শুক্রবার, মার্চ ২৯

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের : চ্যালেঞ্জ (এক তরুণ লেখকের আত্মপ্রকাশ)

0

আমি কখনো কল্পনাও করি নাই হাইস্কুল শেষ করতে না করতেই আমার লেখা বোগোতা শহরের সে সময়কার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় পত্রিকা এল-এসপেকতাদর এর সাপ্তাহিক সাহিত্য পাতা ফিন-দে-সেমানায় এ প্রকাশিত হবে। বেয়াল্লিশ দিন পরে আমার দ্বিতীয় গল্পটা প্রকাশ পেয়েছিল। আরও বেশি অবাক হয়েছিলাম গল্পের শুরুতে সাহিত্য সম্পাদক এদুয়ার্দো সালামেয়া বর্দা’র (যিনি উলিসেস ছদ্মনামে লিখতেন) লেখা একটা ভূমিকা দেখে। কলম্বিয়াতে তখনকার সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন লেখালেখির নতুন ধরণ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সচেতন আর লিখতেনও খুব স্বচ্ছ আর প্রাঞ্জল ভাষায়।

শহরের মাঝখানে ক্যালে-ফ্লোরিয়ানের উপরেই একটা বোর্ডিং হাউসে থাকতাম। বেশির ভাগ বাসিন্দা আমার মতনই আটলান্টিক উপকূল ছেড়ে শহরে গিয়েছিল লেখাপড়ার জন্য। যে দুপুরগুলো ফাঁকা পেতাম, চাকরি করার বদলে বই পড়তাম।

এই ঘটনাগুলো এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে এখন মনে করতে গিয়ে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়ের ইচ্ছানুযায়ী ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ন্যাশলাল ইউনিভার্সিটি অব বোগোতায় ভর্তি হলাম আইন পড়তে। শহরের মাঝখানে ফ্লোরিয়ান সড়কের উপরেই একটা বোর্ডিং হাউসে থাকতাম। বেশিরভাগ বাসিন্দা আমার মতনই আটলান্টিক উপকূল ছেড়ে শহরে গিয়েছিল লেখাপড়ার জন্য। যে দুপুরগুলো ফাঁকা পেতাম, চাকরি করার বদলে বই পড়তাম। কখনো নিজের ঘরে বসেই, কখনো কোনো ক্যাফেতে। কী বই পড়ব তা নির্ভর করত দৈব এবং ভাগ্যের ওপর। যে বন্ধুদের বই কেনার সামর্থ্য ছিল তাদের কাছ থেকে খুব স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিয়ে পড়তাম। সারারাত জেগে পড়ে শেষ করতাম যাতে ঠিক সময়ে ফেরত দিতে পারি। তবে সিপাকিরা স্কুলে পড়ার সময় যে বইগুলো পড়েছি তার চাইতে এই নতুন বইগুলো একদমই অন্যরকম ছিল। সেগুলো ছিল পুরানো প্রতিষ্ঠিত, নামকরা লেখকদের লেখা জাদুঘরে যত্নে সংরক্ষিত নিদর্শনের মতন আর এই নতুন লেখাগুলো মনে হতো যেন সদ্য চুলা থেকে নামানো গরমাগরম রুটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রকাশনায় লম্বা বিরতির পর বুয়েনোস আইরেস থেকে নতুন অনুবাদে এই লেখাগুলো প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবেই সৌভাগ্যক্রমে আবিষ্কার করলাম (আমার জানতে পারার অনেক আগেই যাঁরা আবিষ্কৃত হয়েছিলেন) : হোর্হে লুই বোর্হেস, ডি এইচ লরেন্স, আলডোস হাক্সলি, গ্রাহাম গ্রিন, জি কে চেস্টারটন, উইলিয়াম আইরিশ, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড এবং তাঁদের মতন আরও অনেক লেখককে।

বেশির ভাগ সময় বিভিন্ন বইয়ের দোকানের জানালায় সাজানো থাকত বইগুলো, আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে ছাত্রদের ক্যাফেতেও কিছু কপি পাওয়া যেত। এই ক্যাফেগুলো বিভিন্ন প্রদেশ থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক বিস্তারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল । বহু ছাত্রেরা নিজেদের নামে বছরের পর বছর ধরে ক্যাফের এক একটা টেবিল রেখে দিত। সেখানেই তাদের নামে চিঠি কিংবা মানিঅর্ডার আসতো। ক্যাফেগুলোর মালিক এবং তাঁদের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের বদান্যতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু লোকের জীবিকা নির্মানে সহায় হয়েছে।

ক্যাফে এল-মালিনো ছিল আমার সবচাইতে প্রিয়, বোর্ডিং থেকে মাত্র দুশো মিটার দূরে। বয়স্ক কবিদের যাতায়াত ছিল সেখানে। ছাত্ররা সিট রিজার্ভ করতে পারত না তবে আমরা সবাই মিলে আশেপাশের টেবিলে গাদাগাদি করে বসতাম আর ওঁদের সাহিত্যিক আলাপে আড়ি পাততাম। যেকোনো পাঠ্য বই পড়ার চাইতে সেইসব আলাপ শুনে অনেক বেশি শিখেছি। ক্যাফেটা ছিল বিশাল, স্প্যানিশ কায়দায় সাড়ম্বর, দেয়ালের ডন কিহোতের ‘ব্যাটল অ্যাগেইন্সস্ট দ্যা উইন্ডমিলস’ সিরিজের ছবিগুলো এঁকেছিলেন সান্তিয়াগো মার্টিনেজ দেলগাদো। আমি ওয়েটারদের সাথে ব্যবস্থা করে লিয়ন দে গ্রেইফ এর যত কাছাকাছি সম্ভব বসতে চেষ্টা করতাম— দাঁড়িয়াল, অমার্জিত, মনোমুগ্ধকর একজন মানুষ ছিলেন তিনি। সন্ধ্যার দিকে সাহিত্য সম্পর্কে আলাপ শুরু করতেন সে সময়কার সবচেয়ে নামকরা লেখকদের সাথে আর আড্ডা শেষ করতেন রাত বারোটায় তার দাবার ছাত্রদের সাথে সস্তা মদে ভাসতে ভাসতে। দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখক অথবা শিল্পীদের মধ্যে খুব কম মানুষই রয়েছেন যাঁরা অন্তত একবার সেই টেবিলের আড্ডায় শরিক হন নাই। নিজেদের টেবিলে আমরা একদম মরা মানুষের মতন চুপ করে থাকতাম যাতে ওঁদের আলাপের একটা শব্দও না হারাই। তাঁরা নিজেদের শিল্প অথবা কাজ নিয়ে কমই কথা বলতেন। বেশির ভাগ আলাপই ছিল মেয়েদের নিয়ে নয়তো রাজনীতি সংক্রান্ত। তবে সবসময় ওঁরা কিছু না কিছু বলতেনই যা আমাদের কাছে নতুন মনে হতো।

আমার এক সহপাঠী ছিল জর্জ আলভারো এসপিনোসা, সে বাইবেল পড়তে শিখিয়েছিল আমাকে, তার জোরাজুরিতেই আইয়ুব নবীর সমস্ত সঙ্গীদের নাম মুখস্ত করেছি। একদিন সে আমার সামনে টেবিলের উপরে বিশাল মোটা এক বই রেখে, কণ্ঠস্বরে বিশপের কর্তৃত্ব এনে ঘোষণা দিল ‘এটা হচ্ছে আরেক বাইবেল’।

বইটা ছিল জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’। সে সময় এখান ওখান থেকে একটু আধটু পড়েছিলাম তবে সবটা পড়ার মতন ধৈর্য্য হয় নাই। কম বয়সের হঠকারিতা ছিল সেটা। অনেক বছর পরে, যখন নিরীহ সাবালক হয়ে উঠেছি, গুরুত্বের সাথে আবার পড়েছি বইটা। তার মাধ্যমে নিজের মধ্যে এক খাঁটি পৃথিবীর খোঁজ পেয়েছি, যা আমার কল্পনাতেও ছিল না।

আমরা একদম ছোটোবেলার বন্ধু, যখন সাক্রেতে থাকতাম তখন থেকেই। বুভুক্ষের মতন বই পড়তাম দুজনেই। একরাতে সে তিনটা বই কিনে ঘরে ফিরল। শোবার সময় একটা আমাকে দিল পড়তে। নির্দিষ্ট কোনো বই না, এমনিই কিছু একটা পড়তে পড়তে ঘুমানোর জন্য। অথচ সে বই পড়ে আমার তো ঘুম হারাম হয়ে গেল।

বোর্ডিং এ আমার এক রুমমেটের নাম ছিল দমিঙ্গো-মানুয়েল-ভেগা। সে ডাক্তারি পড়ত। আমরা একদম ছোটোবেলার বন্ধু, যখন সুক্রেতে থাকতাম তখন থেকেই। বুভুক্ষের মতন বই পড়তাম দুজনেই। একরাতে সে তিনটা বই কিনে ঘরে ফিরল। শোবার সময় একটা আমাকে দিল পড়তে। নির্দিষ্ট কোনো বই না, এমনিই কিছু একটা পড়তে পড়তে ঘুমানোর জন্য। অথচ সে বই পড়ে আমার তো ঘুম হারাম হয়ে গেল। আগের মতন শান্তিতে এরপরে আর কোনোদিন ঘুমাতে পারি নাই। বইটা ছিল ফ্রাৎস কাফকার ‘মেটামরফসিস’ : বুয়েনোস আইরেসের লোসাদা থেকে অনুবাদ প্রকাশিত। এর শুরুর লাইনটাই আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। এখন সে লাইন বিশ্ব-সাহিত্যের মহীয়ান উদাহরণ হিসাবে রয়েছে ‘এক সকালে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গ্রেগর সামসা দেখতে পেল সে তার বিছানার উপরেই এক প্রকাণ্ড পোকাতে রূপান্তরিত হয়েছে’।

এসব রহস্যময় বইয়ের বিপজ্জনক দিক শুধু যে আমার এতদিনকার ধ্যানধারনার চাইতে অন্যরকম ছিল তা-ই নয় বরং অনেকক্ষেত্রে একদম বিপরীতধর্মী ছিল। তাদের মাধ্যমে বুঝতে পারলাম সবসময় তথ্যের প্রদর্শন জরুরী নয়, বরং কোনো কিছুর সত্যি হয়ে ওঠার জন্য একজন লেখকের লিখে ফেলাটুকুই যথেষ্ট, শুধুমাত্র তার প্রতিভার শক্তি আর স্বরের দৃঢ়তা ছাড়া আর কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নাই। যেন আবার শেহেরজাদের সাথে দেখা হলো : তার আরব্য রজনীর পৃথিবী যেখানে সবই সম্ভব সেখানে না, বরং এক অসংশোধনীয় পৃথিবীতে যেখানে সবকিছু এরমধ্যেই হারিয়েছে।

‘মেটামরফোসিস’ পড়ার পরে সেই বিদেশি স্বর্গের অংশীদার হয়ে ওঠার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমাকে পেয়ে বসেছিল। পরদিন আমাকে দেখা গেল দমিঙ্গো মানুয়েল ভেগার কাছ থেকে ধার করা ছোট্ট সেই টাইপরাইটারের সামনে, কাফকার গল্পের মতন কিছু লিখতে চাইছিলাম। এর পরের কয়েকদিন ইউনিভার্সিটিতে গেলাম না এই আবিষ্টতা ভেঙে যাবার ভয়ে, আর ঈর্ষার ঘাম ঝরাতে ঝরাতে এভাবেই দিন কাটতে লাগল; যতদিন না এদুয়ার্দো সালামেয়া বর্দা তাঁর পত্রিকায় কলম্বিয়ার নতুন প্রজন্মের লেখকদের সম্পর্কে হতাশাভরা একটা লেখা লিখলেন। তিনি লিখেছিলেন নতুন লেখকদের মধ্যে মনে রাখার মতন কোনো নাম নেই এবং অদূর ভবিষ্যতেও এই অবস্থা বদলের কোনো আভাস দেখছেন না। আমি জানি না কোন অধিকারে তাঁর সেই লেখা আমাকে প্ররোচিত করেছিল আমার প্রজন্মের লেখকদের হয়ে চ্যলেঞ্জ গ্রহণ করতে। আমি আবার গল্পটা নিয়ে কাজ শুরু করলাম তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণের তাগিদে। গল্পটার বিস্তারে কাফকার ‘মেটামরফসিস’ এর অনুকরণে সচেতন লাশের কথা বললাম, তবে গল্প থেকে সব কৃত্রিম রহস্যময়তা অথবা সকল কুসংস্কার ছেঁটে ফেললাম।

তবু লেখাটা সম্পর্কে এতটাই অনিশ্চয়তায় ভুগছিলাম যে এল-মলিনোতে যাদের সাথে আড্ডা হতো তাদের কারো সাথেও এই নিয়ে আলাপ করি নাই। এমন কি আইন বিভাগে আমার সহপাঠী গনজালো-মায়ারিনোকেও দেখাই নাই গল্পটা। অথচ ক্লাসে একঘেয়ে লাগলে যে সব ছন্দে বাঁধা গদ্য লিখতাম তার একমাত্র পাঠক সে-ই ছিল। নিজের গল্পটা বার বার পড়ে, যতটা পারি ঘষেমেজে ঠিকঠাক করলাম। একটা ব্যক্তিগত চিঠি লিখলাম এদুয়ার্দো সালামেয়ার কাছে, তাঁকে আগে কোনোদিন দেখি নাই এবং সেই চিঠির একটা অক্ষরও এখন আর মনে নাই। সবকিছু একটা খামে ভরে নিজেই গেলাম এল-এসপেকতাদোরের অফিসে। আমাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তিনতলায় উঠে নিজ হাতে জালেমাঁর কাছে লেখাটা জমা দেওয়ার কিন্তু আমি তাঁর মুখোমুখি হবার ভয়ে খামটা রিসেপশনেই রেখে পালিয়ে বাঁচলাম।

এটা এক মঙ্গলবারের ঘটনা, জমা দেবার পর লেখাটার পরিণাম বিষয়ে তেমন চিন্তিত ছিলাম না। এটুকু নিশ্চিত জানতাম যে শেষ পর্যন্ত গল্পটা প্রকাশিত হলেও খুব সহসা হবে না। এর মাঝে দুই সপ্তাহ পার হলো। শনিবার দুপুরগুলোতে অস্থির হয়ে এক ক্যাফে থেকে আরেক ক্যাফেতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সেপ্টেম্বরের তেরো তারিখে, এল-মলিনোতে গিয়ে চমকে দেখি নতুন এল-এসপেকতাদোরের প্রস্থ জুড়ে আমার গল্পের শিরোনাম : ‘দ্যা থার্ড রেজিগনেশন’।

শনিবার দুপুরগুলোতে অস্থির হয়ে এক ক্যাফে থেকে আরেক ক্যাফেতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সেপ্টেম্বরের তেরো তারিখে, এল-মলিনোতে গিয়ে চমকে দেখি নতুন এল-এসপেকতাদোরের প্রস্থ জুড়ে আমার গল্পের শিরোনাম : ‘দ্যা থার্ড রেজিগনেশন’।

প্রথমেই মনের মধ্যে হাহাকার উঠল কারণ পত্রিকাটা কেনার জন্য পাঁচটা সেন্তাভোও আমার ছিল না। নিজের দারিদ্র্যের সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল সেটা, শুধু সেই খবরের কাগজ না, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর দামই তখন ছিল পাঁচ সেন্তাভো : যাতায়াত, এক কাপ কফি, পাবলিক ফোন, জুতা পালিশ। সেদিনের নির্বিকার বৃষ্টির ভেতর দৌড়ে রাস্তায় নামলাম কিন্তু আশেপাশের কোনো রেস্তোরাঁতেই এমন কাউকে খুঁজে পেলাম না যার কাছে পাঁচ সেন্তাভো পাওয়া যেতে পারে। সেই নিরিবিলি শনিবারে বোর্ডিং হাউসেও কেউ ছিল না শুধুমাত্র বাড়িওয়ালী ছাড়া, তবে তাঁর থাকা না থাকা সমান কেননা তাঁর কাছে আমার ভাড়া বাবদ দেনা ছিল পাঁচ সেন্তাভোর সাতশো বিশ গুন। আবার যখন যেকোনো সম্ভাবনার জন্য তৈরি হয়ে বাইরে বের হলাম, দেখলাম একজন ট্যাক্সি থেকে নামছেন হাতে ধরা এল-এসপেকতাদরের কপি, মনে হলো যেন দেবদূত। নির্দ্বিধায় পত্রিকাটা চেয়ে নিলাম তাঁর কাছ থেকে।

ছাপার অক্ষরে আমার প্রথম গল্প পড়লাম, সাথে হারনান মেরিনোর করা একটা চিত্রণও ছিল। পত্রিকার ছবিগুলো তিনিই আঁকতেন। এক নিঃশ্বাসে পড়লাম গল্পটা, নিজের ঘরে লুকিয়ে, হৃদপিণ্ডে দুম দুম শব্দ নিয়ে। প্রতিটি বাক্যের সাথে সাথে ছাপার হরফের বিপর্যয়ী ক্ষমতা টের পেলাম, কারণ একজন সার্বজনীন প্রতিভার অনুকরণে যে লেখাটা আমি গড়ে তুলেছিলাম ভালোবাসা আর মমতায়, বুঝতে পারলাম লেখাটা হয়েছে ধোঁয়াটে, দুর্বল এক সগতোক্তি, তার মধ্যে তিন চারটা ভালো লাইন ছিল সেটুকুই যা সান্ত্বনা। প্রায় বিশ বছর পর আরেকবার লেখাটা পড়তে সাহস করেছিলাম, তখনকার সমবেদনাহীন বিচারে আরও দুর্বল লেগেছে লেখাটা।

ঘরের ভেতর ক্রমাগতভাবে বন্ধুদের হামলা, হাতে পত্রিকা, প্রশংসায় উজ্জ্বল মুখ অসহনীয় হয়ে উঠছিল আমার কাছে। আমি নিশ্চিতভাবে জানতাম, তারা কেউ গল্পটা বুঝতে পারে নাই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের কারো কারো কাছে গল্পটা ভালো লেগেছে, কারো কাছে ধাঁধার মতন, কেউ চার লাইনের বেশি পড়ে নাই, কিন্তু যার সাহিত্যিক বিচার না মানা আমার পক্ষে বেশ কষ্টসাধ্য সেই গনজালো মালারিনোর কাছে গল্পটা ভালো লেগেছে।

সবচাইতে বেশি অস্বস্তি হয়েছে জর্জ আলভারো এসপিনোসার রায় শুনে। তার সমালোচনার ধার এমনকি আমাদের নিজস্ব বৃত্তের বাইরেও বেশ বিপজ্জনক ছিল। আমার অনুভূতি ছিল পরস্পরবিরোধী : আমি একই সাথে চাইছিলাম তার সাথে তক্ষুনি দেখা করে লেখা সম্পর্কে অনিশ্চয়তার অবসান ঘটাতে আবার তার মুখোমুখি হতে আতঙ্কিত বোধ করছিলাম। মঙ্গলবার পর্যন্ত সে গা ঢাকা দিল, যা তার মতন পরম পড়ুয়ার পক্ষে স্বাভাবিক। আবার এল-মলিনোতে ফিরে সে আমার সাথে গল্পটা নিয়ে না বরং কথা বলতে শুরু করল আমার স্পর্ধা প্রসঙ্গে।

‘নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ কী পরিমান সমস্যায় নিজেকে ফেলেছ’, সবুজ রাজ-গোখরোর মতন চোখের দৃষ্টি আমার চোখে ফেলতে ফেলতে সে বলল ‘এখন নামকরা লেখকদের সাথে তোমার নাম এসেছে, এবার এর যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য অনেক কিছু করতে হবে তোমাকে’।

‘নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পারছ কী পরিমান সমস্যায় নিজেকে ফেলেছ’, সবুজ রাজ-গোখরোর মতন চোখের দৃষ্টি আমার চোখে ফেলতে ফেলতে সে বলল ‘এখন নামকরা লেখকদের সাথে তোমার নাম এসেছে, এবার এর যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য অনেক কিছু করতে হবে তোমাকে’।

উলিসেস এর পরে তার মতামতই আমাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করত, তার কথা শুনে ভয়ে পাথর হয়ে গেলাম। সে কথা শেষ করার আগেই বললাম তখন এবং এখনো যা সত্যি মনে করি— ‘গল্পটা ফালতু হয়েছে’।

জবাবে সে খুব শান্তভাবে জানাল গল্পটায় শুধু একবার সে চোখ বুলিয়েছে তাই সে সম্পর্কে তখনই কোনো মন্তব্য করতে চায় না। তবে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে আমি যেভাবে বলছি গল্পটা সেরকমই খারাপ, তারপরও জীবন আমাকে যে সুবর্ণ সুযোগ করে দিচ্ছে সেটা বিসর্জন দেওয়া খুব অনুচিত হবে আমার পক্ষে। ‘আর তাছাড়া, ওই গল্পটা তো অতীত এখন মনোযোগের বিষয় হলো তোমার আগামী গল্পটা’।

তার কথায় এতটাই স্তম্ভিত হয়েছিলাম যে প্রথমে বোকার মতন প্রতিবাদ করতে গেলাম, পরে উপলব্ধি করেছি এ সম্পর্কে সমস্ত উপদেশের মধ্যে ওর কথাগুলোই সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত ছিল। তার অনড় অভিমত ছিল প্রথমে গল্পটা ভাবতে হয়, তারপরে ভাবতে হয় রচণাশৈলী সম্পর্কে। এরা আবার এক ধরণের নির্ভরশীলতায় পরস্পরের অধীন, এখানেই রয়েছে ক্লাসিক লেখাগুলোর জাদুর কাঠি। সে প্রায়ই আমাকে গ্রীক সাহিত্য পড়তে বলত, গভীর এবং নিরপেক্ষভাবে, শুধু হোমার না : একমাত্র হোমারটাই আমার পড়া ছিল স্কুলপাঠ্য ছিল বলে। আমি তাকে কথা দিলাম যে পড়ব, আরও কিছু নাম শুনতে চাইছিলাম তার কাছে কিন্তু ততক্ষণে সে বিষয় বদলে সপ্তাহান্তে পড়া অন্দ্রে জিদের লেখা ‘কাউন্টারফিটারস’ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। কখনো তাকে সাহস করে বলতে পারি নাই সেদিন আমাদের কথোপকথন হয়তো পরবর্তীতে আমার জীবনের রাস্তা নির্ধারণ করেছিল। সে রাতে জেগে জেগে নোট লিখলাম এর পরের গল্পটার জন্য, যা প্রথমটার মতন আঁকাবাঁকা পথে চলবে না।

প্রথম গল্পটা নিয়ে বন্ধুদের উচ্ছ্বাস হয়তো যতটা না গল্পের জন্য ছিল তারচেয়ে বেশি ছিল এত নাম করা পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পাতায় এরকম সাড়ম্বরে লেখাটা প্রকাশ পাওয়ায়। এদিকে আমি বুঝতে পারলাম যে-দুটি খুঁত আমার লেখায় ছিল তারচেয়ে বড়ো খুঁত থাকা সম্ভব না : প্রথমত জবরজং লেখার ধরণ আর দ্বিতীয়ত মানুষের মন বুঝতে না পারা। এই দুটি দোষই আমার প্রথম গল্পটায় প্রকটভাবে প্রকাশ পেয়েছে। লেখাটা ছিল বিভ্রান্ত, ধোঁয়াটে স্বগতোক্তির মতো, বানানো আবেগের কারণে যা আরও খারাপ হয়েছে।

দ্বিতীয় গল্পটার জন্য বাস্তব জীবনের স্মৃতি ঘাটতে ঘাটতে ছোটোবেলায় চেনা এক রূপসী মহিলার কথা মনে এলো। একবার তিনি তার সুন্দর দেখতে বিড়ালটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে আমায় বলেছিলেন মাঝে মাঝে তাঁর বিড়ালটার ভিতরে ঢুকে পরতে ইচ্ছা হয়। আমি জানতে চেয়েছিলাম কেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘কারণ বিড়ালটা আমার চেয়ে বেশি সুন্দর’। এই ঘটনা দিয়েই গল্প শুরু করলাম, একটা আকর্ষণীয় নামও পেলাম গল্পটার ‘ইভা ইজ ইনসাইড হার ক্যাট’। বাকি গল্পটা আগেরটার মতোই শূন্য থেকে বানিয়ে তোলা, সে কারণেই তার ধ্বংসের বীজ নিজেই সে বহন করছিল।

এ গল্পটাও ঘটা করে প্রকাশিত হলো ১৯৪৭ সালের এক শনিবারে, অক্টোবরের ২৫ তারিখে। এবারের গল্পটার জন্য ছবি আঁকলেন এনরিক গ্রাউ, ক্যারিবিয়ান আকাশে তিনি তখন উদীয়মান নক্ষত্র। আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে আমার বন্ধুরা নিয়ম মাফিক ঘটনা হিসাবেই গ্রহণ করল বিষয়টা আর আমাকে নামকরা লেখক হিসাবে স্বীকার করে নিল। অন্যদিকে আমি ব্যথিত হচ্ছিলাম নিজের ত্রুটিগুলো দেখে, সাফল্য নিয়েও সন্দিহান হচ্ছিলাম আবার একই সাথে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদীও হচ্ছিলাম। আরও চমকপ্রদ ব্যাপার ঘটল কয়েকদিন পর, যখন এদুয়ার্দো সালামেয়া, উলিসেস ছদ্মনামে ‘এল-এসপেকতাদর’-এ তাঁর দৈনিক কলামে একটা নোট লিখলেন। কোনো ভণিতা ছাড়াই তিনি লিখলেন ‘ফিন দে সামানার পাঠকরা হয়তো ইতিমধ্যেই একজন মৌলিক ও তেজস্বী লেখকের আবির্ভাব লক্ষ্য করেছেন। কল্পনায় যেকোনো কিছুই ঘটতে পারে। কিন্তু কল্পনার শামুকখোল থেকে সেই মুক্তা কোনোরকম অতিরঞ্জন ছাড়াই সহজ স্বাভাবিকভাবে বিকাশ করতে পারা সাধারণ কোনো ঘটনা না। বিশেষ করে লেখক যদি হয় মাত্র কুড়ি বছর বয়সী এক তরুণ যে সবেমাত্র লেখালেখির দুনিয়ায় পা ফেলেছে’। লেখার উপসংহারে নির্দ্বিধায় জানিয়েছিলেন ‘এক নবীন ও উল্লেখযোগ্য লেখক জন্ম নিলেন গার্সিয়া মার্কেজ এর মধ্যে’।

লেখাটা পড়ে খুশিতে ফেটে পড়লাম। না হয়ে উপায় ছিল না তবে কিছুটা উদ্বিগ্নও হলাম এই ভেবে যে জালেমাঁ তাঁর মন্তব্য থেকে বেরিয়ে আসার কোনো রাস্তা খোলা রাখেন নাই। এখন যা বলবার তিনি যেহেতু বলেই দিয়েছিলেন, তাঁর এই বদান্যতা আমাকে দায়বদ্ধতায় বেঁধে ফেলেছিল বাকি জীবনের জন্য।

প্রচুর ক্লাস ফাঁকি দেওয়া এবং লেখাপড়ায় অবহেলা স্বত্তেও প্রথম বছরটা উৎরে গেলাম ঠিক পরীক্ষার আগে আগে রাত জেগে পড়ে। আর যেসব প্রশ্নের উত্তর জানতাম না, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কৌশলে মনগড়া উত্তর লিখে। সত্যি বলতে আমি সে সময় খুব অস্বস্তিতে ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না আর কতদিন এই কানাগলিতে হাতড়ে ফিরতে হবে আমাকে। আইন আমি তেমন বুঝতাম না আর এই বিষয়টা সম্পর্কে আমার আগ্রহও কম ছিল অন্য যেকোনো বিষয়ের তুলনায়। মনে হচ্ছিল নিজের সিদ্ধান্তগুলো নিজেই নেওয়ার মতন যথেষ্ট সাবালক আমি হয়েছি। ছোটো করে বললে বলব, ষোলো মাস ধরে অলৌকিকভাবে টিকে থাকার পরে আমি শুধু পেয়েছিলাম ভালো কিছু বন্ধু সারাজীবনের জন্য।

আইনের প্রতি আমার কমতে থাকা আগ্রহ আরও কমে গেল উলিসেস এর লেখাটা প্রকাশিত হবার পর। ইউনিভার্সিটির বেশ কিছু ছাত্র আমাকে ‘মায়েস্ত্রো’ বলে ডাকা শুরু করল আর অন্যদের সাথে পরিচয় করানোর সময় জানাতো আমি একজন লেখক। এ সব কিছুই আমার মনে মনে করা সংকল্পের সাথে মিলে গেল। চাইছিলাম এমন একটা গল্প লিখতে যা একই সাথে বিশ্বাসযোগ্য এবং অবাস্তব। এরকম বেশ কিছু আদর্শ উদাহরণ ছিল। যেমন সফোক্লিস এর ‘ইডিপাস রেক্স’, যার মূল চরিত্র তার বাবার খুনের তদন্ত করতে করতে বুঝতে পারে সে নিজেই খুনি। উইলিয়াম জেকব্‌স এর লেখা ‘দ্যা মাঙ্কিস প’, একটা নিঁখুত গল্প যেখানে প্রতিটা ঘটনাই আকস্মিক। মোপাসাঁর ‘বোল-ডে-সিফ’ এরকম আরও কত পুরানো পাপী, আল্লাহ তাঁদের বেহেশত নসিব করুন।

চাইছিলাম এমন একটা গল্প লিখতে যা একই সাথে বিশ্বাসযোগ্য এবং অবাস্তব। এরকম বেশ কিছু আদর্শ উদাহরণ ছিল। যেমন সফোক্লিস এর ‘ইডিপাস রেক্স’, যার মূল চরিত্র তার বাবার খুনের তদন্ত করতে করতে বুঝতে পারে সে নিজেই খুনি।

এক রবিবারের রাতের ঘটনা রোমন্থনের দাবিদার। প্রায় সারাদিন ছিলাম গনজালো মালারিনোর সাথে তার অ্যাভেনিদা চিলের বাড়িতে, লিখতে না পারার হতাশা ব্যক্ত করে করেই দিনটা কেটেছে। রাতে যখন শেষ গাড়িতে বোর্ডিং ফিরছি, দেখি চাপিনারো স্টেশন থেকে রক্ত-মাংসের এক ফওন (ছাগলের শিং এবং লেজযুক্ত পৌরাণিক দেবতা) উঠে বসল গাড়িতে। না ভুল শোনেন নাই, ফওনের কথাই বলছি। দেখলাম মাঝরাতের যাত্রীদের কেউই তাকে দেখে তেমন অবাক হলো না; তাই ভাবলাম সে হয়তো রবিবারে বাচ্চাদের পার্কে এসেছিল কস্টিউম পরে কোনো খেলনা টেলনা বিক্রি করতে। কিন্তু তার শিং আর দাড়ি ছিল সত্যিকারের ছাগলের মতন বুনো, যখন আমাকে পেরিয়ে গেল তার গায়ের দুর্গন্ধ একদম ছুড়ির মতন এসে নাকে বিঁধেছে। তাই সে যে বাস্তবিকই একটা ফওন তাতে কোনো সন্দেহই থাকল না। পরিবারের কর্তার মতন অমায়িকভাবে সে ক্যালে ২৬ এর আগেই নেমে পার্কের গাছগুলোর মধ্যে মিলিয়ে গেল। কবরস্থানটাও এই রাস্তাতেই ছিল।

প্রায় সারারাত আমার নড়াচড়ায় ঘুমাতে না পেরে দমিঙ্গো মানুয়েল ভেগা জানতে চাইল কী হয়েছে। আমি আধোঘুমের ভেতর তাকে জানালাম ‘আজকে গাড়িতে একটা ফওন উঠেছিল’। সে সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় জানাল যে আমি যদি দুঃস্বপ্ন দেখে এরকম বলে থাকি তাহলে হয়তো রবিবারে খাওয়া দাওয়ার অনিয়মের কারণে হজমে সমস্যা হয়েছে, তবে এটা যদি আমার পরবর্তী গল্পের বিষয় হয়ে থাকে তাহলে ব্যাপারটা রীতিমতো চমকপ্রদ। পরদিন সকালে বুঝতে পারলাম না সত্যিই রাতে ফওনটা দেখেছিলাম নাকি রবিবার রাতের হ্যালুসিনেশন ছিল ঘটনাটা। নিজের কাছে স্বীকার করলাম হয়তো সারাদিনের ক্লান্তিতে গাড়িতে ঘুমিয়ে পরেছিলাম, তখন স্বপ্ন দেখেছি এতটাই স্পষ্ট যে সত্যি বলে মনে হয়। তবে ফওনের থাকা না থাকায় আসলে কিছু যায় আসে না। যা জরুরী ছিল তা হলো এই অভিজ্ঞতা একদম সত্যির মতনই আমার জীবনে ঘটেছে। সে কারণেই বাস্তবেই হোক আর স্বপ্নে, ব্যাপারটাকে সম্মোহন বলে ধরে নেওয়া ঠিক না; কার্যত এটা ছিল আমার জীবনের এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা।

পরের দিনই এক বসায় লিখে ফেললাম গল্পটা, বালিশের তলায় রেখে দিলাম, কয়েক রাত ধরে বার বার পড়লাম। সেই রাতে গাড়িতে ফেরার সময়ের অভিজ্ঞতারই লিখিত রূপ ছিল গল্পটা। এমন নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলা যেন পত্রিকার সামাজিক পাতায় অভিষেকের ঘোষণা। গল্পটা নিয়ে নিজের মনের সন্দেহ দূর করার জন্য পত্রিকায় ছাপার জন্য জমা দিলাম। তবে এবার দিলাম এল-তিয়েম্পো’র সাহিত্য পাতায়। হয়তো এভাবেই আমি এদুয়ার্দো সালামেয়ার ছাড়াও অন্যান্যদের মতামতও চাইছিলাম। বোর্ডিং এর এক বন্ধুর সাথে পাঠিয়েছিলাম গল্পটা। একটা চিঠিও লিখেছিলাম এল-তিয়েম্পো’র সাহিত্য পাতার নতুন আর কম বয়সী সম্পাদক ডন জেইমে পসাদার সমীপে। তবে আমার গল্প প্রকাশিত হয় নাই, চিঠিরও কোনো উত্তর আসে নাই।

এদিকে এল-এসপেকতেদরে লেখা ছাপা হওয়ার কারণে অভিনব আর মজাদার কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকলাম। প্রায়ই বন্ধুরা রাস্তায় আমাকে দেখলে টাকা ধার চাইত, ওরা বিশ্বাসই করতে চাইত না যে আমার মতন খ্যাতিমান নবীন লেখক তার গল্পের জন্য মোটা অংকের টাকা পায় না। অথচ মোটা অংক দূরের কথা গল্পগুলোর জন্য একটা সেন্তাভোও জোটে নাই, আশাও করি নাই সেরকম, তখনকার পত্রিকাগুলোয় এরকমই প্রথা ছিল।

লেখালেখি করে নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারব না জেনে আমার বাবাও নিরাশ হয়েছিলেন। তাঁর এগারো জন সন্তানের তিনজনই তখনো স্কুল পড়ুয়া। পরিবার থেকে মাসোহারা পেতাম ত্রিশ পেসো। বোর্ডিং এর ভাড়াতেই চলে যেত আঠারো পেসো, তাও নাস্তায় ডিম পেতাম না। ভাড়ার টাকায় প্রায়ই হাত দিতে হতো অন্যান্য প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সেসময় কেমন করে জানি না, তবে বেশ অসচেতনভাবেই পত্রিকার মার্জিনে, রেস্তোরাঁর ন্যাপকিনে অথবা ক্যাফের টেবিলে স্কেচ করা অভ্যাস হয়েছিল। একদিন এল-মলিনোতে পরিচিত একজন একটা প্রস্তাব দিল। সে সরকারি অফিসে প্রভাব খাটিয়ে ড্রাফটসম্যানের চাকরি বাগিয়েছিল, অথচ আঁকাআঁকি সম্পর্কে কোনো ধারণাই তার ছিল না। সে বলল আমি যদি তার হয়ে কাজগুলো করে দেই, তাহলে আমার সাথে অর্ধেক বেতন ভাগ করে নেবে। জীবনে আর কখনো আমি দুর্নীতির এত কাছে যাই নাই যেখান থেকে অনুতাপ হয়।

সে সময় আমার সংগীতপ্রীতি বাড়ছিল। শৈশবে শোনা ক্যারিবিয়ার গানগুলো বোগোতায় পৌঁছতে শুরু করেছিল। রেডিওর যে অনুষ্ঠানটা সবচেয়ে বেশি লোকে শুনত, তার নাম ছিল ‘কোস্টাল আওয়ার’। উপস্থাপক ছিলেন ডন পাস্কুয়াল ডেলভেশিও। রবিবার সকালে হতো এই অনুষ্ঠান আর এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আমরা ক্যারিবিয়ার ছাত্রেরা রেডিও স্টেশনে গিয়ে প্রায় বিকাল পর্যন্ত নাচতাম। সারা দেশে ক্যারিবিয়ার গানকে জনপ্রিয় করে তোলার মূলে ছিল ওই অনুষ্ঠানটা। এতে করে ক্যারিবিয়ার ছাত্রদের বোগোতায় সামাজিক বিস্তারও সহজ হয়েছিল।

শহরে আসা ক্যারিবিয়ার ছাত্ররা ভয়ে ভয়ে থাকত যে শহুরে মেয়েরা হয়তো জোর করে বিয়ে করতে চাইবে তাদের। কে জানে কেন এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে বোগোতার মেয়েরা ক্যারিবিয়ার ছেলেদের ফাঁদে ফেলে প্রথমে বিছানায় নিয়ে যায়, তারপর জোর করে বিয়ে করতে চায়।

শহরে আসা ক্যারিবিয়ার ছাত্ররা ভয়ে ভয়ে থাকত যে শহুরে মেয়েরা হয়তো জোর করে বিয়ে করতে চাইবে তাদের। কে জানে কেন এই বিশ্বাস জন্মেছিল যে বোগোতার মেয়েরা ক্যারিবিয়ার ছেলেদের ফাঁদে ফেলে প্রথমে বিছানায় নিয়ে যায়, তারপর জোর করে বিয়ে করতে চায়। মোটেই ভালোবাসার কারণে না বরং তারা চায় সমুদ্রের মুখোমুখি একটা জানালা।

এসব অবশ্য আমি কখনোই বিশ্বাস করতাম না। বরং উল্টোটাই সত্যি ছিল। আমার জীবনের সবচেয়ে অপ্রিয় স্মৃতিতে আছে বোগোতা শহরের প্রান্তের গণিকালয়গুলো। মাঝেমাঝে মাতাল হয়ে সেখানে আমরা যেতাম মনের দুঃখ ঢেলে আসতে। একবার তো মরে যেতে যেতে বেঁচে ফিরেছি। সেদিন যে মহিলার সাথে খানিকক্ষণ আগেই ঘরের ভিতরে ছিলাম সে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় করিডোরে এসে চ্যাঁচামেচি করতে করতে বলতে শুরু করল আমি নাকি তার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে বারো পেসো চুরি করেছি। সেই বাড়িরই দুই গুণ্ডা আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। খানিক আগের বিধ্বংসী আদর পর্বের পরবর্তীতে যে দুই পেসো আমার পকেটে বেঁচেছিল, তা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হলো না। আমার সমস্ত কাপড় খুলল তারা, জুতা সহ। শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে তল্লাশি চালাল চুরি করা টাকার জন্য। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে আমাকে খুন করবে না, তবে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করবে। এমন সময় সেই মহিলার মনে পরে গেল তার টাকা লুকানোর জায়গা সে আগের দিনই বদল করেছে এবং টাকাটা সেখানেই পাওয়া গেল।

তার কিছুদিন পরেই সিদ্ধান্ত নিলাম আইন পড়ে আর সময় নষ্ট করব না। তবে এ বিষয়ে বাবা-মায়ের মোকাবিলা করার সাহস হচ্ছিল না। তাঁরা আমার প্রথম বছরের পরীক্ষার ফলাফলে এত খুশি হয়েছিলেন যে আমার ভাই লুই এনরিকে্‌র সাথে একটা উপহার পাঠিয়েছিলেন। এনরিক বোগোতায় এসে ১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ভালো চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। উপহারটা ছিল একটা আধুনিক টাইপরাইটার। জীবনে প্রথম একটা টাইপরাইটারের মালিক হলাম অথচ সে রাতেই মেশিনটা আমরা বন্ধক দিয়ে দিলাম বারো পেসোর বিনিময়ে। সেই টাকায় বোর্ডিং এর বন্ধুরা সহ পার্টি দিলাম ভাইকে বরণ করে নেবার জন্য।

পরদিন প্রচণ্ড মাথা ধরা সমেত সেই বন্ধকি-দোকানে হাজির হয়ে নিশ্চিন্ত হলাম টাইপরাইটারটা তখনো সীলমারা অবস্থায় সেখানে দেখতে পেয়ে। যতদিন না তাকে ফেরত নিয়ে যাবার জন্য স্বর্গ থেকে আমাদের উপর যথেষ্ট পরিমাণ টাকা বর্ষিত হচ্ছে, ততদিনের বিমা করালাম যাতে অন্য কোথাও বিক্রি না হয়ে যায়। যদিও আমার বন্ধু সেই নকল ড্রাফটসম্যানের দেওয়া টাকায় টাইপমেশিনটা উদ্ধার করতে পারতাম, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলাম আর কিছুদিন পরেই ফেরত নেব। প্রতিবার আমি অথবা আমার ভাই বন্ধকি-দোকানটা পার হওয়ার পথে বাইরের থেকেই নিশ্চিত হয়ে নিতাম যে টাইপরাইটারটা এখনো রয়েছে অন্যান্য সব গার্হস্থ্য যন্ত্রপাতির সাথে একই তাকে, মূল্যবান কোনো রত্নের মতন সেলোফেনের প্যাকেটে মোড়ানো। মেশিনটা বন্ধক রাখার একমাস পরেও সেরাতে মাতলামির আতিশয্যে যে সমস্ত আশায় ভেসেছিলাম তার কিছুই পূরণ হলো না, তবু টাইপরাইটারটা যে তখনও সশরীরে নিরাপদে তার জায়গায় ছিল আর ত্রৈমাসিক সুদ যতদিন পর্যন্ত দিতে থাকব ততদিন থাকবে, এই নিশ্চয়তা আমাদের স্বস্তিতে রাখত।


Edith Grossman

Edith Grossman

এডিথ গ্রসম্যানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ২২ মার্চ। তিনি স্প্যানিস সাহিত্যকে মূল ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য সমাদৃত। সমকালীন ল্যাটিন আমেরিকা ও স্প্যানিশ সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অনু্বাদকও তিনি। তাঁর অনুবাদের তালিকায় রয়েছেন মারিও ভার্গাস লোসা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, মায়রা মন্তেরো, অগাস্তো মন্তেরোস্সোসহ আরও অনেক নোবেলজয়ী লেখক। এ লেখাটি ২০০৩ সালে ‘দ্যা নিউইয়র্কার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এডিথ গ্রসম্যানের করা ইংরাজি অনুবাদ থেকে অনূদিত।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

গল্পকার, ঔপন্যাসিক। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন। প্রকাশিত বইসমূহ: অনুবাদগ্রন্থ অরুন্ধতি রায় এর ‘দ্যা ব্রোকেন রিপাব্‌লিক’ (২০১৩), প্রকাশক শুদ্ধস্বর। উপন্যাস: ‘আনবাড়ি’ (শুদ্ধস্বর, ২০১৪), এবং প্রকাশের অপেক্ষায় আছে উপন্যাস ‘আর জনমে’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।