মঙ্গলবার, মার্চ ১৯

স্বেচ্ছামৃত্যু : প্রসঙ্গ কবি শামীম কবীর :: ফারুক সিদ্দিকী

0

To be, not to be- That is the questions;
Whether ’tis nobler in the mind to suffer
The slings and arrows of outrageous fortune,
Or to take arms against a sea of troubles,
And by opposing end them ? To die, to sleep
No more; and by a sleep to say we end
The heart-ache and the thousand natural shocks
That flesh is heir to. ‘Tis a consummation
Devoutly to be wish’d. To die, to sleep;
To sleep perchance of dream. Ay, there’s the rub;
For in that sleep of death what dreams may come,
When we have shuffled off this mortal coil,
Must give up pause,

[Hamlet : Act-3, Scene-1]

হে মৃত্যু, সময় হলো! এই দেশ নির্বেদে বিধুর।
এসো, বাঁধি কোমর, নোঙর তুলি, হে মৃত্যু প্রাচীন!
কাণ্ডারী, তুমি তো জানো, অন্ধকার অম্বর সিন্ধুর
অন্তরালে রৌদ্রময় আমাদের প্রাণের পুলিন।

ঢাললা সে-গরল তুমি, যাতে আছে উজ্জীবনী বিভা!
জ্বালো সে-অনল, যাতে অতলান্তে খুঁজি নিমজ্জন!
হোক স্বর্গ, অথবা নরক, তাতে এসে যায় কী-বা,
যতক্ষণ অজানার গর্ভে পাই নূতন-নূতন!

[শার্ল বোদলেয়ার : ভ্রমণ : অনুবাদ / বুদ্ধদেব বসু]

 

তরুণ কবি শামীম কবীরের [জন্ম : ১৯ এপ্রিল ১৯৭১, মৃত্যু ০২ অক্টোবর ১৯৯৫] স্বেচ্ছামৃত্যু আমাদের কাছে ছিল একটি অপ্রত্যাশিত খবর। কী এমন বয়স হয়েছিল তার? তবু তো আত্মহত্যা সংঘটিত হয়ে থাকে এবং পৃথিবীতে বছরে গড়পড়তা এক হাজার জন আত্মহত্যা করে জীবনের চূড়ান্ত অবসান ঘটায়। সংখ্যাতথ্য সম্পর্কে পণ্ডিতদের দ্বিমত আছে। তবে হরিপদ ভট্টাচার্য প্রায় আট বছর আগে জানিয়েছিলেন যে, ‘ফতোয়াবাজদের উৎপাতে বিগত তিন বছরে [বাংলাদেশে] প্রায় দুই হাজার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে’… (সাপ্তাহিক কাগজ ২২ নভেম্বর ১৯৯৪]। সাম্প্রতিক সময়ে ‘দৈনিক প্রথম আলো’ [১ নভেম্বর/ ২০০০] কাগজে ছককেটে বাংলাদেশের একজন গবেষক তাঁর পরিসংখ্যানে উল্লেখ করেছিলেন, ‘লক্ষ করা যায় অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলেই এসব ক্ষেত্রে আত্মহত্যা বেশি সংঘটিত হয়।’ তাছাড়া দেখানো হয়েছে ‘সমাজের উদাসীনতা’ [এক্ষেত্রে আত্মহত্যাকে কেউ কোনো অপরাধ বলে মনে করে না।] ও অনুকরণ [অন্যকে বিষপান করতে দেখে নিজে বিষপানে আত্মহত্যা]। সত্য তবে পুরোনো কথা। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাই নানাবিধ কারণে আত্মহত্যা করে বেশি; সে তুলনায় নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা কম। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা জীবনসংগ্রামে ক্রমবিবর্তিত অনিশ্চয়তা, হতাশা, অনির্বাহ-অস্থিরতা টানাপড়েন অতি সহজে বাহুলগ্ন করে নিতে পারে; চলার পথে সহজে মেনে নিতে পারে; তাদের পরাজয়।

উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকেরাই নানাবিধ কারণে আত্মহত্যা করে বেশি; সে তুলনায় নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা কম। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা জীবনসংগ্রামে ক্রমবিবর্তিত অনিশ্চয়তা, হতাশা, অনির্বাহ-অস্থিরতা টানাপড়েন অতি সহজে বাহুলগ্ন করে নিতে পারে; চলার পথে সহজে মেনে নিতে পারে; তাদের পরাজয়।

নিম্নবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা পরিপার্শ্বের কদর্যতার দুঃসহ ভঙ্গি মনঃসমীক্ষণে আত্মহননের কথিতচিত্র গড়ে তোলে না; অন্তর্বেদনায় দুঃসহ জীবনযাপনের অন্তর্গত সে আখ্যানটুকু নিয়তিতাড়িত, সমাজে তার প্রতিবিধান নেই, পক্ষান্তরে তার বশ্যতাস্বীকারও স্বভাবগত, সেখানে আকস্মিকতার মধ্যবর্তী শর্টকাট পথের কথা তাদের জানা নেই, যদি না অনর্থ ‘উৎপাতের’ শিকার তাদের আপাতবিরোধময় জীবনের ভূত-ভবিষ্যৎ কখনো লাঞ্ছিত ও বিপর্যস্ত না করে। তাদের জীবনসংগ্রামে শুধু বেঁচে থাকা ব্যতিরেকে নিরতিশয় কোনো অর্থও নেই, তবে দুঃখ কষ্টে কায়ক্লেশে বেঁচে-বর্তে থাকারও অন্তরালে নিবিড় বেদনাসঞ্চারী হয়েও আত্মিক শক্তির বিশ্লেষণে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে এক ধরনের লড়াইয়ের মনোবল যেখানে বস্তুবিশ্ব, বিপুল বিশ্বায়নের নতুন নতুন হাতছানি কখনো ধরা পড়ে না। নিরন্নের মনকে এজন্য পীড়িতও করে না। দেশের যারা অধিকাংশ, অপিচ জাতির মেরুদণ্ড, তাদের বেঁচে থাকার জন্য আবেগের স্বরূপ ও তার কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্যরূপ অঙ্গাঙ্গিভাবে মিলেমিশে জীবনের আলোছায়া কখনো সংশয় নিরাকরণে সৃজ্যমান নয়; এই একাত্মতার অভাবে মধ্যবিত্ত জীবনহরণ করে না; কেননা সে মনোবল অন্তত অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত তাদের শ্ৰেণীচৈতন্যেই আছে। উল্লেখ্য, এ-ধরনের বক্তব্য পাওয়া যায় চার দশক পূর্বে মার্কিন দেশের এক পরিসংখ্যানে; উপলব্ধি করা যায় যে মানুষের স্বভাবের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি; সেখানে বলা হচ্ছে … ‘success must be synonymous with life. They play life’s game hard, for the height stakes. And the loss of success, like the loss of face, makes life unbearable. Statistics point to suicides frequent among the wealthy, often educated men and women. This indicates that money and prestige may not be answer … who pull life’s final trigger do not knowing well that this is the most abhorrent crime of man.’ [Time : February 24, 1958]। অবশ্য আত্মহত্যার অনেক কারণও থাকতে পারে; যথা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র বিপ্লব আত্মহত্যার পরে তাঁর পকেট থেকে পাওয়া একটি চিরকুট কাম্যুবর্ণিত দার্শনিক সমস্যা যা অস্তিত্বের একনিষ্ঠ প্রবল প্রতিপক্ষের সুন্দরভাবে সমরূপে উল্লেখ করেছেন; ‘আমি জানি না, আমার মতো এমন আনন্দে কেউ কখনো মারা গেছে কিনা’ দ্রষ্টব্য ‘এক। তরুণের আত্মহত্যা’ বিষয়ে জাহিদ রহমান প্রাবন্ধিক থমসনের আত্মহত্যা সম্পর্কিত মন্তব্যের উদ্ধৃতি দেন : কোনো প্রকার ঝঞাট এড়িয়ে যাওয়া কাপুরুষতা, যদিও এটা সত্য যে, সাহসীরাই আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করে, কিন্তু সে এটা করে কোনো মহান কর্ম বাস্তবায়নের জন্যে নয় বরং কোনো খারাপ ঘটনা এড়ানোর জন্যে। [খবরের কাগজ / ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪]। এ তো সত্য যে কোনো ধরনের ট্রাজেডিতে ভরা এই বিশ্ব, সত্য নির্দয়, গাঁধি বলেছিলেন, অবশেষে তাকে ভালোবাসতেই হয়। গাঁধির এ-ধরনের সত্যদর্শন, ‘সকলের কাছে সমান; … সত্য আমাকে অধিকার করে, আমি সত্যকে অধিকার করি না।’ অপরদিকে গাঁধির দর্শন শামীম কবীরের কবিতার ফর্ম বা অঙ্গপ্রকরণের ক্ষেত্রে মাত্রানির্দেশে সত্য হয়ে ওঠে; একজন যথার্থ রূপদর্শী কবির কাছে এটি অন্তর্দর্শনে আজ্ঞাবহ ও প্রতিফলিত। শামীম কবীরের স্বেচ্ছামৃত্যু কী বলে দেয় না জীবনের দিনানুদৈনিক ভাবনার্গিটে জড়িত প্রথানুগত যে সুখ ও আনন্দের বিমর্শ ইতিবৃত্ত, প্রেম ও ঘর বাঁধবার সাধ সেখানেও নির্বেদ ও বিষাদগ্রস্ততা চারিত করে কখনো প্রমাণ করার জন্য যে মানুষের আকাঙ্ক্ষিত জীবন অন্য কিছু নয়; পক্ষান্তরে, আপতিকভাবে হয়ে ওঠে প্রত্যর্থী, খুনসুটি, অর্থহীন ভঁড়ামি? এখনো আত্মহননের যৌক্তিক তত্ত্ব মনোবিজ্ঞানী দিতে পারেননি তেমনি কবির আবেগের বিমূর্ত কল্পতরু সম্পর্কেও নিশ্চুপ। তবে কবিতা তথা সংস্কৃতির সব অঙ্গ যে পীড়িত ও পরাজিত মনের ইচ্ছাপূরণ এ সম্বন্ধে ফ্রয়েড-ভক্তদের সংশয়মাত্র নেই। অপরদিকে লক্ষণীয়, অটো র‌্যাঙ্ক বলেছেন, virtually everything wrong with man results from the painful experience of birth i.e. rein on Otto Rank; by 1923, Freud accepted the dedication of The Trauma of Birth … ‘মাতৃগর্ভের নিরাপদ পরিশ্রমহীন একটি আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেও সে বারবার ওখানে ফিরে যেতে চায়। “আমি এই ‘ট্রমা’ থেকে মুক্তির জন্য যা করি তার বাইপ্রোডাক্ট আমার লেখা।” অমিয়ভূষণের মানসিক আঘাত থেকে যেমন সৃষ্টিশীলতার উৎস, তেমনি শামীম কবীর দেখেছে জীবনের বিচলিত জটিলতা অথবা যে মাতৃস্নেহের দিকে আকর্ষণ, স্ববিরোধীসম্পাত, সত্তার ক্লীব ও রক্তাক্ত দ্বন্দ্ব বারবার তার কবিতায় বিন্যস্ত হয়েছে, উদাহৃত হয়ে এসেছে পরিণত ও পরিণতি আত্মহননে। কবি অস্বভাবী, কবির ‘পীড়িত ও পরাজিত মনে’ রুগ্ণ বাস্তব পৃথিবী হানা দেয়, বহির্জগৎ ও পরিপার্শ্ব অনেকখানি জায়গা করে নেয় এও সত্য,— কিন্তু আত্মহত্যা কেন যে কুহকীরূপে প্ররোচিত করে সে তত্ত্ব এখনো অমীমাংসিত। অকারণে আত্মহত্যার নজির আছে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে। আমরা দেখেছি সুখ যার শেষ মাইলফলক নেই’ সেখানেও আচমকা, অকারণে বাসা বাঁধে বক্ষ্যমাণ মৃত্যুচেতনা, যেন ‘অল ল্যাংগুয়েজ আর ডেড ল্যাংগুয়েজেস।’ মানুষ অন্ধকার মাতৃজরায়ণ থেকে এসে সে অন্ধকারের দিকে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই যায়, এ কথা মনোবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, ফলে অপ্রতিবিধেয় মৃত্যুবোধ সবার মধ্যে অলক্ষ্যে অস্তিত্বশীল সত্তাকে ভরে রাখে। ‘চাঁদ ডুবে চলে গেলে’ প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে ভয়ঙ্কর কুহকীতাড়িত মৃত্যুচেতনা কারো কারো নিকট ফলসা গাছের নিচে যেন অধিক রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে, অচেনা ‘mysterium iniquitatis’-এ পূজারী হয়ে হঠাৎ অর্ঘ্য নিবেদন করে। মনে পড়ে মিলটনকথিত [Paradise Lost] শয়তান যা কিনা চিরায়ত ঈশ্বরের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় এবং চিত্তাকর্ষক, তখন তার ব্যাখ্যা করা যায় না। ঈশ্বর সুন্দর অথচ কদর্য অসুন্দরের রূপ তার সৃষ্টিতে কেন বেশি? আইনস্টাইনের প্রশ্ন ছিল : ‘মহাবিশ্ব গঠনে ঈশ্বরের কতোটুকু স্বাধীনতা ছিল? মহাবিশ্ব সৃষ্টি করার সময় ঈশ্বরের কি অন্যরকম কিছু করার সম্ভাবনা ছিল!’ শাশ্বত সত্য সুন্দর বলে কিছু নেই, সব কুহকীর অঙ্গুলিনির্দেশের অনুমতিপ্রাপ্তমাত্র? তরুণ কবি শামীম কবীরের দ্বপীড়িত অনতিদীর্ঘ মানসিক অভিজ্ঞতায় কি ধরা পড়েছিল স্বকৃত একরাশ বিষণ্নতা, অসহায়ত্ব, দিনযাপনের ক্লান্তিকর জঞ্জাল, অডেন বর্ণিত : Become the whole of boredom, subject to / Vulger complaints like love, among the just / Be just; among the filthy filthy too —– I’

তবু শামীম কবীরের অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। বন্ধুদের কাছে সে বলত, সবাই বাঁচতে চায় কিন্তু মরতে চায় এ পৃথিবীতে ক’জন? জীবনধারণের ক্লেদাক্ত গ্লানির ভেতর ‘অন্তর্গত রক্তের ভেতরে’ ক্রমবিস্তারিত মৃত্যুবোধ, অহর্নিশ, যা পূর্বেই বলা হয়েছে নীরবে বিচরণশীল, অগোচরে নিয়ে যায় একদিন জেদী, বেপরোয়া উপযাচিতকে, যার আত্মহননের দিকে ধাবিত হবার মতো নিশ্চিত স্থির প্রবণতা বা ঝোঁক আছে।

তবু শামীম কবীরের অস্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। বন্ধুদের কাছে সে বলত, সবাই বাঁচতে চায় কিন্তু মরতে চায় এ পৃথিবীতে ক’জন? জীবনধারণের ক্লেদাক্ত গ্লানির ভেতর ‘অন্তর্গত রক্তের ভেতরে’ ক্রমবিস্তারিত মৃত্যুবোধ, অহর্নিশ, যা পূর্বেই বলা হয়েছে নীরবে বিচরণশীল, অগোচরে নিয়ে যায় একদিন জেদী, বেপরোয়া উপযাচিতকে, যার আত্মহননের দিকে ধাবিত হবার মতো নিশ্চিত স্থির প্রবণতা বা ঝোঁক আছে। কখনো সে নির্জনতা রহস্যখচিত, কায়াহীন অশরীরীতে নৈঃশব্দ্য পূর্ণ হয়ে আছে পরমাত্মীয়তায়। সেই উচ্ছল নিথর নির্জনতার ভেতর যতো দূর যাওয়া যায় হয়তো নিশিডাকের একটানা স্বর কেমন অভিভূত করে; মনে হয় তার বাৎসল্য স্বর ঝিল্লির মতো পাশ দিয়ে চলে। সে নিশিডাক অন্তরের কোনো এক নিভৃত ধ্যানলোকে সবাই নয়; মনোবিকারে কেউ কেউ টের পায়। তার স্বাদ কেমন তখন জানতে চায়। মাটি পৃথিবীর টানকে ছেড়ে যত উর্ধ্বে যাওয়া যায় দেখা দেবে কপোতাভ রশ্মিপাত, ক্রমে ক্ষীণতম নীল, রবি ঠাকুর জানাতে ভুলে যাননি, উদাসীন নীল তো আনন্ত্য আকাশ ও সাগরের প্রতীক; বন্ধনহীন নিরুদ্দেশ যাত্রার আস্পদ। তার স্নেহপটে যেমন থাকতে চায় কখনো এ জীবন, অন্তলোকে যখন বিচ্ছেদ বেদনার লিপ্ততায় যেমন কার জন্যে অদ্ভুত মায়াময় হয়ে ওঠে, রাত্রির গহিনতার মতো সেই অশরীরীর শরীর আবার একেবারে কালো নয়, অনুদ্দিষ্ট সুধাধবলিতও কখনো নয়— উভয়ের মিলেমিশে বৈপরীত্যে তৈরি; হয়তো-বা কালো, হয়তো কেমন এক হালকা উতরোল নীলাভ নীল; যার গায়ে কখনো কখনো লেগে থাকে শুভ ও সততার বিনষ্টি—তার বিকীর্ণ হাতছানি। সে কেমন করে কখন ডাক দেয় কোন জাদুমণিকে; ক্রমান্বয়ে চেতনার সম্পূর্ণ অবলুপ্তিতে; কোন্ সে প্রহরে, যে প্রহর যান্ত্রিক জীবনকে তথাকথিত চিরদিনের জন্য ভারমুক্ত করে, যখন জীবনযাপন এক ধরনের নিবার্সন’— যে ভার কোনোদিন ‘সহিবে না আর’, যে শোনে সে চলে যায় অজানিতের দিকে, নৈঃশব্দ্যের মদিরতা লাগা আচরের ভেতর, সে আচর অজানা থেকে যায় জীবিতের কাছে, বহিশ্চরের একখণ্ড আঙ্গিনায়: প্রাণনের এই পড়তি-ভূমিতে অগোচরে সে নিশিডাক অবিরত লেহন করছে। নৈঃশব্দ্যের অপার্থিব বাহুলগ্ন প্রাপিত উপাত্তটুকু লুলিত, সামসুম, তবে স্মৃতিহরা, সেখানে সৃষ্টির পুনরাবৃত্ত নঞর্থক-নির্দিষ্ট, অসচেতনের পরম সম্বোধন। নাতিদূরে নতুনের জন্য প্রতীক্ষা, স্বেচ্ছামৃত্যুর ভিন্নরূপ, তার স্পর্শলোভে আত্মহননের অচেনা মেরুযাত্রী! সেখানে বস্তুজগতের কোনো বাণী পৌঁছে না; কোনো কোলাহল নেই, নীরব, নিস্তব্ধ, নির্ভার— যতক্ষণ ‘আমি আপনার মনে একাকী’ ততক্ষণ অসীম বস্তুজগৎ ও তার প্রসারিত বাণী, হঠাৎ দুর্ভর হয়ে ওঠে। সেই অনাভাসিত ধূমলহর্ষক অন্তর্প্রবেশের ইশারা, কখনো তিথিযজ্ঞের গন্ধভরা অমোঘ নিশুতি ডাকে, আয় না রাতুল আমার! ঐ তো নাতিদূরে ধ্যানী জটাবুড়ি শূন্যতা, অনির্দেশ্য শূন্যতাময়, বিন্দু বিন্দু স্বল্পতম ফুটকি অনুজ্জ্বলতাময় এই জীবনপাত্র: ‘মরণকে বরণ করে’ একটানা মূক ঔদাসীন্যের ভেতর শুধু অপায়ন, বহির্গমন নেই; অত্বর স্বতোবিরোধ: অনড়, অথই ও অতল। আজকে বিচ্ছিন্নতা উদ্বেগ অবক্ষয়বাদী কবি যোসেফ ব্রোদক্সি যেমন বলেন, ‘আমার ভাবনা আমাদের অন্তর্লোক মূলত কৃষ্ণবর্ণ।’ হয়তো আলোহীনে এক ধরনের কৃষ্ণবর্ণ হয়তো বেদনায় বেদনায় অপার্থিব নীলাভ অথবা অনৈসর্গিক চারিভিতে বেদনাদায়ক কৃষ্ণকায়! আত্মহন্তার কাছে স্বাভাবিক ও যথার্থ এক প্রথা, বাইবেল ও পুরাণকথিত লাজারাস বা সীতার পুনর্বার পাতালে চলে যাবার মতন আত্মহননপ্রক্রিয়া, মনে করে দেয়।

কবির অস্তিত্বশীল সত্তা, ‘Conflict between creative sensibility and the world in which it can find no place.’ এ শিকড়হীন, যন্ত্রণাকাতর উন্মুল যে যুগযন্ত্রণা, স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে ক্রমে নিয়ে যায়, যার সাক্ষ্য একমাত্র সে নিজেই, অন্য কেউ হতে পারে না, অনিঃশেষ এক শিহরণ, অসম্ভব বেদনামথিত এক আনন্দ অপহারী চিত্ত-নিরোধ ধুধু প্রান্তর, যেখানে হয়তো ‘অসম্ভব বেদনার সঙ্গে মিশে রয়ে গেছে অমোঘ আমোদ’ —এই কী মর্মবাণী? কাম্যু বলেছিলেন: ‘আত্মহত্যা একমাত্র যথার্থ দার্শনিক বিষয়।’ শামীম কবীরের মানসিক অভিজ্ঞতা পোড়-খাওয়া জীবনের অভিজ্ঞতার অনুরূপ নয়, ঢাকাতে তরুণ আড্ডরু কবিদের সঙ্গে প্রধানত বায়েজীদ মাহবুবের সঙ্গে সময় কেটেছে, কখনো শিবলী মোকতাদিরের সঙ্গে, কখনো একা ঘরছাড়া হতে স্বেচ্ছাবৃত একাকিত্ব ভালোবাসতো, ভালোবাসতো বহির্চারিতার গোপন নকশা, মনে করি। আমার বাড়িতে ক’একবার এসেছিল, তরুণ হার্দ সৌম্য চেহারা, ফর্সা; হয়তো অত্যুক্তি হবে না গ্রিক ভাস্কর্যের সঙ্গে কখনো তুলনা করা যেতে পারে। কি তার মানসিক অভিজ্ঞতা? ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানবন্দিতে জেনেছি : ‘চিন্তার আশ্রয় মানসিক অভিজ্ঞতা।’ তরুণ কবি শামীম কবীর, অভিজ্ঞতায় কখন এসেছে মৃত্যুচিন্তা; আত্মহত্যার মতো এক নিষ্করুণ বিষয়? গল্পের নায়ক নীলমণি। [আত্মহত্যার অধিকার: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়] বেঁচে থাকতে চায় জীবনের নিরন্তর বিপর্যয়ে বিস্রস্ত, ক্লান্তির চরম প্রস্বর, বিধাতার অনিবার্য জন্মের বিধান, নীলমণি গভীর বায়ুস্তরের ভেতর থেকেও শ্বাসকষ্টে খাবি খায়, যা বেঁচে থাকার দুর্বিষহ এক দ্যোতনা, অন্তঃশীল মৃতপ্রায় এ বাতাবরণের ভেতর তার করুণ জীবনচর্চা। ক্রোধান্ধ ও সব সময় প্রশ্নবোধক! প্রত্যহের অপচয়, অর্থহীনতা অসুস্থতা প্রতিদিনকার নির্বচন, যুগযন্ত্রণা, উন্মত্ততা ও বিকার অপেক্ষিত Post-orgiastic- মূর্ত সময় আড়মোড়া ভেঙে আনুষঙ্গিক সমাধা চায় আত্মহত্যায়, সে আত্মধ্বংসীবোধ কবে থেকে তার একান্ত অন্তর্দেশে নীরব তুষানলের মতো অবিরাম জ্বলছিল, নিরুদ্বেগ সুখ পরিহরা— যে ছিল একদা আমাদের সহযাত্রিক, সহমর্মী, তরুণতম এক শুভানুধ্যায়ী, যার নাম শামীম কবীর* কবি ও ছোটোগল্পকার, তার সৃষ্টিকর্মের অন্তরাতে অতীন্দ্রিয়-সন্তাপ ধরা পড়েছিল; সে চিরদিনের জন্য রহস্য আর প্রহেলিকায় এখন বন্দি, কেউ জানে না মানবতন্ত্রীতে কখন রহস্যময় কোন অচেনা জগতের সতৃষ্ণ আহ্বান কারণে অকারণে এসে পড়ে? তাহলে কী শুধু সংযোজনযোগ্য তামস অন্ধকার ও বিভ্রমপ্রণোদিত অদ্ভুত রহস্যময় পটভূমি জেগে ওঠে? একদা হুইটম্যান যেমন বলেছিলেন: ‘আমার নিকট আলো আঁধারের প্রতিটি মুহূর্ত রহস্যময়, অনন্ত মহাকাশের প্রতিটি ইঞ্চিই রহস্যময়’ —এ অতলতার অতীন্দ্রিয় নিবিড় সাযুজ্য কবিকে আকর্ষণ করে, তখন, বোধ করি, ধুলোছড়ারঙের কাতর স্মরণ, নক্ষত্রবীথির সারিতে উঠে আসে কখন আধিদৈবিক মানসী, মনোজগতের স্মৃতি ধূসরবেলার সান্দ্রবিকেল, কোঁচনাকো শুষ্ক, ছেঁড়াপাতার আকীর্ণ মর্মর, কাচের জানালার পর্যটক কোন এক লিমবিকগ্রস্ততা! অন্যপিঠে, আত্মহত্যা কেন করব, —‘যদি প্রশ্ন করি কেন করব না, তবে উত্তরও পাওয়া যাবে না সঙ্গে সঙ্গে এবং সমস্ত কথাই তখন শেষ হয়ে যায়। তখন স্বেচ্ছামৃত্যুর কথাই মনে আসে। আত্মহত্যার বিষয়টি নিরুদ্যম, নির্বেদ তবু নিষ্কৃতিবিহীন অনুবর্তন ও বশীভূত, আপতিক ও উদ্ভট। শ্রেয় ছিল যার বিবেচনায় প্রধান, সেজন্য বুড়ো বটবৃক্ষের মতো আয়ু চাননি সেনেকা, good it is, তার প্রধান বিবেচনা ছিল, নিজে আত্মহননের পথে জীবনের অবসান ঘটান। ট্রাজেডিজড়িত বিশ্বময় সেনেকার চেতনা কতটুকু জায়গা নিয়ে আছে? তাহলে কেন একবিংশ শতাব্দীতে এ প্রস্তাবনা উঠে এসেছে… a god is partly evil? [Time : 10-06-1991]। অর্থাৎ ‘ঈশ্বর আংশিকরূপে অশুভ?’ আমরা জানি জীবনের কোনো এক মসীলিপ্ত পর্ব, বিঘ্নতাড়িতবোধ জীবনের সূচিপত্রে হয়ে ওঠে বিষণ্নতা, অসহায়ত্ব, একাকিত্ব, সাহায্যের জন্য কান্না’ ভারসাম্যহীনতা, আত্মবিরোধ সংঘাতে দোদুল্যমান। তার নিকট অসহায়ের মতো পরাস্ত হওয়া, বঞ্চিত হওয়ার অস্বভাবী প্রবণতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা অজানা এক সপ্রেম অগাধীয় কুহকীর হাতছানি অনেকের মতো শামীম কবীরকে একদা প্ররোচিত করেছিল। সে এক ধ্বংসের খরশান উত্তেজনা, অন্য অর্থে জীবনকে অনেকের মতে তীব্রভাবে অনুসন্ধান করার ভিন্ন প্রচেষ্টা, যেন নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনের মতে ধ্বংসের উত্তেজনাই একমাত্র সৃষ্টির উত্তেজনা।

সৃষ্টিবৈচিত্র্য আবেগ, হতাশা, বিসৃত দৈন্য কবিকে মথিত করে এজন্য মানসিকভাবে অনিকেত মাইকেলকে আত্মহত্যার চিন্তা আক্রান্ত করেছিল। একসময় কবিতা লিখেছিলেন মায়াকোভস্কি রুশ কবি সের্গেই এসেনিনের আত্মহত্যাকে ব্যঙ্গ করে কিন্তু মায়াকোভস্কি কি উদ্ধার পেয়েছিলেন? জানি, হেমিংওয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু চেয়েছিলেন কিন্তু আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে রোগযন্ত্রণা, অস্থিরতা থেকে উদ্ধার পান। তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুকে কি বলা যায়, ‘logical step to take’? সুমৃত্যু! জাপানী লেখক কাওয়াবাতার আত্মহত্যা রহস্যজনক। একি সামুরাই সংস্কৃতিপ্রসূত হারিকিরি প্রথা কিনা? তবে স্বপ্ন ও সম্ভাবনার প্ররোচনায় শান্তি যখন নিরুপাখ্য অধরা তখন কি কুহকীর অধিকারে চলে যায়? এ আপ্তবাক্য সব সময় সঠিক নয়। এত মস্ত বড়ো ট্রাজেডি, সংকট এবং মনঃস্থৈর্যহীন অবিবেচক সংকট, তার স্বরূপ একেবারে আলাদা। এ সময়ে সন্ত্রাস হত্যাকাণ্ড হাইজাক রাহাজানি অনবরত হচ্ছে, —এসবকে অন্তত necessity evil বলবে না কেউ কিন্তু সমাজ জীবনে এসব বলা বাহুল্য নিদারুণ ট্রাজেডি এবং সর্বোপরি সংকট নিয়ে আসে। সংসারবাসনাশূন্য তরুণ কবি শামীম কবীরের কখনো আর্থিক অসঙ্গতি ছিল না, যেমন ছিল পরিবার স্বজনহারা গল্পকার কায়েসের তদুপরি জীবনসঙ্গিনী ছিল অপ্রকৃতিস্থ তবে পিছনে ছিল কবিতা ও গল্পের অনুভবে সৃষ্ট জগৎ সেটুকু মনে করে কেউ উজ্জীবিত থাকতে পারল না কেন? ‘সংকটমাত্রই সমাধান আছে, এ একটা ভ্রান্ত ধারণামাত্র। এমন অনেক গাণিতিক প্রশ্ন আছে যার কোনো উত্তর নেই।’ [অশোক রুদ্র]। ট্রাজেডি এবং সংকট নানা প্রকারের সেজন্য যথার্থ উত্তরও নেই; আত্মহত্যা তদ্রুপ অন্যতম জটিল সংকট। ‘তবে একটি বিষয় প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দেখা যায় আত্মহননকারী কোনো প্রকার ইঙ্গিতে আগে থেকে স্পষ্টভাবে বলে না।’ [আত্মহত্যার অধিকার: আসাদুজ্জামান]। মনের এক নির্জন প্রদেশে মৃত্যুচিন্তা ভ্রমগ্ৰস্ত মনে বাসা বাঁধে, গোপনে, অন্যের গোচরীভূত নয়। অস্বভাবীর ব্যবহার সব সময় বিচিত্র, অদ্ভুত— এবং আত্মহননের অনিবর্তনীয় চমৎকার সময় আসে যখন তারা একাকী থাকে। জীবনে উচ্চাবচ পথে [লাইফ স্টাইল] কোনো কিছুতে যেন খাপ না খেয়ে চলাই পছন্দ। এ পর্যন্ত যতটুকু জানা যায় অধিকাংশ আত্মহননকারী মৃত্যুপূর্ব মুহূর্তে তীব্র উভয়বলতার [বিপরীতধর্মী শক্তির যুগপৎ বিদ্যমানতা] দ্বারা আক্রান্ত হয় যখন তারা অখণ্ড নির্জন একাকিত্বে থাকে; তখন ইচ্ছাপূরণে আসে মৃত্যু, ‘কামনা ও যাতনা অন্যোন্যনির্ভর’ যেন ‘আমিই চাকা, দেহ আমারই দলি!’ তখন নির্জন একাকিত্ব হন্তারূপে হানা দেয় কুহকী বোধ সদৃশ প্রেতপুরীতে।

কবিতা ফেরৎ চাওয়ার জন্য অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি কে? সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘এ তো আপনার দোষ। আপনি প্রায় আমাকে ভুলে যান। আমাকে কেন জানি না, মনে রাখতে পারেন না।’ এ কি তার দুঃখোক্তি, শোকাবেগ না রাগ? অনেক বন্ধুর ভিড়ের মধ্যে নাম পরিচয় তার জানা হয়নি। এ তো সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সে দিন সে আর কোনো কথাই বলেনি এবং পরে দেখাও হয়নি। এখন সে মরজগতে নেই, কিন্তু তার শেষ কথাগুলো আমাকে প্রায় হানা দেয়। তাকে কখনো ভুলে না যাই সেজন্য কি কথাগুলো সে বলেছিল?

যা হোক, সাত বছর আগের কথা। আমার বাড়িতে এসেছিল শামীম কবীর, তার কবিতাগুচ্ছ ফেরৎ নিতে। একা নয় তার সঙ্গে ক’একজন কবিবন্ধু ছিল। ইতঃপূর্বে শামীম কবীর আমার বাড়িতে অনেকে যেমন সময়ে সময়ে কিছুক্ষণের জন্য আড্ডা দিতে আসে তেম্নিভাবে হয়তো এসেছিল, কিন্তু তেমনভাবে পরিচয় ঘটেনি। কেননা সে কথা কম বলত, অন্তর্মুখী ছিল স্বভাবে। কবিতাগুচ্ছ আমি পেয়েছিলাম তার বন্ধু তরুণ কবি শিবলী মোকতাদিরের কাছ থেকে। তাই কবিতা ফেরৎ চাওয়ার জন্য অবাক হয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তুমি কে? সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘এ তো আপনার দোষ। আপনি প্রায় আমাকে ভুলে যান। আমাকে কেন জানি না, মনে রাখতে পারেন না।’ এ কি তার দুঃখোক্তি, শোকাবেগ না রাগ? অনেক বন্ধুর ভিড়ের মধ্যে নাম পরিচয় তার জানা হয়নি। এ তো সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সে দিন সে আর কোনো কথাই বলেনি এবং পরে দেখাও হয়নি। এখন সে মরজগতে নেই, কিন্তু তার শেষ কথাগুলো আমাকে প্রায় হানা দেয়। তাকে কখনো ভুলে না যাই সেজন্য কি কথাগুলো সে বলেছিল? মৃত্যুচিন্তা তার মনোজগতে তখন থেকে কি নিশ্চুপে এসেছিল? যদি তাই হয় তবে আমি তাকে কখনো ভুলিনি। সে এখন আমার স্মৃতিতে— স্মৃতিময়।

উল্লেখ্য প্রত্যেকে জীবনের কোনো একসময়ে নিজেকে খুন করার উৎকাঙ্ক্ষা করে। জীবনানন্দ জীবনকে দৈবে অর্থে বলেছেন আত্মিকনির্বাসন আর পৃথিবী হচ্ছে বস্তুত অনীশ্বর ‘নিবাসনভূমি’: ফুলকির হাপরযন্ত্রবিশেষ। সমুখে শান্তি পারাবার/এবার ভাসাও তরণী হে কর্ণধার/… মনে হয়, পৃথিবীতে যদি স্বেচ্ছামৃত্যু না থাকত তবে মানুষ, এ গ্রহের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মানুষ, হোমোসেপিয়ান প্রাতিস্বিক চেতনায় অবশ্যই এ বিনাশীপ্রক্রিয়া তৈরি করে নিত, অন্যকথায় যা এক স্বতোবিরোধ মোহনী পলায়নপর দুশ্চিকিৎস্য প্রবণতা, ধূসর ও অনিশ্চয়তাবোধক, বিবর্ণ ও ভয়াবহদ্যোতক।

*এক্ষেত্রে মনে পড়ে তরুণ বামপন্থীকবি ফেরদৌসুর রহমান রিটাকে [জন্ম: ১৫ ডিসেম্বর ১৯৬৮ : মৃত্যু ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৫]। তার প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘লালচিঠি’ [প্রথম প্রকাশ ১৯৯১]। তার জন্মস্থান বগুড়া জেলার গাবতলী থানার সাগাটিয়া গ্রামে; পরবর্তীকালে বগুড়ার পি টি আই লেনে বসবাস। তরুণ কবি ফেরদৌসুর রহমান রিটার সম্পাদনায় ‘জিজ্ঞাসু’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে কিন্তু দু’সংখ্যার পরে আর্থিক কারণে আর বের হয়নি। প্রগতিশীল বামপন্থী এ কবি বগুড়া পৌরসভার দু’নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার পদে বই প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু সফলতা আসেনি। অপরদিকে, বলা চলে, আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিল না, মধ্যবিত্ত ঘরের সাধারণ সহজ সরল ছেলে, অর্থসংকট থাকার কথা এবং সে অর্থসংকট উত্তরণের আন্তরিক প্রচেষ্টাই ছিল তার প্রধান জীবনসংগ্রাম। অবশেষে স্বেচ্ছামৃত্যু। তরুণ কথাশিল্পী কায়েস আহমেদের মতো ঢাকার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে সামান্য বেতনের শিক্ষকতার চাকরি নেয়। দিন চলছিল রিটার, স্বচ্ছলতা না আসুক লেখালেখির বাড়তি অবলম্বন। এবং মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হিসেবে মাথা গোঁজার ঠাঁই, অন্তত মেলে। তারপর একদিন দৈনিক কাগজ পড়ে জানা গেল, এই তরুণ বামপন্থী কবির লাশ শিবালয় থানা এলাকায় যমুনা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া যায় এবং মাতৃছায়া প্রি ক্যাডেট এন্ড হাই স্কুলের [মধুবাগ, ঢাকা] অধ্যক্ষ লাশটি সনাক্ত করেন।

 

প্রথম প্রকাশ : ‘বিপ্রতীক’ : ১৯৯৬/ পুনর্লিখিত : ২০০১


ফারুক সিদ্দিকীলেখক পরিচিতি :
ফারুক সিদ্দিকী ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক। ‘বিপ্রতীক’ নামে একটি অসাধারণ সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ষাটের দশক থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিরলসভাবে তিনি এই কাগজটি সম্পাদনা করে গেছেন। বাস করতেন বগুড়ায়। ছিলেন রুচিশীল এক মানুষ। সুদর্শন দেখতে যতটা, শুনতেও ছিলেন ততটা কর্ণসুখদায়ক। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নাম— ‘স্বরচিহ্নে ফুলের শব’। প্রবন্ধের বইয়ের নাম ‘তামসিক নিসর্গে ঈশ্বরনামা ও অন্যান্য’। ২০০৪ সালে তিনি পরোলোকগমন করেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।