শুক্রবার, মার্চ ২৯

হামিরউদ্দিন মিদ্যার রবিবারের ধারাবাহিক : ধুলোমাটির ভুবন | পর্ব-০৪ | মোরা এক সুরে গান গাই

0

মোরা এক সুরে গান গাই


ছোটো থেকেই যে গ্রামটির আলো-বাতাসে বড়ো হয়ে উঠলাম, কখনও আমার মনে হয়নি যে এখানে দুটি সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। গ্রামটিতে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে মোট আটটি পাড়া। তারমধ্যে আমার পাড়াটির অবস্থান গ্রামের মাঝখানে। ডানপাশে গরাই পাড়া। বাঁ-পাশে রায় পাড়া।

আমার বড়ো ফুপুর বিয়ে হয়েছে গ্রামেই। ফুপুদের ঘরের পাশেই নেউল গরাইয়ের ঘর। বলা চলে একটাই উঠোন। ছোটোবেলায় ফুপুদের বাড়িতেই সারাটাক্ষণ পড়ে থাকতাম। ফুপুর সেজ ছেলে খাইরুল, আমার সমবয়সী। দু’জনে কাদা দিয়ে ছ’চাকার লরি বানাতাম, ডি জে বক্স তৈরি করতাম। লেউল গরাইয়ের নাতি তাপস আমাদের সঙ্গে খেলতে আসত। ভাত খাবার সময় হলে আমাদের তিনজনকেই ভাত বেড়ে দিত ফুপু। কোনোদিন বুঝতেই পারিনি যে, তাপস অন্য ধর্মের, অন্য সম্প্রদায়ের। ফুপুদের বাড়িরই একজন সদস্য ভাবতাম।

ফুপুদের ঘরের পাশেই নেউল গরাইয়ের ঘর। বলা চলে একটাই উঠোন। ছোটোবেলায় ফুপুদের বাড়িতেই সারাটাক্ষণ পড়ে থাকতাম। ফুপুর সেজ ছেলে খাইরুল, আমার সমবয়সী। দু’জনে কাদা দিয়ে ছ’চাকার লরি বানাতাম, ডি জে বক্স তৈরি করতাম। লেউল গরাইয়ের নাতি তাপস আমাদের সঙ্গে খেলতে আসত। ভাত খাবার সময় হলে আমাদের তিনজনকেই ভাত বেড়ে দিত ফুপু। কোনোদিন বুঝতেই পারিনি যে, তাপস অন্য ধর্মের, অন্য সম্প্রদায়ের।

তাপসের মা হয়তো মল্লিক পাড়ার আবুলের দোকানে হাটবাজার করতে যাচ্ছে, বড়ো ফুপু হাঁক পাড়ল—ও বাসন্তী, একবার দাঁড়া গো। শুকনো লঙ্কা শেষ হয়ে গেছে। বলেই দৌড়ে গিয়ে হেঁশেল ঘরে ঢুকে ফুপু চালের ড্রাম থেকে মুঠো কতক চাল বের করে একটা পলিথিনে ভরে তাপসের মায়ের হাতে তুলে দিত। কোনো দিন দরমা থেকে হাঁসের ডিম। চাল, ডিম বিক্রি করে সংসারের টুকিটাকি জিনিস আনতো। ফুপু দোকান গেলে তাপসের মায়েরও কিছু লাগলে আনতে দিত।

খয়েরি রঙের শাড়ি পরা তাপসের মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ে এখন। মোটা করে সিঁথিতে সিঁদুর পরা। হাসলে মনে হতো পৌষসংক্রান্তির রাতে রায়পাড়ায় জাগরণের গান শুনতে গিয়ে দেখা টুসুমণির মূর্তির মতো। তাপসের মাকে খাইরুল ছোটো চাচি বলে ডাকত। দেখাদেখি আমিও চাচি বলতাম। সেই ছোট্ট বয়সে কেউ আমাদের চাচি বলতে বারন করেনি। তাপসের মা খুব ভালোবাসত আমাদের। বাড়িতে গেলে দুধের স্বর দিয়ে মুড়ি খেতে দিত। দোকান গেলে আমাদের জন্য কিনে আনত, মদন কটকটি, মাছ চকলেট।

তেঁতুলগোড়ের পুকুর ঘাটে সবাই একসাথেই স্নান করে। দৃশ্যগুলো দেখে মনেও শান্তি আসে। মনোয়ারা চাচি গা ধুয়ে শুকনো কাপড় পরে, ঘাটের পাথরে বসে নামাজ পড়ার জন্য ওজু করছে, তখন হয়তো সুনীলের মামা জগদীশ দাদু স্নান সেরে পানিতে দাঁড়িয়েই সূর্যের দিকে দু’হাত জড়ো করে মন্ত্র জপ করছে। মল্লিকদের মা-মরা বাছুর ছানা ছুটে গিয়ে কার্তিক রায়ের উঠোনে বাঁধা গাইগরুর বাটে মুখ লাগিয়ে দুধ খেয়ে নেয়। কার্তিকের বউ বলে, ও সামসুরা চাচি। দড়ি দিয়ে বাঁধতে হবে কেনে গো! খেলিই বা একটুকুন দুধ। আজ যদি আমাদের গাইটা মরত, তুমারটা বেঁচে থাকত! তাহলে পারতে তাড়াতে?

রমজান মাস পড়ল। সে সময় চলছে বাগদি পাড়ার পুণ্যিপুকুরে জবকার্ড থেকে মাটি কাটার কাজ। বেলা বারোটা। সব পাড়া থেকেই দু-চারজন করে কাজে লেগেছে। যারা রোজা রেখেছে, খালি পেটে টলছে। তখন বাগদি পাড়ার কেউ একজন বলে উঠল, তুমরা যারা রোজা রেখেছ, ঘর যাবে তো চলে যাও। বাকি কাজ আমরাই করে দিব। এত রোদে খালি পেটে আর খাটতে হয় না।

দুগি বাগদির মেয়েটার বিয়ে লেগেছে মাছডোবায়। জামাইকে দিতে হবে একখানা নতুন সাইকেল, হাত ঘড়ি, আর নগদ পনেরো হাজার টাকা। কোথায় পাবে দুগি! খালেবিলে, নদীতে, মুয়ানে মাছ ধরে সে। দুগি গেল মল্লিকপাড়ার ঝড়ো মল্লিকের কাছে। গিয়ে সব কথা বলে আবদার করে বসল, ও চাচা, মেয়েটার বিয়ে লাগাইছি। তুমি কিছু দিবে নাই?

ঝড়ো মল্লিক বলল, ও মা, এ তো খুশির খবর! মেয়ের বিয়ে দিচ্ছিস, কিছু দিতে হবে বইকি। তা কী দিলে খুশি হবি বল তো?

আবদুল চাচা তো সাইকেলটা দিচ্ছে, তুমি একখানা ভালো হাত ঘড়ি কিনে দিও তাইলে।

এভাবেই তো গ্রামের মানুষগুলোকে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে দেখে আসছি। জাতপাতের বিচার কখনও করতে দেখিনি। উৎসবকে ভাগ করে নেয় একে অপরে। কালি পুজোর পাঁঠাবলি যেমন আমরা দেখতে যাই দল বেঁধে, তেমনই আমাদের মহরমে লাঠিখেলা হলেও ওরা আসে।

রমজান মাসের সন্ধ্যায় বড়ো ফুপুর বউমা, মানে সাবিনা ভাবির কোরান পড়ার সুর শুনে থমকে দাঁড়ায় তুলশি তলায় সাঁজ দিতে আসা ওবাড়ির ছোটো বউ শিউলি। তারপর যখন শাঁখে ফুঁ দেয়, কোরান পাঠ থামিয়ে কানখাড়া করে থাকে এবাড়ির বউ।

সরস্বতী পূজা এলেই পঞ্চমীর সকালে আমাকে ভিজে পান্তা খেয়ে আসতে হয় সরমিলা কাকিমাদের ঘরে। নীবারণ কাকা প্রতিবছর ডেকে নিয়ে যায়। আর ঈদ এলে আমার মা সেমাই, চালগুড়ির রুটি, লাচ্ছা দিয়ে পাঠায়।

রমজান মাসের সন্ধ্যায় বড়ো ফুপুর বউমা, মানে সাবিনা ভাবির কোরান পড়ার সুর শুনে থমকে দাঁড়ায় তুলশি তলায় সাঁজ দিতে আসা ওবাড়ির ছোটো বউ শিউলি। তারপর যখন শাঁখে ফুঁ দেয়, কোরান পাঠ থামিয়ে কানখাড়া করে থাকে এবাড়ির বউ।

একটু বড়ো হতেই কিছু কিছু ব্যাপার আমাকে অনেক প্রশ্নের মুখে ফেলে দিতে লাগল। একবার মা হাতে টাকা দিয়ে বলল, তেমাথার মোড় থেকে ঘুরে আয় তো খোকা। পোলটির মাংস কিনে আন।

মোড়ে দুটি দোকান। সামনেই লখা বাগদি মুরগি কাটে, তারপর সামাদ মণ্ডল। সামনের দোকানেই দাঁড়ালাম। বললাম, এক কিলো মাঝারি সাইজের পিস করে দাও তো লখা কাকা।

লখা বাগদি আমার দিকে কেমন করে তাকাল। বলল, তুই বাসেদের নাতি না?

বললাম, হ্যাঁ। আমি হানিফের ছেলে।

শুনে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল লখা। কী ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। হাসি থামিয়ে বলল, ধুর খ্যাপা, এত বড়ো ছেলে হয়েছিস, এখনও গেয়ান হয় নাই? ওই দেক সামাদের দোকান। ওখান থেকে নিয়ে যা।

বাড়ি ফিরে মাকে বললাম সব কথা। মাও রেগে মারতে গেল আমাকে। তুই কি খ্যাপাই থেকে যাবি! ওরা মুরগি পিটিয়ে মেরে কাটে। আর আমরা গলার দিকে জবাই করে। আর কখনও লখার দোকানে যাস না। যখন গোটা মুরগী আনবি, তখন যেখানে খুশি আনবি।

মায়ের কথা শুনে মনে প্রশ্ন জাগল কেন?

তারপর যত বড়ো হলাম, ধীরে ধীরে বেশকিছু জিনিস বুঝে গেলাম। সবাইকে সবকিছু করতে নেই। সবাইকে সবকিছু খেতে নেই। সবার কিছু আলাদা আলাদা নিয়মকানুন, আচার বিধি আছে। এভাবেই তো বসবাস, আমাদের বেঁচে থাকা।

গ্রামের বাইরের পরিবেশটা কিন্তু আলাদা। আমাদের এখানের অধিকাংশ ছেলে-ছোকরারাই বাইরে খাটতে যায়। কেরালা, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, মহারাষ্ট্র। কেউ রাজমিস্ত্রী হয়ে, কেউ রংমিস্ত্রি। গাঁ-গ্রামে সারাদিন গাধার মতো খেটে যা রোজকার হয়, বাইরে ডবলের থেকেও বেশি। ছেলে-ছোকরারা মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক দেওয়া হলেই ট্রেনের টিকিট কাটে।

উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আমারও পালা পড়ল। লোহার পাড়ার কয়েকজন ছেলে কেরালায় ছিল, কার্তিক পুজোর জন্য কিছুদিন ছুটি নিয়ে এসেছিল। পুজো শেষ হতেই আবার যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করছিল। গণা মিস্ত্রি নিয়ে যাচ্ছে সাতজন নতুন লেবার। রাজমিস্ত্রীর জোগাড়ে। আমিও নাম লেখালাম।

আব্বা বলল, যাচ্ছিস যা। কিন্তু ওখানে কাদের সঙ্গে থাকবি?

বললাম, কেন? যাদের সঙ্গে যাচ্ছি।

আমাদের পাড়ার হাপিজুল, শরিফুল ওরা যেখানে আছে, ফোন করে যোগাযোগ করে নিবি। ওদের কাছে চলে যাবি।

জেনারেল কামরায় গা ঠেঁসাঠেসি ভিড়! দু’দিন, দু’রাত ধরে ট্রেন যাত্রা। অধিকাংশ যাত্রীই ছিল আমাদের মতো খেটেখেকো মানুষ। কিছু বেশি রোজগারের ধান্দায় কেউ যাচ্ছে বউ-ছেলেমেয়েকে ফেলে, কেউ বাপ-মাকে ছেড়ে। বিশ্বাস করুন, সেই ভিড়ের মধ্যে আমি হিন্দু-মুসলিম দেখতে পাইনি। কতগুলো মানুষের খিদে দেখতে পেয়েছিলাম। আর পেয়েছিলাম মুঠো মুঠো সাদা ভাতের গন্ধ।

তামিলনাড়ু ঘেঁষা ডিস্ট্রিক্ট এনার্কুলামে আমাদের কাজ। সাতজন নতুন লেবারদের জন্য আলাদা থাকার রুম পেলাম। থাকা খাওয়ার খরচ নিজের বেতন থেকেই মেটাতে হবে।

বললাম, তোদের সঙ্গে থাকলে কোনো অসুবিধা নাই তো রে!

অসুবিধা বলতে?

এই ধর, রান্না-খাওয়া….

শোন ভাই, এখানে সবাই পেটের টানে কাজ করতে এসেছি। জাতপাতের ব্যাপার এখানে চলে না। তুই কি ভাবছিস শুধু তুই আছিস? পাশের রুমগুলো খোঁজ নিয়ে দেখ। সব একসাথে কেমন মিলেমিশে রয়েছে।

যেদিন যার রান্নার পালি পড়ত, ভোর ভোর উঠে হাঁড়ি কড়াই মেঁজে রান্না বসাতে হতো। সকালে খেয়েদেয়ে বাসে চেপে কাজের সাইডে।

সপ্তাহে এক আধদিন মাংস হতো। মাছ হতো। ওখানে লখা বাগদি, আর সামাদ মণ্ডলের দোকানের মতো ভাগাভাগির ব্যাপার ছিল না।

মাসতিনেক পর হঠাৎ জ্বরে পড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম সকালে বেরিয়ে রাত আটটায় ফিরে স্নান করার জন্য শরীর খারাপ। ধারণাটা ভুল প্রমানিত হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি গায়ে, মুখে, পিঠে জল ফসকার মতো কী যেন বেরিয়েছে। শরীরটা প্রচণ্ড দুর্বল। প্রকাশকে দেখালাম, ও দেখেই শিউরে উঠল। বলল, পক্স হয়েছে যে রে!

মাসতিনেক পর হঠাৎ জ্বরে পড়লাম। প্রথমে ভেবেছিলাম সকালে বেরিয়ে রাত আটটায় ফিরে স্নান করার জন্য শরীর খারাপ। ধারণাটা ভুল প্রমানিত হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি গায়ে, মুখে, পিঠে জল ফসকার মতো কী যেন বেরিয়েছে। শরীরটা প্রচণ্ড দুর্বল। প্রকাশকে দেখালাম, ও দেখেই শিউরে উঠল। বলল, পক্স হয়েছে যে রে!

বেশ চিন্তিত দেখাল রুমের বাকিদেরও। তারপর আমাকে সাহস জোগানোর জন্য বলল, তেমনকিছু নয়। কিছু নিয়মকানুন আছে তা পালন করলেই ভালো হয়ে উঠবি। তবে ছোঁয়াচে রোগ, অন্য কারও রুমে যাস না। আজ থেকে কাজে যেতে হবে না তোকে। মালিককে বলে তোর ছুটির ব্যবস্থা করে দেব।

খুব ভয় পেয়ে গেলাম। ছোঁয়াচে রোগ! তাহলে তো এই রুমের বাকিদেরও হয়ে যেতে পারে? কী করব এখন? আলাদা রুম ভাড়া নেব? তা-ও তো সম্ভব নয়।

ওরা কাজে চলে গেলে আমার বিছানাটা নিজেই ঘরের এককোণে টেনে নিয়ে গেলাম।

এগারোদিন স্নান করিনি। রান্নাবান্না কিছুই করতে হয়নি। সময়ে সময়ে খাবার বাড়িয়ে দিয়েছে সামনে। খাওয়া হলে এঁটো থালাটা কলতলায় গিয়ে ধুয়ে এনে দিয়েছে।

আমার ওই অসুস্থতার সময় যেভাবে গ্রামের কয়েকজন অমুসলিম ছেলে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল। আমার সেবাশুশ্রুষা করেছিল, তা সারাজীবন মনে থাকবে।

বোরোধান চাষ করেছি বিঘাখানেক। চাঁদিফাটা রোদে ধান নিড়াচ্ছি জমিতে। গ্রামের পাশেই মাঠ। জমিতে কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে গিয়ে রায়পাড়ার গোপাল কাকা খেত থেকে উঠে খেঁজুর তলায় বসল। গলায় কয়েক ঢোক পানি ঢেলেই আমাকে হাঁক পাড়ল, ভাইপো উঠে আয় রে। একটু জল খেয়ে যা। খানিক জিরো কেনে।

মাঠে পানি আনিনি। ভেবেছিলাম ছোটো জমি, একদমে পুরোটা নিড়িয়ে দিয়ে ঘরে খেতে চলে যাব। কিন্তু রোদের যা তেজ গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সারা শরীর ভ্যাপসা গরমে ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে। এমন সময় গোপাল কাকার আন্তরিক ডাক শুনে মনটা আনন্দে ভরে গেল। মাথায় পাগড়ি বাঁধা গামছাটা খুলে মুখ মুছতে মুছতে উঠে এলাম। পগাড়ে দুটো পাশাপাশি খেঁজুর গাছ। কতটুকু আর ছায়া! সেখানেই গোপাল কাকার পাশে বসলাম। পানি খেতে গেলাম, আমাকে থামিয়ে থলের ভেতর হাত ভরে বের করল পলিথিনের পুঁটুলি থেকে দুটো বাতাসা। হাতে দিয়ে বলল, খালি পেটে জল খাস না, এগুলো মুখে নে বাপ। পুজোর প্রসাদ। তোর জ্যেঠি ভরে দিয়েছে।

বাতাসা খেয়েই গলাটা ভেজালাম। ধড়ে প্রাণ ফিরে এলো। বললাম, তুমি না পানি খাওয়ালে আজ পুরো জমিটা নিড়াতে পারতাম না।

গোপাল কাকা বলল, তুই আনলে কি আমাকে খাওয়াতিস না?

আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে যেন ইলেক্ট্রিক শক খেলাম। বললাম, তোমার এমন কেন মনে হলো? যে পানি থাকলেও দিতাম না?
তুই দিতিস, কিন্তু সবাই দেয় না রে বাপ। তোকেও সবাই দিত না।

কথা ঘুরিয়ে গোপাল কাকা বলল, যাক গে বাদ দে এসব কথা। ক’টা বাজবেক বলদিনি এখন?

বললাম, মোবাইল তো আনিনি গো। কাদাপানির কাজ। যদি পড়ে যায়! জোহরের আজান তো এখনও দেয়নি। তাহলে বোধহয় একটাও বাজেনি এখন।

গোপাল কাকা বলল, যায় বলিস বাপ আজানটা দেয় বলেই মাঠে এলে সুময়টা জানতে পারি।

বাপ-দাদোদের আমল থেকেই মাঠে আজান শুনে সময় জেনে আসছে সব। শুধু শুক্রবারে বারোটায় আজান দেয়। সেকথা মাঠে খাটতে আসা সব মানুষই জানে।

বাপ-দাদোদের আমল থেকেই মাঠে আজান শুনে সময় জেনে আসছে সব। শুধু শুক্রবারে বারোটায় আজান দেয়। সেকথা মাঠে খাটতে আসা সব মানুষই জানে।

গোপাল কাকা বলল, তুই তো লেখাপড়া জানা ছেলে বাপ, তুই বল তো কোনোদিনও তোর কীর্তনের সুর শুনে বিরক্তি লাগে?

বিরক্তি কেন লাগবে!

শেখপাড়ার ক্লাবের ছেলেগুলো যে গিয়ে এতবড়ো ঝামেলাটা করল, তার কোনো মানে আছে? আর লোহার পাড়ারও কয়েকটা ছাগল আছে। বলে কিনা মসজিদের মাইকগুলো অন্য দিকে ঘুরাতে। এতদিন বাস করছি রে। কুনুদিন তো আমাদের ওসব কথা মাথায় আসেনি!

ইদানিং ওদের মাথায় পোকা ঢুকেছে কাকা। আর সেগুলো কারা ঢোকাচ্ছে সেকথা আর স্পষ্ট করে বলতে হবে না তোমাকে।

জানি রে জানি। মানুষগুলোকে খ্যাপা কুকুরের পারা লেলিয়ে দিয়ে সব ভোট নিবার ধান্দা করছে। এতদিন মিলেমিশে আছি। ‘আমরা-তুরা’ বলে কখনও তো ভাবিনি।

গোপাল কাকার কথা শুনে কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। নিজের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, কয়েকটি মানুষের জন্য গ্রামের, দেশের পরিস্থিতিটাই কেমন পালটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস গোপালকাকার মতো মানুষরা যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন আমাদের বন্ধন কেউ ঘোচাতে পারবে না।

মাঠ থেকে যখন উঠে এলাম, তখন জোহরের আজান হাঁকল মোয়াজ্জিন। রায় পাড়া থেকে ভেসে আসছিল হরিসংকীর্তনের সুর। দুই সুর বাতাসে ভাসতে ভাসতে একসাথে মিশে যাচ্ছিল।


‘ধুলোমাটির ভুবন’ ধারাবাহিকের অন্যন্য পর্ব
প্রথম পর্ব : ঘরামী চালের ভাত
দ্বিতীয় পর্ব : দু’চাকার বাহন
তৃতীয় পর্ব : পৌষসংক্রান্তির মেলা

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

হামিরউদ্দিন মিদ্যার জন্ম ১৪ই জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর একটি প্রত্যন্ত গ্রামে। মূলত গল্পকার। প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। বর্তমান, এই সময়, সাপ্তাহিক বর্তমান, আজকাল, প্রতিদিন, অনুষ্টুপ, পরিচয় প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালেও লিখে থাকেন। ২০১৯ সালে কলকাতা বইমেলায় 'সৃষ্টিসুখ' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয়েছে গল্পগ্রন্থ 'আজরাইলের ডাক'। লেখালেখির জন্য ২০১৮ সালে পেয়েছেন 'প্রতিশ্রুতিমান গল্পকার সম্মান'। ২০২১ সালে 'আজরাইলের ডাক' গল্পগ্রন্থটির জন্য পেয়েছেন 'দৃষ্টি সাহিত্য সম্মান'। তাঁর গল্প ইংরেজি ও হিন্দিতেও অনুবাদ হয়েছে।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।