বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

সতেরো বছর— বাবা তোমাকে দেখি না : মৌলি আজাদ

0

প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার কন্যা মৌলি আজাদ লিখেছেন এই স্মরণাঞ্জলি। লেখকের সতেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আমাদের শ্রদ্ধা।


সতের বছর হয়ে গেল বাবা নেই। মনে হয় এই তো সেদিন, কিন্তু তাই কী? পেছনে ফিরে দেখি— না সেই দিন নয়। অনেক দিন, মাস, বছর এরই মধ্যে গড়িয়ে গেছে। খালি পড়ে আছে তাঁর বসার সেই কাঠের চেয়ার। লেখার টেবিলে পড়ার বইগুলো। বইগুলো দেখে মনে হয় তারা এখন অবসরে আছে যেন। না— লেখার টেবিলে কোন কাগজ নেই। না থাকাই তো স্বাভাবিক, তিনি তো কাগজে লিখতেন না লিখতেন কম্পিউটারে। কম্পিউটারটি ব্যবহার না হতে হতে নষ্টই হয়ে গেছে। আমার মা তাঁর ব্যবহৃত কোন জিনিষ ফেলে দেন নি। সাজিয়ে রেখেছেন, ধুলো মোছেন এখনও। তাঁর লেখা বইগুলো তাঁর পড়ার রুমে সারি সারি সাজানো। তিনি নেই কিন্তু বইগুলোর আজও পুনর্মুদ্রণ হচ্ছে। বইগুলোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি। মনে হয় আসলে মানুষই শেষ পর্যন্ত থাকে না। জড়বস্তু গুলো তো রুমেই রয়ে গেছে।


হুময়ুন আজাদ

হুময়ুন আজাদ


হাতে তুলে নেই বাবার লেখা ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটি। ‘আমার অবিশ্বাস’ বইয়ের শেষ দুই পাতা প্রায়ই আমি উল্টেপাল্টে পড়ি— হয়তো আমারো দিন দিন বয়স বাড়ছে বলেই।

বাবা ‘আমার অবিশ্বাস’ বই এ লিখেছেন ‘মৃত্যু কাকে বলে? মৃত্যু হচ্ছে জীবনপ্রক্রিয়ার উল্টানো অসম্ভব পরিসমাপ্তি; আর ফেরা নেই, আর অগ্রগতি নেই; চিরকালের জন্য থেমে যাওয়া। যে ছিল সে আর নেই; আর সে নিশ্বাস নেয় না, তার শিরা কাঁপে না, আলো তাকে আর চকিত করে না, আঘাত তাকে আর ব্যথা দেয় না’।

‘আমি জানি, ভালো করেই জানি, কিছু অপেক্ষা করে নেই আমার জন্যে; কোনো বিস্মৃতির বিষণ্ন জলধারা, কোনো প্রেতলোক, কোনো পুনরুত্থান, কোনো বিচারক, কোনো স্বর্গ, কোনো নরক; আমি আছি, একদিন আমি থাকবো না, মিশে যাবো, অপরিচিত হয়ে যাবো, জানবো না আমি ছিলাম। নিরর্থক সব পুণ্যশ্লোক, তাৎপর্যহীন সমস্ত প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি; মৃত্যুর পর যেকোনো জায়গায়ই আমি পড়ে থাকতে পারি— জঙ্গলে, জলাভূমিতে, পথের পাশে, পাহাড়ের চূড়োয়, নদীতে, মরুভুমিতে, তুষারস্তুপে’।

বইয়ের এ লাইনগুলো পড়ার পর নিজেকে প্রশ্ন করি আসলেই কী বইগুলোর জীবন নেই— এগুলো দুই মলাটে বন্দি কিছু কাগজ কেবল! বাবা এমনভাবে লিখতেন যেন মনে হয় সাদা কাগজের উপরে কালো কালির লেখাগুলো উঠে এসে আমাকে বলছে ‘এটাই সত্য মৌলি এটাই সত্য’। কী করি আমি এখন! বইয়ের লেখাগুলো আমাকে শান্ত হতে দেয় না। অস্থির করে তোলে। তাই বইটা নেড়েচেড়ে বুকসেলফে রেখে দেই।

বুক সেলফ থেকে তুলে নেই আরেকটা বই— ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না’। বইটি হাতে নিয়ে পড়তে থাকি।

বইয়ের শুরুতেই লেখা ‘মৌলি তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি এক সময় ছিলাম— ছোটো। ছিলাম গ্রামে, গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে সাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলুদ ফুল।

বইয়ের শুরুতেই লেখা ‘মৌলি তোমাকে বলি, তোমার মতোই আমি এক সময় ছিলাম— ছোটো। ছিলাম গ্রামে, গাঁয়ে, যেখানে মেঘ নামে সবুজ হয়ে নীল হয়ে লম্বা হয়ে বাঁকা হয়ে। শাপলা ফোটে; আর রাতে চাঁদ ওঠে সাদা বেলুনের মতো। ওড়ে খেজুর ডালের অনেক ওপরে। যেখানে এপাশে পুকুর ওপাশে ঘরবাড়ি। একটু দূরে মাঠে ধান সবুজ ঘাস কুমড়োর হলুদ ফুল। একটা খাল পুকুর থেকে বের হয়ে পুঁটিমাছের লাফ আর খলশের ঝাঁক নিয়ে চলে গেছে বিলের দিকে। তার ওপর একটা কাঁঠের সাঁকো— নড়োবড়ো। নিচে সাঁকোর টলমলো ছায়া। তার নাম গ্রাম।’


হুময়ুন আজাদ ২

কবি হুমায়ুন আজাদ ও কবিকন্যা মৌলি আজাদ


বইয়ের লাইনগুলো থেকে চোখ ফেরালেই মনে পড়ে যায় তাঁর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় কাটানো দিনগুলোর কথা। বাবা খুব খুব বেশি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। ক্লাস-পড়াশোনা-বই-আজিজ মার্কেট-সোহরাওয়ার্দি উদ্যান ঘিরে ছিল তাঁর জীবন। বিলাসবহুল জীবনের প্রতি দেখিনি তাঁর আগ্রহ। কোনো বড়ো পার্টি, ডাকসাইটে ব্যক্তি ভরা ঝকঝকে রেস্টুরেন্টের নেমতন্ন তিনি অবলীলায় এড়িয়ে চলতেন। দামি কোন খাবারের প্রতিও দেখিনি কোনো আকর্ষণ। বিদেশ ভ্রমণের প্রতিও ছিল না কোনো আগ্রহ তাঁর। শুক্রবার মানেই ছিল তাঁর রাঢ়িখালে ভ্রমণ। বিলেতের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। বেশ কয়েকবছর ছিলেনও সেখানে। কিন্তু সেখানকার গল্প খুব একটা তাঁর মুখে শুনেছি বলে মনে পড়ে না আমার। তাঁর কাছে গল্প শুনতে চাওয়াই মানে সেই রাঢ়িখালের গল্প। রাঢ়িখালের পুঁটি মাছ, সর দিয়ে দুধ ভাত, বাড়ির সামনের পুকুরের কচুড়িপানা, বারেক মিয়া গল্প শুনতে শুনতে মাঝেমধ্যে বিরক্ত যে সে সময় হতাম না— তা নয়। রাঢ়িখালের গল্প যেন তাঁর শেষ হতো না। সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। সেখানেই যে শুরু তাঁর। জীবনের শেষেও রাঢ়িখালের মাটিতেই তো মিশে আছেন তিনি।

তরুণ ও সাংবাদিককেদের সান্নিধ্য তিনি দারুণভাবে উপভোগ করতেন। তর্ক করে কি যে মজা পেতেন! অবশ্য তাঁর সব তর্কে থাকত যুক্তি ও নানান রেফারেন্স। যাদের মধ্যে পুরনো, অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা দেখতেন এড়িয়ে চলতেন তাদের। মনে পড়ে তাঁর সময়জ্ঞানের কথা। সকাল ১০টা মানে সকাল ১০টা, বিকেল ৫টা মানে ৫টা। বাবার সাথে বিয়ে বাড়িতে যথাসময়ে উপস্থিত হয়ে পরিচিত কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাম বিরক্ত। যেকোনো নেমন্তনে তাঁর লেখা বই উপহার দিতেন। অনেকের সে সময় এ ‘উপহার’ পছন্দ হতো না হয়তো। কিন্তু একদিন এক জায়গায় আমি বেড়াতে গিয়েছি— তাঁর এক অনুরাগী এসে আমাকে বললেন ‘স্যার, আমাকে বিয়েতে ‘সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে’ বইটি উপহার দিয়েছিলেন। তখন বুঝিনি কি পেলাম। আজ প্রায়ই বইটি পড়ি। স্যারের অটোগ্রাফে হাত বুলাই আর ভাবি এতো দামি উপহারের কি আমি যোগ্য’। তাঁর অনুরাগীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি আমি।

বাবা নেই ১৭ বছর— নিজের কাছেই বিশ্বাস হয় না। একসময় তিনি না থাকলে কিভাবে তাঁকে ছাড়া বেঁচে থাকব সেই চিন্তে করতাম। কিন্তু এখন তাঁকে ছাড়া দিব্যি দিন পার করছি! যখন একা থাকি মনে হয়— বাবা নিজেও তো লেখার বাইরে আমাদের নিয়েই (সন্তানদের) চিন্তা করতেন। মৃত্যু সে চিন্তা থেকে তাঁকে মুক্ত করেছে।

বাবা নেই ১৭ বছর— নিজের কাছেই বিশ্বাস হয় না। একসময় তিনি না থাকলে কিভাবে তাঁকে ছাড়া বেঁচে থাকব সেই চিন্তে করতাম। কিন্তু এখন তাঁকে ছাড়া দিব্যি দিন পার করছি! যখন একা থাকি মনে হয়— বাবা নিজেও তো লেখার বাইরে আমাদের নিয়েই (সন্তানদের) চিন্তা করতেন। মৃত্যু সে চিন্তা থেকে তাঁকে মুক্ত করেছে। এভাবেই হয়তো বুঝি দুনিয়া চলে! দেয়ালে ঝোলান তাঁর ছবির দিকে চোখ পড়ে আমার। কত সময় চলে গেছে যেন হাওয়ায় ভর করে। ঝাপসা হয়ে আসছে কী তবে তাঁর চেহারা আমার চোখে? বুঝতে পারি না।

চারপাশের নিস্তব্দতা ভেঙ্গে গলা ঠেলে বেড়িয়ে আসতে চায় ‘বাবা’ ডাকটি। মনে হয় এখনই হাফ শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরে ঘরে ঢুকেই তিনি বলবেন— ‘মৌলি এককাপ চা বানা তো’। অলৌকিক সে আওয়াজ কেবল আমিই শুনতে পাই যেন। যতদিন বেঁচে আছি অলৌকিক সে আওয়াজ আমার কানে বোধহয় বেজে চলবে।

বাবা খুব বেশি পরিবার কেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন না। কখনো তাঁর মুখে শুনিনি পুত্র-কন্যার নতুন জীবন নিয়ে চিন্তার কথা। সে চিন্তার ভার মা-ই বোধহয় নিয়েছিলেন। আজ পরিবার বড়ো হয়েছে। বেঁচে থাকলে ‘নানা’ ডাক শুনতে পেতেন তিনি এখন। আমি মাঝেমাঝে ভাবি— কেমন হতো এ ডাকের পর তাঁর রিঅ্যাকশন। নিশ্চয়ই ভালো। শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। নিশ্চয়ই তাঁর নাতি নাতনিদের জন্য লিখতেন ছড়া। তাদের নামও হয়তো তিনিই রাখতেন। কি জানি, কেমন হতো তাদের সাথে তাঁর সর্ম্পক?

আমার ছেলে শাইনির হাতে তুলে দিয়েছি তাঁর নানার লেখা বই ‘আব্বুকে মনে পড়ে’। ছেলেকে কোনো বই পড়তে দিলে তার পাঠপ্রতিক্রিয়া আমি জানতে চাই। একদিন বসে আছি। ছেলের মুখ থমথমে। আমার কাছে এসে ভেজা কন্ঠে বলল মা ‘আব্বুকে মনে পড়ে’বইটি শেষ করলাম। তার কেমন লেগেছে বইটি— জানতে আমার নিজেরই বুক কাঁপছিল। আমি প্রশ্ন করিনি। ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘মা, তোমার বাবা এতো ভালো লিখতেন?’

কী বলব— আমি তাকে! হ্যাঁ তিনি যে খুব ভালো লিখতেন। কিন্তু তাকে বাঁচতে দেয়নি কিছু মানুষের মতো দেখতে আর্বজনা। ছেলেকে কিছু বলি না আমি। সময়েই সে তার নানাকে জানতে/বুঝতে শিখবে।

২০০৪ সালে আক্রান্ত হওয়ার পরও নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভয়ে ছিলেন না তিনি, কিন্তু আমাদের কি হবে সেই ভেবে ছিলেন অস্থির। এরপর উড়ে গেলেন জার্মানি ও সেখানেই তাঁর মৃত্যু। তাঁর শেষ শয্যা হলো তাঁর সেই প্রিয় রাঢ়িখালে।

২০০৪ সালে আক্রান্ত হওয়ার পরও নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র ভয়ে ছিলেন না তিনি, কিন্তু আমাদের কি হবে সেই ভেবে ছিলেন অস্থির। এরপর উড়ে গেলেন জার্মানি ও সেখানেই তাঁর মৃত্যু। তাঁর শেষ শয্যা হলো তাঁর সেই প্রিয় রাঢ়িখালে। মহামারীর কারণে রাঢ়িখালে ইদানিং আমাদের যাওয়া হয় খুব কম। যখনই যাই তাঁর শেষ শয্যাপাশ থেকে ফেরার সময় কে যেন পেছন থেকে ডাক দিয়ে আমাকে বলে— ‘চলে যাচ্ছিস, ভালো থাকিস তোরা’।

মাটির সাথে পা আটকে যায় যেন আমার— জানি পেছনে কেউ নেই। আমি কেবল শুনতে পাই বাবার কন্ঠস্বর ‘ভালো থাকিস তোরা, ভালো থাকিস। খুব সাবধানে থাকিস’। অলৌকিক স্টিমারের মতো সে এক অলৌকিক কন্ঠস্বর— যা আমার কানকে দেয় শান্তি কিন্তু চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ে অশ্রু।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হুমায়ুন আজাদ কন্যা। উপপরিচালক : ইউজিসি।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।