মঙ্গলবার, মার্চ ১৯

‘পরানের গহীন ভিতর’ এবং ‘সোনালী কাবিন’ এর অনুষঙ্গী আলোচনা

0

Startপ্রাক-ইতিহাসের কাল থেকে শুরু করে কালবর্তী আধুনিক সময়ের এই শ্যামল ব-দ্বীপভূমির বঙ্গদেশ পর্যন্ত একধরণের ‘এথনোগ্রাফিক রিসার্চ’ এর সমান পরম্পরায়, হাজার বছরের ইতিহাসের চেতনাঋদ্ধ অনুষঙ্গকে নিয়ে এই বাংলায় সৈয়দ শামসুল হক যে কাব্যের মাধ্যমে অমূল্য ডিসিপ্লিন সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন, বাংলা সাহিত্যে যে ডিসিপ্লিনের মধ্যস্থতায় একটি নিজস্ব জাতিগত বিকাশের রূপরেখা নির্ণয়ে যে এক অনুবৃত্তিক দেদীপ্যমান মহান কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে গেছেন, সেই উদ্ভব জেনেসিস কাব্যগ্রন্থের নাম— ‘পরানের গহীন ভিতর’। সেই ডিসিপ্লিনের বাগভঙ্গির সুরে-দরদে আছে ময়মনসিংহ গীতিকা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার সাথে কবির কল্পবিশ্ব মিশ্রিত একটি লোকজ কোলাজ ভাষার রূপাশ্রিত প্রভাব।

সৈয়দ শামসুল হক যে কাব্যের মাধ্যমে অমূল্য ডিসিপ্লিন সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন, বাংলা সাহিত্যে যে ডিসিপ্লিনের মধ্যস্থতায় একটি নিজস্ব জাতিগত বিকাশের রূপরেখা নির্ণয়ে যে এক অনুবৃত্তিক দেদীপ্যমান মহান কাব্যগ্রন্থ উপহার দিয়ে গেছেন, সেই উদ্ভব জেনেসিস কাব্যগ্রন্থের নাম— ‘পরানের গহীন ভিতর’।

গ্রন্থটি গ্রামবাংলার প্রেমকেন্দ্রিক সনেট ফর্মে ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তে সম্পূর্ণ শিরোনামবিহীন, কিন্তু ক্রমিকসংখ্যা বিশিষ্ট মোট ৩৩টি কবিতা সমষ্টির সমাহার। অসামান্য ক্ষমতাশালী এই কবির চতুর্দশপদী কবিতাগুলিতে মিশে আছে গ্রামবাংলার একটি অনবদ্য নিসর্গচিত্র, যা রূপসী বাংলার মতোই মর্মগ্রাহী। এই কবিতাগুলির প্রকাশভঙ্গিতে কাব্যনাটকের সংলাপের মতো নাটকীয় ভঙ্গি রয়েছে—

কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?
ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?
উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর
আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?
যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,
যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,
যথন ফুরায়া যাবে জীবনের নীল শাড়ি-বোনা
তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?
আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,
আমার বিছানে নাই সোহাগের তাতের চাদর,
আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বড় ফোক,
আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানী আতর।
তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,
আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা।

(পরানের গহীন ভিতর : ১১, সৈয়দ শামসুল হক)

নগরভূমি থেকে দূরে— ‘প্রেম কবে নিয়েছিলো ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?’… অবগাহনের এমন উচ্চারণে আর প্রেমময় কাব্যকলার সমর্পণের ভাষায় এবং নদীর জোয়ারের মতো গীতিময় ভাষার টানে বিংশ শতাব্দীর বাংলার গ্রামীণ পটভূমির এতিহ্যকে ধারণ করে প্রেম বিরহের উচ্চাভিলাষী কাব্য হচ্ছে ‘সোনালী কাবিন’।

২.
নগরভূমি থেকে দূরে— ‘প্রেম কবে নিয়েছিলো ধর্ম কিংবা সংঘের শরণ?’… অবগাহনের এমন উচ্চারণে আর প্রেমময় কাব্যকলার সমর্পণের ভাষায় এবং নদীর জোয়ারের মতো গীতিময় ভাষার টানে বিংশ শতাব্দীর বাংলার গ্রামীণ পটভূমির এতিহ্যকে ধারণ করে প্রেম বিরহের উচ্চাভিলাষী কাব্য হচ্ছে ‘সোনালী কাবিন’। সুনিপুণভাবে লোকজ শব্দের কারুময় এই কাব্যে আছে কবি আল মাহমুদ প্রণীত শিরোনামবিহীন ১৮ মাত্রার অক্ষরবৃত্তের সনেটফর্ম, কিন্তু ক্রমিকসংখ্যা বিশিষ্ট মোট ১৪টি কবিতার প্রবাহ। বিবিধ বৈশিষ্ট্যের সংহতি ‘সোনালী কাবিন’ এর ভাষায় আছে পুঁথি, আরবি গন্ধমিশ্রিত শব্দগুচ্ছ আর কাব্যবোধে মিশিয়েছেন লৌকিক গ্রাম-ঐতিহ্য উপকরণ, আছে মাহমুদীয় প্রকরণ, আছে সংগ্রাম এবং সাম্যবাদের ড্রামাটিক মনোলগ। বয়ানে উৎপাদন-সম্পর্ক আর ক্ষমতা-সম্পর্ক বিষয়ে মার্কসীয় পরিভাষার নিরিখে সনেটসমুহে রাজনৈতিক মতাদর্শিক উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যও আছে—

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ,
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারো বেশি ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ,
সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ

(সোনালী কাবিন : ১০, আল মাহমুদ)

৩.
চিন্তার উপক্রমণিক উদ্ভব, জ্ঞাতির বিকাশ এবং লোকশব্দের পারস্পরিক পূরক শব্দ ব্যবহারের প্রবল প্লাবনে জাতিতত্ত্বের বিষয়ে যে সংযুক্তির বোধ তৈরি করে ‘পরানের গহীন ভিতর’, নারী-পুরুষের মনোবিকলন সম্পর্ক ও স্মরণীয় কবিতা লিখেও মানব জাতি সম্বন্ধীয় ‘এথনোলজি’ তেমনভাবে সঞ্চালিত করে না ‘সেনালী কাবিন’ এর কবিতাসমূহ। কারণ, কবিতার বিচারে বিশুদ্ধতার নিরিখে ভাষাটি বিশুদ্ধিপন্থী হলেও এইসব চিন্তা কালের প্রেক্ষিতে একটি জায়গায় মন্থর। নায়ক-চরিত্রের কুলগৌরব প্রকাশে আছে, আছে বিপুল জনগোষ্ঠীকে আওতাভুক্ত না করে নিজের কুলকেই পরাক্রম করে তুলে বীরত্বের অকুতোভয়তা ধর্মীবয়ান। ঐক্যের পরিবর্তে অসংখ্য প্রতিপক্ষ তৈরি করে সংগ্রামের প্রবল প্রত্যয়ী ইশারাও আছে।

পক্ষান্তরে ‘পরানের গহীন ভিতর’ এর কাব্যে আছে গ্রাম-বাংলার ঘর-কন্নার সুখদুঃখ, গ্রামীণ মনোবিকলনসহ একটি লোকজ ভাষায় রূপাশ্রিত অন্তর্জগৎ— যেখানে আছে অনেক আধুনিকতা এবং সমকালীনতা। এর লোকাল ডায়লেক্ট একটি ভাষায় যথাযথভাবে স্থিতিশীল থেকেও কবির চিন্তামিশ্রত ভাষার প্রয়োগগুণে প্রতিটি সনেটে একটি রহস্যময়তার বিস্তৃত বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। কাব্যভাষাটি ঠিক কোনো আঞ্চলিক ভাষা নয়। বহুবর্ণিল বৈচিত্র্যঋদ্ধ ‘পরানের গহীন ভিতর’–এর কবিতাগুলি যে পটভূমিতে চিত্ররূপময়ে উপস্থাপিত করেছেন কবি তা কবির স্বনির্মিত প্রতিটি কবিতার মেটা-জগৎ। যাতে গ্রামবাংলার পটচিত্র নিপুণ চিন্তায় আছে বৃহৎ ঐক্যের ডাক, প্রেমের আকাঙ্ক্ষা, স্মৃতি, ঈর্ষা, আকুতি, অভিমান এবং কাম। এসবের প্রেক্ষিতে কবি একটি জাতিতত্ত্বিক রাষ্ট্রের প্রথাগত উপায়ে মৌলিক প্যার্টার্ন তৈরি করে দিয়ে গেছেন এই কাব্যগ্রন্থে।

২য় পর্ব :

মানবীয় সম্পর্কের নানা মাত্রায় প্রেমপ্রত্যয়ী একটি প্রকাশভঙ্গি উদ্ভাবন করতে এবং পুরাতনী এই বিষয়কে নতুন করে বর্ণনা করতে বাংলা কাব্য-সাহিত্যে সর্বজনবোধ্য চতুর্দশপদী দুইটি সনেটকাব্য আবির্ভাব করেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক ও কবি আল মাহমুদ।

মানবীয় সম্পর্কের নানা মাত্রায় প্রেমপ্রত্যয়ী একটি প্রকাশভঙ্গি উদ্ভাবন করতে এবং পুরাতনী এই বিষয়কে নতুন করে বর্ণনা করতে বাংলা কাব্য-সাহিত্যে সর্বজনবোধ্য চতুর্দশপদী দুইটি সনেটকাব্য আবির্ভাব করেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক ও কবি আল মাহমুদ। মানবপ্রেম (Agape), পারিবারিক প্রেম (Storge), চিরন্তন প্রেম (Pragma), আত্মপ্রেম (Philautia), সহানুভূতি (Philla), ছেনালি (Ludus), কাম (Eros)— এসব সপ্তমিশ্রনে গ্রিকপ্রেমের ধারণাকে কেন্দ্র করে চতুর্দশপদী বর্ণাঢ্যভাবে এবং সার্থক সংবেদনশীলতায় রচিত হয়েছে ‘পরানের গহীন ভিতর’ এবং ‘সোনালী কাবিন’ এর অন্তর্ভূক্ত কবিতাগুলিতে। গীতধর্মী এসব সনেটগুলি এক বিশাল ব্যতিক্রমী ও নিজস্ব কণ্ঠস্বর হিসাবে সাহিত্যে বিশাল প্রতিভাসম্পন্ন ও নিজস্ব কণ্ঠস্বর হিসাবে অঙ্গীভূত। প্রণয়ের পাশাপাশি জীবনের বহুমাত্রিক অনুভবের তীব্রতা নিয়ে জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গও বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং যৌক্তিক ব্যাখ্যায় এসব কবিতায় উঠে এসেছে। এই দুই কবি তাঁদের সনেট কবিতাসমুহে বিষয় বিন্যাস, আবেগোত্থিত অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তা, শব্দ প্রয়োগ কিংবা অনিবার্য ভাবার্থের বাক্য বিন্যাস— সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা দুই বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্রধারায় পরিবর্তন এনেছেন। যেমন—

জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,
চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,
মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক
কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷
চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,
বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,
নিজেই তাজ্জব তুমি— একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷
সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,
খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,
ডাহুক উড়ায়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,
সোনার মোহর তার পড়া থাকে পথের ধূলায় ৷
এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর
যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর ৷

(পরানের গহীন ভিতর : ১, সৈয়দ শামসুল হক)

পরানের গহীন ভিতর-১ এর সনেটে অর্থসূচক ধ্বনির অক্ষরসমষ্টি ৯৪টি শব্দবন্ধে ফুটে উঠেছে একান্ত আবেগের কথা। প্রতিটি পঙ্‌ক্তির যাত্রাভূমি নিখাঁদ বাস্তবতা থেকে উৎসারিত। প্রত্যেক স্তবকের অভিমুখ গূঢ় অর্থ সমন্বিত জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজমের ফর্মে আকস্মিক ব্যাপারের মতো রূপান্তরির হয়েছে, কিন্তু প্রতিটি লাইনে সূচিত আছে পরিমিত ও সুস্পষ্ট লক্ষ্যাভিমুখী। ভাবাবেগের গাঁথুনিতে এই চতুর্দশপদীর কাঠামোটি স্থির, গতিময়ী ঘনবদ্ধ এবং কাচেঘেরা স্থানের মতো শ্বাসরুদ্ধকর। এক একটি পঙ্‌ক্তির মধ্যেকার দৃশ্য উপস্থাপনের অনুক্রম জাদুর মতোই মুহূর্তেই ক্রমাগত পরিবর্তন আনে— ‘জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক…’ । কিন্তু কথাগুলি অনুভব করলেই এমন কিছু উপলব্ধি হয়, যা থেকে বোঝা যায় এর মূলে রয়েছে একটি গভীর সত্য। অর্থাৎ বাস্তবতার সঙ্গে জাদুর কিংবা জাদুর সঙ্গে বাস্তবতার সংমিশ্রণে বিশ্বাসযোগ্য ধারণায় উপস্থাপন। স্তবকে স্তবকে আলোচিত উপাদানগুলি পোস্ট-এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমার্থক টেক্সটের মতোই চিত্রণধর্মী—

‘চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও।’

পুরুষকণ্ঠে এই কবিতায় সমাজের দৈনন্দিন ঘটনাবলী বর্ণনার প্রেক্ষাপটকে পরাবাস্তবতালগ্ন প্রকরণে তুলে ধরা হয়েছে—‘মানুষ বেকুব চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক/কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর’… এবং বয়ানগুলি নির্দিষ্ট কালে বলার সময় হঠাৎ কালাতিক্রম ‘সময়’ থমকে দাঁড়িয়ে আবার চলতে আরম্ভ করে এবং সময়গুলি সমসাময়িক কাল ও ঐতিহাসিক কালের কোলাজ—

‘নিজেই তাজ্জব তুমি– একদিকে যাইবার চাও
অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান’।

সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্বন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি ।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা

(সোনালী কাবিন : ১, আল মাহমুদ)

‘সোনালী কাবিন’ এর প্রথম সনেটটি ৯৬টি বিভাময় শব্দে হৃদয় আকাঙ্ক্ষার প্রস্তাবধর্মী এবং আত্মরতির মিশ্রণে প্রণয়ের ঘোষণা করেছেন কবি আল মাহমুদ। কিছু আধ্যাত্মিক বার্তাও আছে এখানে। প্রেমের আবেশজনিত রোমাঞ্চের শিহরণ আছে প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে।

প্রথম চার স্তবকের অন্তর্গত টানে অন্ত্যজ সম্প্রদায়ভুক্ত নারীর প্রতি আত্মবিচ্ছিন্নতা ও সত্তাবিচ্ছিন্নতার আউটসাইডার বোধ থেকেই প্রণয়াকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন এভাবে—

সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি…।

বস্তুতে-প্রতীকে, শারীরিক-মানসিকভাবে, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে প্রকাশে কিছুটা ভিন্ন হলেও এর রয়েছে বিংশ শতাব্দীর তৎকালীন সর্বজনীন গ্রামীণ দারিদ্র্যের রূপ। শ্রেণিসংগ্রামের বিষয়টিকেও মানবীর কাছে উন্মোচন করেছেন এবং ফলে এই স্তবকগুলিতে ব্যক্তি ও সমাজের বাস্তবচিত্রই প্রধান্য পেয়েছে।

পরের চার স্তবকে আকুলতা-ব্যাকুলতা তীব্র হয়ে চিরন্তন প্রেম (Pragma) থেকে সরে এসে সমাজ অস্বীকৃত কাম (Eros) এর আকর্ষণে এবং প্রগাঢ় দ্বান্দ্বিকতায় বিস্তৃত করেছেন—

ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন,
ছলনা জানিনা বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি

সম্পর্কের চিন্তা করতে করতেই এখানে আসক্তির সৃষ্টি হয়েছে, সেই আসক্তি হতেই কামের উৎপত্তি। এখানে পুরুষের শূন্যতাবোধ, সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনের চিত্রও পরিলক্ষিত হয়। আচরণগতভাবে উদ্দামতা ও বেআব্রু শব্দচিত্রের জন্য বেশ বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে।

দ্বিধা আর অপূর্ণতাবোধে মার্ক্সিস্ট দ্বান্দ্বিকতায় শেষের ছয় লাইনে আন্টিথিসিস সদা উপস্থিত। আনন্দ-আবৃত, ইচ্ছা-ব্যর্থতা, সরল-জটিল এবং জ্ঞান-অজ্ঞান—

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা

এই স্তবকগুলি নিচু স্বরের নয়, বরং সরাসরি ইন্দ্রিয়প্রবণ। অতীতের বর্ণনার ভেতরেই বর্তমানকে স্পষ্ট করে পারস্পারিক যোগাযোগের সাধনায় ব্যক্তিগত চাওয়াগুলি প্রকাশ করার তীব্র ইচ্ছা এবং তার অনুভূতিগুলিকে মানবীকে আত্মস্থ করিয়ে মনের মহিমা দিয়ে তাকে স্পর্শ করতে চান ।

বোধের বাইরে থেকে অন্ধের মতো কাউকে ভালোবাসার চেয়ে, তার অস্তিত্বের প্রতি সম্মানিত থেকে একটি সম্পর্কেও জাগতিক যেকোনো পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েও যে ভালোবাসা যায়। চতুর্দশপদী এই কবিতায় সেই মগ্নচৈতন্য সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত। অভিলাষী আকাঙ্ক্ষা হলো পাকা ফলের মতো, যে ফলের দিকে চোখ ও ক্ষুধা ভোজনের প্রবণতাকে প্রবৃত্তি বানিয়ে ফেলে এবং আকাঙ্ক্ষাকে দমন না করতে পারলে আগাছার মতো বৃদ্ধি পেতে পেতে প্রকৃত ফসলকে নষ্ট করে দেয়।

৩য় পর্ব :

২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষা আন্দোলনে যেসব শহিদেরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা সৈয়দ শামসুল হকের মতোই প্যান্ট-শার্ট, পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছিলেন, বাংলাভাষার জন্যে নিহত না হলেও সৈয়দ শামসুল হক স্মরণীয় হয়ে আছেন মৃত্যুহীনতা অক্ষয় অমর সৃষ্টির জন্য। মৌখিক আঞ্চলিক রূপটিকে ভালোবেসেই বাংলাভাষায় সুতীব্র বর্মসম ‘পরানের গহীন ভিতর’ সনেট কাব্য লিখে অমর হয়ে আছেন— যার বাগভঙ্গিতে আছে ময়মনসিংহ গীতিকা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়ার সাথে কবির কল্পজগত মিশ্রিত একটি লোকজ কোলাজ ভাষার রূপাশ্রিত প্রভাবের অবিনশ্বর কীর্তি। এসব শব্দধ্বনির ভিতরে আছে ম্যাজিকের মতো দীর্ঘকালব্যাপী স্থিতিময় সম্মোহনের শক্তি। আধুনিক কবিতায় যে পরিভাষা সৃষ্টি হয়েছে এসব আঞ্চলিক শব্দ-ধ্বনির ব্যবহার থেকে, তা চেনা বাস্তবেরই সমান্তরাল।

এমন বৃক্ষ কি নাই ডালে যার নাই কোনো পরী,
এমন নদী কি নাই জলে যার পড়ে না চেহারা,
এমন যাত্রা কি নাই যাতে নাই পরনের তরী,
এমন ডুলি কি নাই যাতে নাই নিষেধের ঘেরা,
এমন নারী কি নাই বুকে যার নাই ভালোবাসা,
এমন পত্র কি নাই বাক্যে-যার নাই নিরাময়,
এমন শস্য কি নাই যার বীজ বোনে নাই চাষা,
এমন মৃত্যু কি নাই যাতে নাই খোয়াবের লয়?
এমন কি রূপ আছে রূপ যার গড়ে না কুমার,
এমন কি দেখা আছে দেখা যার চোখে না কুলায়,
এমন কি কথা আছে কথা যার থাকে না ধুলায়,
এমন কি নেশা আছে নেশা যার অধিক চুমার?
পরানে পরান যদি এই মতো হাজার সোয়াল
সারাদিন যমুনার খলবল চিতল বোয়াল।

(পরানের গহীন ভিতর : ৩৩, সৈয়দ শামসুল হক)

কাব্যসাহিত্যের অন্যতম প্রকরণগত রীতি চেতনার এক নান্দনিক অভিধা হচ্ছে ‘পরানের গহীন ভিতর’ এই শেষ সনেটটির প্রতিটি স্তবক। ধ্যানমগ্ন এক অনুসন্ধানী ভাষায় আর উদগ্রীবতার অন্তরিন্দ্রিয় অধরাকে ধরতে চেয়েছেন কবি, এর ব্যক্ত ও অব্যক্ত আচরণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পটভূমিকে অভেদে সনাক্তকরণ করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে যে বহমানতা আছে এরমধ্যে থেকে নিপুণভাবে অবলম্বন খুঁজেছেন। এক্সট্রিম ক্লোজ-আপ শটের মতো প্রতিটি চরণ-চরিত্র থেকে যে অস্থিরতার উম্মেষ, সেসব প্রতিবোধন নিখুঁতভাবে বর্ণনার সঙ্গে দর্শনীয়ভাবে দৃশ্যগুলি ‘এমন কি দেখা আছে দেখা যার চোখে না কুলায়’ এমন অনুভূবচিত্রে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

কাউকে ভালোবাসা মানে তো শুধু তাকে ভালোবাসা নয়, তার বোধ-চিন্তন এবং তার নৈতিক বিস্তারকে ভালোবাসা। ভালোবাসা বর্মের মতো কাজ করে, যে বর্ম রক্ষা করে ব্যক্তিগত দুঃখ, শোক, গ্লানি, ক্ষোভ, অসহায়তা। প্রতিটি ভালোবাসায় আছে নিজেকে নিরাময় রাখার আপ্রাণ চেষ্টারত সেই বর্ম, যে বর্মসম ভালোবাসার বিস্তার করেছিলেন লোকজ অনুষঙ্গে সুনিপুণ ভাবে সৈয়দ শামসুল হকের কালউত্তীর্ণ সনেট কাব্যসমূহ সৃষ্টির মাধ্যমে, যা ভিন্নতরভাবে অভিযোজিত।

কবি ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর শেষ সনেট ৩৩ নম্বটিরটি সমাপ্তি টেনেছেন ঐতিহ্যসন্ধানের মতো করে মূলত স্বতঃস্ফূর্ত লৌকিক-সামাজিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। লোক-বিশ্বাস বা লোকসংস্কারধর্মী জীবনের বহুমুখিতার উপলব্ধিতে পঙ্‌ক্তিগুলিকে স্তবকের পর স্তবকে সৃষ্টি করেছেন নিপুণ বিস্তারে শিল্পগুণে ঋদ্ধ নাড়ীর সম্পর্কের ন্যায় প্রকৃত ঐতিহ্যসন্ধানে। প্রবাদমূলক পঙ্‌ক্তিগুলিতে পাওয়া যায় রূপকথা, উপকথা, পুরাণকথা, ব্রতকথা ইত্যাদি এবং লোককথার বিভিন্ন সমার্থক শব্দে আছে লোককাহিনি, লোকগল্প, কেচ্ছা-কাহিনি ইত্যাদি। এই কবিতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি স্তবকে আছে সমাজ-বাস্তবতাকে আত্মস্থ করা কবির নিজস্ব উপস্থাপন। পঙ্‌ক্তিগুলি বাংলার ভূমিজাত শেকড় জলসিক্ত কাদামাটির গভীরে প্রোথিত, যা এই কবিতার প্রারম্ভের চার পঙ্‌ক্তিতে লোককথার মিশেলে সেভাবে চিত্রায়িত করেছেন কবি—

এমন বৃক্ষ কি নাই ডালে যার নাই কোনো পরী,
এমন নদী কি নাই জলে যার পড়ে না চেহারা,
এমন যাত্রা কি নাই যাতে নাই পরনের তরী,
এমন ডুলি কি নাই যাতে নাই নিষেধের ঘেরা…

পরের চতুর্থাংশ পঙ্‌ক্তিতে আছে মানস মনের অন্তঃস্থলের বিরাজমান ভাব-আবেগ, বাস্তবতা, প্রেম, শাশ্বত সম্পর্কের অনস্বীকার্য সূত্রাবলীতে উজ্জ্বল। লোকজ শব্দের সফল প্রয়োগে বিষাদমাখা চোখে দ্রোহী সত্তায় এবং বিরহ কাতরতার মাঝে এক অবিনাশী দ্যোতকে দেখেন নদীর চড়ায়—

এমন নারী কি নাই বুকে যার নাই ভালোবাসা,
এমন পত্র কি নাই বাক্যে-যার নাই নিরাময়,
এমন শস্য কি নাই যার বীজ বোনে নাই চাষা,
এমন মৃত্যু কি নাই যাতে নাই খোয়াবের লয়?

রোমান্টিক প্রেরণায়, নিরঙ্কুশ আবেগে এবং লৌকিক পরিক্রমায় সম্পর্কের সংকট-উত্তরণে, চিন্তা, যুক্তি এবং মণীষার সাহায্যে সামাজিক বদ্ধমতসমূহের অসারতা দূর করতে শেষের ছয় স্তবকে সেই স্বাধীন প্রত্যাশায় কবি উল্লেখ করেছেন—

এমন কি রূপ আছে রূপ যার গড়ে না কুমার,
এমন কি দেখা আছে দেখা যার চোখে না কুলায়,
এমন কি কথা আছে কথা যার থাকে না ধুলায়,
এমন কি নেশা আছে নেশা যার অধিক চুমার?
পরানে পরান যদি এই মতো হাজার সোয়াল
সারাদিন যমুনার খলবল চিতল বোয়াল।

৩৩ নং এই শেষ সনেটেটি যে বিষয়গুলির দিব্যপ্রেরণাপ্রাপ্ত হয়ে আছে— এতে দার্শনিকতা আছে, সাধক আছে, চিত্রকলা আছে, গানের গুঞ্জরন আছে, রূপের বন্দনা আছে, ভাস্কর্য আছে, স্থাপত্য আছে, কুমার শিল্প আছে, নাটকীয়তা আছে এবং শর্টফিল্মের মতো চলচ্চিত্রায়ণ আছে। এই বিষয়গুলির পরিস্রাবণে কবি জীবনের অন্তঃসারকে, জীবনের অন্তঃসৌন্দর্যকে এবং জীবনের অন্তঃসত্যকে অনুপ্রেরিত করতে পেরেছেন যথার্থভাবে। এই কবিতাটি শ্রুতিতে সংগীতের মতো, চোখের কাছে চলচ্চিত্রের মতো, হৃদয়ের কাছে সাধকের মতো, মননের কাছে দার্শনিকের মতো, স্থাপনাগুলি ভাস্কর্যের মতো, রূপগুলি শিল্পের মতো, ব্যবহার্য দ্রব্যগুলি কুমারের মতো, তথ্যের সাথে স্বপ্নের নাটকীয় সংঘাত আছে এবং এর ঘটনাগুলি শর্টফিল্ম বৈশিষ্ট্যের মতো। স্বকালের বন্ধ্যাত্ব গুচিয়ে সম্প্রসারিত হয় উত্তরকালের বারান্দায় কবিতাটি। এই সনেটটি মানব আত্মাকে সম্প্রসারণ করে মৃত্তিকাসংলগ্ন জীবনসমৃদ্ধ বাস্তব ও কল্পনার প্রান্তহীন আয়তনকে আরো বিস্তৃত করেছে।

অস্বীকার করিতে চাইলেই আল মাহমুদের মতাদর্শিক নির্মিতিতে সরব ‘সোনালী কাবিন’-কে অস্বীকার বা পরিহার করা যায় না, কিন্তু অতিক্রম করতে চাইলে ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর মাধ্যমে একে অতিক্রম করা যায়।

●●
অস্বীকার করিতে চাইলেই আল মাহমুদের মতাদর্শিক নির্মিতিতে সরব ‘সোনালী কাবিন’-কে অস্বীকার বা পরিহার করা যায় না, কিন্তু অতিক্রম করতে চাইলে ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর মাধ্যমে একে অতিক্রম করা যায়। সৈয়দ শামসুল হক সৃষ্ট সনেটগুচ্ছের শব্দবন্ধগুলি থেকে জীবনের অন্তঃস্থলের, জীবনের অন্তঃসারকে, জীবনের অন্তঃসৌন্দর্যকে এবং জীবনের অন্তঃসত্যকে আরো বিস্তৃত চেতনার ধুকপুকে অনুভব করা যায়। সুঅলংকারের ভূষণে ক্রমবিন্যস্ত করলে দুই-দুইটি সনেটগুচ্ছের মধ্যে বড়ো একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। মনস্তাত্ত্বিক এই ব্যবধান সম্পর্কিত অনুষঙ্গগুলি ধারাবাহিক আলোচনার লেখনি পর্বের মাধ্যমে ক্রমিকভাবে এই নিবন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে। আল মাহমুদের সনেটগুলি পাঠ করলে যে অনুরণন ঘটে মস্তিষ্কে, মনে হয় এক জেদী যুবকের মধ্যযুগের গীতি কবিতারই আধুনিক সংস্করণ ‘সোনালি কাবিন’।

বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা,
এ-বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে,
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভঙে ছল ছল
আমার চুম্বন রাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেবো চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ-মস্তকে নামুক লান
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।

(সোনালী কাবিন : ১৪, আল মাহমুদ। ১৪ নংয়ের রচনাকাল ৬.১২.৬৮ , চট্টগ্রাম।)

তৎসম-তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি কৃষিজীবী মুসলমান সমাজের নিরাময়ধর্মী ঘরোয়া শব্দের রোগবীজসংক্রমণ নিরাময়ী ব্যবহার দেখা যায় ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যের শেষ এই সনেটের প্রবেশলগ্নে। দোহাই, বিবি, কসুর, জবান, গতর, ছতর, নাপাক, আগল, তালাক, কসুর, বানু, খেলাপ, সবক, কবুল, বিবি ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়, তাঁর শব্দগুলি ধ্বনি হয়ে অস্তিত্বের অতল স্পর্শ করে। ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা , দুঃখ, ক্রোধ, চিৎকার— কবির মানস প্রতিক্রিয়াকে আশ্রয় করে কবিতার বর্ণবিন্যাসের বোধে আছে মৃত্তিকাশ্রয়ী শব্দ। রয়েছে নারীর নিখুঁত সৌন্দর্য উম্মোচন, প্রকৃতির সুনিপুণ বর্ণনা, প্রেম ও কামের বৈচিত্রময় ক্যানভাস। শান্ত, শুভ্র ও নরম দেশজ সংসারী শব্দের প্রতি আল মাহমুদের পক্ষপাত অতিশয়ে নতুন বোধগম্যে জন্মায় নতুন জ্ঞান। এই নতুন জ্ঞানে উপলব্ধি হয় লোকজ প্রকরণে প্রেমের অনুরাগবর্গ থেকে শরীরী প্রেমের এমন খোলামেলা প্রকাশ বাংলা কবিতায় পূর্বে তেমন নজরে আসেনি।

প্রথম থেকে শেষ চরণ অবধি কম্পনসূচক ভাবজনিত বিহ্বলতায় আর প্রেয়সীর কাছে নতজানু কাতরতায় অধিষ্ঠিত ‘সোনালী কাবিন’ এর ১৪নং শেষ সনেটটি। একপক্ষীয় প্রেমপ্রস্তাবে অস্তিত্বের এক সর্বব্যাপী আয়োজনে এবং প্রয়েসীর সম্মতির অঙ্গাঙ্গি না হয়েই বিদ্যমান বাস্তবতার করুণ দশা সম্পর্কে নিশ্চিত করেছেন পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে। প্রেমিকের কবিত্ব শক্তিতে ভর করেই কথক চরিত্রে এখানে চরণগুলি বিস্তৃত হয়েছে। এই কবিত্বের জোরেই এখানে বিগতকাল উদ্ঘাটিত হয়েছে, বিদ্যমান বাস্তবতার বিরূপতা চিহ্নিত হয়েছে, আর অদৃষ্ট অনাগতকালের সম্ভাবনার ধারাভাষ্য অঙ্গীভূত হয়েছে। প্রতটি পঙ্‌ক্তিতে দুঃখ এবং আনন্দের তমুল দ্বান্দ্বিক তাড়না আছে। যেমন—

বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই…

এখানে বিদ্যমান বাস্তবতার বিরূপতা যেমন আছে, তেমনি অনাগতকালের সম্ভাবনার ধারাভাষ্যের সাথে দ্বান্দ্বিক তাড়নাও আছে। পাশাপাশি এখানে তিমিরাচ্ছন্ন অতীত ছয়ার মতো উদ্ঘাটিত হয়েছে ‘শস্যের বিপদ’-এর মতো বিগতকাল। এভাবে জ্যোতির্লোকের ন্যায় পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে বর্তমান এবং ভবিষত্যের দ্বান্দ্বিক অবস্থান নির্ধারণ করা আছে ছায়ার মতো তিমিরাচ্ছন্ন অতীতকে জড়িয়ে। নিজের ভিতরে প্রবাহমান বিরুদ্ধ স্রোতগুলি চেষ্টা করেও প্রয়েসীর সম্মতির সাথে একই খাতে বইয়ে দিতে পারেননি বলেই প্রেমিক হিসাবে তার এই অন্তর্দ্বন্দ্ব।

প্রেমিকের কবিত্ব শক্তিতে ভর করে কথক চরিত্রটি বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের একজন প্রতিনিধি। তার চিন্তাপদ্ধতির মধ্যে আদিম সমাজের চিন্তন পদ্ধতির লক্ষণসমূহ সুপ্রকটভাবে বিস্তৃত। এক জেদী যুবকের মধ্যযুগীয় গীতি কবিতারই আধুনিক সংস্করণ হলেও এই কথক প্রেমিকের বাইরের দিক ছাড়া তার বিশ্বাস এবং মানসিকতার মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। ক্রমাগত এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেকে উন্মোচিত করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রেয়সীর বোধের কাছে এই প্রেমের প্লটটি গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। প্রেয়সীর নেতিবাচক মনোভাবজাত ভীত বা ক্রোধের পরিস্থিতি শিকার হয়ে হৃদয়ের দিগন্তের নিচে নিঃসঙ্গ হয়ে প্রেমিক যুবক পড়ে আছে। এক-এক করে ১৪টি চতুর্দশপদী কবিতার মোলায়েম বয়ানে প্রেমিক যুবক কিছুতেই প্রেম-সম্পর্কের গৌরবের স্বাদ পাননি এখানে, বিপরীত দিকে সম্পর্কশাস্ত্রের নিরিখে প্রেয়সী কিছু না জিতেই নিজেকে বিজয়ী বোধ করছেন এই কবিতায়! কবি আল মাহমুদ সৃষ্ট ১৪নং সনেটটি স্ব-নেতিবাচক উদ্দীপনাধর্মী একটি কবিতা, যা শেষ স্তবকে এসে এই মনোভাবের উপর ভিত্তি করে এভাবে মূল্যায়িত হয়েছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

পাঠ প্রতিভাষী। জন্মতারিখ ২০ এপ্রিল ১৯৬৫। নোয়াখালীতে। বর্তমান পেশা ব্যবসা।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।