শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

নিত্য যে নদী বহে (৩য় পর্ব)

0

তৃতীয় পর্ব

 

• ‘আশ্বিনো না মাস আহে, লগে থিরা মেঘ! আহে কড়ি-ধবলা মেঘ!’


এইমতে আমরা এই কন্যারে পাইলাম! গহন কালা ঢলের রাইতে, ঠাটার আওয়াজের তলে আর বিজলি-ঝিলিকের ঘেরের ভিতরে যহন পুরা দুনিয়া! তেমুন কালে নিকি দয়ালে, আমাগো হস্তে সইপ্পা দিলো এই আমানত!

যাগো নিজেগো দেহেরই কোনো ঠিকঠিকুন্তী নাই! বেঙ্কা-তেরা, অবলা-লুলা আমরা দুই জোন! এমুন দোনোজোনের আর কট্টুক খ্যামতা আছে! কট্টুক সাধ্যি আছে! হেরা আরেকটা জানেরে রক্ষা দেওনের কে! তয় মালিকের ইচ্ছার উপরে আর কতা কী! বান্দাগো তো কিছুই কওনের নাই!

তাইলে আইচ্ছা! নিলাম আমরা এই কন্যার ভার!

সাক্ষী থাইক্কো বাবা খোয়াজ খিজির! পানির-রাখোয়াল! আমরা এই মর-মরা কন্যার আমানতদার হইলাম!

সাক্ষী থাইক্কো রে হিয়ালের পাল! যেই তোমরা, আমাগো দোনোজোনেরে জাগুন্তী দিছিলা! তোমাগো কারোণেই না এই দম-ধুরপুর কন্যাখানেরে, ডাঙায় আনতে পারা গেছে!

সাক্ষী থাকো রে আমাগো সুখতী গাঙ! আমাগো জিন্দিগীর চির জনমকার দোসর! তোমারে সাক্ষী কইরা আমরা দোনোজোনে, এই খসমে আর তার পরিবারে, এই কন্যারে আমাগো আমানত বইল্লা মানলাম!

সাক্ষী থাকো রে আমাগো সুখতী গাঙ! আমাগো জিন্দিগীর চির জনমকার দোসর! তোমারে সাক্ষী কইরা আমরা দোনোজোনে, এই খসমে আর তার পরিবারে, এই কন্যারে আমাগো আমানত বইল্লা মানলাম!

দেহি অহন! হেরে ফিরা জনোম দেওন যায়, কী যায় না!

দিনে দিনে করমে করমে, অই কন্যার দেহখানে তো নিজ জানটা ফিরত পাইলো! জানে-পরানে জাগনা দিয়া উঠলো! হেইরবাদে কী জানলাম?

দিনে দিনে জানলাম যে, এই কন্যারও বিস্মরণ ব্যাধি অইয়া রইছে! নিজ পূর্বকথা আর হের, এট্টু কিচ্ছুও স্মরণে নাই! আপনা নামধাম, সাং-কুষ্টি সকলই বিস্মরণ হইয়া গেছে! আহারে! হেয় তো দেহি আমার লাহানই বিমারী! একই আধিব্যাধিয়ে কেমনে, হেরেও গেরাস করলো?

আমারেও তো একদিন এই সুখতী গাঙেই পাওয়া গেছিলো! তবে হেই বিত্তান্তখান তো আর আমাগো উস্তাদের ঝিয়ের চক্ষের উপরে ঘটে নাই! সেয় তহন দুনিয়াতেই আহে নাই! আমার বেপারখানের সাক্ষী আছিলো হের বাপে আর মায়ে! আমার উস্তাদে আর উস্তাদ মায়ে!

এইবার এই শাঙন মাইস্যা রাইতে, উস্তাদের ঝিয়ে যহন, নিজ অক্ষির সামোনে সেই একই প্রকার আচরিত কারবার ঘটতে দেখে; তহন হের শইল্লে য্যান আর শইল থাকে না! হেইটায় তহন জবাই-পাওয়া মুরগীর লাহান ঝিটকী খাইতে থাকে! খিজলী খাইতে থাকে! কম্পন দিতে থাকে! হায় হায়! দেহো তো! উস্তাদের ঝিয়ের শইল্লে তো য্যান কেমুন ধড়ফড় ধড়ফড় করতাছে!

অরে দয়াল চান! হের দীলে অখন ডর জাগনা না দিলে কী হইতো মাবুদ!

বিষম ডরে হেয় কাঁপাকাপুন্তী দিতে থাকে! আফসোস আর হায়-হুতাশের য্যান নহর বহাইয়া দিতে থাকে! কি নিয়া হায় হুতাশ?

এই যে আমরা দোনোজোনে, বৈদেশী মরমর এই মনিষ্যিরে বাঁচানের চেষ্টা দিতাছি! আমাগো যতনের পরও যুদি এই কন্যায়, বাইচ্চা না ওঠে! যুদি কন্যার দেহখানে, আর হের জানেরে ফিরত না-পায়! তাইলে হেরে গোর দাফন দেওয়া কেমনে? কাগো বাড়ির কন্যারে, এমনে আমরা মাটি-মকসেদ দিমু! হের বাপে জানলো না কিছু! মাওয়ে হোনলো না কিছু! গুষ্টির লোকে কই পইড়া রইলো! হায় হায়! এমনে দাফন-মকান দিয়া দিলে হয় নিকি? ধর্মে সইবো এমুন কর্ম? গুনা নি অইয়া যায়!

এমত শতেক বেহুদা ডর নিয়া উস্তাদের ঝিয়ে বিলাপ পাড়া শুরু করে!

কী দিয়া যে মাবুদে এরে গড়ছে, হেইটা মাবুদেই জানে! নাইলে এমুন আপদের কালে এমুন নাই-কতা, কেমনে হের চিত্তে জাগনা পায়? কিয়ের মিদে হেয় কোন কতা টাইন্না আনে! দেহো কারবার!

আমাগো উস্তাদে আর উস্তাদ মায়ে কইলাম এমুন আজাইরা ডর-খাওনের জীব আছিলো না! হেগো কন্যা হইয়া, বুচি বিবিয়ে যে কেমনে এমুন হইছে! এমুন ডরুক!

অ হো রে! আগে তো বাবা আদমের এই সন্তানেরে জিয়ন্তী দেওনের চেষ্টাটা করি! একবার তো একটা চেষ্টা দিয়া দেহি! এই জলে-ভাসা, পেরায় দম-খোয়ান্তি মনিষ্যিটারে, বাচান্তী যায় নিকি, হেইটা দেহি তো আগে! পরের ডর পরে করমু নে!

হেই চেষ্টা করছি! করছি তামানটা রাইত ভইরা! হেইরবাদে আরো মেলা মেলা দিন! যতেক প্রকারে যতন দেওন যায়, দিয়াই গেছি! যতেক রকমে চেষ্টা করোন যায়, কইরাই গেছি!

খোদায় হেই চেষ্টারে কামিয়াবীও দিছে!

অমুন পানিত-ডোবা, অমুন ফুইল্লা আজদাহা হইয়া যাওয়া শইল্লের যেই মর-মর কন্যা! হেয় জ্যাতা হইছে! হেয় বাইচ্চা ওঠছে! দয়াল দয়াল! তুমি হায়াত রাখলে, মারবো কেটায়! না-বাইচ্চা কই যাইবো? আমরা দোনোজোনে তো খালি একটা উছিলা!

হেই তুফাইন্না রাইতে কিন্তুক কন্যারে নিয়া, একটা কড়ড়া পেচ বান্ধছিলো! কুম্ভীরে আর গাঙের ঢেউয়ে তো দেহখানেরে পাড়ে তুইল্লা দিছে! এক সঙ্কট গেছে! কিন্তুক অত্তা বড়ো শালে-জুয়ান শইল! ভিজ্জা, ফুইল্লা না অইটায় দুনিয়ার ভোমা আর থলথলা হইয়া রইছে!

হেই দেহখানেরে কেমনে বাইরার-উটান তেনে ভিতরের-উটানে তুইল্লা আনমু? আমাগো দোনোজোনের শইল্লে কি হেই জুইত দিছে মাবুদে? এমুন আপদের খোনে, অখন তাইলে কী উপায় গো সাই! পন্থ বাতলাও রে!

তহন কোনো পন্থ না পাইয়া; তেরা-লেঙা দুইজোনে করি কী, হেই গাঙ-পাড়েই কন্যারে যতন দেওয়া শুরু করি! রাইতের তুফাইন্না ঢল, আমাগো দোনোজোনের মাতার উপরে, আছড়াইয়া আছড়াইয়া পড়তে থাকে! বাদলা-মেঘের গরজানি আর চিলকানী নিয়া নিয়া ঠাটার উপরে ঠাটা পড়তে থাকে! হেই সগলের দিগে কে নজর দেয়?

দেহি আলা, আকন্দ পাতার সেঁকে কোনো ফল ফলে নিকি! দেহি অখন! আইল্লার তুষের আগুনে, কতখোন জাগনা দিয়া থাকতে রাজি হয়! দেহি তো অখন, দয়ালের মোনে কী আছে!

অই ত্তো! দেহো গা তো অখন? আল্লার মাল হেই কন্যায় অখন, কেমুন লড়তাছে চড়তাছে! সোন্দর চলতাছে লড়তাছে! আহা! কেমুন সোন্দর সেয়, আমার সগল কতা মান্যি দিয়া দিয়া চলতাছে! কেমুন সোন্দর সেয়, গাঙপাড়ে গিয়া বইয়া থাকোনের টোটকাখানেরে মান্যি করতাছে! দেইক্ষা পরানে শান্তি লাগে না নিকি? লাগে কইলাম! বহুত শান্তি লাগে!

নিত্যি সগলগিলি দিনই অখন, ভোর-বিয়ানটায় এট্টু খালি ফুইট্টাও সারে না! আমি তহন কী করতাছি? আমি ধুমধুমাইয়া বাইর অইয়া যাইতাছি! সিধা আইয়া এই খড়া জালের খুঁটিগুলাতে খাড়াইয়া যাইতাছি! অখন আমি সেইটা ক্যান করতাছি?

খালি মাছ ধরোনের ঠেকার কারোণেই হেইটা করতাছি না! আদতে য্যান এইটা করতাছি, অন্য একটা কারোণে! কেমুন একটা সুখের ঠেলা পাইয়া পাইয়া য্যান এমুনটা করতাছি! অখন ক্যান জানি, নিজ পরানের ভিতরে খালি শান্তি লাগতাছে! সুখ জাগনা দিতাছে! মাবুদে জানে, ক্যান এমুনটা হইতাছে!

মাছ তো বলতে গেলে নিত্যিই ধরতাছি অখন! বেসুমার মাছ ধইরাই যাইতাছি নিত্যি! অখন, একদিন মাছ ধরলে তিনদিন পার হইয়া যাওনের অবস্থা আমাগো! আর, অতো খাইবো কেটায়! তাও নিত্যি বিয়ানে আমি মাছ ধরোনের উছিলায়, এই খড়াজালের বাঁশের উপরে আইয়া খাড়াইয়া যাইতাছিই!

ক্যান?

ক্যান?

আদত কতাখান জানে কেবল আমার অন্তরে! মাছ ধরোনের উছিলায়, আমি কী করতাছি? অই উছিলায় নিজেরে আমি এট্টু দুরুত্বিতে লইয়া আইতাছি! এট্টু একলা হইতাছি! হইয়া, আসমান আর গাঙের বরাবরে খাড়াইয়া, সগল বিষয়রে বিবেচনা করোনের চেষ্টাটা নিতাছি খালি!

দয়ালে আমাগো লইয়া, এইটা কোন খেইল খেলতাছে! এইটা হের কেমুন লীলা! কার পরানের ঝিয়েরে হেয়, আমাগো ভিটিতে ভাসাইয়া আনছে! অমুন একজোনেরে যতনে রাখি! হেই সাধ্যি তো আমাগো দেও নাই তুমি, সাঁই! তাইলে কেমনে কী! কও কও সাঁই! ভাইঙ্গা বুজাইয়া দেও তুমি!

দয়ালে আমাগো লইয়া, এইটা কোন খেইল খেলতাছে! এইটা হের কেমুন লীলা! কার পরানের ঝিয়েরে হেয়, আমাগো ভিটিতে ভাসাইয়া আনছে! অমুন একজোনেরে যতনে রাখি! হেই সাধ্যি তো আমাগো দেও নাই তুমি, সাঁই! তাইলে কেমনে কী! কও কও সাঁই! ভাইঙ্গা বুজাইয়া দেও তুমি!

অদিগে, অন্য আরেকখান বেপারও আইয়া হাজির হইছে! হেইটায় ভিতরে ভিতরে না আমাগো দোনোজোনেরে বেচঈন কইরা দিতাছে! না হেই বেচঈন্না বেপাররে মোখে বেক্ত করতে পারতাছি! না অন্তর তেনে মুইচ্ছা ফালাইতে পারতাছি!

হইছে কী, কন্যাখানেরে ভিটির এদিগে-হেদিগে এট্টু লড়া-লড়ুন্তী করতে দেখি তো! হেইটা দেখতে দেখতেই, আতকার উপরে, আমার কইলজার ভিতরটা য্যান কেমুন চিপা দিয়া ওঠতে থাকতাছে! য্যান খালি কেমুন একটা টেঁটা আইয়া, ঘ্যাচ্চর কইরা আমার কইলজারে বিন্ধানী দিতে থাকতাছে! আমার কইলজাটারে ছিড়া থেতরা-মেতরা কইরা কইরা, বেধুম লউ বহাইয়া দিতাছে! উস্তাদের ঝিয়ে আমারে কয়, হেরও বোলে হেই একই দশা!

এই কন্যার লেইগা য্যান, আমাগো দোনো পরানীর দীলের ভিতরেই, মায়া জাগানী দিয়া ওটতাছে! বহুত বহুত মায়া! আমাগো খালি মোনে অইতে থাকতাছে, এই কন্যায় আমাগো আপনের আপন! রক্তের নিধি! দুনিয়ার সর্ব কর্ম ফালাইয়া থুইয়া কেবল কন্যাটার মোখের দিগেই অহন আমাগো চাইয়া থাকোন দরকার!

আহা! এইটা যুদি আমাগো কোলের ছাও হইতো! আমাগো কোলে কোলে যুদি এরে ডাঙর করোনের কিসমত পাইতাম! আহা! এক্কেরে ছাওকাল তেনে যুদি হেরে আমরা পাইতাম!

আহা! পরের বাড়ির এমুন সোনার ঝি! আমাগো এই ভাঙ্গা ঘরে কেমনে তারে সমাদর করি! কেমনে তারে পুরা যতন দেই!

পরক্ষণেই আবার মনের ভিতরে আরেকখান বাঞ্ছা ফাল দিয়া দিয়া ওটতে থাকতাছে! বিধিয়ে যুদি এরে মিলাইয়া দিলোই! তাইলে চির-জনোমের লেইগাই এই কন্যারে আমাগো কোলে দেও দয়াল! এরে আমাগো অক্ষির সামোনে রাখোনের নসীবখান দেও মালিক! ও হো রে, বিধি! দিতা যুদি হেই কিসমত! এরে তুমি আমাগো কোল তেনে ছিনাইয়া নিয়ো না বিধি! কোনোদিন নিয়ো না!

তয়, দীলের গহীনের এমত সগল কতারে আমরা দোনোজোনে, দীলের নিরলেই ডুবাইয়া থুই! এমুন আস্পরদার কতা নি মোখে আনতে আছে! আমরা না গরীবের হদ্দ গরীব! দেখতে না কেমুন কুছবির কুছবি আমরা দোনোজোনে?

টুণ্ডা টেমরা এমুন দুইটা বদছুরত পেরানী! হেগো দীলে এমুন বাঞ্ছা-খায়েশ আহে কেমনে! কোন সাহোসে আহে! সম্ভব? এই কন্যায় হইলে হইবো কোনো বাদশা-নাজিরের ঘরের কন্যা! হেরে সমাদর কইরা রাখোনের হ্যাটাম কি বিধিয়ে আমাগো দিছে?

যাউক যাউক! যাগো কইলজার টুকরা, তাগো কোলেই ফিরা যাউক! নিষ্কণ্টকে ফিরতি নেও রে মালিক, এই কন্যারে!

হ! আমি এই সুখতী গাঙের কিনারে, একটুকরা এট্টু একটা ভিটিতে থাকি! অহনকার কালে, অখন এইনে, পক্ষের পর পক্ষ যায়! চান্দের পর চান্দ ভইরা ওঠে, তারবাদে আবার ফুরায়! এই অহনকার দিনে, একটা কোনো জ্যাতা মাইনষের মোখও আর আমরা চক্ষে দেহি না! জোলাপাড়ার হগলতেরে দয়ালে লইয়া যাওনের বাদে, এই এতো বচ্ছরে, এই একখান খালি জ্যাতা মাইনষের মোখ দেখাইলো মালিকে!

জানি না সাঁইয়ে এইটা কারে, কইত্তেনে আইন্না দিছে! কেটায় হেয়! হেইটা খালি সাঁইয়েই জানে! আমাগো দোনোজোনের বুঝে কিছুই কুলায় না!

দিন গোনতে গেলে কওন লাগবো যে, অখন বহুত বহুতদিন পার হইয়া গেছে! কিন্তুক এককালে, আমার জিন্দিগীতে, একখান মস্ত বেপারও ঘটছিলো! হেই বিস্তরদিন আগে, এই আমারেই নিকি দূরের নগর-মুল্লুকে যাইতে হইছিলো! হেই যেইনে বসত কইরা কইরা আমাগো বাদশা-কোট্টালেরা রাজ্যি চালায়! অই মুল্লুকে আমারে যাওন লাগছিলো একদিন! উস্তাদে হুকুম দিছে যাইতে! না-গিয়া রক্ষা আছে!

এই যে মালিকের দুনিয়া! এইনে কত্তা জাতেরই না পইখ-পাখালী আছে! কত্তা পদেরই না কাউয়া-কুকিলি-কইতর আছে! হিয়াল-বেজী-সর্প-বাগডাশা আছে! হেরা যেমুন আছে, তেমুন হেগো জবানও কিন্তুক আছে! মাইনষের কী বদ কিসমত! হেই জবানেরে বোজোনের হ্যাটাম তাগো নাই!
তয়, গুটিকয় উস্তাদ লোকে কী আর হেই জবান বোজোনের বিদ্যারে শিক্ষা করে নাই? যুগ-জনোম ভইরাই দুই-চাইরজোনে অইটা শিক্ষা কইরা গেছে! আবার নিজ নিজ শাকরিদরেও শিখান্তী দিয়া গেছে!

আমার এই উস্তাদেও হেই এলেমে জব্বর কামেল আছিলো! পইখ-পাখালীর বাত বোঝোনের এলেম, হেকমত আমার আদি উস্তাদের আছিলো তো! বহুত তেজী রকমেরই আছিলো! তাও হের কী মরজি হইছে! হেয় নিজে আমারে হাতেখড়ি না-দিয়া কিনা, হেই কোন নগর মুল্লুকে আমারে পাঠাইয়া দিছে!

হেই নগর-মুল্লুকে অতি এলেমদার এক উস্তাদে বোলে বসত করে! হের কদম মোবারকের ধুল পোছোনের লেইগাই আমারে পাঠায়! হেই ধুল পুছতে পুছতে আলা বিদ্যা যট্টুক হওনের, হইবো নে!
বোজো কথাখান!

অখনকার এইকালে; আগেকার দিনের সগল কিছুরেই, আমার য্যান স্বপন বইল্লা মোনে হইতাছে! কিন্তুক একদিন তো অইসগল কিছু, হাছা হাছাই হইছিলো! একদিন নিকি সত্য সত্যই আমারে তালেব-এলেমের জিন্দিগী পার করতে হইছিলো! একদিন নিকি আমারে, বাদশা-রাজড়া উজির-পিয়াদাগো মুল্লুকে গিয়া থাকতে হইছিলো! বেশিদিন থাকতে পারি নাই! কিন্তুক দিনকতক তো থাকছিলামই!

হেই মুল্লুকের উস্তাদের কাছে, আমি খালি দশ চান্দ থাকতে পারছি! হেইর মিদেই একদিন ভাটির বেইলের কালে, আমার নগর মুল্লুকের উস্তাদে দেখে, এক আজিব বেপার ঘইট্টা গেছে তো! দেহো দেহো! একখান জংলা কইতর আইয়া, উঠানে পউড়া ডেনা দাপড়াইতাছে! আরে! কী কী! এই ভেদের মীমাংসা কী!

মীমাংসা অতি সরল! এই কইতরে তার ডেনার নিচে কইরা একখান পত্র লইয়া আইছে! আমার আদি উস্তাদে জোর হুকুম দিছে, পত্তর পাঠ আমি য্যান বাড়ির দিগে মেলা দেই! সুখতী গাঙের কিনারে আমাগো যেই ভিটি, হেইনে মুসিবত দেহা দিছে! খামাখা কইরা হেইনে গিয়া পাও না-রাখলে উপায় নাই!

ইয়া সাঁই! কী বালাই না-জানি তুমি দিয়া থুইছো আমাগো ভিটিতে! রহম দিয়ো মালিক তুমি!

ভিটিতে ফিরা দেহি, উস্তাদ মায়ের অহন-তহন অবস্থা! আহা!

অইটা ছাড়াও ভিটিতে আরো একখান বিপদ আইয়া খাড়াইয়াই রইছে! যেই দশ চান্দ আমি বাইত আছিলাম না, হেই কয়টা দিনের মিদেই যা সব্বনাশ হওনের, হইয়া রইছে! আমাগো কচি, ফুরফুরা বুচি বিবিরে আলাই-বালাইয়ে নান্দিনাশ কইরা থুইয়া গেছে!

হের জ্বর আইছিলো! যাহা-তাহা জ্বর না! দিনের পর দিন, শইলটা য্যান হইয়া আছিলো তপ্ত খোলা! হেই খোলায় ধান ছোয়ান্তী গেলে, চক্ষের নিমিষে ধানসুদ্দা খই হইয়া যাইতো! এমুন জ্বর হেইটা! তারবাদে হেই বিমারেও একদিন বিদায় নেয়! কিন্তুক যাওনের কালে একখান অঙ্গ না-নিয়া হেইটায় বিদায় হয় নাই!

আমাগো উস্তাদ মায়ের পরান-ভোমরা, হের জানের জান, এই আমাগো বুচি বিবির; একটা পাওরে টুন্ডা কইরা থুইয়া, তয় হেই ব্যাধিয়ে গেছে!

আহহারে! কেমুন এক সোনার চানরে, বাইত থুইয়া গেলাম আমি! তহন সেয় গুড়গুড়াইয়া হাটোন্তী দিতাছে! লড়ুন্তী দিতাছে! আর, ভিটিতে ফিরা আইয়া আমি এইটা কী দেখতাছি! দেখতাছি যে, আমাগো বুচি বিবির হাতে লাডি! লাডি হাতে সেয় ধুঁকতে ধুঁকতে লড়তাছে-চড়তাছে! আহ!

তারবাদে ঠিক দুই চান্দ পরেই, উস্তাদ মায়ে দুনিয়ার তেনে বিদায় হইলো! সেয় গিয়াও সারে না, পরের চান্দে তহন ভরা পুন্নিরে পাইয়াও সারে না, তক্ষণই নিকি উস্তাদের যাওনেরও হুকুম আইয়া পড়লো! মালিক সাঁই! এইটা তোমার কী বিছার!
তহন কে উস্তাদের ঝিয়েরে দেহে, কেটায় বা আমার দিগে চায়! আমরা তহন সদ্য বিয়াইস্তা জামাই-বউ! দুইজোনে তহন; না চিনি সংসারের আগুন, না বুঝি গিরস্থালির পানি! ও হ্হো রে! কী দিন না গেছে আমাগো!

কতা সত্য যে, কোনো এলেমই আমি ভালাপ্রকারে হিগোনের কিসমত পাই নাই! উস্তাদের-ঝিয়েও হেই এলেম, অল্প-এট্টুই জানে! কিন্তুক তাও পইখ-পাখলি আর চাইর পাইয়্য়া জীবের বাত-জবানের ভেদ আমি ধরতে জানি! আমরা দোনোজোনেই জানি! আমি নগরের উস্তাদের কাছে যেট্টুক এলেম পাইছিলাম, এই ভিটিতে বইয়া আদি উস্তাদে হেইটারে আট্টু অল্পই খালি বাড়ান্তী দেওনের ফুরসুত পাইছিলো! বেশি কিছু না!

আর, উস্তাদ-মায়ে হের মাইয়ারে আর এই অভাইগ্যারে দিয়া গেছে কড়িবিদ্যা! কড়িরা তো আর আওয়াজ দেয় না! এরা তো কতাও কয় না! তয়, লড়ন্তী-চড়ন্তী দিয়া ভাবে-প্রকারে হেরা বাত-চিত কিছু কমও করে না!

থাউক! অন্তরের এলেম অন্তরের ভিতরেই থাউক! ভেদের কতা লইয়া এমুন কী অন্তরেও লড়ালড়ি করতে নাই! উস্তাদের এমুনই হুকুম! তয়, আমার সগল এলেমই কিন্তুক আমি আমাগো উস্তাদের ঝিয়েরেও দিয়া থুইছি! এক্কেরে পাতিপাতি কইরাই হেরে শিক্ষা দিয়া থুইছি!

আমি চোখ বোজলেও; এই এলেম দুনিয়ার তেনে এক্কেরে নাই হইয়া যাইবো না! উস্তাদের ঝিয়ে তো থাকলো দুনিয়ায়! তয় হেয় যহন থাকবো না, তহন? তহন, হেইর পরে আর কিছু নাই! তহন, সগলই নাই হইয়া যাইবো! কিসমতের লিখনের বেশি কি কিছু পামু আমরা? পায় কোনোজোনে!

আশা আছে, আমি চোখ বোজলেও; এই এলেম দুনিয়ার তেনে এক্কেরে নাই হইয়া যাইবো না! উস্তাদের ঝিয়ে তো থাকলো দুনিয়ায়! তয় হেয় যহন থাকবো না, তহন? তহন, হেইর পরে আর কিছু নাই! তহন, সগলই নাই হইয়া যাইবো! কিসমতের লিখনের বেশি কি কিছু পামু আমরা? পায় কোনোজোনে!

নগর-মুল্লুকেরে একদিন, নিজ অক্ষিতে দেইক্ষা আইছিলাম তো! হেইর লেইগাই কিন্তুক আমি পষ্ট কইরাই বুজি, এই পানি-ভাসা কন্যা আমাগো বাদশা-কোটালগো ঘরের কেউ না! আমি নগর-মুল্লুকে রাজা মাইনষের ঝি-বউগো লড়া-লড়তি করতে দেখছি না? দেখছি তো!

হেগো সর্ব অঙ্গ তো জেওরে জেওরে পুরা ঢাকুন্তী পউড়া থাকে! জেওরে জেওরে হেরা না পুরা ঠাস-ঠাসা! হেগো লইয়া লইয়া পালকি যাইতে থাকে! আর হেরা নিজেগো অঙ্গ ভইরা লইয়া যাইতে থাকে, জেওরকে জেওর! ছুবানাল্লা! হেগো মাতায় কাপড়! অঙ্গে অঙ্গে ফিনফিনা বস্ত্রের উপরে বস্ত্র! আর, ঝিকমিকা সোনাদানা!

কিন্তুক আমরা যারে পাইছি, হের বস্ত্র তো হেমুন না! অই যে কন্যার পিন্ধনের বস্ত্র-সস্ত্র! এগিলি কেমুন ধারার বস্ত্র! আমাগো কোট্টাল-উজিরের ঘরের ঝি-বউ তো দূরের কতা! আমাগো মুল্লুকের কোনোদিগের কেউরেই তো, এমুন বস্ত্র, কোনোকালে পিন্ধতে দেখি নাই!

জোলাপাড়ার কেউরেই তো এমুন বস্ত্র কোনোকালে বানাইতেও দেহি নাই!

আবার দেহো! এই কন্যার সর্ব অঙ্গের কোনোদিগে, একটা কোনো জেওরের চিন্নসুদ্দা নাই! নাকে বেসর নাই! কানে কানপাশা তো না-ই! হইতে পারে গাঙে ভাসোনের সোমে, অন্য অন্য জেওর হের অঙ্গের তেনে খুইল্লা গেছে গা! কিন্তুক হাতের কঙ্গনা, কানের বালি তো শইল্লেই থাকোনের কতা! কিন্তু হের অঙ্গে তো কোনো জেওরের নামগুষ্টি নাই!

তাইলে হেয় কেটায়? হেরে য্যান আমাগো মুল্লুকের কোনো জোন বইল্লা ঠাহর অয় না! কেটায় সে? তারে তাইলে আমি কই দিয়া আমু? কাগো বাইত?

আর, এই যে হের জবান! এইটা যে কেমুন জবান! হেইটা ইস্তক অখন তরি আমি ধইরা উঠতে পারলাম না! এই যে কেমুন জবান, হেইটা এট্টু আন্দাজও করতে পারলাম না! হের কোনো একটা কথা, আমরা বুঝি না! একেবারেই য্যান হেইটা বোঝোনের কোনো পন্থ নাই! বোবা চক্ষে না খালি হের দিগে চাইয়া থাকোন লাগে!

হেয় এইটা কেটায়? কে সে?

তবে, অখন একটা উপায় য্যান বাইর হইবো! হইবোই! আমার এমুনই লাগতাছে!

উস্তাদে আমার বিস্মরণ সরানের লেইগা যেই টোটকাটা করছিলো! আমিও না হেষে হেইটাই, এই কন্যার লেইগাও করতাছি! পুরাটা দিন হেরে গাঙের সামনে বহাইয়া থুইতাছি! সুখতী গাঙের পানি গো! অগো তরঙ্গরা, এই আজনবির বিস্মরণ ঘোচবো, না ঘোচবো না?

এমুন কিছু একটা যে একদিন হইবো! এমুন এক আজনবির, আধা জ্যাতা দেহ যে একসোম ভাইস্যা আইবো! এমুন একটা কথা আমার উস্তাদে কইলাম আমারে কইয়া থুইয়া গেছে! কিন্তুক আমার হইলো গিয়া পানি-ভাসা, গুটি বসন্ত দংশানী-খাওয়া চিত্ত! এই চিত্তিয়ে, হগলই বিস্মরণ পাইয়া থাকে! দণ্ডে দণ্ডে সব কথা ভোলে! এই নিয়া আমার পরিবারের লগে নিত্যি কেচাল নিত্যি অশান্তি!
নিত্যি তিন-সন্ধ্যার কালে উস্তাদের-ঝিয়ে আমারে ফরমাইশ দেয়, ‘হোনেন গো মিছার বাপ! চঙ্গটারে কইলাম গোয়াইল ঘরের ভিতরে থুইয়া, তয় আপনে হাত-পাও ধুইতে যাইয়েন!’ হেয় ফরমাইশ দেয়, আমিও লগে লগে জব দেই, ‘এই ত্তো থুইতাছি!’

মালিক সাঁই! হেইরবাদে নিকি লগে লগে আমি সেই ফরমাইশটারে বিস্মরণ করি! সোন্দর চঙ্গের জায়গায় চঙ্গ পইড়া থাকে, আমি এদিগে পাও ধুইয়া ঘরে ঢুইক্কা শেষ! খালি অইটুকই না! আমি পিঁড়িখানরে টাইন্না লইয়া, এক্কেবারে পাতে খাওন পাওনের লেইগা বইয়া পড়ি!

পরিবারে তহন আমারে ভাত বাইড়া দিবো কী, হেয় শীতল চক্ষে আমার দিগে চাওন দেয়!

‘কী আবার অইলো? এমনে চাওন দিয়া রইছেন ক্যান?’ আবা-জাবা কিছুই ধরতে না-পাইড়া আমি বেকুব-মোখে তারে তখন জিগাই! নিত্যি এই বিত্তান্ত!

‘চঙ্গরে থুইছেন ভিতরে?’ উস্তাদের ঝিয়ে কী কী জানি খুলিবিলি খুলিবিলি করতে করতে, আমার দিগে চায়!

দয়াল রে! কেমতে তুমি আমারে এমত বেভুলা-মনিষ্যি বানাইয়া থুইলা! চঙ্গরে তো গোয়াইলে থুইতে আমি বিস্মরণ হইছি! অহন তাইলে কী! যাই, কপালে ঠুন্ডা পিছা মাইরা, কর্ম সাইরা আহি গা! ঘসটানী দিয়া দিয়া আলা যেইনকার চঙ্গ, হেইনে থুইয়া আহি!

হেই কামে অহন দুই দণ্ড লাগুক কী এক পহর লাগুক, লাগুক গা! পাইল্লার গরম ভাতে যুদি ততখোনে ঠান্ডা কড়কড়া হইয়া যায়! হউক! উস্তাদের মাইয়ার দীলের তেনে তো চঙ্গের অশান্তি সরবো! হেইটা হইলে আমারও শান্তি!

এইই তো হইতাছে আমার সংসারে! যুগজনম ভইরা এইই!

আবার হেই বিয়ান আইবো! আবার হেই চঙ্গরে গোয়াইল তেনে ঘসটাইয়া ঘসটাইয়া বাইর করোন্তী! আবার হেইটারে ঘরের বেড়ার লগে ভাও-মতোন খাড়া কইরা দেউন্তী! নিত্যি এইই একই কর্ম! চঙ্গ লাগান্তী দেওনের লগে লগে উস্তাদের ঝিয়ে, টুন্ডাইয়া টুন্ডইয়া হেই চঙ্গ বাওন ধরবো!

নিত্যি চঙ্গ বাইয়া বাইয়া হেয় এক্কেরে ঘরের চালের কাছে যায় গা! গিয়া, থামোন্তী দিয়া, হেয় আনাজ তোলোন শুরু করে!

চালে চালে দুনিয়ার আনাজের ঝোপড়ারে সেয়, নিত্যি তুইল্লা দিতাছে! হেই আনাজেরে নিজ হস্তে তোলা-ছিঁড়া না-করলে য্যান, হের জিন্দিগি আলুনি আলুনি লাগতে থাকে! যেইদিন কিছুই তোলোনের থাকে না, হেদিন হেয় কালা মোখে ঝোপড়াগিলির দিগে চাইয়া থাকে! থাকে থাকে, তাও নামোনের কতা হের য্যান মোনে আহে না!

এই তো নিত্যি নিত্যি বিয়ানে আর সইঞ্জার বেইলে- চঙ্গ লইয়া এমুন হেচড়া-পেচড়া দেওন লাগতে থাকে! তাইলে থাউক না চঙ্গখানে, ঘরের বেড়ার কাছে! বরাবইরের লেইগা এমুনই থাউক? হেইটারে এমুন আনোন-নেওনের কোন কাম!

কিন্তুক, এই কতা কারে হোনানো যাইবো! হেয় এট্টুও কানে নেয় না কতাখানেরে! খালি কয়, ‘রাইতে এমনে বাইরে পউড়া থাকলে, বাঁশের চঙ্গয়ে আর আস্তা থাকবো? হেইটারে ঘুনে ধইরা ফালাইবো না?’

কী বুঝ হের! অহন, কী আর কমু! কারে কী কমু! দয়ালে যের লেইগা যেইটা ধাজ্জি কইরা থুইছে, হেরে সেইটা নিয়াই সবুরে থাকতে হয়! উস্তাদে ঢোকে ঢোকে আমারে তো, এই শিক্ষাই দিয়া গেছে! আমিও নিজেরে এই বুজই দেই! কী কাম পেঁচ বাড়াইয়া!

শাঙন মাসের শেষের তেনে, অচিন-মুল্লুকের অই কন্যারে আমি গাঙ বরাবইর বহান্তী শুরু করছি! এই অখন আইয়া গেছে আশশিন মাস! অখনও হের কী কিছুই স্মরণে আহে নাই? কিছুই না? যুদি হের নিজের নাম বংশ-স্মরণ হইয়া যাইতো, তাইলে কি হেইটা আমার অজান্তি থাকতো? আমি হেইটা সঠিক কইরা কইতে পারি না!

ঝাঁপির ভিতরের কড়িরা আমারে কট্টুক অবগত কইরা দিতে পারবো! হেইটাও আমার জানা নাই!

কড়িরা একদিন আমার বিষয়ে তো উস্তাদেরেও অবগত কইরা দিছিলো! আমার পইল্লা জিন্দিগির বহুত কিছুই যে, আমার স্মরণে আইছিলো; সেইটা উস্তাদে নিচ্চয় কইরাই বুইজ্জা গেছিলো! কিন্তুক কট্টুক হেয় বুইজ্জা গেছিলো? কট্টুক? এইটাও আমার অজ্ঞাত! উস্তাদে আমারে ভাইঙ্গা কিছুই জয়-জিজ্ঞাস করে নাই! উস্তাদ মায়েও কিছুই জিগায় নাই!

আমিও ভাইঙ্গা কইতে যাই নাই কিছুই! কী কমু? বিষয়-বিবরণ আমার স্মরণে আইছিলো সত্য! কিন্তুক হেইটুক স্মরণে আইলে কী! আমার নাম-সাকিন তো আর স্মরণে আহে নাই! কোন দ্যাশ কোন গাও, আমার বাপের কী নাম, কেটায় আমার মা! হেই সগলের কিছুই তো আমি স্মরণ পাই নাই! কোনোদিনই তো আর স্মরণে পাইলাম না! তাইলে বিষয়-বিত্তান্তর কতা কইয়া কোন উবকার হইবো? কিচ্ছু না!

তেমুন এই কয়দিনের মিদে, এই কন্যায়ও যুদি কিছু স্মরণে পাইয়া থাকতো; আমার হেইটা অজান্তী থাকতো না! কড়িরাই আপনা তেনে লড়াচড়ি দিতে দিতে জানান্তীর কর্মখান সাইরা থুইতো! কিন্তুক কড়িগিলি, নিদালী ভাবে পইড়া রইছে যে রইছেই! জাগনা পাইতাছেই না! অরা জাগুন্তীতে আইলে আমাগো উস্তাদের-ঝিয়ের চক্ষে পড়তোই! হেয় না দিন-রাইত অই কড়িগিলির চুপড়িটার দিগে নজর দিয়া থুইছে!

এই যে কড়িগিলি! এগিলি বহুত কামেল জিনিস! ঘটন-অঘটনের সগল বেপার হেরা, ঘরের লোকেরে জানান্তী দেয়ই দেয়! বহুতই নিকি কেরামতীর বেপার ঘটায় অরা! কিন্তুক এই সগলই আমার হোনা কথা! উস্তাদে গত হওনের বাদে, আমাগো দোনোজোনের সামনে কড়িগিলি কোনোদিন জাগুন্তী দেয় নাই! অরা সগলসোমেই নিদালী ভাবে আছে!

অরা কহন যে জাগনা পাইবো, হেইটা কওনের সাদ্দি য্যান কোনো মনিষ্যির নাই! হেই একবার আমার আদিকালে, আমি যহন গাঙপাড়ে গিয়া গিয়া বিস্মরণ ঘোচান্তীর টোটকা মান্যি করতাছি, হেই তহন বোলে হেরা জাগনা পাইছিলো! হেইটাও উস্তাদে কইছে! আমি হুনছি! তারবাদে গন্ডা গন্ডা সন যাইতাছে গা! এরা যেমুনকার নিদালী আছিলো, তেমুনই পইড়া আছে! কেমুন কারবার! এগো আদি মালিকে নি এগো নিদালী-ধুলপড়া দিয়া থুইয়া গেছে?

আইচ্ছা! কড়িগিলির কতাখান যহন উটলোই, তহন হেইটাই আগে ভাইঙ্গা কই!

কোন বোলে আছিলো এক দ্যাশ! হেই দ্যাশে বোলে আছিলো এক বাইদ্দানী! হেয় বোলে আছিলো একলা এক জোন! কোন কারোনে কে জানে! হেয় বিবাগী হইয়া, একলা একলা, দুনিয়াতে লড়তে-ফিরতে থাকে! ফিরতে ফিরতে একবার হেয় নিকি, এই আমাগো মুল্লুকে আইয়া পড়ে!

হেইরবাদে, পন্থ চলতে চলতেই হেয় বিমারীতে পড়ে! মালিক মালিক! আতকার উপরে নিকি হেরে, দাস্ত-ভেদের বিমারীয়ে দয়া দিয়া দেয়! ওলা বিবি কারে যে কোনসোমে দয়া দিবো, কেউ নি জানে হেইটা! কপালের লিখন!

দাস্ত-ভেদ হইতে থাকলে; কতখোন আর একজোন মনিষ্যি নিজের চেতনখান রাখতে পারে! বাইদ্দানী বুয়ায়ও এট্টুর মিদেই চেতনহারা হইয়া, ক্ষেতের আইলে পইড়া যায়! আলা অহন খালি, জান-কবোজের ফিরেশতার লেইগা ধুকতে-পুঁকতে থাকা! মাতার উপরে শকুন-চিলে তহন বেধুম উড়া-লড়ি! মউতারে খাওনের নিয়তে, হেটিয়ে, এক্কেরে পাগলা অইয়া শেষ!

অমন কালে উস্তাদ মায়ে যায় পাতরের ক্ষেতে! যায় শাগ তোলোনের নিয়ত কইরা! গিয়া, কিয়ের শাগ কিয়ের কী! বাইদ্দানীরে লইয়া কী একটা লৌড়ালৌড়ি যে পড়ে! হেই বিমারীর হায়াত আছিলো! গরম ফেন আর বেতসের ডগার ভরতা তো খালি উছিলা মাত্র!

জানে বাইচ্চা উইট্টা বাইদ্দানী বুয়ায়, আমার উস্তাদ-মায়েরে খালি ধর্মের ঝি-ই ডাকে না! তারে কড়ি-পড়াও শিক্ষা দিয়া যায়! ক্রমে সেই এলেম— উস্তাদ মায়ে, হের খসমেরে শিক্ষা দেয়! হেইর বাদে হেরা দোনোজোনে হেই বিদ্যারে, আমাগো হস্তে গচ্ছিত থুইয়া যায়!

ছোটোমোটো বেতের চুপড়িখানের ভিতরে রাখা আছে— তিনখান কড়ি! বকের শইল্লের লাহান ফকফক্কা তিন তিনটা কড়ি! তাগো যুদি তোমার সত্যকারের আপৎকালে ডাক দেও, তাইলে তুমি কড়ি তিনখানেরে জাগনা দেখতে পাইবা! নাইলে না! নাইলে কোনোপ্রকারেই কড়িরা জাগনা হইবো না!

হেই আমার উস্তাদের জিয়ৎকালের পরে, আর একবারও তো কড়িরা জাগুন্তী পাইলো না!

কন্যারে গাঙ বরাবইর বহাইয়া; আমি আর উস্তাদের ঝিয়ে, কড়ি তিনটারে নিদ্রাছাড়া করোনের মন্ত্রসুদ্ধি দিছি!

‘অরে মেঘ ফনফনা, বক-পাখনা ধবলা কড়ি! অরে নিদ-ডুবুন্তী কড়িসগল! নিন্দ ঘুচাও! জাগনা লও! কন্যার দিগে হুঁশ দেও! ভেদের মীমাংসার কী হইলো, আমাগো জানান্তী দেও! যেমুন একদিন আমার উস্তাদেরে আমার বিষয়ে জানান্তী দিছিলা! আমাগোও তেমতে জানুন্তী দেও!’

না! অখনো কড়ি তিনজোনে জাগনা দেয় নাই! হেরা যেমনকার চুপড়ি-নিদ্রায় আছিলো, তেমতেই আছে! কিন্তুক, বৈদেশী কন্যার লড়া-লড়ুন্তীতে কেমুন জানি এট্টু অদলা-বদলা হইতে দেখা যাইতাছে! অনেক একটা বদলানী! কী আমার পরিবারে কী আমি; হের এমুন বদলানীর কতা কইলাম স্বপ্নেও ভাবি নাই! এমুন কিছু যে হইতে পারে, এমুনটা চিন্তায়ও পাই নাই! কেমনে যে কী অয়! দয়ালে জানে হেইটা!

হইছে কী! আজউকা জাগনা পাইয়াই, আমি গেছি আমার কপালের বাড়া ভানতে! কী? না! গোয়াইল তেনে চঙ্গখানেরে আইন্না ঘরের বেড়ার লগে খাড়া কইরা থুইতে গেছি! গিয়া দেহি, গোয়াইল ঘরের জায়গায় ঘর পইড়া রইছে! চঙ্গয়ে হের জায়গায় নাই!

কয় কী! চঙ্গয়ে গেলো কই?

চঙ্গয়ে আইয়া, জায়গার জিনিস জায়গায় খাড়াইয়া রইছে!

কেমনে? কেমনে! আমি তো রাইতে হেরে গোয়াইলে নিয়া থুইছি! হেইটা থুইতে তো আমি কিছু এট্টু বিস্মরণ হই নাই, কালকা! তয়?

 

 

• বলো বলো হে নদী! জানো তুমি কিছু?


অনেস্টলি বলছি, এই নদীটাকে রিকোয়েস্ট করে করে আমি—আমি—একেবারে টায়ার্ড হয়ে গেছি! শী মেইড মী ডেড টায়ার্ড! এন্ড আই অ্যাম সীক অফ হার! ওফ! আই নিড টু নো! বেগ য়্যু ডিয়ার! প্লিজ! ইফ পসিবল, দেন হেল্প মী টু রিমেমবার!

ওফ রে! আর্জেন্ট নিড এটা! বলো নদী! বলো বলো! কে আমি! আমার নামটা কী! আমি কে! পচা মিয়া বলেছে না, এই নদীই শুধু পারে আমাকে সব মনে করিয়ে দিতে? দেন আই স্টার্টেড বেগিং হার! প্লিজ! ডু মী দিস ফেভার!

কিন্তু গোড়ার দিকে, এই নদী আমাকে যেনো শুনতে পায়নি কিছুমাত্র! শুনতে যেনো পেলোই না তখন! থাকলো সে তার নিজের ঢেউ তোলাতুলি নিয়ে! থাকলো নিজেকে নিয়ে! এমন ইগনোর কীভাবে করতে পারে কেউ? কী এটা! তাও আমি তাকে রিকোয়েস্ট করা স্টপ করিনি! নেভার!

গড! আর কাঁহাতক এমনটা হতে দেয়া যায়? কাঁহাতক আর ওই দুই ডিসঅ্যাবেল পারসনের ওপর অমন বারডেন হয়ে থাকা যায়! আমার সেন্স অফ ডিগনিটি কি একেবারেই গেছে? আমার তো এবার, এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত! রাইট নাউ! অথচ কী করছি আমি! আমি নড়ছিই না! আমি রয়েই যাচ্ছি রয়েই যাচ্ছি! শেম! শেম অন মী এগেইন!

প্রথমে অবশ্য আমি পচা মিয়ার কথাকে একটুও পাত্তা দেইনি! এই যে— অই নদীর সামনে এসে বসে থাকার কথাটা! হুর! কীসব রাবিশ! কী যে বলে! নদী আবার কী মনে করিয়ে দেবে! এমন হয় নাকি? তবে নদীটার সামনাসামনি থাকতে যেহেতু আমার ভালোই লাগে, তাহলে থাকি না বসে? অন্য আরো তো কিছু করারও নেই এখানে! তাইতেই না এভাবে বসে থাকা!

প্রথমে অবশ্য আমি পচা মিয়ার কথাকে একটুও পাত্তা দেইনি! এই যে— অই নদীর সামনে এসে বসে থাকার কথাটা! হুর! কীসব রাবিশ! কী যে বলে! নদী আবার কী মনে করিয়ে দেবে! এমন হয় নাকি? তবে নদীটার সামনাসামনি থাকতে যেহেতু আমার ভালোই লাগে, তাহলে থাকি না বসে? অন্য আরো তো কিছু করারও নেই এখানে! তাইতেই না এভাবে বসে থাকা!

কিন্তু তারপরে স্লোলি, গ্রাজুয়েলি কী যে হতে থাকে! এই নদীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কী যে হতে থাকে আমার! আনবিলিভেবল! এন্ড আই কান্ট এক্সপ্লেইন! বাট ইট হ্যাপেনড! আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হতে থাকে! পচা মিয়ার কথাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হতে থাকে! মনে হতে থাকে, নদীটা যেনো কথা বলছে! সে যেনো সত্যিই অনেক অনেক কিছু বলে যেতে চাচ্ছে! লটস অফ থিংস আর দেয়ার! শি লাভস টু শেয়ার উইথ মী!

এবং আমিও যেনো একটু একটু করে করে— নদীর কথাকে বুঝেও উঠছি! ভেরি স্ট্রেন্জ!

একদিন প্রথমে একবার একটা বড়ো ঢেউ এলো! অনেক বড়ো! ঝুপাস করে এসে আমাকে ঝটকা ভিজিয়ে দিলো! আরে কাণ্ড!

তখুনি প্রথম নদীটাকে কথা বলতে শুনলাম!

‘এই যে গাছ—এইটা কালা জাবুন গাছ! জষ্টি মাসে হের ডাইলে ডাইলে— হায়রে কালা কালা জাবুন! পাইক্কা কালা কুছকুছা! হেটিরে তহন দেখলে আর জাবুন মোনে অয় না! উল্টা মোনে আহে য্যান—অইটি জাবুন না! কিছকিছা কালা মেঘেরা আইয়া, জাবুন গাছের ঠালায় ঠালায় আটকি পইড়া রইছে! জষ্টি মাইস্যা দিনের জাবুন গাছের বাহার যেয় না দেখছে, হের জনম মিছা!’

তাই নাকি? রিয়েলি? কিন্তু সবার আগে আমাকে বুঝে নিতে হবে যে, কালা জাবুন কাকে বলে? তারপর ভাববো নে, তার বাহারের বিষয়টা! আমি তখন অগত্যা গাছটার দিকে তাকাই! বোঝো অবস্থা! আমি বসে আছি একটা গাছের নিচে! আর ওদিকে কিন্তু, এই বাইরা—আঙিনার সমস্তটা কিনার ঘেঁষে ঘেঁষে আছে গুচ্ছের গাছ! তারা সবাই খুব ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছ! ও হো! কালা জাবুন! তার মানে, সেটা কালো জাম! কালো জাম! মুহূর্তে আমি কেমন করে যেনো কালা জাবুনেরে চিনে উঠি! বাট আমি কীভাবে জষ্টি মাসের কালা জাবুনের বাহারকে দেখবো?

‘জষ্টি মাস যে কবে আসবে, আমি তো এখন সেটার হদিস বের করতে পারবো না! আমার তো কিছু মনে আসে না আর এখন! স্যরি নদী! নট নাউ! এ-যাত্রা সেটা দেখা হবে না! নো ওয়ে টু স্টে হেয়ার টিল দ্যাট জষ্টি মাস! আই অ্যাম লিভিং সুন!’

‘কতা ভুল কতা ভুল কতা ভুল!’ নদী কলকলাতে থাকে! কী যে কলকলায় সে! কোনো ভুল না! আমি শিগগিরই ফিরে যাবো! আমার নামটা মনে আসলেই, এখানে থাকার ব্যাপারটা আমার শেষ হবে! আর আমার অ্যাড্রেসটাও তো তখন মনে এসে যাবে, তাই না!

নদী সেকথা যেনো খুব অ্যাটেনটিভলিই শোনে, বাট শি ডাজনট রেসপন্স! তারপরে বাকিটা দিন সে আমাকে আর কিছুই বলে না! আমি তার দিকে চেয়ে চেয়ে থাকি! চেয়ে চেয়ে থাকি, আর মনে মনে নিশ্চিন্ত হতে চাইতে থাকি! সে কী আমাকে কিছু বলেছে? নাকি সেটা আমার মনের ভুল? ভুল? সবটা নিয়ে কী বিতিকিচ্ছিরি যে লাগতে থাকে! আমি পুরো কনফিউজড হয়ে যাই! হোয়াই অ্যাম আই ফিলিং দিস?

আবার তারপরে দিনদের চলে যেতে দেখতে থাকি আমি! কিচ্ছু কোথাও ঘটে না! পচা মিয়া সেই তার খড়া জালে যেতে থাকে রোজ! বুচি বিবি পুরোটা দুপুর ভরে কাঁথা সেলাই করেই যেতে থাকে! কাঁথা তাকে সেলাই করতে হচ্ছে কেনো? নাইলে নাকি শীতে আমার কষ্ট হবে! শীতের রাতে নাকি একটা কাঁথা দিয়ে ঘুমাতে খুব কষ্ট হয়! তাই এটা সেরে রাখছে সে!

কী আজব না, কথাটা? শীত কোথায়! আর আমিই বা কোথায়! অতোদিন এখানে আমার আবার থাকাথাকি কী! তার বহু আগেই আমি চলে যাবো নির্ঘাত! তাই না? আমার নামটা মনে না-পড়লে না-ই! শুধু আমার প্লেসের নামটাও যদি মনে এসে যায়! ব্যাস! ওতেও হবে! আমি রওনা দিয়ে দেবো!

তবে অতোসব কথা তো আর বুচি বিবিকে জানানোর কিছু নেই! আমি বললেই বা কী? সে তো এই এতোদিনেও, আমার কথা, মোটের ওপর বুঝতেই পারে না! আমি বরং আমার মতো করে নদীর সামনে বসে থাকি! দেখি এতে কোনো রেজাল্ট আসে কিনা! ওহ! ইফ ইট ওয়ার্কস! গড!

আমি নদীমুখী হয়ে বসেই থাকি! থাকি থাকি থাকি! কিন্তু তারপর আর কিচ্ছু ঘটে না! নদী কী তবে সেই একদিন, আমার সাথে কথা বলেছিলো? বলেছিলো? বিষয়টা আমার মনের ভুল নয় তো? ওটা আমার শুধু কল্পনা নয় তো! হোয়াট ইফ, এটা কেবলই আমার মনের ভুল হয়ে থাকে!

তারপর আবার এক বিকেলে বিশাল একটা ঢেউ, আচমকা, আমার দিকে ঝাঁপ দেয়! আউট অফ দ্য ব্লু! এটা কী কাণ্ড! আমি যে ভিজে ঝিবঝিবে হয়ে গেলাম! একদম ধুম ভেজা! এর ভেতরেই কে যেনো ফিসফাস করে! খুব হাস্কি গলায় ফিসফাস করে!

‘এক যে আছে চঙ্গ! চঙ্গয়ে যে নিজে নিজে লইড়া-চইড়া মনিষ্যিগো উবকার করে, হেই হেটাম নাই তার! তয়, দুনিয়ায় এমুন কোনো একজোন থাকলে থাকতেও পারে, যেয় নিকি আপনা তেনেই হেই চঙ্গখানরে আনুন্তী-নেউন্তী করবো! আছে এমুন মনিষ্যি? যুদি কেহ থাইক্কা থাকে; তয়, আগুনে-পানিয়ে হের লগে দুস্তী পাতবো! জনমকার লেইগা দুস্তী পাতবো! বিনা ফরমাইশে যেয় চঙ্গ আনুন্তী-নেউন্তীর তাগিদ পায় না; যেয় নিকি লাচার-দুক্ষীর কষ্টের দিগে ফিরা চায় না! হেয় কিয়ের মনিষ্যি! হের জনম বিরথা!’

ওহ! এখন কিনা সেই ল্যাডারটা বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে! এবং আমাকেই এখন ব্লেইম করা হচ্ছে, তাই তো? আহ! আর কোনো টপিক পাওয়া গেলো না, তাই না? চাই না আমি কোনো ধরণের দোস্ত! অই যে কী বলে, জনমকার দোস্ত! অইটা চাই না! লাগবে না আমার কোনো জনমকার দোস্ত পাওয়া! কিচ্ছু চাই না আমি! শুধু রি-কল করতে চাই, কে আমি! কী আমার নাম! হোয়ার হ্যাভ আই কাম ফ্রম! কোত্থেকে এসেছি আমি?

কাম অন মাই মেমোরী, কাম অন! মনে পড়ুক আমার সবকিছু! মনে পড়ুক! আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই!

বাট, এখানে কী হচ্ছে? আমাকে ব্লেইম করা হচ্ছে! আমি নাকি ল্যাডারটা গুছিয়ে রাখার কাজটা করছি না! যেনো আমি উইলিংলি ওটা করছি না! কোনো হেল্প করছি না পচা মিয়াকে!

দিস ইজ আনফেয়ার! আমাকে ব্লেইম করে ফল কী? আমি তো বারবার ভেবেছি, আই শুড হেল্প দেম! আই মাস্ট ব্রিং ইট! কিন্তু ওরা দুজন আবার কী না কী মনে করে, এই চিন্তাটাই তো অলওয়েজ মেইড মি ক্রিঞ্জ! ওরা যদি ভেবে বসে, আমি তাদের ওয়ে অফ লিভিংয়ে গোলমাল বাঁধায়ে দিচ্ছি? ওদের লাইফে ইনটারফেয়ার করছি? তখন? তখন সেটা কেমন হবে? তাইতেই না আমি চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখে গেছি; অই যে পচা মিয়া মইটা আনছে! হেচড়ে-ছেচরে অই যে আনছে! অই যে আবার গোয়াল ঘরের দিকে সেটাকে নিচ্ছে!

কিন্ত পচা মিয়াকে ওটা হেচড়ে আনতে দেখে দেখে, আমার কী আনইজি লাগতো না? লাগে না? লাগে তো! বরাবর লাগছে! অলওয়েজ আই অ্যাম ফিলিং গিল্টি! সেটা তো কেউ খেয়াল করছে না! শুধু ব্লেইম করে যেতে পারে!

তবে, এখন থেকে আর আমি পচা মিয়াকে ওটা আনতেই দেবো না! নেভার এভার! আরো যে-কয়দিন এখানে আছি, প্রত্যেকদিন ওটা আমিই সরিয়ে নেবো! আবার ঠিকঠিক আর্লি মর্নিংয়ে ওটা এনে রাখবো! একদম ওটাই করবো! করবো! আই মাস্ট ডু ইট! প্রমিজ প্রমিজ!

কিন্তু অই ব্লেইমিংটা আমাকে কে করলো? ওটা কী নদীই আমাকে করলো? নাকি? নাকি এটাও আমার মনের আরেকটা ভুল? আমি কনফিউজড! ভেরি ভেরি কনফিউজড! কে আমাকে এমনভাবে কনফিউজড করে যাচ্ছে! কে!

তবে সেদিন কিন্তু খুব ব্রিলিয়্যান্ট একটা ঘটনা ঘটে! কীভাবে যেনো, সেদিন, অন্ধকার ভোররাতের কালে আমার ঘুম ভেঙে যায়! আমি বুঝতে পারি না— কীভাবে সেটা হলো! পচা মিয়া বা বুচি বিবি তখনও জেগে ওঠেনি! সমস্তটা বাড়িতে একা শুধু আমি জেগে ওঠা! ভেতরের-উঠানে একা শুধু আমি দাঁড়ানো!

আমার মাথার ওপরে ফিকে কালো আকাশ! যেনো এই বাড়িটাও তখন কালো! বাতাসও কালো! আবছা কালো উঠান! কেমন কালো-সুন্দর, অই যে ঘরের চালের ওপরকার লতাটতাগুলো! অ্যামেজিং! কেনো যেনো তখন আমার মনে হতে থাকে, আই অ্যাম রিলিভড! কেনো মনে হতে থাকে, আই হ্যাভ রীচড! আই হ্যাভ রীচড এ্যাট লাস্ট! এন্ড আই অ্যাম রিয়েলি রিয়েলি ব্লেসড! কেনো এমন মনে হতে থাকে!

কেনো এমনটা মনে এলো আমার! কেনো? নট ক্লিয়ার টু মি! শুধু বুঝতে পারি, আমার ভালো লাগছে! ইট সিমস অ্যামেজিং! অ্যামেজিং!

তবে আমি কিছুতেই বুঝলাম না, অই মই সরানো-বসানোর বিষয়টা পচা মিয়াকে কেনো অমন ইমোশনাল করে দিলো! আমি পরিষ্কার দেখেছি, তার চোখ পানি ছলোমলো হয়ে গেছে! খুব পানি ছলোমলো! বোঝো কাণ্ড! গোয়াল থেকে মইটা এনে, জায়গায় ফিট করে রাখাটা কী কোনো গুরুতর কাজ হলো? হোয়াট মেকস হিম সো ইমোশনাল?

এটা তো এখন থেকে, আমি রোজ করবো! যতোদিন আছি ততোদিন! এটা নিয়ে এমন ছলকে যাওয়ার কী আছে? কী যে বোঝে আর কী যে বোঝে না, অই দুইজন মানুষ! কিচ্ছু আমার কাছে পরিষ্কার নয়! নাথিং ক্লিয়ার টু মি! উফফ!

তবে, তারপর থেকে আমার ভেতরে অন্য একটা ভাবনা-খুব নড়ছে চড়ছে! আচ্ছা, সেই আগুন-পানির দোস্তীর ব্যাপারটার কী? নদী তো অমন কথাই বললো! তাই না? সেই দোস্তী কেমনে হয়? এমন ফ্রেন্ডশীপ হয় নাকি? হয়েছে কখনও? নাকি ওটা আমি কী-শুনতে কী-শুনেছি! প্রবাবলি এটাই হয়েছে! আমি কিনা কী-শুনতে কী-শুনে নিয়েছি!

তারপরেও তো দিন যেতে-আসতে থাকে! কিন্তু নদী যেনো কথা বলতে ভুলে যায়! আর, তারদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে— আমারও আজকাল যেনো বড্ড টায়ার্ড লাগতে থাকে! বড্ড যেনো ঘুম পেতে থাকে! মনে হতে থাকে— মনে হতে থাকে, আই শুড স্লিপ লাইক অ্যা লগ!

তারপর বসে বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই, আমি যেনো কোনো একজনকে কেমন ছুটতে দেখতে পেতে থাকি! কোন এক দূরের কোন একটা এলাকার, একটা কাকে যেনো আমি; খুব ছুটতে দেখতে থাকি! খুব যেনো তাড়া আছে তার! খুব যেনো হুড়াহুড়ি! তাই ছুটছে সে সর্বক্ষণ!

তারপর বসে বসে নদীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই, আমি যেনো কোনো একজনকে কেমন ছুটতে দেখতে পেতে থাকি! কোন এক দূরের কোন একটা এলাকার, একটা কাকে যেনো আমি; খুব ছুটতে দেখতে থাকি! খুব যেনো তাড়া আছে তার! খুব যেনো হুড়াহুড়ি! তাই ছুটছে সে সর্বক্ষণ!

দেখো তো অবস্থা! তাকে দেখতে ঠিক আমার মতো লাগছে! হোলি মী! শি লুকস এক্জাক্টলি লাইক মি! বাট শি ইজ ইন এ গ্রেট হারি! শি হ্যাজ নো ওয়ে টু টেক এ লুক অ্যাট এনিথিং! নো ওয়ে টু ওয়েস্ট হার টাইম!

এতো তার তাড়া? এতো তার ছুট? কেনো?

আমার চোখেরা একদম স্পষ্ট রকমে, তাকে দেখতে পেতে থাকে! এক ঝটকা এক ঝটকা করে করে দেখতে পেতে থাকে! আর, শিউরে শিউরে উঠতে থাকে! গড! হোয়াট ইজ গোয়িং অন উইথ দ্যাট গার্ল! এমন ছুটছে কেনো সে?

এন্ড হোয়্যার ইজ শি? প্লেসটার নাম কী! কোথায়! কোথায় সেটা?

তার মনের ভেতরে অমন ভীষণ ক্ষুধা কেনো! অনেক কঠিন ক্ষুধা! খুব দাউদাউ!

এমন কেনো! এটা কেমন?

সব সিঁড়ি তাকে পার হয়ে যেতে হবে! সবার আগে তাকেই, পেরুতে হবে সব সিঁড়ি! সেই পেরুবার কালে, তার ছুটের ধাক্কায় যে-খুশি ছিটকে যাক! যাক! হু কেয়ারস! শুধু সে পেরুলেই হবে! শুধু সে পৌঁছে গেলেই হলো! ওটাই একমাত্র জরুরী! আর জরুরী হলো— এনি হাউ পৌঁছে যাওয়াটা! আর কেউ— কিছুমাত্র ইম্পরট্যান্ট নয়! আর কিচ্ছু না! শুধু সে!

সব ডেসটিনেশন তাকে ছুঁয়ে ফেলতে হবে! মুদ্রার বিপুল ওম, নিজের লাইফে, এভার লাস্টিং করে নিতে হবে! নিচ্ছে সে! অই তো নিচ্ছে! না না! কারো দিকে নজর দেবার অবকাশ তার নেই! তার শুধু নিজের ফুলফিলমেন্টটাকে চাই! বাট, হোয়াই ডাজ শি ডিজায়ার সো মাচ! এতো উৎকট ভুখা কেনো সে? হাউ ডিসগাসটিং!

আমার ভালো লাগছে না ওটা দেখতে! থামো থামো! আই অ্যাম ফিলিং ইরিটেটেড! থামো! জাস্ট স্টপ ইট রাইট নাউ! হেই!

কিন্তু কিছুই থামে না! বরঞ্চ আরো কীসব কীসব যেনো আমার সামনে এসে হাজির হতে থাকে! আমার চোখদের— কে এসব দেখাচ্ছে? এই নদীই কি ওটা করছে? এইভাবেই কি সে মনে করিয়ে দেবার প্রক্রিয়াটা চালায়? এভাবেই?

বাট ওই দেখো, আবার কী আসে! সেই মেয়েটাই আসে! থেকে থেকে আসে! থেমে থেমে আসতে থাকে!

সেদিন, সেই একদিন, মেয়েটা যেনো সদ্য সদ্য কোত্থেকে ফিরলো! এয়ার ক্রাফটেই ফিরলো! তারপর তার গাড়ি তাকে নিয়ে এলো কেমন একটা স্কাই হাই বিল্ডিংয়ে! তবে তার বাড়ি ফিরে আসা নিয়ে সুখ পায়, এমন কেউ তো তার জন্য নেই! কোথাও নেই!

ওহ! অফকোর্স শি ইজ ম্যারিড! বাট দেট রিলেশনশিপ ডাজনট ওয়ার্ক! গড নোজ হোয়াই! ইট ইজ সিম্পলি এ ফেইলিওর!

ইন দেয়ার আইজ, দে বোথ ক্যারি হেট্রেড ফর দেয়ার পার্টনারস! শুধু ঘৃণা! আর কিছু নেই! কারো দিকে কারো চেয়ে দেখা নেই! কারো কথা কারো— কিছু মাত্র মনে করাকরি নেই! ইয়েট, ইয়্যু সী, দে লিভ আনডার দ্য সেম রুফ! তারপরেও তারা একই অ্যাপার্টমেন্টে একই ব্যবহারিক সুবিধায় একই অ্যাড্রেসে!

সে যখন এসে ল্যান্ড করলো, তখন তার বড্ড টায়ার্ড লাগছিলো! সে সেটাকে জেটল্যাগ বলে ধরে নিয়েছিলো! বাড়ি ফিরে সে তখন লম্বা একটা শাওয়ার নিলো! ভেজা চুল খুলে দিয়ে খুব তপ্ত ব্ল্যাক কফি দিয়ে নিজেকে নিজের ফিটনেস ফিরিয়ে দেবার একটা অ্যাটেম্পটও নিলো! কিন্তু তাতে যেনো অহিতই ঘনায়ে আনলো সে, নিজের জন্য! তার জ্বর এলো! অনেক জ্বর!

অনেক জ্বর!

ওই জ্বরটা তখন, তার একারই কিন্তু আসেনি! তার পুরো দেশটাকেই তখন যেনো ওই জ্বরটা, খুব ধীরে ধীরে, ঢেকে নেওয়া শুরু করেছিলো!

তার এয়ার ক্রাফট দেশের মাটি ছুঁয়ে নেয়ার ঠিক একঘণ্টা পর থেকে, দ্য হোল কান্ট্রি স্টার্টেড সাফারিং ফ্রম অ্যা টাইপ অফ ফিভার! জ্বর জ্বর! শুধু জ্বর!

লোকের শরীরে জ্বরটা জাগনা দিচ্ছিলো অতি ধীরে! একটু একটু করে! তারপর শরীরের তাপ যতো বেড়ে উঠছিলো, রোগীর পুরোটা শরীরের রং ততো অদ্ভুত একরকম হয়ে উঠছিলো! ম্যাড়ম্যাড়ে হলদে-রঙা থেকে ক্রমে সেটা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো লেমন ইয়েলো! ডীপ, ডীপ লেমন ইয়েলো!

দেন, হোয়াট?

ওহ! তারপর জ্বরে জ্বরে নেতিয়ে যেতে থাকা! দেন, ব্রীদিং প্রবলেম অ্যাপিয়ার্ড! শ্বাস কষ্ট! খুব খুব শ্বাসকষ্ট! ফুসফুস যেনো ছিঁড়ে-ফেঁড়ে যাচ্ছে! ছিঁড়ে-ভেঙে গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে! সেটার সাথে সাথে-শরীরটা যেনো কেমন খিঁচোনো শুরু করছে! খুব খিচোচ্ছে! খিঁচতে খিঁচতে দাপাতে দাপাতে কুঁকড়ে গিয়ে, এই যেনো একটা ব্যান্ডেলের মতো হয়ে উঠছে শরীরটা! আবার এই যেনো সেটা ছিটকে ছিটকে ফালা ফালা হয়ে যেতে চাচ্ছে!

ওহ গড! লুক লুক! দ্যটস অ্যান এ্যাপিডেমিক! ওহ! অল হেল হ্যাজ ব্রোকেন লুজ! জ্বরে পুড়তে পুড়তে, শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে সমস্তটা দেশের লোকে মরছে! নিজ অ্যাপার্টমেন্টের লিফটের মুখে পড়ে মরছে! সিঁড়িতে থুবড়ে পড়ে মরছে! অ্যাম্বুলেন্সে যেতে যেতে মরছে! হাসপাতালের বেডে শুয়ে মরছে! রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে মরছে!

ওহ গড! লুক লুক! দ্যটস অ্যান এ্যাপিডেমিক! ওহ! অল হেল হ্যাজ ব্রোকেন লুজ! জ্বরে পুড়তে পুড়তে, শ্বাসকষ্টে ধুঁকতে ধুঁকতে সমস্তটা দেশের লোকে মরছে! নিজ অ্যাপার্টমেন্টের লিফটের মুখে পড়ে মরছে! সিঁড়িতে থুবড়ে পড়ে মরছে! অ্যাম্বুলেন্সে যেতে যেতে মরছে! হাসপাতালের বেডে শুয়ে মরছে! রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে মরছে! এবং রুমের ভেতরে নিজের বেডে শুয়ে শুয়ে তো মরছেই!

সেইখানে কে কাকে দেখে! কে কার দিকে ফিরে চায়! কে কার পাশে দাঁড়ায়! কেউ না কেউ না কেউ না!

এই তো আমি দেখতে পাচ্ছি! ওই যে ওখানে কী চলছে! ফ্যামিলিতে ফ্যামিলিতে কী চলছে ওখানে! লুক! লুক! নো ওয়ান ইজ ইভেন টেকিং এ লুক এট দেয়ার এইলিং মেম্বার! লুক আফটার করা তো দূর!

তাদের ঘেন্না হচ্ছে! খুব ভয় পাচ্ছে তারা! জ্বরটাকে ভয় পাচ্ছে! রোগীটাকে ভয় পাচ্ছে! জ্বরে জ্বরে লেমন ইয়েলো হয়ে যেতে থাকা শরীরের রোগীটাকে ফেলে রেখে, বাসার অন্যরা দুদ্দাড় বেরিয়ে যাচ্ছে! কোথায় যেনো চলে যাচ্ছে!

পালাচ্ছে তারা? পালাচ্ছে? গড! তেমনটাই তো মনে হচ্ছে!

ওখানে সকলেই ত্রস্ত! খুব-খুব স্কেয়ারড!

কেনো? নিজের সেফটির চিন্তায় এতো ক্রেইজি হয়ে উঠতে হয়? এমন?

এমন সেলফিস হওয়া যেতে পারে? মানুষ এমন সেলফ-সেন্টারড, এমন ইনহিউম্যান হতে পারে নাকি? ওখানে তবে এমনটা কীভাবে করছে সকলে?

গড! গড! অইখানে যেনো এখন, কারো জন্য কারো কোনো মমতার টানটা আর নেই! শুধু ভয় পাওয়া আছে! শুধু ঘৃণা করা আছে! হোয়াট ইজ গোয়িং অন ওভার দেয়ার? হোয়াট দ্য হেল ডু আই সী? ইজ দ্যাট এ মেইজ অর হোয়াট?

ও গড! গড!

অই যে সেখানে ওরা, ওই মানুষেরা এখন, নিজ প্যারেন্টেকে শেষবিদায়টা দেবার আবেগও একেবারে গিভ আপ করে দিয়েছে! সিবলিংরা এফেক্টেড হচ্ছে, তো হোক! স্পাউস? হোক গে! হোক গে! ওই ডিজিজড-রা, নিজেদের বাঁচা-মরার রেসপনসেবিলিটি, নিজের বুঝুক! নো নিড টু লুক ব্যাক টু দেম! অসুখটা ছোঁয়াচে তো! তাহলে? তাহলে রোগীকে ছুঁতে গিয়ে নিজেকে বিপন্ন করা হয়ে যাবে না? সেটা হয় নাকি! নো! নো!

ইভেন কাছে গিয়ে, এক ঝলকও বা মৃতের মুখটা কীভাবে দেখবে তারা? সেটাতেও তো একটা ডেন্জারাস এটেম্পটই নেয়া হয়ে যাবে! ওহ! কনটেইজাস ডিজীজ না এটা? সরো সরো! সরাও নিজেকে! পালাও!

সেই এলাকায় তাহলে এখন শবদেহ সৎকারের দায় কার? সকল দায় সৎকার সংস্থার!

সৎকার সংস্থার লোকেরা শুরুতে একেকটি শবদেহ একেকটি গর্তে সৎকার করার, অল্প একটু শুধু অবকাশ পায়! অই তো তারা! একটি একটি শবদেহ, ইনডিভিজুয়ালি ক্রিমেশন করার সামান্য একটু পরিস্থিতি পাচ্ছে! কিন্তু সেটা একদম অল্প একটু সময়ের জন্য!

তারপর? তারপর শত শত শবদেহ! ওইখানে তারপর যেনো মৃত্যু আর ঘটে যাওয়ার কোনো ব্যাপার হয়ে নেই! যেনো কোন ওপর থেকে মৃত্যু ঝরে পড়তে শুরু করেছে ওইখানে! ঝরছে মৃত্যু! ঝরছে!

একদিন কবে যেনো, প্রায় প্রায়ই, উইন্টারের সীজনে সীজনে যেনো, আমি পাতা ঝরতে দেখেছিলাম! যেনো সেটা ছিলো উইন্টারের শেষ! তখন যেনো গাছ থেকে থেকে হলুদ পাতারা ঝরে পড়তো! সেই কোন এক এরিয়ায়, ঝরে ঝরে পড়তো! বাতাসে বাতাসে! শব্দহীন!

আরে, দেখো তো কী মজা! আমার মনে পড়ছে! পাতা-ঝরানো সেই গাছের নাম তো আমি রিকল করতে পারছি এখন! মনে আসছে তার নাম! সে গাছের নাম কড়ুই গাছ! রাইট! কড়ুই গাছ!

তার পাতারা যেমন করে করে ঝরে পড়তো! দিনরাত ধরে ধরে ঝরে পড়তো! ওই সেই কান্ট্রিটাতেও যেনো, অবিকল তেমন করে করে মানুষেরা ঝরে ঝরে যাচ্ছে! থাউজ্যান্ডস অফ পিপল ! রোজ রোজ রোজ, হলুদ কড়ুই পাতার মতো ঝরে যাচ্ছে! ঝরছে, ঝরছে সেখানে!

সৎকার কর্মীরা তাহলে এখন কী করবে? কুলাতে না-পেরে পেরে তারা অই তো, শবদেহগুলো গণকবরে সেঁটে রাখতে শুরু করেছে! মস্ত গর্তে সবকয়টাকে ফেলে, এখন কেবল মাটি চাপা দিয়ে দেয়া! মস্ত অগ্নিকুণ্ডে, একসাথে যতো সম্ভব ডেড বডি, দাহ করে চলা!

সাতদিনে, কেবলই সাতদিনের ভেতরে, পুরোটা কান্ট্রি সম্পূর্ণ লাশমোড়ানো হয়ে গেলো! অই তো! কোনো মেডিকেশন নেই, কোনো নিস্তার নেই! রেহাই পাবার কোনো পথ জানা নেই! শুধু মরে যেতে থাকা!

কোথাও কোনো কান্না নেই!

কে কাঁদবে? যারা আপাত সুস্থ আছে, তারা আর কান্নাকে মনে আনতে পারে নাকি? তারা শুধু আতঙ্কে আতঙ্কে! তারা শুধু পালাচ্ছে পালাচ্ছে! শুধু ছুটছে! শুধু লাশ শুধু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন অইখানে! অই তো! অই যে শোনা যাচ্ছে!

ওই যে মেয়েটা! তার পার্টনার মেয়েটার জ্বরের বিষয়টা জানতে পারে, হঠাৎ করেই! তখন নিজের রুমের গোলাপী বেডশীটের ওপরে মেয়েটির শরীর পুরো নিঃসাড়! সে শরীর থেকে একটা কেমন কালার যেনো ঝলক দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে! ডীপ লেমন ইয়েলো কালার! ওহ!

গৃহকর্মী আর তখন সাফাই করবে কী, নিজেকে নিয়ে সে তখন ছোটা শুরু করে! তবে ছুটতে ছুটতেও সে ঘৃণা ও ভয়ভরা গলায়, মালিকটিকে ওই তথ্যটা দিয়ে যেতে ভুল করে না!

ততোদিনে তার জ্বরের কতোদিন পেরিয়ে গেছে, নো বডি নোজ! তাও শরীরে তার তখনও তীব্র থকথকা জ্বর! না! তার তখন ব্রীদিং প্রবলেমটা নেই! হয়তো অনেক আগেই ওটাও হয়ে, তারপর তাকে মৃত্যু দিয়ে দিয়েছে! কঠিন হলদে মৃত্যু! তার শরীর জ্বরেভরা, তাতে কী! এই ডিজিজের সময়ে, হয়তো মৃত শরীরটা, এমন জ্বর গণগণাই থাকে!

নির্ঘাত মারাই গেছে সে এর মধ্যে! তাইতেই সে ওরকম অসাড় পড়ে আছে! লুক লুক! একদম মনে হচ্ছে, দেয়ার ইজ নো সাইন অফ লাইফ ইন হার বডি!

বিষয়টা জেনে ওঠা মাত্র, তার পার্টনার ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে! ঘৃণায় ছটকাতে থাকে! ফিলদি বিচ! হোয়াট দ্য হেল ডিড শি ডু! দ্যাট হোর! হোয়াই ডিডনট শি লীভ হোম! হোয়াই ডিডনট শি গেট অ্যাডমিটেড টু এ হসপিটাল! দিস মাস্ট বি এ কনসপিরেসি টু থ্রো মি ইন টু ডেঞ্জার! এই তো মতলব ছিলো, অই হোরের? শিট!

বাট নো! নো! ওটা হবে না! ওটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না! নিজেকে সেফ এন্ড সাউন্ড রাখার রুলস, তার কী অজানা নাকি! লোকটা কয়েক মিনিটের মধ্যে লিফটে পা রাখে! তারপর জোর ঝটকা দিয়ে সে তার গাড়িকে ছোটাতে থাকে দূরের দিকে! একটা রক্ষা যে, অই নষ্ট ইতর হোরটার রুমটা আগাগোড়া বন্ধ ছিলো! এবং তার নিজের রুম তো লাগাতার বন্ধ ছিলোই! কাজেই এফেক্টেড হবার চান্সটা এখনও হয়তো অল্পই আছে!

সৎকার কর্মীরা কাকতালীয়ভাবেই সেই মেয়েটার কথা জানতে পারে! একটি অ্যাম্বুলেন্সকে হঠাৎ করে নিজের পাড়ার মুখে থামতে দেখে, গৃহকর্মীটির, সেই সংক্রমিতার কথা মনে আসে! আহা গো! হেয় বুঝি এতদিনে মইরা, পইচ্চা গেছে! কী না-জানি অইয়া রইছে লাশটার!

অই দেখো! অই তো! তার কোঁকড়ানো দেহ বিছানায় পড়ে আছে! সে কী এখনও জীবিত? নাকি তার আর দম নেই? মরে গেছে? মৃত নাকি?

সৎকারকর্মীরা সেটা যাচাই করার কোনো গরজ পায় না! এই রোগী এখনও কোনোরকমে বেঁচে থাকেও যদি, তাতে কী! তাকে বাঁচায়ে তোলার চেষ্টাটা করার, কোনো আর উপায় আছে কী? কোনো হাসপাতালেই কী আর কোনো বেড ফাঁকা আছে? কোথাও নেই! কোনোখানেই না! একে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে তবে কে দৌঁড়ুবে?

সৎকারকর্মীরা সেটা যাচাই করার কোনো গরজ পায় না! এই রোগী এখনও কোনোরকমে বেঁচে থাকেও যদি, তাতে কী! তাকে বাঁচায়ে তোলার চেষ্টাটা করার, কোনো আর উপায় আছে কী? কোনো হাসপাতালেই কী আর কোনো বেড ফাঁকা আছে? কোথাও নেই! কোনোখানেই না! একে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে তবে কে দৌঁড়ুবে? কেউই না! কেউই তো কোথাও নেই!

আর, কে বলছে যে, এই রোগী বেঁচে আছে? একে দেখে তো মরার বাড়া এক মরা বলেই বোঝা যাচ্ছে! সৎকারকর্মীরা তাহলে এখন একে দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কী করবে? যতো দ্রুত সম্ভব এই ডেডবডির কাজটা শেষ করতে হবে তাদের! লাইনে এখন আরো সাতটা বডি পড়ে আছে! তারপরে আরো কয়টাকে ম্যানেজ করতে যাবার জন্য যে ডাক পড়বে, কেউ জানে না!

তখন, অন্য অনেকের মতো তারও হয়তো বিশাল কোনো একটা গর্তে ঠাঁই পাওয়া হয়ে যেতো! আরো অন্তত একশো জনের সাথে মাটি চাপা পড়ার ভাগ্যই হয়তো পেতো সে! কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সটা তাকে নিয়ে রওনা দেবার ঠিক আগে কী আজব এক অনর্থ যে ঘটে! বৃষ্টি শুরু হয়! প্রথমে গুঁড়ি গুঁড়ি! ওই বৃষ্টিকে কী কোনো অ্যাম্বুলেন্স পরোয়া করে নাকি!

অ্যাম্বুলেন্স যাত্রা শুরু করে! গণ কবরের জায়গাটা মূল শহর থেকে অনেক দূরে! সেখানে যেতে পথে, দুটো উপশহর পেরোতে হয়; আর পার হতে হয় একটা মরা মতো নদী! তবে এখন তো পথ একেবারে জনশূন্য! তাই মূল সিটিটা থেকে, ওই গণকবরে পৌঁছুতে, এখন মোটেও সময় লাগে না!

কিন্তু সৎকার কর্মীরা এবার অই লাশটাকে নিয়ে, নির্বিঘ্নে সেখানে পৌঁছুনোর ভাগ্য পায় না! গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি অচিরেই মহা বৃষ্টি হয়ে ওঠে! সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে সব-সবকিছু, বৃষ্টির নিচে ঢাকা পড়ে আসে! তবে রাস্তা তো আর জটিল কিছু না! চালক কনফিডেন্টলিই চালিয়ে যেতে থাকে! মসৃন পথ, উল্টো দিক থেকে একটা কোনো গাড়িও আসার কোনো ঘটনা ছিলো না তখন! তাও কীভাবে যেনো ব্রিজটা আর পেরুনো হয় না তাদের! অ্যাম্বুলেন্সটা মরা নদীটাতেই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে!

সৎকার কর্মীরা পলকেই নিজেদের রক্ষা করে ফেলে! শুধু চতুর্চক্রযানটা, শবদেহটি নিয়ে, কোনদিকে যেনো ভেসে যায়! ঝুম বৃষ্টিতে দশদিকই অন্ধকার হয়ে থাকে বলে, কেউই সেটা আর দেখে উঠতে পারে না!


• ‘নিত্য যে নদী বহে’ ১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
• ‘নিত্য যে নদী বহে’ ২য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।