মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩

একজন অসামান্য প্রতিভাবান ক্রীড়াশিল্পী : শামসুর রাহমান

0

কবি শামসুর রাহমান আর্জেন্টিনার বিশ্বখ্যাত ফুটবলার ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে নিয়ে ‘একজন অসামান্য প্রতিভাবান ক্রীড়াশিল্পী’ শীর্ষক একটি অনন্য-উপভোগ্য লেখা লিখেছিলেন যা বিভুরঞ্জন সরকার সম্পাদিত ‘নন্দিত নিন্দিত ম্যারাডোনা’ সংকলনগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৪ সালে ঢাকার প্রত্যয় প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত এ বইয়ে শামসুর রাহমানের এই লেখাটিতে অনেক সমসাময়িক প্রসঙ্গ থাকলেও তাঁর ক্রীড়াপ্রেম অনুধাবনের ক্ষেত্রে লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ। লেখাটি কবি পিয়াস মজিদের সৌজন্যে প্রাপ্ত।


ব্রাজিলের কালো মানিক পেলের পর ফুটবল খেলার ইতিহাসে আরও এক কিংবদন্তি আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। ক্রীড়া-নৈপুণ্যে, নান্দনিক গুণে, দু’পায়ের জাদু প্রদর্শনে শুধু তিনি, শুধু তিনিই পেলের সমকক্ষ। চমকপ্রদ তার জীবন। বুয়েন্স আয়ার্স-এর ভিলা ফিওরিটোর বস্তিতে অত্যন্ত দরিদ্র পিতার ঘরে জন্ম গ্রহণ করেন ম্যারাডোনা। তিনি পিতা-মাতার আট সন্তানের পঞ্চম সন্তান। হতশ্রী বস্তিতে নোংরা ছোট ঘরে তিনি বেড়ে ওঠেন। কিন্তু দারিদ্র তার প্রতিভাকে চেপে রাখতে পারেনি। অল্প বয়স থেকেই প্রতিভার ঝলসানি দৃষ্টিগোচর হয়ে ক্রীড়ামোদীদের। বস্তির গলিতে ফুটবল নিয়ে ছুটেছে যে বালক সেই একদিন পৃথিবীর সব বিখ্যাত স্টেডিয়ামে দু’পায়ের জাদু দেখিয়েছে অগণিত দর্শকের সামনে; মন্ত্রমুগ্ধ, সম্মোহিত দৃষ্টিতে ওরা তাঁর খেলা দেখেছে। সেই গরিবের ঘরের ছেলে একদিন বিশ্বের সবচেয়ে দামি খেলোয়াড়ে পরিণত হন। ঐশ্বর্যের জোয়ারে ভেসে গেছেন তিনি। হয়তো ঐশ্বর্যই শেষ পর্যন্ত কাল হয়েছে এই অসামান্য ক্রীড়াশিল্পীর।


দিয়াগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা


ম্যারাডোনা ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার পক্ষে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে খেলতে পারতেন। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। সেই ১৯৭৮ সালেই তার পায়ের জাদুকরি ক্ষমতা দেখে অনেকে বিস্মিত হন। কিন্তু কোচ ম্যারাডোনার কল্যাণের জন্যেই, বলা যেতে পারে, সে বছর তাঁকে দলভুক্ত করেননি। সে বছর খেললে ম্যারাডোনা অবশ্যই বিশ্বকাপ ফাইনাল রাউন্ডে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার বিশ্ব রেকর্ডটি স্থাপন করতে পারতেন। কিন্তু সেটি হবার নয়। ইলেকট্রনিক্স প্রযুক্তিকে ধন্যবাদ, আমরা নিজেদের ঘরে বসেই বিশ্বকাপের উত্তেজনাপূর্ণ, শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচগুলো দেখতে পাচ্ছি। আমাদের অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত হচ্ছে বিশ্বের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের দৃষ্টিনন্দন ক্রীড়া নৈপুণ্য। আমাদের সৌভাগ্য হচ্ছে ম্যারাডোনার মতো ক্রীড়াবিদের জাদুকরি ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করবার। আমি ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত টেলিভিশনে ম্যারাডোনার খেলা দেখেছি। সে বছর স্পেন বিশ্বকাপে ভালো খেলেছেন তিনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয়। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা আঘাতের পর আঘাত করেছিলেন ম্যারাডোনাকে। শেষ পর্যন্ত মাথা ঠিক রাখতে পারেননি তিনি। প্রতিপক্ষের একজন খেলোয়াড়কে কড়া আঘাত করেন তিনি, রেফারির সঙ্গেও মেজাজ দেখান। ফলে তিনি মাঠ থেকে বের হয়ে যান। ম্যারাডোনার মতো খেলোয়াড়ের এ ধরনের নিষ্ক্রমণ খুবই দুঃখজনক। সেদিন অনেকের মতো আমারও মন খারাপ হয়ে যায়।

আমাদের সৌভাগ্য হচ্ছে ম্যারাডোনার মতো ক্রীড়াবিদের জাদুকরি ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করবার। আমি ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত টেলিভিশনে ম্যারাডোনার খেলা দেখেছি। সে বছর স্পেন বিশ্বকাপে ভালো খেলেছেন তিনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বের করে দেয়া হয়। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা আঘাতের পর আঘাত করেছিলেন ম্যারাডোনাকে। শেষ পর্যন্ত মাথা ঠিক রাখতে পারেননি তিনি।

ফুটবলের তাক লাগানো জাদুকর ম্যারাডোনার জন্যে সবচেয়ে গৌরবের বছর ছিল ১৯৮৬ সাল। সে বছর বিশ্বকাপ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় মেক্সিকোয়। সেবার যারা ম্যারাডোনার খেলা দেখেছেন তাদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে এক অতুলনীয় শৈল্পিক ক্রীড়ার ছবি। ম্যারাডোনা-টাচের আশ্চর্য নিদর্শন হয়ে রয়েছে সে খেলা। প্রতিভা সার্থকতার চূড়ায় পৌঁছলে কি রকম দৃষ্টি ঝলসানো এবং মহিমান্বিত হয় তার দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে ম্যারাডোনার খেলা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি গোল করেছিলেন ম্যারাডোনা। সেই গোল ঈশ্বরের হাত দিয়েছে বলে খোদ ম্যারাডোনা মন্তব্য করেন। কিন্তু সেই খেলাতেই তিনি একটি গোল করেন, যা প্রকৃতই বিস্ময়কর। এ যাবত বিশ্বকাপের অবিস্মরণীয় গোলগুলোর অন্যতম সেটি। কয়েকজন ডিফেন্ডারকে পাশ কাটিয়ে নিখুঁত ছন্দোময় গতিতে নানা ভঙ্গিতে এগিয়ে তিনি জালে যেভাবে জড়িয়ে দিলেন বল তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। ম্যারাডোনা ১৯৯০ সালে ইটালি বিশ্বকাপ খেলার সময় গোড়ালির সমস্যায় ভুগছিলেন। কিন্তু এই সমস্যা সত্ত্বেও তিনি নিজের ক্রীড়ানৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা টিমকে ফাইনালে পৌঁছিয়ে দেন, যদিও শেষ রক্ষা করতে ব্যর্থ হন ম্যারাডোনা। আর্জেন্টিনা জার্মানীর কাছে পরাজিত হয়।


Maradona 2

প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার মুহূর্তে ম্যারাডোনা


ম্যারাডোনা, ফুটবলে ঐন্দ্রজালিক, যেখানেই খেলেছেন সেখানেই উপহার দিয়েছেন বহুবার ক্রীড়া নৈপুণ্যে ভাস্বর, দৃষ্টিনন্দন নব্বই মিনিট। ইটালির নাপোলি ক্লাব দু’বার লীগের বিজয় মাল্য পরেছে ম্যারাডোনার কৃতিত্বে। যদি তিনি নিজে গোল করতে নাও পারেন, তবু অন্যদের গোল করার সুযোগ বানিয়ে দেন ম্যারাডোনা-টাচের মাধ্যমে। অপরূপ ক্রস, নির্ভুল, দৃষ্টি-কাড়া পাস দর্শকদের মাতিয়ে রাখে প্রায় সর্বক্ষণ। এবারও এই ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বে আর্জেন্টিনা দল প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল ম্যারাডোনার যোগ্য নেতৃত্বে। গ্রীস ও নাইজেরিয়া যে আর্জেন্টিনার কাছে হার মানলো তা মূলত আর্জেন্টিনা টিমের দলপতি ডিয়েগো ম্যারাডোনার ক্রীড়া নৈপুণ্যে। তিনি শুধু চমৎকার সব পাসই দেননি। নিজেও একটি সুন্দর গোল করেছেন।


Maradona 4

ম্যারাডোনা-টাচের আশ্চর্য নিদর্শন


পেলের মতো অসাধারণ প্রতিভাবান ও অভিজ্ঞ খেলোয়াড় বলেছিলেন, এবার ম্যারাডোনা তেমন সুবিধা করতে পারবেন না, তিনি অনেক ম্লান হয়ে গেছেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার দলপতি ম্যারাডোনা পেলের মন্তব্যকে অসার প্রমাণিত করে চমৎকার খেলেছেন। তবে দুঃখের বিষয়, ভালো খেলেও তিনি বাদ পড়লেন আর্জেন্টিনা টিম থেকে। না, খারাপ খেলার জন্যে নয়। ‘ডোপ টেস্ট’ পজিটিভ হওয়ার ফলে তিনি বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলো খেলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। ডোপ টেস্টের ফলাফল নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথাও উঠেছে। তবে ম্যারাডোনা যদি জেনেশুনে এফিড্রিন ব্যবহার করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাকে অপরাধ বলতে হবে। কারণ তিনি একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের সর্বনাশ ডেকে এনেছেন, তার টিমকে পরাজয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন এবং দুনিয়া জোড়া অগণিত ভক্তকে হতাশ করেছেন।

দুঃখের বিষয়, ভালো খেলেও তিনি বাদ পড়লেন আর্জেন্টিনা টিম থেকে। না, খারাপ খেলার জন্যে নয়। ‘ডোপ টেস্ট’ পজিটিভ হওয়ার ফলে তিনি বিশ্বকাপের বাকি ম্যাচগুলো খেলার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। ডোপ টেস্টের ফলাফল নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথাও উঠেছে।

অনেকে ম্যারাডোনা খেলতে পারবে না বলে বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখা ছেড়ে দেন। আগেও কোকেন খাওয়ার অপরাধে তাকে জেল খাটতে হয়েছে। অনৈতিক কিছু আচরণের জন্যেও তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। ম্যারাডোনাকে ট্রাজেডির নায়কের মতো মনে হয় আমাদের। গৌরবের অধিকারী নায়ক নিজের অন্তর্গত কোনো দুর্বলতা অথবা দোষের জন্য আখেরে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ব্যক্তিকেই আমরা ট্রাজিক নায়ক বলি। যেমন শেক্সপীয়রের হ্যামলেট, রাজা লীয়ার, ম্যাকবেথ।

না, ম্যারাডোনা ফিফা নিষিদ্ধ উত্তেজক ওষুধের ককটেল ব্যবহার উচিত হয়নি আপনার। আমরা যারা আপনার খেলার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি তাদের আপনার খেলা দেখা থেকে বঞ্চিত করা উচিত হয়নি আপনার। ঐশ্বর্যের মোহে বিভ্রান্ত, বিপথগামী আপনার জন্যে দুঃখ হয় আমাদের। আপনার অমর গৌরবোজ্জ্বল উত্থানের পর এই পতন আমাদের বিষাদগ্রস্ত করেছে। তবু আপনার খেলার শৈল্পিক উৎকর্ষ দেখে প্রচুর আনন্দ পেয়েছি। সেজন্য আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাই, আপনার করুণ পতন সত্ত্বেও।


শামসুর রাহমান

শামসুর রাহমান

লেখক পরিচিতি
শামসুর রাহমান ২৩ অক্টোবর ১৯২৯ সালে পুরনো ঢাকার মাহুতটুলি এলাকায় নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পৈতৃক বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রামে। বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি তিনি। কাব্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিশুকিশোর সাহিত্য, অনুবাদ সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৮০টি। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।