বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ২৫

অতান্ত্রিকেয় লিলিথজন্ম : নির্জ্ঞান থেকে সজ্ঞানে : আশরাফ জুয়েল

0

ইদানীং অনেকের লেখা পড়ি, পড়তে হয়। পড়ে বোঝার চেষ্টা করি, এই সময়ের বাংলাকবিতার গতিপথ। মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেও বাংলাকবিতার গতিপথ কোনদিকে? আমার অনুসন্ধিৎসু পাঠক মন কী সে পথ অনুসরণে সক্ষম? উত্তর খুঁজে পেতে দিকবিদিকশূন্য হয়ে পড়ি। কিন্তু হতাশ হলে তো চলবে না! এই সন্ধান এমন এক সন্ধান, যার খোঁজে পথে নেমে বারবার পথহারা হওয়া যাবে কিন্তু হতাশ হওয়া যাবে না।

এইসব নিরীহ ভাবনাগুলোর শরীরে অবিশ্বাসের হালকা ঠান্ডাউষ্ণ বাতাস দিতে দিতে হঠাৎ আমার মনে পড়ে যায় ইয়েটস; ‘The rhetorician would deceive his neighbours, the sentimentalist himself: While art is but a vision of reality.’ কিন্তু কেন মনে পড়ল! ঠিক বুঝতে পারছি না, এই বোঝা না-বোঝার মধ্যেই শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরের মতো এসে হাজির কোলরিজ, তিনি বলেছিলেন, ‘No man was ever yet a great poet without being at the same time a profound philosopher.’

‘আধুনিককালের কবিরা চারদিকের দুঃখ ও পাপ সমন্ধে শুধু সচেতন নন, এই অমঙ্গলবোধ তাঁদের চেতনাকে অভিভূত করে রেখেছে।’ হয়তো তাই। কিন্তু আসলেও কী তাই!

ভালো কবিতা পড়া আরম্ভ করলেই আমার মনে অদ্ভুত সব চিন্তা এসে কাঠঠোকরার মতো অনবরত আঘাত করতেই থাকে, আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি সেই বৃক্ষদেবের মতো, যে নিজেকে রক্তাক্ত করেও আশ্রয়গন্ধীকে দেয় আশ্রয়।

ভালো কবিতা পড়া আরম্ভ করলেই আমার মনে অদ্ভুত সব চিন্তা এসে কাঠঠোকরার মতো অনবরত আঘাত করতেই থাকে, আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকি সেই বৃক্ষদেবের মতো, যে নিজেকে রক্তাক্ত করেও আশ্রয়গন্ধীকে দেয় আশ্রয়। ভালো কবিতা আমাকে মৌন অভিব্যঞ্জনার চাদরে শুইয়ে দিয়ে বিশ্বসুন্দরের বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিতে চায়।

Otantrikeo Lilithjonmo

অতান্ত্রিকেয় লিলিথজন্ম | লেখক : সোনালী চক্রবর্তী | প্রকাশক : ভিন্নচোখ | প্রকাশকাল : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২২

আমার হাতে একটি কবিতার বই। পড়ছি, হ্যাঁ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ছি, শুদ্ধস্বর প্রেম খুঁজে নিতে যেভাবে হৃদয় ঢেলে দেয় নারী, আমি নারী হয়ে উঠছি মনেমনে-মনেপ্রাণে-প্রাণেপ্রাণে।

কবিতা পড়ছিলাম—

 

‘কারমেল স্কুলের সেলাই মার্কবুকে আমার নামের পাশে নির্ভুল বোনা হতো, অদ্ভুত লম্বা এক লাল মাফলার।’ [মায়াজন্ম]

 

আবাসের কাছে নতজানু হয়ে বসে পড়ি। বুঝতে পারছি আমার পাঠকহৃদয় সজ্ঞান থেকে নির্জ্ঞান এবং নির্জ্ঞান থেকে সজ্ঞানের ভেতর ঘোরাফেরা করছে। বুঝতে পারছি বোধের ভেতর জমা হচ্ছে বেদনার ঢেউ।

কবি বলছেন,

‘আমার নামের পাশে নির্ভুল বোনা হতো অদ্ভুত লম্বা এক লাল মাফলার।’

 

এই আমি কী চুপকথা? বা আভাসের লবণপঙক্তি? জানি না, নাকি প্রত্যাখানের বেহালা? না, আমি বুঝতে পারছি, এ হলো আমার নখের উপর খোদাই করা ঈশ্বরচূর্ণ। আমি খুঁজতে থাকি ভেতরের সকল অমঙ্গলবোধ। পাই না, কবিতার নিকট ফিরে যাই, ফিরে যাই কবির নিকট যাকে আমি বুঝেছি আপাতআশ্রয়, আমাদের দুজনের– আমার এবং আমার ভেতরের নারীবয়ব।

 

‘আমি মেকী, সেকথা জেনেছি বহু আগে। আমার নীতিহীন শরীরে বাজারী সারল্যের মসলিন, মেধার অন্তর্বাসকে দৃশ্যমানতাই বেশি দিয়েছে বরাবর।’
                                                                                                  [গাভী]

 

শাশ্বত বিষ্ময়বোধের খাঁচায় নিজেকে পুরে ফেলি, বারবার আওড়াই, আমি মেকী, আমি মেকী আমি মূক আমি মূঢ়। বলি, নিজেকে, দ্বিচিত্ররূপিণী।

শাশ্বত বিষ্ময়বোধের খাঁচায় নিজেকে পুরে ফেলি, বারবার আওড়াই, আমি মেকী, আমি মেকী আমি মূক আমি মূঢ়। বলি, নিজেকে, দ্বিচিত্ররূপিণী।

 

‘তবুও আমার পঙক্তিরা খরাপ্রবণ দ্বিপদ থেকেছে অবিচল। প্রেম ও দ্রো্হ সমূহের সময়োচিত প্রসবের অভাবে…’

                                                                                                  [ধুনকি]

 

কবিতার লক্ষণাবতীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকি অনিশ্চল। আমার সম্মুখে ময়ূরের গান আর মনোনারীর নৃত্য।

 

‘যশোধরার বরাদ্দ চিরদিন মহতী সংসার শব, আর, অবতার জন্মের বোধিলাভ নিষ্কন্টক।’
                                                                                                  [বাঁটোয়ারা]

 

জাগতিক বিতৃষ্ণা আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমি আরও দ্রবীভূত হতে থাকি যশোধরায়৷ নিজের অভিষেক ঘটাই নির্বেদে।

 

‘আমি তো শুন্যতা চাইনি সই, তোমায় চেয়েছি। অবান্তরে, আগাছায় যেমন ঈশ্বরী কায়া ভাসে। উনিশতম বারান্দা থেকে বস্তির দোলনা দেখা যায়? যাক না যাক, তবু সে তো থাকে, তেমনই আঙুলে তোমার স্বপ্নভাষ্য বুনেছি। বলো, অপরাধ করেছি?’
                                                                                                  [অপরাধ]

 

আজ আর নয়। আমি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি দ্যুতিখেলার গোলকধাঁধায়, থাকি যতক্ষণ সম্ভব, হয়ে লিলিথজন্মের সূত্র।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম : ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। লেখালেখি করেন প্রাণ থেকে। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: ‘যুদ্ধ ছাড়া শুদ্ধতা অসম্ভব’, ‘অতীতা, দুঃখরা পাখি হয়ে গেল’, ‘বাংলাদেশে হৃদয় মেশে’, অনুজ্জ্বল চোখের রাত (কবিতা)। গল্পগ্রন্থ: ‘রাষ্ট্রধারণার বিরুদ্ধে মামলা ও বিবিধ গল্প’। এই পাণ্ডুলিপির জন্য তিনি জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া, পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতা থেকে ইতিকথা মৈত্রী সাহিত্য সম্মাননা-২০১৭ লাভ করেছেন।।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।