শুক্রবার, মে ৩

মৃত-সুন্দরী : পলি শাহীনা

0

বিচ্ছেদের জন্য কোনো প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে না। এই যে না বলে না কয়ে আচমকা আনোয়ার চলে গেল, বাগানবিলাস বেষ্টিত যে দুয়ার পেরিয়ে ওর হাত ধরে এই ঘরে ঢুকেছিলাম, গাছটি এখনো ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ওকে বাড়ি থেকে বিকেলবেলা বের করে নেওয়ার সময় গাছটি ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এখনো একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে, শরীরটাও কেমন অবশ লাগছে। দিনের আলো ছুটি নিয়েছে বেশ আগে, অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। পাথরের মতো ভারি শরীরটা টেনে টেনে নিজের কক্ষে নিয়ে আসি। দরজায় খিল এঁটে ঘুমের মতো করে আলো নিভিয়ে দিই। ও মাথায় হাত বুলিয়ে না দিলে জানি ঘুম আসবে না। ডান দিকের বালিশে ও নেই জেনেও পাশ ফিরে হাত বাড়িয়ে দিই, প্রচ্ছন্ন একটা মায়া আমাকে জড়িয়ে ধরে। গতকাল এই সময় ও ছিল, মায়া ছিল, সব ছিল। আনোয়ার নেই, গোটা দিন গত হয়েছে, কিন্তু এই ধ্রুব সত্যটা কেন জানি এখনো আমি ঠিকঠাকভাবে বিশ্বাসই করতে পারছি না। যে মানুষটার সঙ্গে একত্রিশ বছর ধরে থেকেছি, যার ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ঠিক এই সময়টায় বারবার ঘড়ি দেখেছি, সেই মানুষটা আর নেই, কোনো দিন ফিরবে না আমার কাছে, এই পুরো বিষয়টা আমার মস্তিষ্কে দুর্বোধ্য লাগছে। বাইরের ঘর থেকে কখনো চাপা কান্নার শব্দ, কখনো-বা দোয়া-দরুদ পড়ার শব্দ ভেসে আসছে কানে। ঘুম তো দূরের কথা চোখের পাতা পর্যন্ত একসাথ করতে পারছি না। সামনের দেওয়ালে চোখ আটকে যায়। আমাদের বিয়ের দিনে তোলা যুগল ছবিটি সোনালি ফ্রেমে অন্ধকারের গায়ে যেন জোনাকির মতো জ্বলছে। ওই তো আনোয়ার ঠিক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না, শ্বাসকষ্ট বাড়ছিল দ্রুতগতিতে। সারা দিন যা অনুভূত হয়নি এখন তা হচ্ছে, সবকিছু অস্বাভাবিক ঠেকছে। বন্ধ কপাট পেরিয়ে আগরবাতির গন্ধ এসে আমাকে জাপটে ধরছে। একটা মৃত্যুগন্ধ পাচ্ছি, আমার পৃথিবী শূন্য শূন্য লাগছে। এই প্রথম আমার চোখে পানি আসে, আমি ভেসে যেতে থাকি অশ্রু প্লাবনে।

সামনের দেওয়ালে চোখ আটকে যায়। আমাদের বিয়ের দিনে তোলা যুগল ছবিটি সোনালি ফ্রেমে অন্ধকারের গায়ে যেন জোনাকির মতো জ্বলছে। ওই তো আনোয়ার ঠিক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না, শ্বাসকষ্ট বাড়ছিল দ্রুতগতিতে। সারা দিন যা অনুভূত হয়নি এখন তা হচ্ছে, সবকিছু অস্বাভাবিক ঠেকছে। বন্ধ কপাট পেরিয়ে আগরবাতির গন্ধ এসে আমাকে জাপটে ধরছে।

নিঃসঙ্গ ভুবনে আমি বিছানা ছেড়ে অন্ধকার কক্ষে পায়চারি করতে থাকি। গভীর আঁধারে জ্বলজ্বল করছে শূন্যতা। ততক্ষণে বাইরের ঘরের সমস্ত শব্দ থেমে গেছে। চারপাশের পরিবেশটাকে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত উনুনে রাখা উত্তপ্ত একটা তাওয়া। আমার আপাদমস্তক পুড়ে যাচ্ছে, কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে আনোয়ারের কাছে চলে যাই, ওখানে গেলেই হয়তো শান্তি মিলবে। সদ্য ডাঙায় তোলা মাছের মতো বদ্ধ ঘরে ধড়ফড় করছি। শরীরের এত শক্তি গত কয়েক ঘন্টায় কীভাবে যে এত ক্ষয়ে গেল, বুঝতে পারি না। মন চাইছে কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে খোলা বারান্দায় বসি, কিন্তু দূর্বল শরীর সায় দিচ্ছে না। শরীর ও মনের বিবাদ মেটাতে স্নানঘরে গিয়ে ঢুকি। অবিরাম জলজ ধারার মধ্যে নিজেকে সঁপে দিয়ে একটু শান্তি পাই যদি। স্নানঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ে আয়নায়, চমকে উঠি সাদা বসনে আবৃত নিজেকে দেখে। আরও একটু ঝুঁকে দেখি কানে দুল নেই, গলায় হার নেই, নাক-হাত খালি। মনে পড়ে দিনের আলোতে কে যেন এগুলো খুলে নিয়েছিল, কিন্তু কে নিয়েছিল মনে করতে পারছি না। যে সাজসজ্জার সঙ্গে আমার যাপিত জীবনের দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠতা, তা এক নিমিষেই আমার অনুমতি ছাড়া খুলে নিয়েছে আমারই পরিবারের কেউ, ভাবতেই কষ্টের অথই সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকি। পরিবারের সবাই মিলে যখন আমার গয়না খুলে নিয়েছে, লাল শাড়ির জায়গায় সাদা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে, তখন নিশ্চয়ই ওর খারাপ লেগেছে ভেবে বুকটা ধক করে উঠে।

কাছের মানুষের প্রস্থান আমার বেশভূষা বদলে দিয়েছে সম্পূর্ণভাবে। এমন বদলের রীতি কোথা থেকে এলো? স্ত্রীর মৃত্যুর পর স্বামীর জীবনে কি এমন বদল আসে? পরিবার কিংবা কাছের কেউ কি জোর করে স্বামীর শরীর থেকে কোনো চিহ্ন ছিনিয়ে নেয়, বা তার পোশাক বদলে দেয়? এত মেঘ করে আছে মনে, চাতকের মতো প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, কোনো উত্তর পাই না। প্রশ্নগুলো বোবা দেওয়ালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে আমার বুকে এসে তীরের ফলার মতো বিঁধে থাকে। কিছুটা সময় জাগতিক যোগ-বিয়োগের ভীড়ে আমি আনোয়ারকে ভুলে থাকতে চেষ্টা করলেও পরিবার, কাছের মানুষ, সমাজ, সেটা হতে দেবে না। তাঁরা আমার দহন পথে ডিম ভাজবে, মজা করে খাবে, ব্যাস, ওইটুকুই। আমার আহত হৃদয়ের কোনো খবর রাখবে না, এটাই সমাজের নিয়ম।

অনেক বছর ধরে খুব যত্ন করে আনোয়ারের রাঙিয়ে দেওয়া আমার জীবনটাকে কেমন করে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ছুঁড়ে ফেলি, ভুলে যাই, ফুরিয়ে যাই। স্নানঘরের মৃদু আলোয় অসহায়ের মতো নিজের দিকে তাকিয়ে আছি, চিনতে পারি না, অন্যরকম লাগে। মাথাটা ঈষৎ নুইয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি শরীরটাকে, চোখ বুঁজে অনুভব করি অন্তরালের মনটাকে, যে মনের বেদনা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। পরনের সাদা পোশাকটি বড়ো ভারি লাগছে, যেন মন এই পোশাকের ভার আর নিতে পারছে না। বুকে মোচড় দিয়ে উঠলে উবু হয়ে বসে পড়ি, নীরব আর্তনাদ শেষে একটানে বিসর্জন দিই পোশাকটিকে। শরীরের হাড়পাঁজর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সঙ্গে শরীর-মনের ভাষাও বদলে গেছে। পোশাকটি খুলে ফেলতেই যেন আমার প্রতিটি লোমকূপ ভেদ করে আনোয়ারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে, আমার নিশ্বাসের গতি বেড়ে যায়। সেই চেনা ঘ্রাণ নিমিষেই আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। যেন সমুদ্রের ঢেউয়ে উঠে আসা মুক্তোর মতন, যা কিনা পরের ঢেউতেই অসীম জলরাশির গভীরে হারিয়ে গেছে। নিজের শরীরে নিজেই হাত বুলিয়ে দিই আর ভাবি, আমার কী তবে বেলা পড়ে এসেছে? কোথাও ঝড় নেই, তবুও ঝড়ে ওল্টানো গাছের মতো চেয়ে থাকি শূন্যের দিকে। আশ্চর্য লাগে চারপাশ। অশ্রু আর ঝরছে না, চোখ জ্বলছে। জলের নিচে গিয়ে দাঁড়াই। জলের অভিসারে শরীর-মন কিছুটা শীতল হয়ে আসে। অনেকটা জোর করে শরীর থেকে সাদা পোশাকটি ঝেড়ে ফেলি রাতের জন্য। ভেবে দেখলাম সময় নিয়ে, এতে খুব একটা অসুবিধা হবে না, কারণ, পরিবার, সমাজ তো আর দেখবে না।

স্নান শেষে ফিরোজা রঙের তোয়ালেতে শরীর মুড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে বসি। বহু দিনের অভ্যাসবশত লম্বা সময় ধরে প্রসাধন নিই। ভেজা চুল, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপিস্টিক, বেশ লাগছে। নিজের সরল প্রশংসায় নিজেই আলতো হাসি। আজ থেকে একদিন আগেও এমন সাজগোজ শেষে আনোয়ার এসে পেছনে দাঁড়াত, দুই বাহুতে জড়িয়ে ধরত বুকে। ওর আদরে চড়ুইয়ের মতো আহ্লাদে আমি তিরতির কাঁপতাম। ও আর কোনো দিন এসে দাঁড়াবে না আমার পেছনে, ভাবতেই ধাক্কা খাই ভেতরে। এই কক্ষে কত স্মৃতি ওর সঙ্গে। বড়ো ঘর, বড়ো জানালা, জানালায় লাল রঙের পর্দা। আমার পছন্দ ছিল সবসময় হালকা রং, এতে ওর চলবে না। বিছানা চাদরসহ বাতির আলো পর্যন্ত সব ওর জন্য উজ্জ্বল রঙের হতে হবে। লাল ছিল ওর প্রিয় রং। ফুলশয্যার রাতেই বলেছিল, ধূসর রং ওর ভালো লাগে না। ও নেই কিন্তু ওর বইয়ের তাক, কম্পিউটার, কাগজপত্র, জামা-কাপড়, সর্বত্র উজ্জ্বল রং দোল খাচ্ছে। কিছু সময় চোখ বুঁজে বিছানার কোনায় বসে থাকি। বুকের গহিনে কী যেন নড়াচাড়া করছে, ইচ্ছে করছে শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরি। এই ঘরে কোনো দিন একা থাকিনি, একা ঘুমাইনি। মন চাইছে ওকে কবর থেকে তুলে নিয়ে আসি। তা-ই বা করব কীভাবে? ঘরের বাইরে তো কোনো দিন একা চলিনি ওকে ছাড়া। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই বাড়ির বাইরে রাস্তাঘাটও চিনি না। যখন যেখানে গিয়েছি ওর সঙ্গে গিয়েছি। একাকী আমার দৌড় বাড়ির ছাদ পর্যন্ত। জানালা কিংবা বাড়ির ছাদে গিয়ে আমি পৃথিবী দেখতাম। এখন আমার থেকে কয়েক হাত দূরে ও। কেমন আছে, কী করছে, কিছুই জানি না। অথচ, আমাকে ছাড়া ওর সময় কাটত না, কোনো কাজ সম্পন্ন হতো না।

লাল-নীল কাপড় দিয়ে আমার আদলে অনেক সময় নিয়ে আনোয়ার যত্ন করে বানিয়েছে এটি। পুতুলটি থেকে বিন্দুর মতো একটি আলোর কণা এসে পড়েছে আমার মুখে। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি ওটার দিকে। পুতুলের মধ্যে ওর আঁকা আমার মুখটি যেন হাসছে। ও নেই, পুতুলটা রয়ে গেছে।

বিছানা থেকে দেওয়ালের এক কোণে ঝুলানো পুতুলটির দিকে চোখ যায়। লাল-নীল কাপড় দিয়ে আমার আদলে অনেক সময় নিয়ে আনোয়ার যত্ন করে বানিয়েছে এটি। পুতুলটি থেকে বিন্দুর মতো একটি আলোর কণা এসে পড়েছে আমার মুখে। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকি ওটার দিকে। পুতুলের মধ্যে ওর আঁকা আমার মুখটি যেন হাসছে। ও নেই, পুতুলটা রয়ে গেছে। পুতুলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যরকম একটা ছায়া পড়ে মনের বনে। লাল-নীল ছায়ায় ভরে ওঠে আমার কক্ষ। পরিবার, সমাজের রীতিনীতি ভুলে আলমারিটা খুলে বসি। একগাদা জিনিস সরিয়ে বিয়ের দিন আনোয়ারের দেওয়া লাল বেনারসি শাড়িটি বের করি। শুনেছি মিরপুরের বেনারসি পল্লি থেকে ও এটা কিনেছিল আমার জন্য। বিয়ের পর বার দুয়েক ওর অনুরোধে শাড়িটি পরেছিলামও, পরে আর পরা হয়নি। এই কক্ষে আমি একা, আকাশের মতো একা। আমার স্বামীর দেওয়া শাড়ি যদি পরি, ও নিশ্চয়ই খুশি হবে আমার খুশি দেখে। এতে পরিবার, সমাজের নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি হবে না।

ভারি জড়োয়া গলার হার, কানের দুল, হাতের বালা, টিকলি, লাল টিপ, নেইল পলিশ, আলতা, শাড়ি সব অবিন্যস্তভাবে আয়নার সামনে রাখি।

‘এসো আমার ঘরে
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো অন্তরে’

বেলা শেষে এত সুর কোথা থেকে জড়ো হলো গলায়, কে জানে! অন্ধকারের শরীরে মগ্ন সুরে মোহন বাঁশি বাজছে। আধ ঘন্টার মধ্যেই আয়নায় ভেসে ওঠে একত্রিশ বছর আগের ফুটফুটে সেই মুখটি। ঝড় উঠলে যেমন ভালোবাসায় ডুব দেই, তেমনি ঝড় থামলেও। জীবনের যেকোনো অবস্থায় ভালোবাসার ছায়া ধরে হাঁটতে ভালোবাসি, এটি আমার অজন্ম স্বভাব। ভেতরের সমস্ত দুঃখ, বেদনা, হাহাকার টুকরো টুকরো করে ছেঁড়া কাগজের মতো শূন্যে উড়িয়ে দিয়ে ভালোবাসার ছায়া ধরে সিঁড়ি ডিঙিয়ে আমি ছাদের দিকে যেতে থাকি। ছাদে গিয়ে দেখি আনোয়ারের হাতে লাগানো ফুল গাছের পাশে ভ্রমর উড়ছে। এই রাতে কোথা থেকে কলিতে এসে বসল এত ভ্রমর, ওদের গুঞ্জনে ভোরের আগেই কলি ফুল হয়ে ফুটছে। আমি সযত্নে ফুলের গন্ধে ডুব দেই। প্রকৃতি আমার সব ইন্দ্রিয় আচ্ছন্ন করে ফেলে। হাওয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে, বিলি কেটে দেয় চুলে, আকাশ তখন খুব হাসছে। চাঁদের আলো, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে নিঝুম চরাচর। পরিবার এবং সমাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সীমানার বাইরে একটা তৃতীয় জগৎ নির্মাণ করে আমি যেন কোনো এক রূপকথার দেশে চলে এসেছি। আমি হাসছি, বুকের ভেতর না বলা কথাগুলো আগপিছ না ভেবে হড়হড় করে আসমান, জমিন, প্রকৃতিকে বলছি। ওদের সঙ্গে আমার গাঢ় বন্ধুত্ব হয়, ঠিক আনোয়ারের সঙ্গে যেমনটা হয়েছিল। ওরা আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো বানানো নিয়ম চাপিয়ে দেয় না। টের পাই, প্রকৃতির মধ্যে কোনো ট্যাবু নেই, শুধুই ইচ্ছেরঙে বয়ে চলা, ভালোবাসা আর ভালোলাগায়।

প্রকৃতি মায়ের কোলে আমার বাঁধনহারা আনন্দ দেখে আনোয়ার নিশ্চয়ই আকুল হাসছে। প্রকৃতি ব্লটিং পেপারের মতো আমার সকল বেদনা চুষে নেয়, নির্ভার লাগে। এমন মাধবী রাতে জগৎ-সংসার ভুলে আনোয়ারের দেহঘনিষ্ঠ হতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কিন্তু ও এখন অন্য ভূবনে, যেখানে আমার স্বর, ইচ্ছে কোনোটাই পৌঁছাবে না। আমার ইচ্ছে পূরণের জন্য ও কোনোভাবেই আসবে না। চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি, চাঁদের বুকে আশ্রয় নেই। চাঁদটাকে মনে হয় মোমবাতি, আমি গলে গলে পড়ি। চাঁদের আলো ক্রমশ ম্লান হতে শুরু হলে হুড়মুড়িয়ে চোখে জল আসে। আমার আনন্দময় সময়টা সমাপ্তির দিকে গড়িয়ে যায়। ঘুঘু ডেকে উঠে, আনোয়ারের প্রিয় ঘুঘু যেন ডেকে বলছে দ্রুত ফিরে যাও নিজের ঘরে। অন্ধকার গুটি গুটি পায়ে আলোর কাছে সমর্পিত হচ্ছে, আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। মানুষের কোলাহল ভেসে আসতেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে দৌড়াতে থাকি আপন কক্ষের দিকে। ঘরে ফিরে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখি লাইটটাও ফিউজ হয়ে গেছে। আলোহীন ঘরে দরজা বন্ধ করে আমার নিয়তি রঙের সাদা কাপড়টি শরীরে পেঁচিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। দেখি, বাগানবিলাসের ফাঁকে নিস্তেজ পড়ে আছে একটি বিষণ্ণ ধূসর জোনাকি, অথচ খানিক আগে ও ছিল অনিন্দ্য সুন্দরী।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৪ জুন, নোয়াখালি জেলায়। স্কুলে পড়ার সময় থেকে লেখালেখি করেন। সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ ছোটোবেলা থেকে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করেন। দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পত্রিকাসহ অনলাইন সাহিত্য পত্রিকায় লিখছেন। প্রকাশিত গ্রন্থ চারটি। ‘গভীর জলের কান্না’ (কবিতা, ২০১৬); ‘হৃৎকথন’ (স্মৃতিগদ্য, ২০১৯); ‘ধূসর নির্জনতা’ (ছোটোগল্প, ২০২১) এবং ‘হৃদয় এক অমীমাসিংত জলছবি’ (ছোটোগল্প, ২০২৩)। বর্তমানে 'সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক-র সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।