্রের ভেতরে একটি বিড়াল। সব কিছু মেলানো তখন কত কঠিন ছিল আমাদের জন্য, আমরা তা মিলিয়েছিলাম। আমাদের খুবই কষ্ট করতে হয়েছে। অবশ্য এরকম একটি পিরিওডিক্যাল ছবি নির্মাণে নেমে কষ্ট হবে, সে তো আমরা জানিই। কাজেই কষ্ট কোনো বিষয় নয়, বিষয় হচ্ছে কাজ, আমরা কতটা নির্মাণ করতে পারছি, কতখানি সুনির্মাণ করতে পারছি, সেটাই লক্ষ করবে দর্শক। বাংলাদেশে পিরিওডিক্যাল ছবির ইতিহাসে এবং সর্বোপরি বাংলা ছবির ইতিহাসে কাঁটার জায়গা কোথায় হবে, সেই নির্ণয়ের দায়ভার সচেতন দর্শকের, সমালোচকের। আমরা শুধু আমাদের কাজটি করছি মনোযোগ দিয়ে।


p 28. 4

আজিজ ব্যাপারীকে মেকআপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে


নারিন্দা থেকে একবার আমরা আউটডোর করতে যাই মুন্সিগঞ্জে, পদ্মানদীতে। আউটডোর মানেই একটা আলাদা আনন্দ, আলাদা মজা। মনে আছে, সেই জার্নিতে ব্যাকগ্রাউন্ড টিমের বাইরে শুধু ক্যামেরার সামনেই ছিল ৩৭ জন পাত্রপাত্রী। আর টেকনিক্যাল টিমসহ সামগ্রিক টিম মেম্বর মিলিয়ে প্রায় ষাট জন মানুষ। একটি বড়ো বাস ভাড়া করেছিলাম আমরা। নারিন্দা থেকে যে যার মতো ফিরে যাওয়ার পর আমিও ফিরে যাই আমার মগবাজারের বাসায়। শুটিং তখনো বাকি ছিল কিছু। মগবাজার থেকে আবার একদিন আমরা মুন্সিগঞ্জ যাই দ্বিতীয় লট আউটডোর করতে। সেদিন ছিল টিমে প্রায় পঞ্চাশ জন। এ ছাড়াও মুন্সিগঞ্জের মালিরঅঙ্ক বাজারের স্থানীয় কিছু শ্রমিক ছিল আমাদের সেবারের শুটিংয়ে। স্থানীয় পালপাড়া থেকে রাধাকৃষ্ণের যুগল মুর্তি বানিয়েছিলাম এবং সেটা আগুনে পোড়ানো দৃশ্য ধারণ করা হয়। তখন ছিল শীতকাল। সকাল ৬ টায় খালি গায়ে নদীতে নামতে হলো পাত্রপাত্রীকে অর্থাৎ অনিমেষ ও তৃপ্তিকে। এমন শীত আর নদীর ভেতরে এত শীতার্ত বাতাস, কাঁপছিল ওরা দুজন। কাঁপারই কথা। যেখানে নদীতে না নেমেই আমরা জবুথবু হয়ে যাচ্ছিলাম। শট শেষে কিছু খড়বিচালি জ্বালিয়ে শীত কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছিল। এ সব এখন স্মৃতি। তখন তো প্রোডাকশনকালীন সময়। শীত-গ্রীষ্ম দেখার অবকাশ নেই। যেমন, সৈনিকদের তা দেখার সুযোগ থাকে না। থাকে না কৃষক-শ্রমিকের। আমরাও শ্রমিকের বাইরে কিছু নই, তাই আমাদের সেই কুয়াশা লাগা ভোরে সকাল পাঁচটায় কল ছিল গাড়িতে ওঠার। তার মানে যে যার মতো বাসা থেকে বেরিয়েছে ভোর ৪ টার মধ্যেই। একেই বলে শুটিং।


p 28. 3

চাঁদের আলোয় সুবোধ-স্বপ্না মরার প্রস্তুতি নিচ্ছে মনে হয়


মগবাজার থেকেও পুরান ঢাকায় গিয়ে শুট করতে হয়েছে আমাদের। অর্থাৎ আজিজ ব্যাপারীর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর যেহেতু শুটিং তখন হয়তো ১০ ভাগ বাকি ছিল, সেটা করতে হয়েছে মগবাজার থেকে পুরান ঢাকায় গিয়ে গিয়েই। পুরান ঢাকা ছেড়ে আসার পর তখন আবার পুরান ঢাকায় যাওয়া আসা করতে হচ্ছিল আমাদের। তখন হয়তো আমরা শুটিং করছিলাম সূত্রাপুর, ফরাসগঞ্জ, শ্যামবাজার, কাগজিটোলা, ঢালকান নগর, কালীচরণ সাহা স্ট্রিট, ধুপখোলা মাঠের পাশে, মামুর মাজারের মোড়ে, গেন্ডারিয়া বা ফরিদাবাদের দিকে। মিলব্যারাকের পেছনে দিকে বা হরিচরণ রায় স্ট্রিটে শুট করছি তখন। গেণ্ডারিয়া কবরস্তানে শুট করছি। সাধনার গলিতে কাজ করছি। সত্যি এক ছবিতে এতটা পুরান ঢাকার চেহারা আমি নিজেও দেখিনি কোনো ছবিতে কিন্তু করতে চেয়েছি। করেছি আমরা।

একটা মজার অভিজ্ঞতার কথা বলি। কাঁটার লাইন প্রডিউসার শুভর পরিচিত ছিল ফরাসগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ির এস আই মামুন। ওই পুলিশ ফাঁড়িটা ছিল এক পুরনো বিল্ডিং এবং কাঁটার লোকেশন উপযোগী। ১৬ ডিসেম্বর পুলিশ ফাঁড়িতে শুট ডেট পড়ল। আমরা ফাঁড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দিলাম। চার জন রাজাকার এলো মুক্তিগো খোঁজে, তারা পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো দেখেও নক করল। একজন মাঝবয়সী মহিলা বের হয়ে এলেন। রাজাকার তাকে প্রশ্ন করে, ‘আপ্নাগো এই মহল্লায় কেডা কেডা মুক্তিগো খাতায় নাম লেখাইছে, কইতে পারেন?’


p 27. 9

পদ্মা নদীতে ড্রোন ওড়ানো হচ্ছে


মহিলা জানান, না, তিনি জানেন না। রাজাকাররা বিফল মনে লেফট রাইট লেইফ রাইট করতে করতে চলে যায়। এমন সময় ফরাসগঞ্জ ফাঁড়ির আরেকজন দারোগা দৌড়ে আসেন এবং চিৎকার করে বলেন, বিজয় দিবসে ফাঁড়িতে পাকিস্তানি পতাকা উড়তেছে, ব্যাপার কি?’ তার ভাবনা হয়েছে, ফরাসগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি কি আজ আবার পাকিস্তানিরা দখল করে নিল? ঘটনা কী? শুটিং হচ্ছে, এটা তিনি জানতেন না, তাই চিৎকার করে ফেলেছেন। আমরা হাসাহাসি করেছি। তখন সেই চিৎকার করা দারোগা এস আই মামুনের উপরে রাগারাগি শুরু করেন। আমরা বললাম, আরে ভাই, শুটিং তো।

‘তাই বলে পুলিশ ফাঁড়িতে?’

‘লোকেশন হিসেবে পছন্দ হলো তো।’

‘লোকেশন হিসেবে বঙ্গভবন পছন্দ হলে কী করবেন?’

‘বঙ্গভবনেই শুটিং করব।’

”শুটিং করতে দেবে আপনাদের?’

বলেছি, ‘প্রয়োজন হলে দেবে। প্রয়োজন আমার, আমি মেটাব না? আপনি থাকেন কোথায়?’

‘গেণ্ডারিয়া থানা কোয়ার্টারে।’

‘যদি ওই কোয়ার্টার লাগত আমার, তাহলে ওখানেই শুট করতে যেতাম। অনুমতি নিয়েই যেতাম। তবু প্রয়োজন মেটাতাম।’

প্রকৃতপ্রস্তাবে, লক্ষ কোটি দর্শকের পক্ষ থেকেই আমাকে যেতে হতো বা করতে হতো বা করতে হচ্ছে। দর্শক পারফেক্ট জিনিসটা পছন্দ করবে, কমতি হলে মেনে নেবে না, বলবে, ‘হয়নি’। আমি নিশ্চয়ই দর্শকের সামনে ‘হয়নি’ শুনতে কাঁটা করছি না! কখনো কখনো একটু আধটু অ্যাগ্রেসিভ হতে হয়েছে আমাকে। কাজের জন্য। কাজটাই তো আসল ব্যাপার।


কাঁটার ইংরেজি টাইপো-লোগো। ডিজাইন: দেওয়ান আতিকুর রহমান


সেই এপ্রিলের শুরুতে আমরা মগবাজার কাঁটা ক্যাম্প ছেড়ে আমরা নারিন্দায় এসেছিলাম। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাস আমরা এখানে থাকলাম। নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা, আনন্দ-বেদনার ভেতর দিয়ে আমরা কাঁটা শুট করেছি। ভূতের গলি ছেড়ে, শরৎগুপ্ত রোড ছেড়ে আমরা ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাচ্ছি যা যার ঠিকনায়। আমি যাচ্ছি মগবাজার। ৪ পিক আপ মালামাল নিয়ে নারিন্দা থেকে মগবাজার শিফট করলাম। পেছনে পড়ে রইল হাজার স্মৃতি। হয়তো মন খারাপ হচ্ছিল, তবু যেতেই তো হবে। নারিন্দার জীবন এক অদ্ভুত যাপন দিয়েছিল আমাদের। নারিন্দার স্মৃতি হয়তো কখনো বিস্মৃতিতে যাবে না। আবার ভবিষ্যৎ তো আমরা জানি না। কোন স্মৃতি এসে আগের কোন স্মৃতিকে মুছে দেবে, কেউই জানি না আমরা। হয়তো একটি জীবন রেখে এলাম আমরা পুরান ঢাকায়। প্রথম আমি পুরান ঢাকায় আবাসিক হয়েছিলাম ফরাসগঞ্জে, বসন্ত কুমার দাস রোডে, উলটিনগঞ্জ বুড়িগঙ্গার ধারে। তারপর আবাসিক হয়ে গেছি মগবাজার। মগবাজার বাসা নেয়াড় পর তখন রেল লাইনের পাশে ছিল কাঁটা ক্যাম্প। সেই ক্যাম্পে কয়েক মাস প্রিপ্রোডাকশন করে চলে আসি নারিন্দায়। নারিন্দায় কাঁটার প্রোডাকশন পিরিওড চলল। আবার ফিরে যাচ্ছি মগবাজার। পোস্ট প্রোডাকশন হবে নিকেতন বা ওই দিকে, যে দিকে আমি এতকাল ছিলাম এই শহরে। নারিন্দা থেকে বিদায় নিচ্ছি। বিদায় একটি মর্মান্তিক অনুভূতি। সেই অনুভূতির মুখোমুখি হলাম। কবুতরগুলো এক অ্যাসিস্টেনকে দিয়ে দিলাম। যেন বা একটি গেরিলা জীবন ছেড়ে প্রকাশ্য হতে যাচ্ছি আমরা। এরপর আর আমাদের আজিজ ব্যাপারীর বাড়ির উঠোনে একসঙ্গে বসে আড্ডা হবে না, খাওয়া দাওয়া হবে না। রাত জেগে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে গত শতাব্দীর সিক্সটিজের ওরকম ফ্লেভারে থাকা হবে না। টিম আর একসঙ্গে হতে পারবে না সহজে, তাও জানি। প্রাত্যহিকী আর আগের মতো থাকবে না। জীবনযাপন বদলে যাবে। তবে কাঁটার কাজ তো এখনো শেষ হয়নি। তখনো একটু আধটু আউটডোর বাকি। পুরান ঢাকায়ও কোনো কোনো সিকোয়েন্সের কিছুটা কাজ বাকি। আলটিমেটলি পোষ্ট প্রোডাকশন তো শুরু হবে এরপর। কিছু কি হারিয়ে ফেললাম নারিন্দার জীবনযাপন অবসানের ভেতর দিয়ে? সেই কিছু কি আর কোনোদিন খুঁজে পাব? গ্রীষ্ম, শরৎ, হেমন্ত, শীত পর্যন্ত ছিলাম আমরা নারিন্দা নামক এক ভূখণ্ডে, ঢাকা শহরেই।

এরপর কাঁটা সম্পাদনা, ডাবিংপর্ব। সাউন্ড, মিউজিক, গান বাজনা, অ্যানিমেশন, কালার কারেকশন, সাউন্ড মিক্সিং। তবেই না মানুষের সামনে উন্মোচিত হবে ছবিটি। জার্নি অব কাঁটার এই পর্বে আমরা কাঁটার লোগো প্রকাশ করলাম।

‘কাঁটা’র লোগো চূড়ান্ত, উন্মোচিত হলো। ছবির শুটিংয়ের আগেই ভাবনা ছিল— কী রকম হতে পারে এ গল্পের টাইপো-লোগো? তখন অবশ্য ভাবতাম, মানুষের শরীরের হাড় দিয়ে বানানো বর্ণমালায় লেখা হবে কাঁটা। তাছাড়া স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের বাংলা হরফ তো হতেই হবে, আরও ভেবেছি যে, নামলিপির মধ্যেই ছবির ঐতিহাসিক পটভূমি যেন উঁকি দেয়। স্মর্তব্য, কাঁটা, ইটস নট অ্যা ফিল্ম, ইটস ট্র্যাজেডি। এটা একটা পিরিওডিক্যাল জার্নি।


kaanta logo bangla 2

কাঁটার বাংলা টাইপো-লোগো। ডিজাইন : দেওয়ান আতিকুর রহমান


বাংলা কথাসাহিত্যের খুবই শক্তিমান রূপকার শহীদুল জহিরের ‘কাঁটা’ গল্পটি রচিত ১৯৯৫ সালে। প্রথমে গল্পের নাম ছিল ‘মনোজগতের কাঁটা’। পরে জনাব জহির শুধু ‘কাঁটা’ নামেই সামাজিক এ আখ্যানের নামকরণ করে যান। অকৃতদার শহীদুল জহির আকস্মিক মারা যান ২০০৮ সালে। এখন ২০২৩ সমাপনীতে পৌঁছেছে। ‘কাঁটা’র পোস্ট-লেভেলের কাজ চলছে। এবং দর্শক ছবিটি আর কিছু দিন পরই দেখতে পাবেন—এ কথা এখন বলা যায়। দেরি যা হলো, তার কিছু কারণের প্রধান একটি কারণ বাজেট। মনে রাখা দরকার, আমি তো কোনো কালাবাজারি বা ব্যবসায়ী প্রযোজক কেউ নই, কবিতা লিখিয়ে প্রয়োজক। এরকম একটি ব্যয়বহুল ছবির প্রযোজনা সহজ কিছু নয়। আমার কি অঢেল টাকা আছে? না। তাইলে? তাইলে কি? ছবি বানাব না? আমার ইচ্ছাতে আমি ছবি বানাব। আপনার ইচ্ছাই আপনি দেখবেন বা দেখবেন না, তাই তো? আমার কাজটা আমাকে করতে দেন। যারা আমাকে ফান্ডিং সাপোর্ট করেছেন, এ ব্যাপারে তাদের কোনো প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন নেই কাঁটা টিমেরও, কারণ, তারা বাস্তবতাটা জানে। প্রশ্ন কিছু আছে যারা পত্রিকার বিনোদন খবর পড়ে সিনেমার খবর রাখতে চান, আর বিনে পয়সায় ইউটিউব দেখতে চান। তবে কথা এখন ওদিকে না, কথা হবে লোগো নিয়ে।

বলেছি, শুরু থেকেই এ ছবির লোগো নিয়ে ভাবনা ছিল। সচরাচর আমার লেখা বইগুলোর প্রচ্ছদ বেশিরভাগ করেছেন ধ্রুব এষ। তবে প্রথম বইটার প্রচ্ছদ ও টাইপো ছিল কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকানো। সব্যসাচী হাজরার করা ছিল দুই তিনটা বইয়ের প্রচ্ছদ ও টাইপো ডিজাইন। দিনে দিনে ডিজাইনে ম্যানুয়াল পিরিয়ড পেরিয়ে এখন আমরা এসে পড়েছি একেবারে একটা ডিজিটাল পিরিয়ডে। আনিসুজ্জামান সোহেল কিংবা সব্যসাচী হাজরার লোগো-টাইপোতে দারুণ কিছু থাকে। মামুন হুসাইনের ডিজাইনেও নিজস্ব এক ছন্দ পরিস্ফুটিত হয়। মাসুক হেলাল, উত্তম সেন বা মোস্তাফিজ কারিগরের কাজও খেয়াল করি। শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাদের শিক্ষক ছিলেন, তাঁর টাইপোগ্রাফি বাংলা বর্ণমালার এক সম্পদ, একটা সংযোজন। শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য ফ্রি হ্যান্ড টাইপোতে করেছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ‘মেঘমল্লার’ ছবিটির লোগো। কী সুন্দর! এমন কি আমিও ফ্রি হ্যান্ড বাংলা টাইপোগ্রাফি করতে ভালোবাসি, নানান ক্ষেত্রে কিছু করেছিও। কিন্তু কাঁটা’র লোগো ফ্রি হ্যান্ড টাইপো না হোক, এটাই মাথার মধ্যে ক্রমশ গেঁথে গেল। ভাবতে ভাবতে একদিন একটা মশার কয়েল আমাকে ফর্মটা দৃশ্যমান করে দিল। কী চাচ্ছিলাম তবে লোগোতে? ঘূর্ণাবর্ত সময়ের চক্রাকার মাপঝোঁক সাপেক্ষে জ্যামিতিকভাবে আসুক? এবং চাচ্ছিলাম যে, নামলিপির মধ্যেই যেন ছবির ঐতিহাসিক পটভূমিটা হালকা উঁকি দেয়। আমার ছবি করিয়ে বন্ধুরাও ওদের ছবির নামের টাইপোতে দারুণ সচেতন। নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ টাইপোটি দেখলাম, দেখলাম মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’-এর টাইপো লোগো। স্বতন্ত্র প্রয়াস লক্ষণীয়।

একদা চারুকলা ইন্সটিটিউটের পড়িয়ে ছিলাম বলে এদেশের চিত্রশিল্পী সমাজের প্রায় সকলেই আমার বা আমাদের ঘরবাড়ি-উঠোনের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর মানুষ, এই অনুভব থাকেই সব সময়। আকস্মিক প্রয়াণের পর কবি অমিতাভ পাল স্মরণ সভার ডায়াসে দাঁড়িয়ে হঠাৎই একদিন দেওয়ান আতিকুর রহমানের টাইপোগ্রাফির দক্ষতা ও নতুনত্ব খেয়াল করলাম। পরে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে আতিকের সঙ্গে কাঁটার টাইপো-লোগো নিয়ে বিস্তারিত ভাবনা বিনিময় শুরু হলো এবং দিনে দিনে একাধিক লোগো তৈরি হতে লাগল। হয়তো এগারোতম ভার্সনে এসে মনে হলো, যা প্রয়োজন, তা এসে গেছে। কাঁটা ছবি নির্মাণে চারুকলার শিল্পী যুক্ত আছে ১০-১২ জন। টাইপো-লোগো ধরেই দেওয়ান আতিকুর রহমানও কাঁটা টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল। এই লগ্নে আতিককে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সাযুজ্য বজায় রেখে ছবির বাংলা ও ইংরেজি লোগোও চূড়ান্ত হলো। আতিকের করা কাঁটার লোগোর বাংলা ভার্সনে একটুখানি আমার ফ্রিহ্যান্ড টাইপোও ব্যবহৃত হলো, সে আতিকের আগ্রহের কারণেই।

দি সার্কেল অফ হেল্পলেসনেস, সেলফ রিপ্রোচ অ্যান্ড ডিলিউশন— কিংবা অসহায়ত্ব, আত্মগ্লানি ও বিভ্রান্তির চক্র—কাঁটা। কাঁটার মধ্যে তিনটি অধ্যায়। প্রথমত, ১৯৮৯-৯০ সাল বাস্তবতা, দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ বাস্তবতা এবং তৃতীয়ত, ১৯৬৪ সাল বাস্তবতা। ‘অতীত, বর্তমানের ভেতর দিয়ে ভবিষ্যতে প্রবিষ্ট হয়, কাঁটা ছবিতে ভবিষ্যৎ, বর্তমানের ভেতর দিয়ে অতীতে অনুপ্রবিষ্ট হবে’— এটাই অ্যাট অ্যা গ্লান্স কাঁটা। দারুণ ম্যাজিক্যাল স্টোরি।

ছবির নির্মাণ টিম মেম্বররা যে যার জায়গায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ক্যামেরার পেছনে এবং ক্যামেরার সামনে কাজ করেছেন প্রায় পাঁচশো মানুষ। অকৃত্রিমভাবে কিছু স্বজনের নেপথ্য অর্থনৈতিক সাপোর্টেই ব্যয়বহুল এই পিরিওডিক্যাল ছবিটি নির্মাণ সম্পন্নের দিকে এখন। সে-সব মানুষের কাছে অফুরন্ত কৃতজ্ঞতা আমার।

দেওয়ান আতিকুর রহমানের ডিজাইনে কাঁটার লোগো-টাইপো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হলো। এখন থেকে কাঁটা-কার্যক্রমে বাংলা ও ইংরেজি এই লোগোটিই ব্যবহৃত হবে। এবং অবশ্যই কিছু দিনের মধ্যে কাঁটা আপনার চোখের সামনে উন্মোচিত হবে।

অপেক্ষা শুধু আর কটা দিন। যদিও আমরা জানি, অপেক্ষা কষ্টকর, মধুরও।


আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ২য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৩য় পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৪র্থ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৫ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৬ষ্ঠ পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৭ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৮ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ৯ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা ১০ম পর্ব
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৭
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৮
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ১৯
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২০
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২১
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২২
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৩
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৪
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৫
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৬
আরও পড়ুন : জার্নি অব কাঁটা পর্ব ২৭


কাঁটা প্রোডাকশন ফটোগ্রাফি : হোসেইন আতাহার

 

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১ ডিসেম্বর, ১৯৭২, ঝিনাইদহ। বেড়ে ওঠা, বসবাস:  ঝিনাইদহ, মাগুরা, যশোর, খুলনা ও ঢাকা। একাডেমিক (সর্বশেষ) পড়ালেখা: চারুকলা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রন্থ প্রকাশনা: কবিতার বই কয়েকটি, গদ্যের বই কয়েকটি। সম্পাদিত গ্রন্থ: ২টি। ছবি নির্মাণ: ‘ব্ল্যাকআউট’ (২০০৬) আনরিলিজড। ‘রাজপুত্তুর’ (২০১৪), ‘কাঁটা’ (২০২৩) । পেশা: আর্ট-কালচার চষে বেড়ানো।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।