শনিবার, এপ্রিল ২০

‘চিৎকার’ উপন্যাসের পেছনের গল্প : জব্বার আল নাঈম

0

কথাসাহিত্যের ভাবনা ও অন্যান্য কথা

Chitkar

চিৎকার | জব্বার আল নাঈম | প্রকরণ : উপন্যাস | প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর | প্রকাশক : সাহস পাবলিকেশন্স

‘নিষিদ্ধশয্যা’ আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস হলেও ‘চিৎকার’ প্রথম লেখা উপন্যাস। এটা লেখা শেষ করি ২০১৭ সালের দিকে। উপন্যাসটি ভিন্ন নামে ওই সালেই ‘ভোরের পাতা’ ঈদসংখ্যায় ছাপেন ওই সময়ের ভোরের পাতার সাহিত্য সম্পাদক আলমগীর রেজা চৌধুরী ভাই। ওই সময় কিছুদিনের জন্য ভোরের পাতার সম্পাদকীয় পাতায় কাজ করি আমি। সেই সুবাধে রেজা ভাই বললেন, গেদা (রেজা ভাইয়ের এলাকার ভাষা, এটা নাকি এলাকায় প্রিয় মানুষদের বলা হয়) এইবার ঈদসংখ্যায় একটা লেখা দিবি তুই, কি দিতে চাস বল? বললাম, কবিতা। রেজা ভাই আবার বললেন, কবিতার বাইরে কিছু লেখছ না? আমি আমতা আমতা করে বললাম লেখি। তিনি আবার বললেন, কি লেখস? বললাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটা উপন্যাস লেখছিলাম, ভাই। তবে এটা এখনও অসম্পূর্ণ আরও কিছু কাজ করতে হবে। কথাসাহিত্যিক ও বন্ধু শামস সাইদ পড়েছিল। তখন রেজা ভাই বললেন, শামস তো ভালো লেখক। ওর লেখা আমি পড়ি। ওরে আমি পছন্দও করি। এক কাজ কর, তোর উপন্যাসটা আমারে দে। আমি পইড়্যা দেহি। ছাপানোর যোগ্য হইলে ছাপাইয়া দিমু। মনে মনে খুশি হলাম। এর কিছুদিন পর ভোরের পাতার চাকরিটা ছেড়ে দেই। রেজা ভাই অনেকবার বলেছিলেন চাকরিটা করতে। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে কন্টিনিউ আর করিনি। তখন ভাবছিলাম, রেজা ভাই সম্ভবত উপন্যাসটি আর ছাপবেন না। কিন্তু ঈদের আগে তিনি ফোন করে বললেন, ওই গেদা, ঈদসংখ্যা দেখছস নি? বললাম, না ভাই। তিনি আবার বললেন, দেখিস। তোর উপন্যাস ছাপানো হইছে। সেই মুহূর্তটা আমার কাছে দারুণ ছিল। রেজা ভাইকে এই লেখার মাধ্যমে একটা ধন্যবাদ ও ভালোবাসা জানিয়ে রাখলাম।

 

আমার কথাসাহিত্য ও বেপরোয়া জীবনের ছোঁয়া

আসলে ২০১৭ সালের আগে দু’হাতে লিখেছিলাম। কবিতা লিখেছি। উপন্যাস লিখেছি। গল্প লিখেছি। এর মূল কারণ ছিল তখন বেশির ভাগ সময়ে বেকার জীবন-যাপন করতাম। প্রচুর আড্ডা দিতাম। আমার এখন মনে হচ্ছে, আড্ডা হলো সাহিত্যের প্রাণ। আড্ডা না থাকলে যে সাহিত্য হবে না– তা না। তবে তাতে প্রাণের উপস্থিতি কম থাকবে। যাই হোক মূল কথায় আসি– শুরুতে কবিতা নিয়েই ভাবতাম সারাদিন। এক বন্ধু পরামর্শ দিল উপন্যাস লিখতে হবে। এতে সম্মান বেশি, টাকাও বেশি। পরিচিতি তো আছেই। তখন সম্ভবত ২০০৪-০৫ সাল। আমি বসে গেলাম উপন্যাস লিখতে। উপন্যাস যে বসলেই লেখা হয় না সেটা তখন বুঝলাম। কিন্তু আমাকে যে লিখতেই হবে। উপন্যাসের পাঠক বেশি, উপন্যাস বেশি বিক্রি হয়। কবিতা পড়ে সমাজের একদম এলিট মানুষেরা। একজন কবির পাঠক বড়োজোড় তিনশ। এসব বলতে থাকল ওই বন্ধু। তখন সবে কলেজ পাশ করি। অনার্সে ভর্তি হয়েছি। রঙিন দুনিয়ার বাসিন্দা আমি। কিন্তু লিখব এই নেশাটা ছিল প্রখর। তখন একমাত্র ভাবনা, আমাকে উপন্যাসই লিখতে হবে। মুশকিলটা হলো লিখতে বসে আর কাহিনি খুঁজে পাই না। প্রতিদিন কাহিনি খুঁজি। তখন রুমমেট বন্ধু সুমন ভূইয়া আমাকে অনুপ্রাণিত করত। আমার আরেক প্রাণপ্রিয় বন্ধু রিপন চৌধুরী সেও অনুপ্রাণিত করত উপন্যাস লিখতে, টিভি নাটক লিখতে। তো সাহস করে উপন্যাসের নাম ঠিক করি ‘বাবলা আমার ভালোবাসা’। খাটি রোমান্টিক উপন্যাস। ছেলের প্রেমে মেয়েটি হাবুডুবু খাবে। অনার্স পড়ুয়া নায়ক। কলেজ পড়ুয়া নায়িকা। সে কী প্রবল প্রেম! এমন প্রেমে প্রতিনিয়ত সে ভাসছে আর ডুবছে। একদিন নায়িকা বিষপান করে আত্মহত্যা করে! এই যখন অবস্থা তখন দেখি লিখিত কাগজে সবে এগারতম পৃষ্ঠা! এইভাবে তো উপন্যস হবে না! এটা বড়োজোড় গল্প হতে পারে। তা-ও প্রেমের গল্প। কিন্তু, এইসব সস্তা প্রেমের লেখা বাজারে চলবে না। বাদ দিলাম সেই প্রজেক্ট। এরপর থেকেই কবিতা নিয়ে পড়ে থাকার শুরু।

২০১৫ সালের দিকে এসে মাথায় আবার ভাবনা এলো উপন্যাস লিখতে হবে। অবশ্য এমন ভাবনা প্রথম দিয়েছে কথাসাহিত্যিক শামস সাঈদ। কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, কথাসাহিত্য করো। যখন যেখানে দেখতেন তিনি তাই বলতেন। এরপর রাসেল রায়হানসহ শুরু করলাম কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্য। রাসেল গল্প লিখছে। রাসেল উপন্যাসও লিখছে। যদিও রাসেলের প্রধান পরিচিতি একজন কবি। রাসেল সব শাখায় ভালো করছে এবং করবে। যদিও রাসেল আমার আগেই উপন্যাস প্রকাশ করে। আমি আরও কিছুদিন সময় নিলাম। তখন আশরাফ জুয়েল ভাইয়ের সঙ্গে নতুন পরিচয়। তিনিও বলেন, আমিও টুকটাক গল্প লেখি। শুরু হলো আমাদের কথাসাহিত্যের পর্ব।

 

যেভাবে উপন্যাস ‘চিৎকার’ হলো

প্রথম উপন্যাস ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। দেশটাকে ভালোবাসি। এই দেশের মানুষ একাত্তরে নিজের শরীরের রক্তে ভাসিয়েছিল এই মাটি। সেই মাটির সন্তান আমরা। শেকড়ের কথা তো আর ভুলে থাকা যায় না। যাবেও না। জানলাম যুদ্ধে আমার পরিবারেরও ছোটো একটা অংশগ্রহণমূলক ইতিহাস আছে। দারুণ ইতিহাস, রোমাঞ্চিত ইতিহাস, অনেকটা ট্রাজেডির ইতিহাসও। আমাদের ঘরেই ১৮জন মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছিলেন। সংখ্যাটা মাঝেমধ্যে কমবেশিও হতো। আমার মা-দাদি, চাচিরা দেশটাকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁরা নিজের ঘরটা মুক্তিবাহিনীর জন্য ছেড়ে নিজেরা আশ্রয় নেয় রসুই ঘরে। এই যে বিশাল ত্যাগ, তার ইতিহাস কোথাও লেখা নেই, কোনো স্বীকৃতিও নেই। বড়ো হয়ে দেখলাম আমার প্রজন্মের কেউ এই ইতিহাসও জানে না। এইটা রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার একটা বিশৃঙ্খলাই বলব। এমন অনেক মা-দাদি-বাবার এই ত্যাগগুলোকে যতক্ষণ স্বীকৃতি দেওয়া না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস চাপা পড়ে থাকবে। আমার উপন্যাসটা জাস্ট সেই কাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই লেখা। এটা যদিও ইতিহাস না। ফিকশন।

 

পশুপাখির চিৎকার ও আমাদের অবহেলা

মায়ের কাছে শুনলাম, ওই সময়ে মানুষের মতো পশুপাখিগুলোও ভয়ংকর অস্থির অবস্থায় ছিল। মালিক জানে না পালানোর সময় তার গৃহপালিত পশুগুলো কী করবে! দেখা গেছে গোয়ালেই আটক অবস্থায় রয়েছে গেছে, খেতে না পেয়ে মরে সেখানেই পড়ে আছে। কেউ কেউ ছেড়ে দিয়েছে আল্লাহর নামে। সেগুলো রাজাকার আর পাকিস্তানিরা ভোগ করেছে। এভাবেই গরু, ছাগল, হাস, মুরগি বেশ কষ্টের সম্মুখীন হয়েছে। মানুষের চেয়ে তাদের কষ্টটা কোনো অংশে কম ছিল না। পোষা কুকুরটি জানে না, তার মালিক আর কোনোদিন ফিরে আসবে কি না, অথচ সে পথ চেয়ে আছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি ও কথাসাহিত্যিক। জন্ম ১১ নভেম্বর, ১৯৮৬; চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার বদপুর গ্রাম। হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়েটিভ বিভাগের সঙ্গে যুক্ত। ‘জীবনের ছুটি নেই’ পাণ্ডুলিপির জন্য পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার ২০২০। প্রকাশিত বই : তাড়া খাওয়া মাছের জীবন [কবিতা; শুভ্র প্রকাশ, ২০১৫], বিরুদ্ধ প্রচ্ছদের পেখম [কবিতা; বিভাস প্রকাশন, ২০১৬], এসেছি মিথ্যা বলতে [কবিতা; চৈতন্য, ২০১৭]। কিশোর উপন্যাস :বক্সার দ্য গ্রেট মোহাম্মদ আলী [ অন্বেষা প্রকাশ, ২০১৯]।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।