শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

আফ্রোদিতির ইশারা ও অন্যান্য কবিতা : শাহেদ কায়েস

0

আফ্রোদিতির ইশারা


অপেক্ষায় রেখে এসেছি মাছরাঙাকে
নলুয়া হাওরে; ফিরে আসবো, বলেছি

আদৌ ফেরা হবে কি না, জানি না—
মানুষ এমনই— আশ্বাস-ঘাতক, মধু
ফাঁদে বিছিয়ে রাখে প্রতারণা-বিষ

মনে পড়ছে— মৌন ঘোড়াটির কথা
ট্রয়ের বিশাল দারুনির্মিত সেই অশ্ব
বিশ্বাসীরা বলেছিল— নিয়ে এসো…

চারদিকে সাইনন— ভেঙেছে বিশ্বাস
এথিনার জন্য উপহার, মৃত্যুর উপমা

অস্থির সময়, ছুটছে ইনিয়াস, নগরী—
ছেড়ে, দূরে— আফ্রোদিতির ইশারায়


পার্সিফনি


পাহাড়ে-পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বার্তা
হারিয়ে গেছে পার্সিফনি, বসন্তকুমারী

আমিই সেই নার্সিসাস— যে ফুলের
আশ্চর্য সৌরভে বেরিয়ে এলে তুমি…

চাঁদের হেঁয়ালিতে ভেসে গেছে কোথায়—
গোধূলিতে যারা জল নিতে এলো ঘাটে
ঝুঁকে আসে কারো মুছে যাওয়া পদচিহ্ন
কোন দিকে খুলে যাচ্ছে জীবন-নকশা?

পৃথিবীর তলদেশ থেকে উঠে এলো—
ধ্বনি, প্রতিধ্বনি— ঝিলের জলে পত্রদূত
বেদনার শয্যার ভাগ নিয়েছি আমি

স্বপ্নে তুমুল হাতছানি দিচ্ছে দ্রাক্ষালতা
সিরিস, আমাকে গ্রহণ কর, শস্যদেবী।


অর্ফিউস


বৃষ্টি আসে কবিতার ডানায়, ভোরের দিকে
সরে যায় দ্রুত— বিয়োগ রাতের অস্থিরতা

বৃক্ষের আশ্চর্য গণিতে ফুটেছে বৃষ্টির ফুল
সুরবাহারের তারে অর্ফিউসের সুরের মূর্ছনা—
ছুটতে-ছুটতে হঠাৎ— দাঁড়িয়ে যায় বাতাস

পাতালপুরীর আঁধার থেকে আলোর দিকে
সারা পথ পেরিয়ে কেন যে তাকালে পেছনে!

শেষ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বিস্মিত ইউরিডাইস
হরিণীর দেহে ঢুকেই দেখে বাঘিনীর থাবা!

সমুদ্র জলে মিশে যাচ্ছে অর্ফিউসের দুঃখ—
দয়িতার অকাল বিচ্ছেদের গাঁথা

বৃষ্টিভোরে অনাদরে পড়ে আছে সুরবাহার
রাতদিন গান গায় বুলবুলিরা কবরে তাঁর।


কৃষ্ণ-হাত


যে বাঁধনে ছিলে রাখিপূর্ণিমার রাতে
ছিন্ন হল কোন অচিন সুতোর টানে!

ফিরে আসে শৈশব-স্মৃতির উত্তাপ
খুঁজে ফিরি— সূর্যোদয়ের ভাইবোন

জ্বলছে জহর ব্রত, কোথায় হূমায়ুন!
রক্ষা কি পেল রাজপুত কর্ণাবতী?
মাঝে কাঁটাতার— এপার, ওপার…

যদিও শ্রাবণে পড়েছে ভাদ্রের ছায়া
তবুও দোলে মায়াবী সুতো, শপথের
প্রতীক;— নন্দের বাহুর রক্তজবায়
উড়ে বসে দ্রৌপদীর ছেঁড়া আঁচল

যতবার ফিরে আসে পাশাখেলা—
বর্ম হয়ে এগিয়ে আসে কৃষ্ণ-হাত।


রূপান্তর


উচ্চারিত কথা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে
চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে দরোজায়
কোনও কোনও কথা স্পষ্ট করে জবাব চায়

ভেঙে গেলে সম্পর্কের সংযুক্তি, বাণিজ্যিক—
অভ্যাসে পরিণত হয় কাঙ্ক্ষিত যৌথতাও
হাওয়া পায় প্রেমনিরোধক কথা

চিঠিবৃক্ষে দোল খায় নির্বিষ কথার বর্ণমালা
কথা-মেটামরফোসিসে জন্ম নেয় ভিন্ন কথা

নদীর বাঁকে পলি জমার মতো ফেলে যাওয়া—
তোমার নিঃশব্দ কথার স্পর্শ পাই।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

মূলত কবি। জন্ম ঢাকায়, ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭০। পৈতৃক নিবাস, সোনারগাঁয়ের ললাটি গ্রামে। পড়াশুনা কম্পিউটার বিজ্ঞানে, দক্ষিণ ভারতের চেন্নাই; এরপর দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজু শহরে, চোন্নাম ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘হিউম্যান রাইটস’ বিষয়ে মাস্টার্স। কবিতায় হাতেখড়ি নব্বই দশকের শুরুতে। থাকেন নিজ গ্রাম সোনারগাঁয়। পেশা ফ্রি-ল্যান্স গবেষক। তিনি একজন মুক্ত-চিন্তক, সংস্কৃতিকর্মী, কাজ করেন মানুষের অধিকার নিয়ে। শখ ভ্রমণ, সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ান দেশ-বিদেশ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ‘বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা’ (দোয়েল প্রকাশনী, ১৯৯৯) ‘চূড়ায় হারানো কণ্ঠ’ (মঙ্গলসন্ধ্যা, ২০০৩), ‘মায়াদ্বীপ’ (ঐতিহ্য, ২০১৫), ‘কৃষক ও কবির সেমিনার’ (অভিযান, ২০২০), ‘সহজিয়া প্রেমের কবিতা’ (অভিযান, ২০২১), ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’ (চৈতন্য, ২০২৩), ‘স্বনির্বাচিত কবিতা’ (ভাষাচিত্র, ২০২৩)। সম্পাদিত গ্রন্থ: ‘মঙ্গলসন্ধ্যা প্রেমের কবিতা’ (ধ্রুবপদ, ২০১৭)। অন্যান্য গ্রন্থ: ‘এশিয়ার বারটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ (ইংরেজি গ্রন্থ, মে এইটিন মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন, দক্ষিণ কোরিয়া, ২০১৫), ‘বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম স্মরণগ্রন্থ’ (ঐতিহ্য, একুশে বইমেলা, ২০২০)। পুরস্কার ও সম্মাননা: ‘চন্দ্রাবতী সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’ (কবিতায়, ২০২১), শালুক সম্মাননা (২০১৯)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।