অনিশ্চিত শহরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সংশয়াচ্ছন্ন হেঁটে যাচ্ছে যে তরুণ, নিজেকে তার মনে হয় বিলের জলঘাস, তার অন্তর্গত রক্তের ভেতর ছুটে চলে বিপন্ন বিষ্ময়। করোটি ছেয়ে থাকে রং-বেরঙের ধূসর-কোমল ছবি। একেকটা শ্রেয়তর অন্ত্যমিলের খোঁজে ক্লাসের সময় পেরিয়ে যায় অগোচরে। লিখতে না পারা কোনো ইনসমনিয়াক চরিত্রের সাথে বসে সে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে যেকোনো রাত, কেবল পাতাদের গান শুনে। ভিনদেশী সিনেমায় বুঁদ হয়ে লিখে ফেলে খুনের এলিজি। অস্থিমজ্জাজুড়ে কেবল পৃথিবী গ্রহবাসী সজল বাতাস, পরবাসী মেঘের ভার। যাত্রা তার অতন্দ্র দূর কল্পলোকে।
সে বড়ো হয়ে ওঠে সমবয়সীদের চেয়ে আশঙ্কাজনক দ্রুততর। ওদের সমস্ত রসিকতাকে ভোজপুরি সিনেমার মতো মনে হয়। রুচিবোধ তাকে আহত করে। উপদেশের ভঙ্গিতে কথা বলতে আসে সারাদিন আতলামি করে সর্বসাকুল্যে তেরো নম্বর বেশি পাওয়া কোথাকার কোন অন্তঃসারশূন্য এক গতানুগতিক মাদারফাকার।
সে বড়ো হয়ে ওঠে সমবয়সীদের চেয়ে আশঙ্কাজনক দ্রুততর। ওদের সমস্ত রসিকতাকে ভোজপুরি সিনেমার মতো মনে হয়। রুচিবোধ তাকে আহত করে। উপদেশের ভঙ্গিতে কথা বলতে আসে সারাদিন আতলামি করে সর্বসাকুল্যে তেরো নম্বর বেশি পাওয়া কোথাকার কোন অন্তঃসারশূন্য এক গতানুগতিক মাদারফাকার। খুব বাজেভাবে আক্রমণ করতে ইচ্ছে হয় এদের। তখন মনে পড়ে রিলকের চিঠি, বুদ্ধের বাণী। দাঁতে দাঁত চেপে পার করে একেকটা মানিয়ে নিতে না পারা সময়ের দিন, ইন্দ্রিয়পরায়ণ রাত। মাঝেমধ্যে নিজেকে তার একটা ক্ষত বলে ভ্রম হয়, অবাঞ্ছিত। নিজের মুদ্রাদোষে কোনো বন্ধু হয় না তার। কোনো কোনো উৎসবের দিনে নিজেকে খুব বর্ধিতাংশ মনে হয়।
বাংলার অধ্যাপকের কবিতা পড়ানোর ধরন দেখলে বমি পায় প্রতিবার। প্রশ্ন করে ভীষণভাবে অপদস্থ হয়। মুখস্ত করে এসে উগড়ে দেয় রসায়নের জাহাজ খ্যাত লোকটি। জীববিদ্যা পড়ানো লোকটা যেন প্রচণ্ড যৌন হতাশায় কাতর। কারো কারো ক্লাসে মনে হয়, বাঞ্চোতটাকে এই মুহূর্তে ক্রসফায়ার করা উচিত। যারা প্রতিনিয়ত পুতে দেয় বৈষম্যের বীজ, কোমল হৃদয়ে করে যায় হিংসার চাষাবাদ— এদের শিক্ষকতা করার কোনো অধিকার নেই। ভাবনার পরক্ষণেই মনে পড়ে যেকোনো পরিস্থিতিতেই সে মৃত্যুদণ্ডের ঘোর বিরোধী। এত সব বঞ্চিত কীটের মাঝেও কেউ কেউ ধারণ করেছে যেন আলো ছড়ানোর ব্রত।
এমন তস্করতাপূর্ণ সময়ে, বিশ্বাস বিষয়ক যেকোনো প্রশ্নেই তার উত্তর থাকে নিরালম্ব সত্যের কাছাকাছি, ধোঁয়াশাচ্ছন্ন।
দুই
ভালোবাসায় কারো চোখ যদি খুব ঘন হয়ে যায়— যদি কেউ প্রত্যাশা করে অপ্রস্তুত তপ্তশ্বাস দিঘল চুলের অতীত— সে জেনে যায় মেঘে মেঘে ফুরিয়ে গেলে বেলা। কালেভদ্রে ভুলে যায় জ্ঞান ও বিশ্বাসের স্ববিরোধ, খুব ডুবে যাওয়ার শঙ্কা, ভাবাকুল চোখের তৃষ্ণা ও নিষ্ফল শ্রমের রাগিনি। ডাকার মতো ডাকতে জানে সে। পারস্পারিক চুক্তিভঙ্গ করে কারো সাথে চলে যায় গ্রহান্তর ইতিহাসের কলঙ্ক ভুলে। সহসা আদিম স্বতঃস্ফূর্ততায় নিজেদের উজার করে দেয় এক রাত্রিতে দেওয়া যায় যত। সে বোঝে আলোর অঞ্চল, স্ফুটমান ফুলের কলতান। মৌন নীলের ইশারায় জেগে ওঠে প্রাণ। এই বুঝি জলের অধিকার। জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে যেকোনো অসুখের দিনে হয়ে ওঠে পৃথিবীর অন্যতম নির্ভরযোগ্য আশ্রয় এবং মনে পড়ে এক সমান্তরাল অথবা অসমান্তরাল ক্ষত, যাতে তার হাত ছিল না কোনো।
তার উঠানে বসা চুলখোলা নদী। জ্যোৎস্নামোহিত নদীর খোপায় জড়ানো সুতীব্র লাল, শরীরী মনখারাপ। আকাঙ্ক্ষার ঝড় বয়ে আনে স্পর্শপ্রমাদ। আদিগন্ত কথার বিথার। ঘুমঘোরে কোন বনে ছায়ার উদ্ভাসন।
তিন
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার একাংশকে মনে হয় গাধা-বাছাই পদ্ধতি। একপাল টেপ রেকর্ডার প্রতিবছর কী এক উল্লাসে ফেঁটে পড়ে! তবু সে কিনে আনে সহায়ক বই। নিয়ম করে পড়ে পাণ্ডা প্রতিদিন আট কেজি বাঁশ খায়। বিদ্রোহী কবিতায় কতটি লাইন আছে মোট। যা-কিছু খাপছাড়া, অপ্রয়োজনীয়। ‘বিষে ভরা বীণ’ বলতে কবি ‘আসলে’ কী বুঝিয়েছেন। কার কাছে মজুদ আছে কতখানি বারুদ।
নিজেকে তার মনে হয় নব্য প্রতারক; যে এখনও বিদ্যাটা ঠিক রপ্ত করে উঠতে পারেনি। অপরিণত মন আচ্ছাদিত হয়ে থাকে অসহ্য বৈপরীত্যে। এর মাঝে পেয়ে যায় চূড়ান্ত প্রশ্রয়।
অনেকদিন পর বাড়ি ফিরলে তাঁরা পুত্রকে আদর করে খাওয়ায়। তার জিভে লেগে থাকে অমৃতসম প্রিয়তম মাংসের স্বাদ। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসায় এক পৃথিবীর ঘুম পায় তার। তখন অশেষ প্রজ্ঞাবান পিতা ও মাতা বহুবার বলা একটি নাতিদীর্ঘ গল্প পুত্রকে শোনায় পুনরায়।
চার
প্রথম তারুণ্যের প্রারাম্ভের অপরিণত ফাল্গুনে প্রকাশিত হয় তার প্রথম অ্যালবাম, মফস্বলের কোনো স্যাঁতসেঁতে মিলনায়তনে প্রথম চিত্র-প্রদর্শনী কিংবা ভীষণ অযত্নে প্রকাশিত হয় তার জীবন-পোঁড়া প্রথম পাণ্ডুলিপিটি। সাগ্রহে সে এসব দেখাতে চায় পিতা ও মাতাকে— যৌথ ঈশ্বর— যাঁরা তাকে দিয়েছে জীবন। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরলে তাঁরা পুত্রকে আদর করে খাওয়ায়। তার জিভে লেগে থাকে অমৃতসম প্রিয়তম মাংসের স্বাদ। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসায় এক পৃথিবীর ঘুম পায় তার। তখন অশেষ প্রজ্ঞাবান পিতা ও মাতা বহুবার বলা একটি নাতিদীর্ঘ গল্প পুত্রকে শোনায় পুনরায়। গল্পটা এরকম।
জীর্ণবস্ত্রা এক লোক গেছে ডাক্তারের কাছে। লোকটির পায়খানা হয় না দীর্ঘদিন। ডাক্তার ওষুধ দেয়। সপ্তাহখানেক পর লোকটি আসে এবং জানায় তার কোনো উন্নতি হয়নি ওষুধে। ডাক্তার বাড়িয়ে দেয় ওষুধের মাত্রা। সপ্তাহান্তে লোকটি পুনরায় এসে জানায় ওষুধের বিফলতার কথা। এবার ডাক্তার চিন্তায় পড়ে যায় এবং লোকটিকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে। যুবক ডাক্তার লোকটিকে একটা বিশ টাকার নোট দিয়ে রুটি কিনে খেতে বলে। তখনকার মতো লোকটি ফিরে যায় এবং সেদিন বিকেলেই লোকটি ফিরে আসে— জানায় কত সহস্র ঘন্টা পর তার পায়খানা হলো। ডাক্তারকে সে জানায় কৃতজ্ঞতা। যুবক ডাক্তার লোকটির পেশা জানতে চায়। লোকটি জানায় সে একজন চিত্রকর, গীতিকার, বংশীবাদ কিংবা একজন লেখক, কবি— একদা যার যাত্রা ছিল অতন্দ্র দূর কল্পলোক।
গল্পটি এটুকুই। তরুণটির ঘুম কেটে যায়। বহুদিন পর আবারও ভাবে এই মন, শরীর ও জীবনবোধ নিয়ে মনুষ্যচিত জীবন-যাপন সম্ভব কেবল দূর বিদেশে। তবু স্মৃতিতে লেগে থাকে নিথর শ্রাবণ, মধ্যনিশীথের নীল। অবয়বহীন ইশারা মোছে ভাষার গরিমা।
পাঁচ
অসীমে বসে কেউ হাসে, পাশা খেলে নিজেদের সাথে। ছক কষে কোনো অব্যর্থ শীতল ছায়াপাতের। যার দখলে সমস্ত নিজস্বনির্জনতা। সে জানে বৈষয়িক ইন্ধনে মায়ার শাশ্বতিক বিভ্রম কেটে যাবে একদিন। যারা জড়িয়েছিল এমন বন্ধনে, তারা জেনে যাবে অপূর্ণ মানুষেরাই ছিল অধিক বাস্তবিক। কিংবা এসব কাটে না কখনও, ক্রমশ ছেয়ে ফেলে ভীষণ গভীর। কোনো এক আদিভৌতিক বিপন্নতায় তারা চিরদিন সঁপে দেবে নিজেদের। হয়তো সব হারিয়ে যাবে ভুলে, আরোপিত ভ্রমে, অপমান-কৌতুকে। তবু আশাবাদিতার গানে গানে বুনে উঠবে অন্তঃপুরচারী স্বপ্নজাল।

জন্ম ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার নাটুয়ারপাড়া গ্রামে। পড়াশোনা করছেন ঢাকার সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে। লেখালেখি করেন; পাশাপাশি বন্ধুদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বিষয়ক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। স্বপ্ন দেখেন একদিন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করবেন।