বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮

শিবলী মোকতাদিরের কবিতা : জাড্য জন্মদিনে

0

মাটির রাইফেল


বিবাহে—বারবার কেরোসিন ঢেলে
দেশলাই না জ্বালিয়ে পালিয়ে যাও তুমি
তাহলে বিশটি সোনার আংটি দিয়ে কী করব আমি?

প্রতিদিনই সূর্য অস্ত যায়
আঁধারে অর্ন্তবাস খুলে মনে মনে ভাবি—
এইবার লুট করব বন্দুকের দোকান।

আমার অন্তর্জ্বালা কেমনে কেমনে জানি টের পায় মা
বলে—মুসুরির ডাল, সীমিত সর্ষে আর
পাতাল ঘরে কিছু পাট রাখা আছে
চোরাপথে বেচে সুপথে মাটির রাইফেল কিনে দেবো তোকে।

উৎক্ষেপণের কাল ঘনীভূত হয়, খুশিতে—
মানুষের ভিড় থেকে ছিটকে পড়ি বাতেন ডাকাতের দলে
শিস দেই, হরদম হাওয়া-টাওয়া খাই
সহমরণের কথা ভুলে বাবলা গাছের আড়ালে
সারাক্ষণ তাক করে থাকি
মায়ের কিনে দেওয়া মাটির রাইফেল।

কখন আসবে পালকি!
নৈরাজ্য আর বিপদ নিয়ে আয়নায় দেখা দেবে
তোমার ফ্যাকাশে আর পারদ বিট্রে না করলে,
আমার ডোরাকাটা মুখ।


জাত-পাত-বর্ণ নির্বিশেষে


জাতের প্রশ্ন চাপাও তুমি ক্ষেত্রে খেলার ছলে
ধর্মে-কর্মে-ফলে
শ্রেণির মধ্যে শোষণ ছাড়ো পদাধিকারবলে।

দূষণে হয় সুদৃঢ় সব বাক্যে বিস্তারিত
গোষ্ঠী-গোত্র প্রীত
আদির অন্তে সমস্ত ভুল কেন্দ্রে সঞ্চালিত।

সাম্যজ্ঞানে সুফি তুমি হিন্দু মুসলমান
সাধক-অন্ত প্রাণ
গানেই মারো চিন্তা-চেতন সুর-বাণীতে টান।

তুষ্ট করো উদ্ধৃতিকার ধীবর, চর্মকার
চণ্ডালীনি তার
মাধুকরীর রূপ সে গলে কাপালিকের হাড়।

এই আমাদের পাল-চন্দ্র, দেব-সেন-বর্মণ
উদ্ভাসিত মন
জীবন হাতে যুদ্ধ করা সহিষ্ণু কোন জন।

শূদ্র আমি অন্ত্যজে হই শঙ্করে সঙ্করা
বর্ণাশ্রমে যারা
উচ্চ থাকে ভোগের ভিড়ে, নিম্নে বসুন্ধরা।


জ্যামিতিকথন


যুগের যাতাকলে পড়ে আছে
ঝুঁকিতে থাকা পরিত্যক্ত পাঠশালা।

কেউ আসে না। দীর্ঘদিনের নষ্টামীতে পাঠবাড়ি হয়ে উঠেছে
দিনকেদিন আতঙ্কের শিরোমণি

আজ, অকস্মাৎ ভূকম্পনে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকারে
ঘুম ভেঙে গেল গণিতের ইনসাইক্লোপিডিয়া মোফাজ্জল আকন্দের।
বহুদিন অবসরে। হাতে—অম্লমধুর লাঠি।

বিষণ্ন অন্ধকারে রিক্ত দুই হাত দিয়ে বাতাস কেটে কেটে
তিনি এসে দাঁড়ালেন পাঠশালার দুয়ারে।
দেখলেন, দুই কান ধরে নিল-ডাউন হয়ে আছে
তেত্রিশ বছর আগে শাস্তি পাওয়া দশম শ্রেণির শেফালি শবনম।
বিড়বিড় করে একটানা বলে যাচ্ছে
সমবাহু ত্রিভুজের জ্যামিতিকথন

দুই বাহু বর্তমান। সিক্সটি ডিগ্রির খাতিরে,
সমাধানে সত্যতা দিতে স্বয়ং মোফাজ্জল আকন্দকে আরেক বাহু হয়ে
মিশে যেতে হবে সুবহ সাদেকের আগেই।

সমষ্টির সাতকাহন জানবে না কেউ। না পুলিশ, না পরবাসী
একশ আশি ডিগ্রির চ্যালেঞ্জ, দুঃখ করো না চোখ!
সেতুযুক্ত হও, আত্মরতির প্রলেপে বাঁধো মন।


গমন


চূড়ায় নেমেছে চাঁদ, মাহেন্দ্র বনের আশেপাশে
আর তুমি প্রত্নবিদ—
রক্ষিত ধানের ব্যাকুল বাতাসে ভেসে এলে

যদি আসে গণিত শিক্ষিকা
নিবেদিত অন্ধকারে, সভ্যতার তৈজসপত্র ভেঙে যায়।

ভাসে যদি বেনজিন সংকেত
ধরো—নিমগ্ন গ্রামের পথে;
গার্হস্থ্যবিজ্ঞান ফেলে ছাত্রী চলে যায়।


যামিনী রায়


বরফের বাক্স ভেঙে বের করে আনো বাতাসে বাঁশির সুর
তাতে সাধনা লাগাও—সাধ্যের অতীত
পথিকশূন্য পথ হবে ক্লান্তিটানা
অখণ্ড সন্ধ্যা আর জোনাকির গন্ধে মাখামাখি
তাকে মান্য করে সকল অভিকর্ষ ছিঁড়ে
ছুটে আসো দুই কানে রক্তজবা গুঁজে

বিগত হাসিগুলো মিশিয়ে দাও আগত অশ্রম্নহাওয়ায়
আমি ঘাসের গভীরতা ভেদ করে
বেগুনি বাষ্পের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকব
যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিত্যক্ত বিমানের পাশে

অবুঝ যতিচিহ্নের মতো হুটহাট বসে না পড়ে
আলোচ্য পৃষ্ঠায় এসে থামো
আমাকে ভাবো খানিকটা সৎভাইয়ের সাকার দিয়ে

ফুলের বিস্ফোরণে পাপড়ির পতন হবে, তবুও বলি—
পটে-আঁকা আঙুরগুচ্ছ যতই লোভনীয় হোক
পাখপাখালি যতই ঠুকরে যাক
পিতৃঋণের মতো এটুকু বিশ্বাস রাখতে হবে
সে আঙুরফলে রস পাবে না কখনও!


কৃতী


আবার মরীচিকা ফিরে এলে নাকি রাত্রি পথপাড়ে
দেয়ালে বর্ণবাতি জ্বালো—তারপর দু’হাতে তুলে
চলো, নিয়ে যাই খালি দেহ সৌরভ আর ফুলে
শুয়ে দিই শান্ত, এইভাবে বুকে নিয়েছিলে যারে।

যেখানে শাদা মাঠজুড়ে শীতের তারা উড়ে যায়
খুরের আঘাতে ধূলিকণা। আমার সমস্ত পোশাক
উড়ে গিয়েছিল নীল মেঘে। আর বালুচর থেকে লাখ লাখ
কচ্ছপ উঠে এসে তাদেরই সাথে আমাকে জড়ায়।

তবুও পৃথক আমি—রজনীর পাশে হামাগুড়ি দিয়ে এসে
দাঁড়িয়েছি নগ্ন, সহযোগী বাতাসের বর্শাকে বিঁধে
করেছি লোমশ ছাল পরিধান, মাংসটুকু রেঁধে
খেয়েছি দু’জন—আমি আর মৃতরাত আধাআধি হেসে।

ঘুমিয়েছি বেশ, তখনই শীতের রাত্রি আমাকে তুলে
চালিত করেছে নীলখেতে, উঁচু-নিচু চুন আর পারদের পাশে
সেখানে বিচিত্র নৌকো, ধুলোঝড়, মেঘে মন্ত্র ভাসে
যায় ধাতুকণা দিয়ে হাতে—পালিয়ে রাত্রি উপকূলে।

সে দেশে তীব্র বেগ। ঝাঁজাল নির্গত গ্যাস, হয়তো-বা
আরও কঠিন ফুটন্ত জলাশয়ে বহুকাল শুয়েছিল তারা
রম্নপালি আগুন গায়ে জ্বেলে দেখি লাল চাঁদে যারা
বসেছিল আমাকে কেন্দ্র করে অনন্তকাল কৃতী বিধবা।


যুগে যুগে পাট ও পাটের রচনা এভাবেই ইফেক্ট করে


কৈশোর টপকে যাওয়া দুর্যোগময় সেই বয়সে দেখেছিলাম—সামান্য মুদ্রামোহে নিপতিত কোনো এক সরল যুবতীকে, গ্রামের জনৈক বিদঘুটে ফরিয়া মাস্তান কীভাবে অঙ্গ ও আগুনের লোভে, মুহূর্তে বশ করে শুইয়ে দিয়েছিল বাংলার নির্বাচিত পাটখেতে।

বালকের ব্রেনে, আদি অলংকারে ফুটিয়ে ওঠা, সেদিনের সেই দৃশ্য—বেশ পরিচিত দূরত্ব থেকে দেখা, অমীমাংসিত সেই ইনিংস—যেন রহস্যের জট খুলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসা একগুচ্ছ ভৌতিক আর ভয়ানক মানব-মানবী।

এর বহুবছর পর, শহুরে-শিক্ষিত আর সাবালক হয়ে গেছি। তবু ইতিহাসের পাতায় লেপ্টে থাকা সেদিনের যৌন ও জীবনের লজ্জিত সেই ছবির যাতনায়—মাঝে, যতবার পরীক্ষা ও পত্রে পাটের রচনা পেয়েছি ততবার সবিনয়ে পাশ কেটে গেছি আমি।

এভাবে আরও বহুবছর পর আজ দেখছি—নিশ্চিত কমনের আশায় ছেলেকে তার মা, সেই পাটের রচনাটিই পড়তে বলছে বারবার। দেখলাম অদ্ভুত এক অনিহার মাঝেও কিছুটা বাধ্য হয়ে, ছেলে তরতর করে এক সময় পুরো রচনাটিই প্রায় না দেখে মুখস্থ বলে দিলো তার মা-কে। বিনিময়ে মা-ও প্রসন্ন এক মৌলিক হাসি উপহার দিলো ছেলেকে।

ঘটনার পরবর্তী দিবসে, যথারীতি পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরে ছেলে আমার—দেখি, রাজ্যের যাবতীয় গূগোলময় তথা গম্ভীর মুখে বসে আছে, ঘরের চারিদিকে থমকে থাকা বিবিধ অন্ধকারের আড়ালে। আর পাশে, প্রশ্ন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অতি উৎসাহী মা তার ছেলেকে বলছে,‘কী রে! সবই তো কমন পেয়েছিস আর পাটের রচনা, জুট তো অবশ্যই লিখেছিস?’

দেখলাম শীতের এই পড়ন্ত বেলায়, হঠাৎ একথা শুনেই; ঘামতে ঘামতে ছেলের সমস্ত মুখ কেমন লাবণ্যহীন আর রক্তাক্ত হয়ে গেল নিমিষেই। যেন পুনর্মুদ্রণে ভর করে, ফের বহুদিন পর ফিরে আসা ইতিহাসের অভিনব আর অবাঞ্ছিত সেই লজ্জার ছায়াছবি। আজ ফের তুমুল আগ্রহে অবলোকন করছে—সমবাহু ত্রিভুজের মতো তিনটি বিন্দু হয়ে ফুটে থাকা এ-ঘরের নির্বাক তিনটি প্রাণী।

পরিশেষে কিছুক্ষণ পর কিছুটা অচেনা অন্যের মতো অসম্ভব নত হয়ে, যেন গুপ্ত গানের গোপনীয় সুরে, ফিসফিস্ করে—উত্তরে ছেলের বিন্দুটি আহত উচ্চারণে বলে ওঠে— ‘প্লিজ! মুখস্থ ছিল না মা-মণি!’


ক্যামেলিয়া


লুকিয়ে জঙ্গলে প্রেম করতে গিয়ে,
বিশেষ পর্যায়ে, যদি কোনো ব্যক্তিগত প্রভাষক
অনর্থক অচেনা কণ্ঠে শুধায় :
হু আর ইউ?

আমি কিন্তু বলতেই পারি, আচানক; আরে অধ্যাপক!
না, মানে, আমরা তো মানুষ। রবীন্দ্রনাথ পড়তাছি।
আমরা তো আসলে বিয়েই করিনি।
কী বলো, ক্যামেলিয়া?

অথচ কেউ নেই ওপাশে তখন।
হাজারো শূন্যতায় শুধু এক কোকিল জেগে আছে।


চাঁদমামা


রক্তকরবী গাছের নিচে চট পেড়ে বসেছি,
ব্রহ্মাণ্ডের সস্তা কিছু সামগ্রী শিশুদের উপহার দেবো বলে।

শুনে, পরিক্রমায় কাহিনির ভিতর কাহিনি ঢুকে
নগর-গ্রাম উজার করে ভিড় ভেঙে ছুটে আসছে
দলে দলে রঙবেরঙের শিশুসহ শিশুকাল।

সেই ভোর থেকে বিলিয়ে যাচ্ছি
মুখে কুলুপ এঁটে একটানা নিরবধি।

একজনকে এক মুঠো মাটি দিয়ে বললাম ‘এই হল ‘মা’।
এভাবে কাউকে বেলুনবদ্ধ বাতাস, পেনসিলে আঁকা বাড়ি,
কাউকে গোধূলি, কাউকে দিলাম গোলাপের পাপড়ি।

গোধূলি দেবে আকাশের পরিসীমা
পাপড়ি থেকে পাবে নখপালিশের স্মৃতি।
উপহার পেয়ে সবাই বুথদখলের মতো আনন্দে আত্মহারা।

সূর্যাসেত্মর ঠিক আগে শেষ উপহারটি ছিল—
একটি শোলার তৈরি চন্দ্রবিন্দু। রুপালি রঙের।

লাইনের গালফোলা শেষ বাচ্চাটি এল
চন্দ্রবিন্দুটি তার হাতে তুলে দিয়ে বললাম—
পছন্দ হয়েছে? তোমার পরিচয়?
শুক্লপড়্গে আকাশের দিকে তাকিয়ে
ছেলেটি বলল—অবশ্যই;
আমি মাইকেল কলিন্সের ছোট নাতি!


পরকীয়া


ড. নিতাই চন্দ্র সেন। মনোবিজ্ঞানী। মননশীল ও মহৎ মানুষ।
ইদানিং সবকিছু বাদ দিয়ে পার্কে এসে বসে থাকে।
একা একা সারাক্ষণ।
মানুষ দেখলেই বিড়বিড় করে, বিরক্ত হয়।

এখন পড়ন্ত বিকেল।
ভাব বুঝে, মচমচে গরম জিলাপি নিয়ে
সামনে এসে বললাম—ডিভোর্সটা আটকানো গেল না দাদা?
বৌদির তো দোষের কিছু দেখি না!
বরং বাড়তি গুণ—উনি ভয়ানক সুন্দরী।

শুনে, সেভেনটি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে আমার মুখের দিকে ঈষৎ তাকিয়ে
স্পষ্ট করে বললেন—এটা মিথ্যে নয়,
তবে এই গুণের প্রধান দোষটা হলো কি জানেন—বড্ড বেশি টানে।
নির্ধারিত সীমার অধিক ব্লাড সুগারের মতো।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

কবি, প্রাবন্ধিক। জন্ম : ১১ জুন ১৯৬৯ বগুড়া, বাংলাদেশ। প্রকাশিত গ্রন্থ : ধানের রচনা দিলে পত্রে (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দের নান্দনিক পাঠ (প্রবন্ধগ্রন্থ), নিষিদ্ধ পুষ্টির কোলাহল (কাব্যগ্রন্থ), সোনার কার্তুজ (কাব্যগ্রন্থ), রৌদ্রবঞ্চিত লোক (মুক্তগদ্য), ব্যবহারিক বিস্ময় (কাব্যগ্রন্থ), দুর্ভিক্ষের রাতে (কাব্যগ্রন্থ), কায়া ও কৌতুকী (কাব্যগ্রন্থ), ছন্দকথা (প্রবন্ধগ্রন্থ), লুপ্ত সভ্যতার দিকে (কাব্যগ্রন্থ)

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।