বৃহস্পতিবার, এপ্রিল ১৮

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প : ভালোবাসার ওপারে মৃত্যু অচঞ্চল

0

মৃত্যুর ছয় মাস এগারো দিন বাকি থাকতে জীবনের কাঙ্ক্ষিত নারীর দেখা পেলেন সিনেটর ওনেসিমো সানচেজ। দেখা হলো রোজাল ডেল ভিরি নামের বিভ্রম জাগানো এক গ্রামে, রাতে যেটি চোরাচালানিদের গোপন জাহাজঘাটা, অথচ দিনের আলোয় মরুভূমির নেহাতই গুরুত্বহীন এক খাঁড়ি, পড়ে আছে বিশুষ্ক আর দিকচিহ্নহীন এক সমুদ্রের দিকে মুখ করে। সবকিছু থেকেই জায়গাটা এত দূরে যে কারো নিয়তিকে বদলে দেওয়ার মতো কেউ থাকতে পারে ওখানে, এ ভাবনা কারো মাথাতেই আসবে না। এমনকি এর নামটিও এক ধরনের তামাশা, কারণ লরা ফারিনার সঙ্গে যে বিকেলে দেখা হলো, গ্রামের একমাত্র গোলাপটি পরে ছিলেন সিনেটর ওনেসিমো সানচেজ নিজেই।

নির্বাচনী সফরে বছর চার পরপর এ গ্রামে আসা তাঁর, চাইলেও এড়াতে পারেন না। কার্নিভালের মালগাড়িগুলো সকালেই এসে পৌঁছেছে। ভাড়া করা ইন্ডিয়ানদের নিয়ে ট্রাকগুলো এসেছে পেছন পেছন, জনসমাগম বড়ো করে দেখানোর প্রয়োজনেই তাদের আনা। মন্ত্রীমহোদয়ের স্ট্রবেরি সোডা রঙের গাড়িটি এসে পৌঁছোল আটটার কিছু আগে— গানবাজনা, হাউইবাজি আর সিনেটরের সাঙ্গপাঙ্গদের জিপগাড়িগুলোকে সাথে করে। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গাড়ির ভেতর প্রসন্ন, নিরুদ্বিগ্ন চেহারায় বসে ছিলেন সিনেটর ওনেসিমো সানচেজ, যদিও দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের একটা হলকা এসে কাঁপিয়ে দিল তাকে। খাঁটি রেশমে তৈরি শার্টটি হালকা ঝোলের রঙে ভিজে চুপসে গেল আর নিজেকে বিষম বুড়ো আর নিঃসঙ্গ মনে হলো তার। মাত্র বিয়াল্লিশে পড়েছেন যদিও, ধাতু-প্রকৌশলে সম্মানসহ স্নাতক করেছেন গটিনজেন থেকে, ভালোবাসেন দুর্বল অনুবাদে লাতিন ধ্রুপদী সাহিত্য পড়তে, অবশ্য এ কাজে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। বৌ তাঁর ঝলমলে এক জার্মান নারী, সিনেটরের পাঁচ-পাঁচটি সন্তানের মা। বাড়িতে সবাই সুখী, সবচেয়ে সুখী ছিলেন ওনেসিমো নিজে, অন্তত মাসতিনেক আগেও-আগামী বড়োদিনের আগেই চিরদিনের জন্য পটল তুলবেন, একথা জানার আগ পর্যন্ত।

গণমিছিলের প্রস্তুতিপর্ব শেষ হবার তোড়জোড়ের মধ্যেই তাঁর বিশ্রামের জন্য ঠিক করে রাখা বাড়িটায় ঘণ্টাখানেক নিরালায় থাকার ফুরসত পেলেন সিনেটর। বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার আগ মুহূর্তে গোলাপটাকে এক গ্লাস খাবার পানিতে চুবালেন; মরুভূমি পাড়ি দেওয়ার পুরো সময়টা বাঁচিয়ে রেখেছেন ওটাকে। তারপর ডায়েট সিরিয়াল খেতে শুরু করলেন, বাকি দিন তাঁর অপেক্ষায় থাকা শুকনো ছাগমাংস দফায় দফায় উদরস্থ করার ব্যাপারটাকে এড়ানোর জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গিলে নিলেন কয়েকটি ব্যথানাশক, ব্যথা হামলে পড়ার আগেই যাতে প্রস্তুত থাকে নিরাময়। দোল-বিছানার কাছে টেনে রাখলেন বৈদ্যুতিক পাখাটিকে, তারপর গোলাপের ছায়ায় নগ্ন হয়ে শুয়ে থাকলেন মিনিট পনের। ঝিমুনির সময়টায় মৃত্যুচিন্তা থেকে মনকে সরিয়ে রাখার কঠিন এক মানসিক প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকলেন। তাঁর জন্য যে নির্দিষ্ট একটি সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেটি ডাক্তাররা ছাড়া কেউ জানে না। ঠিক করেছেন, গোপন এই ব্যাপারটার মধ্য দিয়ে একাই যাবেন, কিছুই পাল্টাবেন না জীবনের। কারণটা অহংকার নয়, লজ্জা।

বেলা তিনটায় বিশ্রাম সেরে সাফসুতরো হয়ে ভারি লিনেনের পাজামা আর ফুলপাতার নকশা করা শার্ট পরে আবার যখন জনতার সামনে হাজির হলেন, নিজের স্বাধীন সত্তা পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে তাঁর, ব্যথানাশকের প্রভাবে আত্মাও ফের সতেজ। তবে যা ভেবেছিলেন মৃত্যুর কুরে কুরে খাওয়া তার চেয়েও ভয়ঙ্কর, কারণ মঞ্চে ওঠার সময় তাঁর সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করা লোকগুলোর প্রতি অদ্ভুত এক বিবমিষা অনুভব করলেন। তাছাড়া অন্যসময় শোরা-কয়লা বিছানো বন্ধ্যা, খুদে চত্বরটির গনগনে গরমে নাঙা পায়ের ইন্ডিয়ানগুলোর দুর্দশায় সহানুভূতির যে বোধটি জাগত তা আর জাগল না। খানিকটা যেন রাগের সঙ্গেই হাত ঝাপটা দিয়ে বন্ধ করলেন জনতার করতালি, তারপর কোনোরকম অঙ্গভঙ্গি ছাড়াই কথা বলতে শুরু করলেন, দু’ চোখ স্থির হয়ে আছে তীব্র গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকা মরুসমুদ্রে। সিনেটরের মাপা, ভারী গলার মধ্যে শান্ত জলধারার একটা ভাব আছে, অবশ্য বহুবার মুখস্থ করা ও উগরে দেওয়া এই বক্তৃতাকে সত্যবচনের কোনো মাধ্যম বলে মনে হয়নি তার, বরং মনে হয়েছে মেডিটেশন-এর চতুর্থ পুস্তকে মার্কাস অরেলিয়াস অদৃষ্টবাদী যে ফয়সালা দিয়েছিলেন তার উল্টোটা।

বক্তৃতার সময় তাঁর স্যাঙ্গাতেরা শূন্যে কাগজের পাখি ছুঁড়ে মারে, প্রাণহীন জীবগুলো প্রাণ ধারণ করে, তক্তা দিয়ে বানানো মঞ্চের ওপর উড়ে বেড়ায়, শেষে চলে যায় সমুদ্রের দিকে।

‘এখানে আমরা সমবেত হয়েছি প্রকৃতিকে পরাস্ত করতে,’ —শুরু করলেন তিনি, যা বলছিলেন তার একটা শব্দও বিশ্বাস করেন না। ‘নিজেদের মাটিতে আর বেওয়ারিশ হয়ে থাকব না। জলতেষ্টা আর জঘন্য আবহাওয়ার এই দেশে খোদার এতিম সন্তান হবো না, নিজ ভূমে পরবাসীও না। আমরা হবো ভিন্ন এক জাতি, ভদ্রমহিলা ও মহোদয়েরা, মহান এবং সুখী এক জাতি।’ সিনেটরের এই খেলতামাশার একটা ছক আছে। বক্তৃতার সময় তাঁর স্যাঙ্গাতেরা শূন্যে কাগজের পাখি ছুঁড়ে মারে, প্রাণহীন জীবগুলো প্রাণ ধারণ করে, তক্তা দিয়ে বানানো মঞ্চের ওপর উড়ে বেড়ায়, শেষে চলে যায় সমুদ্রের দিকে। এই ফাঁকে মালগাড়ি থেকে পশম দিয়ে বানানো পাতাওয়ালা কয়েকটা গাছ নামিয়ে আনে কয়েকজন চ্যালা, জনতার পেছনে শোরাভর্তি মাটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড় করায় ওগুলোকে। তাদের শেষ কাজ হচ্ছে কার্ডবোর্ড দিয়ে বানানো নকল ঘরবাড়ি লাগানো একটা বেড়া ঠেকনা দিয়ে বসানো। কাচের জানালা আর লাল ইটের বাড়িগুলোকে অবিকল আসলের মতো মনে হয়। আশেপাশের সবগুলো ঝুপড়ি বাড়ি সকল বাড়ি দিয়ে ঢেকে ফেলল চ্যালারা।

বক্তৃতার মধ্যে দুটো লাতিন উদ্ধৃতি ঢুকিয়ে তামাশাটাকে আরেকটু লম্বা করলেন সিনেটর। বৃষ্টি নামানোর যন্ত্র, গবাদিপশুর বাচ্চা জন্মানো যায় আবার সহজে বহনও করা যায় এমন যন্ত্র, শোরার মাটিতেও সব্জি ফলানো যায় এমন সুখতেল এবং জানালার পাশে ফুলের বাক্সের মধ্যে প্যানজি লতার ঝাড়— গালভরা হরেক প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনি। চ্যালারা কল্পকাহিনির ভুবন বানানো শেষ করেছে খেয়াল করে আঙ্গুল তাক করলেন সেদিকে। ‘ভাই ও বোনেরা, এই হবে আমাদের ভবিষ্যৎ,’ গলার স্বর চড়ালেন তিনি, ‘দেখুন! আমাদের ভবিষ্যৎ হবে এমন!’

জনতা ঘাড় ফেরাল। রঙিন কাগজ দিয়ে বানানো সমুদ্রগামী একটি জাহাজ বাড়িগুলোর পেছন দিয়ে যাচ্ছে, কার্ডবোডে আঁকা সবচেয়ে উঁচু বাড়িটার চেয়েও যা উঁচু। কেবল সিনেটরই লক্ষ করলেন, যেহেতু বারবার খুলে নানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ওগুলোকে, কার্ডবোর্ডের কৃত্রিম শহরটির গায়েও কামড় বসিয়েছে লু হাওয়া। রোজাল ডেল ভিরির মতোই বিবর্ণ ও ধূলিমলিন দেখাচ্ছে ওটাকে এখন।

বারো বছরে এই প্রথমবারের মতো সিনেটরকে স্বাগত জানাতে গেল না নেলসন ফারিনা। অমৃসণ তক্তা দিয়ে বানানো বাড়ির শীতল ছায়ায় নিজের দোল-বিছানায় শুয়ে ভাতঘুমের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তার ভেতর থেকেই বক্তৃতাটা শুনল। ফার্মাসিস্টের যে দক্ষ হাতে বাড়িটা বানিয়েছে সে হাতেই নিজের প্রথম বৌকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিল সে। শয়তানের দ্বীপ থেকে পালিয়ে আসা মানুষ সে, জাহাজভর্তি নিরীহ কাকাতুয়া আর সুন্দরী তবে মুখ খারাপ এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে নিয়ে এসে ভিড়েছিল রোসাল ডেল ভিরিতে। প্যারামারাইবোতে পেয়েছিল মহিলাকে, যার গর্ভে এক কন্যার জন্ম হয়েছিল তার। ক’দিন পরই স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটল মহিলার। সতিনের মতো দুর্ভাগ্য পোহাতে হয়নি তাকে, যার শরীরের টুকরোগুলো তার নিজের বাঁধাকপির ক্ষেতে সার জুগিয়েছিল। বরং গোটা শরীর আর নিজের ওলন্দাজ নামসমেত কবরস্থ হয়েছিল সে স্থানীয় গোরস্তানে। মায়ের গায়ের রঙ ও শরীর দুটোই পেয়েছে মেয়ে, সঙ্গে বাবার হলুদ, হতবিহ্বল চোখ। দুনিয়ার সবচেয়ে রূপসী নারীকে পেলেপুষে বড়ো করছে, এ ভাবনা ভাবার পুরোই এখতিয়ার ছিল নেলসন ফারিনার।

ফার্মাসিস্টের যে দক্ষ হাতে বাড়িটা বানিয়েছে সে হাতেই নিজের প্রথম বৌকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করেছিল সে। শয়তানের দ্বীপ থেকে পালিয়ে আসা মানুষ সে, জাহাজভর্তি নিরীহ কাকাতুয়া আর সুন্দরী তবে মুখ খারাপ এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীকে নিয়ে এসে ভিড়েছিল রোসাল ডেল ভিরিতে।

সিনেটরের প্রথম নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় পরিচয় হয়েছিল তার সঙ্গে, তখন থেকেই আইনের হাত থেকে বাঁচতে নিজের জন্য ভুয়া একটি পরিচয়পত্রের তদবির করে আসছে ফারিনা। মেজাজ দেখিয়ে না হলেও, শক্তভাবেই ‘না’ করেছে সিনেটর। হাল ছাড়েনি নেলসন ফারিনা। কয়েক বছর ধরে যখনই সুযোগ পেয়েছে অনুরোধটা করে গেছে। সিনেটরের জবাবও বরাবরই ছিল একই। এ কারণে দোল-বিছানাতেই শুয়ে থাকল সে এবার, বোম্বেটেদের জ্বলন্ত গুহায় জ্যান্ত পচে মরার দণ্ডপ্রাপ্তের মতো। জনতার শেষ করতালি শোনার পর মাথা তুলল সে, বেড়ার তক্তাগুলোর ওপর দিয়ে সিনেটরের সার্কাসের পেছন দিকটা চোখে পড়ল: ভুয়া বাড়ি ঠেকনা দেওয়ার খুঁটি, গাছের কাঠামো, জাহাজ ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাওয়া লুকোনো দড়াবাজের দল। মেজাজ খারাপ না করেই একদলা থু থু ফেলল সে।
‘শা-লা!’ বিড়বিড় করল সে, ‘রাজনীতির কিম্ভুত এক চিজ!’
বক্তৃতার পর বরাবরের নিয়ম মেনে বাদ্যবাজনা আর হাউইবাতির মধ্য দিয়ে শহরের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেন সিনেটর, তাঁকে ঘিরে ধরে নিজেদের দুর্দশার কথা জানাল শহরবাসী। খোশমেজাজে শুনলেন সব সিনেটর। দুঃসাধ্য হবে এমন কোনো উপকার না করে মানুষকে ঠান্ডা করার একটা না একটা উপায় ঠিকই বের করে ফেলেন তিনি।
সবচেয়ে ছোটো ছয় বাচ্চাকে নিয়ে ছাদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা হট্টগোল আর পটকার শব্দকে ছাপিয়ে সিনেটরের কানে নিজের কথাকে পৌঁছে দিতে পারল।
‘বেশি কিছু চাইছি না সিনেটর,’ সে বলল। ‘ফাঁস দেওয়া মানুষের কুয়ো থেকে পানি আনার জন্য একটা গাধা কেবল।’
হাড় জিরজিরে বাচ্চা ছ’টাকে লক্ষ করলেন সিনেটর। ‘তোমার স্বামী কোথায়?’ শুধালেন তিনি।
‘ধনসম্পদের খোঁজে আরুবা দ্বীপে গেছে,’ সকৌতুকে বলল মহিলা, ‘তবে ওখানে গিয়ে যা পেয়েছে সেটা হলো দাঁতের মধ্যে হীরা লাগায় এমন এক বিদেশি মহিলা।’
মহিলার উত্তরটা হাসির হল্লা তুলল চারপাশে।
‘ঠিক আছে,’ সিদ্ধান্ত নিলেন সিনেটর, ‘তোমার গাধা তুমি পাবে।’
খানিক পর সিনেটরের এক সহচর মহিলার বাড়িতে একটা গাধা পৌঁছে দিল, ওটার পাছায় অমোচনীয় কালিতে নির্বাচনী স্লোগান লেখা— এটি যে সিনেটরের উপহার সেটা যাতে কখনও কেউ না ভোলে।
নাতিদীর্ঘ রাস্তা ধরে যেতে যেতে ছোটোখাটো এমন আরো কয়েকটি উপকার করলেন সিনেটর। এমনকি এক বুড়োকে এক চামচ ঔষধও দিলেন, সিনেটরকে দেখার জন্য বুড়োকে তার বিছানাসহ দরজার কাছে নিয়ে আসা হয়েছিল। রাস্তার শেষ মাথায় কার্ডবোর্ড লাগানো বেড়ার ফাঁকে দোলবিছানায় পাংশুটে আর বিষণ্ন মুখে শুয়ে থাকা নেলসন ফারিনাকে চোখে পড়ল সিনেটরের। চেহারায় দয়ামায়ার কোনো ভাব না ফুটিয়ে তাকে সম্ভাষণ জানালেন সিনেটর, ‘কী খবর, কেমন আছ?’
দোলবিছানা থেকে ঘাড় ফিরিয়ে বিষণ্ন হলুদাভ চোখে সিনেটরের দিকে তাকাল নেলসন ফারিনা। ‘জানেনইতো কেমন আছি।’

সিনেটরের গলা শুনে উঠোনে বেরিয়ে এলো নেলসনের মেয়ে। ইন্ডিয়ানদের ঢঙে সস্তা একটা আলখেল্লামতো পরনে তার, মাথায় রঙিন ফিতা, রোদ থেকে সুরক্ষার জন্য চেহারায় রঙ মাখা। কিন্তু এমন দৈন্যদশা সত্তেও গোটা দুনিয়ায় তার তুল্য সুন্দরী যে আর নেই সেটি বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল না। সিনেটরের দম আটকে এলো।
‘তাজ্জব ব্যাপার!’ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হবার অবস্থা তার, ‘খোদার কেরামতি বোঝে কার সাধ্য!’
সে রাতে মেয়েকে তার সেরা পোশাকে সাজিয়ে গুছিয়ে সিনেটরের কাছে পাঠাল নেলসন ফারিনা। সিনেটরের ধার করা বাড়িতে গরমে ঝিমোতে থাকা বন্দুকধারী দুই প্রহরী হলঘরে রাখা একমাত্র চেয়ারে অপেক্ষা করতে বলল তাকে।
পাশের ঘরে রোসাল ডেল ভিরির হোমরাচোমরাদের সঙ্গে সভায় ব্যস্ত ছিলেন সিনেটর। বক্তৃতা থেকে যেসব সত্য বাদ পড়ে গেছে সেগুলো শোনানোর জন্যই তাদের ডেকে এনেছেন তিনি। মরুশহরগুলোতে দেখা হওয়া বাকি মানুষজনের সঙ্গে এ লোকগুলোর এত মিল যে রাতের পর রাত ধরে চলা এসব সভা রীতিমতো অসুস্থ আর ক্লান্ত করে তোলে সিনেটরকে। পরা অবস্থাতেই ঘামে ভেজা শার্টটাকে বৈদ্যুতিক পাখার গরম বাতাসে শুকানোর চেষ্টা করছিলেন, দম আটকানো গরমের মধ্যে যেটা গোঁ গোঁ করছিল ডাঁশপোকার মতো।

‘বলাই বাহুল্য, আমাদের পক্ষে কাগজের পাখি খাওয়া সম্ভব নয়,’ তিনি বললেন। ‘আমি যেমন জানি তোমরাও জানো যে, এই গোবরের গাদার মধ্যে যেদিন গাছ আর ফুল জন্মাবে আর কুয়াগুলোতে পোকার বদলে শ্যাড মাছ পাওয়া যাবে সেদিন তোমাদের বা আমার কারোরই করার কিছু থাকবে না এখানে। বোঝাতে পেরেছি ব্যাপারটা?’
জবাব দিল না কেউ।

কথার ফাঁকে ক্যালেন্ডার থেকে একটা পাতা নিয়ে সেটা দিয়ে কাগজের একটা প্রজাপতি বানিয়ে ফেলেছিলেন সিনেটর। তাক না করেই পাখার বাতাসের মধ্যে ছুঁড়ে মারলেন সেটাকে। প্রজাপতিটা ঘরের মধ্যে খানিকক্ষণ উড়ে আধখোলা দরজা দিয়ে চলে গেল বাইরে। মৃত্যুর যোগসাজশে প্রবল এক আত্মবিশ্বাস ভর করেছে সিনেটরের গলায়। ‘অতএব,’ তিনি বললেন, ‘ইতোমধ্যে যা জানো নতুন করে বলতে চাই না সেটা। আমি আবার নির্বাচিত হলে যতটা না আমার তার চেয়ে বেশি ফায়দা হবে তোমাদের, কারণ জলাবদ্ধতা আর ইন্ডিয়ানদের ঘাম আমার জন্য বিরক্তিকর, অন্যদিকে তোমাদের রুটি রুজিই টিকে আছে এর ওপর।

কাগজের প্রজাপতিটাকে বেরিয়ে আসতে দেখল লরা ফারিনা। তার চোখেই পড়ল ওটা, কারণ প্রহরী দুজন বন্দুক বগলদাবা করে ঘুমিয়ে পড়েছে হলঘরের সিঁড়িতেই। কয়েকবার চক্কর মারার পর লিথোগ্রাফ করা বিরাট প্রজাপতিটার ভাঁজগুলো খুলে এলো এক এক করে, তারপর দেয়ালে গায়ে সেঁটে রইল ওটা। নখ দিয়ে সেটাকে দেয়াল থেকে তুলে আনার চেষ্টা করল লরা ফারিনা। ভেতরের করতালির শব্দে ঘুম ভেঙেছে প্রহরীদের একজনের, মেয়েটার ব্যর্থ চেষ্টা লক্ষ করল সে।
‘খুলবে না,’ ঘুমজড়ানো গলায় বলল সে, ‘ওটা দেয়ালে রং করা।’
মানুষজন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করতেই ফের বসে পড়ল লরা ফারিনা। হুড়কোতে হাত দিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল সিনেটর, হলঘর পুরো খালি হতে মেয়েটাকে চোখে পড়ল তার।
‘এখানে কী করছ তুমি?’
‘আমার বাবা পাঠালেন,’ লরা ফারিনা বলল।
সিনেটর বুঝলেন। ঘুমন্ত প্রহরীদের জরিপ করলেন তিনি, তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন লরা ফারিনাকে। নিজের ব্যথা-বেদনার তুলনায় মেয়েটার অস্বাভাবিক সৌন্দর্যই বেশি গুরুত্ব পেল তাঁর কাছে। মৃত্যুই তার হয়ে সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিয়েছে, সিদ্ধান্তে এলেন তিনি।
‘ভেতরে এসো,’ মেয়েটির উদ্দেশে বললেন সিনেটর।
চৌকাঠে পা দিয়েই হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল লরা ফারিনা, শূন্যে ভাসছে হাজার হাজার টাকার নোট, ডানা ঝাপটাচ্ছে প্রজাপতির মতো। ফ্যান বন্ধ করে দিলেন সিনেটর, বায়ুশূন্যতার কারণে নোটগুলো ধীরে ধীরে নেমে এলো কক্ষের নানা জিনিসপত্রের ওপর।
‘দেখলে তো, বিষ্ঠাও উড়তে পারে,’ হেসে বললেন সিনেটর।
ছোট্ট একটা টুলে বসল লরা ফারিনা। ত্বক তার মসৃণ ও টানটান, রং যার মাটির নিচ থেকে তুলে আনা তেলের মতো, ঘনত্বও সেরকম। তরুণী মাদি ঘোড়ার কেশরের মতো চুল তার, বিশাল দুই চোখ আলোর চেয়েও জ্বলজ্বলে। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে গোলাপটার দিকে তাকালেন সিনেটর, শোরার কারণে রং জ্বলে গেছে যার।
‘একটা গোলাপ,’ সিনেটর বললেন।
‘হ্যাঁ,’ দ্বিধাজড়ানো গলায় বলল মেয়েটা, ‘রিওহাচায় থাকতে গোলাপ চিনেছিলাম।’
একটা খাটিয়ায় বসলেন সিনেটর, গোলাপের কথা বলতে বলতে বোতাম খুলতে লাগলেন শার্টের। ভেতরে হৃৎপিণ্ডটা যেখানে বলে তার ধারণা বুকের সেখানটায় জলদস্যুদের একটা উল্কি আঁকা, তীরবিদ্ধ হৃৎপিন্ডের। ঘামে ভেজা শার্টটাকে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে জুতো খোলায় লরা ফারিনাকে সাহায্য করতে বললেন তিনি। খাটিয়ার দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসল মেয়েটা। চিন্তাক্লিষ্ট চোখে তাকে ফের জরিপ করতে শুরু করেছেন সিনেটর। যখন তাঁর জুতোর ফিতে খুলছে মেয়েটা, তিনি ভাবতে শুরু করলেন এই সাক্ষাতের দুর্ভাগ্যটা দুজনের কার ওপর চাপবে।
‘বাচ্চা মেয়ে তুমি একটা,’ তিনি বললেন।
‘বিশ্বাস করবেন না,’ মেয়েটা বলল। ‘এই এপ্রিলে উনিশে পড়ব।’
আগ্রহী দেখাল সিনেটরকে। ‘কত তারিখে?’
‘এগারো,’ জবাব দিল মেয়েটি।

ওদিকে সিনেটরও বুঝতে পারছিলেন না লরা ফারিনাকে নিয়ে কী করবেন। আকস্মিক প্রণয়ের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই, তাছাড়া তিনি বুঝতে পারছিলেন এ প্রণয়ের জন্ম অসম্মানে। ভাবার জন্য কিছুটা সময় পাওয়ার আশায় দুই হাঁটুতে চেপে ধরে কোমরের কাছটায় জড়িয়ে ধরলেন মেয়েটিকে, তারপর চিৎ হয়ে শুলেন খাটিয়ায়। তখনই বুঝলেন, পোশাকের নিচে কিছু পরেনি মেয়েটি

ভালো বোধ করলেন সিনেটর। ‘দুজনেই মেষ রাশি আমরা,’ তারপর মৃদু হেসে যোগ করলেন, ‘এ হলো নিঃসঙ্গতার প্রতীক।’
তাঁর কথায় মনোযোগ ছিল না লরা ফারিনার। কারণ সিনেটরের জুতো নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না সে। ওদিকে সিনেটরও বুঝতে পারছিলেন না লরা ফারিনাকে নিয়ে কী করবেন। আকস্মিক প্রণয়ের অভিজ্ঞতা তাঁর নেই, তাছাড়া তিনি বুঝতে পারছিলেন এ প্রণয়ের জন্ম অসম্মানে। ভাবার জন্য কিছুটা সময় পাওয়ার আশায় দুই হাঁটুতে চেপে ধরে কোমরের কাছটায় জড়িয়ে ধরলেন মেয়েটিকে, তারপর চিৎ হয়ে শুলেন খাটিয়ায়। তখনই বুঝলেন, পোশাকের নিচে কিছু পরেনি মেয়েটি, কারণ শরীর থেকে বুনো প্রাণীর গভীর ঘ্রাণ ভেসে আসছিল তার, বুকটা ধুকপুক করছিল আর ত্বকের লাবণ্য নষ্ট করছিল ঠান্ডা ঘাম।
‘কেউ ভালোবাসে না আমাদের,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি।
কিছু বলার চেষ্টা করল লরা ফারিনা, তবে দম খুঁজে পেল না কথা বলার। মেয়েটিকে সাহায্য করার জন্য তাকে পাশে শোয়ালেন সিনেটর, নিবিয়ে দিলেন বাতি। গোলাপের ছায়ায় ঢাকা পড়ল ঘর। নিয়তির করুণার হাতে নিজেকে ছেড়ে দিল মেয়েটা। হালকা করে আদর করলেন তাকে সিনেটর, তার শরীরের ইতিউতি অনুসন্ধান করলেন প্রায় স্পর্শ না করেই, তবে যেখানে তাকে খুঁজে পাওয়ার আশা করেছিলেন সেখানটায় লোহার মতো কিছু একটা বাধা হয়ে দাঁড়াল।
‘কী ওখানে?’
‘একটা তালা,’ মেয়েটা বলল।
‘মানে?’ সক্রোধে বলে উঠল সিনেটর। যদিও ঘটনা তাঁর কাছে পরিষ্কার তবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাবি কোথায় এটার?’
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল লরা ফারিনা। ‘বাবার কাছে,’ বলল সে। ‘চাবির জন্য আপনার কোনো লোককে পাঠাতে বলেছে, সেইসঙ্গে তার ঝামেলাটা দূর করে দেবেন এই লিখিত প্রতিশ্রুতিও।’
মেজাজ তেঁতে উঠল সিনেটরের। ‘দুষ্টু বেজন্মা,’ খেপে আগুন হয়ে বিড়বিড় করলেন তিনি। চোখ বন্ধ করে আত্মসংবরণের চেষ্টা করলেন, আর তখনই অন্ধকারে দেখা হলো নিজের সঙ্গে। মনে রেখো, নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিলেন তিনি, তুমি বা আর যে-ই হোক, মরার বেশি দেরি নেই, মৃত্যুর কদিন পর নামেরও পাত্তা থাকবে না তোমার। কাঁপুনিটা থামার জন্য অপেক্ষা করলেন তিনি।
‘একটা কথা বলো আমাকে,’ বললেন, ‘আমার সম্বন্ধে কী শুনেছ তুমি?’
‘একদম খাঁটি সত্য কথাটি শুনতে চান?’
‘খাঁটি সত্য কথা।’
‘আসলে,’ বলল লরা ফারিনা, ‘লোকে বলে আপনি অন্যদের চেয়েও খারাপ, যেহেতু আপনি অন্যরকম।’
বিচলিত হলেন না সিনেটর। চোখ বন্ধ করে চুপ করে রইলেন দীর্ঘক্ষণ, ফের যখন চোখ খুললেন, মনে হলো নিজের গভীর গোপনে লুকানো প্রবৃত্তির বুড়ি ছুঁয়ে ফিরে এসেছেন।
‘কী আসে যায়,’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি, ‘তোমার বেজন্মা বাপকে বলো তার ঝামেলা দূর করব আমি।’
‘আপনি বললে আমি নিজেই গিয়ে চাবি নিয়ে আসতে পারি,’ লরা ফারিনা বলল।
তাকে উঠতে দিলেন না সিনেটর। ‘ভুলে যাও চাবির কথা। আমার সঙ্গে শুয়ে থাকো কতক্ষণ। এমন নিঃসঙ্গতার মধ্যে কেউ একজনকে কাছে পাওয়াটা আরামের।’

মেয়েটি মাথা রাখল তাঁর কাঁধে, চোখদুটো স্থির হয়ে আছে গোলাপের ওপর। মেয়েটির কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে তার বুনোপ্রাণীর গন্ধমাখা বগলে মুখ গুঁজলেন সিনেটর, নিজেকে সমর্পণ করলেন ভয়ের রাজ্যে। ছয় মাস এগারো দিন পর ঠিক এ অবস্থাতেই মারা যাবেন তিনি, লরা ফারিনার সঙ্গে কেলেঙ্কারির কারণে অধঃপতিত ও প্রত্যাখ্যাত অবস্থায়, মেয়েটিকে ছাড়াই মরতে হচ্ছে এ ক্ষোভে কাঁদতে কাঁদতে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ফেনীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। বর্তমানে একই বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। লেখালেখির শুরু নব্বইয়ের দশকের শুরুতে, পত্রপত্রিকায়। গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি ইতিহাস, তথ্যপ্রযুক্তি, ছোটোদের জন্য রূপকথা নানা বিষয়ে লিখেছেন। বিশেষ আগ্রহ অনুবাদে। সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার’ ছাড়াও ইতিহাসভিত্তিক কয়েকটি বই অনুবাদ করেছেন। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বাইশ।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।