শনিবার, এপ্রিল ২০

চমকদার দাঁতের মাজন ও অন্যান্য গল্প : আহমেদ খান হীরক

0

চমকদার দাঁতের মাজন


ফিরছিলাম।

রাস্তায় বিক্রি হচ্ছে ‘চমকদার দাঁতের মাজন’। দাঁত আমার হলুদ আছে তাও কম দিনের না। হলুদ দাঁত দিয়ে আমার যে চলে যাচ্ছিল না, তা না। খাচ্ছিলাম, কুলকুচি করছিলাম, শিরশিরে ছিল না। তবু রং তো হলুদ!

মাজনঅলা আমাকে পেয়ে খুশি। পাঁচ মিনিটে দাঁত অর্ধেক শাদা হয়ে যাবে, পাঁচ দিনে বাকি অর্ধেক।

আমি ফুটপাতেই দাঁত মাজলাম। মাজনঅলা আয়না দেখালো। দাঁত ঝকঝকে বটে!

পরের পাঁচ দিন অহোরাত্রি দাঁত মাজি। কী তামশা! দাঁত ফকফকা!

১০ টাকার মাজনে ১০ লাখ টাকার কাজ। আমি দিলখুশ মানুষ। মাজনঅলাকে গিয়ে ১০০ টাকা বকসিস দিয়ে এলাম।

অফিসের সবাইকে বললাম চমকদার দাঁতের মাজনের কথা। তাদের কেউ কেউ কিনল। পাঁচ দিনে দাঁত চমকালো!

বন্ধুদের সবাইকে বললাম চমকদার দাঁতের মাজনের কথা।

তাদের কেউ কেউ কিনল। পাঁচ দিনে দাঁত চমকালো!

কিন্তু মাস খানেক যেতে না যেতেই আমার দাঁত নড়তে শুরু করল। মাড়ির একটা দাঁত হাড় চিবাতে গিয়ে খসে গেল। সামনের একটা দাঁত ঝুলতে শুরু করল। অহোরাত্রি নয়টা দাঁতে ব্যথা।

আমি মাজনঅলার কাছে ছুটে গেলাম। মাজনঅলা তখনও মাজন বেচছে। অনেক ভিড় তাকে ঘিরে। সবাই তাদের দাঁতের উন্নয়ন চায়। চকচক উন্নয়ন। সবাই দাঁত মাজছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে।
আমি বললাম— এইটা ভুল উন্নয়ন। এইভাবে দাঁত চকচকাবে শুধু। দাঁত টিকবে না!

আশ্চর্য! ওরা আমাকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে বাতাসে মিলিয়ে দিল। আমি হয়তো ওদের কামড়ে দিতে পারতাম, কিন্তু তত দিনে আমার কোনো দাঁতই অবশিষ্ট ছিল না!


এক্সট্রা


সিনটা সিম্পল। মিজানুর পোলাও খাচ্ছে। পোলাও খেতে গিয়ে সে থমকে যাবে। একবার বউয়ের দিকে তাকাবে। তারপর বলবে, এইটা কী পোলাও রানছ? এত ত্যাল!

তবে ডিরেক্টর ‘এত ত্যাল’ ডায়লগটা বাদ দিয়েছেন। মিজানুর এক্সট্রা আর্টিস্ট। এত বড়ো সংলাপ সে দিতে পারবে না। ডিরেক্টর বলেছেন, তুমি শুধু বলবা, এইটা কী রানছ! তারপর খাবার রেখে উঠে চলে যাবা। বুঝছ না?

মিজানুর মাথা নাড়িয়েছে। এই শটটার পর একটা পাসিং আছে তার। হিরো হিরোইন গল্প করছে, সে পাশ দিয়ে চলে যাবে। তাহলেই তার আজকের কাজ শেষ। কিন্তু কাজ শেষ হলেও রাত পর্যন্ত স্পটে থাকতে হবে। প্যাকআপ না হলে টাকা পাওয়া যাবে না। টাকা বেশি না। ম্যানেজারের ভাগ কাটলে আড়াই শ।

ডিরেক্টর বলেন, অ্যাকশন!

মিজানুর পোলাও মুখে তুলে নিয়ে কী করতে হবে ভুলে যায়। খেয়ে ফেলে। ডিরেক্টর বলেন, কাট কাট! খাবা না। মুখে রাখো, তারপর ফেলে দাও…থু!… রোল ক্যামেরা অ্যান্ড অ্যাকশন!

মিজানুর পোলাও মুখে তোলে এবং কী করতে হবে আবার ভুলে যায়। পোলাও খেয়ে ফেলে। রাগের বদলে তার চোখে পানি চলে আসে। ডিরেক্টরও অদ্ভুত। কাট বলেন না। মিজানুর পোলাও খেতে থাকে। খেতে খেতে বলে, খাইতে খুব টেস হইছে!


কেমোথেরাপি


আব্বার তিনটা কেমো হয়েছে। আব্বা জানেন আব্বা আর বাঁচবেন না। ডাক্তার বলে দিয়েছে বাড়িতে নিয়ে যান, ভালোমন্দ খাওয়ান।

আমরা আব্বাকে বললাম, কী খাবেন?
আব্বা কিছু বলেন না।
আমরা বললাম, আব্বা, শিং মাছ আনাই?
আব্বা কিছু বলেন না।
আমরা বললাম, আব্বা, দুম্বা খাবেন?
আব্বা কিছু বলেন না।

ডাক্তার বলল, আর না। খুব তাড়াতাড়ি।

আমরাও খুব তাড়াতাড়ি বললাম, আপনাকে পাহাড়ে নিয়ে যাই? সমুদ্রে?
আব্বা কিছু বলেন না।
আমরা বলি, কী ইচ্ছা আপনার? কী চান বলেন একবার?

আব্বা খুব ধীরে, ফিসফিসিয়ে বলেন, একটা উইগ। একটা উইগ।

একটা উইগ।


আইসক্রিম


একটা স্যান্ডেল বের করে, পা-টা অদ্ভুত উপায়ে বাঁকিয়ে, কাঁধের বস্তাটাকে মাটিতে ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলিজান। দশ বছরের চোখে একটু বাড়তি বয়সের অভিজ্ঞতা। যদিও তার চোখটা এখন স্থির—অনেকটা মৃতের মতো, বা মাছের মতো। অথচ চোখের মণিতে কায়দা করে কোনো লেন্স জুম করলে বোঝা যায় গোলাপি রঙের আইসক্রিমের ছবি তাতে। যা কাচের ওপারে তুলতুলে এক হাতে ঝুলছে।

হাতটা একবার খুবই আলগোছে মুখের কাছে তুলে নিচ্ছে আইসক্রিমটা, আবার নামিয়ে ফেলছে। কিন্তু তাতে আলিজানের দৃষ্টির হেরফের হচ্ছে না। সে যেন ওই গোলাপিটা শুষে নিচ্ছে। তার রং তার ঘ্রাণ এমনকি কোনোদিন না-পাওয়া তার স্বাদও চোখের ভেতর দিয়ে সে মাথায় চালান করে দিচ্ছে। দিচ্ছে। দিচ্ছে।

২.

: নতুন আইছে তাইলে, না?
: হ বোধয়। এমনতরো দেখি নাই আগে।
: খাইতে বোধয় বেশি মজা, না?
: হইতে পারে। পুলাডা কিন্তু আসতে আসতে চাখছিল।
: মজা লইতেছিল। কাঠি আছিল?
: নাহ। একটা কেমুন ঠোঙার ভিত্রে দিছে। একটুক ভিত্রে একটুক বাহিরে।
: খাইতে ম্যালা মজা আছে, না?
: হইতে পারে।
: একদিনকা খামু, নারে?
: হ।
: কেমন জানি বললি দ্যাখতে?
: ঠিক য্যান হাউয়াই মিঠাই…টসটস্যা গুলাপি!
: গুলাপিটা কেমুনরে ভাই? কালার চাইতে এট্টু ফরসা?

আলিজান অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও তার জন্মান্ধ বোনটাকে গোলাপি রং কেমন তা বোঝাতে পারে না। কিন্তু সে পরের দিন আবারো আইসক্রিম পার্লারের সামনে দাঁড়ায়—যদি গোলাপি রংটা কেমন আজ সে ধরতে পারে!


ভুডু


লিপস্টিক কিনতে ঢুকে জাপানি এক দোকান থেকে আপনি আপনার পাঁচ বছরের তুলতুলকে একটা পুতুল কিনে দিলেন। একটাই ছিল পুতুলটা। টোকেনে দাম লেখা—চার শ একান্ন!

বাসায় ফিরতে না ফিরতেই ফোন পেলেন আপনি। সে জাপানি দোকান থেকে। নাম্বার রেখেছিল তারা বিল দেওয়ার সাথে। সার্ভিস পছন্দ কি না তার সার্ভের তা জানতে। কিন্তু তাই বলে এত দ্রুত সার্ভিসের প্রশ্নের জবাব কী করে দেবেন আপনি? অথচ তারা জিজ্ঞাসাও করল না সে সব। করল অদ্ভুত এক অনুরোধ… বিক্রি করা পুতুলটা তারা ফেরত চান। কী নাকি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। এই পুতুলটা নাকি বিক্রির জন্য না। সেলসগার্ল ভুল করে টাঙিয়ে দিয়েছিল ট্যাগ লাগিয়ে।

আপনি বললেন অত সময় আপনার নেই যে পুতুলটা এখন ফেরত দিতে যাবেন!

ওরা বলল আরও অদ্ভুত কথা। পুতুলটা নিতে ওরা নাকি লোক পাঠাচ্ছে। শুধু চায় বাসার ঠিকানা।

ঘণ্টা খানেক পরেই দুজন লোক এলো। একটা বাঙালি—নাক বোঁচা; একটা জাপানি—নাক খাড়া; বিস্ময়করভাবেই।

ওরা টাকা নিয়ে এসেছে। সঙ্গে অন্য দুটো পুতুলও। এর সব কিছুর বিনিময়েই তুলতুলের পুতুলটা ওরা ফেরত নিতে চায়।

কিন্তু তুলতুল দিলে তো! সে ফ্রক পেতে বসেছে পুতুলটা নিয়ে। এরই মধ্যে পুতুলটার চুল খুলে ফেলেছে। নীলচে চুল বেরিয়ে এসেছে। কী মায়া মায়া চেহারা পুতুলটার। আপনার নিজেরই খারাপ লাগছে পুতুলটা ফেরত দিতে… তুলতুলকে কী বলবেন?

বাঙালিটা ইংরেজিতে আর জাপানিজটা ভাঙা বাংলাতে, বিস্ময়করভাবেই, আপনাকে অনুরোধ করতে থাকল পুতুলটা ফেরত দিতে।

তুলতুল বলল, না।
আপনি বললেন, না।

মুখ শুকিয়ে ওরা ফিরে গেল। জাপানিজটা বারবার দেখতে থাকল বাসাটা। আপনি দরজা বন্ধ করে দিলেন। কোনো কারণ ছাড়াই আপনার শরীরটা একটু ছমছমিয়ে উঠল।

তুলতুল বলল, মাম্মাম… লাভ ইউ!

পুতুলটা রাখতে পেরে সে যে ভীষণ খুশি এটা বোঝাতে জড়িয়েও ধরল। পুতুলটা মেঝেতে শুয়ে আপনাদের দেখতে থাকল।

 

২.
গভীর রাতে কিচেনের জানলাটা খুলে গেল। বিকালের জাপানিজটা লাফিয়ে নামল। ভাগ্যিস আপনার স্বামীর ইনসমনিয়া। পানি খেতে উঠে ঠিকই তাকে ধরে ফেললেন। বাসায় একটা হইচই বাঁধল মধ্যরাতে। ইনসমনিয়ার জন্যই স্বামীটির মেজাজ চড়া। তাছাড়া বন্ধুও আছে পুলিশে।

জাপানিজকে ওরা ধরে নিয়ে গেল সেই রাতেই। জাপানিজ ভাঙা বাঙলায় বলল, আমি তো চোর না!

বন্ধু পুলিশটি ইংরেজিতে বলল, শাট আপ রাস্কেল!

 

৩.
স্বামীটি সকালে কাজে বেরিয়ে গেলে আপনার কাছে ফোন এলো। আননোন অদ্ভুত নাম্বার। প্রথমে জাপানিজ কচর মচর শোনা গেল কিছুক্ষণ। তারপর শুদ্ধ বাঙলায় কেউ একজন বললেন, আর না বলে থাকতে পারছি না… আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের দিক থেকে অনেকভাবে… আসলে আপনার বাচ্চাটা যে পুতুল নিয়ে গেছে… সেটা ভুডু…

আপনি বললেন, খুব ভালো। তাতে কী?

‘আপনি হয়তো ভুডু সম্পর্কে কিছু জানেন না। গুগল করলেই জানতে পারবেন। ওটা খুব ভয়ংকর জিনিস। ওটায় চাইলে অনেক কিছু করা যায়।’

‘অনেক কিছুই তো করিয়েছেন আপনারা। একটা পুতুলের জন্য শেষ পর্যন্ত চুরি করতে পাঠিয়েছেন আপনাদের স্টাফকে। সে এখন জেলে।’

‘সে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু আপনারা আর বেরোতে পারবেন না। যত দ্রুত সম্ভব পুতুলটাকে পুড়িয়ে দিন।’

‘মানে কী?’

‘বললাম তো ওটা সাধারণ পুতুল না। ওটা ভুডু। ভুডু বিপদজনক। ভুডুর কানে যদি কেউ কারো নাম বলে দেয় ভুডু ওই নামব্যক্তিটির ছায়া হয়ে যায়। তখন ভুডুর সাথে যা ঘটানো হয়, ওই ব্যক্তিটির সাথেও তাই ঘটে। প্লিজ, আমাদের কথা শুনুন… ওটাকে যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে দিন। পুড়িয়ে ফেলুন…’

‘আপনারা এই পুতুল অন্য কারো কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন না? খুব প্রভাবশালী কেউ? সে জন্যই এইটাকে নিতে মরিয়া হয়ে চুরি করতে এসেছিলেন? এখন জেলে ঢুকেছেন দেখে উলটো আমাদের ভয় দেখাতে আসছেন? আপনাদের বিরুদ্ধে সব কথা আমি জানিয়ে দেবো… ফেসবুকে জানিয়ে দেবো… দেখবেন আর কেউ আপনাদের প্রোডাক্ট কিনবে না। দোকান মাথায় করে জাপানে ফিরে যাবেন…’

‘ম্যাডাম, প্লিজ, আমাদের কথা বিশ্বাস করেন। বিশ্বাস যদি নাও করেন… তবু, প্লিজ, ভুডুকে শেষ করে দেন… ‘

আপনি বিরক্তির চূড়ান্তে গিয়ে ফোনটা নামিয়ে রাখলেন।
তুলতুল ছুটে এলো—মাম্মাম…ভুডু হাংরি…ভুডু কী খাবে?

আপনি প্লাস্টিকের বিস্কুটগুলো দেখিয়ে দিলেন। আর তখনই আপনার একটা সাংঘাতিক বোধ হলো। আপনি তুলতুলকে ডাকলেন—তোমার পুতুলের নাম কী?

‘কেন…ভুডু…’

‘এই নাম তোমাকে কে বলেছে? রাতের চোরটা?’

‘নো মাম্মাম… ভুডু বলেছে। ভুডু তার মাম্মামের নামও বলেছে। আমি ওর কানে বললে ও-ও আমার কানে বলে… দেখবে?’

আপনার হঠাৎই কী যেন হলো। তুলতুলের হাত থেকে পুতুলটা ছিনিয়ে নিলেন। তারপর রান্নাঘরে দৌড়ে ঢুকলেন। চুলাটা জ্বালিয়েই তার ওপর পুতুলটা ছেড়ে দিলেন। পটপট আওয়াজ উঠল। আপনি ভাবলেন তুলতুল কাঁদবে… কিন্তু দূরে সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকল। আর তখনই জ্বলন্ত পুতুলটা, যেন জীবন্ত, নেচে আপনার কোলে উঠল। আপনার শরীরেও আগুনের আঁচ। আপনি পুতুলটা ঝটকায় সরিয়ে বেরোতে গেলেন, কিন্তু দেখলেন তুলতুল রান্নাঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে। আপনি চিৎকার করে তুলতুলকে ডাকলেন। কিন্তু তখন অজস্র পটপট আওয়াজে ভরে গেছে চারদিক। আপনার কণ্ঠ চাপা পড়ে গেল সেই নরক গুলজারে। পুতুলটা আপনার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, মাম্মাম!

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৮১। দশ বছরের লেখালেখির জীবনে লিখছেন মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। বর্তমানে কর্মরত একটি বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলে।

প্রকাশিত গ্রন্থ কবিতা :আত্মহননের পূর্বপাঠ (২০১০) রম্য সংকলন : যে কারণে আমি সাকিব আল হাসান হতে পারি নি (২০১৭) গল্প সংকলন : য পলায়তি স জীবতি (২০২০), সিলগালা মহল্লার ব্যালকনিরা (২০২১), কী একটা অবস্থা (২০২২)।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।