জরুরি বৈঠকে স্বরধ্বনিপ্রধান
দীর্ঘ ঈ কীভাবে দিনদিন হ্রস্ব হয়ে যাচ্ছে আপনারা সে বিষয়ে অবগত আছেন। আমরা তার ঊরু ও জানু রক্ষায় তৎপর এবং কেশ ও কেশর ছিঁড়ে মানবতার মায়েরে বাপ করতে আরও তৎপর।
আপনারা জানেন হ্রস্ব উ রা আজকাল দীর্ঘ হতে চাইছে এবং এই গভীর ষড়যন্ত্রে সামিল করেছে ও এবং এ কে। বাদিগোলক নির্মূল কমিটি থেকে আমরা ঘোষণা করছি তাদের বিচি অর্থাৎ বীজের দোষ। ঋ এখন অনেকটাই বিলুপ্ত, কেননা সে ব্যঞ্জনত্ববাদী।
আমরা স্বরধ্বনিকে শীঘ্রই ব্যঞ্জনমুক্ত ঘোষণা করবো তারপর যাবে যৌগিক স্বরধ্বনি তারপর তার সহপাঠীরাও…
একসময় বাংলা বর্ণমালায় কেবল একটিই স্বরধ্বনি থাকবে, এই আমাদের প্রতিশ্রুতি।
দ্বৈরথ
আমার কোনো পাণ্ডুলিপি নেই, কিছু বিদীর্ণ দ্বৈরথ আছে।
ঘোড়াকে বলেছিলাম দিক নির্ণয় করতে, সে দৌড়ে গিয়ে থেমে গেল নেভারল্যান্ডে।
নেকড়ের সভায় আমি একা এক লণ্ঠন।
পুঁথিপাঠ হচ্ছে পাঠশালায়। মাংসের রন্ধনপ্রণালী আর ছিঁড়ে ফেলার প্রক্রিয়া পড়াতে পড়াতে ঘুমিয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ মাস্টার। ছাত্রদের কারো পড়ার টেবিলে আমার আঙুল, কারো ব্যাগে আমার ছিন্ন মাথা, আর কারো বুকপকেটে বলের মতো নড়ছে আমার মায়াকাজল চোখ।
অথচ আমার নিজেকে জীবন্ত মনে হচ্ছে যেন। খসে যাওয়া পায়ের দিকে তাকিয়েও মনে হচ্ছে আমি হাঁটছি হেমন্তবনে, কানে এখনও প্রবল ঘুঙুর, ঠোঁটে শের-ই গালিব; কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ।
কী অদ্ভুত বেতার সম্প্রচার!
আমার মৃত্যু হয়েছে
অথবা আমার মৃত্যু হয়নি
জানিয়ে দিতে যদি এইটুকু নিশ্চিত সংবাদ!
মায়াতাত্ত্বিক
প্রসব করেছো মায়া, অর্বাচীন আনন্দে।
তারপর অয়ি বৃক্ষ, কে তোমার ফল, কী তোমার বীজ! ধারণ করাই স্বভাব যদি ধরে রাখো পুষ্প, পত্র, জল।
অপেক্ষা করো শীতের। আর তারপর পুনরায় উৎসব হোক চিৎকারের। এইভাবে ঠিক— একা এক ঘ্রাণ ছুটে চলেছে সমাপ্তির দিকে। বিষাদই তার অঘ্রাণ, উঠছে আগুন ধান নিয়ত জমিন হতে। চরাচর পুড়িয়ে ঠায় একলা কৃষক গুনছে অন্তিম ফসল।
এমনকি শৈশব ফিনকি দিয়ে দেখাচ্ছে আতশবাজি সন্তাপের সন্তানগুলিও বৃদ্ধার ত্বকে বয়সের আর্তনাদ জ্বেলে রেখেছে মাতৃত্বের পর থেকে। শেষে মৃত্যুও সয়ে নেবে জাগতিক ছাই। হয়তো—
তবু কেন নবান্ন শরীর! উঠোনে মৃত নক্ষত্র নিয়ে পুঁথিপাঠে বসে রোজ যৌবনের জেব্রামাস্টার? কেন সে ভালোবাসে নিষিদ্ধের ঘোর!
খুনকাব্য
ঝরাপাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আমাকে খুন করে রেখে গেছে রোদ।
আমি তাকে নিষেধ করেছি স্বজনদের জানাতে। সে কথা রেখেছে। আমি মুচমুচে কুয়াশায় হেলান দিয়ে পাথর গুনছি একমনে। একজন বৃদ্ধ এসে বললেন, জানো নওরোজ, মানুষ ফুটবলের মতো। বেশি লাথি খেলে চুপসে যায়, আর লাথি না দিলে খেলাটা হয় না। আমি একটা প্রায় খসে পড়া পাতার দিকে নিবিড় তাকিয়ে থাকি।
তার কাছেই জানলাম, মানুষ এমন একটা খেলা যার কোনো নিয়ম থাকে না। নিয়ম না থাকলে খেলাও যুদ্ধ হয়ে যায়, আর মানুষ হয়ে যায় চেকমেট রাজা।
ঝরা পাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আমাকে খুন করে রেখে গেছে রোদ।
আমি কী গভীর প্রার্থনা! রোদের কোনো শাস্তি না হয় যেন!
শিকার-শিকারি সংবাদ
নিকোলাস, স্বরবৃত্তে বসে আছো নিজেকে ঘিরে।
হৈচৈ পাখিরা সব নিয়মের আড়াইঘর পেরিয়ে এইমাত্র ঘুমোলো।
এখন তুমি কী করবে! এসো বিছানা খেলি।
সকালবেলা সুব্রত শুনিয়েছিলেন এক আহামরি টোটকা, বাতাসকে বশে এনে নাকি বানানো যায় বৈধব্যেও বাহবা। আমি মানতে চাইনি। কিন্তু চা পান করতে গিয়ে যখন মারা গেল আমার নয়নতারা, বাগানবিলাস খেয়ে নিলো অজানা কোনো পোকায়, আমি জানলাম— সুব্রত একটা বাঘ ছিল আর আমি আস্তাবল। দৌড়ে ছুটে যেতে চাইলো লক্ষ লক্ষ ঘোড়া।
কিন্তু জানো নিকোলাস, জাগতিক দৌড়গুলি একটু কেমন যেন, রাস্তাগুলি হঠাৎ মাঠ হয়ে যায়, আর মাঠ বদলে গিয়ে হঠাৎই তরল আগুনে ঢেলে দেয় সমূহ দাবা ও দাবানল নেভানোর চেষ্টা।
নিকোলাস, রাত বাড়ছে। তোমার দধীচি হাড়ে বানালে যে বজ্র তার নিচে শুয়ে আছে বহুলোক, আর তুমি তলিয়ে যাচ্ছো তোমার নিজেরই তুমুল অতলে।
তোমাকে কে রাখে! রাখে ধরে!
তারচেয়ে এসো, ঘুম ঘুম খেলি, তোমার দেয়ালে গুম করে রাখি তোমার শরীর এবং প্রমাণ খুঁজি হন্যে হয়ে। গুপ্ত ঘাতক হয়ে একে অন্যের ঠিকানায় পাঠাই কামড় ও কালশিটে।

কবি
জন্ম একত্রিশ এ জুলাই নওগাঁর মহাদেবপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতোকত্তর।বর্তমানে ঢাকায় থাকেন। গ্লোরি কলেজে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত। প্রকাশিত কবিতার বই দুটি। কীর্তিনাশা (২০১৩) আর জলের জ্যামিতি (২০১৭)।