বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫

‘সেলফিশ জিন’ এক মহাগ্রন্থের আবিষ্কার : জাহেদ সরওয়ার

0

দুইহাজার এগারো বারো সালের দিকে আমি একটা পত্রিকার হয়ে দ্বিজেন শর্মার সাক্ষাৎকার করতে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকারের টেবিলে সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ বা পুঁজিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তিনি তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন পুঁজিবাদ জেনেটিক। স্বার্থপরতা জেনেটিক। তাই পুঁজিবাদ নিঃশ্বেস হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন রিচার্ড ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ বইটির কথা। বইটির নানা দিক বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি তখন। আমার তখন মনে গেঁথে গিয়েছিল এই বই ও লেখকের নাম। আমি নানাভাবে ‘সেলফিশ জিনে’র সন্ধান করতে থাকি। এই বইটি ইউরোপে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৬ সালে। শুধু সেলফিশ জিন নয়। তখনও অব্দি রিচার্ড ডকিন্সের কোনো বই বাংলায় অনুবাদ হয় নাই। যেহেতু আমি বির্বতনবাদী তাই ডকিন্সের নানা লেখার সন্ধান পাই; যদিও সবই ইংরেজিতে। সতেরো-আঠারো সালের দিকে ডকিন্সের ‘গড ডিলুশন’ বইটির অনুবাদ বের হয়। অনুবাদ করেন কাজী মাহবুব হাসান। সম্ভবত এর পরের বছর ‘ম্যাজিক অব রিয়েলিটি’ নামের আরেকটি বই অনুবাদ হয় ডকিন্সের। সেটা বের হয় রোদেলা প্রকাশনী থেকে। এরপর ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ অনূদিত হয় অনুবাদ করেন কাজী মাহবুব হাসান। এরপর ‘ম্যাজিক অব রিয়েলিটি’ও অনুবাদ করেন কাজী মাহবুব হাসান। ডকিন্সের অনুদিত সব বইই আমি সংগ্রহ করি। যদিও ডকিন্সের সব বইয়ের সফট কপি আমি অনলাইন থেকে সংগ্রহ করি।

এই মহাগ্রন্থটি জীবিত পাঠকমাত্রেরই অন্তত একবার পড়া উচিত। জীবনের রহস্য, বেঁচে থাকার রহস্য আপনার সামনে পরতে পরতে খুলে যাবে। বলতে গেলে সারা জীবন একজন আত্মসন্ধানী মানুষ যা খুঁজে বেড়ান। কে আমি কোথায় আমার যাত্রা। তাদের সমস্ত জীবনসাধনার সারমর্ম এই গ্রন্থ।

যেহেতু কাজী মাহবুব হাসান রিচার্ড ডকিন্স সহ বিবর্তনবাদী নানা বই অনুবাদ করে চলেছেন আমি অনলাইনে নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে ফলো করি। তার সাথে একটা যোগাযোগও গড়ে উঠে। তাকে অনুরোধ করি এই মহাগ্রন্থটি অনুবাদ করার জন্য। আমি জানি চার্লস ডারউইনের সুযোগ্য উত্তরসূরি রিচার্ড ডকিন্স। বিবর্তনবাদে ডারইউনের অসমাপ্ত কাজগুলো তার মতো সুচারুভাবে কেউ করতে পারে নাই। অত্যন্ত খোশখবর যে, তিনি জানালেন ‘সেলফিশ জিনে’র অনেকাংশ তিনি ইতোমধ্যে অনুবাদ করেছেন। সম্পাদনাটাই কেবল বাকি। খুশি হলাম আর অপেক্ষায় থাকলাম কখন এটা পড়ে ফেলব। ইতোমধ্যে ‘সেই বই’ নামের একটা অনলাইন পিডিএফ সাইটে অনুবাদটির কিয়দংশ পিডিএফ আকারে টাকার বিনিময়ে পড়া যেত। কিন্তু পড়ে যেন আশ মেটে না। অবশেষে বইটি বাংলায় প্রকাশিত হলো উড়াল বুকস প্রকাশনী থেকে। যেহেতু কাজী মাহবুব হাসানের অনুবাদ আমার আগেই পড়া, তাই যথেষ্ট বিশ্বাস ছিল এটা সহজবোধ্য অনুবাদ করবেন তিনি। বিবর্তনবাদের মতো সিরিয়াস বিষয়ের বই তিনি অবলীলায় স্বচ্ছ চমৎকার অনুবাদ করেন। ডকিন্স অবশ্যই গল্পের ছলে বিবর্তনবাদের মতো সিরিয়াস বিষয় উন্মোচিত করেন ধীরে ধীরে।

The Selfish Gene

‘দ্য সেলফিস জিন’ বইটি কিনতে এখানে ক্লিক করুন

আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি নিশ্চয়ই এই মহাগ্রন্থটি জীবিত পাঠকমাত্রেরই অন্তত একবার পড়া উচিত। জীবনের রহস্য, বেঁচে থাকার রহস্য আপনার সামনে পরতে পরতে খুলে যাবে। বলতে গেলে সারা জীবন একজন আত্মসন্ধানী মানুষ যা খুঁজে বেড়ান। কে আমি কোথায় আমার যাত্রা। তাদের সমস্ত জীবনসাধনার সারমর্ম এই গ্রন্থ। ডকিন্সের মতে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণি হচ্ছে অজস্র জিনের সার্ভাইভাল মেশিন। এই বইয়ে মোট তেরটি অধ্যায় রয়েছে। অধ্যায়গুলো হচ্ছে মানুষেরা কেন? অনুলিপনকারী, অমর কুণ্ডলী, জিন মেশিন, আগ্রাসন: স্থিতিশীলতা এবং স্বার্থপর মেশিন, জিনম্যানশিপ বা জিন সৌহার্দ্য, পরিবার পরিকল্পনা, আন্তঃপ্রজন্ম দ্বন্ধ, আন্তঃলিঙ্গ দ্বন্ধ, তুমি আমার পিঠ চুলকে দাও, আমি তোমার পিঠে চড়ব, মিম: নতুন অনুলিপনকারী, ভালোরা সফল হয়, জিনের দীর্ঘ হাত ইত্যাদি এছাড়াও রয়েছে দুটো দীর্ঘ ভূমিকা।

প্রতিটি অধ্যায় অনেক সময় নিয়ে পড়া উচিত। পড়ে নিজের সাথে তর্ক করা উচিত। নিজের এতদিনের জানা বিষয়গুলোকে তারপর ভাগযোগ করতে হবে। ‘মানুষ কেন’ অধ্যায়ে ডকিন্স দুইধরণের স্বার্থপরতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। স্বার্থপরতা আর পরার্থপরতা। পরার্থপরতাও একধরণের স্বার্থপরতা। এর উদাহারণ টানতে গিয়ে তিনি বলেন, ব্ল্যাকহেডেড গালরা বড়ো আকারের কলোনি হিসাবে তাদের নীড় বানায়। সাধারণত এই বাসাগুলো পরস্পর থেকে অল্প কয়েক ফুট দূরত্বে অবস্থান করে। যখন ডিম ফুটে প্রথম বাচ্চা বের হয়, তারা আকারে খুব ছোটো হয় আর নিজেদের সুরক্ষা করার কোনো উপায় থাকে না, খুব সহজেই তাদের আস্ত গিলে খাওয়া যায়। এই গাল পাখিদের মধ্যে খুব প্রচলিত একটি আচরণ দেখা যায়, সেটি হচ্ছে, তারা অপেক্ষা করে কখন তাদের প্রতিবেশী গাল অন্যদিকে তাকাবে বা নিজের বাসা ছেড়ে বের হবে, তখনই তারা ছোঁ মেরে প্রতিবেশীর কোনো একটি পাখির ছানা আস্ত গিলে খেয়ে নেয়। এভাবেই সেই পাখিটি মাছ ধরার জন্য কোনো ঝামেলা না করে এবং নিজের বাসাটিকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে যাওয়া ছাড়াই বেশ ভালো একটি পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করে নেয়।

The Selfish Gene

দি ম্যাজিক অব রিয়েলিটি এবং দি গড ডিল্যুশন বইয়ের প্রচ্ছদ


আসলে শুধু ডিকেন্সের নয়, প্রাণি জগতে এরকম স্বার্থপরতার গল্প ভুরি ভুরি। নিজেদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখতে পৃথিবীর সামন্তীয় রাজবংশগুলোর দিকে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাই নিজের উত্তরাধিকারীদের হত্যা করতে। পিতাকে পুত্র বা পুত্রকে পিতা, ভাইকে ভাই, একে অন্যকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করার গল্প অনেক শুনেছি আমরা। সেটা অন্যান্য প্রাণিজগতেও বিদ্যমান।

ডকিন্স বলেন, অপেক্ষাকৃত স্ত্রী-প্রেইং মানতিসদের অদ্ভুত স্বজাতি ভক্ষণ করার আচরণটি আরও সুপরিচিত। মানতিসরা বড়ো আকারের মাংসাশি কীট। তার সাধারণত অপেক্ষাকৃত ছোটো পোকামাকড় যেমন– মাছি খায়, কিন্তু তাদের নড়াচড়া করে এমন প্রায় সব কিছুকেই আক্রমণ করার স্বভাব আছে। তারা যখন প্রজননের জন্য মিলিত হয়, পুরুষ মানতিসরা সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে তাদের স্ত্রী-সদস্যদের উপরে উঠে আসে, তারপর সঙ্গম করে, যদি স্ত্রী-সদস্যটি সুযোগ পায়, সে তাকে খেয়ে ফেলে। প্রথমে এক কামড়ে তার মাথাটি খেয়ে ফেলে, এই কাজটি সে করতে পারে, যখন কোনো পুরুষ মিলিত হবার জন্য তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অথবা তার উপর উঠেছে এবং সঙ্গমরত অবস্থায়, কিংবা সঙ্গমের পরপর তারা পৃথক হলে।

ডকিন্স আরও বলেন, হয়তো আমরা সমব্যথী হতে পারি এমপেরর পেঙ্গুইনদের আপাতদৃষ্টিতে ভীরু কাপুরুষোচিত আচরণ লক্ষ করে। তাদেরকে দেখা গেছে কোনো সমুদ্রের সীমানায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে, পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তাদের মধ্যে ইতস্তত দেখা যায়। তাদের ভয় সিলের আক্রমণ ও তাদের খাদ্য পরিণত হওয়া থেকে নিজেকে যেন বাঁচানো যায়।

যদিও স্বার্থপরতা একরকম নয় এটা বিভিন্নভাবে হতে পারে। ডকিন্স আরও বলেন, হয়তো আমরা সমব্যথী হতে পারি এমপেরর পেঙ্গুইনদের আপাতদৃষ্টিতে ভীরু কাপুরুষোচিত আচরণ লক্ষ করে। তাদেরকে দেখা গেছে কোনো সমুদ্রের সীমানায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকতে, পানিতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে তাদের মধ্যে ইতস্তত দেখা যায়। তাদের ভয় সিলের আক্রমণ ও তাদের খাদ্য পরিণত হওয়া থেকে নিজেকে যেন বাঁচানো যায়। যদি তাদের একজন পানিতে ঝাঁপ দেয়, বাকি সবাই কিন্তু সাথে সাথেই জেনে যায়, পানিতে সিল অপেক্ষা করছে, নাকি কোনো সিল সেখানে নেই।

আবার দেখা যায়, মৌমাছিদের ক্ষেত্রে কর্মী মৌমাছিদের হুল ফোটানোর আচরণ মৌচাকের মধু চোরদের বিরুদ্ধে কার্যকরী একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু যে মৌমাছিরা এই কাজটি করে, তারা আসলে যোদ্ধা বা আত্মঘাতী মৌমাছি। এই হুল দিয়ে কাজটি করতে হলে তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বাইরে ছিড়ে চলে আসে আর আক্রমণকারী মৌমাছিরাও মারা যায়। তবু কেন তারা এই কাজটি করে? এটাই হচ্ছে পরার্থপরতা। আমরা দেখি নানা মতবাদের জন্য যারা প্রাণ দেয়। তারা মনে করে মৌমাছিদের মতো তার নিজের মতবাদ বা নিজের কৌমকে রক্ষা করার জন্য নিজেদের আত্মত্যাগ করে। এটাই পরার্থপরতার উৎকৃষ্ট উদাহারণ। এটা আমি শুধু একটা অধ্যায় থেকে উদাহারণ দিলাম। এই বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়েই আসলে এরকম অসংখ্য উদাহারণের মাধ্যমে ডকিন্স তার বক্তব্যের যথার্থতা তুলে আনেন।

এই অনুবাদ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালে। অনুবাদ করেছেন কাজী মাহবুব হাসান। তিনি ইতমধ্যে রিচার্ড ডকিন্সের আরও কয়েকটি বইয়ের অনুবাদ করেছেন। এরমধ্যে ‘দ্য গড ডিল্যুশন’, ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’, ‘দ্য ম্যাজিক অব রিয়েলিটি’ অন্যতম। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন আসমা সুলতানা মিতা। বইটি প্রকাশিত হয়েছে উড়াল বুকস থেকে। এর পরিবেশক হিসাবে রয়েছে আগ্রদূত অ্যান্ড কোম্পানি। বইটির মুল্য রাখা হয়েছে ১২৫০ টাকা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৬; মহেশখালী দ্বীপে। স্নাতকোত্তর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফ্রিল্যান্সার। প্রকাশিত বই: এই মিছা কবি জীবন [কবিতা] আততায়ী একটি কবর [কবিতা] বিকালের দাসবাজার [কবিতা] আরো একটি কবিতা শোনাও কবি [কবিতা] সূর্যের নিচে শুধু ভয় [কবিতা] পায়ুবাসনার জনগণ [উপন্যাস] দস্তইয়েভস্কির বই ও কোটিপতির সকাল [গল্প] সম্পর্কের সন্ত্রাস ও অন্যান্য গল্প [গল্প] রাজ্য ও সাম্রাজ্য [রাজ্যচিন্তার কারখানা-১] সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ [রাজ্যচিন্তার কারখানা-২] কবিতা পড়ুয়ার নোটবই [কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধের বই] ফিদেল কাস্ত্রো [জীবনী গ্রন্থ]

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।