বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮

নির্বাচিত দশ কবিতা : আহমেদ স্বপন মাহমুদ

0

রেখা


রেখা বিস্তীর্ণ হলে বর্ণ ক্রমাগত নীল হয়।
সুদূরের যে পথে তুমি
রেখাক্রম সেই পথে ধায়।

একটি ঘোড়া দৌড়েছিল কাল সুতোর ওপরে
রোমগুলো তার কাঁপছিল— নীলরঙে মাখা
আমি ঘোড়া ভালোবাসি

এবং বর্ণসমেত ক্রম করেছি যাত্রা রেখাপথে।


সুন্দরবনের গল্প


সুন্দরবনের গল্পে একপ্রকার সম্মোহন আছে।
সারা রাত হরিণীর পেছনে চিতাবাঘ
চিতার পেছনে আকাঙ্ক্ষা
আকাঙ্ক্ষার পেছনে আগুন
আগুনের পেছনে সম্মোহন
ইত্যাকার গল্পে একপ্রকার ধ্যান নিহিত।

আমি যেই সম্মোহনে তার দিকে তাকালাম
যথামাত্র অজস্র জৈব-মেঘ উড়ে এলো
আর তার চোখের লুকানো আগুন
অন্ধ হলো নিমেষে­— আগুনের ভরা অন্ধকার।

এইরূপ গল্পে আমি ও জীবনানন্দ প্রায়শ সুন্দরবনে যাই
আর সুন্দরবন ক্রমশ মুগ্ধ হয় আমাদের প্রতিভায়!


কাঁঠালপাতায়


কাঠালের রঙের মতো এত উদাসীন আর কিছু নাই।

না গ্রীষ্ম, না হেমন্ত, না শীত
ফলে তোমাকে চেয়ে চেয়ে ভাবি,
পাতার আড়ালে, বিশিষ্ট;

তোমার পরনে যে শাড়ি তার নাম
মমতা হলেও, চোখে ছুরির তীক্ষ্ণতা
আর বারবার ঝলসানো চমক;

চমকে উদাসীন হয় রং আর পোড়া মাংসের কাবাব,
শাড়ির আঁচড় ও মাতৃসদন,
জ্বলন্ত চুলার উত্তাপ;

আর তুমি জড়িয়ে আছ যে ক্ষুধা—
অসামান্য আগুন আর বুকের রোদন
চাপা দিয়ে প্রতিদিন ট্রেন চলে যায়—

আমরা চলো কাঁঠালপাতায় লুকিয়ে থাকি!


নায়ক


আমিও এসেছি বীজ থেকে, যেখানে কেবল উচ্ছ্বাস ও সরল রোদের ভাব, যেভাবে এসেছি পাতাদের রেখায় রেখায়— স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষায় বীজের অন্তরে— সেখানে লুকিয়ে ছিলাম অজস্র বছর আর তোমাদের সূর্যের দেশে এসে কেবল অন্ধ থেকেছি, যে আঁধার রক্তের থেকে আরও উজ্জ্বল, ঝলমলে। আমি তোমাকে দেখি নাই, ফলে শেওড়াগাছের ডালে ডালে যে ভূত বসে থাকে অদৃশ্য, আমি তাদের সরিয়ে জমিনের গায়ে পুঁতেছি অন্তর, ফলে বীজ হয়ে সেসব অন্তর বারবার জেগে ওঠে ফসলে, বিলে আর হাওড়ের তলদেশে।

আমি এসেছি বীজ ভেঙে ফলে তোমাদের বুকে রেখে যাই আলোর রেখা, ফলে হাতের রেখা অস্পষ্ট হওয়ার আগেই তোমরা নিদ্রা যাও, আর শেকড়সুদ্ধ শেওড়াগাছ নড়ে ওঠে, আর ভূতের মুখ থেকে যে লালা ঝরে তা দিয়ে বর্ষার বিলে হেসে ওঠো, ফসলে ফসলে, হে নায়ক।


আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল


আমি মৃত্যু চেয়েছিলাম, তাই আকাশে লিখেছি নাম মেঘের, যারা সমুদ্রের জলে সন্তরণ করে আর উচ্ছল জোয়ারে রক্তের সাথে বিনিময় করে বিষাদ— তুমি না রক্ত, না বিষাদ— ফলে মৃত্যু হয়ে ধেয়ে আস, যার নাম সর্বনাশ!— আর ছড়িয়ে দাও বিস্তীর্ণ মাঠের নামে আনন্দফোয়ারা, হাসতে থাক,

কেননা মৃত্যু তামাশা মাত্র— যেমন প্রেম তামাশা হয়ে বেঁচে থাকে তাপ বিকিরণে— আগুন একপ্রকার ধ্বনি, সর্বনাশ তার বাক্য হয়ে গেঁথে থাকে মনে— পরাশ্রয়ী; পারনি স্বাধীন হতে, অথচ কবির হৃদয় স্বাধীন ভূখণ্ড— যাকে তুমি মৃত্যুর খসড়া দিয়ে চলে যাও দূরত্বে— দূরত্ব কোনো কল্পনা নয়, অধিক বাস্তবতা হয়ে আসে, আর খুলে যেতে থাকে উন্মত্ত সকল পাঁজর— অবশিষ্ট পাটাতনসহ জাহাজ ডুবে যায়; তুমি না ডুব না সাঁতার কোনোটাই চাওনি, বরং চেয়েছিলে মেঘের মৃত্যুর দিনে আনন্দ-উল্লাস— অথচ সেই মেঘ আলোর উৎস হতে চেয়ে আকাশে উড্ডীন, আর যত বিদ্যুচ্চমক সে মেঘেদের গর্জন, বৃষ্টি হয়ে বারবার মৃত্যুর পরাজয় নিয়ে বেঁচে থাকে— আর মেঘ মরে গেলে তুমি যখন আনন্দবাড়ির ছাদ ঘেঁষে দাঁড়াও, পাতার আড়ালে পুকুরের জল তোমাকে সম্মোহিত করে—

সম্মোহন একপ্রকার প্রেম, অথবা মৃত্যুর নাম— কেননা মৃত্যু রচিত না হলে প্রেমের যত আয়োজন নিঃস্ব হতে থাকে, নিঃস্ব হতে হতে চঞ্চল অথচ অর্থহীনতার সকল সারমর্ম তোমাকে জীবিত রাখে— এভাবে প্রেম বিষাদ হয়, বিষাদ কঙ্কাল হয়ে ঝুলে থাকে, আর টিকটিকি, যে ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে আছে, পুনরায় দেখে নেয়

মানুষ চিরকাল পরাশ্রয়ী— তুমি খণ্ডিত আশ্রয়ে থাক— আর সবকিছু পড়ে থাকে মৃত্যুর মতো, অনাস্থায়।


আগুন ও সমুদ্রের দিকে


আগুনকে পিতা বলে জানি, মা আমার সমুদ্র সহায়, অপরাহ্নে জেনেছেন আগুনের ধর্ম বিনাশ নয়— জেগে ওঠার স্বচ্ছ প্রণোদনা— সূর্যালোর মতো পৃথিবীব্যাপী জলের ফেনায় আলোবিন্দুর সমারোহে— তুমি পুত্র গান গেয়ে ওঠো— আর চেয়ে থাক পিতার উত্তরাধিকার ও মায়ের কৃপার দিকে— ঊর্ধ্বমুখী বাসনার বিস্ফারিত চঞ্চলতা নিয়ে— আমাদের আগুনের পিতা উড়ে যাচ্ছেন দেখে অন্তর্গত দহনে রূপান্তর হয়ে আলোর উৎসের দিকে যাও— পৃথিবীর সহায় হয়ে সুবিস্তার মায়ের আঁচল সমুদ্রে নিয়ে যায়— আমি আগুন ও সমুদ্রের দিকে যেতে থাকি…


অশেষ যাত্রা


প্রারম্ভ ছিল না। আমি এসেছি আঁধারের বীজ ভেঙে ভূমিদেশে। সেই থেকে আলো ও প্রাারম্ভ, সেই থেকে প্রিয় পাখি-ইতিহাস— অজস্র আলোর ফেনায় নগরীর উত্থান— অশেষ যাত্রা— নিয়ত ধাবমান ঘোড়া

আলোকিত রেখা নিভে গেলে আঁধার নামে, তখন লোক ও নগরীর ভয়াবহ বিলাপ ও ভঙ্গুরতা— পৃথিবীতে আঁধার খেলা করে, মৃত্যুরেখার ক্রমগতায়তে ছরায় বিলুপ্ত নগরীতে জরা ও ভীতি, বর্ণশেষ— স্তব্ধ অনুভূতির কঙ্কাল শূন্যতার পাড়ে পড়ে থাকে— ধূলিমাখা মেঘ

মেঘেরাও রয়েছে শেষ— জেগে ওঠে অনিঃশেষ আলোরেখা, মৃত্যুহীন— ছুঁয়ে যায় অনন্ত আকাশ ও জলবায়ু, আঁধারের রেখা নিভে যায়— আর ধাবমান অশ্বের গতিরেখা অশেষ যাত্রায়।


সোনালি ধান আর তুমি


উঠানে পড়েছে রোদ আর ধান শুকানোর ছলে
তমার মুখে যে হাসি ফুটে আছে
বারান্দায় আড়ালে ঠোঁটের তীক্ষ্ণতা নিয়ে
প্রস্ফূটিত হও, গাঢ়তর সম্পদের বিভায়;

রোদ আড়াল হলেও সোনালি ধানের রঙে
স্পষ্ট হয়ে থাক চক্ষুসীমা-দূরে,
আর দৃশ্যের তৃৃপ্তি নিয়ে অপস্রিয়মাণ
ক্ষীণতর আলোর মতো
দূরে যেতে গিয়ে কেঁদে ওঠো
প্রকাশের ভারে।

রোদের স্পন্দনে তখনো কি ভালোবাসা জমা পড়ে থাকে?


উড়ন্ত ধুলার গান


উড়ন্ত ধুলার সাথে আজ এই সন্ধ্যার প্রতিভা উড়ে গেছে—

অগ্নিময় অজস্র আকাঙ্ক্ষার ডানায়, আলোয় আঁধারে— আঁধার মানে
সৌন্দর্যপ্রভা— আমাদের বিকেল অথবা গোধূলি, সন্ধ্যা, রাত অথবা
ভোর— যখন সময় পুড়ে যেতে থাকে— তোমাকে বাসনা করি
বর্ণঘনধ্যানে;

সেইহেতু উড়ন্ত ধুলার গান,
তোমার প্রতিভা লুকিয়ে রেখেছে কোন সময়ের ধ্যানে।


লোনাবালা


পৌঁছে গেছি লোনাবালা, দীর্ঘ ভ্রমণের পর, প্রীতিময়
এই শীতের বিকেলে দেখো পাহাড় কী আনন্দময়
সবুজ জড়িয়ে আছে গায়ে, আর হালকা কুয়াশা
ধীরে ধীরে ঘন আর স্থির হয়ে আসে;

অদ্ভুত পাখিটার নাম তুমি শুনেছ, তোমার আশ্রয়ে
সে বহু দিন থাকে, আর সময় হলে উড়াল দেয়
ঘুরে ফিরে তারপর ফিরে আসে এই উপত্যকাময়
দেশে, স্তরে স্তরে সাজানো তোমার রূপময় স্তনোল্লাসে।

এই যে পাহাড় থমথম, নিবিড়, অতি দূর নগর কোলাহল থেকে
তুমিও সুস্পষ্ট, প্রাকৃতিক, জানাও গভীর আহ্বান
পাখি আর পাহাড়ের, মানবের প্রেমে
আকাশে মেঘের সাথে কথা হয়, উপত্যকাময়
স্পর্শ করে আছে যে মেঘ তা নেমে এসে
ঝরনায় অভিভূত জল হয়ে ঝরে, আলোময় প্রাণ হয়ে
ঘাসের শরীরে, এ দৃশ্য আনন্দময়, বিশিষ্ট শীত-বিকেলে।

আর তুমি জেগে ওঠো লোনাবালা
উপত্যকাময়, আদিপৃথিবীর গানে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৩৭২ বঙ্গাব্দের ২১ মাঘ, তথা ১৯৬৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি, নেত্রকোণা জেলায়। পড়াশুনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, (১৯৮৫-৮৯ সেশন )। সাংবাদিকতা ও অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে ভয়েস নামে বেসরকারি একটি গবেষণা সংস্থার প্রধান নির্বাহী। ঢাকায় বসবাস করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ : কবিতা : অতিক্রমণের রেখা, ২০০০; সকল বিকেল আমাদের অধিকারে আছে, ২০০৪; অবিচল ডানার উত্থান, ২০০৬; আদিপৃথিবীর গান, ২০০৭; আগুন ও সমুদ্রের দিকে, ২০০৯; আনন্দবাড়ি অথবা রাতের কঙ্কাল, ২০১০; প্রেম, মৃত্যু ও সর্বনাম, ২০১৪; অতিক্রমণের রেখা : নির্বাচিত কবিতা, ২০১১; ভূখণ্ডে কেঁপে ওঠে মৃত ঘোড়ার কেশর, ২০১৩; রাজার পোশাক, ২০১৪; অনেক উঁচুতে পানশালা, ২০১৪; দাহকাব্য, ২০১৫; শ্রীমতি প্রজাপতি রায়, ২০১৭; এখান থেকে আকাশ দেখা যায়, ২০১৮। গদ্যগ্রন্থ : সমূহ সংকেতের ভাষা, ২০০১; কলমতালাশ : কবিতার ভাব ও বৈভব, ২০১৪; কবিতার নতুন জগৎ, ২০১৭। পুরস্কার : বইপত্র সম্মাননা, কলকাতা, ২০০০; বগুড়া লেখক চক্র, ২০১৫; শব্দগুচ্ছ, ঢাকা-নিউইয়র্ক, ২০১৫; লোক, ২০১৬।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।