মঙ্গলবার, এপ্রিল ২৩

শহরে জোনাকির আলো : তাইমুর মাহমুদ শমীক

0

সুমিকে নিয়ে সুখেই আছি। জীবনটাকে সহজ ছকে বেঁধে ফেলার মতো সাজিয়ে নিয়েছি। লোকে আমায় পাগল বলে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেসরকারি দাসত্ব করা ছেড়ে দিয়েছি বলে পাশের বাসার ভাবির মতো কেউ কেউ কথা শোনাচ্ছে। সিক্স ডিজিট সেলারির মর্ম নাকি বুঝব কঠিন অভাবে পড়লে। দিনকাল ভালো না। নিকট ভবিষ্যতে হাত পাততে এলে ওরা আমার দিকে আঙুল তুলে প্রাণ খুলে হাসার প্রতীক্ষায় আছে।

আমি সব কথা নীরবে শুনি। আমার হাসির প্রশান্তি ওদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। নীরবে প্রস্থান করি। আরও একা হয়ে উঠি। সুমি একদিন বলে, বাসার বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছে। আমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলি, পারবে না হারিকেন জ্বালিয়ে কংক্রিটের শহরে ভালোবাসা খুঁজে পাবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে?

আমি ধীরে ধীরে অভাব বুঝতে শুরু করি। এসি ছেড়ে হুট করে তালপাতার পাখার বাতাসের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা কঠিন। অন্তরঙ্গ অবস্থায় সুমি পরের দিনের দুশ্চিন্তা করে। শীৎকার করুণ অনুভূতি হয়ে শব্দরূপ পাল্টায়। আমি দীর্ঘশ্বাসের নদীভাঙ্গন শুনি। বাড়িতে মাকে টাকা পাঠানোর পরিমাণ কমে আসে।

সুমির ছেঁড়া ব্লাউজ পাল্টানো হয় না। আমি ধীরে ধীরে অভাব বুঝতে শুরু করি। এসি ছেড়ে হুট করে তালপাতার পাখার বাতাসের সাথে মানিয়ে নেওয়াটা কঠিন। অন্তরঙ্গ অবস্থায় সুমি পরের দিনের দুশ্চিন্তা করে। শীৎকার করুণ অনুভূতি হয়ে শব্দরূপ পাল্টায়। আমি দীর্ঘশ্বাসের নদীভাঙ্গন শুনি। বাড়িতে মাকে টাকা পাঠানোর পরিমাণ কমে আসে। ফোনে মায়ের কথার ধরন বদলায়। বুঝতে পারি, সকল সম্পর্ক আজকাল অর্থের পুঁজিতে বেড়ে ওঠে।

আমি দূরালাপনী সেবা গ্রহণ করার অভিপ্রায় প্রকাশ করি মাঝে মাঝে মনটা হালকা করব বলে। বন্ধুরা আশঙ্কায় কল রিসিভ করে। এই বুঝি তাদের শরীরের বিশেষ কোনো অঙ্গ চেয়ে বসলাম! বাজারের ব্যাগে ইদানীং ছোটো মাছ, দুই একটা এলেবেলে সবজি, এক আধটা দেশি ফল থাকে। প্রতিবেশীরা মুখ টিপে হাসে। সুমি মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে আকারে ছোটো মৎসপ্রজাতির একটা বিহিত করতে বসে। আমি জড়িয়ে ধরি তাকে পেছন থেকে। পিঠখোলা ছেঁড়া ব্লাউজ সাবধানে খুলে রাখি। যুদ্ধযাত্রায় পা বাড়াবার কালে সৈনিকের কালো ঠোঁট আর মমতাময়ী প্রেমিকার উৎকণ্ঠায় শেষ চুমুর মতো মধ্যাহ্ন নীরবতা ভেঙে ভালোবাসা খুঁজি। এদিকে বিদ্যুৎ বিল দিয়েছি। তবু ঘর বেশিরভাগ সময় এই শহরের মানুষের মনের মতো অন্ধকার হয়ে থাকে।

সেলাই মেশিন চালিয়ে সুমি কিছু অর্থ উপার্জন করার চেষ্টা করে। আমি সঞ্চিত টাকাগুলো খরচ করে ফেলি নিজের টাকায় কবিতার বই প্রকাশ করতে গিয়ে। পরাজিত মানুষের মতো নীরবে বসে সেলাই মেশিন চালানোর একটানা শব্দ শুনি। লোডশেডিং হলে শব্দের তীব্রতা বাড়ে। আমি ঘামতে থাকি পরাজিত বিপ্লবীর মতো। ভুল বললাম। বিপ্লবীরা কখনো পরাজিত হয় না। হেরে যায় কিছু মানুষ। যারা দাসত্ব মেনে নিতে চায় না। যারা সহজ জীবনটাকে জটিল করে ফেলার চাতুর্য বোঝে।

একটা ইউকুলেলে কিনেছি ঘরের একটা পুরানো ফার্নিচার বন্ধক রেখে। সেটা বাজিয়ে মাঝে মাঝে ইদানীং শহরের রাস্তায় সুমিকে নিয়ে হাঁটি সন্ধ্যার পর। বেশ ভালোই বাজাই বোধহয় বাদ্যযন্ত্রটাকে। জীবন ধারণের আরোপিত যন্ত্রণা আমার ভেতরের সুরটাকে ঠিকঠাকভাবে বের করে আনছে। একটা নীল তোয়ালে বিছিয়ে ফুটপাতে বসে গান করলে সুমি খঞ্জনি বাজিয়ে একটা হাহাকারের মাধুর্য তৈরি করে।

আমি আমার একসময়কার দামী, এখন দম আসে দম যায় ফোনে গান ছাড়ি। নো উইম্যান, নো ক্রাই। কেঁদো না প্রিয়তমা নারী, তুমি কেঁদো না। একদিন সেলাই মেশিনটা নষ্ট হয়ে গেলে সুমি হাসিমুখে আমার পাশে এসে বসে। আমি দুঃসময়ের বন্ধুর মতো পরিচিত সেই গানটা আবারো ছাড়ি। একটা ইউকুলেলে কিনেছি ঘরের একটা পুরানো ফার্নিচার বন্ধক রেখে। সেটা বাজিয়ে মাঝে মাঝে ইদানীং শহরের রাস্তায় সুমিকে নিয়ে হাঁটি সন্ধ্যার পর। বেশ ভালোই বাজাই বোধহয় বাদ্যযন্ত্রটাকে। জীবন ধারণের আরোপিত যন্ত্রণা আমার ভেতরের সুরটাকে ঠিকঠাকভাবে বের করে আনছে। একটা নীল তোয়ালে বিছিয়ে ফুটপাতে বসে গান করলে সুমি খঞ্জনি বাজিয়ে একটা হাহাকারের মাধুর্য তৈরি করে।

খুচরো টাকাগুলো দিয়ে কাঁচাবাজার গুটানোর শেষ মুহূর্তে লাউ, ছোটো মাছ, হ্যান-ত্যান কিনে বাড়ি ফিরি। মাঝে মাঝে কংক্রিটের শহর ছেড়ে চলে যাই লতায়পাতায় পরিচিত কোনো গ্রামে। ফিরবার ভয়াল তাড়া থাকে না। স্বার্থপর কর্পোরেট বেনিয়াদের কাছে জবাবদিহিতা করবার স্নায়বিক যন্ত্রণা থাকে না। শহরে ফিরে নতুন ব্লাউজ কিনবার পর খুশিতে সুমির চোখে জল জমে। আমি সহজ জীবনের মাধুর্য্য দেখে আরেকবার চমকে উঠি। সেই চোখ-নাচানো পাশের বাসার ভাবির মতো অযাচিত উপদেশ দিয়ে বেড়ানো মানুষদের জীবনবোধের প্রতি একরাশ করুণা জন্মায়। বিষাক্ত শহরের পথেঘাটে ইদানীং একটা দৃশ্য প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। ফোর্থ ডাইমেনশনের সূত্র মেনে, সদ্য তিরিশের কোঠায় পা রাখা দুটো সুখী জোনাকি হাতে হাত রেখে মুক্তির সুর, আলো ছড়াতে ছড়াতে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

শমীকের বাবা একজন কবি। মূলত তার উৎসাহেই লেখালেখির ভুবনে আসা। প্রকাশিত বই দুটি। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সাদাকালো’। ২০২০ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় উপন্যাস ‘শ্যামাবউ’।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।