মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩

ওশো রজনীশের ‘বোধিধর্ম’ : ভূমিকা ও ভাষান্তর : হালিমাতুস সাদিয়া

0
Osho Rajnish 2

ওশো রজনীশ

রজনীশ, যিনি ওশো বা ভগবান শ্রী রজনীশ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৯৩১ সালে ভারতের মধ্য প্রদেশের কুচওয়াদাতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬০ এর দশকে আধ্যাত্মিক বক্তৃতা দিতে শুরু করেন।

ওশো রজনীশের শিক্ষাগুলি ধ্যান, স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত দায়িত্ব আর গুরুত্বের ওপর জোর দেয় এবং তিনি তার সম্মোহনকারী বিতর্কিত ও উত্তেজক বক্তব্যের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। তার বক্তৃতা ও ধ্যানের অসংখ্য অডিও রেকর্ডিং থেকে নির্মিত হয়েছে প্রায় সাত শতাধিক বই।

ওশো কিছু কবিতাও লিখেছেন এবং তাঁর কবিতার একটি নির্বাচিত সংকলন ১৯৯১ সালে (The Sun Behind the Sun) ‘দ্য সান বিহাইন্ড দ্য সান’ বইয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে বই পড়া বা বক্তৃতা শুনে প্রকৃত আধ্যাত্মিক বোঝাপড়া অর্জন করা যায় না, বরং এটা অর্জিত হয় সরাসরি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এই কারণে, রজনীশ আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের একটি উপায় হিসেবে কথোপকথন এবং যোগাযোগের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছিলেন।

ওশো বিশ্বাস করতেন যে সমাধি হলো আধ্যাত্মিক অনুশীলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এটি কেবলমাত্র সমাধি অর্জনের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা সম্ভব। ওশো শিখিয়েছিলেন যে সমাধি অর্জনের চাবিকাঠি হলো মুহূর্তে সম্পূর্ণরূপে উপস্থিত হওয়া, সমস্ত চিন্তাভাবনা ও আকাঙ্ক্ষাকে ছেড়ে দেওয়া এবং সহজভাবে থাকা।

ওশো বলেন, যৌনতা মানব প্রকৃতির একটি অপরিহার্য দিক এবং এটিকে অবদমিত বা অস্বীকার করার পরিবর্তে উদ্‌যাপন ও আলিঙ্গন করা উচিত। তিনি বিশ্বাস করতেন যে যৌন অবদমন মানসিক কষ্টের একটি প্রধান কারণ এবং এটি মানুষকে সত্যিকারের ভালোবাসা ও ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতে বাধা দেয়। তিনি সত্যিকারের ভালোবাসা ও পরিপূর্ণতা খুঁজে পাওয়ার জন্য মানুষকে তাদের নিজস্ব ইচ্ছা এবং প্রয়োজনগুলি অন্বেষণ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি শিখিয়েছিলেন যে ভালোবাসা সামাজিক নিয়ম বা প্রত্যাশার পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস ও বোঝার ওপর ভিত্তি করে হওয়া উচিত।

এই লেখাটি তার ‘Meeting With Remarkable’ গ্রন্থের বোধিধর্ম অধ্যায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ।


বোধিধর্ম


মানব চেতনার দীর্ঘ বিবর্তনে বোধিধর্মের মতো অসাধারণ বুদ্ধ কখনো আসেনি—যিনি ছিলেন খুব বিরল, খুব অনন্য আর বিস্ময়কর একজন ব্যক্তিত্ব। সাধনার বলে একমাত্র জর্জ গুরজিফ তার সামান্য কাছাকাছি পৌঁছান, কিন্তু খুব কাছাকাছি না—এবং সকল মার্গীয় পথে না।

পৃথিবীতে অনেক বুদ্ধ ছিলেন, কিন্তু বোধিধর্ম এভারেস্টের মতো স্পষ্টতই স্বতন্ত্র। তার সত্তা, জীবনযাপন এবং সত্যকে তুলে ধরার ভঙ্গি তার একান্তই নিজস্ব; এটি অতুলনীয়। এমনকি তার নিজের গুরু গৌতম বুদ্ধের সাথেও তুলনা করা যায় না। স্বয়ং বুদ্ধের পক্ষেও এই মানুষটিকে হজম করা বেশ কঠিন হতো।

বোধিধর্ম তার গুরুর বার্তা ছড়িয়ে দিতে ভারত থেকে চীন ভ্রমণ করেছিলেন। যদিও তাদের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল এক হাজার বছরের, তথাপি বোধিধর্ম এবং এই জাতীয় মানুষদের জন্য সময় আর স্থানের পার্থক্য বড়ো বিষয় নয়। তারা দুজন যেন ছিলেন সমসাময়িক। আপাতদৃষ্টিতে বুদ্ধ ও বোধিধর্মের মধ্যে হাজার বছরের ব্যবধান থাকলেও সমসাময়িকতা ও সত্যের ক্ষেত্রে এক মুহূর্তেরও ব্যবধান নেই। বোধিধর্মের দৃশ্যপটে আসার এক হাজার বছর পূর্বে বুদ্ধের মৃত্যু ঘটলেও কেন্দ্রবিন্দুতে তারা একত্রেই রয়েছেন। তিনি বুদ্ধের সারকথাই বলেন—তবে তাঁর নিজস্ব পথে, নিজস্ব শৈলীতে।

বুদ্ধ সংস্কৃতিবান, অত্যন্ত পরিশীলিত, খুব কমনীয় মানুষ ছিলেন। বোধিধর্ম ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। তিনি মানুষ নন, সিংহ। তিনি কথা বলেন না, গর্জে ওঠেন। গৌতম বুদ্ধের যে কমনীয়তা ছিল, সে রকম তাঁর মধ্যে নেই; তিনি ছিলেন রুক্ষ, অনেকটা অপরিশোধিত। তিনি হীরার মতো পলিশ নয়; যেন কেবল খনি থেকে তুলে আনা, একেবারে কাঁচা, খরখরে। আর এটাই তার সৌন্দর্য। বুদ্ধের মধ্যে একপ্রকার নারীসুলভ সৌন্দর্য রয়েছে, খুব মসৃণ আর পেলব। বোধিধর্মের সৌন্দর্য ভিন্ন রকম, পাথরের মতো—দৃঢ়, পুরুষালী, অক্ষয়, শক্তিমান।

গৌতম বুদ্ধও শক্তি বিকিরণ করেন, কিন্তু তাঁর শক্তি বেশ নীরব, ফিসফিস ধ্বনির মতো, শীতল বাতাসের মতো। বোধিধর্ম যেন ঝড় আর বজ্রপাত। বুদ্ধ কোনো আওয়াজ না করেই আপনার দরজায় আসেন; এমনকি সে আপনার দরজায় কড়া নাড়বে না, আপনি তার পায়ের আওয়াজটুকুও শুনতে পাবেন না। কিন্তু বোধিধর্ম যখন আপনার কাছে আসবেন, তখন তিনি পুরো বাড়ির ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দেবেন।

আপনি ঘুমিয়ে থাকলেও বুদ্ধ আপনাকে কাঁপিয়ে দেবেন না। আর বোধিধর্ম? তিনি আপনাদের কবর থেকে জাগিয়ে তুলবেন! বোধিধর্ম এক হাতুড়ি, তিনি জোরে আঘাত করেন। অভিব্যক্তিতে তিনি বুদ্ধের ঠিক বিপরীত, কিন্তু তাঁর বার্তা একই। তিনি বুদ্ধকে তাঁর গুরু হিসাবে প্রণাম করেন। তিনি কখনো বলেননি, এটাই আমার বার্তা। তিনি সহজভাবে বলেন, ‘এ বাণী বুদ্ধদের, প্রাচীন বুদ্ধদের। আমি তো শুধু একজন বার্তাবাহক মাত্র। কিছুই আমার নয়। আমি কেবল একটি ফাঁপা বাঁশ যা বুদ্ধদের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে বাঁশি হিসেবে। তারা গায়; আমি কেবল তাদের আমার মাধ্যমে গাইতে দেই।’

বোধিধর্ম ১৪ শতাব্দী আগে ভারতের দক্ষিণে এক রাজার পুত্র হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে পল্লবদের সাম্রাজ্য নামে এক বিশাল সাম্রাজ্য ছিল। তিনি তার পিতার তৃতীয় পুত্র ছিলেন, কিন্তু খুব বুঝে-শুনে অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন মানুষটি রাজ্য ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তিনি ঠিক পার্থিব এ জগতের বিরুদ্ধে ছিলেন না, কিন্তু পার্থিব বিষয়ে ট্রিভিয়ায় তার সময় নষ্ট করতে রাজি ছিলেন না। তার পুরো চিন্তা ছিল নিজের আত্ম-প্রকৃতিকে জানা, কারণ আপনাকে এটা না জেনেই মৃত্যুকে শেষ আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে, সকল সত্যের সন্ধানকারীর লড়াই মৃত্যুর বিরুদ্ধে। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, যদি মৃত্যু না থাকত তবে ধর্মেরও অস্তিত্ব থাকত না। এ কথায় কিছু সত্যতা আছে। তবে আমি এতে পুরোপুরি একমত নই, কারণ ধর্ম একটি বিশাল মহাদেশ।

প্রকৃতপক্ষে, সকল সত্যের সন্ধানকারীর লড়াই মৃত্যুর বিরুদ্ধে। বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, যদি মৃত্যু না থাকত তবে ধর্মেরও অস্তিত্ব থাকত না। এ কথায় কিছু সত্যতা আছে। তবে আমি এতে পুরোপুরি একমত নই, কারণ ধর্ম একটি বিশাল মহাদেশ। এটি কেবল মৃত্যু নয়, আনন্দের সন্ধান দেয়, সত্যের সন্ধান দেয়, এটি সন্ধান দেয় জীবনের অর্থবহতারও; এটি আরও অনেক কিছু। তবে অবশ্যই বার্ট্রান্ড রাসেল ঠিক বলেছেন: যদি মৃত্যু না হতো তবে খুব কম মানুষই ধর্মের প্রতি আগ্রহী হতো। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুই সবচেয়ে বড়ো উদ্দীপক।

বোধিধর্ম তার পিতাকে এই বলে রাজ্য ত্যাগ করেছিলেন, ‘আপনি যদি আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে না পারেন তবে দয়া করে আমাকে বাধা দেবেন না। আমাকে এমন কিছুর সন্ধানে যেতে দিন যা মৃত্যুর ঊর্ধ্বে।’ প্রাচ্যের সেই দিনগুলো ছিল মনোরম। বাবা এক মুহূর্তের জন্য চিন্তা করলেন ও বললেন, ‘আমি তোমাকে বাধা দেবো না, কারণ আমি তোমার মৃত্যু রোধ করতে পারব না। তুমি আমার সমস্ত আশীর্বাদ নিয়ে তোমার অনুসন্ধানে বের হতে পারো। যদিও বিষয়টা আমার জন্য বেশ কষ্টদায়ক, কিন্তু তোমার জন্য এর চাইতে বেশি আমি কী করতে পারি। আমি আশা করেছিলাম তুমি আমার উত্তরাধিকারী হবে, মহান পল্লব সাম্রাজ্যের সম্রাট হবে, কিন্তু তুমি এর চাইতে উচ্চতর কিছু বেছে নিয়েছ। আমি তোমার বাবা, কীভাবে তোমাকে আটকাতে পারি? তুমি কত সহজে প্রশ্নটি করেছ যা আমি কখনো আশা করিনি। তুমি বলেছ, ‘তুমি যদি আমার মৃত্যু রোধ করতে পারো তাহলে আমি প্রাসাদ ছাড়ব না, কিন্তু যদি তুমি আমার মৃত্যু রোধ করতে না পারো, তাহলে দয়া করে আমাকে বাধা দিও না।’ আপনি বোধিধর্মের এই ধীশক্তিকে একটি দুর্দান্ত বুদ্ধিমত্তা হিসাবে দেখতে পারেন।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি আমি আপনাদের মনে করাতে চাই তা হলো যদিও তিনি গৌতম বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন, তথাপি কিছু ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের চেয়েও উচ্চতর স্থানে। উদাহরণস্বরূপ, গৌতম বুদ্ধ তাঁর কমিউনে একজন মহিলাকে দীক্ষিত করতে ভয় পেতেন, কিন্তু বোধিধর্ম একজন আলোকিত মহিলার দ্বারা দীক্ষিত হয়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল প্রজ্ঞাতারা। মানুষ হয়তো তাঁর নাম ভুলে যেত; শুধুমাত্র বোধিধর্মের কারণেই তাঁর নাম এখনো রয়ে গেছে। তবে কেবল রয়ে গেছে শুধু নামটুকুই—এ ছাড়া আমরা তাঁর সম্পর্কে আর কিছুই জানি না। তিনিই বোধিধর্মকে চীনে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। বৌদ্ধধর্ম বোধিধর্মের ৬০০ বছর আগে চীনে পৌঁছেছিল। এটা সত্যিই একটি জাদুকরি ব্যাপার ছিল; এমনটি কোথাও কখনো ঘটেনি,—বুদ্ধের বাণী তাৎক্ষণিকভাবে সমগ্র চীনদেশের মানুষের নজর কেড়েছিল।

পরিস্থিতি এমন ছিল যে কনফুসিয়াসের প্রভাব বলয়ে এত দিনে চীন যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। যেহেতু কনফুসিয়াস ছিলেন কেবল একজন নৈতিকতাবাদী, একজন পিউরিটান, তিনি জীবনের অভ্যন্তরীণ রহস্য সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আসলে তিনি মানুষের অন্তরগত জগৎকে স্বীকার করতেন না। তার বক্তব্য হলো: সব কিছু বাইরের; একে পরিমার্জিত করুন, মসৃণ করুন, একে সংস্কৃতিক করুন, যতটা সম্ভব সুন্দর করুন।

কনফুসিয়াসের সমসাময়িক লাও তজু, চুয়াং তজু, লিহ তজু-এর মতো লোক ছিল, তবে তারা ঠিক শিক্ষক ছিলেন না, রহস্যবাদী ছিলেন। তারা চীনা জনগণের হৃদয়ে কনফুসিয়াসের বিরুদ্ধে পালটা আন্দোলন তৈরি করতে পারেনি। সুতরাং যেন একটি শূন্যতা বিরাজ করছিল। আত্মা ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না, এবং একবার যদি আপনি ভাবতে শুরু করেন যে আত্মা নেই, আপনার জীবন তার সমস্ত অর্থ হারাতে শুরু করবে। আত্মা একটি খুব সমন্বিত ধারণা; এটি ছাড়া আপনি অস্তিত্ব ও অনন্ত জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন। ঠিক যেমন গাছ থেকে কেটে ফেলা একটি ডাল মরে যেতে বাধ্য—এটি তার পুষ্টির একমাত্র উৎসটি হারিয়ে ফেলে—আত্মাহীনতার এই ধারণা, চেতনার অভাবজনীত বোধ, আমাদের অস্তিত্ব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। ব্যক্তি আরও সঙ্কুচিত হতে শুরু করে, শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা তৈরি হয়ে যায়।

কিন্তু কনফুসিয়াস ছিলেন অত্যন্ত মহান যুক্তিবাদী। এই রহস্যবাদী লাও তজু, চুয়াং তজু, লিহ তজু, তারা সকলে জানত যে কনফুসিয়াস যা করছিল তা ভুল, কিন্তু তারা শিক্ষক ছিলেন না। তাই তারা তাদের গুটিকয়েক শিষ্য নিয়ে নিজ আশ্রমে রয়ে যান।

বৌদ্ধধর্ম যখন চীনে পৌঁছায়, তখন তা অবিলম্বে মানুষের আত্মায় প্রবেশ করে… যেন তারা বহু শতাব্দী ধরে পিপাসার্ত আছে আর বৌদ্ধধর্ম এসেছে বারিধারা হয়ে। এটি অকল্পনীয়ভাবে তাদের তৃষ্ণা মিটিয়েছিল।

খ্রিষ্টান ধর্ম অনেক লোককে ধর্মান্তরিত করেছে, কিন্তু সেই ধর্মান্তরকে ধর্মীয় বলার মতো নয়। দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, ভিক্ষুক, এতিমদের মাঝে এ ধর্মান্তকরণ কোনো আধ্যাত্মিক প্রভাবের কারণে ঘটেনি, ঘটেছে কেবল তাদের খাদ্য, বস্তু, বাসস্থান, শিক্ষার সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে। এসবের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। ইসলাম বিপুল সংখ্যক মানুষকে ধর্মান্তরিত করেছে তলোয়ারের মাধ্যমে: হয় আপনি ইসলাম বেছে নিন, না হয় মৃত্যুকে। সিদ্ধান্ত আপনার।

চীনে যে রূপান্তর ঘটেছিল তা ছিল মানবজাতির সমগ্র ইতিহাসে একমাত্র ধর্মীয় রূপান্তর। বৌদ্ধধর্ম কেবল নিজেকে ব্যাখ্যা করেছিল, এবং এ বার্তার সৌন্দর্য মানুষ বুঝতে পেরেছিল। তারা এমন কিছুর জন্যই তৃষ্ণার্ত ছিল, এমন কিছুর জন্যই অপেক্ষমাণ ছিল। সমগ্র দেশ, যা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম দেশ, বৌদ্ধধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ৬০০ বছর পর বোধিধর্ম যখন সেখানে পৌঁছায়, তখন চীনে ত্রিশ হাজার বৌদ্ধ মন্দির, মঠ ও বিশ লক্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিল। আর সংখ্যার দিক দিয়ে এই বিশ লক্ষ বৌদ্ধ কম নয়; এটি ছিল চীনের মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ।

বোধিধর্মের গুরু প্রজ্ঞাতারা তাঁকে চীনে যেতে বলেছিলেন কারণ তাঁর আগে যারা সেখানে পৌঁছেছিলেন তারা দারুণ প্রভাব ফেলেছিলেন। তারা ছিলেন একেকজন পণ্ডিত। তারা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, প্রেমময়, শান্তিপূর্ণ এবং সহানুভুতিশীল ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তাদের কেউই (Englightened) আলোকিত মানুষ ছিলেন না। এ সময় চীনের আরেকজন গৌতম বুদ্ধের প্রয়োজন ছিল। সে জন্য মাঠও ছিল প্রস্তুত।

বোধিধর্ম ছিলেন প্রথম আলোকিত ব্যক্তি যিনি চীনে পৌঁছেছিলেন। আমি যে বিষয়টি স্পষ্ট করতে চাই তা হলো গৌতম বুদ্ধ যখন তাঁর কমিউনে মহিলাদের দীক্ষিত করতে ভয় পেতেন, বোধিধর্ম একজন মহিলার দ্বারা গৌতম বুদ্ধের পথে দীক্ষিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহসী ছিলেন। আরও অনেক আলোকিত মানুষ থাকলেও তিনি একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে একজন মহিলাকে বেছে নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল একজন নারীও যে আলোকিত হতে পারে তা দেখানো। শুধু তাই নয়, তার হাত ধরে তাঁর শিষ্যরাও আলোকিত হতে পারেন। বুদ্ধের আলোয় আলোকিত সকল মানুষের মধ্যে বোধিধর্মের নাম গৌতম বুদ্ধের পরের অবস্থানে রয়েছে।

সম্রাট উ গৌতম বুদ্ধের দর্শন প্রসারে মহান ভূমিকা রেখেছিলেন। হাজার হাজার পণ্ডিত পালি থেকে চীনা ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করছিলেন এবং সম্রাট সেসব অনুবাদকৃত মহান কর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

লোকটি সম্পর্কে অনেক কিংবদন্তি রয়েছে; এর প্রত্যেকটারই কিছু না কিছু তাৎপর্য আছে। একটি কিংবদন্তি হলো চীনে পৌঁছুতে তার তিন বছর সময় লেগেছিল—চীনা সম্রাট উ তাকে বরণ করতে এসেছিলেন। সম্রাটের চাইতেও তার খ্যাতি এগিয়ে ছিল। সম্রাট উ গৌতম বুদ্ধের দর্শন প্রসারে মহান ভূমিকা রেখেছিলেন। হাজার হাজার পণ্ডিত পালি থেকে চীনা ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অনুবাদ করছিলেন এবং সম্রাট সেসব অনুবাদকৃত মহান কর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি হাজার হাজার মন্দির ও মঠ তৈরি করেছিলেন এবং হাজার হাজার সন্ন্যাসীকে খাইয়েছিলেন। তাঁর সমস্ত সম্পদ তিনি গৌতম বুদ্ধের সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন, এবং স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা যারা বোধিধর্মের আগে চীনে পৌঁছেছিলেন তারা তাকে বলেছিলেন যে তিনি মহান পুণ্য অর্জন করছেন, তিনি স্বর্গে দেবতা হিসেবে জন্মগ্রহণ করবেন।

স্বভাবতই বোধিধর্মের কাছে সম্রাটের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘আমি এত মঠ তৈরি করেছি, হাজার হাজার পণ্ডিতকে খাওয়াচ্ছি, গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে অধ্যয়নের জন্য আমি একটি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছি, আমি আমার পুরো সাম্রাজ্য এবং এর সম্পদ গৌতম বুদ্ধের সেবায় নিয়োজিত করেছি। আমার পুরস্কার কী হবে?

বোধিধর্মকে দেখে তিনি কিছুটা বিব্রত হয়েছিলেন, ভাবতেও পারেননি যে লোকটি এ রকম হবে। হিংস্র মুখাবয়ব, বড়ো বড়ো চোখ। কিন্তু তার হৃদয় ছিল একটি পদ্মফুলের মতো কোমল। তাঁর মুখমণ্ডল প্রায় ততটাই বিপজ্জনক ছিল যতটা আপনি কল্পনা করতে পারেন। শুধুমাত্র সানগ্লাসের অনুপস্থিতি ছিল; নতুবা তাকে দেখতে একজন মাফিয়া বলেই মনে হতো! প্রচণ্ড ভয় পেয়ে সম্রাট উ প্রশ্ন করলে উত্তরে বোধিধর্ম বললেন, ‘কিছুই না, কোনো পুরস্কার নেই। বরং সপ্তম জাহান্নামে পড়ার জন্য প্রস্তুত হোন।’

সম্রাট বললেন, ‘কিন্তু আমি তো কোনো অন্যায় করিনি—সপ্তম জাহান্নাম কেন? বৌদ্ধ ভিক্ষুরা আমাকে যা বলছেন, আমি তার সবই করছি।’

বোধিধর্ম বললেন, ‘আপনি যদি নিজের ভেতরের কণ্ঠস্বর শুনতে না পান তবে বৌদ্ধ বা অ-বৌদ্ধ কেউ আপনাকে কেন সাহায্য করতে পারবে না। আর আপনি এখনো আপনার ভেতরের কণ্ঠস্বর শোনেননি। আপনি যদি তা শুনতে পেতেন তবে এমন বোকার মতো প্রশ্ন করতেন না।’

‘গৌতম বুদ্ধের পথে কোনো পুরস্কার নেই কারণ পুরস্কারের আকাঙ্ক্ষার জন্ম হয় লোভী মন থেকে। গৌতম বুদ্ধের সমগ্র শিক্ষাই আকাঙ্ক্ষাহীনতার। আর আপনি যদি এ সমস্ত তথাকথিত পুণ্যকর্ম করেন, মন্দির ও মঠ তৈরি করেন এবং হাজার হাজার সন্ন্যাসীকে খাওয়ান, তাও আবার আপনার মনের মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখে, মনে রাখবেন আপনি নরকের পথ প্রস্তুত করছেন। আপনি যদি আনন্দের জন্য, পুরো সাম্রাজ্যের সাথে আপনার আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য এই কাজগুলি করেন এবং কোথাও কোনো পুরস্কারের জন্য সামান্য আকাঙ্ক্ষাও না থাকে তবে এই কাজটি নিজেই একটি পুরস্কার। অন্যথায় তা আপনার জন্য কিছুই বয়ে আনবে না।’

সম্রাট উত্তরে বললেন, ‘আমার মন এত চিন্তায় পরিপূর্ণ যে, আমি কিছুটা মানসিক শান্তি উৎপাদন করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। এবং আমার এই চিন্তাভাবনা আর তাদের কোলাহলের কারণে, আপনি যাকে অভ্যন্তরীণ কণ্ঠস্বর বলছেন তা আমি শুনতে পাচ্ছি না। এ বিষয়ে আমি আর কিছুই বলতে পারবো না।’

বোধিধর্ম বললেন, ‘ঠিক আছে ভোর চারটে নাগাদ কোনো দেহরক্ষী ছাড়াই পাহাড়ের যে মন্দিরে আমি থাকতে যাচ্ছি, সেখানে একা চলে আসবেন। আমি আপনার মনকে সদা শান্তিময় করে দেবো।’

সম্রাট ভেবেছিলেন যে এই লোকটি সত্যিই উদ্ভট, ভয়ানক। তিনি এ পর্যন্ত অনেক সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করেছিলেন; তারা প্রত্যেকেই ছিল খুব নম্র। কিন্তু এই ব্যক্তি এমনকি বিব্রতও হয় না যে তিনি একটি মহান দেশের সম্রাট। ভোর চারটার অন্ধকারে একা একা এমন একজন বিপজ্জনক ব্যক্তির কাছে যাওয়ার বিষয় নিয়ে সম্রাট ভাবতে লাগলেন—তিনি সব সময় তার সাথে একজন দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করেন।

‘যাবেন নাকি যাবেন না—এটা ভেবে সম্রাট সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। কারণ, এই ব্যক্তি যে কোনো কিছু করতে পারে। তাকে একেবারেই আস্থাভাজন বলে মনে হচ্ছে না।’ অপরদিকে, সম্রাট গভীরভাবে অনুভব করছিলেন যে, লোকটি ভণ্ড নন। ‘সে একটুও চিন্তা করেন না যে আপনি একজন সম্রাট এবং সে একজন সামান্য ভিক্ষুক। তিনি সম্রাটের মতো আচরণ করেন, এবং তার সামনে আপনিই বরং একজন ভিক্ষুক। ‘আমি আপনার মনকে সদা শান্তিময় করে তুলব’—ঘুরেফিরে এ কথাই তিনি ভাবতে লাগলেন।

‘বিষয়টা সত্যিই অদ্ভুত।’ সম্রাট ভাবছিলেন, ‘ভারত থেকে আসা অনেক অনেক জ্ঞানী লোক আমাকে বিভিন্ন পন্থা, কৌশল দিয়েছে, যা আমি অনুশীলন করেছি, কিন্তু কিছুই ঘটছে না। আর এই অদ্ভুত ব্যক্তি, যাকে দেখতে প্রায় পাগল বা মদ্যপের মতো লাগছে, এবং যার এত বড়ো চোখের সাথে একটি ভীতি-সঞ্চারী অদ্ভুত মুখমণ্ডল রয়েছে… তবে তাকে আন্তরিক বলেই মনে হচ্ছে—লোকটি একেবারেই বন্য। বিষয়টা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সে ভাবল, লোকটা বড়োজোর কী করতে পারে—আমাকে মেরে ফেলতে পারে।’ শেষপর্যন্ত, তিনি এ প্রলোভনকে প্রতিরোধ করতে পারেননি, কারণ লোকটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘আমি আপনার মনকে সদা শান্তিময় করে তুলব।’

সম্রাট উ ভোর চারটায় মন্দিরে পৌঁছান। অন্ধকারে এবং একা। সে সময় বোধিধর্ম তার কর্মীদের সাথে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সম্রাটকে দেখে তিনি বললেন, ‘আমি জানতাম আপনি আসবেন, যদিও সারা রাত আপনি যাবেন কি যাবেন না তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। আপনি কী ধরনের সম্রাট—যে কিনা এতটা কাপুরুষোচিত, একজন নিরীহ সন্ন্যাসীকে ভয় পান, আমি একজন গরিব ভিক্ষুক যার এই লাঠিটি ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছু নেই। আর তা দিয়েই আমি আপনার মনকে নীরব করে দিতে যাচ্ছি।’

সম্রাট ভাবলেন, ‘হে ঈশ্বর, কেউ কি কখনো শুনেছে যে একটা লাঠি দিয়ে কেউ কারো মনকে নীরব করে দিতে পারে! আপনি তাকে শেষ করে দিতে পারেন, তার মাথায় জোরে আঘাত করতে পারেন—তখন পুরো মানুষটাই নীরব হয়ে যায়, মন নয়। কিন্তু এখন আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।’

বোধিধর্মের নির্দেশে জনমানবহীন মন্দির প্রাঙ্গণে সম্রাট চোখ বন্ধ করলে বোধিধর্ম বলেন—‘আমি আমার লাঠি সাথে করে আপনার সামনে বসে আছি। আপনার কাজ হচ্ছে মনকে খুঁজে বের করা। কেবল চোখ বন্ধ করুন এবং মনকে খুঁজতে নিজের ভেতরে প্রবেশ করুন—দেখুন সেটি কোথায় রয়েছে। যে মুহূর্তে আপনি একে খুঁজে পাবেন, আমাকে বলবেন, “এটি এখানে” এরপর আমার লাঠি বাকি কাজটি করবে।’

সত্য অথবা শান্তি অথবা নীরবতার সন্ধানকারী যেকোনো ব্যক্তির কাছে এটি ছিল সবচেয়ে অদ্ভুতুরে অভিজ্ঞতা—কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। সম্রাট চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন, তিনি খুব ভালো করেই জানতেন যে বোধিধর্ম যেমনটি বলেছেন তেমনটিই বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি চারিদিকে তাকালেন—সেখানে মনের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পেলেন না। লাঠি তার কাজ করে চলেছে। এই প্রথম তিনি এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন। আপনি যদি মনের অস্তিত্ব খুঁজে পান তবে কারোর বলার উপায় নেই, এরপর এই লোকটি তার লাঠি দিয়ে কী করে বসবে। আর তেমন একটি নীরব পাহাড়ি এলাকায় বোধিধর্মের উপস্থিতিতে, যার কিনা নিজস্ব আধ্যাত্মিক শক্তি আছে… অনেক আলোকিত মানুষ এসেছেন, কিন্তু বোধিধর্ম এভারেস্টের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রতিটি কাজই অনন্য ও মৌলিক। তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গির নিজস্ব স্বাক্ষর রয়েছে; যা কখনো ধার করা যায় না।

তিনি মনকে খুঁজে পেতে অনেক চেষ্টা করেছিলেন, এবং প্রথমবারের মতো তিনি মনকে খুঁজে পেলেন না। আসলে এটি ছিল বেধির্মের ছোট্ট একটি কৌশল। মন শুধুমাত্র এই কারণে বিদ্যমান যে আপনি কখনই এটির সন্ধান করেন না; এটি কেবলমাত্র বিদ্যমান কারণ আপনি কখনই এটি সম্পর্কে সচেতন নন। আপনি যখন এটি খুঁজছেন শুধুমাত্র তখনই আপনি এটির সম্পর্কে সচেতন হন, আর এই সচেতনতাই এটিকে সম্পূর্ণরূপে মেরে ফেলে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে গেল। শীতল বাতাসকে সঙ্গি করে নীরব পাহাড়ে সূর্যোদয় হচ্ছিল। বোধিধর্ম সম্রাট উ’র মুখে এমন শান্তি, এমন নীরবতা, এমন স্থিরতা দেখতে পেলেন যেন তিনি একটি মর্মর মূর্তি। তিনি তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘অনেক দিন হয়ে গেছে। আপনি কি মনকে খুঁজে পেয়েছেন?’

সম্রাট উ উঠলেন, ‘আপনার লাঠি ব্যবহার না করে, আপনি আমার মনকে পুরোপুরি শান্ত করেছেন। অবশেষে বুঝলাম মনের কোনো অস্তিত্ব নেই এবং আপনি যে অভ্যন্তরীণ কণ্ঠস্বরের কথা বলেছেন তা আমি শুনেছি। আপনি যা বলেছেন তা সঠিক। আপনি কিছু না করেই আমাকে বদলে দিয়েছেন। এখন আমি জানি যে প্রতিটি কাজকে গ্রহণ করতে হবে একেকটি পুরস্কার স্বরূপ; অন্যথায়, তা করার প্রয়োজন নেই।

ভাবছেন আপনাদের পুরস্কার দেবে কে? আসলে এটি একটি শিশুসুলভ ধারণা। আপনাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য বা কে আছে? আসলে আপনাদের কর্মই শাস্তি এবং কর্মই আপনাদের প্রতিদান। আপনিই আপনার ভাগ্যের মালিক।’

বোধিধর্ম বললেন, ‘আপনি একজন বিরল শিষ্য। আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং সম্মান করি, একজন সম্রাট হিসাবে নয়, বরং এমন একজন মানুষ হিসাবে যিনি এক-বসাতেই অনেক সচেতনতার সাথে, এত আলো ধারণ করার সাহস রাখেন যে, তাতে মনের সকল অন্ধকার বিদীর্ণ হয়ে যায়।

তিনি তাই নামক এক পর্বতে বাস করতেন… দ্বিতীয় কিংবদন্তিটি হলো বোধিধর্ম সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি চা তৈরি করেছিলেন—‘চা’( Tea) নামটি তাই (Tai) নাম থেকে এসেছে

সম্রাট উ তাকে রাজপ্রাসাদে আসতে রাজি করানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি বললেন, ‘এটা আমার জায়গা নয়। আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন যে আমি বন্য স্বভাবের লোক, আমি এমন কিছু করি যা আমি নিজেই আগে থেকে জানি না। আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুহূর্তের জন্য বাঁচি, আমার জীবনযাপন অনিশ্চিত। আমার দ্বারা আপনার, আপনার আদালতের, আপনার জনগণের অপ্রয়োজনীয় সমস্যা তৈরি হতে পারে; আমি প্রাসাদের জন্য নই, শুধু আমাকে আমার বন্যতায় থাকতে দিন।’

তিনি তাই নামক এক পর্বতে বাস করতেন… দ্বিতীয় কিংবদন্তিটি হলো বোধিধর্ম সেই প্রথম ব্যক্তি যিনি চা তৈরি করেছিলেন—‘চা’( Tea) নামটি তাই (Tai) নাম থেকে এসেছে, কারণ এটি তাই পর্বতে তৈরি হয়েছিল। বিশ্বের সকল ভাষার চায়ের আদি উৎস এখান থেকেই উদ্ভূত।

বোধিধর্ম যেভাবে চা তৈরি করেছিলেন তা ঐতিহাসিক না হলেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি প্রায় সবসময় ধ্যান করতেন, এবং কখনো কখনো রাতে তার ঘুম পেয়ে যেত। সুতরাং, শুধুমাত্র ঘুমিয়ে পড়ার জন্য নয়, তার চোখকে একটি শিক্ষা দেওয়ার জন্যও। তিনি তার সমস্ত ভুরুর চুল কেটে মন্দিরের মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। প্রচলিত আছে, সেই ভুরুগুলির মধ্যে থেকে চা ঝোপগুলি গজিয়ে ওঠে। এগুলোই ছিল প্রথম চা গাছ। আর এ জন্যই চা পান করলে ঘুম দূরে চলে যায়। এরপর বৌদ্ধধর্মে এটি একটি রুটিন হয়ে ওঠে যে ধ্যানের জন্য চা অত্যন্ত সহায়ক। সুতরাং সমগ্র বৌদ্ধ বিশ্ব ধ্যানের অংশ হিসাবে চা পান করে, কারণ এটি ব্যক্তিকে সজাগ ও জাগ্রত রাখে।

যদিও চীনে বিশ লক্ষ বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন, বোধিধর্ম তাঁর শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করার যোগ্য মাত্র চার জনকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তার প্রথম শিষ্য হুই কো-কে খুঁজে পেতে তার প্রায় নয় বছর সময় লেগেছিল।

ঐতিহাসিক তথ্যমতে, কারণ বোধিধর্মের প্রায় সমসাময়িক প্রাচীনতম উল্লেখে তা পাওয়া যায়, আর সকলের বয়ানেও এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে—সম্রাট উ-কে প্রাসাদে ফেরত পাঠানোর পরে নয় বছর ধরে তিনি রাজপ্রাচীরের দিকে মুখ করে মন্দিরের দেওয়ালের মুখোমুখি বসে ছিলেন। এটাকে তিনি একটি মহান ধ্যানে পরিণত করেছিলেন। শুধু দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা। দীর্ঘদিন এভাবে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলে আপনার ভাবনার গতি থেমে যাবে। ধীরে ধীরে, প্রাচীরের মতো, আপনার মনের পর্দাও শূন্য হয়ে যবে।

এর একটি দ্বিতীয় কারণও ছিল। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার শিষ্য হওয়ার যোগ্য কেউ না আসা পর্যন্ত আমি দর্শকদের দিকে তাকাব না।’

লোকেরা আসত এবং তারা তার পিছনে বসত। এটা একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি ছিল। এভাবে কেউ কখনো কথা বলেনি; মনে হতো তিনি যেন দেওয়ালের সঙ্গে কথা বলছেন। লোকেরা তার পিছনে বসে থাকবে কিন্তু তিনি তাদের মুখোমুখি হবেন না, কারণ তিনি বলেন, ‘শ্রোতারা আমাকে বেশি কষ্ট দেয়, বরং তাদেরকেই আমার কাছে একটি প্রাচীরের মতো লাগে। কেউ বোঝে না যে, এমন অজ্ঞতা নিয়ে মানুষের মুখোমুখি হতে আমার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলে সেটা হয় না; দেওয়াল তো দেওয়াল-ই। সে শুনতে পারে না, তাই আঘাত করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি তখনই দর্শকদের মুখোমুখি হব যখন কেউ তার কর্মের দ্বারা প্রমাণ করবে যে সে আমার শিষ্য হতে প্রস্তুত।

নয় বছর কেটে গেল। সকলে কী করবে তা খুঁজে পাচ্ছিল না, কীভাবে তাকে সন্তুষ্ট করা যায় তারা তা বুঝতে পারছিল না। এরপর এলেন হুই কো নামের এক যুবক। সে তরবারি দিয়ে তাঁর এক হাত কেটে ফেলে এবং বোধিধর্মের সামনে হাতটি ছুড়ে দিয়ে বলে, ‘এই নাও। তুমি ঘুরে না দাঁড়ালে, এরপর আমার মাথা তোমার সামনে পড়বে। আমি আমার মাথাটাও কেটে ফেলব।’

বোধিধর্ম ঘুরলেন এবং বললেন, ‘তুমি সত্যিই আমার যোগ্য একজন মানুষ। মাথা কেটে ফেলার দরকার নেই, আমাদের এটি ব্যবহার করতে হবে। এই হুই কো-ই তাঁর প্রথম শিষ্য ছিলেন।

অবশেষে যখন তিনি চীন ত্যাগ করেন, বা চীন ত্যাগ করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তিনি তার চার শিষ্যকে ডাকলেন—হুই কো’র পরে তিনি আরও তিন জনকে জড়ো করেছিলেন। তিনি তাদের বললেন—সহজ কথায়, ছোটো ছোটো বাক্যে, টেলিগ্রাফিক ভাষায়—‘তোমরা আমাকে আমার শিক্ষার সারমর্ম বলো। আমি আগামীকাল সকালে হিমালয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা দিতে চাই, এবং আমি তোমাদের চারজনের মধ্যে একজনকে আমার উত্তরসূরি হিসাবে বেছে নিতে চাই।’

প্রথম জন বলল, ‘আপনার শিক্ষা হচ্ছে মনের বাইরে যাওয়া, একেবারে নীরব থাকা এবং তারপর সবকিছু তার নিজের ইচ্ছায় ঘটতে দেওয়া।’

বোধিধর্ম বললেন, ‘তুমি ভুল নও, কিন্তু তুমি আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারনি। তোমার কাছে শুধু আমার চামড়াটুকু আছে।’

দ্বিতীয় জন বলল, ‘আমি বলে কেউ নেই, কেবল রয়েছে অস্তিত্ব। এটাই আপনার মৌলিক শিক্ষা।’

বোধিধর্ম বললেন, ‘ভালো বলেছ, কিন্তু আমার মান অনুযায়ী হয়নি। তোমার কাছে আমার হাড়গুলো আছে; বসে পড়ো।’

তৃতীয়জন বলল, ‘এ বিষয়ে কিছু বলা যায় না। কোনো শব্দেই তাকে প্রকাশ করা যায় না।’

বোধিধর্ম বললেন, ‘ভালো, কিন্তু তুমি ইতিমধ্যে এই বিষয়ে কিছু বলে ফেলেছ। তুমি নিজে তোমার কথার বিরোধিতা করে ফেলেছ। বসে পড়; তোমার কাছে আমার মজ্জাটুকু আছে।’

এবং চতুর্থজন ছিল তাঁর প্রথম শিষ্য হুই কো, যিনি কোনো কথা না বলে বোধিধর্মের পায়ে পড়ে যায়, তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে। বোধিধর্ম বললেন, ‘তুমিই সঠিক মর্মটা বলতে পেরেছ। তোমাকেই আমার উত্তরসুরি করে যাচ্ছি।’

কিন্তু সেই রাতে প্রতিশোধপরায়ণ কিছু শিষ্য বোধিধর্মকে বিষ প্রয়োগ করেছিল, কারণ তাদেরকে উত্তরসুরি হিসাবে নির্বাচিত করা হয়নি। এ কারণে তারা তাকে কবর দিয়েছিল। এবং সবচেয়ে অদ্ভুত কিংবদন্তি হলো তিন বছর পরে একজন সরকারী কর্মকর্তা তাকে চীন থেকে হিমালয়ের দিকে হেঁটে যেতে দেখেছিলেন, যথারীতি তার হতে তার লাঠিটি ছিল এবং একপাটি স্যান্ডেল সেই লাঠিতে ঝুলছিল আর তিনি খালি পায়ে হাঁটছিলেন।

কর্মকর্তাটি তাকে চিনতো, তার কাছে অনেকবার গিয়েছিল, বোধিধর্ম ব্যক্তিটিকে কিছুটা খামখেয়ালি মনে হলেও, কর্মকর্তাটি তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার এই লাঠির মানে কী, এবং এতে একটি স্যান্ডেল ঝুলছে কেন?’ বোধিধর্ম বললেন, ‘শীঘ্রই তুমি তা জানতে পারবে। তোমার সাথে যদি আমার লোকদের দেখা হয় তবে তাদের বলবে যে আমি চিরদিনের জন্য হিমালয়ে চলে যাচ্ছি।’

কর্মকর্তাটি তৎক্ষণাৎ যত দ্রুত সম্ভব পাহাড়ের সেই মঠে পৌঁছে যায়, যেখানে বোধিধর্ম বাস করতেন। সেখানে গিয়ে তিনি শুনলেন যে তাকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে… সেখানে তার কবরও ছিল। কর্মকর্তাটি এ ব্যাপারে কিছুই জানত না, কারণ সে সাম্রাজ্যের একেবারে প্রান্তসীমায় চাকরিতে নিযুক্ত ছিল। সে বলল, হায় খোদা, কিন্তু আমি তাকে দেখেছি, আমার ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই কারণ আমি তাকে আগেও বহুবার দেখেছি। তিনি সেই মানুষ ছিলেন, সেই একই হিংস্র চোখ, একই জ্বলন্ত আর বন্য দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার, তার হাতে ছিল সেই লাঠি, যাতে তিনি একটি স্যান্ডেল বহন করছিলেন।

শিষ্যরা তাদের কৌতুহল ধরে রাখতে না পেরে কবরটি খুড়তে শুরু করল। তারপর তারা সেখানে যা খুঁজে পেয়েছিল তা কেবলমাত্র একপাটি স্যান্ডেল। আর তখনই কর্মকর্তা বুঝতে পেরেছিল যে তিনি কেন বলেছিলেন, ‘শীঘ্রই তুমি এর অর্থ জানতে পারবে।’

আমরা যীশুর পুনরুত্থান সম্বন্ধে অনেক কিছু শুনেছি। কিন্তু বোধিধর্মের পুনরুত্থান সম্পর্কে কেউ খুব বেশি কথা বলেনি। সম্ভবত শিষ্যরা তাকে কবর দেওয়ার সময় তিনি কোমায় ছিলেন, এবং তারপর তাঁর জ্ঞান ফিরে এলে তিনি কবর থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে একটি স্যান্ডেল রেখে এবং তার লাঠির আগায় আরেকটি স্যান্ডেল নিয়ে চলে গিয়েছিলেন।

তিনি হিমালয়ের চিরায়ত তুষারে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সেখানে কোনো সমাধি না থাকুক, কোনো মন্দির, কোনো মূর্তি না থাকুক। তিনি উপাসনার জন্য পেছনে কোনো পদচিহ্ন রেখে যেতে চাননি; তার কথা, যারা তাঁকে ভালোবাসে তারা নিজ নিজ অন্তরের ভেতরেই তাঁকে খুঁজে পাবে। পুজিত হওয়ার বাসনা তার কোনোকালেই ছিল না।

এরপর মৃদুমন্দ বাতাসের মতো একসময় তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। কেউ তার সম্পর্কে কিছুই শোনেনি—তার কী হয়েছিল, কোথায় তিনি মারা গিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি হিমালয়ের চিরায়ত তুষারে কোথাও সমাহিত হয়ে আছেন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম নারায়ণগঞ্জে। ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যয়ন করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।