শুক্রবার, মার্চ ২৯

আমার কবি : শঙ্খ ঘোষ

0

Shangkha Ghosh 2বাংলা সাহিত্যে শঙ্খ ঘোষের অবদান অপরিসীম। ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘দিনগুলি রাতগুলি’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কাব্যগ্রন্থগুলি বাংলা সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। ‘বাবরের প্রার্থনা’ গ্রন্থের জন্য ১৯৭৭ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ২০১১ সালে তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত করা হয়। গত ২১ এপ্রিল ২০২১ প্রয়াত হন এই প্রবাদপ্রতীম কবি। রিমঝিম আহমেদের এই গদ্যের মাধ্যমে শ্রী ওয়েবম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে তাঁর স্মৃতির প্রতি রইল আমাদের অশেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি।


কাউকে যখন খুব মনে পড়ে, শুধু মনে পড়ে হয়তো নয়। ধরি, খুব মন কেমন করে, আমি তার সাথে যোগাযোগ করি না। চাইলেই কথা বলা যায়, অথচ কথা বলি না। এই ফোন আর ইন্টারনেটের দুনিয়ায় একটা ফোনকল, একটা দুটো শব্দ, অনেকটা দীর্ঘশ্বাস আমরা অনায়াসেই কুড়োতে পারি। কিন্তু আমি সেটা করি না।

কেন করি না?

আমি নিজের ভেতর ডুব দিই। সে মন কেমন করাকে পুষি। আর চিঠি লিখি। চিঠি অবশ্য সবসময় খাতা-কলমে লিখি তা নয়, মনে মনেই বেশি লিখি। মনে মনে লেখা একটা সহজ তরিকা। তাতে চিঠি প্রাপকের নীরবতা, অপমান হয়ে ফিরে আসে না।

এরকম ডুবে থাকার দিনে, আমার কবি মারা গেলেন। হ্যাঁ, আমারই কবি। না-হোক তাঁর সাথে নিত্যের আলাপ। না-থাক সীমালঙ্ঘনের আত্মীয়তা। অসীমের বেড়া ঠেলে আমি কত রাত্তির পার করেছি তার কবিতার অক্ষর, শব্দ-বাক্যের সাথে কথা বলে!

ঘুম ভেঙে টিভি খুলেই খবরটা পেলাম। এই যুগে কোনো দুঃসংবাদ বা সুসংবাদ কাঁটাতারে আটকে থাকে না। আমার দমবন্ধ লাগে। আমি চুপ করে যাই, এই কঠিন খবরটা আমি নীরবতা দিয়ে সহজপাচ্য করে তুলি।

নষ্ট হয়ে যায় প্রভু, নষ্ট হয়ে যায়!
ছিল, নেই— মাত্র এই, ইটের পাঁজায়
আগুন জ্বালায় রাত্রে দারুণ জ্বালায়
আর সব ধ্যান ধান নষ্ট হয়ে যায়।

কবিকে জেনেছিলাম কবিতায়। সামান্যই সে জানা। কেউ একজন সে জানাতে ছিটিয়ে দিয়েছিল কৌতূহলের মেওয়া। সে লোভে আরও বেশি অগ্রসর হয়েছি মাছির মতো। সে একজন বা এরকম যত ‘একজন’ আসে অনেকেরই তাড়া থাকে ফেরার। কিন্তু কেউ চলে গেলেও আদ্যোপান্ত চলে যাওয়া যায় না। শেকড় থাকে, বাকড় থাকে। অথবা একটিমাত্র পাতার মর্মর হলেও। এইতো কবিকে স্মরণ করতে গেলে সেও আসে। আমাদের অনন্ত কোলাহলের ভেতর ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ উঁচু করে রাখে। ফলে, জীবনে নানাভাবে থাকাটা উপজীব্য হয়ে যায় নানা স্মৃতিময়তার ভেতর। রোমন্থনের সুতোয় বাঁধা না-থাকারা অনেককালের থাকা হয়ে রয়ে যায়।

এমনভাবেই আমার অনেক ব্যক্তিগত বোধের জগতে কবি আমার স্ব-বাধ্যতার পাঠ্য হয়ে উঠেছিলেন। সমস্ত ক্ষতের মুখে পলি, কবিতার মুহূর্ত, এমনকি তাঁর সমস্ত গদ্যসংগ্রহ আমার সৃজন সাধনার আরাধ্য সঙ্গী হয়েছে ক্রমান্বয়ে। শেলফে রেখেছেন তাঁর আলো।

মনের মধ্যে ভাবনাগুলো ধুলোর মতো ছোটে
যে কথাটা বলব সেটা কাঁপতে থাকে ঠোঁটে,
বলা হয় না কিছু—
আকাশ যেমন নামতে থাকে নিচুর থেকে নিচু
মুখ ঢেকে দেয় মুখ ঢেকে দেয়, বলা হয় না কিছু।

কত কথাই তো ভাবনার তড়পড়ানি হয়েই থেকে যায়। একজীবনে। কিন্তু বলা হয় না কিছুই। বলার ভাষাটাও রপ্ত করা হয় না। আমার মতো এক আনাড়ি কবি হতে চাওয়া অনন্ত পাঠশালার সামান্য বিদ্যার্থিনী তাঁর কাছ থেকে কতটুকুই আর নিতে পারি! তিনি তো ঢেলেই দিয়েছেন নিজেকে উজাড় করে— কবিতায়, গদ্যে। বোধের শস্য ফলিয়েছেন, আপাত ভিড়ের মধ্যে কী ভীষণ কোলাহলহীন! বাংলাসাহিত্যের রত্নসম্ভারের তিনিও যে অন্যতম বলাই বাহুল্য।

শঙ্খ ঘোষ

আদম সম্মাননার অনুষ্ঠানে কলকাতার রোটারি সদনে বাম থেকে কবি শঙ্খ ঘোষ, রিমঝিম আহমেদ এবং বিধান সাহা ।। ছবি সৌজন্য : তমাল রায়

ছোটোবেলায় জলে পড়ে যাবার স্মৃতি থেকেই হয়তো তাঁর অনেক লেখায় জল ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু আমার কাছে সে জলের অন্য এক মানে আছে। জল আদি ও অনন্ত। জলের কোনো কাঁটাতার নেই। জল সীমারেখা জানে না। জলের আত্মীয়তা সমস্ত দেশকাল ছাড়িয়ে সর্বময়তায়। তাই জলের এই অতলতা ভেতরঘরে কত মণি-মুক্তাফলিত বোধের জন্ম দেয়!

জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?

অথবা

…তবে কি আমারও বুকে এতটা পাথরজমা ভার?
ঠিক। ঠিকই বলেছিলে তুমি, আজ
চোখে কোনো জল নেই, বুকের উপরে শুধু সেই
জলই পাষাণ হয়ে আছে।

কবি জন্মেছিলেন বাংলাদেশের চাঁদপুরে জেলায় ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ সালে। বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বরিশাল জেলার বানারিপাড়ায়। বড়ো এক নদী থেকে সাপের মতো ঢুকে পড়া সরু এক খাল, যার নাম সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যা নদীর পাড়ে। তারপর পাবনার সেই পাকশীতে কেটেছে তাঁর কৈশোর। দেশভাগের এক অপার বেদনা সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। বাস্তুহারা হৃদয়ে যে দেশ পুষেছেন তার নাম বরিশাল তথা বাংলাদেশ।

…তার পর, ভোরের সামান্য আগে
সীমান্তসান্ত্রির গুলি বুকে এসে লাগে—
মরণের আগে ঠিক বুঝতেও পারি না আমি শরীর লুটাব কোন্ দেশে। 

কোনো এক সাক্ষাৎকারে বার বার বলছেন দেশ বলতে যা বোঝায় ভারতকে সে অর্থে দেশ বলা যায় না। ভারতকে কখনো নিজের দেশ ভাবতে পারেননি তিনি, যদিও কোলকাতাকে ভালোবেসেছেন। কিন্তু দেশ বলতে সন্ধ্যা নদীর পারের এই দেশটাই তাঁর।

এ সত্য জানার পর আরও বেশি নিজের লোক মনে হয় তাঁকে। কী ভীষণভাবে এই দেশটাও তাঁর। একই দেশে জন্মানো একটা মানুষ, তাঁর সাথে যত প্রজন্মের গ্যাপ থাকুক না কেন, তাও তিনি নিজের লোক। বড়ো বেশি আপনার। বড্ড নিকটের।

…কিন্তু কোথায় গিয়েছিলাম? মাঝি, আমার বাংলাদেশের
ছলাৎছল শব্দ গেল অনেক দূরে মিলিয়ে, সেই
শব্দকুহক, নৌকাকাঙাল, খোলা আজান বাংলাদেশের
কিছুই হাতে তুলে দাওনি, বিদায় করে দিয়েছ, সেই
স্মৃতি আমার শহর, আমার এলোমেলো হাতের খেলা,
তোমায় আমি বুকের ভিতর নিইনি কেন রাত্রিবেলা?

আকাশ মেঘ করে আসে। হাওয়া দেয়। প্রকৃতি তার রাগ-বিরাগ, সুষমার অনাবিল কথকতা ছড়িয়ে দেয় শূন্যে ও প্রাণে। মানুষ তার নিজস্ব বেদনার ডালি সবসময় খুলতে পারে না। তার বড্ড ভয়। সমাজ, মানুষ, আইন এতসব বেড়ি ছাড়িয়ে মুক্ত পৃথিবীর প্রাণ হতে পারে না সে। সে বড়ো আড়াল মেনে চলে। চলতে বাধ্য। সেসব নিজস্ব ব্যথাতুর দিনরাত্তিরে কবি এসে যেন কানে কানে বলেন— তাঁর অস্পষ্ট স্বরে—

হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয়
সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়
এ কথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে
সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।

কবির কথাই ঠিক। যত সহজে আসা যায়, থাকা কি তত সহজ? অথবা সেই থাকাটুকুন বইতে পারা? আমি মেনে নিই। আসলেই তো! কে কার পাশে থাকে অবলীলায়? কার অন্ধকার ঘরে কে আলোর রশ্মি পাঠায়! আমাদের অপেক্ষাগুলো এভাবেই শেষ হয় চিরবিদায়ের বীণাঝংকারে। থাকে শুধু মল্লার। জানালার ওধারে না হলেও ভেতরে ভেতরে অনন্ত বৃষ্টিধারা।


আদম সম্মাননা পাওয়ার পর কোলকাতা যাওয়ার ইচ্ছেটা শতগুণ তাড়িত করেছে যখন জেনেছি শঙ্খ ঘোষ থাকবেন সে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হয়ে। এই কারণেই আদম সম্মাননা পাওয়াটা আমার জন্য অনেক মর্যাদার। আদম এবং গৌতমদার (গৌতম মণ্ডল) প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা, এমন একটা তাৎপর্যপূর্ণ সন্ধ্যা উপহার দেওয়ার জন্য।

কবিতা লিখে এর বেশি আর কী-বা পাওয়ার আছে এ নশ্বর জীবনে!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও ঔপন্যাসিক। জন্ম ৮ জুলাই ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায়। পেশায় তিনি একজন উন্নয়নকর্মী। প্রকাশিত গ্রন্থ : লিলিথের ডানা  [কবিতা, চৈতন্য, ২০১৬], কয়েক লাইন হেঁটে  [কবিতা, জেব্রাক্রসিং, ২০১৮], ময়ূরফুলের সন্ধ্যা  [কবিতা, বাতিঘর, ২০১৯], সুবেহ তারা  [কবিতা, তবুও প্রয়াস, ২০১৯], বিস্ময়চিহ্নের মতো [উপন্যাস, বাতিঘর, ২০২০], অনন্তকলহ [কবিতা, বাতিঘর, ২০২২]।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।