শুক্রবার, এপ্রিল ১৯

ব্যক্তি ও লেখক শাহাদুজ্জামান : ইলিয়াছ কামাল রিসাত

0

দশ নভেম্বর। বছর ঘুরে আরেকটি জন্মদিন চলে এলো শাহাদুজ্জামানের কিংবা জামান ভাইয়ের—অনেকের কাছেই তিনি মুন্না ভাই, মুন্না অথবা জামান। সম্পর্কভেদে একেকজন একেক নামে ডাকেন। এতটুকু পরিষ্কার করে বলা যায়, বেশিরভাগের কাছে তিনি তার অক্ষরবন্দি পরিচয়েই পরিচিত, অর্থাৎ শাহাদুজ্জামান। অক্ষরের কারিগরদের এই এক অভাবনীয় ও অপরিসীম ক্ষমতা। তার সাথে দেখা নেই বলা নেই কওয়া নেই, কিন্তু তার লেখার মাধ্যমেই উষ্ণ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠে।

এই সম্পর্কের সাথে সিনেমা, বিনোদন, কিংবা ক্রীড়া জগতের কিছুটা মিল থাকলেও মৌলিক জায়গায় বিশাল ফারাক রয়ে গেছে। অক্ষরের কারিগর অর্থাৎ লেখকদের উষ্ণ সম্পর্কের পেছনে লেখককে পারফর্মেটিভ কিছু করতে হচ্ছে না। অর্থাৎ তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে না এমন কিছুর উপর যেখানে তার কোনো নৈপুণ্য সরাসরি দর্শকদের প্রদর্শন করতে হবে। এই সম্পর্ক স্রেফ অক্ষরের মাধ্যমে স্থাপিত। অক্ষরের পৃথিবীতে কি জানি একটা মাদকতা আছে!

এত কথা না বাড়িয়ে আসল কথাটা এবার বলে ফেলি। এই লেখাটা জামান ভাইয়ের প্রতি জন্মদিনের শুভেচ্ছাস্বরূপ। অনেক কিছু নিয়ে লেখা গেলেও এই লেখায় আমি আলো ফেলছি কীভাবে বইয়ের মলাটে বন্দি শাহাদুজ্জামান নামটা অক্ষর ছেড়ে বেরিয়ে জীবনযাপনের ডানায় মিশে আমার ‘জামান ভাই’ হয়ে উঠলেন সে প্রসঙ্গে। মলাটবন্দি শাহাদুজ্জামান থেকে জামান ভাই—আমার কাছে এই রূপান্তরের ভ্রমণটা এখনো বিস্ময়ের। এই লেখায় সেসব বিস্ময়ের বিস্তার ঘটাব বলে মনস্থির করিনি, তবে এই লেখা সেই বিস্ময় প্রকাশের একটা ভূমিকা মাত্র। আপাতত এই লেখায় এটাই বলতে চাই যে, শাহাদুজ্জামানের অক্ষরের পৃথিবীতে যে একটা দার্শনিক রূপরেখা থাকে স্বপ্নকল্পের পৃথিবী নির্মাণের, সেই যুক্তির রাস্তা ধরেই অঙ্কিত হয়েছে এই রূপান্তরের গতিরেখা। তা না হলে কীভাবে এটার ব্যাখ্যা সম্ভব যে ২০০৭ সালে যখন আমি আমার এক বন্ধুর শেলফ থেকে ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’র পাতা উলটাচ্ছিলাম তখন তো আমার স্বপ্নেও ভাবিনি তিনিই আমার পিএইচডি সুপারভাইজার হবেন ঠিক ১১বছর পরে, ২০১৮ সালে। টাইম ট্র্যাভেলের উপন্যাসে এই প্রসঙ্গটা একটা কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা হতে পারে। এতসব আকস্মিকতার দোহাই না দিয়ে বিষয়টা যুক্তিযুক্তভাবেই ভাবতে চাই। তাই তো আমি একটু আগে এটাই ইঙ্গিত দিচ্ছিলাম যে অক্ষরের পৃথিবীতে জামান ভাইয়ের মতো শক্তিশালী লেখকেরা গল্প-কল্পনার রহস্যের আশ্রয়ে দার্শনিক ভাবনার যে সুশৃঙ্খল একটা জগতের রূপরেখার ইঙ্গিত দেন তার শক্তিতেই এই সম্পর্ক সম্ভব হয়েছে।

 

ক্রাচের কর্ণেল’-প্রথম ইমেইল
২০০৭ এ ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’ পাঠের পর জামান ভাইয়ের যেসব বই প্রকাশিত হলো, সব পড়া হয়ে গেছে। একসময় আগ্রহী হলাম তাঁকে লেখার জন্য। ততদিনে তিনি দেশান্তরী হয়েছেন, খুব সম্ভবত যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছিলেন তখন। প্রসঙ্গক্রমেই তাঁর সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তখন ইমেইল। তাঁর বইয়ের ফ্ল্যাপে যে ইমেইল এড্রেস লেখা ছিল তাতেই ইমেইল পাঠিয়ে দিলাম, ২০১১ কিংবা ১২ এর দিকে। যতটুকু মনে পড়ে, ‘ক্রাচের কর্ণেল’ পড়ে শেষ করার পর ভোররাতে ল্যাপটপে বসে আমার মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলাম। খুবই সাদামাটা ভাষায় জানিয়েছিলাম কীভাবে ‘ক্রাচের কর্ণেল’ আমার মতো এক সামান্য পাঠককে নাড়া দিল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতি আমার যে প্রচ্ছন্ন আগ্রহ ছিল তাতেই যেন পরশপাথরের মতো হৃদয়বিদারী একটা ধাক্কা দিল ‘ক্রাচের কর্ণেল’। প্রচ্ছন্ন আগ্রহ থেকে আমার আগ্রহ যেন চূড়ান্ত রূপ নিল ‘ক্রাচের কর্ণেল’ পড়ার পর। বইটা নিজে পড়েই থেমে থাকলাম না। আমার কাছের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন সকলকে রীতিমতো ক্যানভাসারের ভূমিকায় বুঝালাম কেন এই বই বাংলাদেশের ইতিহাস বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ একটা বই। আমাদের দেশে যে ধরনের পঠন-পাঠনের সংস্কৃতি তাতে ক্রাচের কর্ণেলের প্রভাব খুব সহজেই টের পাওয়া যায়। এই তো গত বছরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একদল তরুণের উদ্যোগে শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যকর্ম নিয়ে দুই দিন ব্যাপী ওয়েবিনার হয়েছিল। সেই সেশনগুলোতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘ক্রাচের কর্ণেল’।

যে ক্রাচের কর্ণেলে ইতিহাসে শাণ দিয়েছিলাম, সেই ইতিহাসের বোঝাপড়ার যেন সাক্ষাত লিটমাস টেস্ট ছিল ২০১৩ এর গণজাগরণ!

১৯৭১-১৯৭৫ নিয়ে আমাদের ইতিহাস বোঝাপড়ায় যে নানা রাজনৈতিক দলের, নানা সুযোগসন্ধানী, নানা ষড়যন্ত্রকারী তত্ত্ব বাজারে হাজির আছে, সেসবের বাইরে বেরিয়ে সেই সময়টাকে গবেষণালব্ধ প্রক্রিয়ায় বুঝতে চেয়েছিলেন শাহাদুজ্জামান। সেই বইয়ের রেফারেন্সের দিকে তাকালেই বোঝা যায় একজন সত্যানুসন্ধানী গবেষক কিংবা লেখক তার প্রতিটি বয়ান যাচাই করে নেওয়ার জন্য কতটুকু নিষ্ঠার পরিচয় দিতে পারেন। এসব নানা বিষয়েই মুগ্ধতা জানিয়ে সেই মেইল লিখেছিলাম জামান ভাইকে। এরপরে জামান ভাইয়ের সাথে ইমেইলে আলাপ হতো প্রায়ই। উনার লেখা নানা বই নিয়ে আমার মন্তব্য জানাতাম। উনার নানা অনুবাদ গ্রন্থ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি যে মিলান কুন্ডেরা, মুরাকামি পাঠ শুরু করলাম তা জানাতে ভুলতাম না। সেসব মেইলে জানাতাম কেন মুরাকামিকে আমার মনে হয় ‘উড়াল দেয়া কাফকা’। এর মাঝে একদিন আমাদের দেশে নেমে এলো শাহবাগ ২০১৩। যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবিতে ধর্ম-বর্ণ-পেশা-শ্রেণি নির্বিশেষে যে গণজাগরণ নেমে এসেছিল দেশে, সেই ২০১৩ এর শাহবাগ। আমরা তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় জীবনের দীক্ষা নিচ্ছি। যে ক্রাচের কর্ণেলে ইতিহাসে শাণ দিয়েছিলাম, সেই ইতিহাসের বোঝাপড়ার যেন সাক্ষাত লিটমাস টেস্ট ছিল ২০১৩ এর গণজাগরণ! জামান ভাইয়ের সাথে তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে ইমেইলে আলাপ চালু রেখেছিলাম। জানতে পারলাম তিনি দেশে আসবেন। এবার আর ইমেইলে বন্দি থাকতে চাইলাম না। দেখা করব বলেই মনস্থির করলাম।

 

শাহবাগ ২০১৩- প্রথম সাক্ষাৎ
শাহবাগ আমাদের মতো তরুণদের সাক্ষাৎ করাল আমাদের ইতিহাসের অনিবার্য প্রশ্নগুলোর। বাঙালি মুসলমান, বাংলাদেশী মুসলমান, ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষতা, ৯/১১ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো কি হতে পারে ইত্যাদি সকল প্রশ্ন যেন ওপেন-বুক পরীক্ষার মতো দেশের যেকোনো চিন্তাশীল মানুষকে ভাবাতে বাধ্য করল। এমন সময় যেমন সম্ভাবনার, তেমন আশঙ্কার। সম্ভাবনার এজন্য যে, এসব প্রশ্ন আমাদের জাতীয় জীবনেই শুধু নয় বরং আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভবিষ্যত রাজনীতির দিক নির্দেশনার জন্যও আবশ্যিক আলোচনা। আশঙ্কার এজন্য যে, এই বারুদ সময়ের অপদ্ধতিগত অথবা সুযোগসন্ধানী বিশ্লেষণ আবারো আমাদের নিয়ে যেতে পারে ভুল খাদের কিনারায়। আশঙ্কার অনেক কিছুই ঘটেছে সেসময়ে। সেসব আলোচনা আমার লেখার ধর্তব্য নয়; তাই আর সেদিকে আলোচনায় না গিয়ে ফিরে আসি জামান ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতের ঘটনায়। ২০১৩ শাহবাগ আন্দোলনের পর থেকেই শাহাদুজ্জামান শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে উনার বিশ্লেষণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় প্রকাশ করতে লাগলেন। এমন সময়ে তার লেখা ‘ভাবনা ভাষান্তর’ বইয়ে কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর তত্ত্বের ব্যাখ্যা পড়তে গিয়ে একটা ছোটো লেখা লিখে ফেললাম।

শাহবাগ যেভাবে বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয়াতাবাদের নানা অমীমাংসিত প্রশ্ন আমাদের সকলের সামনে তুলে এনেছিল তার সাথে কেন জানি একটা সম্পর্ক পেয়েছিলাম কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর ‘আর্কিটাইপ’ নামক তত্ত্বের মধ্যে। সহজে বললে ব্যাপারটা এমন—১৯৭১ এর সময়ে নানা কারণে যুদ্ধাপরাধের যে বিচারটা সংগঠিত হয়নি, তার কারণে বিচারহীনতার যে ধারা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রকে কলুষিত করছিল, শাহবাগের আন্দোলন যেন সেই কলুষিত ধারাকে প্রশ্ন করার আন্দোলন।

শাহবাগ যেভাবে বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয়াতাবাদের নানা অমীমাংসিত প্রশ্ন আমাদের সকলের সামনে তুলে এনেছিল তার সাথে কেন জানি একটা সম্পর্ক পেয়েছিলাম কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং এর ‘আর্কিটাইপ’ নামক তত্ত্বের মধ্যে। সহজে বললে ব্যাপারটা এমন—১৯৭১ এর সময়ে নানা কারণে যুদ্ধাপরাধের যে বিচারটা সংগঠিত হয়নি, তার কারণে বিচারহীনতার যে ধারা আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রকে কলুষিত করছিল, শাহবাগের আন্দোলন যেন সেই কলুষিত ধারাকে প্রশ্ন করার আন্দোলন। এ যেন বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের জনমানসের সামগ্রিক অবচেতনায় স্থান করে ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নিয়ে ভাবতে হলে অতীতের এই প্রশ্নকে মীমাংসা করেই এগুতে হবে। এই ভাবনাটা ভাবা আর লেখার পেছনের পুরো অনুপ্রেরণাই ছিল জামান ভাইয়ের লেখাপত্র ও ভাবনা ভাষান্তর বইয়ে উনার লেখা ইয়ুং এর অধ্যায়টা। এসব নিয়ে উনার সাথে ইমেইল চালাচালি হলো। অবশেষে ২০১৪ এর ১ সেপ্টেম্বর দেখা করলাম উনার সাথে। পাঠক সমাবেশে প্রায় এক-দেড় ঘন্টার মতো সরাসরি বসে গল্প করলাম প্রিয় জামান ভাইয়ের সাথে। উনাকে আমি ইমেইলে জামান ভাই বলেই সম্বোধন করতাম। সেসূত্রে তিনিই বললেন আমি তাকে জামান ভাই বলেই ডাকতে পারি সামনাসামনি। সাহিত্য, সিনেমা, বাংলাদেশের জনজীবন, সকল বিষয়ে মনের কোণে চাপা পড়ে থাকা সকল বিষয়ে মন খুলে আড্ডা দিলাম। সেদিন সাক্ষাতের পর মলাটবন্দি কিংবা ভার্চুয়াল দুনিয়ার অবয়ব ছেড়ে সাক্ষাৎ মানব জামান ভাইয়ের সাথে দেখা করার, কথা বলার স্বাদ যেন মিটল। এই সাক্ষাতের আনন্দ যতটা না একজন প্রিয় লেখকের সান্নিধ্য পাবার, তার চেয়েও বেশি ছিল একজন দিশারীর অথবা একজন দার্শনিকের ছায়াতলে বসে জীবনের নানা দ্বিধাসংকুচিত বিহবল মুহূর্ত নিয়ে কিছু সময় ধ্যান করার মতো প্রশান্তি লাভের। এরপর উনার সাথে ইমেইলে যোগাযোগ চলছিল আগের মতোই। নানান লেখা, নানান সমস্যা, নানান ভাবনা নিয়েই জামান ভাইকে ইমেইল করে বসতাম। এমনই এক সময়ে একদিন আমাকে তিনি পরামর্শ দিলেন বিখ্যাত সাবঅল্টার্ন তাত্ত্বিক দীপেশ চক্রবর্তীর বই ‘প্রোভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ’ পড়ার জন্য। চিন্তাভাবনার জগতে ভিন্ন এক জগতে প্রবেশ করলাম এই বইয়ের সূত্রে।

 

‘প্রোভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ’-পরিণত বয়সের চিন্তায় প্রথম ধাক্কা
দিশারীর পরামর্শে কঠিন এই তত্ত্ব-দর্শনের বই একটানা পড়ে ফেললাম। এ বই নিয়ে ইন্টারনেটে হাজার হাজার ভিডিও, প্রবন্ধ, লেখা, বিশ্লেষণ খুঁজে পাবেন আগ্রহী যে কেউ। সুতরাং এ বইয়ের ব্যাখ্যার চেয়ে এখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো জামান ভাইয়ের সাথে আমার বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্কের প্রসঙ্গ। ‘প্রোভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ’ নিয়ে শুধুমাত্র কয়েকটা বাক্য ব্যয় করতে চাই। এ বইয়ের মূল বক্তব্য হলো: ইউরোপ আমাদের মতো উন্নয়নশীল কিংবা তথাকথিত অনুন্নত দেশের জনমানসে যেভাবে সকল কিছুর আদর্শ হয়ে স্থান দখল করে আছে তার স্বরূপ যাচাই করে দেখা। আজকের পুঁজিবাদ বলি, গণতন্ত্র বলি, উন্নয়ন বলি সব কিছুতেই ইউরোপের বাতলে দেয়া জ্ঞানই যেন আমরা উন্নয়নশীল জনপদের মানুষেরা ধরার চেয়ে সরা জ্ঞান বলে ধরে নেই। সমতা, শ্রমের মজুরী, পুঁজিবাদ, উন্নয়ন, সার্বজনীন শিক্ষা, মানবাধিকার—সকল কিছুই যেন ইউরোপের কাঠামোতেই ভাবতে হবে। দীপেশ চক্রবর্তী এই ইউরোপকেন্দ্রিক ভাবনার মূলে প্রশ্ন করেছেন।

‘প্রোভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ’ নিয়ে শুধুমাত্র কয়েকটা বাক্য ব্যয় করতে চাই। এ বইয়ের মূল বক্তব্য হলো: ইউরোপ আমাদের মতো উন্নয়নশীল কিংবা তথাকথিত অনুন্নত দেশের জনমানসে যেভাবে সকল কিছুর আদর্শ হয়ে স্থান দখল করে আছে তার স্বরূপ যাচাই করে দেখা। আজকের পুঁজিবাদ বলি, গণতন্ত্র বলি, উন্নয়ন বলি সব কিছুতেই ইউরোপের বাতলে দেয়া জ্ঞানই যেন আমরা উন্নয়নশীল জনপদের মানুষেরা ধরার চেয়ে সরা জ্ঞান বলে ধরে নেই।

তিনি দেখিয়েছেন, সকল ধারণার যেমন একটা বৈশ্বিক আদল আছে, ঠিক তেমনি আছে এর স্থানিক রূপ। স্থানিক রূপ কোনোভাবেই কম শক্তিশালী নয়। বরং কিছুক্ষেত্রে বেশি প্রভাবশালী এবং অনিবার্য। ইউরোপকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার অনিবার্যতা যেমন আছে, এ-ও সত্য যে এই ইউরোপীয় চিন্তা অসম্পূর্ণ। পুরো বইয়ের এই হাইপোথিসিসের সারমর্মের দিকে তাকালে আজকের পৃথিবীতে আমাদের মতো দেশে নানান সমস্যার অনেক কিছুর ব্যাখ্যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই যে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে ফেনা তুলে ফেলছে, এই যে আদর্শ গণতন্ত্র বলে বলে রাত বিরোতে টকশোতে জ্ঞান বিলোচ্ছে, এর পেছনের যে তাড়না, এই যে প্রচ্ছন্নভাবে ইউরোপীয় হবার জন্য কি এক মরীচিকার পেছনে ছুটছে, তারই যেন ব্যবচ্ছেদ আছে দীপেশের ঐ জগদ্বিখ্যাত বইয়ে। এই বই পড়ার পরে জামান ভাইয়ের সাথে আমার অনেক ভাবনার বিনিময় ঘটেছে। আমার বোঝাপড়া জানিয়েছি উনাকে। আরও খেয়াল করেছি, দীপেশের মূল বক্তব্যের যে নির্যাস, তার একটা সাহিত্যিক দৃষ্টান্ত যেন জামান ভাইয়ের লেখাপত্রে দারুণ অনুষঙ্গ হিসেবে আছে। ‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস’, ‘সাইপ্রাস’, ‘উড্ডীন’, এরকম জামান ভাইয়ের লেখা আরও অনেক গল্প আছে যেখানে স্থানিক সংস্কৃতি, স্থানিক ইতিহাসের অনিবার্যতা প্রকাশ পাচ্ছে কোনো ভনিতা ছাড়াই। ঢাকায় যখন বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য দিতে আসতেন, তিনি এই স্থানিকতার কথা উল্লেখ করতেন নানান প্রসঙ্গে। বিশ্বায়নের এই দুর্দান্ত টালমাটাল দ্রুত ঘটে যাওয়া সময়ে কীভাবে একজন সাহিত্যিক আমাদের অঞ্চলের গল্পকে তার নিজস্ব শক্তিতে রাঙাতে পারেন সেসব নিয়ে নানা সময়ে কথা বলেছেন। আমিও কয়েকটা ব্লগে লিখে ফেললাম আমার নানা ভাবনা-চিন্তা। সেসব লেখার মূল অনুপ্রেরণা ছিল দীপেশের জগদ্বিখ্যাত সেই বই। এভাবে জামান ভাইয়ের চিন্তার জগতকে আরও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম তখন। এমন সময়ে আমার হাতে এসে পৌঁছুল জামান ভাইয়ের লেখা একটা একাডেমিক গবেষণা প্রবন্ধ।

 

উপশম কিংবা প্যালিয়েটিভ কেয়ার: দিশারীর হাত ধরে গবেষণার জগতে প্রবেশ
যে একাডেমিক প্রবন্ধ আমার হাতে এসে পৌঁছুল সে প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল— ‘Common or multiple futures for end of life care around the world? Ideas from the waiting room of history। দিশারী জামান ভাইয়ের মারফতেই এই প্রবন্ধ পেলাম। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম। লেখাটা সামাজিক বিজ্ঞানের প্রথিতযশা জার্নাল সোশ্যাল সায়েন্স এন্ড মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছিল। প্যালিয়েটিভ কেয়ার নিয়ে একাডেমিক জগতে যে আলাপ-বিতর্ক চালু আছে তার মধ্যে প্রথম সারির দিকেই থাকবে এই প্রবন্ধ। যাই হোক, এই প্রবন্ধের মূল বক্তব্য ছিল প্যালিয়েটিভ কেয়ারের যে আপাত বৈশ্বিক বয়ান, তাকে প্রশ্ন করা। ছোট্ট করে একটু ব্যাখ্যা করি প্যালিয়েটিভ কেয়ার কি তা নিয়ে। দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে রোগীর অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে আসে যখন আর তথাকথিত চিকিৎসা কাজে আসে না। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই সেসময় প্যালিয়েটিভ কেয়ার সেবা দেওয়া হয়ে থাকে যেন মৃত্যুর সময়ে কোনোরকমের ব্যথা যন্ত্রণা ভোগ না করেন। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের একটা গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হলো ভালো মৃত্যু অর্থাৎ Good death নামের concept। সংস্কৃতিভেদে ভালো মৃত্যু অর্থাৎ মৃত্যুকালীন সময়ের নানা বয়ান থাকলেও প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মডেলে যে অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে তার মূলে ইউরোপীয়, আরও ব্যাপক করে বললে উন্নত বিশ্বের ধ্যানধারণাগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। জামান ভাই সেই প্রবন্ধে দীপেশের প্রোভিনশিয়ালাজিং ইউরোপের তত্ত্বের মাধ্যমে প্রশ্ন করে দেখিয়েছেন উন্নত/উন্নয়নশীল দেশের সংস্কৃতিভেদে আমরা সবার জন্য এক ধরনের রূপরেখা প্রণয়ন না করে বরং বহুধা ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মাণের পরিকল্পনা করতে পারি।

প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মডেলে যে অনুষঙ্গকে প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে তার মূলে ইউরোপীয়, আরও ব্যাপক করে বললে উন্নত বিশ্বের ধ্যানধারণাগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। জামান ভাই সেই প্রবন্ধে দীপেশের প্রোভিনশিয়ালাজিং ইউরোপের তত্ত্বের মাধ্যমে প্রশ্ন করে দেখিয়েছেন উন্নত/উন্নয়নশীল দেশের সংস্কৃতিভেদে আমরা সবার জন্য এক ধরনের রূপরেখা প্রণয়ন না করে বরং বহুধা ভবিষ্যতের রূপরেখা নির্মাণের পরিকল্পনা করতে পারি।

জামান ভাইয়ের এই গবেষণা প্রবন্ধের মারফতে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের দুনিয়া সম্পর্কে এক ধরণের ভালোলাগা তৈরি হলো। মূলত তাঁর অনুপ্রেরণা ও দীক্ষাতেই প্রস্তুতি শুরু করলাম আমার পিএইচডির। এই প্রবন্ধের অনুপ্রেরণাতেই আমার পিএইচডির বিষয় নির্ধারণ করলাম: Understanding the notions of ‘good death’ in Bangladesh: Medical anthropological exploration. যখন আমার পিএইচডির এই প্রস্তুতি পর্যায় চলছিল তখন তিনি যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। আমার দিশারী জামান ভাই-ই আমার পিএইচডির লিড সুপারভাইজার হলেন। ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে এই পিএইচডি যাত্রায় দিশারী জামান ভাইকে সুপারভাইজারের ভূমিকায় পেয়ে জ্ঞানজগতের তৃপ্তি মেটানোর তাগিদে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই অবস্থা হলো আমার। এই পিএইচডির সুবাদে আরও অনেক কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে জামান ভাইকে। অনানুষ্ঠানিকভাবে এতদিন দিশারী ছিলেন, এখন যেন তারই একটা প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি সম্পন্ন হলো তাঁকে পিএইচডি সুপারভাইজার হিসেবে পাওয়ার পর।

 

ইতিকথা
বর্তমানে আমার পিএইচডি প্রায় শেষের দিকে। গত ৪ বছরে এর সুবাদে আরও কাছ থেকে জামান ভাইকে ভালোভাবে দেখেছি, জেনেছি। সেই সূত্রে লেখক ও চিন্তাশীল জামান ভাইয়ের সান্নিধ্যের পাশাপাশি উনাকে আরও বেশি কাছে পেয়েছি অভিভাবক হিসেবে। এই দূর বিদেশ বিভূঁইয়ে এই অভিভাবকত্বের মূল্যটা অন্য অনেক কিছুর থেকেই বেশি, অনেকটা মাঝ সাগরে ভেসে চলা তরীর মতো। একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনি জীবন নিয়ে কৌতূহলী। এই কৌতূহলভরা দৃষ্টি দিয়েই জীবনকে বুঝতে চান। কোনো সত্যকে আঁকড়ে না ধরে পরিবর্তনশীল এ জীবনকে আরও গভীরভাবে বুঝতে চান।

লেখাটার উদ্দেশ্য ছিল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো। সেই সূত্রে এটাও অক্ষরবন্দি করতে চাইলাম কীভাবে শাহাদুজ্জামানের পাঠক থেকে ছাত্র হওয়ার যাত্রা পাড়ি দিয়েছি। যেসব প্রসঙ্গ এসেছে লেখায় সেসব নিয়ে আরও বিস্তারিত আলাপ তোলা যাবে। সে নাহয় অন্য একদিনের জন্য তোলা থাকল। আপাতত জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে লেখা শেষ করি।

প্রিয় জামান ভাই, আপনার বিহবল গল্পের পাঠককুলের একজন হতে পারা আমাদের জন্য চরম সৌভাগ্যের বটে! সাইপ্রাসের আকাশে চড়ে এমন আরও হাজারো ইব্রাহিম বক্সের সার্কাসের নাগরদোলায় নিত্য বিহবলতায় ডুব দিতে চাই আমরা।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

পেশায় চিকিৎসা নৃবিজ্ঞান গবেষক। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ব্রাইটন শহরে বসবাস করছেন। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন। ডেভিড লিঞ্চের সিনেমা, কুন্ডেরার যেকোনো লেখাপত্র, যেকোনো যুদ্ধের ডকুমেন্টারি, বিমান দুর্ঘটনা, সমাজবিজ্ঞান, শহীদুল জহিরের লেখার জগৎ তার আগ্রহের বিষয়।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।