শনিবার, এপ্রিল ২০

শহর থেকে দূরে… অচিন পাখির সুরে

0

১.
আমার মাথার ভেতর অনবরত কেউ কথা বলত।

শৈশবকাল। মগ্ন হয়ে (বলা ভালো বাধ্য হয়ে) পাঠ্যবইয়ে মন অথবা উৎফুল্ল হয়ে বিকেলের খেলা বাদ দিলেই কে যেন আমার ভিতর কথা বলত। বিশেষ করে আমাদের হাইকোর্ট কলোনির বাসায় আমি যখন দুপুরবেলায় একা একা বারান্দায় বসে থাকতাম। হাতে গল্পের বই। দু’এক পাতা পড়ে আমি মুখ তুলে চাইতাম। ঈষৎ ক্ষয়ে যাওয়া হলদে রঙা বেতের চেয়ার, বারান্দা ঘিরে থাকা চার-সাড়ে চার ইঞ্চি দেয়াল আর বাম পাশে ঋজু ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা কড়ই গাছ।

সেই দুপুরগুলো আমার বুকের দরমিয়ায় স্মৃতির অভিধান। বহু বছর পর আমাকে শান্ত করে দেওয়া শব্দ পাখির দল।

২.
আমার অফুরান প্রাণশক্তি ছিল। কিছুতেই কিছু ক্লান্ত হতাম না।

আব্বার কথা ছিল আমাদের জন্য অমোচনীয় আইন। আমরা বিশ্বস্ত তাবেঈণদের মতো তা অনুসরণ করতাম। আব্বাকে ভয় পেতাম। যেমন ঠা ঠা করে হাসতেন সময়ে, রেগে গেলে যেন বজ্র নিনাদ।

আব্বার কথা ছিল আমাদের জন্য অমোচনীয় আইন। আমরা বিশ্বস্ত তাবেঈণদের মতো তা অনুসরণ করতাম। আব্বাকে ভয় পেতাম। যেমন ঠা ঠা করে হাসতেন সময়ে, রেগে গেলে যেন বজ্র নিনাদ। কিন্তু নিজের শৈশবভূমিতে ফিরে গেলেই আব্বার চেহারায় এক ধরণের উদাস অবয়ব। সে কী কেবল আমার চোখেই পড়ত?

শহর থেকে দূরে আমার দাদাবাড়ি। পাবনার চকদুবলিয়া, দোগাছি। আর জায়গাটার নাম মান্দারতলা। অনেক পরে নাম ভুলে যাওয়া এক গল্পের বইয়ে আমি জেনেছি মান্দার বা মাদার হলো পারিজাত ফুলের আঞ্চলিক নাম। আর পারিজাত হলো স্বর্গের ফুল।

মূল সড়কের ডান পাশে মান্দার গাছ। তার ঠিক বায়ে ঢাল ধরে নেমে যাওয়া মাটির রাস্তায় রিকশা নামিয়ে দিলে যেখানে সমতল, সেখানেই আমার দাদাবাড়ি। আমরা গেলেই আশপাশ থেকে রাজ্যের মানুষ এসে ভিড় জমাত সেই বাড়িতে। আর রিকশা থেকে না নামতেই দাদী এসে মাথায়, শরীরে হাত বুলিয়ে দিতেন।

পালা-পার্বন ছাড়া একমাত্র কোরবানী ঈদে আমরা নিয়ম করে পাবনা যেতাম। সেই ভ্রমণটা ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রতিবার কিছু না কিছু ঘটত। আমি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে পড়তাম। সড়ক দূর্ঘটনার খবর তাই যাত্রাপথে আমাকে ঘুরেফিরেই মাথায় টোকা দিত। যেন এক ত্র্যহস্পর্শ! সেই অশুভ যোগের বাতাস কেটে যেত আরিচা ফেরি ঘাটে এসে।

আর একটু যখন বড়ো হলাম, যে বয়সে নিজেকে বড়ো ভাবি কিন্তু আশাপাশের মানুষ আদতে খুব একটা পাত্তা দিতে চায় না, সেই সময়ে একা হয়ে ফেরি ঘুরে বেড়ানো ছিল এক দর্শনীয় আড়াই ঘন্টার লিখে রাখা গল্প। এই ঝালমুড়ি, তিলের খাজা, নারিকেলের মিষ্টি খাজা অথবা পেয়ারা-আমড়া নিয়ে হকার ঘুরে বেড়াচ্ছে বিক্রির আশায়।

তখন যমুনা নদী পানিতে উত্তাল। অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে…গান থেকে উঠে আসা যেন! ফেরির নামগুলো আমার এখনও মনে আছে। শাহ মখদুম, শাহ পরাণ। পারাপার হতে চাওয়া বাস উঠে যেতেই বিকট আওয়াজ করে ফেরি চলতে শুরু করত। লোহা আর কংক্রিটের শক্ত সিঁড়ি বেয়ে আমি চলমান ফেরির দোতলায় উঠে যেতাম। সাথে কেউ না কেউ থাকত। চাচা, ফুপু, ভাই-বোন অথবা আম্মা-আব্বা। আর একটু যখন বড়ো হলাম, যে বয়সে নিজেকে বড়ো ভাবি কিন্তু আশাপাশের মানুষ আদতে খুব একটা পাত্তা দিতে চায় না, সেই সময়ে একা হয়ে ফেরি ঘুরে বেড়ানো ছিল এক দর্শনীয় আড়াই ঘন্টার লিখে রাখা গল্প। এই ঝালমুড়ি, তিলের খাজা, নারিকেলের মিষ্টি খাজা অথবা পেয়ারা-আমড়া নিয়ে হকার ঘুরে বেড়াচ্ছে বিক্রির আশায়। অথবা মুখ তুলে নদীর দিকে চাইতেই তীর ঘেসে হঠাৎ হঠাৎ দেখে ফেলা গাঙ্গেয় শুশুক। শুধু কালো পৃষ্ঠদেশ দেখা যেত। কেউ কেউ ‘শিশু, শিশু’ বলে চিৎকার করে উঠত দেখে। তার তেল নাকি ছিল সর্বরোগের মহৌষধ। হকাররা হলুদ রঙের রাঙতা পেঁচিয়ে বোতলে করে বিক্রি করত। ফেরির একদম শীর্ষ প্রান্ত অনেকটা ছাদের মতো। মাঝখান ধরে বসার স্থান। রেলিং ধরে দাঁড়ালে সেখানে নদীর হু হু বাতাস। ঝাপটা দিয়ে এক একবার ফেলে দিতে চাইত। নাকি আদর করে নদীর বুকে টেনে নিতে চাইত আমাকে?

কত মানুষ যেত আরিচা হয়ে নগরবাড়ি ঘাটে? কোন গন্তব্যে? আমি দাঁড়িয়ে ভাবতাম। এমনও হতো বাসে বা ফেরিতে কারো সাথে আলাপ হয়ে যেত। কীভাবে যেন শিশুদের সাথে ভাব জমে যেত বেশি। একটা শিশুর কথা আমার এখনও মনে আছে। আমরা একই গন্তব্যে যাচ্ছিলাম, পাবনায়। ফেরি পার হয়ে বাসে বসেও গুটুরগুটুর করে আমার সাথে কত কথা তার!

ঢাকা থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হতো সকালের বাস ধরে। মধ্যপ্রহরে আমরা নদীর বুকে থাকতাম। গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত, ঝালঝাল মাংশ আর ডাল। এই ছিল ফেরিতে খাবারের মেনু। কত দাম ছিল? দশ টাকা/ পনেরো টাকা? এখন আর মনে পড়ে না। দাম নিয়ে তখন তো ভ্রু কুঞ্চন দিনও ছিল না। ফেরির তিনতলার এক বিশাল প্রকোষ্ঠে খুঁজে পাওয়া কোনো খালি টেবিলে বসে আয়েশ করে সেই ভাত খেতাম। আশেপাশেই একতারা বা হারমোনিয়াম নিয়ে গান গাইছে কেউ। এই যাত্রাসময়ে গায়ক যত বেশি মানুষকে পৌঁছে দিতে পারে তার গানের টংকার। আমি ভাত খেতে খেতে তাদের গান শুনতাম। কানে এসে নদীর ঢেউ দোলা দিত, দিতেই থাকত।

একসময় নিয়ম মেনে ঢেউয়ের ব্যস্ততা সে দিনের মত শেষ হতো। ফেরি এসে ভিড়ত নগরবাড়ি ঘাটে। একদল মানুষের এন্তার ব্যস্ততা শুরু হয়ে যেত তারপর। পাটাতন খুলে দিতেই রাজা-বাদশা অথবা পাবনা এক্সপ্রেস নামধারী বাহারী বাস ছুটে যেত নিজস্ব গন্তব্যে। কাশীনাথপুর, বেড়া পেরিয়ে পাবনা সদর। তারপর অনন্ত সিনেমা হল আসতেই আমরা সদলবলে নেমে রিকশা ধরতাম। পাবনার ছাওয়াল আব্বাকে চিনে ফেলত সবাই। ত্রি-চক্রযানে উঠে গন্তব্য বলার প্রয়োজন পড়ত না তাই।

আরিফপুর গোরস্থান পার হতে হতে আমার মনে হতো পথ কেন শেষ হয় না। আমি থামতে চাইতাম তখন। রিকশা থামত না। এবড়ো-থেবড়ো ইট সুড়কি পথ ধরে সারি বেঁধে এগিয়ে যেত। মিনিট বিশেক পর দোগাছি ইউনিয়ন। একটা সোজা রাস্তা চলে গেছে সুজানগরের দিকে আর বায়ে ধরে মিনিট পনেরো গেলেই মান্দার তলা।

তার আগ দিয়ে খয়েরসুতি। কী সুন্দর নাম! তখন এই সৌন্দর্য কেন পাইনি আমি!

৩.
এইসব যোজনগন্ধা স্মৃতি আমি লিখতে লিখতে ধরি। ধরতে ধরতে যাই। আর দাদাবাড়ি পৌঁছে যাত্রাধকল সয়ে আব্বাকে দেখতে পাই। দেখি একটা জল থৈ থৈ পুকুর, তার দু’পাড়ে শান বাঁধানো পরিপাটি ঘাট। পুকুরপাড়ের লাগোয়া জামগাছতলা। তার নিচে আলসী। আমার কানে এসে লাগে ‘আইলসে’। মাড় দেওয়া নতুন লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সেখানে আব্বা বসে আছেন। জুন-জুলাই এর গরম। জাম গাছের নিচে দু’দন্ড জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসত। সেই উদাস ভঙ্গি। কোথায় যেন তাকিয়ে আছেন! একটু পরেই আশেপাশের গ্রাম থেকে একদল মানুষ সেই আলসীতে এসে বসে। আর আমরা দাদাবাড়ির আঙ্গিনায় ঠিক কি যে চাই খুঁজে বেড়াই আনন্দে ছুটোছুটি করি। দাদা, দাদী, চাচা,ফুপু আর নাম মনে রাখা আত্মীয়-স্বজন ততক্ষণে হাল ছেড়ে দিয়ে হাসিমুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।

মাড় দেওয়া নতুন লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সেখানে আব্বা বসে আছেন। জুন-জুলাই এর গরম। জাম গাছের নিচে দু’দন্ড জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসত। সেই উদাস ভঙ্গি। কোথায় যেন তাকিয়ে আছেন!

রোদ ধরে এলেই আমি ছোটো চাচার ‘ফোনিক্স’ সাইকেলে চড়ে টাউনে যাব। সেখানে গিয়ে প্যারাডাইস সুইটমিটে রাজভোগ আর ঝুড়ি-বুন্দিয়া, যতক্ষণ হাঁসফাঁস না লাগে। ফিরে এসে যদি রাত হয়ে যায় তাহলে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। রাত নয় আসলে সন্ধ্যা হয়ে গেলেই। সকালে উঠে খাগড়াই কিনতে বেরিয়ে যাই, এক বা দু টাকার অনেকগুলো। গুড় দেওয়া এক অদ্ভুত জিনিষ। রাতে জোনাক পোকা নেমে আসে শয়ে শয়ে। আমি একটা দুটো মুঠোয় ধরে অবাক বিস্ময়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকি।

সেই জোনাক পোকাও আমাকে দেখে বিস্মিত হয়। শহর থেকে অনেক দূরে এক অপার্থিব ময়ূখ আমাদের আলিঙ্গন করে রাখে, অন্তরালে।

৪.
তারপর ভাবুক শীর্ণ ছেলেটা শহরে ফিরে আসে। দ্বিধারু মন তার। কিন্তু মনের দিকে ঝুঁকে ভাবতে বসলেই তার দ্বিধা আর ভীরু মন এক শান্ত তরঙ্গ খুঁজে পায়। অবগাহনে হয়তো মণি মুক্তো উঠে আসে না, কিন্তু তাতে কী! সেই রূপকথার পথে প্রান্তরে আনন্দের উপকরণও তো ঢের! জোনাক পোকার আলো, জনকের উদাস কিন্তু প্রসন্ন মুখ, মান্দারতলার দাদাবাড়ি আর ফেরিতে করে পাড়ি দেয়া উত্তাল যমুনা নদী।

এইসব নিয়ে কেউ একজন মাথার ভেতর কথা বলে তার সাথে। এক চিলতে বারান্দায়।

শহরে ফিরে এসে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৭৫, ১৫ আগস্ট। বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাপ্পা মজুমদারের রাতের ট্রেন অ্যালবামে প্রথম লিরিক : বিশ্বাসেতে বস্তু মেলায়। পরী, বৃষ্টি পড়ে, ফিরে পেতে চাই, মার ঘুরিয়ে (আই সি সি ২০১১ বিশ্বকাপ ক্রিকেট এর থিম সং), সবুজ যখন, খোলা আকাশ একটি গাছ- উল্লেখযোগ্য গান। গীতিকার হিসেবে বিলেতের সংহতি সাহিত্য পুরষ্কার পেয়েছেন ২০১৫ তে। এবারডিনশায়ার এর ডেভেরন আর্টস এ গান লেখার গল্প বলায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ২০১৬ তে। প্রকাশিত বই : ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে’, ‘কবির তখন সওদাগরী মন’, ‘রুল টানা খাতা’, ‘টুকরো নাগরিক জার্নাল’, ‘শব্দ পাখির দল’, ‘ম্যারাডোনা’ (অনুবাদ), ‘কবিতার পোস্টকার্ড’ এবং ‘টুকরো নাগরিক জার্নাল’ (দ্বিতীয় পর্ব)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।