বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

অন্ধকারের কোনো নিউরন নাই : শেখ লুৎফর

0

সন্ধ্যা হতে না হতেই তেঘরির জেলেপাড়াটার উপর জগতের সমস্ত অন্ধকার এসে হামলে পড়ে। অন্ধকার একটা রূপ। প্রভাব। তাই তিনঘর জেলেপাড়া তিরিশ বছরে তেতাল্লিশ ঘর ছুঁয়ে ফেলতে পারে। পেট আর যৌনাঙ্গের ব্যাকরণ ছাড়া এদের জীবনে অন্য কোনো অভিজ্ঞতা বিরল। চতুষ্পদী প্রাণীর সাথে এদের তফাৎ এই যে, এরা কথা বলতে পারে, দরকার মতো গালিগালাজ ও লাঠালাঠি করতে পারে। এই শর্তে এদের ক্রোমোজোম অন্ধকার প্রিয়। আজন্ম পেটের অন্ধকারের সাথে লড়াই করতে করতে মৎসজীবী এই মানুষগুলোর চোখ অন্ধকারেও কিছুটা দেখতে পায়। তাই তারা অনেকটা প্রকাশ্যেই আদিম। তাদের পেট ভরলে পিঠ-পাছা উদাম থাকে। আর গতর ঢাকলে কয়দিন আধাপেটে থাকতে হয়। তবু তারা একটুতেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। পাখির মতো একটুতেই জেগে উঠে। বলতে গেলে নদীর উপরেই জেলেপাড়াটা। চুরি হওয়ার মতো কোনো সম্বল নাই বলে শীত বাদে, সারা বছর তারা দরজা খোলে ঘুমায়। নদী থেকে ছুটে আসা বাতাসের আদরে ঘুমটাও গভীর হয়। ঘুম মানে অন্ধকার। ঘুমের কোনো স্নায়ু নাই। জন্মান্ধের স্মৃতি বলতে শুধু অন্ধকার! ঘুমও তাই। এইভাবে জীবনের সবরকম জটিল অন্ধকার নিয়ে, সভ্য জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ও খাপছাড়াভাবে, বছরের পর বছর বেড়ে চলছে তেঘরির জেলেপাড়াটা।

তেঘরির পশ্চিমে নদী, পুবে সাত কিলোমিটার চওড়া হাওর। জায়গাটা নদী ও হাওরের লীলাভূমি। ঝড়-তুফান, বন্যা আর বুক সমান ঢেউয়ের শাসনে আছে হাজার বছর। একটু দূরে হিজল, করচ গাছে জটপাকানো কালচে-সবুজের ছোট্ট একটা বন আছে। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মোতরা ও বেতের ঘন ঝোঁপ।

তেঘরির পশ্চিমে নদী, পুবে সাত কিলোমিটার চওড়া হাওর। জায়গাটা নদী ও হাওরের লীলাভূমি। ঝড়-তুফান, বন্যা আর বুক সমান ঢেউয়ের শাসনে আছে হাজার বছর। একটু দূরে হিজল, করচ গাছে জটপাকানো কালচে-সবুজের ছোট্ট একটা বন আছে। তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মোতরা ও বেতের ঘন ঝোঁপ। জায়গাটা মেছোবাঘ আর বিষাক্ত সাপের অভয়াশ্রম। শীতের দুপুরগুলোতে তারা বেরিয়ে এসে রোদ পোহায় ঘন্টার পর ঘন্টা। তাই এখানে এতকাল কোনো সভ্য মানুষ বসত গড়েনি। তিরিশ বছর আগে দুঃসাহসী তিনজন জেলে এইখানে এসে তিনটা চালা তুলে সংসার পাতলে নূরপুরের মানুষজন তাদেরকে ‘তেঘরির জালোপাড়া’ বলে ডাকতে শুরু করে। এইসব বিবেচনায় শেখ হাসিনার উন্নয়ন নদীটার ওপারের পাকা সড়ক দিয়ে সোজা নূরপুরের দিকে চলে যায়। সেদিকে ভাগ্যবানদের চাঁদের হাট। তাই সুরুজ ডুবলে বিদ্যুতের বাতি ঝলমল করে। তাতে টিনশেড দালানের রঙিন শরীর আরও পেখম মেলে। আর ঠিক এই সময় নদীর এইপারের জেলেপাড়ায় সস্তা টিনের ছোটো ছোটো খুপরিগুলোতে জ্বলতে থাকে কেরোসিনের লাল লাল বাতি। নদীর বুক থেকে ছুটে আসা বাতাসে বাতির শিষগুলো কাঁপতে থাকে। মনে হয় এক্ষুণি নিভবে! তবু নেভে না। মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তির মতো বংশের পর বংশ ধরে বাতিগুলো জ্বলতেই থাকে।

এশার আযান পড়তেই জেলেপাড়ার পুরুষরা মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে যার যার ডিঙিতে উঠতে শুরু করে। তারপর বিশ-তিরিশ মিনিটের মাঝে ম্যাড়ম্যাড়ে আলোর বিন্দুগুলো নিভে গেলে অন্ধকার আরও জটিল হয়। মাঝে মাঝে নূরপুরের পাকা রাস্তা দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়ির হেড লাইটের তীব্র আলোতে সস্তা টিনগুলো একঝলক মুখ ভেংচায়। হঠাৎ হঠাৎ শিশুর কান্না ভেসে আসে। নিচের নদীতে মাছ ঘাই মারে। পুবের করচ বনে শিয়াল ডাকে। তেঘরির ছালপড়া কুকুরগুলো একদফা ঘেউ ঘেউ করে তার ক্ষীণ প্রতিবাদ জানায়। তারপর সব স্তব্দ, সব অন্ধকার!

শেষ রাতে হাওর-বিল থেকে ডিঙিগুলো যেমন নিঃশব্দে ঘাটে ফিরে আসে তেমনি করে এখানে বিয়ে হয়, ভাঙা চৌকিতে ক্যাঁতকুঁত শব্দ ওঠে, বছর শেষে বাচ্চা হয়। বছরে সাত-আটজন হয়। কোনো আমোদ নাই। আবেগ নাই। মোতরা বনের বেজির বাচ্চার মতো তারা নিঃশব্দে ডাঙ্গর হয়। বড়ো কঠিন নীরবতায় দুই-একজন মরেও যায়।

শেষ রাতে হাওর-বিল থেকে ডিঙিগুলো যেমন নিঃশব্দে ঘাটে ফিরে আসে তেমনি করে এখানে বিয়ে হয়, ভাঙা চৌকিতে ক্যাঁতকুঁত শব্দ ওঠে, বছর শেষে বাচ্চা হয়। বছরে সাত-আটজন হয়। কোনো আমোদ নাই। আবেগ নাই। মোতরা বনের বেজির বাচ্চার মতো তারা নিঃশব্দে ডাঙ্গর হয়। বড়ো কঠিন নীরবতায় দুই-একজন মরেও যায়। কেউ মরলে বেশি দূর নিতে হয় না। কয় হাত পুবেই হাওরের শুরু। সেদিকের করচ-হিজল কিংবা বেত ঝোঁপের ফাঁকে তাদের গোর দেওয়া হয়। কাজটা যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি সমাধা হলে দশ মিনিটের মাঝেই জাল, বৈঠা, ডিঙি নৌকা, বিড়ি এইসব শব্দগুলো তাদেরকে হাওরের দিকে তাড়া করে।

হঠাৎ আকাশ অঘোর কালো হয়ে যেমন ঝড় আসে তেমনি মাঝে মাঝে তেঘরিতে কলহের আগুন জ্বলে ওঠে। জেলেপাড়ায় এই জিনিসটা বাংলা মদের মতো কাজ করে। একেবারে নিরানন্দ, নির্জীব বসতিটা এই আড়কে গতরঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে। সমানে গালিগালাজ চলতে থাকে। তর্জন-গর্জনও চলে। সবই কাপড়ের তলের বিষয়-আশয়। যেহেতু নদী-হাওর-বিল থেকে ফিরে এসে পুরুষরাও ঝগড়ায় শরিক হয়। তাই হামলা, প্রতিহামলা সবই হয় শুধু কাপড়ের তলের অঙ্গ নিয়ে, দিয়ে। গর্জনে গর্জনে দুই পক্ষই তাদের মা-চাচির গোপন শরীর অবলীলায় তছনছ করতে থাকে। মাঝে মাঝে গুপ্পুৎ গুপ্পুৎ শব্দ হয়। কিল খেয়ে আমসি গতরের বউগুলো আরও বেশি চণ্ডালিনী হয়ে ওঠে। তেঘরির পুরুষদের মরবার টাইম নাই। তাই মিনিট বিশেক পড়েই সব থেমে যায়। মরামরা লাল বাতিগুলো বাতাসের মুখে কেঁপে কেঁপে জ্বলতেই থাকে।

পুরুষরা ডাকাডাকি করে মাছ ধরার জাল, বরশি নিয়ে নদীর দিকে নেমে যায়। ফিরবে শেষ রাতে। আগরাতের বিবাদে জেলেপাড়াটা গরম হয়ে উঠেছিল। মরদেরা ইচ্ছামতো ব্যবহার করেছিল শত্রু পক্ষের নারীর গুপ্তাঙ্গগুলোকে। সেই উত্তেজনা, অতৃপ্ত কামনা তাদের রক্তের গোপনে বিড়ির কড়া নিকোটিনের মতো কাজ করতে থাকবে। তাই সেইদিন শেষ রাতে জেলেপাড়ার নড়বড়ে চৌকিগুলো অনেকক্ষণ ধরে মড়মড় করবে, ক্যাঁতকুঁত করে সারি গান গাইবে।

আজ তেঘরির আকাশে চাঁদ তো চাঁদ একটা তারাও নাই। সন্ধ্যা থেকেই রহস্যে, গাম্ভীর্যে একেবারে স্তব্দ অতল! মাঝে মাঝে মাছাইয়ের কাশির শব্দে মুহূর্তের জন্য সেই অতলতা খান খান হয়। তারপর আবার যেইকে সেই।

বউ বলতে কাঠি কাঠি হাত-পা আর ফিরিঙ্গি মার্কা রুক্ষ, লাল চুলের এক কিশোরি। এই পাড়াতেই বসত। তেঘরির পুরুষেরা বউয়ের খোঁজে পারতপক্ষে দূরে যায় না। আর খুব বেশিদূর গেলে সামনের বাঁকের জেলেপাড়াতক। জীবনে যাদের ভেজা নেংটি শুকায় না, তারা আয়োজন করে যাবে দূরের শ্বশুরবাড়ি?

মাছাই এখন ক্ষেপা জন্তু। আজ বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে তুলেছে। এশার আযানের পর থেকে সে জানপ্রাণে চেষ্টা করছে উপুত হয়ে বিছানায় মিশে থাকা বউটাকে চিত করতে। পারছে না। বউ বলতে কাঠি কাঠি হাত-পা আর ফিরিঙ্গি মার্কা রুক্ষ, লাল চুলের এক কিশোরি। এই পাড়াতেই বসত। তেঘরির পুরুষেরা বউয়ের খোঁজে পারতপক্ষে দূরে যায় না। আর খুব বেশিদূর গেলে সামনের বাঁকের জেলেপাড়াতক। জীবনে যাদের ভেজা নেংটি শুকায় না, তারা আয়োজন করে যাবে দূরের শ্বশুরবাড়ি?

আগেই বলেছি, নাম তার মাছাই। ছোটো ছোটো লালটি বরণ দুইটা চোখ আছে। হাঁসের ঠোঁটের মতো চ্যাপ্টা একটা নাক আছে। গতরের চামড়া হাওরের মাটির মতো কুটকুটা কালো। ঘামে গরমে পিছলা হয়। শীতে হয় ফাঁটা বাঙি। শৈশব থেকে সে বিড়ি টানে। ঘন ঘন বিড়ি টানা তার অভ্যাস। তাই সারা বছর কাশে। পাঙসা, পাকানো চেহারার ছোটোখাটো মানুষটার বয়স তেইশ না তেত্রিশ আন্দাজ করার জো নাই। মাছ ধরা, মাছ বেচা তার জীবনের একমাত্র গদ্য। তবু যৌবন আসার পর থেকে জাল ফেলে, জাল তোলার মধ্যের ফাঁরাকটুকুর মাঝে সে বউ নামক পদ্যের চিত্রকল্প খুঁজত। আজ বউ পেয়েছে। এখন তার শরীরের উত্তাপে, ছন্দে বউয়ের শরীরে কবিতার বাণী খোদাই করবে। করবেই।

বাসর ঘরে ঢুকে, টিনের দরজায় খিল তুলে, মাছাই ঘুরে দাঁড়াতেই মেয়েটা দুই উরুর ফাঁকে জোড়হাত ঢুকিয়ে কী একটা রক্ষায় উপুত হয়ে বিছানায় মিশে যায়। তারপর থেকে মাছাই প্রাণপন লড়ছে। তবু একরত্তি মেয়েটাকে চিত করতে পারছে না।

এখন মাছাই জোরে জোরে কাশছে আর হাঁপাচ্ছে। মাছাইয়ের ঘরের টিনে কান লাগিয়ে লইলুছেরও ইচ্ছা করছে পশুর মতো ধাপাধাপি করতে, হাঁপাতে। লইলুছ তাগড়া। কাশিটাশি নাই। সংসার করেনি। আয়-রোজগার বেশি বলে দুই বেলা ভরপেট খায়। তাই এখন তার রক্তে পৃথিবীর আদিমতম অন্ধকার এত টগবগ করছে।

ঘন্টাখানেক পর হঠাৎ খট করে দরজা খুলে যায়। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মাছাই বেরিয়ে আসে। রাগে, হতাশায় পশুর মতো হাঁপাচ্ছে। কাশছে। তারপর খক করে একদলা কফ থু করে ফেলে। বিড়ি ধরায়। গ্যাস লাইটারের নীল আলোতে মাছাইকে বিশ্বের নিঃস্বতম মানুষ মনে হয়। তারপর অন্ধকারেই জাল হাতে নদীর দিকে থপথপ করে নামতে থাকে। নামতে নামতে আহত পশুর মতো চাপা গলায় গর্জন দিয়ে নতুন বউকে শাসায়, দিল না চুতমারানি।

একটু পরেই নিচে, ডিঙি নাওয়ের পাটাতনে কয়টা ভোঁতা শব্দ হয়। অন্ধকার ভরা নদীর বুক থেকে বৈঠা বাওয়ার শব্দ আসে। অন্ধকারের বাতাসে ভুরভুর করছে পানির আঁশটে গন্ধ। লইলুছ বুক ভরে দম টানে। কামনায় থরথর করে কাঁপে। অনেক দূরে মেঘের ফাঁক থেকে একটা তারাও উঁকি দিয়ে লইলুছকে দেখে। মিটমিট করে হাসে। একটা রাতচরা পাখি পত পত শব্দে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। এইসব দেখে-শুনে নিশ্চিত মনে লইলুছ ঘরের পেছন থেকে মাছাইয়ের দরজার কাছে চলে আসে। টিনের ছোট্ট খুপরির অতল অন্ধকারে গতর ঢুবিয়ে শুয়ে আছে মাছাইয়ের কচি বউ! আন্ডুল বউ! এই নদীতে আজো কেউ সাঁতার কাটেনি, ছিনান করেনি।

হারিয়াবাজ পাখির মতো বড়ো বড়ো পা ফেলে সে হাঁটে। শিকারী চিলের মতো চোখ দুইটা হাওর-বিল কিংবা নদীর ডহরের দিকে। একা একাই ছিপডিঙি ভাসিয়ে দেয়। জোরে জোরে লগি মারে। শাঁ শাঁ করে চলে যায় নদী কিংবা হাওরের দূর্গম অঞ্চলে। ফিরে আসে সবার আগে। ডিঙির খোলে তড়পায় সেরা সেরা মাছ।

লইলুছের ঢ্যাঙা গতরটা কাঁপতেই থাকে। মাথা ভর্তি রুক্ষ-লাল চুল। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চিকন গোঁফের নিচে শেয়ালের হাসি। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে, হারিয়াবাজ পাখির মতো বড়ো বড়ো পা ফেলে সে হাঁটে। শিকারী চিলের মতো চোখ দুইটা হাওর-বিল কিংবা নদীর ডহরের দিকে। একা একাই ছিপডিঙি ভাসিয়ে দেয়। জোরে জোরে লগি মারে। শাঁ শাঁ করে চলে যায় নদী কিংবা হাওরের দূর্গম অঞ্চলে। ফিরে আসে সবার আগে। ডিঙির খোলে তড়পায় সেরা সেরা মাছ। ঘরে ফিরে কয় খাবলায় বাসি-পান্তা খায়। কয়েক মিনিটের মাঝে বন্ধুরাও আসে। নিপুন হাতে সিলিম সাজে। তারপর এক আসনে তিন কলকি পুড়ায়। সবশেষে একটা জ্বলন্ত বিড়ি দাঁতে কামড়ে ধরে জেলেপাড়ার খুপড়িগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সাবধানে হাঁটতে থাকে। ততক্ষণে রাতটা গভীরতর। জেলেপাড়াটা আদিম অন্ধকারে দিকচিহ্নহীন। যদি বন্ধুদের কেউ কেউ পিছু নিতে চায় তবে লইলুছ আলদ সাপের মতো ফণা তুলে ঘুরে দাঁড়াবে, তুই বেটিমাইনশ্যের সোনার চৌখ দ্যাখছত? আমি দ্যাখছি।

লইলুছের সারাটা মুখ-নাক-কপাল জুড়ে মেয়েদের নখের চিরল চিরল দাগ। এইগুলো তার অন্ধকার জীবনের সাক্ষী। পেট পিঠ উরুতে ছোটো ছোটো দাঁতের নির্দয় ছাপ্পর। জেলেপাড়ার দরজা তো খোলাই থাকে। চণ্ডালিনী বউগুলো মরদদের বিদায় করেই বিছানায় নেতিয়ে পড়ে। পাশের বাচ্চাটাও মাই চুষতে চুষতে ঘুমিয়ে মরা কাঠ। সে চট করে মনমতো একটা ঘরে ঢুকে যায়। কামের মাঝ পথে কতবার যে ধরা পড়েছে! ভুল ভাঙলেও কোনো মেয়েই চিৎকার দেয় না। তারা জানে ‘খাইলে জাত যায় না, কইলে যায়।’ কিন্তু অনেকেই শিকারী বেজির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামড়ে, খাঁমচে একেবারে সারা করে দেয়। কেউ কেউ ঘুমের ভান করে মজা খায়। তাই জেলেপাড়ার মেয়ে মহলে লইলুছ একটা কস্তুরি মাখা পান। পুরুষরা এইসব ভাবতেও চায় না। মেয়েরাও কয় না। মুখের হিজিবিজি দাগ আর অনেকটা প্রকাশ্যেই তাকে নিয়ে মেয়েদের হাসাহাসি, রঙ্গ, বিদ্রুপ এইসব গতরে না মাখলে কী লইলুছের চলে?

সে মেয়েটার দুই পা নিজের দুই গালে চেপে ধরে বসে থাকে। কামনার আগুন গলতে গলতে তার দুই চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে মেয়েটার পায়ে। অবুঝ, আনাড়ি মানুষ। এতক্ষণ অনুতাপে পুড়ছিল। নিজের মানুষটার বিনয়ে, প্রেমে কাতর হয়ে এক ঝটকায় উঠে বসে। লইলুছও কম জানে না! সে এখন মেয়েটার পায়ের নরম গোছা জিব দিয়ে চাটছে। কিশোরীর আবেগ হৃদয়ের সব ভয়-তড়াস মুছে দিলে সে লইলুছকেই স্বামী ভেবে বুকে টেনে নেয়।

লইলুছ মাছাইয়ের ঘরে ঢুকে পড়ে। চতুষ্পদী জন্তুর মতো হামা দিয়ে দিয়ে মাছাইয়ের বউয়ের পায়ের কাছে গিয়ে থিতু হয়। মেয়েটা এখন চিত হয়ে শুয়ে আছে। জেগে আছে। গতর থেকে ভুরভুর করে আসছে নতুন শাড়ি আর কমদামা পাউডারের খুশবু। সেই সুঘ্রাণে লইলুছের বুকে মুহূর্তের জোয়ার আসে। সে মেয়েটার দুই পা নিজের দুই গালে চেপে ধরে বসে থাকে। কামনার আগুন গলতে গলতে তার দুই চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে মেয়েটার পায়ে। অবুঝ, আনাড়ি মানুষ। এতক্ষণ অনুতাপে পুড়ছিল। নিজের মানুষটার বিনয়ে, প্রেমে কাতর হয়ে এক ঝটকায় উঠে বসে। লইলুছও কম জানে না! সে এখন মেয়েটার পায়ের নরম গোছা জিব দিয়ে চাটছে। কিশোরীর আবেগ হৃদয়ের সব ভয়-তড়াস মুছে দিলে সে লইলুছকেই স্বামী ভেবে বুকে টেনে নেয়।

নিজের বোকামি ধরতে পেরে মাছাই অর্ধেক পথ থেকে ডিঙি নিয়ে ফিরে আসে। কোয়ার্টার সেকেন্ড আগে লইলুছও মৌচাকভাঙা অভিযান শেষ করেছে। লুঙিটা কোমড়ে কষে বাঁধতে বাঁধতেই সে দরজার সামনে চলে যায়। মাছাইও দরজার মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে! লইলুছের বাম হাতের এক ধাক্কায় দূর্বল মাছাই ছিটকে পড়ে তিন হাত দূরে। এই ফাঁকে সে পাশের নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নদীটা জমাট অন্ধকারের চলমান গহ্বর। সৃষ্টির পর থেকে সে বয়ে চলছে পৃথিবীর ইতিহাস। ইতিহাস কল্পনার আবরণে লুকানো সামান্য সত্য। কিন্তু অন্ধকার চিরন্তন সত্য। এইভাবে লইলুছ তার তৃপ্ত, রমনক্লান্ত গতরের সমুদয় ভার নদীর স্রোতে ছেড়ে দিয়ে ভাসতে ভাসতে এক কিলোমিটার ভাটিতে গিয়ে বটতলার চরে ঠেকতে পারে। ক্লান্ত পশুর মতো চরের বালুতে হাত-পা ছড়িয়ে, চিত হয়ে পড়ে থাকবে। ভোরের অপেক্ষায় অন্ধকার আকাশে তারার শোভা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়বে। আদিম জীবনের স্মৃতি থেকে স্বপ্ন দেখতেইবা দোষ কী? মানুষের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি ছাড়া কোনো স্বপ্ন হয় না। পৃথিবীর কোনো কোনো গহীন বনে ভালুকেরা যেমন করে চাকে মুখ লাগিয়ে চপচপ করে মধু খায়, লইলুছও স্বপ্নের ঘোরে তেমনি করে জেলেপাড়ার মেয়েদের মধু খাবে। এক লইলুছ হিজল-করচের বনের পাশে ঘুমিয়ে পড়লেও আহ্নিক ও বার্ষিক গতির লীলাখানায় অনেক অনেক লইলুছ অন্ধকারে মধু খাবে চপচপ…ছপছপ।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ময়মনসিংহরে গফরগাঁওয়ে ১৯৬৬ সালে। বিএসসি সম্পন্ন করে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত আছেন। র্বতমানে থাকনে সুনামগঞ্জে। প্রকাশতি গল্পের বই: ‘উল্টারথে’ [২০০৮], ‘ভাতবউ’ [২০১৩] ‘অসুখ ও টিকনের ঘরগিরস্তি’, [২০১৭]। উপন্যাস: ‘আত্মজীবনের দিবারাত্রী’ [২০১১], ‘রাজকুমারী’ [২০১৯]।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।