শনিবার, এপ্রিল ২৭

নির্বাচিত দশ কবিতা : জুয়েল মাজহার

0

আততায়ী


আমি জানি, আমার প্রস্থানপথ হয়ে থাকবে
শয়তানের পুরীষে আবিল!

স্বপ্নের ভেতরে গিয়ে জিরোবার ছল করে ডাকলে তোমাকে
কান দুটি ভরে উঠবে প্রতিধ্বনিময় কা-কা রবে;

অথবা, আমার স্বর শুষে নেবে খর মরুবালি
ঘুমের অশক্ত ডাল ভেঙে যাবে
চোখ দুটি খসে পড়বে নগরের নর্দমার পাঁকে

আমাকে ঘুমন্ত দেখে কালো দাঁড়কাক
অবসিডিয়ান নাইফের মতো তার ঠোঁটজোড়া নিয়ে
আমার মুখের দিকে ঝুঁকে র’বে, চেয়ে র’বে চুপ;
—সারারাত বসে থাকবে শান্ত হয়ে বুকের ওপরে।

আমি এর কিছু জানবো না।


মেগাস্থিনিসের হাসি


নিঃশব্দ কামানে তুমি একা বসে ভরছো বারুদ।
শীতকাল গেল;
নিঃশব্দ কামানে তুমি একা কেন
ভরছো বারুদ?

আমি ভাবছি:
মেগাস্থিনিসের হাসিও কি মেগাস্থিনিস?

শক্তিচালিত এই তামাশার মধ্যে বহু
বাদামি ঘোটক উড়ে যায়
—এঞ্জিনের শব্দ আর রোবটের কাশি শোনা যায়।

নিঃশব্দ কামানে তুমি এখনো কি ভরছো বারুদ?


বীতশোক ফিরে এসো


১.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ ঢেলেছে আগুন;
জ্যোতিরথে চোখ রেখে চেনা পথ শান্ত পায়ে হেঁটে
নিজেকে শুনিয়ে কোনো গূঢ়কথা, গোপন মর্মর
বীতশোক চলে গেছে। পশ্চিমের প্রত্যন্ত প্রদেশে।

আমার ‘সামান্য ক্ষতি’? বিপর্যয়! খসে পড়ে ফল!
বহুঘুম-রাত্রিব্যেপে অনৃত ঢেউয়েরা! তরী ডোবে!

 

২.
পুরাতন বিষণ্নতা, গোপনে যে আঙুরলতায়
ফল রূপে পেকে ওঠে, সারারাত তস্করের ভয়ে,
শুষ্ক তৃণে ঢেকে তারে সযতনে দিয়েছে প্রহরা।

 

৩.
প্রত্যহের দুঃখ-দৈন্য-বেদনা ও ক্লেশে—হয়তো সে
বসন্ত-রুধির এনে চেয়েছিল কিছুটা মেশাতে;

যেন নীল প্রজাপতি তার কাছে এসে চায় মদ;
অধীর মক্ষিকা শুধু দ্রাক্ষা মেগে উড়ে উড়ে চলে।

 

৪.
সন্তর্পণে একা বসে পানপাত্রে দিল সে চুমুক;
লম্বা ঢোঁক গিলে নিয়ে স্তনলোভী শিশুর নিয়মে
আলগোছে মৃগনাভী ভরেছে উদকে স্বার্থপর!!

‘শিশির-চোঁয়ানো রাতে, মধ্যদিনে দহনের শেষে’
অন্যরা ঘুমিয়ে ছিলো? এ-সুযোগে হলো সে কর্পূর?

 

৫.
হেমন্তের মঞ্চ থেকে গরুড়ের ছড়ানো ডানায়
অতর্কিতে চড়ে বসে শরীর সারাতে গেছে দূরে।

কত দূরে? কাউকে বলে নি; শুধু উপশমহীন
অনন্ত গোধূলিপথ ছেয়ে আছে হলদে পাতায়!

এই তবে গূঢ়লেখ? বৃথা তব নর্তকী ও মদ?

 

৬.
বীতশোক, তুমি আছো! অনন্ত পশ্চিমে নাকি পুবে?
অসম্ভব ভুলে থাকা; লিথিজলও স্মৃতিসমুজ্জ্বল!

অফুরান দ্রাক্ষা থেকে অন্ধকার প্রশীর্ণ আঙুলে
নিজের ভিতরে, চুপে, শমদায়ী পেড়ে আনো ফল?

 

৭.
বিকেলের করোটিতে সন্ধ্যারাগ! জ্বলছে আগুন!
ফিরে এসো সেই পথে;—ঝরাপাতা-মুখর সরণি—

কিছুটা যবের মোহে, কিছু প্রেমে, শর্করার টানে।

 

৮.
উপশম হলো ব্যথা? পিঞ্জিরার ভেতরে পাখির?
দ্রুত তবে চলে এসো, পরিত্যক্ত আঙুরের বনে;

অনন্ত গোধূলিপথ ভরে দিয়ে পাতায়, মর্মরে।


দর্জিঘরে এক রাত


শূন্যতা বল্লম এক, গেঁথে আছে দর্জিমহলে!

রাশি রাশি বস্ত্র ফেলে দর্জিদল গোপনে উধাও;
—শুধু দেয়ালের গলদেশে ঝুলে আছে একটি পুরনো ঘড়ি; —মৃত!

দশবস্ত্রে-দিগম্বর বেশ্যার ইশারা আজ মেঘেতে উত্থান
তাই, লক্ষ শিশ্ন হাতে চেপে দর্জিদল মেঘে ধাবমান

শৃঙ্গারের গোলাপি আরকে আজ প্রতিপার্শ্ব ঢাকা
আঁধারে ঝর্নার মতো বেজে ওঠে গণিকামহল

সবুজ প্রিজমে আমি চোখ রেখে সবকিছু দেখি:
দর্জিদের অনুপস্থিতির এই দীর্ঘ অবসরে
আতশি কাচের গুঁড়ো জড়ো করে চুপে

ঢেকে রাখি ফাঁকফুঁক, দর্জিঘর, ঘড়ি ও জানালা।


রুবিকন


আমার সামনে এক রুবিকন, পুলসিরাত, ভয়ানক ক্রূর অমানিশা
এর সামনে একা আমি;
কিস্তিহীন, নিরশ্ব, রসদহীন
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি!

আর আমার ভাঙা হাড়, থ্যাঁতলানো
খর্বকায় দেহের ভেতরে যতো
রক্ত-পিত্ত-কফ-থুথু-বীর্য-লালা সবই
অসীম বরফে-হিমে গ্রানিটের মতো ক্রমে হতেছে জমাট;
আর ওই থেকে-থেকে ফুঁসন্ত ব্লিজার্ড এক
আর এক আনক্যানি করাল হিমানী
আমাকে আদ্যন্ত ঘিরে আছে।

সান্নিপাতিক হেতু নাসিকার ছিদ্র বেয়ে
চোখ বেয়ে যে-জল গড়ায় আর মাটিতে পড়ে না;
শূন্য থেকে বর্শা হয়ে সিগ্নি ঝুলে রয় যেন নর্স দেবতার!

সারি সারি শতশত বল্মীকূট পেছনে আমার।
তাদের আড়াল হ’তে জুলজুল চেয়ে থাকে লোম-কর্ণ শিবা।
লোলজিভ, অভ্রংলিহ জিভ নাড়ে মেদুসা-মনসা আর কালী।

আমার তরবারি নাই। তাই
দু’হাতে নখর আমার তরবারি!

আমি কি ডরাবো?
না, আমি ডরাবো না।
—অসীম হিম্মত লয়ে এক পায়ে হয়ে আছি খাড়া ।

কিস্তিহীন, শস্ত্রহীন, নিরশ্ব, রসদহীন— আমি একা;
পিগমিদের চেয়ে ছোটো আমি।

আমি ফুঁ দিচ্ছি হাপরে আমার।
আমি আমাকে বলছি: ওঠো, জাগো!

আমার অশ্ব নাই।
এক দুর্বিনীতাশ্ব জন্ম নিচ্ছে ভেতরে আমার।

থ্যাঁতলানো ভাঙা পায়ে আমি লাফ দিচ্ছি। আমি সাঁতরে চলেছি
আমার আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ এক গন্ধকের নদী।
আমি ভেদ ক’রে যাবো ক্রূর অমানিশা
আমি জয়ী হবো
আমি পার হবো রুবিকন!!


মম প্রিয় বন্ধুগণ

[আশির দশকের কবি-বন্ধুদের জন্য]


১.
মম প্রিয় বন্ধুগণ তপ্ত লাল শলাকা শানায়। আর
রক্তজবা কানে গুঁজে শব্দ করে ভয়ানক হাসে

মাঝেমাঝে বক্ষো’পরে বসে তারা
মোর পানে উঁচায় খঞ্জর।

তাদের চেহারাগুলি ঘোর লাগা
লাল আর বিভীষিকাময়

আমাকে তারাই ফের পিঠে নিয়ে চলে বহুদূর।
আমারে তারাই ফের তৃপ্ত করে
লেহ্য-পেয়ে, সুরায় আরকে!

দিন ক্রমে নত হয়!
সূর্যের গ্রীবা ঢলে পড়ে

যখন সবাই ঘুমে
বদ্দিরাজ গাছে এক চোর
মগডালে রুপালি, বর্তুল।

সাদা-নীল পরচুলা, উঁচু টুপি
লাল মোজা, কালো মোকাসিন
বিনোদক বাঁশি নিয়ে
রাতেই নীরবে তারা আসে;

সময় হলেই তারা অবলীলাভরে
বুকে উঠে দ্রুত হাতে চালায় খঞ্জর!

(সূর্মাটানা চোখজোড়া প্রপীড়িত অন্ধ খোড়লে!)

রুপালি নদীর জলে ভিস্তি ভরে
দল বেঁধে কারা আসে, কারা যায় হেঁটে
মোগলটুলিতে আর আরমানিটোলায়?
—বৈকালিক পথে-পথে বাজখাঁই হাঁক দিয়ে যায়!

আর আমি, হয়তো চোখের ভ্রম, দেখি:
খাম্বিরা তামাকে তৃপ্ত পুরান ঢাকার সব
রাংতা-মোড়া জানালার কাচ ভেঙে পড়ে

 

২.
এ সময় তুষারঝড়ের গ্রীবা নড়ে যদি সমূহ বিপদ
সুবিস্তীর্ণ স্তেপজুড়ে ঠান্ডা হিম করাতের দাঁত
তারপর শান্ত সবই। গর্জনেরা নীরব হঠাৎ !

চতুর্দিকে অসীম বরফ আর ধ্বংসরেখা!
পাহাড়ের উচ্চাবচ চূড়া
যেন এক বিমর্দিত স্তনের কাফেলা

ঝড় শেষ হওয়া মানে
আকাশে রুপালি তাঁবু ফুলে উঠবে এখন আবার

ধারালো নখের নিচে ঈগলেরা লুকায় শিকার
আর তারা বিপুল ডানার তলে, ছানাদের আগলে রাখে
সুকোমল লোমের আদরে
অপর্যাপ্ত খাদ্যকণা, যবদানা, ঠান্ডা মাংস পথে-পথে এখন সম্বল;
মিতব্যয়ী, সচেতন তারা জানে রসদ সামান্য, কিন্তু
সামনে আরো লড়াই লড়াই শুধু লড়াই! লড়াই!!

ঠান্ডা রুটি ধেনো মদ যবদানা তারা তাই ভাগ করে খায়
নিজে খায়, পশুকে খাওয়ায় আর
পালান নামিয়ে রেখে ঘোড়াগুলো ছেড়ে দেয় ঘাসে

ত্রস্তে তারা জড়ো হয়
চমরি গাইয়ের ত্বকে তৈরি এক দড়াটানা তাঁবুর ভিতরে;
মধ্যরাত। বাইরে হু-হু হাওয়ার ঝাপট
তাদের ক্লান্ত হাতে অভ্যাসের তাস জমে ওঠে!

তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!!

 

৩.
ক্রূর, বক্র, ভীতিপ্রদ অতিকায় তাদের নাসিকা
গুম্ফ নেড়ে নেড়ে তারা
ত্রাহিরবে দুনিয়া কাঁপায়!

তাদের করাল ঠোঁটে রক্ত-চর্বি, ছিন্নমাংস চুনিগাঢ় লাল!
বক্র-শ্যেন-ঘোরলাগা রক্তজবা তাদের নয়ান!!

তাদের চক্ষু থেকে ক্ষণে ক্ষণে ঝরে শুধু
শত শত মৃত্যু আর শব

তারাই আমার সখা
সদাহাস্য তাহাদের কপালে তিলক;

যুদ্ধ আর খুনে লাল তরবারি দিয়ে তারা ক্রমাগত আমাকে শাসায়!!
আস্তিনের ভাঁজ খুলে বের করে খড়্গ-চাকু, জংধরা বাঁকা তলোয়ার;

কল্লাবালু দিয়ে তারা, সঙ্গোপনে, ছুরি-কাঁচি ধার দিয়ে চলে
আর আমি ঈশ্বরের প্রিয়তম ভেড়া যেন
প্রতিদিন দিবালোকে বলি হয়ে যাই

কপালের ফেরে হায়, এ-যেনবা শেষ নিশিভোজ
সকলের মধ্যে আমি নীলমণি-যিশু!

নিজের কলবে আমি কান পেতে রই আর শুনি:
পাপাল বুল-কে ঘিরে টানা দীর্ঘ চারশো বছর
কোটি কোটি মার্জারের অবিরাম মরণ-চিৎকার!

 

৪.
অভ্রভেদী লাফ দিয়ে ভয়ে আমি অবিরাম দ্রুত উড়ে উড়ে
শত শত ক্রুশ আর সূচ্যগ্র শলাকা থেকে নিজেকে বাঁচাই

ক্রমাগত ভিক্ষা করি লক্ষ নিমেষ আর একটি নিমেষ!

আর আমি দুই চোখ মুদে
প্রেমপূর্ণ রিরংসায় মম প্রিয় বন্ধুদের দেখে যেতে চাই:

মধ্যরাত। তাঁবুর ভেতরে তারা
খুমিশ ঢালছে পেয়ালায়!!


কিন ব্রিজ দেখবার স্মৃতি


দুই কিবা তিন সাল আগে আমি শ্রীহট্টতে গিয়া
শ্রীহট্টরে ফিরা পাই নাই

কিনব্রিজে গিয়া দেখি কিনব্রিজ নাই

শুধু একটা জংধরা জীর্ণ লাল লোহার ধনুক
সুরমা নদীর উপ্রে উপ্তা হয়া আছে

তাহার বুগলে একটা আলিশান ঘড়ি; যারে আলি আমজাদ
চাবি মাইরা রাইখা গেছে। তবে

এর দীর্ঘ পেন্ডুলাম
আজ আর লড়ে না চড়ে না

যেন সে আসঙ্গবঞ্চিত কোনো অভিশপ্ত মৃত দানবের
নতমুখ প্রকাণ্ড নিঃসাড় লিঙ্গ; —আইজকা তাহারে

ঘিরিয়া ঘিরিয়া শুধু বেশুমার চামচিকা ওড়ে


সহোদরার জন্য একটি লাজুক টিট্টিভ


টিট্টিভ পাখি: দূর অতীতের লোবানে ডোবানো পাখা
নিয়ে এসেছিল; তার মুখ আজো উঁকি মারে জানালায়।

কামার্ত স্রোত খসাচ্ছে কার বসন্ত-আঙরাখা?
মা-মেরি তোমার? এ-রাম এ-রাম কী বাতাস বয়ে যায়!

দূর নেব্যুলার খাঁজে খাঁজে শুধু ইশারার উপহার
তীব্র প্যাশন! উড়ছে মেদিনী স্পর্শের বিদ্যুতে;
আর টিট্টিভ উগরে দিচ্ছে নীল বিষ জিহ্বার।

ওগো সহোদরা, জ্বালো যোনিপোকা ঘুমন্ত পর্বতে!

বিশাল-বিপুল বরফের চাঁই ঘুমের কারখানায়
নিজেকে ভাঙছে; আর দিকে দিকে একাই একশোখান
হয়ে উঁকি দ্যায়। দূর-দূর দেশে অলিন্দে-জানালায়;

শীৎকারময় অসীম ধূমল গ্লেসিয়ারে জাগে গান!

স্মৃতি-টিট্টিভ, যোনিপোকা আর বাতাসের উৎপাত
স্রোতে ভেসে আসে ওই দ্যাখো, ওই, অযুত-নিযুত পাখা!
—মুচকি হাসেন মা-মেরি, এবং, বুনেই চলেন তাঁত!

কে এসে খসায় ভগিনী তোমার বসন্তে আঙ্‌রাখা?


সিঁড়িঘর


চেয়েছিলে তীব্র রতি। সিঁড়িঘরে হঠাৎ বিকেলে!
লাল লাল চোখে ঈর্ষা। জ্বলে ওঠে যেন দাবানল;

উটকো লোকের দল। কট্‌মট্‌ কেন যে তাকায়!
তৃতীয় বিশ্বের হ্যাপা! আঁতিপাতি পেছনে কুকুর;

কেউ যদি দেখে ফ্যালে, পায় রতি-কুসুমের ঘ্রাণ?

নির্ঘাৎ ঝামেলা হবে। বিকেলের অপার্থিব আলো
সে-ও ঝানু গুপ্তচর। সঙ্গে নিয়ে বেয়াড়া বাতাস
আল্টপকা ঢুকে যাবে ঘরে। —তাই, আসঙ্গলিপ্সার
মৃত্যু হবে। নারীমাছগুলি ভয়ে ভুলবে সাঁতার

তার চে’ বরং চলো, ভাণ করি মোরা প্লেটোনিক
নিষ্কাম যক্ষের মতো লিবিডো পাহারা দিয়ে চলি;

দ্বীপান্তর? প্রেম-নাস্তি? —চারপাশে এতো যে শ্বাপদ!
এতো যে বন্দুক-চাকু-বল্লমের এতো আয়োজন!

অধর, স্তনের শোভা, লোল হাস্য, মদির ভ্রূকুটি
পুরুষের বগলের ঘ্রাণ, পেশি, চুমুর গোলাপ
রতি-মধুরতা ভুলে অপরের মর্জিমতো বাঁচো

অলক্ষ্যে ও অনাদরে স্তন-ডালিমের বোঁটা ঝরে যাবে;
ফ্যাকাশে ও নীল হবে। অরব মরুভূ শুধু ধু-ধু
মরীচিকাময় এক অতল গহ্বর মেলে র’বে

আমার উত্থান বৃথা! ব্যর্থ রতি! তোমারও করুণ
চোখের লেগুনে ক্রমে কাত হ’য়ে তরী ডুবে যাবে

এইভাবে দিন যাবে। মুখ ভরে জমে উঠবে ছাই ;
ছেঁড়াখোড়া মন নিয়ে এইভাবে অবিরাম হেঁটে
তুমি-আমি একটু-একটু ঝুঁকে পড়বো হাঁ-মুখ কবরে

আমরা অতৃপ্ত আত্মা। আমাদের নীল দীর্ঘশ্বাস
কুকুরের বন্ধ চোখে সারারাত শিশির ঝরাবে


পাহাড়ে বেড়াতে যাবার পর


পাহাড়ে বেড়াতে যাবার পর ক্রমশ তরঙ্গবহুল হয়ে উঠল তোমার গ্রীবা। রজঃস্বলাদের গুরু নিতম্বের ক্রম শিহরণ গাছেদের গায়ে এসে লাগে। আর আমি, ঝুলন্ত ডেউয়াফলের মতো তোমার গরিমাময় কুচযুগের দিকে তাকাই নতুন করে।

আমার লোভের চাহনি, গ্রীষ্মদিনে তপ্ত স্বেদবিন্দুর মতো ক্ষীণ ধারায় গড়িয়ে শুধু নামে।

উপত্যকায় হাজার রাত্রিশেষের রাত্রি আর হাজার দিনশেষের দিনে লোহু-রঙিন জবাফুলের মতো উপহার তুমি। কালচে-সবুজ পাতার আড়ালে বসে তোমাকে জারিত করি চোখের লবণে। তুমি শাদা-শাদা অপার্থিব কাচের মিনার থেকে উঁকি দাও। লহমায় লহমায় তোমার মুখ জ্বলে উঠতে দেখি এই অরণ্য-প্রদোষে।

যখন পাহাড়ে যায় লোক, ভালুকদের কাছ থেকে তাদের ভারী চলনগতি আর যূথবদ্ধতার মন্ত্র শিখে নেওয়া ভালো। এসবের কিছু নমুনা নিয়ে এসেছি। বরফে, বক্ষবন্ধনীর ভেতরে সেসব তুমি বহুদিন যত্নে রেখে দিও।

আর চলো চিরখল, চিরলোভাতুর, চিরকুটিল আর চিরবদমায়েশ শহরে ফিরে না যাই আবার। চলো শীতরাত্রে গোপনে ডিঙি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি সরল অসভ্যতার দিকে। চলো ঘুমের ভেতরে! চলো পরস্পরকে কাঁধে নিয়ে ছুটি আবছা ভোরের কুয়াশায়।

শাদা ফসিলের মতো বৃষ্টিতে ট্যাক্সিরা গর্জন করে ওঠে—শুনি। আর দেখি, হাতের তালুর মতো ঢালু উপত্যকায় ভোর-সন্ধ্যার আভারূপে ক্ষণে-ক্ষণে হেসে ওঠো তুমি; আর, কেঁদে ওঠো ভালুকশিশুর মতো। কেঁদে ওঠো যেন দূর সাইবেরিয়ায়।

সেসব কান্নাকে এখন জড়ো করছি; আর ভাবছি, এঞ্জিন-রব আর খুরধ্বনি থেকে দূরেই রয়েছে তোমার অভিজ্ঞান। তুমি এক লম্বা দৌড়; তুমি পত্রালির ভেতরে সাঁতার—বায়ুবাহিত বেলুনে বেলুনে।

পাহাড় গোপন জলধারা নামায় আর ডাকে তোমায়। আর তাতে শব্দ করে ওঠে রাত্রি; —যেন একাকী তক্ষক। যেন ছল।

এটুকু ছলই একদিন আমাদের জোড়া ঠোঁটের কাছে প্রেম হয়ে আসবে কামের পেয়ালায়। সেখানে রঙিন পাথর থেকে পাথরে, চূড়া থেকে চূড়ায় লালাভ সূর্য আর মেদুর রাত্রির চুপ-সিরাপ ছল্‌কে পড়বে তোমার গুরু নিতম্বে; আর তোমার তরঙ্গবহুল গ্রীবায়, ডেউয়া ফলের মতো ঈষৎ-ঝুলেপড়া তোমার স্তনে আর গ্রানিট পাথরে গড়া নাভিনিম্নদেশে।

শেয়ার করুন

লেখক পরিচিতি

জন্ম ১৯৬২ সালের ২০ জানুয়ারি। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার গড়াডোবা ইউনিয়নের সাখড়া গ্রামে। পিতা মুকদম আলী, মা বেগম নূরজাহান (সরু)। দুজনই প্রয়াত। বন্ধু শিরিন সুলতানা ও পুত্র অর্ক মাজহারের সঙ্গে থাকেন ঢাকায়। পেশা সাংবাদিকতা। কৈশোরে নিরুদ্দেশযাত্রা। দীর্ঘ ভবঘুরে জীবন। যৌবনের একটা বড় অংশ কেটেছে বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ে। বিশেষত হবিগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারে। ঘৃণা করেন বৈষম্য, জাতিবৈর, সকল প্রকারের অন্ধতা। ঘৃণা করেন পৃথিবীকে খণ্ডক্ষুদ্র-করে-দেওয়া সীমান্ত নামের ‘খাটালের বেড়া’। লেখেন মূলত কবিতা। কালেভদ্রে সাহিত্যশিল্প বিষয়ে গদ্যও লেখেন। বিচিত্র বিষয়ে প্রচুর অনুবাদও করেন ইংরেজি থেকে বাংলায় আর বাংলা থেকে ইংরেজিতে।

কবিতাবই: ‘দর্জিঘরে একরাত’, ‘মেগাস্থিনিসের হাসি’, ‘দিওয়ানা জিকির’, ‘নির্বাচিত কবিতা’, ‘রাত্রি ও বাঘিনী’ ও ‘বসন্তরূপক হাসি’।

অনুবাদগ্রন্থ: ‘কবিতার ট্রান্সট্রোমার’ নোবেলজয়ী সুইডিশ কবি টোমাস ট্রান্সট্রোমারের বাছাই করা কবিতার অনুবাদ সংকলন। ‘দূরের হাওয়া’ প্রাচীন কাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ ২০০ কবিতার অনুবাদগ্রন্থ।

পুরস্কার ও সম্মাননা: ১. ‘জীবনানন্দ দাশ কবিতাপুরস্কার ২০১৯’ ২. ভারতের পশ্চিমবঙ্গের (কলকাতার) ঐহিক সাহিত্যগোষ্ঠির ‘ঐহিক মৈত্রী সম্মাননা ২০২০’ ৩. ’নির্বাচিত কবিতা’ বইয়ের জন্য ’বেহুলাবাঙলা বেস্টসেলার বই সম্মাননা ২০১৯' ৪. রাত্রি ও বাঘিনী কাব্যগ্রন্থের জন্য 'শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই-২০২১' সম্মাননা পুরস্কার।

error: আপনার আবেদন গ্রহণযোগ্য নয় ।