বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫

রূপনগর ফিল্ড রিপোর্ট : মশিউল আলম

0

বইমেলা থেকে বেরিয়ে হেঁটে শাহবাগ পর্যন্ত এসে বাসে উঠলাম। আমি বাংলামোটরে নেমে ইস্কাটনে নিজের বাসায় চলে এলাম, সাগর গেল অফিসে। আমাদের অফিস কারানবাজারে। একটা দৈনিক পত্রিকায় কাজ করি আমরা। আমি সম্পাদকীয় বিভাগে, সাগর অনলাইনের ভিডিও সেকশনে। আমার কাজ সন্ধ্যা ছটা-সাতটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়, ওকে অফিসে থাকতে হয় রাত ১১টা পর্যন্ত।

রাত সাড়ে এগারোটায় সাগরের ফোন: ‘জামিল, অফিস তো বলে দিল, কাল থেকে আমার আর আসার দরকার নাই।’

খুব অবাক হলাম না। গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি নন-জার্নালিস্টিক প্ল্যাটফরমের দাপটে নিউজ মিডিয়ার অ্যাড রেভিনিউ সাংঘাতিকভাবে কমে যাচ্ছে; ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য কর্মীছাঁটাই শুরু হয়েছে।

বললাম, ‘আমার আগেই তোমারে যাইতে হলো?’

ওপাশে হাসি শুনতে পেলাম। আমার বন্ধু-সহকর্মীদের মধ্যে সাগর সেনগুপ্তই সবচেয়ে ঠান্ডা প্রকৃতির। কোনো কিছুতেই বিচলিত হয় না; অন্তত আমি দেখতে পাই না। কারও প্রতি ওর ঘৃণা-বিদ্বেষ আছে বলেও কখনো মনে হয়নি। অফিস যে ওকে বিনা নোটিশে দুম করে ফায়ার করে দিল, এ জন্য অফিসের বিরুদ্ধে একটা কথাও উচ্চারণ করল না। ওকে কোনোদিন কোনো কারণেই রাগতে দেখিনি; কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে শুনিনি; ঝগড়া দূরে থাক, কারও সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি হয়েছে বলেও কখনো শুনিনি। যখন কোনো গুরুতর অন্যায়ের শিকার হয়েও ওকে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখি না, তখন আমার খুব অবাক লাগে। এ জন্য কখনো কখনো ওকে তিরস্কার করে বলি, ‘কী ধরনের লোক তুমি? একটুও চ্যাতভ্যাত নাই?’ ও তবুও কিছু বলে না। মৃদু মৃদু হাসে।

ওকে কোনোদিন কোনো কারণেই রাগতে দেখিনি; কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করতে শুনিনি; ঝগড়া দূরে থাক, কারও সঙ্গে ওর কথা কাটাকাটি হয়েছে বলেও কখনো শুনিনি। যখন কোনো গুরুতর অন্যায়ের শিকার হয়েও ওকে কোনো প্রতিবাদ করতে দেখি না, তখন আমার খুব অবাক লাগে। এ জন্য কখনো কখনো ওকে তিরস্কার করে বলি, ‘কী ধরনের লোক তুমি?

জগতে বুদ্ধির অভাবে গোবেচারা ভালোমানুষ অনেক আছে, কিন্তু সাগর সেই কাতারে পড়ে না। ওর সবজান্তার মতো মৃদু হাসি আমাকে সে কথাই বলে। খুব প্রখর বুদ্ধি ওর। ঝকঝকে দুই চোখে সেই দ্যুতি ঝলকায়। পড়েছে চারুকলা, করে সাংবাদিকতা, কিন্তু গণিত, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স, কগনিটিভ সায়েন্স, সেমিওটিক্স, হিস্টরি, ফিলোসফি, হেন কোনো বিষয় নাই যা নিয়ে টানা দুই ঘণ্টা কথা বলতে না পারে। ওর মতো ইংরেজি আমরা কেউ জানি না। নিজে নিজে জার্মান ভাষা শিখেছে, কেমন করে এটা সম্ভব হয়েছে কে জানে; জার্মান থেকে অনুবাদ করেছে কাফকা ও পিটার বিকসেলের গল্প। সারা পৃথিবীর সিরিয়াস লিটারেচার পড়া সারা। নিজেও চমৎকার লেখে। কিন্তু সেই ধরনের কিছু না, যা লিখে লোকে নোবেল পুরস্কার পায়। ও লেখে সায়েন্স ফিকশন, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, মিস্ট্রি, হরর, উইয়ার্ড ফিকশন, এইসব। এসব উইয়ার্ড ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে মেতে থাকে বলেই হয়তো ওর ভাবাবেগের প্রকাশ নাই।

 

২.
শুয়েছি রাত তিনটায়। ঘুম আসতে আসতে বোধহয় সাড়ে তিন বেজে গেছিল, বালিশের পাশে ফোন বেজে উঠলে কাঁচা ঘুমটা এমনভাবে ভেঙে গেল যে মুখে খিস্তি চলে এল। দেখলাম ভোর সাড়ে চারটা। আর ফোনটা করেছে বাল্যবন্ধু আবদুল গফুর। বিরক্তির সঙ্গে যোগ হলো বিস্ময়।

‘কী রে গফুর! এই ভোররাতে?’

‘দোস্ত, তুই তো ভোর পর্যন্ত ঘুমাস না…।’

এবার রাগ লাগল। আমি বেশি রাত করে ঘুমাতে যাই বলে কি ভোর সাড়ে চারটায়ও আমাকে ফোন করা চলে? ভাবলাম গফুরকে জোরে একটা ধমক দিয়ে লাইন কেটে দিই। কিন্তু খুব প্রিয় বাল্যবন্ধু। আমি ওকে যত ভালোবাসি, ও আমাকে তার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি ভালোবাসে। বললাম, ‘তুই এখন কোথায়?’

‘রূপনগর।’

‘ঘুমাস না ক্যান?’

‘শোন শোন, বিরক্ত হোস না…।’

‘মাথা ব্যথা করতেছে। সকালে ফোন দিব, এখন ঘুমা।’

‘থাম থাম। শোনেক আগে। আমি আর মেহেদি বাস থ্যাকে ন্যামে দেখি, রাস্তাত জনমানুষের চিহ্ন নাই। বাস কাউন্টারের লোকজন ব্যাবাকে ঘুমে ব্যাহুঁশ। পাঁচুর হুটালের সামনের বেঞ্চিত নাইট গার্ড ঘোঁ ঘাঁ করে ঘুমাচ্ছে। বেঞ্চির পায়ের কাছে একটা কুত্তাও ঘুমাচ্ছে। সিগারেট কিনবা যায়া দেখি, দোকানদার নাক ডাকিচ্ছে। রাস্তাত রিকশা নাই, ইজিবাইক নাই, কেচ্চু নাই। মেহেদি কলো, ফজরের টাইম তো হোছে, চ, নামাজটা মসজিদেই পড়ে যাই। মসজিদত যায়া দেখি, ছয়-সাতজন মুসল্লি এটে-উটে পড়ে আছে, ব্যাহুঁশ। মিম্বারের কাছে কুঁকড়ি ল্যাগে পড়ে আছে মুয়াজ্জিন। চেতন নাই। তে নামাজ পড়া আর হলো না, মসজিদ থ্যাকে বার হয়া আলাম। এখন বাসার দিকে যাচ্ছি, হ্যাঁটেই যাওয়া লাগিচ্ছে। মেহেদির বাড়ি তো অনেক দূর। কচ্ছে, দোস্ত, ভয় লাগিচ্ছে রে! একটু আগায়ে দে। কিন্তু আমি যদি অক বাসা পর্যন্ত আগায়া দিতে যাই, তালে ফিরার টাইমে একলা-একলি ফিরব ক্যাংকা করে, তুই ক?’

মসজিদত যায়া দেখি, ছয়-সাতজন মুসল্লি এটে-উটে পড়ে আছে, ব্যাহুঁশ। মিম্বারের কাছে কুঁকড়ি ল্যাগে পড়ে আছে মুয়াজ্জিন। চেতন নাই। তে নামাজ পড়া আর হলো না, মসজিদ থ্যাকে বার হয়া আলাম। এখন বাসার দিকে যাচ্ছি, হ্যাঁটেই যাওয়া লাগিচ্ছে।

আবদুল গফুর আর মেহেদি ইকবাল আমার ছেলেবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এখন রূপনগরের এক বেসরকারি কলেজে পড়ায়। গফুর প্রিন্সিপাল; মেহেদিকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা এসেছিল কলেজের দাপ্তরিক কাজে। আগের দিন সন্ধ্যায় একুশের বইমেলায় ওদের সঙ্গে অনেকক্ষণ কাটিয়েছি। ওরা আগেই জেনেছিল আমার নতুন বই বেরিয়েছে। শিক্ষাভবনের কাজ শেষ করে বিকেলে ফোন করে বলল, ‘বইমেলাত আয়, আমরা তোর বই কিনব, তুই অটোগ্রাফ দিবু।’ আমি গেলাম, বইমেলায় ওদের সঙ্গে ঘণ্টা দুয়েক কাটল, তারপর ওরা চলে গেল। রাত আটটায় ছিল ওদের রূপনগর ফেরার বাস।

ওদের বিদায় দেওয়ার পরেই আমার দেখা হয়েছিল সাগরের সঙ্গে।

 

৩.
সকাল সাড়ে ৯টায় ঘুম ভাঙলে গফুর আর মেহেদির কথা মনে পড়ল; কৌতূহল জাগল। গফুরকে ফোন করলাম, ওর ফোন বেজে চলল। কেটে দিয়ে ফোন করলাম মেহেদিকে, ওর ফোনও বেজে চলল। ভাবলাম, সারা রাত জার্নি করেছে, এখন ঘুমাচ্ছে।

অফিসে গিয়ে সম্পাদকীয় বিভাগের মিটিংয়ে বসে ওদের কথা ভুলে গেলাম। মিটিং শেষে সম্পাদকীয় লিখতে বসে আবার মনে পড়ল। আবার ফোন করলাম গফুরকে। ফোন বাজল, কিন্তু ও রিসিভ করল না। মেহেদিকে ফোন করে শুনতে পেলাম ‘সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’।

সম্পাদকীয় লেখা শেষ করে বেলা দেড়টায় আবার ফোন করলাম গফুরকে। এবার ওর ফোন বন্ধ। বন্ধ মেহেদির ফোনও।

রূপনগরে আমার জন্ম। ঢাকা থেকে আড়াইশ কিলোমিটার দূরে উত্তরবঙ্গের ওই মফস্বল শহরেই কেটেছে আমার শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের প্রথম দিনগুলো। স্কুল-কলেজের লেখাপড়া শেষ করেছি ওখানেই। এখন ওই শহরে আমার আম্মা-আব্বা ও বড়ো দুই ভাই সপরিবারে থাকে। প্রথমে আব্বাকে ফোন করলাম। ফোন বাজল, আব্বা ধরল না। ফোন করলাম বড়ো ভাইকে। ফোন বাজল না। ফোন করলাম মেজ ভাইকে, ফোন বাজল, কিন্তু সে রিসিভ করল না। বড়ো ভাবির নাম্বারে কল দিলাম, ফোন বন্ধ। মেজ ভাবির ফোনও বন্ধ।

মেজ ভাইয়ের ছেলে সৌমিক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ে। ওকে ফোন করলাম। ও ফোন কেটে দিল। একটু পরে ওর নাম্বার থেকে এসএমএস এলো, ‘চাচ্চু, আমি ক্লাসে। বের হয়ে কল দিচ্ছি।’

আমাদের পত্রিকার রূপনগর প্রতিনিধিকে ফোন করলাম। ফোন বেজে চলল, সে রিসিভ করল না। কয়েক মিনিট পর আবার। রিসিভ করল না। অফিসের টেলিফোন অপারেটরকে বললাম রূপনগর প্রতিনিধির নাম্বারে সংযোগ দিতে। একটু পর অপারেটর বলল, ‘রিং বাজতেছে, কিন্তু রিসিভ করতেছে না।’ বললাম, ‘আবার চেষ্টা করেন। সে কল রিসিভ না করা পর্যন্ত কল দিতেই থাকেন। খুব জরুরি।’

ন্যাশনাল ডেস্কের প্রধানকে ফোন করে বিস্তারিত জানিয়ে বললাম, রূপনগর প্রতিনিধিকে আমার খুব দরকার। কিছুক্ষণ পরে সে জানাল, ‘উনি ফোন ধরতেছে না।’

দৈনিক কালের কণ্ঠের এক্সকিউটিভ এডিটর আমার বন্ধু। তাকে ফোন করে বললাম, ‘দোস্ত, তোমাদের রূপনগর প্রতিনিধিকে আমার খুব দরকার। ওর ফোন নাম্বারটা পাঠাও।’ সে এসএমএস করে নাম্বারটা পাঠিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ওই নাম্বারে ফোন করলাম। ফোন বেজে চলল, ওপাশে কেউ রিসিভ করল না।

রূপনগরে আমার যত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের ফোন নাম্বার আমার ফোনবুকে আছে, একে একে সবাইকে ফোন করলাম। কারও ফোন বন্ধ, কেউ কল রিসিভ করল না।

এসির মধ্যেও আমার গরম লাগা শুরু হলো। পেচ্ছাপ করতে গিয়ে ওয়াশরুমের আয়নায় দেখলাম কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ডেস্কে ফিরে এলাম। এক কলিগ বলল, ‘আপনারে কেমন জানি লাগতেছে। ঠিক আছেন তো?’ বললাম ঠিক আছি। কলিগ আশ্বস্ত হতে পারল না। বলল, ‘ব্লাড প্রেশারটা চেক করেন।’

আমার বিভাগের কলিগরা জানে, আমি হাইপারটেশনের রোগী। বললাম, ‘না, ঠিক আছে।’

অন্য কলিগরাও বলল, আমাকে স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। শেষে বলতে বাধ্য হলাম, আব্বা, আম্মা, ভাই, ভাবি কেউ ফোন ধরছে না। রূপনগরের কাউকেই ফোনে পাচ্ছি না।

এক কলিগ ফোন করল ক্রাইম ডেস্কের প্রধানকে। সে ফোন করল রূপনগর থানার ওসিকে। ওসিকে না পেয়ে ফোন করল পুলিশ সুপারকে। তাকে না পেয়ে ফোন করল রূপনগরের ডিসিকে। সব নিস্ফল। কেউ কল রিসিভ করল না।

ময়মনসিংহ থেকে ভাতিজার ফোন এলো, ‘চাচ্চু, বলেন।’

‘আব্বু-আম্মুকে ফোন দাও।’

‘কেন? কী হইছে?’

‘বাড়ির কেউ আমার ফোন ধরছে না। তুমি দ্যাখো।’

মিনিট দশেক পর ভাতিজার ফিরতি কল, ‘আমার ফোনও তো কেউ ধরিচ্ছে না। কী হইছে, চাচ্চু?’

‘কিছুই বুঝতে পারছি না।’

রূপনগরের সবচেয়ে কাছের জেলা বগুড়া। আমাদের পত্রিকার বগুড়া প্রতিনিধি পারভেজকে ফোন করলাম। সে ফোন ধরে বলল, ‘জামিল ভাই, আমাক ভুলে গেলেন?’

‘পারভেজ, দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। বাড়িতে কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না। কেউ ফোন রিসিভ করছে না।’

‘ক্যান ভাই? কী হোছে?’

পারভেজ শুধু সহকর্মী নয়, আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। আমাদের রূপনগরের বাসায় ওর আসা-যাওয়া আছে। ওকে বিস্তারিত বললাম। ও সব শুনে বলল, ‘আমি অ্যাক্ষনি রূপনগর রওনা দিচ্ছি। আপনাদের বাসাত পৌঁছে আপনাক ফোন দিব।’

‘তাড়াতাড়ি যাও।’

রূপনগর থেকে ১২ মাইল দূরে আমার দাদার গ্রামে থাকে একমাত্র চাচা। তাকে ফোন করে বিস্তারিত বলে অনুরোধ করলাম, ‘তাড়াতাড়ি রূপনগর লোক পাঠান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খবর নিয়ে আমাকে জানান, প্লিজ!’

চাচা বলল, ‘এই চ্যাংরা, এত ব্যস্ত হচ্ছ ক্যা?’

মুরুব্বি না হলে চাচাকে মুখের উপরেই বলতাম, ‘আপনাদের মতো ক্যালাস লোকজন দুনিয়ায় আর নাই।’

চাচার ওপর ভরসা না পেয়ে বগুড়া প্রতিনিধি পারভেজের ফোনের অপেক্ষায় প্রহর গুনতে লাগলাম। বাসায় বউকে কিচ্ছু জানালাম না। একবার মনে হলো খুরশিদ মামাকে ফোন করে বিস্তারিত বলি। এই মামা কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম, আমার বউয়ের আপন মামা। তাঁর গ্রামের বাড়ি রূপনগর থেকে মাইল দশেক দূরে। রূপনগরের বড়ো বড়ো লোকজনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। কিন্তু তাঁকে ফোন করে সব বললে তিনি আমার বউকে ফোন করে সব বলে দিতে পারেন, এই ভয়ে তাঁকে ফোন করার ভাবনাটা বাদ দিলাম।

হঠাৎ মনে পড়ল রূপনগর সদরের এমপি সাহেবের কথা, তিনি সপরিবারে ঢাকায় থাকেন। তাঁকে ফোন করে সব বললাম। তিনি বললেন, ‘ভাই রে, আমিও তো সেই সকাল থেকে রূপনগরের কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারতেছি না। আমার আব্বার বয়স নব্বই। আম্মা মারা গেছে। আমার ব্লাডপ্রেশার, তার উপর ডাইবেটিস। টেনশন কন্ট্রোল করতে পারতেছি না। প্লেন ধরতে ইয়ারপোর্ট যাচ্ছি, সৈয়দপুর নেমে সেখান থেকে রূপনগর পৌঁছতে পৌঁছতে কতক্ষণ যে লাগে! দোয়া রাইখেন।’

দুপুরে খাওয়ার রুচি হলো না। গ্যাসে পেটটা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল। বগুড়া প্রতিনিধি পারভেজের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বিকাল পৌঁনে পাঁচটা বেজে গেল। অগত্যা আমিই আবার ওকে ফোন করলাম। ওর ফোন বাজল, কিন্তু ও রিসিভ করল না।

অসুস্থ বোধ হতে লাগল। কলিগদের বললাম, ‘বাসায় যাই।’

বিভাগীয় প্রধান সহৃদয় কণ্ঠে বলল, ‘ফোনটা খোলা রাইখেন।’

 

৪.
সুমনা দরজা খুলে আমার মুখ দেখে নিজের মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল, ‘কী হইছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

‘মনে হয় প্রেশার বাড়ছে,’ বলতে বাসায় ঢুকে সোজা বাথরুমে ঢুকতেই হড়হড় করে বমি চলে এল। বাথরুমের দরজার বাইরে থেকে ছুটে এল সুমনার উদ্বিগ্ন আর্তনাদ, ‘এই! কী হইছে? বমি করতেছ ক্যান?’

‘এমনি, পেটে গ্যাস জমছে।’

‘কেন? কী খাইছ দুপুরে?’

‘কিছু না। দাঁড়াও, আসতেছি।’

‘বমি হইতেছে ক্যান?’ দরজায় থাবড়ানি শুরু হলো, ‘ছিটকানি লাগাইছো ক্যান? ছিটকানি খোলো তাড়াতাড়ি!’

‘আরে বাবা, কিছু হই নাই তো! এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন?’

‘ছিটকানিটা খুলতে কী সমস্যা হচ্ছে তোমার?’

দমকে দমকে বমির ধাক্কায় আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। বাথরুমের দরজায় সুমনার থাবড়ানি রূপান্তরিত হলো ঘন ঘন ধাক্কায়।

বমি হয়ে যাওয়ার পর আরাম বোধ হলো। কুলিকুচি করে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সুমনার উৎকণ্ঠাভরা চোখে চোখ পড়ল।

দমকে দমকে বমির ধাক্কায় আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। বাথরুমের দরজায় সুমনার থাবড়ানি রূপান্তরিত হলো ঘন ঘন ধাক্কায়।

বমি হয়ে যাওয়ার পর আরাম বোধ হলো। কুলিকুচি করে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। সুমনার উৎকণ্ঠাভরা চোখে চোখ পড়ল।

‘কিছু না, পেটে গ্যাস জমছিল। বমি হয়ে যাওয়ায় ভালোই হলো।’

সুমনা অবাক চোখে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। আমি ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে বোতলের মুখেই মুখ লাগিয়ে কয়েক ঢোক পানি খেলাম। পেট ঠান্ডা হয়ে গেল।

পকেটে ফোন বেজে উঠল। ময়মনসিংহ থেকে ভাতিজা সৌমিক। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘চাচ্চু, আব্বু-আম্মু দুজনার ফোনই এখন বন্ধ! আমি এখন কী করব?’

‘অয়েট করো।’

‘আপনেও কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি?’

‘না। চেষ্টা করছি। তুমি ব্যস্ত হয়ো না।’

‘খুব টেনশন লাগিচ্ছে তো।’

‘অত টেনশনের কিছু নাই। অয়েট করো।’

ভাতিজার সঙ্গে কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুমনার জিজ্ঞাসা, কার সঙ্গে কথা বললাম, তার কিসের টেনশন, কিসের জন্য তাকে অয়েট করতে বললাম।

দেখলাম, এখন আর ওর কাছে লুকানো সম্ভব নয়। সংক্ষেপে সব বললাম। সুমনা আত্মীয়-স্বজনদের একের পর ফোন করা শুরু দিল।

আমি পোশাক বদলে বেডরুমে ঢুকে শুয়ে পড়লাম। সঙ্গে সঙ্গে আম্মাকে মনে পড়ল: শেষ কবে ফোনে কথা হয়েছে? আম্মার হাঁটুর ব্যাথার কী অবস্থা এখন? একা বাথরুমে যেতে পারছে তো?

 

৫.
সন্ধ্যা সাতটার দিকে সাগরের ফোন, ‘জামিল, তোমার রূপনগর নিয়া এইসব কী হইতেছে?’

‘তুমিও খবর পাইছ?’

‘সারা রাজধানী তোলপাড়। সবগুলা টিভি চ্যানেলে রূপনগর রূপনগর মাতম চলতেছে…’

‘ক্যামনে? তারা রূপনগরে কোনো রিপোর্টার পাঠাইতে পারছে?’

‘পাঠাইছে, সবাই রিপোর্টার-ফটোগ্রাফার-ভিডিওগ্রাফার পাঠাইছে। কিন্তু কেউ ফিরে আসেনি। পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে রূপনগরে হেলিকপ্টার পাঠানো হইছে, সেইটারও কোনো খবর নাই। প্রাইম মিনিস্টারের অফিস পর্যন্ত দিশাহারা হয়ে গেছে। গভমেন্ট তো পড়ে যাবে মনে হইতেছে!’

‘তাইলে তুমি খুশিই হবা মনে হয়?’

‘আমার কিছু যাবে আসবে না। শোনো, তোমার মেইলবক্সে একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠানো হইছে।’

‘কিসের ভিডিও?’

‘টিভি চ্যানেলগুলা তো রূপনগরের কিছু দেখাইতে পারতেছে না…।’

সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে ডেস্কটপ অন করলাম। মেইলবক্স খুলে সাগরের পাঠানো ভিডিও ফাইলটা ডাউনলোড করে দেখা শুরু করলাম।

কয়েকটা তরুণ এক তরুণীকে জবাই করছে।

বুকটা ধক করে উঠল। দম আটকে গিয়ে দুই চোখ বন্ধ হয়ে এল। কম্পিউটার শাট ডাউন করে হাঁপাতে লাগলাম। সুমনা ঘরে ঢুকে বলল, ‘কেউ ফোন ধরে না! কী হইতে পারে, বলো তো?’

‘জানি না।’

‘জানার চেষ্টাও তো করতেছ না।’

‘চেষ্টার কিছু বাকি নাই।’

ফোন বেজে উঠল। সুমনা ছুটে এসে বলল, ‘আমাকে দাও! আমাকে দাও!’

‘আরে এটা সাগর।’

ফোন রিসিভ করে সাগরের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘জামিল, ভিডিওটা দেখা হলো?’

‘তুমি এটা কী পাঠাইছো? কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এরকম দৃশ্য দেখা সম্ভব?’

‘ওই মিয়া, তুমি না সাংবাদিক? এরকম একটা সলিড এভিডেন্স হাতে পাইয়াও দেখবা না?’

‘ভিডিও ক্লিপটা তুমি পাইছ কই?’

‘বানাইনি। হানড্রেড পারসেন্ট অথেনটিক ডকুমেন্ট।’

‘বুঝলাম, রূপনগরে একটা মেয়ে খুন হইছে…’

‘সাদামাটা খুন না। একদম জবাই, সকাল এগারোটায় রূপনগর কলেজের গেটের সামনের রাস্তা থেকে ছেলেগুলা যখন মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যায়, তখন সেখানে অনেক লোক ছিল। সবাই চায়া চায়া দেখছে। কারও মুখ দিয়া টুঁ শব্দটাও বারায় নাই।’

‘পুলিশের লোকেরাই কিছু বলে না, পাবলিক কী করবে? পাবলিকের জানের মায়া নাই? ছেলেগুলা নিশ্চয়ই সরকারি দলের ক্যাডার।’

‘ছেলেগুলার চোখে মেয়েটার চরিত্র খারাপ। প্রেমের অভিনয় করে অনেক ছেলের জীবন নষ্ট করছে। ওরা মেয়েটাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তুলে নিয়ে গেছে। মেয়েটা ভাবছে ওরা ওকে গ্যাং রেপ করবে। সে ওদের বলে, রেপ করার দরকার নাই, তোমরা একজন একজন করে আসো।’

‘সাগর, এর মধ্যে রগড় শুরু করে দিলা?’

‘কিন্তু ছেলেগুলা মেয়েটাকে রেপ করেনি। তুমি ভিডিওটার কতদূর পর্যন্ত দেখলা?’

‘তিরিশ সেকেন্ডও না। এসব দৃশ্য দেখা সম্ভব না।’

‘ঠিক আছে, একটু পরে তোমার মেইলবক্সে একটা অডিও ক্লিপ যাবে। শুইনো।’

‘কিচ্ছু শুনতে ইচ্ছা করতেছে না। ভীষণ টায়ার্ড।’

সাগর লাইন কেটে দিল। আমি শুয়ে পড়লাম। একদম কাহিল। কিন্তু মনে স্বস্তি এলো না। আম্মা-আব্বার কোনো খবরই পাওয়া গেল না, এইভাবে সারা রাত কাটবে কীভাবে?

সুমনা কখন ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল খেয়াল করিনি, ফিরে এসে বলল, খুরশিদ মামা রাতের বাসে রূপনগর যাবে। আমি উঠে বসলাম। এতক্ষণ আমার নিজের মাথায় ভাবনাটা আসেনি কেন? কেন আমি এখনো রূপনগরের পথে রওনা হইনি? খুরশিদ মামাকে ফোন করে বললাম, ‘মামা, আপনার সঙ্গে আমিও যাব।’

‘তা তো যাবে মামা, কিন্তু কীভাবে যাবে! নো ট্রান্সপোর্ট। হানিফ পরিবহনে ফোন করেছিলাম। ওরা বলল, রূপনগরের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা থেকে যে কটা বাস রূপনগর গেছে, একটাও ফিরে আসেনি। তাই ওরা ওই রুটের বাস বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু হানিফ না, কোনো কোম্পানির বাসই রূপনগর যাচ্ছে না। রূপনগর টোটালি আউট অব কম্যুনিকেশন।’

‘বগুড়ায় কারও সাথে যোগাযোগ করেছিলেন?’

‘হ্যাঁ। এক বন্ধুকে অনুরোধ করেছিলাম। সে বগুড়া থেকে রূপনগর লোক পাঠিয়েছে। সেই লোক গেছে তো গেছেই, ফেরার আর নাম নাই। ফোনও রিসিভ করে না। আমি র‌্যাবের ডিজিকে রিকুয়েস্ট করেছিলাম রূপনগরে খোঁজ নিতে। তারাও যোগাযোগ করতে পারেনি।’

মামার সঙ্গে কথা শেষ হতে না হতেই আবার সাগরের নাম্বার থেকে কল এল। আমি রিসিভ করে শুনতে পেলাম সাগরের নয়, রোবটের মতো এক পুরুষকণ্ঠ:

‘তরুণীর কাটা গলা থেকে প্রথমে সূক্ষ্ম চিরচির শব্দে সুচিকন ধারায় তীরের গতিতে রক্ত ছুটে গিয়ে বিঁধল প্রায় দুই মিটার দূরের দেয়ালে; ধবধবে সাদা পটভূমিতে টকটকে লাল নকশা আঁকা শুরু হলো। তারপর পিচকারি দিয়ে রঙ খেলার মতো ছেলেগুলির চোখেমুখে ও শরীরে রক্ত ছিটিয়ে পড়ল; রক্ত ফেনায়িত হওয়ার ও সেই ফেনার গভীর থেকে বাতাস বেরিয়ে আসার ঘরঘর ধ্বনি উত্থিত হলো।

‘গলাকাটা তরুণীর দেহটা মেঝেতে কাটা মাছের মতো আছাড় খাচ্ছে। তরুণেরা তার এলোপাথারি আস্ফালনরত হাত-পাগুলি মেঝের সঙ্গে ঠেসে ধরল। তাদের হাতের ও হাঁটুর চাপের নিচে তরুণীর সর্বদেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে, মেরুদণ্ড চাড় খেয়ে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে।’

‘কী শুনতেছ এসব?’ চিৎকার করে উঠল সুমনা

আমি বললাম, ‘সাগর পাঠাইছে।’

‘তোমার এই হরর রাইটার বন্ধুটা আসলে সিক! আর তুমিই বা এই অবস্থার মধ্যে এসব শুনতে পারতেছ কীভাবে?’ সুমনা রেগে তিরিক্ষি হয়ে মেঝেতে গুঁড়ি মারতে মারতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আমার ফোনে রোবোটিক কণ্ঠটা বেজে চলেছে, ‘ঘরের মেঝে রক্তে ডুবে যাচ্ছে, ভেসে যাচ্ছে; রক্তের ধারা সাপের মতো আঁকাবাকা হয়ে এই ঘরের দরজা পার হয়ে ড্রয়িংঘরের দিকে ছুটে চলেছে, তবু রক্তক্ষরণ শেষ হচ্ছে না। তরুণীর কাটা গলার গর্তের ভিতরে রক্তের ফেনায় এখন এক অদ্ভুত শব্দ হচ্ছে। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নড়াচড়া পুরোপুরি থেমে যেতে যেতে যে সময় লাগল, ততক্ষণে ঘরের মেঝেটা রক্তে ডুবে গেল। এক তরুণ বলল, ‘এত রক্ত কীভাবে পরিষ্কার করা হোবে?’ আরেক তরুণ হ্যাচকা টানে বিছানার চাদর মেঝেতে ফেলে দিল। সূতি কাপড়ের চাদরটা মুহূর্তেই রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে উঠল, কিন্তু তার ফলে ঘরের মেঝের রক্ত একটুও কমল না। সেই তরুণ রক্তে ভেজা চাদরটা তুলে নিয়ে একটা বালতির উপরে ধরে চিপে চিপে রক্ত নিংড়াতে শুরু করল। তার দেখাদেখি অন্য তরুণেরাও যে যেখানে যে কাপড় পেল তাই নিয়ে একইভাবে রক্ত পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল। বালতিটা রক্তে ও রক্তের ফেনায় ভরে টইটুম্বুর হয়ে উঠলে এক তরুণ সেটা নিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢেলে ফেলে দিয়ে এল।

সূতি কাপড়ের চাদরটা মুহূর্তেই রক্তে ভিজে জবজবে হয়ে উঠল, কিন্তু তার ফলে ঘরের মেঝের রক্ত একটুও কমল না। সেই তরুণ রক্তে ভেজা চাদরটা তুলে নিয়ে একটা বালতির উপরে ধরে চিপে চিপে রক্ত নিংড়াতে শুরু করল। তার দেখাদেখি অন্য তরুণেরাও যে যেখানে যে কাপড় পেল তাই নিয়ে একইভাবে রক্ত পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল।

‘তারপর তারা তরুণীর লাশটাকে ধরাধরি করে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। কাটাকাটির সুবিধার জন্য তরুণীর পরনের সব কাপড় খুলে তাকে আপাদমস্তক উলঙ্গ করার হলো। প্রথমে ধড় থেকে মাথাটা বিচ্ছিন্ন করা হলো। খুব সহজেই; কারণ, তরুণীর গলা আগেই অর্ধেকের বেশি কাটা হয়ে গিয়েছিল।

‘তারপর ছেলেগুলি দক্ষ ও অভিজ্ঞ কসাইদের মতো তরুণীর দুই ডানায় ছুরি চালিয়ে হাতদুটি বিচ্ছিন্ন করে নিল এবং দুই পা বিচ্ছিন্ন করার জন্য বস্তিকোটরের হাড়ের সংযোগস্থল বরাবর ছুরি ও দা চালাতে লাগল। তারপর এক খণ্ড কাঠের উপরে রেখে মেয়েটির দেহের বড়ো বড়ো অস্থিসন্ধিগুলো কুড়াল দিয়ে কেটে কেটে আলাদা করা হলো। তারপর সবাই দ্রুত হাত চালিয়ে হাড়-মাংস আলাদা করতে লাগল এবং রান্নার উপযোগী করে ছোটো ছোটো টুকরায় মাংস কাটতে আরম্ভ করল।

‘রান্নাঘরে বড়ো পাত্র ছিল না। বাড়িওয়ালার ছেলেটা পাশের একটা ঘরে ঢুকল এবং কিছুক্ষণ পরেই বড়ো বড়ো দুটি পিতলের পিতলের ডেকচি নিয়ে ফিরে এল। সবাই পেট পুরে খেতে পারে এমন পরিমাণ মাংস ইতিমধ্যে কাটা হয়ে গেছে; কিন্তু ওরা থামল না, মেয়েটার দেহের পুরোটাই টুকরা টুকরা করে কাটতে থাকল। এক পর্যায়ে বিপদ দেখা দিল ঊরুর দুই হাড় নিয়ে; সেগুলো এমনই শক্ত ও কঠিন যে কুড়ালেও কাটার সাধ্য নাই। ওরা নিরুপায় ঊরুর হাড়দুটি থেকে চেঁছে চেঁছে মাংস তুলে নিল। তারপর ফটফটে সাদা দুই হাড় একপাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে দিল।

‘তরুণীর কাটা মুণ্ডু বিস্ফারিত চোখে ছাদের দিকে চেয়ে আছে।

‘মাথাভর্তি এক রাশ ঘন চুল রক্তে ভিজে চুপসে জটা ধরে মেঝেতে লুটাচ্ছে।

‘মাথাডা লিয়ে কী করা যায়?’

‘মগজের হেব্বি টেস্ট। মগজ ভাজি করা হোক।’

‘কুড়ালের আঘাতে মাথার খুলিটা ফাটানো হলো। খানিকটা মগজ এদিকে-ওদিকে ছিটকে গেল। একজন তা কুড়িয়ে জড়ো করে একটা ফ্রাইপ্যানে তুলে নিল।

‘বড়ো বড়ো দুই পিতলের ডেকচি মাংসে ভরানো হয়েছে। সয়াবিন তেল ঢেলে দেওয়া হলো। কুচি কুচি করে কাটা পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও কাঁচা মরিচ মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে ভালোভালো দলাইমলাই করা হলো। তারপর এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ ইত্যাদি গরম মশলা যোগ করা হলো। গ্যাসের সিলিন্ডারের সুইচ অন করে চুলার নব ঘুরিয়ে দেশলাই ঠুকে চুলা জ্বালানো হলো। কিছুক্ষণ পরে সুস্বাদু সুঘ্রাণে রান্নাঘরের বাতাস ভরে উঠল।

‘এই ফাঁকে তরুণেরা একে একে গোসল সেরে ফুরফুরে হয়ে এসে বসল। তাদের ক্ষুধা আরও চাগার দিয়ে উঠল।

‘একটা বড়ো পাতিলে ভাত বসানো হয়েছিল, এখন ভাত টগবগ করে ফুটছে এবং তার ফলে পাতিলের ঢাকনা ঠেলে বাষ্প উঠে আসছে।

‘রান্না শেষ হলে তরুণেরা মেঝেতে গোল হয়ে বসল এবং প্রথমে ভাতের পাতিল থেকে ভাপ-ওঠা গরম ভাত নিজ নিজ থালায় তুলে নিল। তারপর সুসিদ্ধ মাংস তুলে নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া আরম্ভ করে দিল। খেতে খেতে গল্প-গুজব চলল। গল্পের বিষয় বিচিত্র। একজন বলল, সে এক সের চালের ভাত এক বৈঠকে সাবাড় করতে পারে। আরেকজন বলল, এখন ভাত নয়, শুধু গোশত খাওয়া উচিত। কারণ, সামনের কুরবানির ঈদ আসতে এখনো অনেক দেরি আছে। একজন মন্তব্য করল, গোশতে ঝাল কম হয়েছে। আরেকজন মাথা দুলিয়ে তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করল। একজন বলল, রূপনগর টাউনে যত খারাপ চরিত্রের মেয়ে আছে, সবগুলাকে এইভাবে একে একে জবাই করে খাওয়ার একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা দরকার। অন্যরা মাথা ঝাঁকিয়ে হয় হয় বলে তাকে সমর্থন জানাল।

‘কিছুক্ষণের মধ্যে তারা এক ডেকচির সব মাংস শেষ করে অন্য ডেকচির দিকে হাত বাড়াল। একজন ভাতের পাতিল খালি হয়ে গেছে দেখে রাগে ফায়ার হয়ে গেল। অন্যরা বলল, এত মাংস থাকতে ভাতের আর কী দরকার।

‘তরুণেরা খেতে খেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তাদের জিভ, মাঢ়ি ও চোয়াল অসাড় ও আড়ষ্ঠ হয়ে এল। পেটে আর জায়গা নাই। তারা এক ঢোক দুই ঢোক করে পানি খেয়ে ঔ ঔ শব্দে ঢেঁকুর তুলতে আরম্ভ করল। তাদের শরীর ভারী হয়ে এল, তারা মেঝে থেকে উঠল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রত্যেকের চোখে ভারী হয়ে ঘুম নেমে এল; যে যেখানে বসে ছিল সেখানেই হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে ঢলে পড়ল এবং গভীর ঘুমে ডুবে গেল।’

রোবোটিক কণ্ঠটা থেমে গেল। এবার সাগরের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ‘জামিল, আছ?’

‘এইটা তুমি পাইলা কই?’

‘প্রশ্ন করো না। আমি যা বলি শোনো।’

‘আচ্ছা, বলো।’

‘ওই ছেলেগুলা ঘুমায়ে পড়ার পর থেকে রূপনগরের সব লোক ঘুমে ঢুলতে আরম্ভ করে। সন্ধ্যা হতে হতে শহরের সব লোক ঘুমে বেহুঁশ। এখন কেউ জেগে নাই। একজনও না। খুলনা টু পাবর্তীপুর ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ রূপনগরের উপর দিয়ে ট্রেন যাইতে হলে তো সেখান থেকে লাইন ক্লিয়ারের সিগন্যাল পাইতে হবে। কিন্তু রূপনগর স্টেশন থেকে কোনো সিগন্যাল আসতেছে না। স্টেশন মাস্টারের ফোনও বন্ধ। রূপনগর থেকে ঢাকায় কোনো বাস আসতেছে না। ঢাকা থেকে যে বাসগুলা রূপনগর গেছে, সেগুলা টাউনের ভিতরে ঢুকতে ঢুকতেই ড্রাইভার, হেলপার, প্যাসেঞ্জার সবাই ঘুমায়ে পড়ছে…।’

‘এইসব তুমি কেমনে জানলা?’

‘আমি এখন রূপনগরে।’

‘কী?’

‘বাট ডোন্ট শেয়ার দিস উইথ এনিবডি।’

‘কীভাবে গেলা রূপনগর?’

‘প্রশ্ন করবা না। আমি নিজে যা বলব শুধু শুনে যাবা। সেটুকুই তোমার লাভ।’

‘সত্যিই তুমি এখন রূপনগরে?’

‘আমি মিথ্যা কই না।’

সাগর মিথ্যা বলে না এতদিন আমার এমন ধারণাই ছিল। কিন্তু আজ ও এসব কী বলছে?

আমি ওর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে কাপড় পরতে শুরু করলাম। সুমনা অবাক হয়ে বলল, ‘কই যাও?’

‘সাগরের বাসায়।’

‘কেন হঠাৎ?’

‘জরুরি দরকার।’

‘ফিরবা কখন?’

সাগর কাঁঠালবাগানে থাকে। আমার বাসা থেকে হেঁটে যেতে লাগে মাত্র পনের মিনিট।

‘খুব তাড়াতাড়ি। যাব আর আসব।’

‘দেখো, পারভার্ট লোকটার সাথে আবার মদ খাইতে বইসো না।’

 

৬.
মিনিট পনের পরে সাগরের বাসার দরজায় কলিংবেল বাজালাম। একটু পর দরজার ওপাশে ওর বউ নিশির কণ্ঠ শুনতে পেলাম।

‘কে?’

‘আমি জামিল।’

দরজা খুলে গেল, নিশি হাসিমুখে বলল, ‘আসেন।’

আমি ঘরে ঢুকে বললাম, ‘সাগর কই?’

‘আপনি বসেন, ডেকে দিচ্ছি।’

আমি ওদের ড্রয়িংরুমের সোফায় বসলাম। নিশি সিলিংফ্যান চালিয়ে দিয়ে ভিতরের ঘরের দিকে হেঁটে গেল। একটু পরে সাগর এল।

‘কী মিয়া? তুমি না এখন রূপনগরে?’ আমি বললাম।

সাগর নিঃশব্দে হাসতে হাসতে আমার সামনের সোফায় মুখোমুখি বসল, কিছু বলল না। আমি বললাম, ‘তোমার অডিও ফিকশনটা এক্সট্রিম হয়ে গেছে।’

‘ওইটা ফিকশন না।’

‘তাইলে কী?’

‘একটা ফিল্ড রিপোর্টের অডিও ভার্শন।’

‘তাই নাকি? তুমি ওইটা রূপনগর থেকে পাঠাইছিলা?’

‘আমি এখনও রূপনগরেই আছি। ঘুমন্ত এক মফস্বল টাউনে একমাত্র জাগ্রত লোক। ভূতের মতন হাঁইটা বেড়াইতেছি।’

‘সাগর, এই অবস্থায় তুমি আমার সাথে এসব ইয়ার্কি কেমনে করতে পারতেছ? আম্মা-আব্বার কোনো খবরই পাইলাম না, আমার অবস্থাটা বুঝতে পারতেছ?’

‘তোমার কি বিশ্বাস হইতেছে না আমি এখন রূপনগরে?’

‘যাই গা।’ বিরক্তির সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম।

সঙ্গে সঙ্গে আমার প্যান্টের পকেটে ফোন বেজে উঠল। ফোনসেট বের করে দেখলাম, স্ক্রিনে ভাসছে সাগর সেনগুপ্তর নাম। কল রিসিভ করতেই ওপাশে বেজে উঠল সাগরের কণ্ঠস্বর, ‘রূপনগরের লোকজনরে ডিস্টার্ব কইরো না, জামিল। এরা ঘুমাইতেছে।’

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম বাংলাদেশের জয়পুরহাট জেলায়। সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর। পেশায় সাংবাদিক। গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ এবং কলাম সংকলন— সব মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩০ এর অধিক।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।