মঙ্গলবার, মার্চ ১৯

মননশীলতা যেখানে সঘন দীর্ঘশ্বাসকেও সঙ্গে নিয়ে আসে : আকিমুন রহমান

0

এক.
ড. আবেদীন কাদের রচিত ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’ গ্রন্থটিকে নিয়ে; আমি পাঠক, কী ঘোর ও বিস্ময়ের মধ্যে যে আছি!

এ-বইয়ের সংকলিত হয়েছে সতেরোটি নিবন্ধ। নিকট স্বদেশের ও দূরের নানা দিগন্তের; বিবিধ আলো ও ভূগোলের বা সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পকলার ভাষ্য রচনা করেছেন আবেদীন, এই গ্রন্থে। ওই ভাষ্য বিশদ ও অনুপুঙ্খ। এখানে শব্দে শব্দে ও বাক্যবন্ধে বন্ধে লেখকের ‘ঔপন্যাসিকসুলভ গভীর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা’ আর ‘গবেষক-পণ্ডিতের সত্যের প্রতি সুতীব্র নিষ্ঠা’র স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে! তিনি মেধাবী, পরিশ্রমী, আন্তরিক! ব্যাখ্যা ও ভাষ্যরচনাকর্মে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদিত করে দেয়া এক মনস্বী তিনি। তাঁকে সসম্ভ্রম অভিবাদন জানাই!

এ-বইয়ের প্রতিটি লেখাই মূল্যবান! সবকটি লেখাতেই লেখকের ভারী চমৎকার এক প্রবণতা মুদ্রিত হয়ে আছে! লেখক এখানে একটি মূল বিষয়কে লক্ষ্য করে তাঁর ব্যাখ্যাকর্মের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন ঠিকই, তবে শুধু মূল বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করতে যাননি!

এ-বইয়ের প্রতিটি লেখাই মূল্যবান! সবকটি লেখাতেই লেখকের ভারী চমৎকার এক প্রবণতা মুদ্রিত হয়ে আছে! লেখক এখানে একটি মূল বিষয়কে লক্ষ্য করে তাঁর ব্যাখ্যাকর্মের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন ঠিকই, তবে শুধু মূল বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেই তিনি তাঁর দায়িত্ব শেষ করতে যাননি! তিনি তাঁর গৃহীত বিষয়বস্তুর সমকালীন এবং অতীত আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে তাকিয়েছেন! এবং ওই বাস্তবতার স্বরূপ তিনি বিস্তারিতভাবেই উদঘাটিত করেছেন! সেইসাথে তিনি দিয়েছেন গৃহীত বিষয়বস্তুটির বর্তমানকালের রাষ্ট্রসংঘ ও সমাজসত্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিচয়!

বঙ্গভাষী কোনো লেখকের ওপর আলোকপাতকালীন সময়েই হোক; বা পেরুবাসী স্প্যানিশভাষী কোনো কবির কাব্যকর্মের ওপর আলোসম্পাতের ক্ষেত্রেই হোক, বা বিংশ শতাব্দী শক্তিমান কোনো দার্শনিকের বৈশিষ্ট্য নির্দেশের কালেই হোক; আবেদীন কাদের শুধু ওই প্রতিভাগণের মেধা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয়ই দেন না। একই সাথে তিনি রচনা করেন রাজনীতিক ও সামাজিক বাস্তবতার বিপুল ভাষ্য! এর পাশাপাশি তিনি ওই সৃষ্টিশীলগণের সমকালীন স্রষ্টা-সহযোদ্ধাদের শক্তি ও সামর্থ্যরে পরিচয়টিও দেন।

ফলে আবেদীনের নিবন্ধগুলো পাঠের মধ্য দিয়ে পাঠক যেমন একটি বিশাল সাহিত্যবিশ্ব বা দর্শনের ভুবনকে-পরিব্রাজন করতে থাকেন; একই সাথে পেতে থাকেন ওই ভূভাগের রাজনৈতিক ও অর্থনীতিক ও সমাজবাস্তবতার অন্তরঙ্গ পরিচয়! আবেদীন কাদেরের এই প্রবণতাটি মুগ্ধকর এবং বিস্ময় উদ্রেককর তো নিশ্চয়ই!

এ-সবের সঙ্গে সঙ্গে, এই নিবন্ধগুলোতে, মুদ্রিত হয়ে উঠেছে নিবন্ধকারের নিজস্ব জীবনদর্শন, বোধ ও বেদনা! আর এই সবকিছুর সুষম মিশেলের গুণেই এই বইয়ের নিবন্ধেরা কেবল নীরক্ত ও তথ্যভারাক্রান্ত ব্যাখ্যাকর্ম মাত্র হয়ে নেই! বরং হয়ে উঠেছে অনেকাংশে মনকাড়া। হয়ে উঠেছে পাঠকচিত্তে নব আগ্রহ ও নবভাবনা জাগিয়ে তোলার শক্তিসম্পন্ন!

নিবন্ধগুলোর প্রথম সাদাসিধে পাঠকালীন সময়ে, এমন বোধ ও ভাবনাই আমাদের মনে জেগে উঠবে! তবে অচিরেই আর অমন সরল ভাবনার মধ্যে অবস্থান করার সুযোগ হারাবো আমরা! এই বইয়ের নিবন্ধগুলোই শেষ পর্যন্ত আমাদের অমন সহজ ধারণার মধ্যে রয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবে না! বরং আমাদের ঠেলে ফেলে দেবে, এক জটিল অস্থির বেদনার ভুবনে!

এই নিবন্ধেরা ধীরে, অতি সন্তর্পনে; মিহি ও অরোধ্য এক বেদনা, আমাদের ভেতরে, সংক্রমিত করে দিতে থাকে! পরবাসী, উন্মূল জীবনের কাঁধে স্বভাষা ও স্বদেশ খোয়ানোর যেই যাতনা ও মনস্তাপ ও ভার– চিরকালের জন্য চেপে বসে থাকে, সেই যন্ত্রণার দংশন পেতে বাধ্য হতে থাকি আমরা! হাহাকার দীণর্ হতে থাকি। আমাদের আদ্যোপান্ত গ্রাস করে নিতে থাকে বিমর্ষতা! তাহলে বড়ো বেদনার মতো বেজেছ-কে কেবলই এক গুরু-জটিল-ভারী-গম্ভীর নিবন্ধ সংকলন বলি কী করে!

 

দুই.
এ-কথা ঠিক যে, আবেদীনের ব্যাখ্যা ও ভাষ্যরা—সুদূরকেই—আমাদের নিকট করে তোলে। নিকট সাহিত্যের দিকে গভীর মন ঢেলে তাকাবার যেই শক্তি ও আবেগ আমরা নিজেরাই নিভিয়ে দিচ্ছি, সেই আবেগকে জাগিয়ে দিতে থাকে! দূর মেক্সিকোর সাহিত্যের, রাজনৈতিক লড়াইয়ের, জনতার হার ও নবরূপে রুখে দাঁড়ানোর বাস্তবতাকে, আমাদের সকল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলতে তাকে। দার্শনিক আইজিয়া বার্লিন সকল অপরিচয়ের দূরত্ব ঘুচিয়ে হয়ে ওঠেন আমাদের নিকটজন। স্প্যানিশ সাহিত্য ও পেরু দেশের রাজনীতিক-জীবন-বাস্তবতার শব্দগন্ধ আর রৌদ্র নিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হন তীব্রতম কবি সিজার ভ্যায়াহো! এসে যান গ্রিক কবি নিকোস অ্যালেক্সিও। বা ভারতবাসী ইংরেজভাষী কবি ডোম মোরেস; বা আন্দ্রে অ্যাসিম্যান। বা ফরাশি নিঃসঃঙ্গতার মূর্তরূপ— মাদাম দ্যু দিফিকে চিনে উঠতে থাকি আমরা। বা আলবেয়ার ক্যামুর দর্শনের বাঁক বদলের ইতিহাস—সুস্পষ্ট কাঠামো নিয়ে আমাদের অক্ষির সম্মুখে এসে যায়! অ্যাবসার্ড দর্শনের পথ ধরে যেতে যেতে, কখন কীভাবে পজিটিভ হিউম্যানিজমের পথে যান আলবেয়ার ক্যামু, তার বিবরণ পাই আমরা।

আবেদীন আমাদের পরিচিত করাতে থাকেন বিশ্বসাহিত্য ও দর্শনের নানা লেখকের সঙ্গে। ওইসব লেখকের সাথে হয়তো বঙ্গভাষা এলাকার চেনাশোনাটা তেমন একটা হয়ে ওঠেনি। বা, কেউ কেউ এই তল্লাটে হয়তো একেবারেই হয়ে আছেন অপঠিত ও অপরিচিত! তাঁদের প্রবণতা ও বিশেষত্বকে তন্নতন্ন করে তুলে আনেন আবেদীন। এবং এইমতে তিনি আমাদের পঠন-দিগন্তকে ক্রমসম্প্রসারিত করে চলেন।

এ-বইয়ের নিবন্ধে নিবন্ধে আবেদীন, সাহিত্য-দর্শন ও শিল্পকলার নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য করেছেন, সেটা ঠিক! গুরু-গম্ভীর সব বিষয়বস্তুর বিস্তৃত— বিপুল ভাষ্যরচনাতেই আগাগোড়া ব্যাপৃত এখানে তিনি। কাজেই এই বইকে গুরুত্বপূর্ণ এক মননশীল গ্রন্থ বলেই আমরা অভিহিত করতে পারি।

এ-বইয়ের নিবন্ধে নিবন্ধে আবেদীন, সাহিত্য-দর্শন ও শিল্পকলার নানা বিষয়ের ব্যাখ্যা ও ভাষ্য করেছেন, সেটা ঠিক! গুরু-গম্ভীর সব বিষয়বস্তুর বিস্তৃত— বিপুল ভাষ্যরচনাতেই আগাগোড়া ব্যাপৃত এখানে তিনি। কাজেই এই বইকে গুরুত্বপূর্ণ এক মননশীল গ্রন্থ বলেই আমরা অভিহিত করতে পারি। কিন্তু এ-বইটিকে কী শুধু ওই সরল পরিচয়ের মোড়কে আটকে রাখার কোনো উপায় আছে?

নেই! নেই! কিছুমাত্র নেই! এখানে বিস্ময়কর হলো এই যে, ওপরের ওই কথাগুলোর মধ্য দিয়েই এই বই সম্পর্কে সবটা বলে ওঠা সম্ভব হবে না।

boro bedonar moto cover

বড়ো বেদনার মতো বেজেছ | আবেদীন কাদের | প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ্য | প্রকরণ : প্রবন্ধ | প্রকাশক : বেঙ্গল পাবলিকেশন্স |
গায়ের মূল্য : ৩৭৫ টাকা | বইটি সংগ্রহ করতে এখানে ক্লিক করুন

এই বইয়ের নিবন্ধেরা কেবলই ভাষ্যমাত্র হয়ে থাকেনি! এইখানে, নিবন্ধে নিবন্ধে, আরো কিছু আছে! গূঢ় এক মায়ার অথবা বেদনার অথবা বিফলতা-বোধের অথবা দীর্ঘশ্বাসের সুর এইখানে, প্রায় সবকটি নিবন্ধে! ছড়িয়ে-জড়িয়ে আছে। থির ঘন হয়ে বিরাজ করছে!

ফলে এই লেখাগুলো—দুরকম ভাবে—আমাদের আন্দোলিত করে চলে। প্রথমত: মনস্বিতা দিয়ে এরা আমাদের আলোড়িত করতে থাকে! নতুন ভাবনা ও নতুন রকমের চিন্তার অভিঘাত তুলে তুলে, এরা, আমাদের যতোটা জাগ্রত করে তুলতে থাকে; ঠিক ততোটাই এরা আমাদের ভেতরে বেদনার জন্ম দিতে থাকে! আমরা কেমন এক অচেনা বেদনাবোধের মৃদু অথচ শেষহীন ছল্লাৎকার পেতে থাকি! ব্যথিত হতে থাকি! ব্যথিতই হতে থাকি!

বড়ো বেদনার মতো বেজেছ-র নিবন্ধগুলোর বিষয়বস্তু খতিয়ে দেখতে গিয়ে; আমরা দেখতে পাবো, সামান্য কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে, আবেদীন কাদের নির্বাচিত ও ব্যাখ্যাত প্রতিটি লেখক বা ব্যক্তিত্বই নিঃসীম হিম নিঃসঙ্গতা শৃঙ্খলিত! একাকী পথিক তাঁরা। আয়ুষ্কালের পথে পথে বহুজনের সাথে দেখা হয় তাঁদের! কিন্তু এমনই নিয়তি! চিরসঙ্গী হয়ে কেউই থাকে না পাশে! হয়তো নিজের ছায়াটুকু শুধু থাকে! আর থাকে, বেদনার দীর্ঘশ্বাস!

প্রশ্ন জাগে, কেনো বেছে বেছে কেবল স্বদেশ-খোয়ানোর বা নির্বাসনের বেদনাবিধ্বস্ত মেধাবীগণের ওপরই আলো ঢেলেছেন আবেদীন? বা, কেনো শুধুই একাকীত্ব-দগ্ধ আর বিপন্নতা-তাপিত সৃষ্টিশীলকেই, তিনি করে তুলেছেন তাঁর আলোচ্য বিষয়? এটা কী এজন্যে যে, তিনি নিজেই অমন একাকী পরবাসী! তিনি নিজেই পুড়ে চলেছেন তেমন আগুনে, যেমন আগুনে পুড়ছিলেন এক ফরাশি নিঃসঙ্গতা, যার নাম মাদাম দ্যু দিফি; অথবা ইয়েলনিকের নায়িকা এরিকা কোহুট?

নিবন্ধগুলোকে পড়ে যেতে যেতে, ক্রমে, আমি বিস্ময় বোধ করেছি এই ভেবে যে, আবেদীন কী সচেতনভাবেই ওই বিষণ্নতাকেই মূর্ত করে তুলতে গেছেন! নাকি, ওটি তাঁর অলক্ষ্যেই ঘটিয়ে তুলেছেন তিনি! নির্বাসনের যেই বেদনা তিনি তাঁর মর্মে বহন করে চলেছেন, সেই বেদনাই কী তাঁকে দিয়ে নির্বাচন করিয়ে চলেছে অমন সব বিষয়বস্তু? নির্বাসিত অথবা সমাজ বহিরিস্থিত ও চির খাপ-না-খাওয়া মনস্বীদেরই, তাঁর আলোচ্য করে তুলতে বাধ্য করেছে?

নিবন্ধের পর নিবন্ধে এই গ্রন্থটি যেনো মনুষ্যসত্তার নিঃসঙ্গতাবোধ ও তার বেদনারই ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রচনা করার ব্রত গ্রহণ করেছে। কতোরকমের নিঃসঙ্গতা আমাদের চরাচরে বিরাজমান; আর কতো রকমেই বা সৃষ্টিশীলগণ ওই নিঃসঙ্গতাকে আত্মসঙ্গী করে তুলতে পেরেছেন, এবং ওই নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে করে তাঁরা কোন আলো ফলিয়ে যেতে পেরেছেন— সেটিই দেখিয়েছেন আবেদীন!

 

তিন.
‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’ গ্রন্থে সংকলিত নিবন্ধগুলোর শিরোনাম এমন: ‘দূরে থাকার বেদনা, দূরে থাকতে না পারার রক্তক্ষরণ’, ‘নিঃসঙ্গতা, অবদমন ও ধ্রুপদী সোনাটা’, ‘মরীচিকায় শৃঙ্খলিত নিয়তি’, ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’, ‘কবি নিকোস অ্যালেক্সিওর কবিতা’, ‘বিবর্ণ ভারতের অর্থনীতি-সংস্কৃতি: দীর্ঘরেখা দিগন্তে’, ‘সিজার ভ্যোয়াহো: বেদনার ঘূর্ণাবর্তে সৃষ্টির সংরাগে’, ‘এক তরুণ কবি ও তাঁর কবিতা’, ‘মাদাম দ্যু দিফি ও তাঁর জগৎ’, ‘তোমার স্মৃতিও জানি সেই মতো হারাবে ধূলায়’, ‘একজন কথাশিল্পী ও উপন্যাসে জীবন-জিজ্ঞাসা’, ‘মেক্সিকোর আধুনিকায়ন’, ‘আইজিয়া বার্লিন: অনন্ত জ্যোৎস্নায় ধূলিদীর্ণ পাণ্ডুলিপি’, ‘কথাসাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি’, ‘কবিতার সঙ্গীত কবিতার চিত্রকলা’, ‘পরবাসী মার্সেল’, ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব: দার্শনিক-বিজ্ঞানী-প্রেমিক হৃদয় পূজারি কবিতাশিল্পের’।

এই লেখাগুলোকে আমি তিনটি গোত্রে বিভক্ত করতে চাই। ক) প্রগাঢ় সৃষ্টিশীল এবং চির উন্মূল প্রতিভাবিষয়ক নিবন্ধ; খ) নির্দিষ্ট দুয়েকটি গ্রন্থকেন্দ্রিক কিন্তু সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক-সাহিত্যিক বাস্তবতার ওপর আলোকপাতকারী নিবন্ধ; গ) উদ্বাস্তু জীবনের মর্মবেদনা ও কাব্যকলার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক নিবন্ধ।

ক) যে-কটি লেখাকে প্রথম গোত্রভুক্ত করা যেতে পারে, সেগুলো হচ্ছে: ‘মাদাম দ্যু দিফি ও তাঁর জগৎ’, ‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’, ‘সিজার ভ্যায়াহো: বেদনার ঘূর্ণাবর্তে সৃষ্টির সংরাগে’, ‘তোমার স্মৃতিও জানি সেই মতো হারাবে ধূলায়’, ‘আইজিয়া বার্লিন: অনন্ত জ্যোৎস্নায় ধূলিদীর্ণ পাণ্ডুলিপি’, ‘কথাসাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি’ এবং ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব: দার্শনিক-বিজ্ঞানী-প্রেমিক-হৃদয় পূজারি কবিতাশিল্পের’।

খ) ‘নিঃসঙ্গতা, অবদমন ও ধ্রুপদী সোনাটা’, ‘মরীচিকায় শৃঙ্খলিত নিয়তি’, ‘কবি নিকোলাস অ্যালেক্সিওর কবিতা’, ‘বিবর্ণ ভারতের অর্থনীতি-সংস্কৃতি: দীর্ঘরেখা দিগন্তে’, ‘এক তরুণ কবি ও তাঁর কবিতা’, ‘একজন কথাশিল্পী ও উপন্যাসে জীবন-জিজ্ঞাসা’, ‘মেক্সিকোর আধুনিকায়ন’, ‘পরবাসী মার্সেল’ শীর্ষক নিবন্ধগুলো এই গোত্রভুক্ত ।

গ) ‘দূরে থাকার বেদনা, দূরে থাকতে না পারার রক্তক্ষরণ’ এবং ‘কবিতার সংগীত কবিতার চিত্রকলা’ রচনাদুটিকে উদ্বাস্তু জীবনের মর্মবেদনা ও কাব্যকলার নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক নিবন্ধ গোত্রভুক্ত করছি।

 

চার.
যে-দুটি লেখাকে আমি এই গ্রন্থের সবচেয়ে মূল্যবান রচনা বলে গণ্য করতে চাই, সেগুলো হচ্ছে: ‘দূরে থাকার বেদনা, দূরে থাকতে না পারার রক্তক্ষরণ’ এবং ‘কবিতার সংগীত কবিতার চিত্রকলা’। প্রথম নিবন্ধটি নির্বাসিত, উদ্বাস্তু জীবনের বেদনার রূপটিকে উদঘাটন করেছে! আর, দ্বিতীয়টি হচ্ছে কাব্যশিল্পের ভেতরে চির বহমান সুর ও সংগীত বিষয়ে নববোধসঞ্চারী, নব ভাবনা জাগ্রতকারী এক রচনা।

একজন সাধারণ ব্যক্তি যখন বিভাষী পরবাসের জীবনকে মেনে নিতে বাধ্য হন, তখন তাঁর অন্তরে কী কোনো বেদনা, কোনো সংকট ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে? কোনো সৃষ্টিশীল প্রতিভাকে যখন মেনে নিতে হয় নির্বাসন, যখন তিনি যাপন করতে বাধ্য হন উদ্বাস্তু জীবন; ওই উন্মূলতা তাঁর ভেতরেই বা কোন প্রতিক্রিয়া জাগায়? নিজ স্বদেশভূমির ভাষা, জলবায়ু, খাদ্য, পোশাক, কলহাস্য এবং ধূলিকণার ওড়াউড়ি থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণায় কতোটা রক্তাক্ত ও ছন্ন ভন্ন হতে থাকেন তিনি?

ভৌগোলিক দূরত্ব কী তাঁর ভেতর থেকে স্বদেশভূমির জন্য তাঁর টান ও আকুলতা ঘুচিয়ে দিতে পারে? নাকি দূরে থেকেও তাঁকে নীরবে, বরাবর, সহ্য করে যেতে হয় ‘দূরে যেতে না-পারার যন্ত্রণা’? ভৌগোলিক দূরত্বের দণ্ড তিনি যতোটা ভোগ করতে থাকেন; ততোটাই কী তাঁকে, নিজ মাতৃভাষা খুইয়ে ফেলতে বাধ্য হবার জন্যও দণ্ড ভোগ করে যেতে হয় না? আমৃত্যু?

ওই যে দূরে থাকার বেদনা, আর ওই যে দূরে না-থাকতে পারার রক্তক্ষরণ! দার্শনিক নির্মোহতা নিয়ে ওই দুই যাতনার পরিচয় নির্দেশে তৎপর হয়েছেন আবেদীন এখানে।

কবিতায় শব্দের দায়িত্ব কতোটা? একজন কবি কীভাবে তাঁর কবিতায় তাঁর নিজস্ব ধ্বনির সংগীত রচনা করেন? কীভাবে কোনো কবি সেই কাব্যসুরকে দিতে পারেন বিলম্বিত ছাঁদ? আর কীভাবেই বা কারো হাতে সৃজিত হয় দ্রুত লয়! কোন দিব্য আভাগুণে কবিতা পায় ‘ছায়াচ্ছন্ন রহস্যময়তা’? শব্দে শব্দে কীভাবে বিমূর্ততা গড়ে তুলতে সমর্থ হন কবি! কেমন সেই বিমূর্ততা! এই বিষয়গুলো ব্যাখ্যাত হয়েছে এখানে।

অন্যদিকে, ‘কবিতার সংগীত কবিতার চিত্রকলা’ নিবন্ধটি কবিতায় ধ্বনির সংগীত গড়ে ওঠার কলাকৌশলের বিষয়টি যাচাইয়ে ব্যাপৃত হয়েছে। কবিতায় শব্দের দায়িত্ব কতোটা? একজন কবি কীভাবে তাঁর কবিতায় তাঁর নিজস্ব ধ্বনির সংগীত রচনা করেন? কীভাবে কোনো কবি সেই কাব্যসুরকে দিতে পারেন বিলম্বিত ছাঁদ? আর কীভাবেই বা কারো হাতে সৃজিত হয় দ্রুত লয়! কোন দিব্য আভাগুণে কবিতা পায় ‘ছায়াচ্ছন্ন রহস্যময়তা’? শব্দে শব্দে কীভাবে বিমূর্ততা গড়ে তুলতে সমর্থ হন কবি! কেমন সেই বিমূর্ততা! এই বিষয়গুলো ব্যাখ্যাত হয়েছে এখানে।

নিবন্ধটি কবিতার সংগীত এবং কবিতার চিত্রকলা বিষয়ে আমাদের ঋদ্ধ করে তোলার শক্তিসম্পন্ন। তেমনি, আমরা যাঁরা লেখক হয়ে ওঠার অগাধ বাসনাকাতর হয়ে আছি, আমাদের জন্য এক অবশ্যপাঠ্য রচনাও এটি।

 

পাঁচ.
এবার আমরা এই বইয়ের অন্য কয়েকটি নিবন্ধদের সাথেও ক্রমে, বিশদ রকমে, আমাদের পরিচয় সম্পন্ন করে নিতে পারি।

‘মাদাম দ্যু দিফি ও তাঁর জগৎ’ নিবন্ধটিকে গণ্য করা যায় দূরকালের ফরাশি অভিজাত নিঃসঙ্গতার বৈশিষ্ট্য নির্দেশের প্রয়াস বলে! মাদাম দ্যু দিফি অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে জীবন যাপনকারী এমন এক ফরাশি অভিজাত রমণী, যিনি ছিলের রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের নিকট আত্মীয় মার্কেজ দ্যু দিফির পত্নী। মধ্য তারুণ্যেই তিনি বিধবা হন, এবং বৈধব্য পাবার অল্পদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে শিল্পানুরাগী, সুসংস্কৃতা এবং প্যারিসের বুদ্ধিজীবীগণের বন্ধুতা লাভের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন ভলতেয়ার। তাঁর কাছে মাদাম দিফি গণ্য হতে থাকেন, ‘সজীব ও উর্বর কল্পনাশক্তির’ অধিকারী এক নারী রূপে! মাদাম দিফির প্রেমে উতল-অন্ধ হন তাঁর চেয়ে কুড়ি বছরের ছোটো হোরেস ওয়ালপল। এবং সমকালীন আরো বহু লেখক-দার্শনিকের উষ্ণ মিত্রতা তো তাঁর ভাগ্যে জোটেই!

এতো রকমের প্রাপ্তি, এতো রকমের বন্ধুতা সত্বেও মাদাম দিফি নিজেকে চির নিঃসঙ্গ বোধ করেছেন! তার অন্তরসত্তা কখনো সন্তোষে ও সুখে ভরে ওঠার ভাগ্য পায়নি! সেখানে কেবলই উঠেছে করুণ ক্রন্দনরোল, কেবলই জেগেছে শূন্যতাবোধ ও নিঃসঙ্গতাজনিত হাহাকার! ‘গভীর রাতে প্রেমিক ওয়ালপল বা ভলতেয়ারকে বিদায় দিয়ে নিরালা নিঝুম একাকী অন্ধকারে দিফি কান্নায় ভেঙে’ পড়েছেন! এতো আলো ও এতো স্তব ও অতো বন্ধুতার পরেও কোন ‘গভীর ক্ষতে ব্যথার্ত ছিলো’ দিফির অন্তরলোক, সেটি তাঁর নিজের কাছেও সম্ভবত পরিষ্কার ছিলো না!

এই যে নিষ্ফলতাবোধ ও শূন্যতাবোধ; এটি ব্যক্তির অবধারিত নিয়তি। দিফি নিজেই ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন সেই অন্তিম নিয়তির মূর্তরূপ! আবেদীনের নিবন্ধটি মনুষ্যসত্তার ‘শূন্যতায় ভরা মরুময় সীমান্তে নিঃসঙ্গ একা বিরান’ অবস্থাটিকে আমাদের সামনে হাজির করে দেয়, এবং আমরা দীর্ঘশ্বাস দীর্ণ হতে থাকি!

‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’ নিবন্ধটিতে আলোচিত হয়েছে ভারতবাসী ইংরেজীভাষী কবি ডোম মোরেস-এর জীবন এবং তাঁর কাব্যভাবনা। মোরেসের কবিতার চারিত্র্য নির্দেশের পাশাপাশি তাঁর কয়েকটি কবিতার অনুবাদও করেছেন আবেদীন, এখানে।

ডোম মোরেস তাঁর সমস্তটা জীবন ছিলেন নিজগৃহে পরবাসী দশায়। ‘মুম্বাইয়ের এক গোয়ানিজ ক্যাথলিক পরিবারে’ জন্ম তাঁর; ১৯৩৮ সালে। অক্সফোর্ড স্নাতক ডোম লেখালেখি ও সাংবাদিকতাকেই তাঁর পেশা হিসেবে বেছে নেন। ২০০৪ সালে মৃত্যু বরণ করেন মোরেস। দীর্ঘায়ু পেয়েছেন মোরেস, তবে বড়ো যন্ত্রণাদীর্ণ ছিলো তাঁর সমস্তটা আয়ুষ্কাল!

আবেদীনের ভাষ্য আমাদের জানায় ডোম মোরেস ‘সারাজীবন চেয়েছিলেন একাকী দ্বীপের মতো বাস করতে! সাথীহীন, স্বজনহীন, পরিবারহীন, ঘরহীন উন্মূল এক শিল্পীর মতো। মানসিকভাবে হয়তো তা-ই ছিলেন!’ কিন্তু অমন বাসনা সত্ত্বে মোরেস ছিলেন এক ‘আজন্ম ক্ষুধার্ত-প্রেমিক’, যিনি ‘নারী ও ভালোবাসাকে নিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছেন।’

‘যে-দেশে জন্মেছিলেন, সে-দেশের কোনো ভাষা জানতেন না’ মোরেস! তিনি লিখে গেছেন ইংরেজিতে। তাঁকে পেতে হয়েছে বেদনা জর্জরিত এক বাল্যজীবন। ‘মাত্র সাত বছর বয়সে তাঁর মাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়’। তারপর তাঁর বাকিটা জীবন কাটে মায়ের জন্য আকুলতা বোধ করে করে; মাকে অমন চির নির্বাসিত হতে দেবার জন্য যন্ত্রণা ও অপরাধবোধে ছিন্নভিন্ন হয়ে হয়ে। চিরদিনই মোরেস ছিলেন উন্মূলতা বোধ-আক্রান্ত!

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিগিনিং’ বেরোয় ১৯৫৭ তে। গ্রন্থটি প্রকাশের সাথে সাথেই খ্যাতিমান হন তিনি। প্রায় পাঁচ দশক ধরে লেখালেখি করেছেন মোরেস। যদিও তিনি বিপুল পরিমাণেই গদ্য রচনা করেছেন, কিন্তু মূলত তিনি ছিলেন কবি। চিরকালই তিনি যাপন করতে চেয়েছেন কবিরই জীবন! ‘প্রেম ও শিল্পসৃষ্টির ক্ষুধা’ তাঁকে নিরন্তর তাড়িত করে গেছে;এবং ওই ক্ষুধা তাঁর ‘কোনোদিনই মেটেনি!’

মোরেসের কবিতার জীবনকে দুটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্ব, যেটি স্থায়িত্ব পেয়েছে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। আর, ১৯৮২-র পর থেকে তাঁর কবিজীবনের দ্বিতীয় পর্বের শুরু! প্রথম পর্বে তিনি এমন এক কল্পজগতকে সৃজন করেছেন, ‘যার সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো সম্পর্ক নেই! প্রেম, নারী, যৌনতা সবই সেখানে রয়েছে, তবুও সে জগৎ একেবারে কল্পলোকের জগৎ!’ আর দ্বিতীয় বা শেষ পর্বের কবিতাগুলো হয়ে উঠেছে ‘প্রজ্ঞা-আবেগানুভূতি মিশ্রিত অশ্রুরাজির শব্দরূপ!’

‘সিজার ভ্যায়াহো: বেদনার ঘূর্ণাবর্তে সৃষ্টির সংরাগে’ নিবন্ধটি শুধু ‘ভিন্নতর কাব্যভাষার জাদুকর’ সিজার ভ্যায়াহোর কাব্যকীর্তির মূল্যায়নেই মগ্ন থাকে না, এটি আধুনিক স্প্যানিশ কাব্যধারার সামগ্রিক পরিস্থিতিটিকেও বিস্তৃত ভাবে উপস্থাপন করে। সিজার ভ্যায়াহো বিংশ শতকের তুমুল এক শক্তিমান কবি। স্প্যানিশভাষী ভ্যায়াহো জন্মেছেন পেরুতে, ‘গোঁড়া এক ক্যাথলিক পরিবারে, ১৮৯২ সালে। মৃত্যুবরণ করেন ১৯৩৮-এ।

ভ্যায়াহোর জীবনের প্রথমটা শুধু দারিদ্র্যের ভয়াল পীড়নের মধ্য দিয়েই কাটেনি, ‘কঠোর ধর্মানুশাসন’ অনুশীলনের মধ্য দিয়েও কেটেছে। পিতার স্বপ্ন ছিলো তাঁর এই কনিষ্ঠ পুত্রটি হবে পাদ্রী। সেই কারণেই ভ্যায়াহোকে বিবিধ ধর্মবিধি মান্য করার ও অনুশীলন করে চলার মধ্য দিয়ে বড়ো হয়ে উঠতে হয়েছে।

যদিও পরে নিজ জীবনকে একেবারেই ভিন্ন এক খাতে বইয়ে দিয়েছেন ভ্যায়াহো, হয়ে উঠেছেন গভীর অঙ্গীকারাবদ্ধ এক কমিউনিস্ট; হয়ে উঠেছেন সমাজ বদলের স্বপ্ন-আন্দোলিত একজন! হয়ে উঠেছেন বিশ্বমানবতার ঐক্যসাধনের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন-সমর্থ এক অতি সক্রিয় মার্ক্সবাদী! কিন্তু তাঁর অর্ন্তলোককে নিত্য নিরন্তর ছিন্নভিন্ন করেছে, প্রথম জীবনে পাওয়া পাপপুণ্য বিষয়ক কট্টর ক্যাথলিক শিক্ষা ও নীতিবোধগুলো। একদিকে ভ্যায়াহো প্রেম ও মুক্ত অবাধ যৌনতার অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলতে পেরে বোধ করেছেন সার্থকতা! পেয়েছেন সৃষ্টিশীলতার অগাধ প্রেরণা! অন্যদিকে গোপনে নিভৃতে দগ্ধ হয়েছেন তীব্র অনুতাপ আর পাপবোধে।

স্কুলের পড়া শেষ করে ভ্যায়াহো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু দারিদ্র্যের পেষণ তাঁকে নির্বিঘ্ন ও নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে দেয়নি। অগত্যা একসময় পেরুর বিরাট এক আখের খামারের হিসাব বিভাগে তাঁকে কাজ নিতে হয়। এখানেই ‘মানুষের জীবনের কষ্টের, শ্রমের, ঘামের, মজুরির পরিমাণ-এর’ ও তাদের চির বিপন্নতার সঙ্গে ভ্যায়াহোর সত্যকার পরিচয়টি সম্পন্ন হয়! অতি সামান্য মজুরিপ্রাপ্ত আখ-খামার শ্রমিকদের ‘অস্তিত্বের ভয়াবহ সংকটের’ রূপটি অনুধাবনে সমর্থ হন তিনি। ভ্যায়াহো তাঁর সেই অভিজ্ঞতাকে এভাবে ব্যক্ত করেছেন: ‘এই অভিজ্ঞতা—ভেতরের কতগুলো রক্তকণিকাকে নিঃশেষ ও অবশ করে দিয়েছে; অন্যদিকে মনের গভীরে জ্বালিয়ে দিয়েছে একটি অনিঃশেষ দীপ—যা একটানা বিরামহীনভাবে—আলো দিয়ে পথ দেখিয়েছে, বাঁচিয়ে রেখেছে সারাজীবন।’

১৯২৩-এর শুরুর দিকে, ভ্যায়াহো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পর্ব শেষ করে, একটা স্বস্তিকর চাকুরিতে খানিকটা থিতু হওয়ার সুযোগ লাভ করেন; তখুনি ভাগ্য তাঁকে বিড়ম্বনাকর এক অবস্থার দিকে ঠেলে দেয়। ভ্যায়াহো রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন। তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এবং তাঁর চাকুরিটিও কেড়ে নেয়া হয়।

অতীব বিধ্বস্ত এক মানসিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় ভ্যায়াহোকে মাতৃভূমি পেরু ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ১৯২৩ সালের জুন মাসে, ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে জাহাজে চেপে বসতে হয় তাঁকে। তারপর আর কখনো মাতৃভূমিতে ফিরে আসার সুযোগ পাননি ভ্যায়াহো।

প্যারিস বাসের প্রথম দিকে ভ্যায়াহো কাটিয়েছেন ভয়াবহ দারিদ্র্য কণ্টকিত দিন ও রাত! অর্ধাহার অনাহার ছিলো তখন নিত্যসহচর; খাদ্যখরচা জোগাড়ের অর্থ আয়ের চেষ্টায়, তাঁকে প্যারিসের পথে পথে পুরোনো বোতলও ফেরি করতে হয়েছে দীর্ঘকাল। পরে স্পেন সরকারের দেয়া একটি বৃত্তি, তাঁর এই দুর্দশার অবসান ঘটায়।

ভ্যায়াহোর জীবন যেমন বাঁক বদলেছে; তেমনি সময় ও পরিস্থিতির সাথে সাথে বাঁক বদলেছে তাঁর কবিতা ও কাব্যপ্রবণতা। রাজনীতিক মানচিত্র বদলে নিতে বাধ্য হয়েছেন কবি! মানচিত্র বদলের সঙ্গে তাঁর কবিতাও পেয়েছে ভিন্ন চারিত্র্য। গোড়াতে গভীর রোম্যান্টিসিজমই শুধু তাঁর কাব্যচৈতন্যকে আলোড়িত করে চলেছে; ক্রমে সেই চৈতন্য হয়ে উঠেছে তীব্র রাজনীতিমনস্ক।

জীবনের শেষ পর্যায়ে, ১৯২৩ থেকে শুরু করে ১৯৩৮-এ আগ পর্যন্ত সময়ে, ভ্যায়াহো রচিত ‘সকল কবিতাই আর্তমানবতার জন্য লেখা!’ এবং এভাবে ‘কবিতার মাধ্যমেই’ ভ্যায়াহো ‘নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে চেয়েছেন।’ তবে ভ্যায়াহো তাঁর কবিতাকে কখনোই ‘কোনো রাজনৈতিক মতবাদ বা দর্শন প্রচারের’ মাধ্যম করে তোলেননি। নিজের কবিতার জন্য একটি নিজস্ব ‘কাব্যভাষা’ সৃজনে সমর্থ হন ভ্যায়াহো, এবং ‘স্প্যানিশ ভাষায় ভ্যায়াহোই প্রথম’ ওটি করতে পেরেছিলেন।

১৯২৮-এ প্যারিস বাসকালীন সময়ে ‘নতুন করে মার্ক্সবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করা’ এবং ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ বিষয়ক বিতর্ক ও সেমিনারে’ অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়েই ভ্যায়াহো তীব্ররকমে মার্ক্সবাদী দর্শন-শাসিত হয়ে ওঠেন। তবে তাঁর অর্ন্তলোকে, নিভৃতে, ওই বোধের উদগম ঘটে আরো অনেক আগেই! সেই আখ-খামারে কর্মরত থাকার সময়পর্বেই।

জীবনের ঘন তমসা এবং মানবতার দুর্বিপাক ভ্যায়াহোকে কতোটা উৎকণ্ঠিত করেছে? তাঁর কবিতার পংক্তিরা তাঁর সেই ‘উৎকণ্ঠিত উদ্বেগময় মানসের’ যে-পরিচয় ধারণ করে আছে, আমরা সেটির সঙ্গে একটুখানি পরিচিত হতে পারি:

জীবনের হিংস্র আঘাত রয়েছে
এমনি কঠিন আঘাত— আমি বলতে অপারগ
সেই আঘাত ঈশ্বরের ঘৃণার মতো;
যেন তার সামনে রয়েছে দু:খের কষ্টের ভয়াল বন্যা, …
একটি মানুষ—একজন গরিব-হতভাগা-গরিব হতভাগা!
সে তার চোখ তোলে, যেমন
কেউ আমাদের কাঁধে হাত রাখলে আমরা তুলি!

সে তার অবিন্যস্ত চোখ তোলে! (‘কালো সংবাদবাহী’। আবেদীন কাদেরকৃত অনুবাদ)

‘আইজিয়া বার্লিন: অনন্ত জ্যোৎস্নায় ধূলিদীর্ণ পাণ্ডুলিপি’ নিবন্ধে আবেদীন বিংশ শতাব্দীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেই দার্শনিক ও চিন্তাবিদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে দেন, তাঁর নাম আইজিয়া বার্লিন! বার্লিন ‘খ্যাতিমান ছিলেন দার্শনিক হিসেবে। ছিলেন চিন্তাবিদ, ঐতিহাসিক, মননশীল অধ্যাপক!’ বাগ্মীতার জন্য, ‘দ্যুতিময় বক্তৃতার জন্য’ ‘পশ্চিমের জ্ঞানজগতে’ ও বোদ্ধামহলে তিনি পেয়েছিলেন গগণচুম্বী খ্যাতি! অথচ এমনই দুর্দৈব! বঙ্গভাষা এলাকা ওই মনস্বী দার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের সাথে প্রায় অপরিচিতই হয়ে রয়েছে।

আইজিয়া বার্লিন ১৯০৯-এর জুন মাসে, লাটভিয়ার রিগাতে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত সম্পদশালী ইহুদী পরিবারের সন্তান তিনি। তবে ১৯১৭-র রুশ বিপ্লবের পরে তাঁর পরিবার রিগা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তারপর তারা স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস শুরু করে। বার্লিনের ছাত্রজীবন ও পেশাগত জীবনের পুরোটাই অক্সফোর্ডে কেটেছে। তিনি মারা যান ১৯৯৭-এর নভেম্বরে।

বিংশ শতাব্দীর চিন্তাজগতে বার্লিনকে গণ্য করা হয় ‘স্বাধীনতা’ বিষয়ে সবচেয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধানতম চিন্তাবিদ’ বলে। তিনি যেমন ‘স্বাধীনতা’ বিষয়ে ভেবেছেন, তেমনি গভীরভাবে ভেবেছেন ‘মানবজীবনে মর্যাদা’র ভূমিকা বিষয়ে। ‘চিন্তার গুরুত্ব’ বিষয়েও তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেন।

দুই ধরণের স্বাধীনতার কথা বলেছেন বার্লিন। ‘এক ধরণের স্বাধীনতায় নাগরিকগণ রাষ্ট্রীয় কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা ভোগ’ করতে সমর্থ হবে। বার্লিন একে বলেছেন ‘নেগেটিভ লিবার্টি’। ‘অন্যটি পজেটিভ লিবার্টি।’ এই লিবার্টিকে ‘রাষ্ট্র অনুমোদন করে, কিন্তু জুড়ে দেয় নানা নিয়মকানুন ও বিধিবিধান ও বিবিধ শর্ত’!

বার্লিন তাঁর ‘টু কনসেপ্ট অফ লিবার্টি’ গ্রন্থে এই দুই রকমের স্বাধীনতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এবং প্রতিপন্ন করেন যে, ‘ন্যায়ভিত্তিক সমাজের জন্য এই দুই ধরণের লিবার্টি বা স্বাধীনতারই প্রয়োজন রয়েছে।’ প্রচলিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বে একটি নতুন ধারণাও যুক্ত করেন বার্লিন।

‘তোমার স্মৃতিও জানি সেই মতো হারাবে ধূলায়’ নিবন্ধটিকে প্রথমত এক হৃদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণামূলক গদ্যকর্ম বলে আমরা গণ্য করতে পারি। তবে এখানে আন্দ্রে অ্যাসিম্যানের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়নের কাজটিও বিশদরকমইে সম্পন্ন করেন আবেদীন। এবং লেখক অ্যাসিম্যানকে নিবিড়ভাবে চিনে ওঠার জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও এখানে জুড়ে দিয়েছেন তিনি।

আন্দ্রে অ্যাসিম্যান জন্মেছেন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায়। ১৯৬৫ সালে এই ইহুদী পরিবারটি মিসর থেকে বিতাড়িত হয়; এবং দীর্ঘকাল ধরে পরিবারটিকে যাপন করতে হয় প্রায় এক যাযাবর, অথিতু জীবন। বছরের কয়েকমাস করে করে পরিবারটিকে কখনো রোমে, কখনো প্যারিসে বসবাস করে করে চলতে হয়।

পরে অ্যাসিম্যান থিতু হন আমেরিকায়, গ্রহণ করেন অধ্যাপনার কাজ। গদ্যকার অ্যাসিম্যান বরাবর বিদীর্ণ হয়েছেন নির্বাসিত জীবনের বেদনা ও নিঃসঙ্গতায়! বরাবর তিনি স্মৃতিকণ্টকিত এবং বেদনার্ত! ‘আউট অফ ইজিপ্ট’ অ্যাসিম্যানের আত্মজীবনী গ্রন্থ। এটি তাঁর ‘জন্মস্থান আলেকজান্দ্রিয়ার কাহিনি। তাঁর পরিবার, স্বজাতি-স্বজন, তাদের জীবন যাপন এবং পেশা, ভালো লাগা মন্দ লাগা এবং ইহুদী সম্প্রদায়ের বিভিন্ন কঞ্জুসপনা ও বাহাদুরি— সবকিছুই লিখেছেন এক নির্মম নৈর্ব্যক্তিকতায়।’

আবেদীনের আলোচনা আমাদের চিনিয়ে দিতে থাকে এমন এক দুর্মর রোম্যান্টিককে, যিনি ‘পেতে চান সেই বস্তু, যা বরাবরই তাঁর আয়ত্তের বাইরে; যা কখনোই তিনি পাবেন না, যা শুধুই স্বপ্ন থেকে যাবে তাঁর জীবনে!’ তবে কখনো কখনো আরাধ্য ধন তো হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়ে দেয়! কখনো কখনো তো বাহুর নিবিড়বেষ্টনে ধরে ফেলতে পারি আমরা অধরা স্বপ্ন ও প্রেমকে। তখন অ্যাসিম্যানের বোধের পৃথিবীতে কোন চাঞ্চল্য জাগে? কেমন লাগে তখন তাঁর? অ্যাসিম্যান জানান, যখন তিনি তাঁর কোনো আরাধ্য বস্তু বা বিষয়কে পেয়ে যান; তখন সেই পেয়ে ওঠার সাথে—সেই প্রাপ্তিমোড়ানো বাস্তবতার সাথে— খাপ খাওয়ানো তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে! তাই ‘পেয়ে যেতে’ চান না তিনি। তিনি শুধু চান ‘পাবার জন্য জন্ম নেওয়া আকুলতাটুকু’। ‘সারাক্ষণ, সারা জীবন’ শুধু ওইটুকুই চান তিনি। শুধু চান ‘স্বপ্ন ও জাগরণের’ ঘোরের মধ্যে বাস করতে!

অ্যাসিম্যান-এর স্বীকারেক্তি এমন: যা কিছু এতোদিন শুধু তাঁর স্বপ্নে সত্য হয়ে ছিলো, সেটিকে যখন তিনি বাস্তবে মূর্ত হয়ে উঠতে দেখেন, তখুনই তাঁর চোখে পড়ে ওটির অসম্পূর্ণতা! চোখে পড়ে খুঁত ও সামান্যতা! তখনই ওই ‘পেয়ে ওঠাটার’ সঙ্গে থাকার আবেগটা তাঁর ফুরিয়ে যায়। আর এক মুহূর্তও ওটির সন্নিকট থাকার বাসনা থাকে না তাঁর! শুধু দূরে কোথাও, অন্যত্র কোনোখানে, ছুটে যাবার তীব্র চাপ তাকে দিশাহারা করে দিতে থাকে!

লেখক অ্যাসিম্যান ‘একাধিক স্থানে একই সঙ্গে থাকতে চান!’ তবে তাঁর লেখারা জানায়, অ্যাসিম্যান সবচেয়ে তুমুল রকমে থাকেন এবং থাকতে ভালোবাসেন ‘তাঁর লেখায়, তাঁর স্বপ্নে, তাঁর কল্পনায়— তাঁর বইয়ের পাতায়; এবং এমন কী তাঁর প্রিয় লেখকদের বইয়ের পাতার ফাঁকে ফাঁকে!’

‘কথাসাহিত্যিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি’ নিবন্ধটি আবু জাফর শামসুদ্দীনের আত্মস্মৃতি গ্রন্থটির ওপর আলোকপাতের অভিলাষ নিয়ে যাত্রা শুরু করে ঠিকই, কিন্তু অচিরেই আমরা তন্নতন্ন আলো পড়তে দেখি আবু জাফর শামসুদ্দীনের পারিপার্শ্বের পৃথিবীর ওপর। যেই অর্থনীতিক ও রাজনীতিক বাস্তবতামোড়ানো দুনিয়ায় তিনি জন্মপরবর্তীকালে বেড়ে ওঠেন, সেই জগত, তার নিরাবরণ সত্য-স্বরূপে এসে হাজির হয়, আমাদের সামনে।

শিক্ষা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার শেকল ছেঁড়ার জন্য তাঁর বেদিশা চেষ্টাটা আমাদের রক্তে এসে ঝনাৎকার তোলে। এক চির নিঃসঙ্গ পথিকের চির একাকী পরিব্রাজনের ছবিটি পাচ্ছি আমরা এ-লেখায়। আবেদীনের ভাষ্য আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলতে থাকে দারিদ্র্য-ক্লিষ্ট এক দুনিয়ার ছবি।

সেই দুনিয়ায়, ক্রমে অতি নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এক সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান, মাদ্রাসায় অধ্যয়নপর্বেই বিপুল বিশ্বকে চিনে উঠতে থাকে! বই পড়ার মধ্য দিয়ে দিয়েই জেনে উঠতে থাকে বিপ্লবী সর্বহারার সংগ্রামের আদ্যোপান্ত। তারপর একদিন অকস্মাৎ; সেই একাকী কিশোরের অন্তর, নিরুদ্দেশের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তখন সব ফেলে সে পাড়ি জমায় অনিশ্চিত অজানার উদ্দেশ্যে। পেছনে পড়ে থাকে থিতু জীবন। নিশ্চিন্ত আগামীর পথপরিস্থিতি।

আমরা জেনে উঠতে থাকি, ‘পারিপার্শ্বের রাজনীতিক ঝড়ঝঞ্ঝাট’ আবু জাফর শামসুদ্দীনকে কতোটা কাতর রাখতো! জেনে উঠতে থাকি তিনি কতোটা ছিলেন ‘রাজনীতিঅন্ত প্রাণ’, আর কতোটাই বা ছিলেন ‘সাহিত্য সমর্পিত’! কোথাও থিতু হতে না-পারার বেদনাদীর্ণ তিনি! জন কল্যাণের জন্য চির উৎকণ্ঠ! তাঁর একাকী পরিব্রাজন, তাঁর দেশপ্রেম— আমাদের মধ্যে জাগিয়ে দিতে থাকে গভীর অপরাধবোধ!

কী মূঢ়তামোড়ানো আত্মশ্লাঘার মধ্যে, হীন পরিতোষের মধ্যে আমাদের বসবাস! আমাদের এই অগ্রজকে কতোটা জেনে উঠেছি আমরা? কতোটা পাঠ করেছি তাঁকে? আদৌ করছি কী?

কী মূঢ়তামোড়ানো আত্মশ্লাঘার মধ্যে, হীন পরিতোষের মধ্যে আমাদের বসবাস! আমাদের এই অগ্রজকে কতোটা জেনে উঠেছি আমরা? কতোটা পাঠ করেছি তাঁকে? আদৌ করছি কী?

সমস্তটা নিবন্ধ পড়ে উঠতে উঠতে অন্য একটি সূক্ষ্ম ও অস্ফুটপ্রায় ভাবনাও কী আমাদের মনে আনাগোণা চালাতে থাকে না? থাকে। আমাদেও জানতে ইচ্ছে হতে থাকে, এই যে পথিক, যাঁর নাম আবু জাফর শামসুদ্দীন! তিনি যেমন চির একাকী এবং ভ্রাম্যমাণ অনিকেত! আমাদের এই নিবন্ধকার, আবেদীন কাদেরও কী তেমনই চির নিসঃঙ্গ? সে কারণেই কী তাঁর অগ্রজের বেদনা-মূহ্যমানতার-নিঃসঙ্গতার অমন সত্য-প্রতীয়মান রচনা করে উঠতে পেরেছেন তিনি?

 

ছয়.
বড়ো বেদনার মতো বেজেছ গ্রন্থটি সাক্ষ্য দেয়, তাঁর নিবন্ধের বিষয়বস্তুর দিকে লেখক যতোটা গভীররকমে মনোযোগী থেকেছেন, ঠিক ততোখানিই তিনি উপেক্ষা ও অনাদর দিয়েছেন তাঁর গদ্যকে। তাঁর বাক্য প্রায়শই হয়ে উঠেছে বিবিধ গোলযোগে পরিপূর্ণ। তাঁর উপমা বা উদাহরণগুলো প্রায় প্রায়ই হয়ে উঠেছে পারম্পর্যহীন! কখনো কখনো দীর্ঘ শিথিল বাক্য-শরীর; লেখকের বক্তব্যের শেষপ্রান্তে পৌঁছুতে পৌঁছুতে, একেবারেই থেবড়ে গেছে। কোনো অর্থজ্ঞাপনের সামর্থ্যই আর থাকেনি ওই বাক্যের! এমনটা যে ক্বচিৎ-কদাচিৎ ঘটেছে, তা নয়! ঘটেছে প্রায়শই! নিবন্ধে নিবন্ধেই আবেদীন কাদেরের বাক্যরা, লেখকের ওই চরম উপেক্ষা ও অমনোযোগের অত্যাচারটা পেয়েছে।

আমরা এখানে লেখকের ওই গদ্যঅবহেলা, মনোযোগহীনতার কিছু উদাহরণ উদ্ধৃত করছি:

১. ‘ভ্যায়াহোর প্রথম পর্যায়ের কবিতা পড়লে মনে হয়, এর ভাষা পাঠককে ত্বরিত চোরাবালিতে আচ্ছন্ন করে রাখে, তখন গভীরভাবে মনোনিবেশ করলে সে চোরাবালি পাঠককে অত্যন্ত আর্দ্র এক গভীর জলরাশির ভেতরে নিমজ্জিত করে।’ (‘সিজার ভ্যায়াহো: বেদনার ঘূর্ণাবর্তে সৃষ্টির সংরাগে’, পৃষ্ঠা: ৯৫)। আমাদের জিজ্ঞাস্য এই যে, চোরাবালি কি আচ্ছন্ন করে রাখে? নাকি গ্রাস করে? কবে থেকে চোরাবালি তার স্বভাব বদলেছে? আর এই যে বাক্য! এই বাক্যের মরতবা কী? এটি কী কিছু স্পষ্ট করে? কী স্পষ্ট করে?

২. ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে অবক্ষয়ের চূড়ায় যুবসমাজ যখন জীবনদর্শনগুলোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে, আস্থা হারাচ্ছে সবরকম বুদ্ধিবৃত্তিতে, তখন অস্তিত্ববাদ এক নতুন পথের সন্ধান দিলো।’ (‘পরবাসী মার্সেল’, পৃষ্ঠা: ১৯৬)। আজকাল কী অবক্ষয়ের চূড়ায়ও ওঠা যাচ্ছে? নিচে আর নামতে হচ্ছে না? কী জানি, হবেও বা! আমি আর কতোটাই বা বুঝি! কিন্তু এই যে বাক্য, এটা তো গোড়াতেই আমাদের জানায় যে, জীবনদর্শন বা অন্যসব বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলো তুড়ি পেয়ে উড়ে যাচ্ছে! তার মধ্যেই অস্তিত্ববাদ একটা নয়া পথের সন্ধান দেয় কেমনে? বললে তো বরং এখানে বলা উচিত, অস্তিত্ববাদ অস্তিত্ববিষয়ক এক নতুন ধারণার সন্ধান দিলো!

৩. ‘যেগুলোকে বাস্তব সত্যের ক্ষুরধার ছেনিতে বিশ্লেষণ করতে প্রয়াসী হলেন তিনি।’ (‘পরবাসী মার্সেল, পৃষ্ঠা: ১৯৬)। ছেনি দিয়ে কি বিশ্লেষণ করার কর্ম সম্পাদিত হয়? ছেনি তো হচ্ছে প্রস্তর বা ধাতু ছেদনের যন্ত্রবিশেষ। ওটি কী এখন বিশ্লেষণ কর্মে ব্যবহার করা হচ্ছে নাকি? তাই? কবে থেকে?

৪. ‘বিদ্রোহ হয়তো কখনো তাঁর জীবনে ব্যর্থতা এনেছিল, কিন্তু তাতে ছিল জীবনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রয়াস।’ (ওই, পৃষ্ঠা: ১৯৮) এই বাক্যেরও অর্থের কোনো আগামাথা পাওয়া সম্ভব হয়নি !

৫. ‘অসুস্থ মায়ের জন্য মনের মধ্যে ঘুমন্ত বেদনা, অপরাধবোধ ও বিষাদ তাঁকে সারাক্ষণ তাড়া করত।’ (‘বড়ো বেদনার মতো বেজেছ’, পৃষ্ঠা: ৫৪)। ঘুমন্ত বেদনা তাড়া করে কীভাবে?

৬. এই বইয়ের একটি নিবন্ধের শিরোনাম: ‘মরীচিকায় শৃঙ্খলিত নিয়তি’। মরীচিকা কি শৃঙ্খলিত করার শক্তি রাখছে আজকাল? আগে তো সে কেবল জলভ্রান্তি জাগায়ে জাগায়ে, লোককে দিকভ্রান্ত করার কাজেই নিয়োজিত ছিলো। আজকাল বুঝি সে তার চারিত্র্য বদলে নিয়েছে? তাই বিভ্রম জাগানোর পেশায় ক্ষান্তি দিয়ে, মরীচিকা এখন, লৌহকাঠিন্য দিয়ে লোককে বন্দী করা শুরু করেছে?

আবেদীনের এই সীমাবদ্ধতা বা স্বেচ্ছা উদাসীনতা বা গদ্য-অনাদর আমাদের পীড়িত করে! কঠিনভাবেই পীড়িত করে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

বাংলা ভাষার একজন ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার। আকিমুন রহমানের গ্রন্থসমূহ হলো : ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-৫০)’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘বিবি থেকে বেগম’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘এইসব নিভৃত কুহক’, ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পাশে শুধু ছায়া ছিলো’, ‘জীবনের পুরোনো বৃত্তান্ত’, ‘নিরন্তর পুরুষভাবনা’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়ো’, ‘পৌরাণিক পুরুষ’, ‘বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার দলিল (১৩১৮-১৩৫০ বঙ্গাব্দ)’, ‘অচিন আলোকুমার ও নগণ্য মানবী’, ‘একদিন একটি বুনোপ্রেম ফুটেছিলো’, ‘জলের সংসারের এই ভুল বুদবুদ’, এবং ‘নিরুদ্দেশের লুপ্তগন্ধা নদী’।

আকিমুন রহমান ভালোবাসেন গন্ধরাজ আর বেলীফুল আর হিজলের ওড়াভাসা! আর তত্ত্বের পথ পরিক্রমণ! আর ফিকশন! ঊনবিংশ শতকের ইউরোপের সকল এলাকার গল্পগাঁথা আর এমিল জোলার কথা-বৈভব! দূর পুরান-দুনিয়ায় বসতের সাথে সাথে তিনি আছেন রোজকার ধূলি ও দংশনে; আশা ও নিরাশায়!

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।